মাথা উচু করে বাঁচো
"মন থেকে যাকে প্রিয় বন্ধু মনে করেছিলাম আর সেই এমনটা করতে পারলো?" কথাগুলো বলে মহুয়া টেবিলের উপর মাথাটা দিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। তার কান্না দেখে পাশের চেয়ারে বসা সুমিত কি বলবে ভেবে উঠতে না পেরে সেও চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে রইলো। বহুক্ষণ পরে মহুয়া নিজেকে কিছুটা হালকা করে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- কথাগুলো কাল থেকে কাউকেই বলতে পারিনি রে। এ যে আমার লজ্জা!এসব কথা আমি কাকে জানাবো? আমাদের পরিবারের সব আত্মীয়-স্বজন বর্ষার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা সেই ছোটবেলা থেকেই জানে।যাকেই বলবো না কেন সেই কিন্তু আমাকে দোষ দেবে। কারণ সত্যিই আমি বর্ষাকে নিয়ে সেই ছেলেবেলা থেকেই বড্ড বাড়াবাড়ি করেছি।এত বড় বেইমান বর্ষা আমি ভাবতেই পারিনি।এই বর্ষার জন্য আমি কি না করেছি!বাবা মায়ের সাথে অশান্তি করেছি দিনের পর দিন। তার সাথে বন্ধুত্ব মনে রেখেছি বিয়ের পরেও।তাই নিজের থেকে তার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম বিয়ের পর পরই।যাকে ভালোবেসে তোর ভালোবাসা কে অগ্রাহ্য করে বিয়ে করেছিলাম আমি ভাবতেই পারিনি সেই মানুষটাও একদিন আমার থাকবে না, তাকেও বর্ষা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। আচ্ছা সুমিত মানুষ এত অকৃতজ্ঞ হয় কি করে?
মহুয়ার কথা শুনে সুমিত কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ মহুয়া ও সুমিত দুজনেই চুপ করেই বসে থাকে নীরবতা ভঙ্গ করে সুমিত বলে,
-- পুরো ঘটনাটা শুনে মনেহল এর জন্য তুই কিছুটা দায়ী। কিছুটা বলবো কেন বেশ অনেকটাই দায়ী।একটা কথা কি জানিস?নিজে পুরুষ মানুষ হয়েই বলছি,সব পুরুষেরা কিন্তু একরকম হয় না।কিন্তু অধিকাংশ পুরুষই সুযোগ পেলেই সেই সুযোগে সদ্ব্যবহার করে থাকে।তুই বোকার মত বর্ষাকে, তোর স্বামীকে বিশ্বাস করে দিনের পর দিন বর্ষার হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে থেকেছিস, এটা তোর অন্যায় নয়?
মহুয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,
---আমি ওদের বিশ্বাস করেছিলাম।কিন্তু আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি এই রকম একটা ঘটনা ঘটাবে ওরা।আর সেই মুহূর্তে বাপের বাড়িতে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া আমার কোনো উপায়ও ছিল না।মায়ের বয়স হয়েছে বাবা হাসপাতালে ভর্তি।মা একা একাই হাসপাতালে ছুটাছুটি করছেন।সেই মুহূর্তে আমার মাথায় অন্য কোন চিন্তা ছিল না।
--- তাই বলে পনেরটা দিন ?
স্কুল লাইফ থেকেই বর্ষা আর মহুয়া খুব ভালো বন্ধু। বর্ষার থেকে মহুয়াদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভালো। কিন্তু বর্ষার হাবভাব, চালচলন, কথাবার্তা মহুয়ার বাবা মা মোটেই পছন্দ করতেন না।তাই অনেকবার তারা তাদের মেয়েকে নিষেধ করেছেন বর্ষার সাথে বন্ধুত্ব না রাখতে। কিন্তু মহুয়া বর্ষাকে ভীষণ ভালোবাসতো।আর সেই কারণে সে বাবা-মার এ কথা শোনে না। সে তার বন্ধুত্বটা বর্ষার সাথে রেখেই চলেছে। গ্রাজুয়েশনের পর মহুয়া ভালোবেসে সুভাষকে বিয়ে করে।কলেজ লাইফে সুমিত তাকে প্রপোজ করলে সে তাকে ফিরিয়ে দেয় এবং তাকে জানিয়ে দেয় তাদেরই ক্লাসমেট সুভাষকে ভালোবাসে সে।গ্রাজুয়েশনের মাস ছয়েকের মধ্যেই সুভাষ ব্যাংকে চাকরি পেয়ে যায়। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পর থেকেই সুভাষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল শুধু একটা সরকারি চাকরির।চেষ্টায় সফলতা আসে গ্রাজুয়েশনের ছ'মাস পরে। কিন্তু সুভাষকে জয়েন করতে হয় কলকাতা থেকে বেশ অনেকটাই দূরে সেই বাখরাহাট রুটে বড় কাছারির কাছাকাছি।নিত্য যাতায়াতে দু'ঘণ্টা করে চার ঘন্টা সময় তার চলে যায়। ঝড়-বাদল বা কোন এক্সিডেন্ট যে কোনো কারণ ঘটলেই সেই রুটে বাস থাকে বন্ধ।যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয় ম্যাটাডোর।এবং অনেক সময় তাও পাওয়া যায় না।এই কারণে মহুয়া বুদ্ধি দেয় গ্রাম অঞ্চলে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকার।সুভাষ রাজি হয় এবং তারা ওদিকে চলে যায়।থেকে যায় বর্ষার সাথে ফোনে যোগাযোগ। বর্ষার বাবা মহুয়ার বিয়ের আগেই মারা গেছিলেন।বাবার মৃত্যুর পর সংসারে রোজগারের পথটাও বন্ধ হয়ে যায়।বর্ষা তখন প্রচুর টিউশনি করতো।এইভাবেই মা,মেয়ের সংসার চলতো দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে।কিছুদিনের মধ্যে বর্ষার মা ও চলে যান।এই খবর যখন মহুয়ার কানে যায় তখন সে তাকে বলে তার বাড়িতে একা একা মোটেই ভাল লাগেনা।সুভাষ সেই সকাল বেলায় বেরোয় আর রাতে ফিরে।তাই বর্ষা ইচ্ছা করলে তার কাছে গিয়ে কটা দিন থাকতে পারে।বর্ষা চলে যায় মহুয়ার কাছে। হাসি-ঠাট্টা গল্পগুজবে তিনজনের বেশ ভালোই সময় কাটে।হঠাৎ একদিন মহুয়ার মা মহুয়াকে জানান তার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।তিনি একাই হাসপাতাল বাড়ি ছোটাছুটি করছেন।এই খবর পেয়ে মহুয়া খুবই ভেঙ্গে পড়ে।সে বর্ষার হাতে তার সংসার এবং স্বামীর দায়িত্ব দিয়ে মায়ের কাছে চলে যায়। বাবা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পরে সে তার নিজের বাড়িতে সুভাষ এর কাছে ফিরে আসে।কিন্তু ততদিনে মহুয়া অনেকটাই দেরি করে ফেলেছে।গড়ে উঠেছে সুভাষ ও বর্ষার মধ্যে একটা শারীরিক সম্পর্ক।ভালোবাসা তার ভিতরে আছে কিনা মহুয়া জানেনা কিন্তু একদিন রাতে সুভাষকে পাশে দেখতে না পেয়ে সে বাইরে বেরিয়ে বর্ষার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে দরজায় কান পেতে শোনে চাপাস্বরে বর্ষা ও সুভাষের কথাবার্তা।মহুয়ার তখন আর বুঝতে একটুও বাকি থাকল না বদ্ধ দরজার ভিতরে তখন কি চলছে।চোখ ভরা জল আর বুকভরা অভিমান নিয়ে সে তার নিজের ঘরে চলে আসে।কিছুক্ষণ পরে সুভাষ অতি সন্তর্পনে তার পাশে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালবেলা সুভাষ স্বাভাবিক আবার বর্ষাও ঠিক তাই। সুভাষ অফিসে চলে যাওয়ার পর মহুয়া কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে সুমিতের মুখটাই তার সামনে ভেসে ওঠে।সে সুমিত কে ফোন করে দেখা করতে বলে। সুমিতের সাথে দেখা করার জন্য সেই সুদূর গ্রাম অঞ্চল থেকে মহুয়া পৌঁছে যায় কফি হাউজে।তখন দুপুর।সুমিতের সাথে ফেসবুকের মাধ্যমে পুনরায় বন্ধুত্বটা হওয়ায় মাঝে মধ্যে কথাবার্তাও হত মামুলি।
--- এখন তুই কি করবি এইটা জানতে চাইছিস তো?আমি তোকে বলবো মাথা উঁচু করে বাঁচ।পৃথিবীতে সুন্দর ভাবে বাঁচার জন্য বিয়েটাই একমাত্র শেষ কথা নয়।নিজেকে তৈরি কর।নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত কর। ছেড়ে দে সবকিছু যা তুই পিছনে ফেলে এসেছিস। আজ এই মুহূর্ত থেকে তুই ভুলে যা যে তোর বিয়ে হয়েছিল।সুভাষকে তুই ভালবাসতিস। যে ভালবাসার মধ্যে বিশ্বাস নেই সেটা আর যাই হোক ভালোবাসা হতে পারে না রে!আমি তোকে বলবো সুভাষের কাছে আর তুই ফিরে যাস না।কিন্তু এ কথা ভাবিস না যে তোকে আমি ভালোবাসি বলে তোকে সুভাষ এর কাছে ফিরে যেতে নিষেধ করছি।আমি তোর বন্ধু ছিলাম, আছি, থাকবো। আমার দরজা তোর জন্য সারা জীবন খোলা থাকবে। কখনো যদি তুই খুব ক্লান্ত হয়ে পরিস তখন না হয় আসিস আমার কাছে কিংবা আমায় ডাকিস।এই আজকের মত দুদণ্ড বসে নিজেদের সুখ দুখের কথা বলে জীবনের মানেটা খুঁজব। কিন্তু আগে নিজের পায়ে দাঁড়া।শুরু কর আবার পড়াশুনা। হায়ার এডুকেশনটা নে। যেভাবেই হোক যে কোন একটা চাকরি খুঁজে নে।সুভাষকে দেখিয়ে দে যে সুভাষের অবহেলা তোকে কোন উচ্চস্তরে নিয়ে গেছে;তুই ভেঙ্গে পরিসনি।হেরে গেছে সুভাষ তোর ভালোবাসা হারিয়ে আর তুই জিতে গেছিস নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে।তুই বর্ষাকে বুঝিয়ে দে বর্ষার এই বেঈমানির জন্য সাময়িক কিছু হারালেও নিজেকে খুঁজে বের করতে পেরেছিস। ভালোভাবে বাঁচ,মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চল।আমাদের বন্ধুত্বটা আজীবন থাকবে।
No comments:
Post a Comment