Monday, June 28, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৪০)

সুখের ঘরে আগুন (৪০)

   সেদিন রাতে নিখিলেশ নিলয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে যাওয়ার পথে অচলার সাথে ধাক্কা খায়।অচলা গিয়ে দেওয়ালের উপর পড়ে। শশব্যস্ত নিখিলেশ ঠিক যেন অন্যমনষ্ক ভাবে এগিয়ে গিয়ে অচলাকে ধরে জানতে চায় তা কতটা ব্যথা লেগেছে।অচলা তখন কিছুটা বিব্রত বোধ করে বলে,
--- না না ঠিক আছে এমন কিছু লাগেনি।
 কিন্তু অচলার কপালটা সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক ফুলে যায়।এদিকে তখন নিলয় দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অম্বিকার সাথে ফোনে কথা বলছিল।অচলা এবং নিখিলেশের কথাবার্তা শুনে কি ঘটেছে কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে জানতে চায় সে কি হয়েছে?ওদের দিকে তাকাতেই অচলার কপালে ফোলা অংশ দেখে বলে ওঠে,
--- এত রাত্রে কোথায় গিয়ে ধাক্কা খেলি? যে এত ফুলে গেলো?
  অচলা নিখিলেশের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে,
--- অন্ধকারে দেখতে পাইনি দাদা।একটু লেগে কপালটা  ফুলে গেল। ও কিছু হবে না।এখনই ঠিক হয়ে যাবে।নিখিলেশ তখন কি করবে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললো,
--- নিলয় একটু বরফ এনে লাগিয়ে দে, তাতেও কিছুটা আরাম পাবে।
অচলা বলে উঠলো, 
--ওইসব বড়লোকদের ব্যাপারস্যাপার।ওসব আমাদের লাগেনা।এমনিতেই সকালে ঠিক হয়ে যাবে।
-- পাকামো একটু কম কর অচলা।অনেকটা ফুলে গেছে। যদি ব্যথা হয় রাতে একটা পেইনকিলার খেয়ে নিস আর এখন চল বরফটা বের করে দি।ফোলা যায়গাটায় চেপেচেপে দিয়ে দে।তাতে ব্যথা আর ফোলা দুইই কমবে।
তারপর বেশ রাগান্বিত স্বরেই বলল, 
--তোকে আমি বলেছি না তুই ভুলে যা আগে কি ছিলি।এখন তুই এ বাড়ির মেয়ে।আমার বোন।
--- তুমি যে কি বল না দাদা!পুরনো সবকিছু ভুলে গেলে মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ হয়ে যায় যে!আমি কি ছিলাম আর এখন কেমন আছি এই দুইয়ের পার্থক্য তখনই করতে পারবো যখন পুরনোর সাথে এখনকার আমির মিল খুঁজব।কিচ্ছু হবে না এরকম অনেক কাটা ফোলা জীবনে হয়েছে কেউ কোনদিনও কোন পাত্তাই দেয়নি।আবার অনেকে মেরে ফুলিয়ে দিয়েছে।চোখের জলে সব কষ্ট ধুয়ে মুছে গেছে।আমাকে নিয়ে এত ভেবোনা ও একসময় ঠিক হয়ে যাবে।আমাদের সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েই ঈশ্বর পৃথিবীতে পাঠান।
  নিলয় এবং নিখিলেশ দুজনেই অচলার কথা শুনে খুব কষ্ট পেলো।সত্যিই মেয়েটা তার জন্মের পর থেকে ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছে। দু'জন দু'জনের মুখের দিকে তাকালো কিন্তু আর কেউ কোন কথা না বলে ড্রইং রুমে গিয়ে ঢুকলো। নিলয় এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে কিছুটা বরফ এনে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে অচলার হাতে দিয়ে বলল,
---এই নে রুমালে করে বরফ নিয়ে ফোলা যায়গাটায় একটু চেপে ধরে থাক কিছুক্ষণ। কিছু সামান্য পরে ব্যথা ফোলা দুটোই কমে যাবে।
--- তুমি রুমালটা রাখো।আমি আমার গামছাটা নিয়ে আসছি।
 নিলয়ের উত্তর দেওয়ার অপেক্ষা না করে অচলা তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
নিখিলেশ তখন নিজেকে খুব অপরাধী এবং অসহায় মনে করছে।অপরাধী মনে করছে নিজেকে এই কারণে যে তার জন্য অচলার এই আঘাত পাওয়া আর অসহায় মনে করছে এই মুহূর্তে নিখিলেশের অনেক কিছু ইচ্ছা থাকলেও অচলার উপরে কোনটাই সে এপ্লাই করতে পারছে না। নিলয় একমনে চেয়ারে বসে বকবক করেই চলেছে।নিখিলেশ মাঝেমধ্যে আড় চোখে অচলার দিকে দেখছে সে কিভাবে গামছার ভিতর বরফ নিয়ে একমনে ফোলা জায়গাটায় চেপে ধরে বসে আছে।নিলয় খেয়াল না করলেও নজর এড়ায় না অচলার।তার বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা ধুকপুকানি অনুভব করতে থাকে সে।যা আগে কোনদিনও তার হয়নি।কিন্তু সে তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে এতটাই ওয়াকিবহাল যে তখন সে তার কপালে আঘাত পাওয়া নিয়ে যে কথাগুলো বলেছে তা একমাত্র নিখিলেশকে বুঝিয়ে দেওয়া যে সে তার উপযুক্ত নয়।সে অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা।বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর তার মোটেই ইচ্ছা নেই।আর ওদিকে নিলয় কথা বলেই চলেছে।নিখিলেশ নিলয়ের কথাগুলো কানে নিলেও মাথায় নিতে পারছে না কারণ তখন সে অচলার এই আঘাত পাওয়া নিয়ে সত্যিই নিজেকে দায়ী মনে করছে।ভালোবাসার পাত্রী যখন নিজের কারণে আঘাত পায় তখন সে আঘাত যেন দ্বিগুণ হয়ে অপরের বুকে বাজে।আর তখনি প্রতিটা মানুষেরই কষ্টটা যেমন বেশি হয় ঠিক তেমনই সে নিজেকে নিজেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
 নিলয়ের বাবা মা রাত অনেক হওয়াতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ তারা ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়েই বসে থাকার পর সেখান থেকে উঠে অচলা নিলয়কে বলে নিজের ঘরে চলে আসে।আসবার সময় নিলয় তাকে বারবার বলে দেয় আজ রাতে আর বইপত্তর নিয়ে তাকে রাত জাগতে হবে না।সে যেন শুয়ে পড়ে। কাল ভোরে উঠেই যেন সে পড়তে বসে কারণ অচলার পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই।
  পরদিন সকালবেলা মলিনাদেবী  জানতে পারেন গতকাল রাতে দেওয়ালে ধাক্কা লেগে অচলার কপাল ফুলে যায়। নিজের থেকে সে কথা মাকে বলতে অবশ্য চায়নি।অচলার কপাল ভোলা দেখে তিনি বারবার তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে এ কথাই জানিয়েছে।সে নিলয় বা বাড়ির কাউকেই বলে না যে নিখিলেশের সাথে ধাক্কা লেগে সে দেওয়ালের উপর গিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন যে সত্যি কথাটা সবাইকে বলতে পারেনি তা সে নিজেও বুঝতে পারে না।অনেক ভেবেছে সে কিন্তু তারপরেও কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর সে পায়নি।একটা সাধারণ কারণে কেন মিথ্যা কথা বলতে গেল একথা তার মাথায় কিছুতেই আসছে না।সে তো নিলয় বা তার বাবা-মার কাছে আসা অব্দি থেকে কোন কথা গোপন করেনি।তবে আজ কেন নিখিলেশের সাথে সামান্য ধাক্কা খাওয়ার কথাটা সে বলতে পারল না?তেইশ বছরের তম্বি অচলা যে কিনা দেখতে শুনতে মন্দ নয়;সে যে নানান ঘাটের জল খেয়ে এই প্রথম কোন পুরুষের মুখের দিকে তাকাতে গেলে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে আর নিজেও দেখেছে নিখিলেশের চোখে তারজন্য ভালোবাসা।কিন্তু নিখিলেশের সাথে তার সম্পর্কে কোন কথা চিন্তা করা মানে বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো!তা সে যেমন করবে না ঠিক তেমনি নিলয় বা তার পরিবারের কোন সম্মানহানি হয় সে কাজ কখনোই করতে পারবে না।তাই সে নিজের মনকে নিজেই শক্ত করে বাঁধে।
 সেদিন রাতে নিখিলেশ ও নিলয় তাদের কর্মস্থল ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।অচলা পারতপক্ষে সেদিন সকাল থেকে আর নিখিলেশের সামনে আসেনি।কিন্তু নিখিলেশ অচলা কেমন আছে জানার জন্য উসকুস করলেও সাহস করে কারো কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি।শুধু মলিনাদেবির মুখে শুনেছে তার কপাল ফোলাটা মারত্মকভাবে রয়েছে।তিনি সকাল বেলা টেবিলে অচলার করে দেওয়া টিফিন গুছাতে গুছাতে নিজের মনেই কথাগুলো বলে চলেছিলেন।সারাটাদিন অচলার সাথে নিখিলেশের আর দেখা হয়নি।শুধু সন্ধ্যায় বেরোনোর সময়  অচলা এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে।
   নিলয় অম্বিকার বিয়ের ডেট এগিয়ে আসতে থাকে।অচলার পরীক্ষাও শেষ।অচলার এখন সময় কাটে সংসারের কাজকর্ম করেই।দাদার বিয়ের জন্য ঘরদোর পরিস্কার করা নিয়ে রোজই সে ব্যস্ত।বাবা,মা তাকে বারবার বলেছেন কাজগুলি লোক দিয়ে করিয়ে নেবেন।কিন্তু অচলা সে কথার কোন পাত্তাই দেয়নি। নিলয় তাকে কথা দিয়েছে যদি সে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করে তবে তাকে সে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দেবে।কারণ একাদশ শ্রেণিতে তাকে বাইরে যাতায়াত করতে হবে।তার কাছে একটা ফোন থাকা ভীষণ দরকার। আর তাছাড়া বাবা মায়ের বয়স হয়েছে ল্যান্ডফোন বাজতে লাগলে বাবা-মা অনেক সময় অলসতা বশত উঠে ফোন ধরেন না বা কখনো তারা তাদের ঘর থেকে আসতে আসতেই রিংটা কেটে যায়।অচলা যদি এদিক-ওদিক থাকে তাহলে তাদের খবর নিতে নিলয়কে ফোন করতে হয় এখন অম্বিকার কাছে। কিন্তু অম্বিকা তো চাকরি করে।তাছাড়া নানান প্রয়োজনে এদিক ওদিকে ঘোরাফেরা করে,তাই তার পক্ষে সব সময় তার বাবা-মায়ের খবর রাখা সম্ভব নয়।অথচ তারা কেউই মোবাইল ফোন ইউজ করতে পারেন না।তাই সে ঠিক করে অচলাকে একটা ফোন কিনে দেবে।সেটা সে অচলাকে অবশ্য বলে ফার্স্ট ডিভিশন পেলেই তোকে আমি ফোন দেবো নইলে নয়।
  সময়ের সাথে সাথে দিনগুলো এগিয়ে যেতে থাকে।এগিয়ে আসে নিলয়ের বিয়ের দিন।বিয়ের দিন সাতেক আগে থাকতে নিলয় বাড়িতে চলে আসে।নিখিলেশ বিয়ের দু'দিন আগে আসবে কথা হয়।সামান্য কিছু আত্মীয়-স্বজন নিলয়দের তারাও চলে আসেন।অচলার দম ফেলার ফুরসত নেই।সব সময় সে কাজ করে চলেছে।সে যেন প্রতিজ্ঞা করে আছে মাকে সে কোন অবস্থাতেই কোন কাজ করতে দেবে না। মলিনাদেবী কোন কাজ করতে গেলেই সে দৌড়ে গিয়ে  তার হাত থেকে কাজটা ছিনিয়ে নেয়।মাঝে মাঝে মলিনাদেবী খুব ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেন।কিন্তু তার চিৎকার শুনে ওর রাগের থেকে হাসি পায় বেশি।হাসতেই থাকে আর তা দেখে মলিনাদেবী বকবক করতে করতে সে কাজ ফেলে দিয়ে ঘরে গিয়ে গোমড়ামুখো হয়ে বসে থাকেন।আর নরেশবাবু তাকে দেখেই বুঝতে পারেন আবার একসাথে কাজ করা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। এই ব্যাপারগুলি তিনি খুব উপভোগ করেন।এতদিন পরে একটা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে বাড়িতে এসে তাদের সবাইকে এত আপন করে নিয়েছে এটা ভাবলেও আনন্দে বুকটা ভরে যায়। দুজনেই বলাবলি করেন নিলয়টা বদলি হয়ে যাওয়ার পরে বাড়িটাই কোন প্রাণ ছিল না।অচলা আসাতে বাড়ির পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেছে।এই রাগারাগির কিছুক্ষণ পরেই আবার মলিনাদেবী  উঠে কর্মরত অচলার পাশে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে বসেন।তারপর নিজের থেকেই মেয়েটির সাথে বকবক করতে থাকেন।আর এটা অচলা ভালোভাবেই জানে বলে মলিনাদেবীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে সে একদমই পাত্তা দেয় না।তিনি যখন অচলার কাছে গিয়ে বসেন অচলা মুখ টিপে টিপে হাসে আর বলে,
--- তোমার রাগ পড়ে গেলো মা?যে কাজগুলো আমি করতে পারবো না সেগুলো তো তোমাকে করতেই হবে মা।যারা এসেছেন দাদার বিয়ে উপলক্ষ্যে তারা কেউই সে রকম কাজের নয়।সবাই তো বসে শুয়েই দিন কাটাচ্ছেন দেখছি।
 মলিনাদেবী একথা শুনে চোখ বড় বড় করে এদিকওদিক তাকিয়ে নিজের মুখে নিজেই আঙ্গুল দিয়ে আস্তে কথা বলতে বলেন অচলাকে।আবার কেউ শুনে ফেললে বিয়েবাড়িতে ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে।কারণ তিনি তার আত্মীয়স্বজনকে ভালোভাবেই চেনেন।বিয়ের দিন প্রমিতা আসলে সে তার দাদার বিয়ের কাজে হাত লাগাবে।কিন্তু তার ছেলেটি যা দুরন্ত ।তাকে সামলাতেই সে হিমশিম খায়।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment