সুখের ঘরে আগুন (৩৯)
এর ঠিক দুমাস পরেই নিলয় আর নিখিলেশ ঝটিকা সফরের মত হঠাৎ করেই কলকাতা এসে হাজির দুদিনের জন্য।শনিবার কোন একটা কারণে ছুটি থাকায় তারা শুক্রবারে রাতের ট্রেন ধরে শনিবার এসে পৌঁছায়।বাবা,মাকে এবার সে অম্বিকার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে বলে।চারজন গার্জিয়ানের মিটিং বসে অম্বিকাদের বাড়িতে।কথাবার্তা এগোতে থাকে। ছ'মাস পরে বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়।একটু দেরিতেই তারা ডেটটা ফাইনাল করেন কারণ নিলয়ের ছুটির সমস্যা।বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয় দু'বাড়িতেই ।অনেকদিন পর নিলয়ের বাবা,মা যেন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছেন।অচলা তো ভীষণই খুশি।মাঝে মধ্যেই অচলাকে নিয়ে টুকটাক কেনাকাটা করতে বেরোচ্ছে অম্বিকা।আর সাথে থাকছে নিশিতা।
অচলা তার পড়াশুনা নিয়ে বেশ ব্যস্তই থাকে।তার মধ্যেও সে মাকে কোনরকম কাজ করতে দেয় না।নিজেই একার হাতে সংসারের কাজ করেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে।বিয়ের তারিখ আসার আগেই তার মাধ্যমিক দেওয়া হয়ে যাবে।তার একার উপর চাপ পড়ে যাচ্ছে,পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে মনেকরে নিলয় মাকে বলে একজন কাজের মহিলা রেখে দিয়েছে।এখন অচলা শুধু রান্নাটাই করে।মাকে সে রান্নাঘরে কিছুতেই ঢুকতে দেয় না।
এরই মাঝে হঠাৎ করেই একদিন নরেশবাবুর রাতের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।কথা বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে যান আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর তার লোহার মত শক্ত হয়ে পড়ে।মলিনাদেবী চিৎকার করে অচলাকে ডাকেন।অচলা দৌড়ে এসে ওই অবস্থা দেখে কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।কিন্তু একটু পরেই দৌড়ে গিয়ে ডাইরি বের করে অম্বিকাকে ফোন করে।অম্বিকা ফোন পেয়ে নরেশবাবুর শারীরিক অবস্থা শুনে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে ছুঁটতে ছুঁটতে নিলয়দের বাড়িতে এসে হাজির হয়। ছ'ফুটের উপর লম্বা মানুষটাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই চালক ও হেলপার দুটো মানুষ হিমশিম খেয়ে যায়।কোনরকমে অম্বিকা আর অচলা গাড়ির ভিতর গিয়ে বসে। পাড়ার দুটি ছেলে বাইকে রওনা দেয়।মলিনাদেবীকে অনেক বুঝিয়ে পাড়ার লোকের হেফাজতে রেখে তারা নরেশবাবুকে নিয়ে নার্সিংহোম পৌঁছে যায়। ডক্টরসদের তৎপরতায় একটা ইনজেকশনেই তার জ্ঞান ফিরে আসে।তারা জানান হঠাৎ করে শরীরে সোডিয়াম পটাশিয়াম এর মাত্রা কমে যাওয়ার ফলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন এবং পুরো বডি শক্ত হয়ে গেছিল।সবাই খুবই ভয় পেয়ে গেছিলো।জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই অম্বিকা ফোন করে মলিনাদেবীকে জানিয়ে দেয়।কিন্তু এত রাত্রে সেই মুহূর্তে নিলয়কে কিছু জানাতে নিষেধ করে দেন তিনি। তিন দিনের মতো নরেশবাবুকে নার্সিংহোমে থাকতে হয়।অচলা ও অম্বিকা ভোর রাতে বাড়ি ফেরে।মলিনাদেবী ওরা না ফেরা অবধি বারান্দাতেই বসে ছিলেন।ওদের উবের থেকে নামতে দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি গেটের তালা খুলেই কাঁদতে শুরু করেন। ওরা দুজনে মিলে তাকে আশ্বস্ত করে নরেশবাবু ভালো আছেন বলে।ভোরের আলো ফুটলে অম্বিকা বাড়ি চলে যায় আর যাওয়ার সময় অচলাকে বলে যায় দশটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকতে সে বাড়ি থেকে ফ্রেস হয়ে এসে আবার তাকে নিয়ে নার্সিংহোম যাবে।
ঠিক দশটা নাগাদ অম্বিকা নিলয়দের বাড়িতে এসে দেখে অচলা ও মলিনাদেবী দুজনেই সেজেগুজে রেডি বেরোনোর জন্য।অম্বিকা এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে অচলা তাকে বলল,
--- দেখো না দিদি মা কিছুতেই শুনবেন না।মা বাবাকে দেখতে যাবেনই। আমিও ভাবলাম বাবা যখন ভালই আছেন তখন মা একবার দেখে আসলেই ভালো হবে। তাহলে মায়ের মনটাও ভালো লাগবে।
--- হ্যাঁ ঠিকই করেছিস।মাসিমা, আপনাকে নিয়েই যাবো। আমিও মনেমনে ভাবছিলাম এখানে এসে আপনাকে বলবো আমাদের সাথে যাওয়ার কথা।এখন কোনোই সমস্যা নেই।এখন খুবই ভাল আছেন। কথাবার্তাও বলেছেন ভোরের দিকে আমাদের সাথে।তবে ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন কোন অবস্থাতেই ভাজাপোড়া খাওয়া চলবে না। যেসব জিনিসে উনার গ্যাসের সমস্যা হয় সে সব খাবার একেবারে বন্ধ।
পরদিন হাসপাতালে যেতে যেতেই উবের এর ভিতরেই অম্বিকা, মলিনাদেবীর পরামর্শ নিয়েই নিলয়কে সবকিছু জানায় এবং একথাও বলে বর্তমানে সে সামলে নেবে কোন অসুবিধা নেই এই মুহূর্তে।এখন এখানে আসতে হবে না। তাছাড়া অচলা এখন বাইরে দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি, বাসে ওঠা সবকিছুই করতে পারে। যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে হওয়ায় ডাক্তারের সাথে কথাবার্তা বলাতেও বেশ পারদর্শী।সুতরাং নিলয় যেন কোনো অবস্থাতেই কিছু চিন্তা না করে। নিলয় কথাপ্রসঙ্গে টাকা পয়সার কথা বললে অম্বিকা তাকে বলে আপাতত এই দিকটা সে সামলে নিতে পারবে।সে ক্ষমতাটুকু তার আছে। কিন্তু নিলয় তার কথাতে কোন পাত্তা না দিয়ে খবরটা শোনার সাথে সাথেই তার অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা ট্রানস্ফার করে দেয়।এর ফলে অম্বিকার ভিতরে একটা অভিমান দানা বেঁধে ওঠে।কিন্তু সে মুখে কিছু বলে না; নিজেকে নিরস্ত করে।তার কারণ সন্তান হিসেবে প্রত্যেকের কাছে এটাই স্বাভাবিক।ফিজিক্যালি সে ছুটোছুটি করছে ঠিকই কিন্তু ইকনোমিক্যালি নিলয়ের সমস্ত দায়িত্ব এই সময়ে।এই অর্থের ব্যাপারে নিলয় অম্বিকার উপরে নির্ভর করতে না পারাটাই স্বাভাবিক।প্রথম অবস্থায় এই ব্যাপারে কিছুটা অভিমান হলেও পরে অম্বিকা নিজে চিন্তা করে দেখেছে দায়িত্ববান ছেলে হিসেবে বাবা মায়ের প্রতি দুশ্চিন্তার থেকেই সে এ কাজ করেছে।সশরীরে হাজির থাকতে না পারলেও তার বাবার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অর্থের অভাব যাতে না হয় সে ব্যবস্থা সে সঙ্গে সঙ্গেই করেছে।
অম্বিকা যখন নিলয়কে ফোন করেছিলো নিলয় তখন অফিসের পথে।সে অফিসে ঢুকেই তার বসের কাছে গিয়ে বাবার শারীরিক অবস্থার কথা জানায় এবং বার বার তাকে বলে যে সে ছাড়া তার বাবা-মায়ের আর কেউ নেই।কম করে তাকে চার দিন ছুটির ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।তার ছুটি মঞ্জুর হয়।নিখিলেশের সাথে দেখা করে সে সবকিছু তাকে জানায়। নিখিলেশও তার সাথে যেতে চায়।কিন্তু সে ছুটি পায় না কারণ দুজনেই একই ডিপার্টমেন্টে আছে।একসাথে ছুটি নিলে খুব সমস্যা হয়। এমতাবস্তায় নিলয় ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে।ট্রেন বদলে বদলে সে রাতেই দিকেই পৌঁছে যায় সেদিনই নার্সিংহোমে।অম্বিকা আর অচলা তখনো নার্সিংহোমে।ভিজিটিং আওয়ার শেষে বাইরে বেরিয়ে একটু চা খেয়ে তারা যখন বাসের অপেক্ষায় ঠিক তখনই উসখোখুস্কো চুলে উদভ্রান্তের মত নিলয় উবের থেকে নামে।তাকে দেখতে পেয়ে ওরা দুজনেই হতভম্ব!নিলয় ওদের দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে জানতে চাইলো,
--- বাবা এখন কেমন আছেন?
--- ভালো আছেন সেতো তোমাকে সকালেই জানালাম।তোমার সাথে তো আরও কয়েকবার কথা হল ফোনে।সারাদিনে।একবারও তো বলোনি তুমি আসছো ---।
--- ইচ্ছা করেই বলিনি।বললেই আবার আমায় নিয়ে তোমরা টেনশন করতে।তোমরা একটু দাঁড়াও আমি ভিতরে গিয়ে দেখি বাবার সাথে একটু দেখা করতে পারি কিনা।
অচলা তখন বলে ওঠে,
--- ভিজিটিং আওয়ার তো শেষ।চলো আমরাও যাই তোমার সাথে।
তিনজনে আবার এগিয়ে গেলো।অনেক কাকুতি মিনতির পর মিনিট পাঁচেকের সময় বরাদ্দ হল নিলয়ের বাবার সাথে দেখা করবার জন্য।নরেশবাবু চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন।নিলয় গিয়ে মাথায় হাত দিতেই চোখ খুলে ছেলেকে দেখে মুখে হাসি নিয়ে বললেন,
--- আমি এখন ভালো আছি রে।এত পরিশ্রম করে কেন আসতে গেলি?তবে তোকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে বাবা।মেয়ে দুটো কাল থেকেই ছুটাছুটি করছে।তোকে দেখে তোর মা ও অনেকটা মনের বল পাবে।যা এবার বাড়ি যা।ওদের সাথে তোর দেখা হয়েছে?
নিলয় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।
"তাহলে একসাথে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নে।ভালো আছি এখন একদম চিন্তা করিস না।যা বেরিয়ে পড়।সকালে আসিস আবার।"
নার্স এসেও বেরিয়ে যাওযার জন্য নিলয়কে তাগাদা দিলেন।নিলয় বাবাকে ' আসছি ' বলে ওদের নিয়ে উবের ধরে বাড়ির পথে রওনা দিলো।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment