Tuesday, June 29, 2021

ভালোবাসার আঘাত

ভালোবাসার আঘাত

"আমি অনেক কিছু করলে, অনেকেরই পসার থাকতো না তাই আমি কিছুই করিনি ---"ছমাসের দাম্পত্য জীবনে শ্রেষ্ঠা আজ অফিস থেকে বেরিয়ে ঠিকই করে এসেছিল বাড়িতে এসে সুদীপের সাথে একটা হেস্তনেস্ত সে করবে।বিয়ের দুমাসের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে "ভালো চাকরি খুঁজে নেবো" এ কথা গত চারমাস ধরে শুনতে শুনতে শ্রেষ্ঠা আজ সত্যিই ক্লান্ত। অফিস আর বাড়িতে উদয়াস্ত পরিশ্রম,ঘরে বেকার স্বামীর সব সময় মোবাইল নিয়ে খাটের উপর শুয়ে খুট খুট করা সে আর মেনে নিতে পারছিল না।বাড়িতে ফিরে দুকাপ চা করে স্বামীর পাশে গিয়ে বসে।
--- কি গো কাল তোমাকে যে অফিসটায় দেখা করতে বলেছিলাম সেখানে কি বললো?
 অলসতা কাটিয়ে উঠে বসে মাথার বালিশটা দুপায়ের উপর রেখে চা খেতে খেতে সুদীপ বলে,
--- ও তোমার সুখেন্দুদা যে খবরটা দিয়েছিলো?না,আমি সেখানে যাইনি।আমি আমার এক বন্ধুর কাছে খবর নিয়ে জানলাম কোম্পানির মালিক কর্মচারীদের মাইনেটাই ঠিকভাবে দেয় না।
--- তা কার কাছে এত বিশাল খবরটা পেলে?
 আড় চোখে শ্রেষ্ঠাকে একবার দেখে নিয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুদীপ বলে,
--- ও তুমি চিনবে না আমার এক বন্ধু।ওই কোম্পানিতেই চাকরি করে।সেই বলছিলো।
--- তোমার বন্ধুর নাম কি?
--- তারমানে?তুমি কি আমায় জেরা করছ নাকি? তুমি  আমার সব বন্ধুদের চেনো নাকি?
--- জেরা করবো কেন? আমি তো জানতে চাইছি আর আজকেই সেই বন্ধু ফোন করেছিল?বন্ধুর নামটা একটু বল।
--- তোমার কি মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি?
---আরে তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন?রেগে যাওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।আসলে তুমি কাজ করে খেতে চাও না।আমার চাকরি দেখে আমার সাথে প্রেম করে নিজের দুঃখের কথা জানিয়ে আমাকে কনভিন্সড করে বিয়ে করেছিলে।আর আমিও সরল মনে তোমার কথা আর তোমার ভালোবাসাকে বিশ্বাস করে বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। বাবা মার অমতে গিয়ে তোমায় বিশ্বাস করে তাদের ছেড়ে চলে এসেছিলাম। আর তার ফল আমি প্রতিটা মুহূর্তেই পাচ্ছি।তুমি আমায় বলেছিলে যেমন তেমন একটা কাজ খুঁজে নেবে।কিন্তু আজ ছ'মাস হয়ে গেলো আমাদের বিয়ে হয়েছে।বিয়ের পর দুমাস চাকরি করেছো।তারপর  তোমাকে আজ পর্যন্ত আমি বাড়ির বাইরে কাজ খোঁজার জন্য বেরোতে দেখলাম না।অথচ তোমার তিন বেলা খাবার গুছিয়ে তোমার সামনে আমাকে দিতে হয়।ঘরের কাজকর্ম করি আমি,অফিস করি।অফিসে বেরোনোর আগে যেখানে যেমন জিনিস পরে থাকে বাড়িতে ফিরে দেখি ঠিক সেই রকমই পরে আছে।অফিস থেকে ফিরে আমাকে সেই সব কাজ করতে হয। অথচ ঘরে থেকেও তুমি কোন কাজ করো না।পুরুষেরা বাইরে কাজ করে, যেসব মেয়েরা চাকরি বাকরি করে না তারা সংসারের কাজ করে।আমি চাকরি করছি, বাইরে বের হচ্ছি অথচ তুমি ঘরে থেকেও ঘরের কোন কাজ করছ না;কেন করবে না?সংসার তা তো দুজনের।  একজন ইনকাম করলে আরেকজনকে ঘরের কাজ করতেই হয়।তুমি তাও করবে না। চাকরির চেষ্টাও করবে না।তুমি  আমার ঘাড়ের উপর বসে খাবে।কিন্তু আমিতো তা হতে দেবো না। ঠিক যেভাবে বাবা মার অমতে বিয়ে পিতৃমাতৃহীন একটা ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলাম,এখানেও আমি কিন্তু যে কোন সময় সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে যেতে দুবার ভাববো না।আমার পায়ের তলায় মাটি শক্ত।আমি রোজগার করি। তুমি বেকার বসে খাও। সুতরাং চিন্তা করে দেখো হয় সংসারের কাজ নয়তো টাকা ইনকাম।যেকোন একটাকে তোমার বেছে নিতেই হবে।ওই সার্টিফিকেট বিক্রি করে কিন্তু সংসার বা পেট চলবে না। গাদা  গুচ্ছের সার্টিফিকেট দেখিয়ে আর আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার চাকরি দেখে বিয়ে করেছিলে আমায় এটা আমি এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
   প্রথম প্রথম সুদীপ তর্ক করে গেলেও একসময় সে এতটাই রেগে যায় শ্রেষ্ঠার গায়ে হাত তুলতে উদ্যত হলে খপ করে সে হাতটা ধরে ফেলে বলে,
--- অনেক পৌরুষত্ব দেখিয়েছো।বাকি ছিল এটাই।আমারই খাবে আর আমার উপর ছড়ি ঘুরাবে আমি তো এটা বরদাস্ত করবো না।
 সুদীপ তেজ দেখিয়ে খাট থেকে উঠে একটা জমা গায়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।রাতে আর ফেরে না।সারাটা রাত উৎকণ্ঠা নিয়ে কাটে শ্রেষ্টার।বারবার তাকে ফোন করলে সে ফোন কেটে দিয়েছে।কিন্তু আঘাত না দিলে সুদীপের মধ্যে যে কোন পরিবর্তন আসবে না এটা সে ভালোভাবেই বুঝেছিল।এই ছাড়া তার কাছে কোন উপায়ও ছিলনা।অফিসের কাজে ভালোভাবে মন বসাতে পারছিল না।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলে দেখে সুখেন্দুদা ফোন করেছে।
--- তোর বরের কাজটা হয়ে গেছে রে।আমি সাথে করেই ওকে আমাদের বসের ঘরে নিয়ে গেছিলাম।ওর একটা চাকরির যে কত প্রয়োজন সেকথা বলতে বলতে কেঁদেই দিয়েছিলো।প্রথম প্রথম খুব একটা মাইনে না দিলেও আস্তে অস্তে মাইনেটা বাড়বে রে।
  শ্রেষ্ঠা ফোনটা নিজের ড্রয়ারে রেখে বাথরুমে ঢুকে জোরে কলটা চালিয়ে দিয়ে কেঁদে কেটে একটু হালকা হয়ে তাড়াতাড়িই অফিস থেকে বেরিয়ে পরে।বাড়িতে ফিরে দেখে সুদীপ বাড়ির গেটের কাছে বসে আছে।ঘরে ছিল তালা দেওয়া কারণ রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সুদীপ ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে বেরিয়েছিল না।তার হাতে ধরা একটি মিষ্টির প্যাকেট।


Monday, June 28, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৪০)

সুখের ঘরে আগুন (৪০)

   সেদিন রাতে নিখিলেশ নিলয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে যাওয়ার পথে অচলার সাথে ধাক্কা খায়।অচলা গিয়ে দেওয়ালের উপর পড়ে। শশব্যস্ত নিখিলেশ ঠিক যেন অন্যমনষ্ক ভাবে এগিয়ে গিয়ে অচলাকে ধরে জানতে চায় তা কতটা ব্যথা লেগেছে।অচলা তখন কিছুটা বিব্রত বোধ করে বলে,
--- না না ঠিক আছে এমন কিছু লাগেনি।
 কিন্তু অচলার কপালটা সঙ্গে সঙ্গে মারাত্মক ফুলে যায়।এদিকে তখন নিলয় দরজা খুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অম্বিকার সাথে ফোনে কথা বলছিল।অচলা এবং নিখিলেশের কথাবার্তা শুনে কি ঘটেছে কিছু বুঝতে না পেরে এগিয়ে গিয়ে জানতে চায় সে কি হয়েছে?ওদের দিকে তাকাতেই অচলার কপালে ফোলা অংশ দেখে বলে ওঠে,
--- এত রাত্রে কোথায় গিয়ে ধাক্কা খেলি? যে এত ফুলে গেলো?
  অচলা নিখিলেশের মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে,
--- অন্ধকারে দেখতে পাইনি দাদা।একটু লেগে কপালটা  ফুলে গেল। ও কিছু হবে না।এখনই ঠিক হয়ে যাবে।নিখিলেশ তখন কি করবে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললো,
--- নিলয় একটু বরফ এনে লাগিয়ে দে, তাতেও কিছুটা আরাম পাবে।
অচলা বলে উঠলো, 
--ওইসব বড়লোকদের ব্যাপারস্যাপার।ওসব আমাদের লাগেনা।এমনিতেই সকালে ঠিক হয়ে যাবে।
-- পাকামো একটু কম কর অচলা।অনেকটা ফুলে গেছে। যদি ব্যথা হয় রাতে একটা পেইনকিলার খেয়ে নিস আর এখন চল বরফটা বের করে দি।ফোলা যায়গাটায় চেপেচেপে দিয়ে দে।তাতে ব্যথা আর ফোলা দুইই কমবে।
তারপর বেশ রাগান্বিত স্বরেই বলল, 
--তোকে আমি বলেছি না তুই ভুলে যা আগে কি ছিলি।এখন তুই এ বাড়ির মেয়ে।আমার বোন।
--- তুমি যে কি বল না দাদা!পুরনো সবকিছু ভুলে গেলে মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ হয়ে যায় যে!আমি কি ছিলাম আর এখন কেমন আছি এই দুইয়ের পার্থক্য তখনই করতে পারবো যখন পুরনোর সাথে এখনকার আমির মিল খুঁজব।কিচ্ছু হবে না এরকম অনেক কাটা ফোলা জীবনে হয়েছে কেউ কোনদিনও কোন পাত্তাই দেয়নি।আবার অনেকে মেরে ফুলিয়ে দিয়েছে।চোখের জলে সব কষ্ট ধুয়ে মুছে গেছে।আমাকে নিয়ে এত ভেবোনা ও একসময় ঠিক হয়ে যাবে।আমাদের সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা দিয়েই ঈশ্বর পৃথিবীতে পাঠান।
  নিলয় এবং নিখিলেশ দুজনেই অচলার কথা শুনে খুব কষ্ট পেলো।সত্যিই মেয়েটা তার জন্মের পর থেকে ভীষণ কষ্টের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছে। দু'জন দু'জনের মুখের দিকে তাকালো কিন্তু আর কেউ কোন কথা না বলে ড্রইং রুমে গিয়ে ঢুকলো। নিলয় এগিয়ে গিয়ে ফ্রিজ থেকে কিছুটা বরফ এনে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে অচলার হাতে দিয়ে বলল,
---এই নে রুমালে করে বরফ নিয়ে ফোলা যায়গাটায় একটু চেপে ধরে থাক কিছুক্ষণ। কিছু সামান্য পরে ব্যথা ফোলা দুটোই কমে যাবে।
--- তুমি রুমালটা রাখো।আমি আমার গামছাটা নিয়ে আসছি।
 নিলয়ের উত্তর দেওয়ার অপেক্ষা না করে অচলা তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
নিখিলেশ তখন নিজেকে খুব অপরাধী এবং অসহায় মনে করছে।অপরাধী মনে করছে নিজেকে এই কারণে যে তার জন্য অচলার এই আঘাত পাওয়া আর অসহায় মনে করছে এই মুহূর্তে নিখিলেশের অনেক কিছু ইচ্ছা থাকলেও অচলার উপরে কোনটাই সে এপ্লাই করতে পারছে না। নিলয় একমনে চেয়ারে বসে বকবক করেই চলেছে।নিখিলেশ মাঝেমধ্যে আড় চোখে অচলার দিকে দেখছে সে কিভাবে গামছার ভিতর বরফ নিয়ে একমনে ফোলা জায়গাটায় চেপে ধরে বসে আছে।নিলয় খেয়াল না করলেও নজর এড়ায় না অচলার।তার বুকের ভিতর অদ্ভুত একটা ধুকপুকানি অনুভব করতে থাকে সে।যা আগে কোনদিনও তার হয়নি।কিন্তু সে তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে এতটাই ওয়াকিবহাল যে তখন সে তার কপালে আঘাত পাওয়া নিয়ে যে কথাগুলো বলেছে তা একমাত্র নিখিলেশকে বুঝিয়ে দেওয়া যে সে তার উপযুক্ত নয়।সে অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা।বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর তার মোটেই ইচ্ছা নেই।আর ওদিকে নিলয় কথা বলেই চলেছে।নিখিলেশ নিলয়ের কথাগুলো কানে নিলেও মাথায় নিতে পারছে না কারণ তখন সে অচলার এই আঘাত পাওয়া নিয়ে সত্যিই নিজেকে দায়ী মনে করছে।ভালোবাসার পাত্রী যখন নিজের কারণে আঘাত পায় তখন সে আঘাত যেন দ্বিগুণ হয়ে অপরের বুকে বাজে।আর তখনি প্রতিটা মানুষেরই কষ্টটা যেমন বেশি হয় ঠিক তেমনই সে নিজেকে নিজেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
 নিলয়ের বাবা মা রাত অনেক হওয়াতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিছুক্ষণ তারা ড্রয়িং কাম ডাইনিংয়েই বসে থাকার পর সেখান থেকে উঠে অচলা নিলয়কে বলে নিজের ঘরে চলে আসে।আসবার সময় নিলয় তাকে বারবার বলে দেয় আজ রাতে আর বইপত্তর নিয়ে তাকে রাত জাগতে হবে না।সে যেন শুয়ে পড়ে। কাল ভোরে উঠেই যেন সে পড়তে বসে কারণ অচলার পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই।
  পরদিন সকালবেলা মলিনাদেবী  জানতে পারেন গতকাল রাতে দেওয়ালে ধাক্কা লেগে অচলার কপাল ফুলে যায়। নিজের থেকে সে কথা মাকে বলতে অবশ্য চায়নি।অচলার কপাল ভোলা দেখে তিনি বারবার তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে এ কথাই জানিয়েছে।সে নিলয় বা বাড়ির কাউকেই বলে না যে নিখিলেশের সাথে ধাক্কা লেগে সে দেওয়ালের উপর গিয়ে পড়েছে। কিন্তু কেন যে সত্যি কথাটা সবাইকে বলতে পারেনি তা সে নিজেও বুঝতে পারে না।অনেক ভেবেছে সে কিন্তু তারপরেও কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর সে পায়নি।একটা সাধারণ কারণে কেন মিথ্যা কথা বলতে গেল একথা তার মাথায় কিছুতেই আসছে না।সে তো নিলয় বা তার বাবা-মার কাছে আসা অব্দি থেকে কোন কথা গোপন করেনি।তবে আজ কেন নিখিলেশের সাথে সামান্য ধাক্কা খাওয়ার কথাটা সে বলতে পারল না?তেইশ বছরের তম্বি অচলা যে কিনা দেখতে শুনতে মন্দ নয়;সে যে নানান ঘাটের জল খেয়ে এই প্রথম কোন পুরুষের মুখের দিকে তাকাতে গেলে লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে আর নিজেও দেখেছে নিখিলেশের চোখে তারজন্য ভালোবাসা।কিন্তু নিখিলেশের সাথে তার সম্পর্কে কোন কথা চিন্তা করা মানে বামুন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো!তা সে যেমন করবে না ঠিক তেমনি নিলয় বা তার পরিবারের কোন সম্মানহানি হয় সে কাজ কখনোই করতে পারবে না।তাই সে নিজের মনকে নিজেই শক্ত করে বাঁধে।
 সেদিন রাতে নিখিলেশ ও নিলয় তাদের কর্মস্থল ভুবনেশ্বরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।অচলা পারতপক্ষে সেদিন সকাল থেকে আর নিখিলেশের সামনে আসেনি।কিন্তু নিখিলেশ অচলা কেমন আছে জানার জন্য উসকুস করলেও সাহস করে কারো কাছে জিজ্ঞাসা করতে পারেনি।শুধু মলিনাদেবির মুখে শুনেছে তার কপাল ফোলাটা মারত্মকভাবে রয়েছে।তিনি সকাল বেলা টেবিলে অচলার করে দেওয়া টিফিন গুছাতে গুছাতে নিজের মনেই কথাগুলো বলে চলেছিলেন।সারাটাদিন অচলার সাথে নিখিলেশের আর দেখা হয়নি।শুধু সন্ধ্যায় বেরোনোর সময়  অচলা এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে।
   নিলয় অম্বিকার বিয়ের ডেট এগিয়ে আসতে থাকে।অচলার পরীক্ষাও শেষ।অচলার এখন সময় কাটে সংসারের কাজকর্ম করেই।দাদার বিয়ের জন্য ঘরদোর পরিস্কার করা নিয়ে রোজই সে ব্যস্ত।বাবা,মা তাকে বারবার বলেছেন কাজগুলি লোক দিয়ে করিয়ে নেবেন।কিন্তু অচলা সে কথার কোন পাত্তাই দেয়নি। নিলয় তাকে কথা দিয়েছে যদি সে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করে তবে তাকে সে একটি স্মার্ট ফোন কিনে দেবে।কারণ একাদশ শ্রেণিতে তাকে বাইরে যাতায়াত করতে হবে।তার কাছে একটা ফোন থাকা ভীষণ দরকার। আর তাছাড়া বাবা মায়ের বয়স হয়েছে ল্যান্ডফোন বাজতে লাগলে বাবা-মা অনেক সময় অলসতা বশত উঠে ফোন ধরেন না বা কখনো তারা তাদের ঘর থেকে আসতে আসতেই রিংটা কেটে যায়।অচলা যদি এদিক-ওদিক থাকে তাহলে তাদের খবর নিতে নিলয়কে ফোন করতে হয় এখন অম্বিকার কাছে। কিন্তু অম্বিকা তো চাকরি করে।তাছাড়া নানান প্রয়োজনে এদিক ওদিকে ঘোরাফেরা করে,তাই তার পক্ষে সব সময় তার বাবা-মায়ের খবর রাখা সম্ভব নয়।অথচ তারা কেউই মোবাইল ফোন ইউজ করতে পারেন না।তাই সে ঠিক করে অচলাকে একটা ফোন কিনে দেবে।সেটা সে অচলাকে অবশ্য বলে ফার্স্ট ডিভিশন পেলেই তোকে আমি ফোন দেবো নইলে নয়।
  সময়ের সাথে সাথে দিনগুলো এগিয়ে যেতে থাকে।এগিয়ে আসে নিলয়ের বিয়ের দিন।বিয়ের দিন সাতেক আগে থাকতে নিলয় বাড়িতে চলে আসে।নিখিলেশ বিয়ের দু'দিন আগে আসবে কথা হয়।সামান্য কিছু আত্মীয়-স্বজন নিলয়দের তারাও চলে আসেন।অচলার দম ফেলার ফুরসত নেই।সব সময় সে কাজ করে চলেছে।সে যেন প্রতিজ্ঞা করে আছে মাকে সে কোন অবস্থাতেই কোন কাজ করতে দেবে না। মলিনাদেবী কোন কাজ করতে গেলেই সে দৌড়ে গিয়ে  তার হাত থেকে কাজটা ছিনিয়ে নেয়।মাঝে মাঝে মলিনাদেবী খুব ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেন।কিন্তু তার চিৎকার শুনে ওর রাগের থেকে হাসি পায় বেশি।হাসতেই থাকে আর তা দেখে মলিনাদেবী বকবক করতে করতে সে কাজ ফেলে দিয়ে ঘরে গিয়ে গোমড়ামুখো হয়ে বসে থাকেন।আর নরেশবাবু তাকে দেখেই বুঝতে পারেন আবার একসাথে কাজ করা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। এই ব্যাপারগুলি তিনি খুব উপভোগ করেন।এতদিন পরে একটা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে বাড়িতে এসে তাদের সবাইকে এত আপন করে নিয়েছে এটা ভাবলেও আনন্দে বুকটা ভরে যায়। দুজনেই বলাবলি করেন নিলয়টা বদলি হয়ে যাওয়ার পরে বাড়িটাই কোন প্রাণ ছিল না।অচলা আসাতে বাড়ির পরিবেশটাই যেন পাল্টে গেছে।এই রাগারাগির কিছুক্ষণ পরেই আবার মলিনাদেবী  উঠে কর্মরত অচলার পাশে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে গিয়ে বসেন।তারপর নিজের থেকেই মেয়েটির সাথে বকবক করতে থাকেন।আর এটা অচলা ভালোভাবেই জানে বলে মলিনাদেবীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে সে একদমই পাত্তা দেয় না।তিনি যখন অচলার কাছে গিয়ে বসেন অচলা মুখ টিপে টিপে হাসে আর বলে,
--- তোমার রাগ পড়ে গেলো মা?যে কাজগুলো আমি করতে পারবো না সেগুলো তো তোমাকে করতেই হবে মা।যারা এসেছেন দাদার বিয়ে উপলক্ষ্যে তারা কেউই সে রকম কাজের নয়।সবাই তো বসে শুয়েই দিন কাটাচ্ছেন দেখছি।
 মলিনাদেবী একথা শুনে চোখ বড় বড় করে এদিকওদিক তাকিয়ে নিজের মুখে নিজেই আঙ্গুল দিয়ে আস্তে কথা বলতে বলেন অচলাকে।আবার কেউ শুনে ফেললে বিয়েবাড়িতে ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে।কারণ তিনি তার আত্মীয়স্বজনকে ভালোভাবেই চেনেন।বিয়ের দিন প্রমিতা আসলে সে তার দাদার বিয়ের কাজে হাত লাগাবে।কিন্তু তার ছেলেটি যা দুরন্ত ।তাকে সামলাতেই সে হিমশিম খায়।

ক্রমশঃ

Thursday, June 17, 2021

তোর জন্য

তোর জন্য

"আমার জীবনের প্রথম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল সেটা ---যেদিন তোর ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে আমি সন্দীপকে বিয়ে করেছিলাম।তুই আমাকে ভালোবাসতিস আর আমি ভালবাসতাম সন্দীপকে।তাই আমি ভেবেছিলাম সন্দীপকে বিয়ে করে আমি সুখী হব।কিন্তু আমার জীবনের বেস্ট ফ্রেন্ড যার সাথে সব কথা আমি শেয়ার করি তিনি ছিলেন আমার বাবা।বাবা সেদিন সবকিছু শুনে আমাকে বলেছিলেন, 'জীবনে সুখী হতে গেলে সেই মানুষটাকে বিয়ে করা উচিত যে তোকে ভালবাসে, তুই যাকে ভালোবাসিস তাকে নয়।বাবার কথার অর্থ সেদিন আমি বুঝেছিলাম না।কিন্তু আজ আমি বুঝতে পারি সত্যিই জীবনে সুখী হতে গেলে দরকার প্রকৃত ভালোবাসার। সন্দীপের সাথে আমার বিয়ে হওয়ায় বাড়ির সকলের অমত থাকলেও কেউ বাধা দিয়েছিল না।তারা আশায় বুক বেঁধে ছিলেন হয়তো তাদের আদরের কন্যা তার ভালবাসার পাত্রকে বিয়ে করলে সুখী হতে পারে।তাই তারা নিমরাজি হলেও সন্দীপেরর সাথে বিয়েটা মেনে নিয়েছিলেন।
  সন্দীপেরর আরো একটি ভাই ছিল।সে কলেজে পড়ত। সন্দীপের থেকে তার চেহারা স্বাস্থ্য খুবই ভালো।বিয়ের সময় সন্দীপ দিন দশেক ছুটি নিয়েছিল। ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর সন্দীপ অফিসে জয়েন করে। আর ঠিক তার দিন সাতেক পরেই সমীর ফাইনাল পরীক্ষার কারণে কলেজ যাওয়া বন্ধ করে। সন্দীপের মায়ের বয়স হয়েছে।তিনি অধিকাংশ সময় তার নিজের ঘরেই শুয়ে থাকেন।সমীরের সাথে বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই আমার একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। হাসি-ঠাট্টা, গল্পগুজব, হাহা -হিহি সবকিছুই চলতো।সমীর আমাকে খুব ভালবাসতো,আর আমিও তাকে ছোট ভাইয়ের মতন স্নেহ করতাম।
  সন্দীপ বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে বাড়িতে ফিরে আসতো আর ঠিক এই সময়ে অধিকাংশ দিনই বাড়িতে ফিরে সে দেখতো আমি আর সমীর বসে হয় চা খাচ্ছি না হলে চা খাওয়া হয়ে গেছে দুজনে বসে গল্প করছি। প্রথম প্রথম সন্দীপ এটা নিয়ে মাথা ঘামাতো না 
।কিন্তু তারপরেই শুরু হল তার ভাই এবং আমাকে নিয়ে তার নানান ধরনের কুৎসিত ইঙ্গিত। মাঝেমধ্যে এসব কথাগুলো সমীরও শুনেছে।তাই সে আমাকে অ্যাভয়েড করতে লাগলো। আমিও ঠিক তেমনই তাকে অভয়েড করতে থাকলাম। সন্দীপ বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে আমি ও সমীর কেউই কারও সাথে কথা বলতাম না।এমন ভাবেই দুজনে থাকতাম যেন কেউ কাউকে চিনি না।খুব খারাপ লাগত, যাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতন দেখি তাকে নিয়ে এই ধরনের কুৎসিত ভাষা।মন থেকে মেনে নিতে পারতাম না। তখন বারবার করে বাবার কথা গুলো মনে পড়তো।সন্দীপ যদি আমার ভালোবাসাটা সত্যিই বুঝতে পারত,সে যদি সত্যিই আমায় প্রকৃত ভালোবাসতো তাহলে অন্তত নিজের ভাইকে নিয়ে এই ধরনের কথা সে আমায় বলতো না।
 একই পাড়ায় থাকার সুবাদে তোর সাথে আমার বন্ধুত্বটা অনেক পুরনো। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি কিন্তু তোকে কোনদিন ভালোবাসতাম না।এমনকি তুই যে আমায় ভালোবাসিস এটাও আমি বুঝতাম না।কিন্তু তুই যখন আমাকে প্রপোজ করলি সেদিনই প্রথম বুঝলাম তুই আমায় ভালবাসিস।কিন্তু আমিতো ভালবাসতাম সন্দীপকে। আমার বিয়ের আগে তুই চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেলি। আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলি। আসলে এক্ষেত্রে তোকে কিছু বলারও নেই।কারণ জীবনের ছেলেবেলার বন্ধু, প্রথম ভালোবাসার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু আমি তো জীবনে তখন চরম ভুল করে বসে আছি।সন্দীপকে ভালবেসে তোর প্রকৃত ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করে তার সাথে সুখী হওয়ার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।সন্দীপের অহেতুক সন্দেহ যখন আমার মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন চোখ বুজলেই যেন আমি তোকে দেখতে পেতাম।তোর কথা তখন আমার ভীষণভাবে মনে পরতো।কিন্তু আমি তখন খাঁচায় বন্দি পাখি।ইচ্ছেমতন ওড়ার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলেছি। জীবনের এত বড় ভুলটা শুধরানো তখন আর কোন উপায়ই ছিল না। এরইমধ্যে আমি টের পেলাম আমার ভিতরে আরেকটি প্রাণীর অস্তিত্ব। আমি ভেবেছিলাম সন্দীপ এই খবরে খুশি হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সন্দীপ এ সন্তানের দায় চাপিয়ে দিল তার ভাইয়ের ঘাড়ে।সমীর এ কথা শুনে নিজেকে শেষ করে দেওয়ারও চেষ্টা করেছিল।তখন সন্দীপ অফিসে ছিল।অনেক কষ্টে সেদিন আমি সেযাত্রা থেকে তাকে রক্ষা করেছিলাম।কিন্তু তারপরেই সমীর বাড়ি ছেড়ে একটা মেসে গিয়ে ওঠে।আমার সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।আর তখন সন্দীপ আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে যায় আমার উপর। শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে না পেরে সন্দীপকে ছেড়ে মাথা নিচু করে আবার বাবার কাছে ফিরে আসি।
  আজ দুবছর হতে চললো সন্দীপের খবর কিছু আমি জানিনা।তবে পাড়ার লোকের কাছে শুনে সমীর এসেছিল।এখনো মাঝে মধ্যে আসে। বুবাইকে ভীষণ ভালোবাসে।তোদের বাড়িতে গেছিলাম বুবাই হওয়ার পর।কাকিমা বললেন,তুই প্রায় তিনবছর কলকাতা আসিস না।"
 --- বাড়িতে ফিরে তোর কথা জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এসছি।যদি কোনদিন নূতন করে নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে নিতে চাস আমায় জানাস।আমি আছি তোর পাশে।আমি আজও তোকে সেই আগের মতই ভালোবাসি।


 
  

Monday, June 14, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩৯)

সুখের ঘরে আগুন (৩৯)

    এর ঠিক দুমাস পরেই নিলয় আর নিখিলেশ ঝটিকা সফরের মত হঠাৎ করেই কলকাতা এসে হাজির দুদিনের জন্য।শনিবার কোন একটা কারণে ছুটি থাকায় তারা শুক্রবারে রাতের ট্রেন ধরে শনিবার এসে পৌঁছায়।বাবা,মাকে এবার সে অম্বিকার সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে বলে।চারজন গার্জিয়ানের মিটিং বসে অম্বিকাদের বাড়িতে।কথাবার্তা এগোতে থাকে। ছ'মাস পরে বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়।একটু দেরিতেই তারা ডেটটা ফাইনাল করেন কারণ নিলয়ের ছুটির সমস্যা।বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয় দু'বাড়িতেই ।অনেকদিন পর নিলয়ের বাবা,মা যেন বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছেন।অচলা তো ভীষণই খুশি।মাঝে মধ্যেই অচলাকে নিয়ে টুকটাক কেনাকাটা করতে বেরোচ্ছে অম্বিকা।আর সাথে থাকছে নিশিতা।
   অচলা তার পড়াশুনা নিয়ে বেশ ব্যস্তই থাকে।তার মধ্যেও সে মাকে কোনরকম কাজ করতে দেয় না।নিজেই একার হাতে সংসারের কাজ করেই পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে।বিয়ের তারিখ আসার আগেই তার মাধ্যমিক দেওয়া হয়ে যাবে।তার একার উপর চাপ পড়ে যাচ্ছে,পড়াশুনার ক্ষতি হচ্ছে মনেকরে নিলয় মাকে বলে একজন কাজের মহিলা রেখে দিয়েছে।এখন অচলা শুধু রান্নাটাই করে।মাকে সে রান্নাঘরে কিছুতেই ঢুকতে দেয় না।
  এরই মাঝে হঠাৎ করেই একদিন নরেশবাবুর রাতের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।কথা বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে যান আর সঙ্গে সঙ্গে পুরো শরীর তার লোহার মত শক্ত হয়ে পড়ে।মলিনাদেবী চিৎকার করে অচলাকে ডাকেন।অচলা দৌড়ে এসে ওই অবস্থা দেখে কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।কিন্তু একটু পরেই দৌড়ে গিয়ে ডাইরি বের করে অম্বিকাকে ফোন করে।অম্বিকা ফোন পেয়ে নরেশবাবুর শারীরিক অবস্থা শুনে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে ছুঁটতে ছুঁটতে নিলয়দের বাড়িতে এসে হাজির হয়। ছ'ফুটের উপর লম্বা মানুষটাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলতেই চালক ও হেলপার দুটো মানুষ হিমশিম খেয়ে যায়।কোনরকমে অম্বিকা আর অচলা গাড়ির ভিতর গিয়ে বসে। পাড়ার দুটি ছেলে বাইকে রওনা দেয়।মলিনাদেবীকে অনেক বুঝিয়ে পাড়ার লোকের হেফাজতে রেখে তারা নরেশবাবুকে নিয়ে নার্সিংহোম পৌঁছে যায়। ডক্টরসদের তৎপরতায় একটা ইনজেকশনেই তার জ্ঞান ফিরে আসে।তারা জানান হঠাৎ করে শরীরে সোডিয়াম পটাশিয়াম এর মাত্রা কমে যাওয়ার ফলেই তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন এবং পুরো বডি শক্ত হয়ে গেছিল।সবাই খুবই ভয় পেয়ে গেছিলো।জ্ঞান ফেরার সাথে সাথেই অম্বিকা ফোন করে মলিনাদেবীকে জানিয়ে দেয়।কিন্তু এত রাত্রে সেই মুহূর্তে নিলয়কে কিছু জানাতে নিষেধ করে দেন তিনি। তিন দিনের মতো নরেশবাবুকে নার্সিংহোমে থাকতে হয়।অচলা ও অম্বিকা ভোর রাতে বাড়ি ফেরে।মলিনাদেবী ওরা না ফেরা অবধি বারান্দাতেই বসে ছিলেন।ওদের উবের থেকে নামতে দেখতে পেয়েই তড়িঘড়ি গেটের তালা খুলেই কাঁদতে শুরু করেন। ওরা দুজনে মিলে তাকে আশ্বস্ত করে নরেশবাবু  ভালো আছেন বলে।ভোরের আলো ফুটলে অম্বিকা বাড়ি চলে যায় আর যাওয়ার সময় অচলাকে বলে যায় দশটার মধ্যে রেডি হয়ে থাকতে সে বাড়ি থেকে ফ্রেস হয়ে এসে আবার তাকে নিয়ে নার্সিংহোম যাবে।
  ঠিক দশটা নাগাদ অম্বিকা নিলয়দের বাড়িতে এসে দেখে অচলা ও মলিনাদেবী দুজনেই সেজেগুজে রেডি বেরোনোর জন্য।অম্বিকা এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে অচলা তাকে বলল,
--- দেখো না দিদি মা কিছুতেই শুনবেন না।মা বাবাকে দেখতে যাবেনই। আমিও ভাবলাম বাবা যখন ভালই আছেন তখন মা একবার দেখে আসলেই ভালো হবে। তাহলে মায়ের মনটাও ভালো লাগবে।
---  হ্যাঁ ঠিকই করেছিস।মাসিমা, আপনাকে নিয়েই যাবো। আমিও মনেমনে ভাবছিলাম এখানে এসে আপনাকে বলবো আমাদের সাথে যাওয়ার কথা।এখন কোনোই সমস্যা নেই।এখন খুবই ভাল আছেন। কথাবার্তাও বলেছেন ভোরের দিকে আমাদের সাথে।তবে ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন কোন অবস্থাতেই ভাজাপোড়া খাওয়া চলবে না। যেসব জিনিসে উনার গ্যাসের সমস্যা হয় সে সব খাবার একেবারে বন্ধ।

   পরদিন হাসপাতালে যেতে যেতেই উবের এর ভিতরেই  অম্বিকা, মলিনাদেবীর পরামর্শ নিয়েই নিলয়কে সবকিছু জানায় এবং একথাও বলে বর্তমানে সে সামলে নেবে কোন অসুবিধা নেই এই মুহূর্তে।এখন এখানে আসতে হবে না। তাছাড়া অচলা এখন বাইরে দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি, বাসে ওঠা সবকিছুই করতে পারে। যথেষ্ট বুদ্ধিমতি মেয়ে হওয়ায় ডাক্তারের সাথে কথাবার্তা বলাতেও বেশ পারদর্শী।সুতরাং নিলয় যেন কোনো অবস্থাতেই কিছু চিন্তা না করে। নিলয় কথাপ্রসঙ্গে টাকা পয়সার কথা বললে অম্বিকা তাকে বলে আপাতত এই দিকটা সে সামলে নিতে পারবে।সে ক্ষমতাটুকু তার আছে। কিন্তু নিলয় তার কথাতে কোন পাত্তা না দিয়ে খবরটা শোনার সাথে সাথেই তার অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা ট্রানস্ফার করে দেয়।এর ফলে অম্বিকার ভিতরে একটা অভিমান দানা বেঁধে ওঠে।কিন্তু সে মুখে কিছু বলে না; নিজেকে নিরস্ত করে।তার কারণ সন্তান হিসেবে প্রত্যেকের কাছে এটাই স্বাভাবিক।ফিজিক্যালি সে ছুটোছুটি করছে ঠিকই কিন্তু ইকনোমিক্যালি নিলয়ের সমস্ত দায়িত্ব এই সময়ে।এই অর্থের ব্যাপারে নিলয় অম্বিকার উপরে নির্ভর করতে না পারাটাই স্বাভাবিক।প্রথম অবস্থায় এই ব্যাপারে কিছুটা অভিমান হলেও পরে অম্বিকা নিজে চিন্তা করে দেখেছে দায়িত্ববান ছেলে হিসেবে বাবা মায়ের প্রতি দুশ্চিন্তার থেকেই সে এ কাজ করেছে।সশরীরে হাজির থাকতে না পারলেও তার বাবার চিকিৎসার ক্ষেত্রে অর্থের অভাব যাতে না হয় সে ব্যবস্থা সে সঙ্গে সঙ্গেই করেছে।
  অম্বিকা যখন নিলয়কে ফোন করেছিলো নিলয় তখন অফিসের পথে।সে অফিসে ঢুকেই তার বসের কাছে গিয়ে বাবার শারীরিক অবস্থার কথা জানায় এবং বার বার তাকে বলে যে সে ছাড়া তার বাবা-মায়ের আর কেউ নেই।কম করে তাকে চার দিন ছুটির ব্যবস্থা করে দিতেই হবে।তার ছুটি মঞ্জুর হয়।নিখিলেশের সাথে দেখা করে সে সবকিছু তাকে জানায়। নিখিলেশও তার সাথে যেতে চায়।কিন্তু সে ছুটি পায় না কারণ দুজনেই একই ডিপার্টমেন্টে আছে।একসাথে ছুটি নিলে খুব সমস্যা হয়। এমতাবস্তায় নিলয় ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে।ট্রেন বদলে বদলে সে রাতেই দিকেই পৌঁছে যায় সেদিনই নার্সিংহোমে।অম্বিকা আর অচলা তখনো নার্সিংহোমে।ভিজিটিং আওয়ার শেষে বাইরে বেরিয়ে একটু চা খেয়ে তারা যখন বাসের অপেক্ষায় ঠিক তখনই উসখোখুস্কো চুলে উদভ্রান্তের মত নিলয় উবের থেকে নামে।তাকে দেখতে পেয়ে ওরা দুজনেই হতভম্ব!নিলয় ওদের দেখতে পেয়েই দৌড়ে এসে জানতে চাইলো,
--- বাবা এখন কেমন আছেন?
--- ভালো আছেন সেতো তোমাকে সকালেই জানালাম।তোমার সাথে তো আরও কয়েকবার কথা হল ফোনে।সারাদিনে।একবারও তো বলোনি তুমি আসছো ---।
--- ইচ্ছা করেই বলিনি।বললেই আবার আমায় নিয়ে তোমরা টেনশন করতে।তোমরা একটু দাঁড়াও আমি ভিতরে গিয়ে দেখি বাবার সাথে একটু দেখা করতে পারি কিনা।
  অচলা তখন বলে ওঠে,
--- ভিজিটিং আওয়ার তো শেষ।চলো আমরাও যাই তোমার সাথে।
 তিনজনে আবার এগিয়ে গেলো।অনেক কাকুতি মিনতির পর মিনিট পাঁচেকের সময় বরাদ্দ হল নিলয়ের বাবার সাথে দেখা করবার জন্য।নরেশবাবু চোখ বন্ধ করে শুয়েছিলেন।নিলয় গিয়ে মাথায় হাত দিতেই চোখ খুলে ছেলেকে দেখে মুখে হাসি নিয়ে বললেন,
--- আমি এখন ভালো আছি রে।এত পরিশ্রম করে কেন আসতে গেলি?তবে তোকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে বাবা।মেয়ে দুটো কাল থেকেই ছুটাছুটি করছে।তোকে দেখে তোর মা ও অনেকটা মনের বল পাবে।যা এবার বাড়ি যা।ওদের সাথে তোর দেখা হয়েছে?
 নিলয় মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো।
"তাহলে একসাথে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নে।ভালো আছি এখন একদম চিন্তা করিস না।যা বেরিয়ে পড়।সকালে আসিস আবার।"
  নার্স এসেও বেরিয়ে যাওযার জন্য নিলয়কে তাগাদা দিলেন।নিলয় বাবাকে ' আসছি ' বলে ওদের নিয়ে উবের ধরে বাড়ির পথে রওনা দিলো।

ক্রমশঃ 

Friday, June 11, 2021

বন্ধুত্বের মর্যাদা

বন্ধুত্বের মর্যাদা

" কতবার চেষ্টা করেছি সব কিছু জানাতে, কিন্তু ---
--- কিন্তু কি?
--- একদিন যে ব্যবহার আমি তোর সাথে করেছিলাম তারপরে তুই যে আমার পাশে দাঁড়াবি এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।আর তাছাড়া সাহসও পাইনি বলতে পারিস।।যদি জানতে চাস কিসের সাহস?আমি বলব আমার লজ্জা আর লোক জানাজানির ভয়।
--- পমের বাবা এখন কোথায় থাকেন?
---আমি জানিনা সে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর আমি আর তার সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি। 
--- কিন্তু তুই তো আমাকে বলেছিলি সুদীপ্ত তোকে ভালোবাসে।তোদের দু'বাড়ির থেকেও মেনে নিয়েছে সম্পর্কটা।তোদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছিল তখন।
--- হ্যাঁ আমি সেটাই জানতাম সুদীপ আমায় ভালোবাসে।আর যেহেতু বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছিল তাই আমার জীবনের চরম সম্পদ অবলীলায় তার কাছে সমর্পণ করেছিলাম।কিন্তু আমি কখনোই ভাবতে পারিনি আমার প্রেগনেন্সির খবর পেয়ে সে বাচ্চাটিকে পৃথিবীর আলো দেখাতে অস্বীকার করবে।সে আমায় স্বত্ব দিয়েছিল বাচ্চাটিকে যদি আমি নষ্ট করে ফেলি তাহলে সে আমাকে বিয়ে করতে রাজি আছে।তা না হলে নাকি বাড়ি এবং আত্মীয়স্বজনের কাছে তার সন্মান নষ্ট হবে। সুদীপ্তকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম আমাদের ভালোবাসার প্রথম সন্তান এর মধ্যে কোন পাপ নেই।কিন্তু ও ওর কথা থেকে বিন্দুমাত্র সরেনি।তাই আমাকে ওর কাছ থেকে সরে আসতে হয়েছিল। পরে শুনেছি সুদীপ্ত বিয়ে করেছে।আজ পাঁচ বছর তাদের কোনো সন্তান হয়নি।আমি ওর সব খবরই জান। কিন্তু আমার খবর সুদীপ্ত কিছুই জানেনা।তার কারণ হচ্ছে বাচ্চাটিকে নষ্ট করবো না বলে আমি যখন নাছোড়বান্দা তখন মা আমাকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাট বিক্রি করে অন্য ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠেন।মানুষের কথার ঝাল থেকে বাঁচতে আর চোখ এড়াতে ঠাকুরের আসন থেকে সিঁদুর নিয়ে আমাকে নিজেই পরে নিতে বলেন মা।এই যে সিঁদুর আমার কপালে দেখছিস এ কিন্তু সুদীপ্তর দেওয়া সিঁদুর নয়।তার মুখ স্মরণ করে লোকলজ্জার ভয়ে এক কুমারী মায়ের নিজের হতে পরা সিঁদুর।সবাই জানে আমার স্বামী বিদেশে থাকে। ভাগ্যিস আমার স্কুলের চাকরিটা ছিল।তাই মা,আমার আর পমের কোন অসুবিধা হয়নি।
 কলেজের তিন বন্ধু। নৈরিতা,সুদীপ্ত আর রনিত।দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে যখন বন্ধুত্ব হয় অধিকাংশ সময়ই দেখা যায় ছেলে দুটিই মেয়েটির প্রেমে হাবুডুবু খায়। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।সুদীপ্ত এবং রনিত দুজনই ভালোবাসে নৈরিতাকে। রনিত যখন নৈরিতাকে তার ভালোবাসার কথা জানায় তার অনেক আগে থাকতেই ওদের দু'বাড়ির মধ্যে কথা হয়ে গেছে সুদীপ্ত চাকরি পেলেই তারা চারহাত এক করে দেবেন।তাই রনিত নৈরিতার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়।রনিত জানায় ," তাহলে অন্তত বন্ধুত্বটা বজায় রাখিস।"
  তারপর এই সাত বছর পর আবার রনিতের সাথে নৈরিতার হঠাৎ করেই দেখা একটা শপিং মলে।সেদিন মামুলি কথাবার্তা হয়।ফোন নম্বরটাও আদানপ্রদান হয়।তারপর নৈরিতার ডাকে আজ সাতদিন পরে রনিত হাজির হয় তার ফ্ল্যাটে।সুদীপ্ত কোথায় জানতে চাওয়ায় ভেঙ্গে পড়ে নৈরিতা।সুপম ওরফে পম জানে তার বাবা বিদেশে থাকেন। ও যখন বড় হবে তখন ওর বাবা ফিরে আসবেন।অনেকক্ষণ চুপ থেকে রনিত বলে,
--- আজ যদি আমি পুনরায় তোর কাছে কিছু চাই তুই কি সেদিনের মতই আমায় ফিরিয়ে দিবি?
--- আজ তোর চাওয়ার মত আমার কাছে কিছুই নেই।
--- আছে রে আছে --- বল দিবি তো?
--- কি চায় তোর বল।আমার ক্ষমতার মধ্যে থাকলে নিশ্চয়ই দেবো।
--- তোর সন্তানের পিতৃপরিচয়টা দিতে চাই।দিবি এ অধিকারটা আমায়?
--- কি বলছিস কি তুই?তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি?
--- আমি শুধু এইটুকুই অধিকার চাই,কথা দিচ্ছি এর জন্য তোর কাছে অন্য কোন দাবি নিয়ে কখনোই দাঁড়াবো না।আজীবন তোর পাশে থেকে বন্ধুত্বের মর্যাদা রেখেই চলবো।
  নৈরিতা হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।


  

    

Monday, June 7, 2021

মাথা উচুঁ করে বাঁচো

মাথা উচু করে বাঁচো

"মন থেকে যাকে প্রিয় বন্ধু মনে করেছিলাম আর সেই এমনটা  করতে পারলো?" কথাগুলো বলে মহুয়া টেবিলের উপর মাথাটা দিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। তার কান্না দেখে পাশের চেয়ারে বসা সুমিত কি বলবে ভেবে উঠতে না পেরে সেও চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে রইলো। বহুক্ষণ পরে মহুয়া নিজেকে কিছুটা হালকা করে সুমিতের দিকে তাকিয়ে বললো,
-- কথাগুলো কাল থেকে কাউকেই বলতে পারিনি রে। এ যে আমার লজ্জা!এসব কথা আমি কাকে জানাবো? আমাদের পরিবারের সব আত্মীয়-স্বজন বর্ষার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্কটা সেই ছোটবেলা থেকেই জানে।যাকেই বলবো না কেন সেই কিন্তু আমাকে দোষ দেবে। কারণ সত্যিই আমি বর্ষাকে নিয়ে সেই ছেলেবেলা থেকেই বড্ড বাড়াবাড়ি করেছি।এত বড় বেইমান বর্ষা আমি ভাবতেই পারিনি।এই বর্ষার জন্য আমি কি না করেছি!বাবা মায়ের সাথে অশান্তি করেছি দিনের পর দিন। তার সাথে বন্ধুত্ব মনে রেখেছি বিয়ের পরেও।তাই নিজের থেকে তার সাথে যোগাযোগ করেছিলাম বিয়ের পর পরই।যাকে ভালোবেসে তোর ভালোবাসা কে অগ্রাহ্য করে বিয়ে করেছিলাম আমি ভাবতেই পারিনি সেই মানুষটাও একদিন আমার থাকবে না, তাকেও বর্ষা আমার কাছ থেকে কেড়ে নেবে। আচ্ছা সুমিত মানুষ এত অকৃতজ্ঞ  হয় কি করে?
 মহুয়ার কথা শুনে সুমিত কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ মহুয়া ও সুমিত দুজনেই চুপ করেই বসে থাকে নীরবতা ভঙ্গ করে সুমিত বলে,
-- পুরো ঘটনাটা শুনে মনেহল এর জন্য তুই কিছুটা দায়ী। কিছুটা বলবো কেন বেশ অনেকটাই দায়ী।একটা কথা কি জানিস?নিজে পুরুষ মানুষ হয়েই বলছি,সব পুরুষেরা কিন্তু  একরকম হয় না।কিন্তু অধিকাংশ পুরুষই সুযোগ পেলেই সেই সুযোগে সদ্ব্যবহার করে থাকে।তুই বোকার মত বর্ষাকে,  তোর স্বামীকে বিশ্বাস করে দিনের পর দিন বর্ষার হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে থেকেছিস, এটা তোর অন্যায় নয়?
  মহুয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল, 
---আমি ওদের বিশ্বাস করেছিলাম।কিন্তু আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি এই রকম একটা ঘটনা ঘটাবে ওরা।আর সেই মুহূর্তে বাপের বাড়িতে গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়ানো ছাড়া আমার কোনো উপায়ও ছিল না।মায়ের বয়স হয়েছে বাবা হাসপাতালে ভর্তি।মা একা একাই হাসপাতালে ছুটাছুটি করছেন।সেই মুহূর্তে আমার মাথায় অন্য কোন চিন্তা ছিল না।
--- তাই বলে পনেরটা দিন ?
  স্কুল লাইফ থেকেই বর্ষা আর মহুয়া খুব ভালো বন্ধু। বর্ষার থেকে মহুয়াদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভালো। কিন্তু বর্ষার হাবভাব, চালচলন, কথাবার্তা মহুয়ার বাবা মা মোটেই পছন্দ করতেন না।তাই অনেকবার তারা তাদের মেয়েকে নিষেধ করেছেন বর্ষার সাথে বন্ধুত্ব না রাখতে। কিন্তু মহুয়া বর্ষাকে ভীষণ ভালোবাসতো।আর সেই কারণে সে বাবা-মার এ কথা শোনে না। সে তার বন্ধুত্বটা বর্ষার সাথে রেখেই চলেছে। গ্রাজুয়েশনের পর মহুয়া ভালোবেসে সুভাষকে বিয়ে করে।কলেজ লাইফে সুমিত তাকে প্রপোজ করলে সে তাকে ফিরিয়ে দেয় এবং তাকে জানিয়ে দেয় তাদেরই ক্লাসমেট সুভাষকে ভালোবাসে সে।গ্রাজুয়েশনের মাস ছয়েকের মধ্যেই সুভাষ ব্যাংকে চাকরি পেয়ে যায়। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পর থেকেই সুভাষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল শুধু একটা সরকারি চাকরির।চেষ্টায় সফলতা আসে গ্রাজুয়েশনের ছ'মাস পরে। কিন্তু সুভাষকে জয়েন করতে হয় কলকাতা থেকে বেশ অনেকটাই দূরে সেই বাখরাহাট রুটে বড় কাছারির কাছাকাছি।নিত্য যাতায়াতে দু'ঘণ্টা করে চার ঘন্টা সময় তার চলে যায়। ঝড়-বাদল বা কোন এক্সিডেন্ট যে কোনো কারণ ঘটলেই সেই রুটে বাস থাকে বন্ধ।যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয় ম্যাটাডোর।এবং অনেক সময় তাও পাওয়া যায় না।এই কারণে মহুয়া বুদ্ধি দেয় গ্রাম অঞ্চলে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে সেখানে থাকার।সুভাষ রাজি হয় এবং তারা ওদিকে চলে যায়।থেকে যায় বর্ষার সাথে ফোনে যোগাযোগ। বর্ষার বাবা মহুয়ার বিয়ের আগেই মারা গেছিলেন।বাবার মৃত্যুর পর সংসারে রোজগারের পথটাও বন্ধ হয়ে যায়।বর্ষা তখন প্রচুর টিউশনি করতো।এইভাবেই মা,মেয়ের সংসার চলতো দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে।কিছুদিনের মধ্যে বর্ষার মা ও  চলে যান।এই খবর যখন মহুয়ার কানে যায় তখন সে তাকে বলে তার বাড়িতে একা একা মোটেই ভাল লাগেনা।সুভাষ সেই সকাল বেলায় বেরোয় আর রাতে ফিরে।তাই বর্ষা ইচ্ছা করলে তার কাছে গিয়ে কটা দিন থাকতে পারে।বর্ষা চলে যায় মহুয়ার কাছে। হাসি-ঠাট্টা গল্পগুজবে তিনজনের বেশ ভালোই সময় কাটে।হঠাৎ একদিন মহুয়ার মা মহুয়াকে জানান তার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।তিনি একাই হাসপাতাল বাড়ি ছোটাছুটি করছেন।এই খবর পেয়ে মহুয়া খুবই ভেঙ্গে পড়ে।সে বর্ষার হাতে তার সংসার এবং স্বামীর দায়িত্ব দিয়ে মায়ের কাছে চলে যায়। বাবা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসার পরে সে তার নিজের বাড়িতে সুভাষ এর কাছে ফিরে আসে।কিন্তু ততদিনে মহুয়া অনেকটাই দেরি করে ফেলেছে।গড়ে উঠেছে সুভাষ ও বর্ষার মধ্যে একটা শারীরিক সম্পর্ক।ভালোবাসা তার ভিতরে আছে কিনা মহুয়া জানেনা কিন্তু একদিন রাতে সুভাষকে পাশে দেখতে না পেয়ে সে বাইরে বেরিয়ে বর্ষার ঘরে আলো জ্বলতে দেখে দরজায় কান পেতে শোনে চাপাস্বরে বর্ষা ও সুভাষের  কথাবার্তা।মহুয়ার তখন আর বুঝতে একটুও বাকি থাকল না বদ্ধ দরজার ভিতরে তখন কি চলছে।চোখ ভরা জল আর বুকভরা অভিমান নিয়ে সে তার নিজের ঘরে চলে আসে।কিছুক্ষণ পরে সুভাষ অতি সন্তর্পনে তার পাশে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। 
 সকালবেলা সুভাষ স্বাভাবিক আবার বর্ষাও ঠিক তাই। সুভাষ অফিসে চলে যাওয়ার পর মহুয়া কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে সুমিতের মুখটাই তার সামনে ভেসে ওঠে।সে সুমিত কে ফোন করে দেখা করতে বলে। সুমিতের সাথে দেখা করার জন্য সেই সুদূর গ্রাম অঞ্চল থেকে মহুয়া পৌঁছে যায় কফি হাউজে।তখন দুপুর।সুমিতের সাথে ফেসবুকের মাধ্যমে পুনরায় বন্ধুত্বটা হওয়ায় মাঝে মধ্যে কথাবার্তাও হত মামুলি।
 --- এখন তুই কি করবি এইটা জানতে চাইছিস তো?আমি তোকে বলবো মাথা উঁচু করে বাঁচ।পৃথিবীতে সুন্দর ভাবে বাঁচার জন্য বিয়েটাই একমাত্র শেষ কথা নয়।নিজেকে তৈরি কর।নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত কর। ছেড়ে দে সবকিছু যা তুই পিছনে ফেলে  এসেছিস। আজ এই মুহূর্ত থেকে তুই ভুলে যা যে তোর বিয়ে হয়েছিল।সুভাষকে তুই ভালবাসতিস। যে ভালবাসার মধ্যে বিশ্বাস নেই সেটা আর যাই হোক ভালোবাসা হতে পারে না রে!আমি তোকে বলবো সুভাষের কাছে আর তুই ফিরে যাস না।কিন্তু এ কথা ভাবিস না যে তোকে আমি ভালোবাসি বলে তোকে সুভাষ এর কাছে ফিরে যেতে নিষেধ করছি।আমি তোর বন্ধু ছিলাম, আছি, থাকবো। আমার দরজা তোর জন্য সারা জীবন খোলা থাকবে। কখনো যদি তুই খুব ক্লান্ত হয়ে পরিস তখন না হয় আসিস আমার কাছে কিংবা আমায় ডাকিস।এই আজকের মত দুদণ্ড বসে নিজেদের সুখ দুখের কথা বলে জীবনের মানেটা খুঁজব। কিন্তু আগে নিজের পায়ে দাঁড়া।শুরু কর আবার পড়াশুনা। হায়ার এডুকেশনটা নে। যেভাবেই হোক যে কোন একটা চাকরি খুঁজে নে।সুভাষকে দেখিয়ে দে যে সুভাষের অবহেলা তোকে কোন উচ্চস্তরে নিয়ে গেছে;তুই ভেঙ্গে পরিসনি।হেরে গেছে সুভাষ তোর ভালোবাসা হারিয়ে আর তুই জিতে গেছিস নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে।তুই বর্ষাকে বুঝিয়ে দে বর্ষার এই বেঈমানির জন্য সাময়িক কিছু হারালেও নিজেকে খুঁজে বের করতে পেরেছিস। ভালোভাবে বাঁচ,মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চল।আমাদের বন্ধুত্বটা আজীবন থাকবে।


Saturday, June 5, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩৮)

সুখের ঘরে আগুন (৩৮)

     কিছুটা চক্ষুলজ্জা আর কিছুটা নিয়ম রক্ষা এই দুটো মিলিয়ে নিখিলেশ তাঁর দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাড়িতে ঘণ্টা দুয়েক ছিল।তারপর আবার সে ফিরে আসে নিলয়দের বাড়িতে।রাতের দিকে দুজনেই বেরিয়ে যায়।কাছেপিঠে একটা কফিশপে বসে অম্বিকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
তিনজনে বসে গল্প করতে করতে কফি খেয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে বেরিয়ে পরে।সেখানেও অচলাকে নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হয়।সেক্ষেত্রে নিখিলেশ চুপ করে নিলয় আর অম্বিকার কথা শুনে যায়।
  পরদিন ওদের ভুবনেশ্বর চলে যাওয়ার কথা।সারাটাদিন দুই বন্ধু আজ ঘরে বসেই বাকিদের সাথে আড্ডা দেয়।অচলা বেশ কয়েকবার নানান কাজে সেখানে আসে।নিখিলেশ লক্ষ্য করে অচলার চেহারার বেশ পরিবর্তন হয়েছে।গায়ের রংও ফর্সা হয়েছে।চেহারার মধ্যে বেশ একটা লাবণ্য দেখতে পায়।যাওয়ার সময় নিখিলেশ অচলাকে বলে যায় 
--- মন দিয়ে লেখাপড়া করো।দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে অনেক দূর যেতে হবে।
  অচলা নীচু হয়ে নিলয় ও নিখিলেশকে প্রণাম করে।
   অম্বিকা অনেক ভেবেচিন্তে মনস্থির করে যে বাবাকে আজ রাতে নিলয়ের কথা সবকিছু জানাবে।সে  এটাও জানে তার বাবা এতে আপত্তি করবেন না।আপত্তি করলে করতে পারেন মা।
--- বাবা তোমার সাথে আমার কিছু দরকারী কথা আছে,তুমি আমার ঘরে একটু আসবে?
---এমন কি কথা তর বাবার সাথে যে আমার সামনে কইতে পারবিনা?
--- বাপ মেয়ের আলাদা কথা থাকতেই পারে;সব কথার মধ্যে কথা বলতে আসা ঠিক নয়।তোমার সাথে তোমার মেয়ে যখন ফিসফিস করে কথা বলে সে কথা শোনার জন্য কি আমি কখনও আড়ি পাতি?
--- আজ পর্যন্ত আমার সাথে আমার মাইয়াটা একটা দিনের তরেও ফিসফিস কইরা কোন কথা কয় নাই।ও তো সারা জীবনই বাপ ভক্ত। আমি তো বাপ মেয়ের ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারি না,তাইতো সব সময় ঘরের কোণে পইরা আছি।
 --- হ্যাঁ মা তোমাকেও কথাটা বলবো। তবে সেটা আমি না, তোমাকে বাবা সব কিছু বলবেন।আগে আমি বাবার কাছে সবটা বলে বাবার মতামতটা নিই। তারপর তোমাকে জানাবো। এই কথাটা তোমাদের দুজনেরই জানা দরকার। 
 অমলবাবু হাসতে হাসতে বললেন,
--- খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে হচ্ছে।ঠিক আছে আমি এখনই এখান থেকেই তোর ঘরে চলে যাচ্ছি তুই চলে আয় তোর  খাওয়া-দাওয়া শেষ করে।
  অম্বিকার খাওয়া হয়ে গেলে সে তার ঘরে গিয়ে দেখে তার বাবা তার খাটের উপরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।কিছুক্ষণ খাটের পাশে দাঁড়িয়ে নিজে মনে মনে একটু হেসে নেয়।সে খুব আস্তে আস্তে খাটের উপর বাবার পাশে বসে।সঙ্গে সঙ্গে নরেশবাবুর ঘুমটা ভেঙ্গে যায়।তিনি লাফ দিয়ে খাটের উপর উঠে বসে চোখ ডলতে ডলতে বলেন,
--- চোখটা একটু লেগে এসেছিল।আমি কিন্তু ঘুমাইনি।
 অম্বিকা হাসতে হাসতে বলে,
--- আমি কি বলেছি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?বাবা, তুমি এখনো কিন্তু সেই বাচ্চাই আছো, বড় হওনি।
---  আসলে মেয়ের কাছে বাবারা একটু বাচ্চাই থাকে।কেন জানিস তো? মেয়েরা যে বাবার ভক্ত হয় তাই মেয়ে রুপী মায়ের কাছে তার বাপটা সারা জীবনই বাচ্চা। যাক গে আসল কথায় আসি তোর কি কথা আছে আমার সাথে বলে ফেল।এর পরে তোর মা আবার চেঁচামেচি শুরু করবেন আমার শুতে রাত হয়ে যাচ্ছে বলে।
 অম্বিকা কথাটা যে কিভাবে শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।নিজের বিয়ের কথা আবার নিজেই পছন্দ করেছে হ্যাংলার মত কিভাবে যে বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করেই থাকলো। অম্বিকা কে চুপ করে থাকতে দেখে নরেশবাবু বললেন, 
---কি এত ভাবছিস কিভাবে কথাটা আমায় বলবি? আমি তোকে সাহায্য করছি। সেদিন আমি যখন সন্ধ্যার সময় পাড়ার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম তখন আমার একটু দূরে পাড়ার দুই ভদ্রলোক খুব নিচু স্বরে  তোর আর নিলয়ের কথা বলাবলি করছিলেন। কথাটা আমার কানে এসেছিলো।কিন্তু আমি তোকে কিছু বলিনি।তার একটাই কারণ ছেলেটিকে আমাদের দুজনেই খুব পছন্দ।আমরা প্রথম থেকে চেয়েও ছিলাম ও আমাদের জামাই হোক।কিন্তু তুই নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করতে চাসনি।একটা প্রবাদ বাক্য আছে জানিস? " জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে - তিন বিধাতা নিয়ে।" ছেলেটার জীবনে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে হ্যাঁ আমি এটাকে অ্যাক্সিডেন্টই বলবো। তবে কারণ কিছু জানিনা আর জানার কোন  উপায়ও আমাদের হাতে নেই।একমাত্র তার কাছে তুই জানতে চাইতে পারিস। আর আমি এটা জানি তুই আজ আমাকে যে কথাটা বলতে চাইছিস সেটা নিলয় সম্পর্কিত।তোর মায়ের সাথে আমার এ ব্যাপারে কথা হয়েছে, তারও মত আছে।এখন তোদের সুবিধামতো একটা ডেট নিজেরাই ঠিক করিস।আমাদের কোন আপত্তি নেই।তুই আমাদের একমাত্র সন্তান আর তাছাড়া নিজে চাকরি করিস। তোর সুখের জন্য তোর জীবনের এই সিদ্ধান্তকে আমরা মেনে নেবো সেটা দুজনে আগেই আলোচনা করে রেখেছি।
--- তাহলে তো মা ও সবকিছু জানেন।মাকে ডেকে না এনে খুব অন্যায় করলাম।
--- সেটা ঠিক।তোর মা একটু কষ্ট পেয়েছেন বৈকি!তবে চোখের ইশারায় আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন তুই আমাকে আজ কি বলতে ডেকেছিস।
 কথাটা বলেই তিনি হাসতে লাগলেন।আর অম্বিকা লজ্জায় তখন মাটিতে মিশে যাচ্ছে।
--- বাবা,তুমি একটু বসো আমি মাকে ডেকে নিয়ে আসি।
--- হ্যাঁ সেটাই ভালো।কারণ তিনি তো বসে আছেন না ঘুমিয়ে আমার কাছে সব শুনে ঘুমাবেন বলে।
 আবারও তিনি হাসতে থাকেন।অম্বিকা বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে মাকে এ ঘরে ডেকে আনার জন্য।
  তিনজন বিষয়টা নিয়ে কথাবার্তা বলার সময় অম্বিকা তার বাবা,মাকে জানালো নিলয়ের ডিভোর্সের কারণটা।তারা চুপচাপ শুধু শুনেই গেলেন।ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নরেশবাবু বলতে বলতে বেরোলেন," কপালে যা আছে তাতো ঘটবেই।বিধাতার লিখন কে খন্ডাবে ?"
সেদিন রাতেই অম্বিকা নিলয়কে ফোন করে সবকিছু জানায়।অম্বিকার ফোন আসার সাথে সাথেই নিখিলেশ তাকে বলে,
--- ওই তোর শ্যামের বাঁশি বাজছে।তুই কথা বল আমি ওদিকের সিটটা ফাঁকা আছে ওখানে গিয়ে বসছি।
দুজনে তখন ট্রেনে।বন্ধুর কথা শুনে নিলয় বললো,
--- আরে না,এখানেই বোস।ফোন তো আমার কানে থাকবে।
 অম্বিকা ফোনেই তার বাবা,মায়ের মত আছে এ বিয়েতে সে কথা জানিয়ে দিলো।নিলয়ও সে কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বললো,
--- বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেলো যেন।দমকা হওয়ার মত জীবন থেকে হঠাৎ করেই যেন খুশিটা হারিয়ে গেছিলো।আমার জীবনের অনেক কথায় তোর অজানা ;সবকিছু বলে উঠার সময় পাইনি।একদিন সময় করে সবই বলবো।তাই অম্বিকার সাথে আমার সম্পর্কটা নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলাম।এত সহজে যে ওর বাবা,মা সব মেনে নেবেন ভাবতেই পারিনি।
--- কেন কিসের জন্য মানবেন না বলে তোর মনে হয়েছিল?ভালো চাকরি করিস,দেখতে মন্দ নয়,পরিবারের একমাত্র ছেলে ।না মেনে নেওয়ার কারণটাই তো বুঝতে পারছি না।
--- আমার একটা অতীত আছে যা তোর অজানা।অম্বিকার বাড়ি শুধু নয় পুরো পাড়ার লোক সবটাই জানে।সেটা নিয়েই একটু ভয় ছিল।
--- কি সেই অতীত?
--- বলবো বন্ধু এবার সব বলবো।তবে এখন এই ট্রেনের মধ্যে নয়।

ক্রমশঃ 

Thursday, June 3, 2021

শিরদাঁড়া

শিরদাঁড়া

"দূর থেকে তার ছায়া দেখতে পেলাম, আমার দিকেই সে এগিয়ে আসছে"। অনেকগুলো বছর তার সাথে ছাড়াছাড়ি থাকলেও অন্ধকারের ভিতর তাকে দেখতে পেয়েও আমার তাকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি।একটু একটু করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসছে আর ছায়াটা স্পষ্ট হচ্ছে।সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত আমি ফিরে যাচ্ছি আমার ফেলে আসা অতীতে।
  ভালোবেসে সুমনকে বিয়ে করেছিলাম।সেও আমায় খুব ভালবাসতো।অন্তত তখন আমি তাই জানতাম।দুবাড়ির থেকে আমাদের বিয়েটা মেনেও নিয়েছিল। সুমনকে বিয়ে করার দুমাস পর আমি বুঝতে পারি যে সুমনকে আমি ভালবাসতাম আর যে সুমনকে আমি বিয়ে করেছি দুটো মানুষ সম্পূর্ণ আলাদা।প্রেম করার সময় আমি সুমনের বাইরের চেহারাটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বেশিক্ষণ সময় যেহেতু তার সাথে বিয়ের আগে কাটাইনি তাই তার ভেতরের চেহারাটা আমি বুঝতেই পারিনি।বুঝতে পারলাম দ্বিতীয় মাসে মাইনে পাওয়ার পর। 
  আমি একটা ম্যালটিন্যশনাল কোম্পানিতে মোটা মাইনের চাকরি করি।প্রথম মাসে মাইনে পাওয়ার পর অফিস থেকেই বাপের বাড়িতে গিয়ে মায়ের হাতে যে টাকাটা দিতাম সেটা দিয়ে আসি।কারণ বাবা অনেকদিন আগেই রিটায়ার করেছেন।কোন পেনশনও নেই।এককালীন যা সামান্য কিছু টাকা পেয়েছিলেন বছর খানেক ওই জমানো টাকাতেই টুকটাক করে তিনজনে চালিয়ে নিয়েছি।তারপর আমার এই চাকরি পাওয়া।এরপর থেকে আমার টাকাতেই সংসার চলত।যেহেতু আমাদের পরিবারের আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম সেহেতু এই মুহূর্তে আমি বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। সে কারণটা আমি সুমনকে জানিয়েছিলাম।সুমন আমাকে বলেছিল,
--- ধুর পাগলী, এটা কোনো সমস্যা?তুমি যেমন মাকে টাকা দাও ঠিক সেরকমই দেবে।সেক্ষেত্রে আমি কোনদিনও তোমায় বাঁধা দেবোনা।আমার ভালো লেগেছিলো সুমনের কথা শুনে।তাই আমিও বিয়েতে রাজী হয়ে গেলাম।
 প্রথম মাসে মাকে টাকা দিয়ে এসে আমি শ্বাশুড়ির হাতে কিছু টাকা সংসারের পিছনে খরচ করার জন্য হাতে ধরিয়ে দিই। যদিও তিনি বারবার বলেন এসব ব্যাপারে তাকে না জড়াতে।আমি যেন তার ছেলের হাতেই টাকাটা দিই।কিন্তু আমি রাজি হই না।কারণ সুমন ভালো চাকরি করে;সে ক্ষেত্রে শ্বাশুড়ি মায়ের সব সময় ছেলের কাছ থেকে টাকা চেয়ে কিছু কেনার থেকে তার হাতে যদি টাকা থাকে তিনি নিজেই সেটা তার ইচ্ছামত খরচ করতে পারবেন।আমি জোর করে তার হাতে টাকা রেখে আসি।কিন্তু দ্বিতীয় মাসে আমাকে অবাক করে দিয়ে মাইনে হওয়ার দিন আমি যখন অফিস থেকে বেরোচ্ছি দেখি সুমন দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দেখে একগাল হেসে বলল,
---তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম তাই ভাবলাম একসাথে বাড়ি ফিরবো।আমি তখন তাকে বললাম,
--- কিন্তু আমি তো আগে মায়ের কাছে যাবো মায়ের হাতে সংসার খরচের টাকাটা দিতে। সুমন আমাকে বলল,
--- আরে আজকেই দিতে হবে কেন?তুমি কাল অফিসের পথে দিয়ে এসো। তখনও আমি বুঝতে পারিনি সুমনের আসল উদ্দেশ্য কি?আমি তার সাথে বাড়ি ফিরে আসলাম। মাকে ফোন করে বলে দিলাম কাল অফিসের পথে বাড়িতে যাবো। সেদিন রাতে আমাকে আদর করতে করতে সুমন আমাকে বলল,তার একজনের কাছে বেশ কিছু টাকা লোন আছে।সেই টাকাটা তাকে দিতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সুমনের কাছে কোন টাকা পয়সা নেই।আমি যদি কোনভাবে সুমনকে সাহায্য করতে পারি তাহলে তার খুব উপকার হয়।আমি তার কাছে জানতে চাইলাম,
---কত টাকা?
সে বলল,
---হাজার পঞ্চাশেক।
আমি তাকে জানালাম এই মুহূর্তে আমার কাছে অত টাকা হবে না।তবে কিছু দিয়ে সাহায্য করতে পারি।সুমন আপাতত তাতেই রাজি হল। আমি সুমনের হাতে পরদিন ব্যাংক থেকে তুলে এনে হাজার দশেক টাকা দিলাম।কিন্তু এইপর প্রতিদিনই সুমন কোন না কোন কাজের বাহানা দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিতে শুরু করলো।প্রথমদিকে ব্যাপারটা একদম বুঝতে পারিনি।কিন্তু দিন যত এগোতে লাগলো সে আমার বাপের বাড়িতে টাকা দেওয়া নিয়েও আমাকে টোনটিং  করা থেকে শুরু করে নানান ছুতোয় আমার কাছ থেকে নানান ভাবে টাকা আদায় করতে থাকে।একদিন আমি তার প্রতিবাদ করায় সে আমাকে জানায়,
--- থাকবে এখানে, খাবে এখানে, অসুখ বিসুখ হলে দেখবো আমি, খরচ করবো আমি আর টাকা দেওয়ার বেলায় বাপের বাড়ি?
--- কিন্তু আমি তো শুধু তোমার বাড়িতেই থাকি।আমি মায়ের হাতে যে টাকাটা ধরিয়ে দিই একজন মানুষের খাওয়া, থাকার বিনিময়ে এর থেকে বেশি লাগেনা।তাছাড়া অফিসে যাওয়ার আগে রান্নাটা করেই বেরোই কারণ রাধুনির হাতের রান্না তো তোমার আবার মুখে রোচে না।তবে কোন অবস্থাতেই বাপের বাড়িতে টাকা দেওয়া আমি বন্ধ করবো না।আমি তাদের একমাত্র সন্তান।অনেক কষ্টে তারা আমাকে এই জায়গাটায় দাঁড় করিয়েছেন।আর বেনিফিটটা শুধু এ বাড়ির লোকেরা পাবেন আর আমার বাবা-মা অর্থের অভাবে কষ্ট করবেন এটা আমি কিছুতেই মেনে নেবো না।এতে যদি তোমার সমস্যা হয় অনায়াসে তুমি আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিতে পারো।
 অশান্তির সূত্রপাত সেই শুরু। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমার শ্বাশুড়ি মা সম্পূর্ণভাবে আমার পক্ষে থেকে ছেলের সাথে অনেক সময় ঝামেলায় জড়িয়ে গেছেন। নিত্য অশান্তি আর তিক্ততার মাঝেও আমি কখনোই বাপের বাড়িতে টাকা দেওয়া বন্ধ করিনি।নিজের শিরদাঁড়াটা সোজাই রেখেছি।এইভাবে এক বছর পর যেদিন সুমন আমার গায়ে হাত তোলে তার পরদিন বাবার দেওয়ার গয়নাগাটি নিয়ে আমি  সুমনের সামনে থেকে ও বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসি। ছ'মাস পর উকিল এর মাধ্যমে ডিভোর্সের চিঠি পাঠাই।তারপরে সুমন বেশ কয়েকবার আমাকে ফোন করার চেষ্টা করে।কিন্তু আমি ফোন ধরি না।ডিভোর্সটা পেতে আমার খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি।আমি বাবা মায়ের কাছে এসে সময়ের সাথে সবকিছু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি।কিছুটা সফলতা অর্জনও করি।কিন্তু কখনো কখনো একাকী মনের মধ্যে বিয়ের আগের স্মৃতি গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।কারণ বিয়ের পরে সুমনের সাথে সত্যিই আমার কোন সুখস্মৃতি নেই।
  এইভাবে বছর ছয়েক কেটে যায়।এক বছরের ব্যবধানে বাবা-মা দু'জনকেই হারিয়ে ফেলি।আগে চলে যান বাবা তারপর মা।আমি খুব একা হয়ে পড়ি।যেটুকু সময় অফিসে থাকি সেই সময়টুকুই সবকিছু ভুলে থাকি।অফিস থেকে বাড়ি ফিরে ফাঁকা ঘরে মা,বাবার স্মৃতিগুলি আমায় যেন ঘিরে ধরে। একদিন অফিস থেকে ফিরে অন্ধকার বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম।হঠাৎ দেখি সুমন এগিয়ে আসছে।সুমনকে দেখতে পেয়ে সত্যি বলতে কি আমি একটুও খুশি হতে পারিনি।শেষে গেটের কাছে এসে দাঁড়ালে আমি গেটের তালা  খুলে দিতে বাধ্য হই। ভদ্রতা বলেও তো একটা কথা আছে! সুমন আমাকে সবকিছু ভুলে আবার ফিরে যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করে।এমনকি হাত দুটি ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে ফিরে যাওয়ার জন্যও অনুরোধ করতে থাকে।কিন্তু সুমনের এই অভিনয় সেদিন আমি ধরে ফেলি।যেহেতু বাবা মা বেঁচে নেই সে যদি আমাকে আবার তার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে তাহলে  মাইনের পুরো টাকাটা তার থাকবে। কিন্তু আমি আমার শিরদাঁড়াটাকে সোজা রেখে সেদিনও সুমনকে ফিরিয়ে দিই এবং তাকে ভালভাবে বুঝিয়ে দিই আমার মৃত্যুর পর আমার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি একটি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবে এবং আমি তার সমস্ত রকম ব্যবস্থা করেই রেখেছি। সুমন মাথা নিচু করে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
 না সেদিন আমার একটুও কষ্ট হয়নি।আমার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসেনি।ছেলেবেলায় বাবা শিখিয়েছিলেন শিরদাঁড়া সোজা রেখে মাথা উঁচু করে বাঁচতে।আমি আজও সেই ভাবেই বেঁচে আছি।



Tuesday, June 1, 2021

অসহায় আজ সবাই

অসহায় আজ সবাই

 "মেয়েটার সমস্ত ভাবনা জুড়ে ওই ছেলেটার আনাগোনা"-কথাগুলো বলে হৃদয়নাথ একটু থামলেন।তিনি মুখ নিচু করেই বন্ধু অখিলেশের সাথে কথা বলছিলেন। এবার তিনি মুখটা তুলে বন্ধুর দিকে যখন তাকালেন অখিলেশ দেখতে পেলেন হৃদয়নাথের চোখ দুটি জলে ভর্তি। সেই কোন স্কুল লাইফ থেকে হৃদয়নাথ ও অখিলেশ হরিহর আত্মা দুই বন্ধু। স্কুল, কলেজ লাইফ শেষ করে ঘটনাক্রমে তারা একই প্রফেশনে চাকরি পেয়ে গেলেন।কিন্তু জায়গাটা একটু ভিন্ন হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই দুই বন্ধু একই স্কুলে  চলে আসেন।তারপর রিটায়ার করার পূর্ব পর্যন্ত তারা একই স্কুলে থাকেন।দুজনের রিটায়ারমেন্ট এর ব্যবধান আট মাসের।বাড়ি একই পাড়ায়।ছেলেবেলা থেকে হৃদয়নাথ যে নরম মনের মানুষ একথা অখিলেশ জানতেন।সংসার বা নিজের জীবনের যেকোনো রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তিনি তার বন্ধু  অখিলেশের কাছে সুপরামর্শের জন্য ছুটে এসেছেন। আর অখিলেশ তাকে নানান ভাবে নানান কাজে পরামর্শ দিয়ে সঠিক পথের সন্ধান যুগিয়েছেন। কেউ বিপদে পড়লে বা রাস্তাঘাটে কেউ অসহায় হয়ে পড়লে,অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তখনই তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 
   সেদিন গিন্নির সাথে একটা বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ সেরে তিনি ও গিন্নি যখন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা বাস বা ট্যাক্সির আশায় তখন তিনি দেখতে পান চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে বাসস্ট্যান্ডে এক কোণে একটি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্বভাবসুলভ কৌতূহলবশত তিনি মেয়েটির দিকে এগিয়ে যান। এবং তার কাছে জানতে চান এত রাতে একাকী সে কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছে?মেয়েটি প্রথমে হৃদয়নাথের সাথে কথা বলতে ইতস্তত করলেও পরে সমস্ত ঘটনা সে পুঙ্খানুপুঙ্খ হৃদয়নাথকে জানায়।
 অখিলেশবাবু সব শুনে বললেন,
--- তাহলে এখন কি করা যায় মেয়েটিকে নিয়ে?এই মুহূর্তে এত বড় আঘাত ও মেনে নিতে পারবে না।কটা দিন যেতে দে।তারপর ধীরে সুস্থে মেয়েটিকে সব জানানো যাবে।
--- কিন্তু এত বড় শোক ও কি সহ্য করতে পারবে।
--- দেখা যাক।তবে মেয়েটিকে তুই আর বৌঠান মিলে একটু চোখে চোখে রাখিস কোন অঘটন ঘটিয়ে না ফেলে।
--- এই ভয়টা আমারও করছে রে!
  বাপ,মা হারানো সুচরিতা দূরসম্পর্কের এক কাকার বাড়িতে মানুষ।কাকিমার কোন সন্তান না থাকায় মায়ের অভাব সে বুঝতে না পারলেও লোভী কাকা তার খাওয়াপরার যাবতীয় খরচ উসুল করতেই কাকিমার মৃত্যুর দ্বিতীয় দিনেই তাকে বিক্রির ব্যবস্থা করে ফেলেন।কপাল ভালো তাই ভেজানো দরজার বাইরে থেকে কাকা ও অপরিচিত একজনের সমস্ত কথা তার কানে আসে।সুচরিতা ভালোবাসতো পাড়ার মুদিখানার দোকানের মালিক সুনীলকে।মাকে নিয়ে সুনীল দোকান থেকে বেশ খানিকটা দূরেই বাস করতো।কাকিমা থাকতেই সুনীলের সাথে তার বিয়েটা দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।কিন্তু দেশের এই চরম ভয়াবহতার দিনে সুনীলের মা হঠাৎ করেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।সুনীল একা বাড়ি।এই অবস্থায় একটা যুবতী মেয়েকে ঘরে এনে সে আশ্রয় দিতে পারে না।তাই ভেবেছিলো আশৌচ পালন না হওয়া পর্যন্ত তার কোন আত্মীয়ের বাসায় তাকে রেখে দেবে।সুনীল সুচরিতাকে সাথে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে কাকার বাড়ি থেকে একবারেই বেরিয়ে আসতে বলে।সুচরিতা আসেও তাই।কিন্তু সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা অবধি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকেও সুনীলের দেখা পায় না।সেখানে পরিচয় হয় হৃদয়নাথবাবুর সাথে।
 সুচরিতার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তিনি যখন সুনীলের বাড়ি পৌঁছলেন তখন পাড়ার লোক মারফত জানতে পারলেন প্রশাসনের মাধ্যমে মায়ের সৎকার হলেও সেদিন রাত থেকেই সে জ্বরে বেহুস ছিল। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দুদিনের মাথায় এতটাই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিলো বেশিদিন আর মাকে ছেড়ে থাকতে হয়নি।এই খবর নিয়ে হৃদয়নাথবাবু ফিরে আসলেও সে খবর তিনি সুচরিতাকে দিতে পারেননি তিনি বাইরে থেকে ফিরে আসার পর সুচরিতার সুনীলের খবর জানার  আগ্রহ দেখে।কিন্তু কতদিন তিনি মেয়েটির কাছ থেকে এই দুঃসংবাদটি লুকিয়ে রাখবেন?পৃথিবী ব্যাপী যে ভয়াবহতা শুরু হয়েছে তাতে যে কত মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে কখনো বা পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে --- এর শেষ কোথায়? আস্তে আস্তে সবকিছুই তো স্বাভাবিক হচ্ছিল ।গাড়ি,বাস সবই চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ করেই ভয়াবহতা বেড়ে গেলো।মেয়েটির যে সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে সুনীল রয়েছে।কিভাবে মেয়েটিকে তিনি মানসিকভাবে সাপোর্ট দেবেন এটাই সর্বক্ষণের চিন্তা তার এখন।

সত্যেরে লও সহজে

সত্যেরে লও সহজে

"ভালো হোক বা মন্দ হোক প্রত্যেক মানুষের বাঁচার জন্য প্রয়োজন তার পরিবারের প্রিয় মানুষগুলো"--- আজ এ কথাটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে অরুন ব্যানার্জী।বেশিদিন আগের কথা নয়।মা,বাবা পছন্দ করে তার বিয়ে দিলেন অমৃতার সাথে। অরুন তাকে নিয়ে সুখীই ছিলো।অমৃতা আহামরি সুন্দরী না হলেও দেখতে মন্দ ছিল না।বলতে গেলে গৃহকর্মে সে ছিল ভীষণ পারদর্শী।বৌভাতের পরদিন থেকেই সে স্বইচ্ছায় সংসারের যাবতীয় কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল।ভীষণ বুদ্ধিমতী অমৃতা সংসারে প্রবেশ করেই বুঝতে পেরেছিল বয়স্ক শ্বশুর,শ্বাশুড়ীকে দিয়ে সংসারের কোন কাজ করানো ঠিক হবে না।কারণ এতে তাদের কষ্টই হবে আর স্বামীর কাছে এই কারণে সে ছোট হবে।অরুনের মা,বাবাকে কষ্ট দিলে তার প্রতি অরুনের ভালোবাসা কমবে।বুদ্ধিমতী অমৃতা ন্যায়নীতি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল ছিলো।সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো নিজের মা,বাবার জায়গাটা কাউকেই দেওয়া যায় না ঠিকই কিন্তু স্বামীর মা,বাবাকে তো কিছুটা ভালোবাসা দেওয়া যেতেই পারে।আর অরুনও তাতে খুশিই হবে।সংসার মানেই তো পরিবারের সকল মানুষের পাশে থেকে তাদের সুখে সুখী হওয়া তাদের দুখে দুখী হওয়া।একটা সুখী পরিবার গড়তে গেলে অনেক সময় অনেক কিছুই মানিয়ে নিতে হয়।
 বিয়ের এক বছরের মধ্যেই অরুনদের বাড়ি, পাড়া-প্রতিবেশী এবং অরুনদের সমস্ত আত্মিয়বন্ধুর মধ্যে অমৃতার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো।কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল বিষয়টা প্রথম প্রথম অরুনের ভালো লাগলেও খুব ভালো কখনোই লাগেনি। পরের দিকে নিজের স্ত্রীর গুণকীর্তন অন্যের মুখে শুনলেই তার সমস্ত রাগ এসে পড়তো অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অমৃতার উপর। অমৃতা নিজে তো নয়ই তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি হঠাৎ করে অরুনের মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখে তারা নিজেরাও অবাক হয়ে গেলেন।দিনকে দিন অরুন তার নিজের স্ত্রীকেই হিংসা করতে শুরু করলো।মা,বাবার শত অনুরোধ,দিনরাতে তাকে বুঝিয়েও কোন পরিবর্তন তার মধ্যে আনা গেলো না।কেমন যেন সে মানসিক রোগী হয়ে উঠতে লাগলো।অমৃতা চেষ্টা করেছিল তাকে ডক্টর দেখানোর কিন্তু সেদিন তার গায়ে অরুনের হাত উঠেছিলো।রাতে ঘরের ভিতর চিৎকার,চেঁচামেচি শুনে অরুনের মা,বাবা ছুটে এসে বন্ধ দরজায় আঘাত করে জোর পূর্বক দরজা খুলে দেখেছিলেন অমৃতা অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে আর তার কপাল ফেঁটে রক্ত বেরোচ্ছে।বাবা ছেলেকে মারতে উদ্যত হলে তার মা চিৎকার করে বলেন,
--- শাসন করার পরিস্থিতিতে আজ ও আর নেই।আগে মেয়েটির জ্ঞান ফেরায় ওকে বাঁচাই পরে ওর ব্যবস্থা আমরা করতে না পারলে পুলিশের হাতে ছেড়ে দেবো।
  সেই মুহূর্তে অরুন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
  তারপর কেটে গেছে পাঁচ,পাঁচটি বছর।অরুন আর বাড়ি ফিরে আসেনি।অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও তার কোন হদিস পাওয়া যায়নি।পরের মাসেই অমৃতা বুঝতে পারে সে মা হতে চলেছে।ছেলের বয়স এখন চার বছর।বাড়ির এই তিনটি প্রাণী সকলের অরুনের কথা প্রতি মুহূর্তে মনে পড়লেও কখনোই তারা একের সাথে অন্যে অরুনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না।শুন্যতা যার যার বুকের ভিতর সেই সেই চাপা দিয়েই রাখে।।দীর্ঘদিন অফিসে না যাওয়ার কারণে তার চাকরিটাও সে খুইয়েছে।
  অরুনের দূর সম্পর্কের এক মামার পরিবার বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর ভ্রমণের উদ্দেশ্যে গিয়ে শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে একটা দোকানের সামনে অরুনকে আবিস্কার করেন সম্পূর্ণ উন্মাদ অবস্থায়।তারা সেখানে আর কাল বিলম্ব না করে সেদিনই তাদের গাড়িতে করে অরুনকে নিয়ে ফিরে আসেন অরুনদের বাড়িতে।ডাক্তারের পরামর্শ আর সেবাযত্নের ফলে অরুন ফিরে পায় তার পূর্ব জীবন।ফিরে পায় তার স্ত্রী,সন্তান আর মা বাবাকে।সকলের কাছে সে ক্ষমা চেয়ে নেয়।শুরু হয় তার নূতন করে পথ চলা।চেষ্টা করে আবার রোজগারের একটা পথ খুঁজে নেওয়ার।ভীষণভাবে উপলব্ধি করে সংসার জীবনে ভালো মন্দ যে ঝড় ই আসুক না কেনো সকলে মিলে এক জায়গায়,একসাথে থাকাটাই জীবনে মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।

অসহায় আজ সবাই

অসহায় আজ সবাই

 "মেয়েটার সমস্ত ভাবনা জুড়ে ওই ছেলেটার আনাগোনা"-কথাগুলো বলে হৃদয়নাথ একটু থামলেন।তিনি মুখ নিচু করেই বন্ধু অখিলেশের সাথে কথা বলছিলেন। এবার তিনি মুখটা তুলে বন্ধুর দিকে যখন তাকালেন অখিলেশ দেখতে পেলেন হৃদয়নাথের চোখ দুটি জলে ভর্তি। সেই কোন স্কুল লাইফ থেকে হৃদয়নাথ ও অখিলেশ হরিহর আত্মা দুই বন্ধু। স্কুল, কলেজ লাইফ শেষ করে ঘটনাক্রমে তারা একই প্রফেশনে চাকরি পেয়ে গেলেন।কিন্তু জায়গাটা একটু ভিন্ন হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই দুই বন্ধু একই স্কুলে  চলে আসেন।তারপর রিটায়ার করার পূর্ব পর্যন্ত তারা একই স্কুলে থাকেন।দুজনের রিটায়ারমেন্ট এর ব্যবধান আট মাসের।বাড়ি একই পাড়ায়।ছেলেবেলা থেকে হৃদয়নাথ যে নরম মনের মানুষ একথা অখিলেশ জানতেন।সংসার বা নিজের জীবনের যেকোনো রকম সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে তিনি তার বন্ধু  অখিলেশের কাছে সুপরামর্শের জন্য ছুটে এসেছেন। আর অখিলেশ তাকে নানান ভাবে নানান কাজে পরামর্শ দিয়ে সঠিক পথের সন্ধান যুগিয়েছেন। কেউ বিপদে পড়লে বা রাস্তাঘাটে কেউ অসহায় হয়ে পড়লে,অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তখনই তাকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। 
   সেদিন গিন্নির সাথে একটা বিয়ে বাড়ির নিমন্ত্রণ সেরে তিনি ও গিন্নি যখন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা বাস বা ট্যাক্সির আশায় তখন তিনি দেখতে পান চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি মেয়ে বাসস্ট্যান্ডে এক কোণে একটি ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্বভাবসুলভ কৌতূহলবশত তিনি মেয়েটির দিকে এগিয়ে যান। এবং তার কাছে জানতে চান এত রাতে একাকী সে কেন এখানে দাঁড়িয়ে আছে?মেয়েটি প্রথমে হৃদয়নাথের সাথে কথা বলতে ইতস্তত করলেও পরে সমস্ত ঘটনা সে পুঙ্খানুপুঙ্খ হৃদয়নাথকে জানায়।
 অখিলেশবাবু সব শুনে বললেন,
--- তাহলে এখন কি করা যায় মেয়েটিকে নিয়ে?এই মুহূর্তে এত বড় আঘাত ও মেনে নিতে পারবে না।কটা দিন যেতে দে।তারপর ধীরে সুস্থে মেয়েটিকে সব জানানো যাবে।
--- কিন্তু এত বড় শোক ও কি সহ্য করতে পারবে।
--- দেখা যাক।তবে মেয়েটিকে তুই আর বৌঠান মিলে একটু চোখে চোখে রাখিস কোন অঘটন ঘটিয়ে না ফেলে।
--- এই ভয়টা আমারও করছে রে!
  বাপ,মা হারানো সুচরিতা দূরসম্পর্কের এক কাকার বাড়িতে মানুষ।কাকিমার কোন সন্তান না থাকায় মায়ের অভাব সে বুঝতে না পারলেও লোভী কাকা তার খাওয়াপরার যাবতীয় খরচ উসুল করতেই কাকিমার মৃত্যুর দ্বিতীয় দিনেই তাকে বিক্রির ব্যবস্থা করে ফেলেন।কপাল ভালো তাই ভেজানো দরজার বাইরে থেকে কাকা ও অপরিচিত একজনের সমস্ত কথা তার কানে আসে।সুচরিতা ভালোবাসতো পাড়ার মুদিখানার দোকানের মালিক সুনীলকে।মাকে নিয়ে সুনীল দোকান থেকে বেশ খানিকটা দূরেই বাস করতো।কাকিমা থাকতেই সুনীলের সাথে তার বিয়েটা দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।কিন্তু দেশের এই চরম ভয়াবহতার দিনে সুনীলের মা হঠাৎ করেই কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।সুনীল একা বাড়ি।এই অবস্থায় একটা যুবতী মেয়েকে ঘরে এনে সে আশ্রয় দিতে পারে না।তাই ভেবেছিলো আশৌচ পালন না হওয়া পর্যন্ত তার কোন আত্মীয়ের বাসায় তাকে রেখে দেবে।সুনীল সুচরিতাকে সাথে নিয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাকে কাকার বাড়ি থেকে একবারেই বেরিয়ে আসতে বলে।সুচরিতা আসেও তাই।কিন্তু সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা অবধি বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকেও সুনীলের দেখা পায় না।সেখানে পরিচয় হয় হৃদয়নাথবাবুর সাথে।
 সুচরিতার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তিনি যখন সুনীলের বাড়ি পৌঁছলেন তখন পাড়ার লোক মারফত জানতে পারলেন প্রশাসনের মাধ্যমে মায়ের সৎকার হলেও সেদিন রাত থেকেই সে জ্বরে বেহুস ছিল। কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দুদিনের মাথায় এতটাই বাড়াবাড়ি হয়ে গেছিলো বেশিদিন আর মাকে ছেড়ে থাকতে হয়নি।এই খবর নিয়ে হৃদয়নাথবাবু ফিরে আসলেও সে খবর তিনি সুচরিতাকে দিতে পারেননি তিনি বাইরে থেকে ফিরে আসার পর সুচরিতার সুনীলের খবর জানার  আগ্রহ দেখে।কিন্তু কতদিন তিনি মেয়েটির কাছ থেকে এই দুঃসংবাদটি লুকিয়ে রাখবেন?পৃথিবী ব্যাপী যে ভয়াবহতা শুরু হয়েছে তাতে যে কত মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে কখনো বা পুরো পরিবারটাই শেষ হয়ে যাচ্ছে --- এর শেষ কোথায়? আস্তে আস্তে সবকিছুই তো স্বাভাবিক হচ্ছিল ।গাড়ি,বাস সবই চলছিলো।কিন্তু হঠাৎ করেই ভয়াবহতা বেড়ে গেলো।মেয়েটির যে সমস্ত মনপ্রাণ জুড়ে সুনীল রয়েছে।কিভাবে মেয়েটিকে তিনি মানসিকভাবে সাপোর্ট দেবেন এটাই সর্বক্ষণের চিন্তা তার এখন।