Tuesday, June 1, 2021

অসহায় আজ সবাই

অসহায় আজ সবাই

 "মেয়েটার সমস্ত ভাবনা জুড়ে ওই ছেলেটার আনাগোনা"-কথাগুলো বলে হৃদয়নাথ একটু থামলেন।তিনি মুখ নিচু করেই বন্ধু অখিলেশের সাথে কথা বলছিলেন। এবার তিনি মুখটা তুলে বন্ধুর দিকে যখন তাকালেন অখিলেশ দেখতে পেলেন হৃদয়নাথের চোখ দুটি জলে ভর্তি। সেই কোন স্কুল লাইফ থেকে হৃদয়নাথ ও অখিলেশ হরিহর আত্মা দুই বন্ধু। স্কুল, কলেজ লাইফ শেষ করে ঘটনাক্রমে তারা একই প্রফেশনে চাকরি পেয়ে গেলেন।কিন্তু জায়গাটা একটু ভিন্ন হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই দুই বন্ধু একই স্কুলে  চলে আসেন।তারপর রিটায়ার করার পূর্ব পর্যন্ত তারা একই স্কুলে থাকেন।দুজনের রিটায়ারমেন্ট এর ব্যবধান আট মাসের।বাড়ি একই পাড়ায়।ছেলেবেলা থেকে হৃদয়নাথ যে নরম মনের মানুষ একথা অখিলেশ জানতেন।সংসার বা নিজের জীবনের যেকোনো রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তিনি তার বন্ধু  অখিলেশের কাছে সুপরামর্শের জন্য ছুটে এসেছেন। আর অখিলেশ তাকে নানান ভাবে নানান কাজে পরামর্শ দিয়ে সঠিক পথের সন্ধান যুগিয়েছেন। কেউ বিপদে পড়লে বা রাস্তাঘাটে কেউ অসহায় হয়ে পড়লে,অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তখনই তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 
   সেদিন গিন্নির সাথে একটা বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ সেরে তিনি ও গিন্নি যখন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা বাস বা ট্যাক্সির আশায় তখন তিনি দেখতে পান চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে বাসস্ট্যান্ডে এক কোণে একটি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্বভাবসুলভ কৌতূহলবশত তিনি মেয়েটির দিকে এগিয়ে যান। এবং তার কাছে জানতে চান এত রাতে একাকী সে কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছে?মেয়েটি প্রথমে হৃদয়নাথের সাথে কথা বলতে ইতস্তত করলেও পরে সমস্ত ঘটনা সে পুঙ্খানুপুঙ্খ হৃদয়নাথকে জানায়।
 অখিলেশবাবু সব শুনে বললেন,
--- তাহলে এখন কি করা যায় মেয়েটিকে নিয়ে?এই মুহূর্তে এত বড় আঘাত ও মেনে নিতে পারবে না।কটা দিন যেতে দে।তারপর ধীরে সুস্থে মেয়েটিকে সব জানানো যাবে।
--- কিন্তু এত বড় শোক ও কি সহ্য করতে পারবে।
--- দেখা যাক।তবে মেয়েটিকে তুই আর বৌঠান মিলে একটু চোখে চোখে রাখিস কোন অঘটন ঘটিয়ে না ফেলে।
--- এই ভয়টা আমারও করছে রে!
  বাপ,মা হারানো সুচরিতা দূরসম্পর্কের এক কাকার বাড়িতে মানুষ।কাকিমার কোন সন্তান না থাকায় মায়ের অভাব সে বুঝতে না পারলেও লোভী কাকা তার খাওয়াপরার যাবতীয় খরচ উসুল করতেই কাকিমার মৃত্যুর দ্বিতীয় দিনেই তাকে বিক্রির ব্যবস্থা করে ফেলেন।কপাল ভালো তাই ভেজানো দরজার বাইরে থেকে কাকা ও অপরিচিত একজনের সমস্ত কথা তার কানে আসে।সুচরিতা ভালোবাসতো পাড়ার মুদিখানার দোকানের মালিক সুনীলকে।মাকে নিয়ে সুনীল দোকান থেকে বেশ খানিকটা দূরেই বাস করতো।কাকিমা থাকতেই সুনীলের সাথে তার বিয়েটা দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।কিন্তু দেশের এই চরম ভয়াবহতার দিনে সুনীলের মা হঠাৎ করেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।সুনীল একা বাড়ি।এই অবস্থায় একটা যুবতী মেয়েকে ঘরে এনে সে আশ্রয় দিতে পারে না।তাই ভেবেছিলো আশৌচ পালন না হওয়া পর্যন্ত তার কোন আত্মীয়ের বাসায় তাকে রেখে দেবে।সুনীল সুচরিতাকে সাথে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে কাকার বাড়ি থেকে একবারেই বেরিয়ে আসতে বলে।সুচরিতা আসেও তাই।কিন্তু সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা অবধি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকেও সুনীলের দেখা পায় না।সেখানে পরিচয় হয় হৃদয়নাথবাবুর সাথে।
 সুচরিতার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তিনি যখন সুনীলের বাড়ি পৌঁছলেন তখন পাড়ার লোক মারফত জানতে পারলেন প্রশাসনের মাধ্যমে মায়ের সৎকার হলেও সেদিন রাত থেকেই সে জ্বরে বেহুস ছিল। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দুদিনের মাথায় এতটাই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিলো বেশিদিন আর মাকে ছেড়ে থাকতে হয়নি।এই খবর নিয়ে হৃদয়নাথবাবু ফিরে আসলেও সে খবর তিনি সুচরিতাকে দিতে পারেননি তিনি বাইরে থেকে ফিরে আসার পর সুচরিতার সুনীলের খবর জানার  আগ্রহ দেখে।কিন্তু কতদিন তিনি মেয়েটির কাছ থেকে এই দুঃসংবাদটি লুকিয়ে রাখবেন?পৃথিবী ব্যাপী যে ভয়াবহতা শুরু হয়েছে তাতে যে কত মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে কখনো বা পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে --- এর শেষ কোথায়? আস্তে আস্তে সবকিছুই তো স্বাভাবিক হচ্ছিল ।গাড়ি,বাস সবই চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ করেই ভয়াবহতা বেড়ে গেলো।মেয়েটির যে সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে সুনীল রয়েছে।কিভাবে মেয়েটিকে তিনি মানসিকভাবে সাপোর্ট দেবেন এটাই সর্বক্ষণের চিন্তা তার এখন।

No comments:

Post a Comment