Sunday, December 27, 2020

সুখের ঘরে আগুন ( একাদশ পর্ব)

সুখের ঘরে আগুন (একাদশ পর্ব)

  শালিনী বুঝতে পারে কোনো অবস্থাতেই নিলয় তার সাথে আর কোন ব্যাপারেই কথা বলবেনা। সেও চুপ করে যায় ।বাড়িতে  মেয়ে আর নূতন জামাই ঢোকার সাথে সাথে শুরু হয় শাঁখ ও উলুধ্বনি সহকারে জামাই বরণ। মনের ভিতরে একটা অস্থিরতা কাজ করলেও নিলয় এই মুহূর্তে চুপ করেই থাকে। পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলের সাথে নিলয় হাসিঠাট্টায় মশগুল। কাউকেই সে বুঝতে দিতে নারাজ তারও শালিনীর ভিতরকার ব্যাপারটা। কিন্তু শালিনী বহুবার চেষ্টা করেছে এত কিছু সত্ত্বেও নিলয়ের সাথে একটু আলাদা ভাবে কথা বলার ।কিন্তু নিলয় তাকে সে সুযোগ দেয়নি।
  রাতে ঘরে শুতে গিয়ে ঘরে একটা ছোট খাট দেখে নিলয় এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছু খোঁজার চেষ্টা করে ।শালিনী বুঝতে পারে এবং ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে একটা মাদুর নিয়ে ।নিচুতে সে একটা বিছানা করে এবং নিজেই নিচে শুয়ে পড়ে। নিলয় তাকে অনুরোধ করে উপরে উঠে শুতে ; কিন্তু শালিনী সেকথার কোন জবাব দেয় না। রাতটা এভাবেই কেটে যায় ।শালিনী আর কখনো চেষ্টা করেনি নিলয়ের সাথে কথা বলবার কারন সে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে নিলয় তার সাথে কোন কথাই বলবে না। বিয়ের আগের দিন রাতে নিলয়কে কথাগুলো বলার জন্য এখন তার  নিজের হাত নিজেকেই কামড়াতে ইচ্ছা করছে ।সে ভাবতেও পারেনি তার জীবনে হঠাৎ করে এরূপ একটি ঘটনা ঘটবে। এই ঘটনার জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। শংকর যে তার সাথে এরূপ একটি ঘটনা ঘটাবে তা তার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। সেতো শঙ্করকে ভালোবেসে, বিশ্বাস করে বিয়ের আগের দিন রাতে তার হবু স্বামীকে তার ছেলেবেলার ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল।
  পরদিন সকাল থেকেই নিলয় বাড়ি যাবার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরলো। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী অষ্টমঙ্গলায় শ্বশুর বাড়িতে এসে আড়াই দিন থাকতে হয়। বারবার শালিনীর বাবা-মা তাকে অনুরোধ করে। সে একটি কথাই শুধু বলে,
---  কাল অফিস আছে।
কিন্তু শালিনী খুব ভালোভাবে জানে নিলয়ের এখনো তিনদিন ছুটি।সে  এখানে থাকবে না বলেই বাবা-মাকে জানাচ্ছে কাল তার অফিস আছে। সবকিছু বুঝেও শালিনী চুপ করে থাকে। কারন সে নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরেছে। তবুও সুযোগ পেয়ে একসময় সে নিলয় কে বলে,
--- আপনার তো এখনো তিনদিন ছুটি বাকি আছে যদি খুব অসুবিধা না হয় আরেকটি দিন এখানে থেকে যান। তাতে আশা করি আপনার বিশ্বাস কোন ক্ষতি হবে না।
--- আপনার কথাটা আমি মেনে নিলাম। তবে কাল আমি বাড়ি ফিরবো আপনি এখানেই  থাকবেন আমি সময় মত ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেব।
  কথাটা শুনে শালিনী চমকে ওঠে। কিন্তু ওর কিছু করার নেই  ও তো নিজেই নিজের কবর খুঁড়ে আছে। ইচ্ছা থাকলেও নিলয় কে  ও আর ধরে রাখতে পারবেনা। শালিনী কোন উত্তর দি লো না দেখে নিলয় পুনরায় তাকে বলল,
---এটলিস্ট  ছমাস আলাদা থাকতেই হবে ।তা না হলে তো ডিভোর্স পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ আপনি ইচ্ছে করলে খোরপোষ দাবি করতে পারেন তবে আমার মনে হয় আমাদের বিয়েটা যেহেতু লোকদেখানো ছিল সেই কারণে এই খোরপোষটা মনেহয় ধোপে টিকবে না। আপনার ইচ্ছা হলে এটা করতেই পারেন আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব বিনা প্রতিবাদে আপনার দাবি পূরণের। আপনি আপনার বাবা মাকে কি বলবেন সেটা আপনার ব্যাপার। আমি আমার বাবা মাকে ঠিক ম্যানেজ করে নেব। আপনার কিছু জামাকাপড় আর হয়তোবা কিছু গয়নাগাটি ওই বাড়িতে আছে আমি একসময় লোক মারফত ওগুলো পাঠিয়ে দেব। তবে এবার আমি চলে যাওয়ার পর পরবর্তীতে আপনার সাথে আমার দেখা হবে কোর্টে।
 শালিনী একটা কথারও উত্তর করেনা। ঘরে  নাইট লাইট জ্বলছিল। সেই লাইটের আলোতে নিলয় দেখতেও পেলো না শালিনীর চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় জল পড়ে চলেছে। নিলয় ঘুমিয়ে পরল আর শালিনী সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারলো না। শুধু চোখের থেকে নোনা জল ঝরে বালিশ ভিজিয়ে দিল।
  শালিনীর জীবনে শংকর এসেছিল ঝড়ের মতন সেই স্কুল লাইফ থেকে। শালিনী একদিন স্কুল যাবার পথে কিছু ছেলের   টোন টিটকারীর শিকার হয়।আ র তা থেকে শালিনিকে রক্ষা করেছিল শংকর। সেই থেকেই শংকরের সাথে তার পরিচয় ।গরিব ঘরের ছেলে সে। টিউশনি করে পড়াশোনা করে ।শালিনী যখন মাধ্যমিক দেবে শংকর সে বছরই উচ্চমাধ্যমিক দেবে। দুজনের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্বপূর্ণ পরে তা ভালবাসায় পরিনত হয় ।শঙ্করের বাড়ির লোক সব কথা জানলেও শালিনীর বাবা-মা তাদের এ সম্পর্কের কথা জানত না ।শালি নীদের পরিবার ছিল খুব কনজারভেটিভ। শালিনীরা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের আর শঙ্ক রেরা ছিল নিম্নবিত্ত । শালিনীর বাবা দারিদ্রতাকে কোনরকম সহ্য করতে পারতেন না। শালিনীর বাবা জন্ম থেকেই ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। বলতে গেলে তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন। তাই কোনরকম দারিদ্রতা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। মানসিক দিক থেকে বলতে গেলে বলা যায় তিনি ছিলেন অর্থ পিপাসু এবং অহংকারী। একমাত্র সন্তান হওয়ার ফলে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি পেয়েছিলেন অঢেল টাকাপয়সা, সম্পত্তি এবং পারিবারিক ব্যবসার মালিকানা। তাই তিনি যখন জানতে পারেন শংকরের সাথে শালিনীর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তিনি তখন তার একমাত্র কন্যার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। শংকর কিন্তু তখন বিএসএফ এ চাকরিও পেয়েছিল। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে শালিনীকে বিয়ে করার পক্ষপাতী সে ছিল না। শালিনী তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর শংকর কে বলেছিল পালিয়ে বিয়ে করতে ।কিন্তু শংকর রাজি হয়নি। শালীন শেষ মুহূর্তে বিয়েটা ভেঙ্গে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হয়তো ভাগ্যের পরিহাসে তা সম্ভব হয়নি। বিয়ের দিন সকালে শংকর তার এক বন্ধুর মারফত এক চিঠি পাঠিয়েছিল শালিনীকে তাতে সে পরিষ্কার জানিয়েছিল সে চাকরিতে জয়েন করার জন্য সীমান্তপারে চলে যাচ্ছে ।শালিনী যেন এই বিয়ে করে সুখী হয় এবং তাকে সারা জীবনের মতো ভুলে যায়।
 এই কথাগুলো জানানোর জন্যই বিয়ের পরদিন থেকেই শালিনী আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছে নিলয় কে কথাগুলো জানানোর জন্য।কিন্তু নিলয় কোন অবস্থাতেই সেই রাতের ফোনের পর তার সাথে অন্য কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে রাজী হয়নি। এখন শালিনী সম্পূর্ণ নিরুপায়! কোন অবস্থাতেই নিলয় তাকে যে আর মেনে নেবে না এটা সে ভালভাবেই বুঝতে পেরেছে। ঠিক এই মুহূর্তে শালিনী তার নিজের ভাগ্য টাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
 পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট করেই নিলয় যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। শালিনীর মা এসে শালীনিকে রেডি হতে বলেন। কিন্তু শালিনী বলে সে কটা দিন এখানে থাকবে। মা তাকে জানান দুজনকে একসাথে শ্বশুর বাড়িতে ফিরতে হবে। কিন্তু শালিনী জীদ করতে থাকে সে কিছুদিন এখানেই থাকবে। শালিনীর মা তার জামাইকে গিয়ে শালিনীকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। নিলয় তাকে জানায় কয়েকটা দিন শালিনী যদি এখানে থাকে তাতে তার কোন অসুবিধা হবে না। সে তার বাবা-মাকে কথাগুলো বুঝিয়ে বলবে। এরজন্য শালিনীকে কোন কথা শুনতে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে হবে না। কোন উপায় না দেখে শালিনীর মা রাজি হতে বাধ্য হন। নিলয় তার ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেয়। যাওয়ার আগে শালিনীকে জানিয়ে যায়, ছয় মাসের মধ্যেই সে ডিভোর্স  পেপার পাঠিয়ে দেবে। শালিনী যেন তার ভালোবাসাকে আপন করে নেয়।

ভালোবাসা থেকে যায়

ভালোবাসা থেকে যায়

    সুন্দরী বলতে যা বোঝায় রিমা কোনদিনও তা ছিল না। কিন্তু তবুও রিমার একটা আলগা শ্রী ছিল। তাকে দেখে কেউ খারাপ দেখতে বলতে পারত না ।এক মাথা ঘন কালো চুল, টিকালো নাক, হরিণী নয়ন কিন্তু গায়ের রংটা অস্বাভাবিক হারে কালো। তাই এত কিছু থাকা সত্ত্বেও রিমাকে ঠিক সুন্দরী বলে কেউ আখ্যা দিতে পারতো না। রিমা তখন এমটেক করছে। ভার্চুয়াল জগতে বেশ কয়েকজন বন্ধু হয়েছে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে রিমা ভার্চুয়াল জগতের এই সব বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত ।এরই মধ্যে একজন স্পেশাল বন্ধু তার ছিল। নাম ছিল তার সাগর।সাগর গ্রামের ছেলে। ভোলাভালো সরল প্রকৃতির । সাগরের সাথে রিমা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারতো অধিক রাতের দিকে। চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে আড্ডা মারতে মারতে রিমার সাগরকে ভালো লেগে যায়।অপরদিকে সাগরেরও ঠিক তাই ।তারা ঠিক করে দুজনে একদিন দেখা করবে। কিন্তু সাগর গ্রামে থাকে।মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসলে তাকে একদিন রাতে থাকতেই হবে। তাহলে সাগর কোথায় থাকবে? হোটেল ছাড়া কোন উপায় নেই।
   দুজনে মিলে একটা ডেট ফাইনাল করে সাগর কলকাতায় এসে একটা হোটেলে ওঠে। তারপর বিকেলের দিকে সাগর ও রিমা ভিক্টোরিয়ায় দেখা করে। পূর্বের কথা অনুযায়ী দুজনেই যে পোশাক পরে আসে তার কালার আগেই দুজনে ঠিক করে নিয়েছিল। তাই পরস্পরকে চিনতে তাদের একটুও কষ্ট হয়নি।রিমার হাইট ছিল 5 ফুট 4 ইঞ্চি কিন্তু সাগরের হাইট ছিল পাঁচ ফুট। বাড়ির বাগানের গোলাপ দিয়ে সাগর রিমাকে প্রপোজ করেছিল। সেই মুহূর্তে রিমা কিছু না বললেও পরে তার মনটা একটু খুঁতখুঁত করতো সাগরের হাইট্টা নিয়ে। কিন্তু সাগরের কাছ থেকে সে সরে আসতে পারেনি।
  রিমার বাড়িতে এ খবর জানাজানি হওয়ার পর রিমার বাবা-মা ভাইয়ের অত্যাচার তার প্রতি বেড়ে যায় ।তারা কিছুতেই তাদের মেয়েকে সামান্য চাকরি করা একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিতে রাজি নয়। কিন্তু সাগরদের বাড়িতে খুশিমনে এই সম্পর্ক বাড়ির সকলেই মেনে নেয়। হয়তো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে পারতো।কিন্তু রিমা কখনই চায়নি তার জীবনটা শুরু হোক পালিয়ে গিয়ে। সে চেয়েছিল বাবা-মায়ের মত নিয়ে তাদের আশীর্বাদ নিয়ে যাতে তার বিয়েটা হয়। শেষমেশ তারা বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু বিয়ের আসরে তারা উপস্থিত ছিলেন না ছোট ভাই বড় দাদার মত দিদির বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব সামলেছে।
  বিয়ের বছর দুয়েক কোথা থেকে কেটে গেল রিমা নিজেই টের পেল না। তিন বছরের মাথায় তাদের সন্তান এলো সুজন। আর তখনই সাগরের প্রমোশন হলো ।সাগর হয়ে পরলো ভীষণ ব্যস্ত। অফিস আর বাড়ি, বাকি সময় সে থাকত পরিশ্রান্ত।আস্তে আস্তে রিমা ও সাগরের ভিতর একটা দূরত্ব বাড়তে লাগল ।এই দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এতটাই হল যে- সে দূরত্ব ঘোচানোর মতন কোন ক্ষমতা রিমার নিজের হাতে ছিল না। সাগরের এই টাকার পিছনে ছোটার নেশাটা রিমা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না ।তার মনে হতো অভাব থাক কিন্তু সাগর যেন তার থাকে ঠিক সেই আগের মত। সাগরের সাথে সময় কাটাতে, সাগরের সাথে ঘুরতে রিমার মন চাইতো। কিন্তু সাগরের কাছে সে সময় ছিল না তাই আস্তে আস্তে সে রিমার কাছ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেল।
  সকাল থেকে রাত অবধি গাধার মত অফিসে পরিশ্রমের পর সাগর যখন বাড়িতে আসত সত্যিই সে থাকত খুব টায়ার্ড। কোন কোন দিন বাড়িতে ফিরে সে দেখতো তার চোখের মনি সুজন ঘুমিয়ে পড়েছে আজ ডাইনিং টেবিলে তার জন্য অপেক্ষা করছে রিমা।কোন কোন দিন সে খেত আবার কোন দিন বা কোন হোটেল বা পার্টি থেকে খেয়েএসে রিমাকে খেয়ে নিতে বলে ঘুমিয়ে পড়তো। দিনের পর দিন সাগরের এই অবহেলা রিমা মেনে নিতে পারে না। তার ভিতরে একটা চাপা কষ্ট শুরু হয় ।যে সাগরকে ভালোবেসে তার সাথে একটা সুখের সংসার করতে চেয়েছিল ।সেই সুখের সংসারে কালবোশাখী হয়ে দেখা দিয়েছে সাগরের টাকার পিছনে ছোটা । রিমা আস্তে আস্তে কেমন নির্জীব মেরে যেতে থাকে। সে খেতে পারেনা, রাতে ঘুমাতে পারে না, চোখের কোনায় কালি পড়ে গেছে কিন্তু সাগরের কোন দিকেই কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
  একদিন সকালে  অফিস যাওয়ার সময় টেবিলে খাবার না পেয়ে সাগর বেশ কয়েকবার রিমা কে ডাকে। সাড়া না পেয়ে সে রান্নাঘরে ঢুকে দেখে রান্না ঘরের মেঝেতে রিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এক বছরের সুজন তখনো ঘরে ঘুমাচ্ছে ।সে দৌড়ে গিয়ে রিমাকে তুলে নিয়ে সোফার উপরে শুইয়ে দেয়। পাশের বাড়ির বৌদিকে ডেকে সুজন কে দেখতে বলে রিমা কে নিয়ে নার্সিংহোম ছোটে। চারদিন পরে রিমা কে নিয়ে সাগর বাড়িতে আসে। এই কটা দিন শুধুমাত্র রাতেই সাগর বাড়িতে ফিরেছে। সুজন পাশের বাড়িতেই থেকেছে। কান্নাকাটি করেছে ঠিকই কিন্তু তারা সামলে নিয়েছে। রিমাকে ছেড়ে রাতে ছাড়া সে এক সেকেন্ডের জন্য নার্সিংহোম থেকে নড়েনি।
 এতদিন ধরে রিমা কোন কাজের লোক বাড়িতে রাখতে দেয়নি। সে নিজের হাতেই যাবতীয় কাজ করতো সাগরের কথা অমান্য করে। কিন্তু রিমাকে বাড়িতে এনেই সাগর একটা রান্নার লোক রাখে।আর সর্বক্ষণ রিমার পাশে বসে তার সেবা কবে চলে।
--- নিজের কি হাল করেছ দেখেছ?
--- তুমি আজও অফিস যাওনি?
--- অফিস, পরিশ্রম, টাকা রোজগার সবই তো তোমাদের জন্য ।সেই তোমরাই যদি ভালো না থাকো কি হবে এসব করে?তুমি এতো অবুঝ কেন? কেন বোঝনা আমার এই পরিশ্রম সবই তোমার আর সুজনের জন্য ।এখনো পরিশ্রম করতে পারছি কিন্তু এরপরে বয়স বেড়ে গেলে তো পারবোনা। আমি সময় পাইনা তাই তোমার খাওয়া-দাওয়ার দিকে এভাবে নজর দিতে পারিনা। তারমানে তুমি এইভাবে নিজের শরীরের অবহেলা করবে? তুমি একবারও ভাববে না তুমি ছাড়া আমার আর সুজনের আর কেউ নেই। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা তো বাঁচতে পারব না।
 রিমা উঠে বসার চেষ্টা করে, সুজন বাধা দেয়--
--- আরে কি করছো উঠছো কেন? তোমাকে এখনো ডাক্তারের কথামত 15 দিন শুয়ে থাকতে হবে ।আর এই 15 দিন আমি তোমার পাশে থেকে সবসময় তোমায় সঙ্গ দেবো, তোমার সাথে গল্প করবো আর মাঝে মাঝে একটু আদর করবো ।আর তুমি চুপ করে এখানে শুয়ে থাকবে। হ্যাঁ এখন একটা কাজ করতে পারো- এখন আমি তোমাকে একটু ধরি; তুমি তোমার মাথাটা আমার হাঁটুর উপর দিয়ে চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো আর আমি তোমার চুলের ভিতরে হাত বুলিয়ে দিই ঠিক সেই আগের মত।
-- তুমি এখনো আমাকে সেই আগের মত ভালবাসো?
--- বোকা মেয়ে! কেন ভালোবাসবো না?তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি কিন্তু সময় পাই না বলে তোমাকে আগের মতো সময় দিতে পারিনা আর এরজন্য তুমি এত কষ্ট পাচ্ছিলে?আমাকে বলে একবার দেখতে পারতে--। আর কক্ষনো আমাকে ভুল বুঝে নিজের শরীরের অযত্ন কোরো না। একটু সুস্থ হয়ে নাও, অনেকদিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়না ।আমরা বাইরের থেকে দিন পনেরোর জন্য ঘুরে আসি।
 রিমা আস্তে আস্তে সাগরের হাঁটুর উপর থেকে মাথাটা তোলার চেষ্টা করে সাগর তাকে সাহায্য করে ।কোনরকমে একটু বসতে  পেরেই সাগরকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আর সাগরও রিমাকে দুহাত দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে। রিমা  কাঁদতে কাঁদতে সাগরকে বলে,
--- আমি ভেবেছিলাম আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা বুঝি ফুরিয়ে গেছে,তাই ভীষণ কষ্ট পেতাম ।আমি তোমায় ভুল বুঝেছিলাম গো আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।
অসুস্থ রিমার ঠোঁটের উপরে নিজের তর্জনীটা দিয়ে সাগর বলে,
--- আর কক্ষনো তুমি আমাকে ভুল বুঝনা। আমি তোমাকে আমার নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসি ।তোমার এই অসুস্থতার সময় ডাক্তারের কথা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি সত্যিই আমি অন্যায় করেছি এই ভুল আর আমার কোনদিন হবে না। তাই তুমিও আমায় ক্ষমা করে দাও।
    

Friday, December 25, 2020

ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়

ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়

   হঠাৎ পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর শুনে পায়েল ঘুরে দেখে মানুষটাকে।একমুহুর্ত ও সময় লাগেনা মানুষটিকে চিনতে ।পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সেই পরিচিত মানুষটির কাছে।সেই আগের মতই উস্কোখুস্কো চুল। নূতন সংযোজন মুখে কাচাপাকা একগাল দাঁড়ি,আর কাঁধ থেকে ঝুলছে বহু পুরনো রংচটা ছেঁড়া একটি ব্যাগ । ব্যাগটি র উপর থেকে উঁকি দিচ্ছে কিছু আঁকার সরঞ্জাম। 
  জনবহুল একটি ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে ফুটপাথের একটি চায়ের স্টল থেকে চা খাওয়া র পর পয়সা দিতে না পারায় দোকানদার তাকে নানানভাবে হেনস্থা করছে ।আর ভদ্রলোকটি হাত জোড় করে সমানে বলে যাচ্ছে,"বিশ্বাস করো আমার পকেটে পয়সা ছিল কিন্তু পকেটটা  ছেঁড়া থাকাই পকেট থেকে পয়সাগুলো  সব পড়ে গেছে।" দোকানের আশেপাশের মানুষগুলো একথা শুনে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ে । এদের কথা শুনে পায়েল এগিয়ে যায় দোকানদারের সামনে। সে তার ব্যাগ থেকে তিনটে টাকা বের করে দোকানদারের হাতে দেয়।পরে সে ভদ্রলোকের হাত ধরে ওই দোকানের সামনে থেকে বাইরে বের করে আনে।l পায়েল তার হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে আর লোকটি কোন প্রতিবাদ না করে পায়েলের সাথে বাচচাদের মত দৌড়াতে  লাগে। একটু ফাঁকা জায়গায় এসে পায়েল তার হাতটা ছেড়ে দেয়। লোকটি উৎসুক দৃষ্টিতে পায়েলের মুখের দিকে তাকায়। পায়েলকে তার খুবই চেনা মনে হয় কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না ।স্মৃতির অতল গহবরে হাত ঢুকিয়ে সে চিন্তা করতে থাকে এই মেয়েটিকে সে যেন কোথাও দেখেছিল কিন্তু কোন কুল সে খুঁজে পায়না। পায়েলকে যে সে চিনতে পারছেনা পায়েল সেটা বুঝতে পারে তাই সে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
--- তুমি আমার মুখের দিকে তাকাও রঞ্জিতদা ,আমি পায়েল, আমার মুখের দিকে একটু  তাকিয়ে দেখো ঠিক চিনতে পারবে।
কিন্তু রঞ্জিতবাবু পায়েলের কথার কোন উত্তর না দিয়ে তার ব্যাগের ভেতর সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে কি যেন খুঁজে চলেছেন আর মাঝে মাঝে কি খুঁজছেন মনে না পড়ায় নিজের মাথার চুলগুলো নিজেই টেনে ছিঁড়ছেন। পায়েল বুঝতে পারে রঞ্জিতদার মাথাটাই পুরো গেছে।
  সে ফিরে যায় এক যুগ আগের দিন গুলিতে। তার মনে পড়তে থাকে পায়েলের দিদি পামেলা ভালোবাসতো রঞ্জিতদাকে। রঞ্জিতদাও পাগলের মত ভালবাসত তার দিদি পামেলাকে।পায়েল তখন  সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। রঞ্জিতদা খুব সুন্দর ছবি আঁকতো। বাড়ির সবাই রঞ্জিতদাকে মেনে নিয়েছিল।তাই প্রায়ই রঞ্জিতদা পায়েলদের বাড়িতে আসত। আর যে ছবিগুলো রঞ্জিতদা আঁকতো  সেই ছবিগুলো এনে বাড়ির সবাইকে দেখাতো। টুকটাক ছবি আঁকতে পায়েল ও জানতো। তাই রঞ্জিতদা যখন তার আঁকা ছবিগুলো নিয়ে পায়েলদের বাড়িতে আসত সে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে রঞ্জিতদার কাছ থেকে ছবি আঁকার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জেনে নিত। যেহেতু পামেলার সাথে রঞ্জিতের বিয়ের সব কিছু ফাইনাল হয়ে গেছিল তাই পায়েলের সাথে সময় কাটানো বাড়ির লোক কেউ কিছু মনে করতো না।কিন্তু পায়েল মনেমনে তার রঞ্জিতদাকে কিছুটা হলেও ভালোবেসে ফেলেছিল।কিন্তু মুখে কোনদিনও তা প্রকাশ করেনি কারণ দিদি এবং রঞ্জিতদা পরস্পর পরস্পরকে ভীষণ ভালোবাসতো।হঠাৎ পায়েলদের সংসারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত হঠাৎ একটি অঘটন ঘটে যায়। একদিন পামেলা কলেজ থেকে ফেরার সময় মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট করে।পাগলের মতন রঞ্জিত হাসপাতাল আর বাড়ি ছোটাছুটি করতে থাকে ।কিন্তু পামেলাকে সে ধরে রাখতে পারেনা। চল্লিশটা দিন যমে মানুষে টানাটানি করার পর পামেলা সব মায়া ত্যাগ করে চিরতরে সবাইকে ছেড়ে চলে যায়। বাবা-মা ভীষণ ভেঙে পড়েন আর রঞ্জিতদা পুরো পাগলের মতন হয়ে যায়।রঞ্জিতদা ছিল বাবা - মায়ের একমাত্র সন্তান।
 পামেলার বাবা-মা এ শোক সামলাতে পারলেও রঞ্জিত এ শোক সামলাতে পারেনা।সে আস্তে আস্তে চুপচাপ থাকতে থাকতে কেমন নির্জীব হয়ে যেতে থাকে।ঘরে থাকে কারো সাথে কথা বলে না, কোথাও বেড়াতে বের হয়না বাবা মার সাথে প্রয়োজন না হলে কথা বলেনা, বন্ধুবান্ধবের সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না। পামেলার মৃত্যুর মাস দুয়েক পরে হঠাৎ একদিন খুব ভোরে তার আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে সে বাড়ি থেকে কোথায় যেন বেরিয়ে যায়।অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাড়ির লোক তার কোন সন্ধান পায় না। যেহেতু রঞ্জিতদার প্রতি পায়েলের আলাদা একটা ফিলিংস ছিল তাই রঞ্জিতদার এই চলে যাওয়াটাকে সে কিছুতেই মন থেকে মানতে পারেনি।হয়তো সেই কারণেই সে বাবা-মার কথাও  রাখতে পারেনি। এই পর্যন্ত রঞ্জিতদাকে খুঁজেছে সে প্রচুর তাই হয়ত বাবা মার পছন্দ করা ছেলেকে সে বিয়ে করতে রাজি হয়নি।
 পায়েল এই আত্মভোলা, স্মৃতিভ্রংশ মানুষটিকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে চলে যায়।রঞ্জিতদার বাবা,মা কয়েক বছর আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। পরদিন পায়েল এই মানুষটিকে নিয়ে একজন মনোবিদ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। ডাক্তার রনজিতকে কোন ওষুধ দেন না, শুধু পায়েলকে জানিয়ে দেন একটু ভালোবাসা একটু সেবা-যত্ন পেলেই রঞ্জিত সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠবে। শুরু হয় পায়েলের জীবনে এক নতুন অধ্যায়। অফিস,ঘরের কাজ আর রঞ্জিতের সেবা যত্ন এই হয়ে ওঠে পায়েলের জীবন। বছর চারেক আগে পায়েলের বাবা মা দুজনই পায়েলকে ছেড়ে সারা জীবনের মতো চলে যান ।পায়েল হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ একা। সে তার বাড়ি বিক্রি করে একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানে উঠে আসে। পায়েল অফিস যাওয়ার সময় তালা বন্ধ করে রঞ্জিতকে ঘরে রেখে যেত আর যখন ফিরে আসতো এসে দেখতো ঘরের সমস্ত জিনিস লন্ডভন্ড করা। চারিদিকে আঁকার সরঞ্জাম ছড়ানো  আর কাগজের ঢিপ।
  আস্তে আস্তে রঞ্জিতের ভিতর পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকে পায়েল। একদিন অফিস থেকে তালা খুলে ঘরে ঢুকে পায়েল দেখে রঞ্জিত বেশ কয়েকটি ছবি এঁকেছে। তারমধ্যে দু-তিনটি ছবি পামেলার। পায়েল বুঝতে পারে রঞ্জিত আস্তে আস্তে সুস্থর দিকে যাচ্ছে।
 এরইমধ্যে হঠাৎ একদিন পায়েলের খুব জ্বর হয়। পায়েল অফিস যেতে পারে না।সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে। রঞ্জিত খেতে গিয়ে তার খাবার গুছানো না পেয়ে এবং পায়েলকে দেখতে না পেয়ে সন্ধ্যার দিকে আস্তে আস্তে সে পায়েলের ঘরে ঢোকে। পায়েলের ঘরে ঢুকে সে দেখে পায়েল গায়ের চাদর দিয়ে শুয়ে আছে। সে পায়েলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পায়েল রক্তবর্ণ  চোখ খুলে তার দিকে তাকায়। রঞ্জিত তার কপালে হাত রেখে বুঝতে পারে পায়েলের খুব জ্বর, সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রান্না ঘরে ঢুকে একটি বাটি নিয়ে পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে পায়েলের কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। জ্বরটা একটু কমলে সে পায়েলের জন্য একটু খাবারও করে আনে। রঞ্জিতের এই উন্নতি দেখে পায়েল খুব খুশি হয়। এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা দিন কেটে যায় রঞ্জিত নিজেও বুঝতে পারে সে আস্তে আস্তে পায়েলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ছে। সে তখন চেষ্টা করতে থাকে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ার।
  ঠিক যেভাবে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সেই একইভাবে এবার সে  পায়েলের ফ্ল্যাট থেকেও বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।কিন্তু পায়েল আগে থাকতেই এটা অনুমান করেছিল। তাই ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে চাবি তার কাছেই  রেখে দিয়েছিল। রঞ্জিত শত ছিদ্র, নোংরা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে অপারগ হয়। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে পায়েল দাঁড়ানো,
--- কি চিরঞ্জিতদা আমার ফ্ল্যাট থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলে বুঝি?
--- একি তুমি ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে রেখেছো বুঝি? তোমার কি মনের ইচ্ছা আমায় এখানেই থাকতে হবে ?আমাকে কি তুমি আটকে রাখতে পারবে?
---- আমার ঘরের দরজা দিয়ে তুমি হয়তো বেরিয়ে যেতে পারবে কিন্তু আমার মনের ঘরে যেখানে তোমায় আমি বন্ধু করেছি সেখান থেকে তুমি ইচ্ছে করলেও পালিয়ে যেতে পারবেনা রঞ্জিতদা। আমি তোমায় ভালোবাসি রঞ্জিতদা। আর তোমাকে ভালোবাসি বলেই আজও আমি একা। কাউকেই আমি তোমার জায়গাটা দিতে পারিনি। দিদি চলে যাওয়ার পর তুমি যখন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে আমি তোমাকে পাগলের মত সব জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু কোথাও তোমাকে পাইনি। আজকে আমার বলতে একটুও বাধা নেই আমি তোমাকে দিদি থাকতেই ভালবাসতে শুরু করেছিলাম কিন্তু কোনদিন মুখে বলতে পারিনি কারণ আমি জানতাম দিদি আর তুমি পরস্পরকে ভীষণ  ভালবাসতে। আমি তোমার প্রতিক্ষাতেই আজও রয়েছি ।পারবেনা আমাকে আপন করে নিতে ?তোমার মনে দিদির জন্য যে জায়গাটা পাতা আছে সেই জায়গাটায় আমি কোনদিনও বসতে চাইব না কিন্তু তবুও তোমার মনের যেকোনো জায়গায় আমার জন্য একটু জায়গা হবে না?
 
কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রঞ্জিত আস্তে আস্তে পায়েলের দিকে এগিয়ে যায় পায়েলের মুখটা আলতো করে তুলে ধরে বলে,
--- তোমার দিদিকে যখন ভালবাসতাম তখন তুমি খুব ছোট ছিলে। আমার কাছে আঁকার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানতে চাইতে ভালো লাগতো। তারপর নিজেকে হারিয়ে ফেললাম অনেক কিছু ভুলে ছিলাম বেশ কয়েক বছর। কিন্তু এই কটা দিনে তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছো ।আমি বুঝতে পেরেছি আমিও বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। না, না এটা আমার কৃতজ্ঞতা নয় আমি সত্যিই তোমায় ভালবাসি পায়েল। ভালোবাসা জীবনে বহুবার আসতে পারে ভালোবাসা বয়স মানে না, ভালোবাসা সম্পর্ক মানে না, ভালোবাসা  অর্থ দেখেও হয় না।শুধু দুটি মনের মিলনেই ভালোবাসার জন্ম নেয়। বয়সটা হয়ত আমার একটু বেশিই হয়েছে, তুমিও ম্যাচিওর হয়েছো।এই বয়সে এসে আমরা দুজনেই একটা সুখনীড় রচনা করতে অনায়াসেই পারবো। ভুলে যাব আমরা অতীতকে। যে অতীত আমাদের বারবার কষ্ট দেয়, যে অতীত আমাদের সামনে এগোতে বাঁধা দেয়, সেই অতীতকে আমরা আর ধরে রাখবো না। সবকিছু ভুলে আমরা সামনে এগিয়ে যাবো।
 

Thursday, December 24, 2020

সুখের ঘরে আগুন (দশম পর্ব)

সুখের  ঘরে  আগুন  ( দশম  পর্ব )
  
     তিনজনে  ছাদে  কথা  শেষ  করে  যে  যার  ঘরে  ঢুকে  যায়  | নিলয়  তার  ঘরে  শুতে  গিয়ে  দেখে  শালিনী  তখনও জেগে  সোফায়  বসে | নিলয়  ঘরে  ঢুকে  দরজা  বন্ধ  করে  বাথরুমে  চলে  যায় |
 শালিনী একইভাবে সোফায় বসে থাকে | নিলয় ঘরে ঢুকে আজ খাটের দিকে এগিয়ে যায় | শালিনী তখন বলে ওঠে,
--- অদ্ভুত মানুষ তো আপনি?আমি বসে আছি আপনার সাথে কথা বলবো বলে আর আপনি কোন কথা বলার বা শোনার প্রয়োজনীয়তাই বোধ করছেন না --|
 দাঁতে দাঁত টিপে মাথাটা অতিকষ্টে ঠান্ডা রেখে নিলয় উত্তর দিলো ,
--- আপনি কি করে আশা করেন আপনার কথা আমি শুনবো বা আমি কিছু আপনাকে বলবো?আপনার সাথে ফোনে সেদিন কথার পরে আর তো কোন কথা আপনার সাথে আমার থাকতে পারে না | যাহোক আমার খুব ঘুম পেয়েছে ; আমি এখন ঘুমাবো | আপনি কি সোফাতেই শোবেন?তাহলে আমি খাটে শুয়ে পড়বো | শালিনী কোন উত্তর না দিয়ে সেভাবেই বসে থাকে | নিলয় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে খাটের উপরেই ঘুমিয়ে পরে | আর বাকি রাতটা শালিনী সোফায় বসেই কাটিয়ে দেয় | 
  আজ তাদের অষ্টমঙ্গলা |বাইরে আলো দেখা দিলেই শালিনী স্নান সেরে জামাকাপড় ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় | শ্বাশুড়ি তাকে দেখতে পেয়েই বলেন ,
--- বৌমা, দশটা পঁয়ত্রিশের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে তোমাদের | নীলুকে ডেকে দাও আর তুমি রেডি হয়ে নাও | আমি তোমাদের টিফিনটা রেডি করছি | তুমি নীলুর চা টা নিয়ে যাও |
 ঝড়ের গতিতে দুহাতে কাজ করতে করতে মলিনাদেবী কথাগুলো বলে গেলেন | মুখে কোন কথা না বলে শুধু সম্মতিসূচক  ঘাড় নাড়িয়ে নিলয়ের চা টা নিয়ে শালিনী ঘরে যেতে যেতে ভাবে " কি করে লোকটাকে ঘুম থেকে ডেকে সে চা দেবে?ঘরে ঢুকে দেখে নিলয় অঘোরে ঘুমাচ্ছে |কিন্তু ডাকবে কি করে ?বহু চিন্তা করে সে তার একটা কসমেটিকসের কৌটো নিচুতে ফেলে দিলো | আর তাতেই কাজ হল | নিলয় হুড়মুড় করে উঠে বসলো | তার সামনে শালিনী চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো | নিলয়ের তখন রাগে সর্বশরীর জ্বলছে | তাকে ঘুম থেকে ডাকার জন্যই যে এই ফন্দি এটা সে বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে | বলতে ইচ্ছা করছে " ন্যাকামো করে আবার চা নিয়ে আসা হয়েছে |" আবার পরক্ষণেই ভাবছে " কি আর করবে হয়তো মা ই হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন |" খাট থেকে নেমে চা টা হাতে করেই সে বেরিয়ে যায় | মা  তার নীলুকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে বলে  ওঠেন ,
--- তাড়াতাড়ি  বেরোতে হবে কিন্তু , আজ পেপারটা একটু কম পড়িস | স্নান করে নে আমি তোদের টিফিন ----|
 কথা শেষ হয়না | নিলয় বলে ওঠে ,
--- মা , কি বলছো টা কি তুমি?স্নান করে খেয়ে কোথায় যাবো?আমার,আমার তো এখনো সাতদিন অফিস ছুটি |
 মলিনাদেবী হাসতে হাসতে ছেলের কাছে এসে বলেন ,
--- ওরে পাগল তোর যে আজ অষ্টমঙ্গলা |
 তোকে তো আজ তোর শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে | 
 স্বামীকে দরজা দিয়ে ডাইনিংয়ে ঢুকতে দেখে বলেন ,
--- তোমার ছেলের কথা শোনো | আজ কোথায় যাবে জানতে চাইছে ?
 চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে তিনিও উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন ,
--- সবে ছেলেটার বিয়ে হল এর মধ্যে ওকে কোথায় পাঠাতে চাইছো?বৌমা সাথে যাবে তো ?
 অবাক হয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "ওহ বলিহারি কপাল বটে আমার! আজ যে ওদের অষ্টমঙ্গলা ; নীলু   আজ শ্বশুরবাড়ি যাবে |
 --- ও তাই বলো | আমার মনে ছিল কিন্তু সবে ঘুম থেকে উঠে আসলাম বলে মুখে আসেনি কথাটা |
 নিলয় বাবার কথা শুনে মিটি মিটি হাসছিলো | এবার সে গম্ভীর মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো ,
--- মা, শালিনী  একাই যাক আমার শরীরটা ভালো লাগছে না |
--- তা হয়না বাবা ; এখানে জোড়ে যাওয়ায় নিয়ম |
--- অনেক তো নিয়মকানুন  হল  মা , এবার এসব বাদ দাও |
--- ব্যাস শুধু এটাই,আর কিছু বলবো না|
  শালিনী একদম রেডি হয়ে চলে আসে | তাকে দেখে মলিনাদেবী ওই তো বৌমা রেডি হয়ে গেছে | যা নীলু তুইও রেডি  হয়ে  নে| কথা দিচ্ছি এর পরে আর কোন নিয়মের বেড়াজাল তোকে ডিঙোতে হবে না |
 একটা ক্যাব বুক করে শালিনীকে নিয়ে নিলয় শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো | ক্যাবের ভিতরে দুজনের মাঝে দূরত্ব  যেন তাদের মনের দূরত্বকেও হার মানিয়ে দেয় | ক্যাবের ভিতর উঠেই নিলয় তার মোবাইল বের করে বুক পকেট থেকে হেয়ার ফোনটা বের করে আড়চোখে শালিনীকে একটু দেখে নিয়েই গান শুনতে শুরু করে | শালিনী বেশ কয়েকবার নিলয়কে কিছু বলার চেষ্টা করে | কিন্তু নিলয় চোখ বন্ধ করেই গান শুনতে থাকে | এবার শালিনী খুব ভালোভাবেই বুঝে যায় নিলয় তার সাথে কথা বলবেনা বলেই ইচ্ছাকৃত কানে হেডফোন গুঁজে রয়েছে |

 ক্রমশঃ-

Wednesday, December 23, 2020

মধ্যরাতের ভয়

মধ্যরাতের  ভয় | 
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

                                    (পর্ব ১)

       অর্থ  চাহিদা   যখন  প্রবলভাবে  দেখা  দেয় আর  ঠিক  তখনই  সংসারের  উপার্জনক্ষম  ব্যক্তিটির  যদি  প্রমোশন  হয়  তখন  কোথায়  তার  বদলী হল  তা  নিয়ে  তিনি  মাথা  না  ঘামিয়ে  তার  মাইনের  টাকাটাই  যে  বেড়েছে  এটা নিয়েই  তিনি  মশগুল  থাকেন | ঠিক  তেমনই পিয়াল  রায়ের  অবস্থা | 
  পিয়াল  বাংলাতে  এমএ  করেছেন | মফস্বল  শহরে  একটি  প্রাইমারি  স্কুলে  দশ  বছর  বেকার  থাকার  পর  শিক্ষক  পদে  নিযুক্ত  আছেন  বেশ  কয়েক  বছর | চাকরি  পাওয়ার  পরেই মায়ের  চাপে বিয়ে , আর  বিয়ের  পরেই বংশ  প্রদীপের  মুখ  দেখার  চাপ  | পরপর  দুটি  কন্যা  সন্তান  কিন্তু  বড়  হয়ে  ওরা তো  পরের  ঘরে  চলে  যাবে  তাই  বংশধর  তার  চাইই | তৃতীয়বার  তার  ঘরে বাতি  দিতে  এলো  বহু  আকাঙ্খিত  তার  বংশ  প্রদীপটি   | এক  থেকে  দেড়  বছরের  ব্যবধানে  এই  তিন  তিনটি  বাচ্চার  পিছনে  যে  খরচ  , সংসার  চালনা  তার  উপর  মায়ের  বার্ধক্যজনিত  নানান  অসুখের  তালগোলে পিয়ালের  ওই  সামান্য  কটা মাইনের  টাকায় চলা  ভীষণ  দুস্কর  হয়ে  পড়লো | গ্রামে  সেভাবে  টিউশনিও  তখন  পাওয়া  যেত না  | আর  যারা  পড়তে  আসতো তাদের  টাকা  দেওয়ার  ক্ষমতা  না  থাকার  ফলে  ক্ষেতের  কফি , মূলো, বেগুন , লাউ  দিয়েই  ক্ষান্ত  থাকতেন | ঠিক  এমন  সময়ে  পিয়ালকে  প্রমোশন  ও  গলাধাক্কা  দুটোই  একসাথে  খেতে  হল | যেখানে  তাকে  বদলি  করা  হল  চৌদ্দ  পুরুষ  সে  জায়গার  নাম  শুনেছে  বলে  মনেহয়না  পিয়ালের | কিন্তু   তিনি  খুশি  মনেই  এই  প্রমোশন ও  বদলী মেনে  নিয়ে  একদিন  রওনা  দিলেন  পাঠকাঠি  গ্রামের  উদ্দেশ্যে |
  শীতের  রাত | হাড় হিম করা  ঠান্ডা  পড়েছে | দুপুরের  দিকে  বেরোলেও  ট্রেন লেটের বদৌলতে  তিনি  গাড়িতে  চাপলেন  সেই  সন্ধ্যা  নাগাদ | ট্রেনের  কামরায়  হাতে  গোনা  কয়েকজন  যাত্রী | বগির  ভিতরে   জানলার  কাঁচ ভাঙ্গা | সকলেই  সেদিকটা  বাঁচিয়ে  অন্য জায়গায়  বসতে  ব্যস্ত | কিন্তু  ট্রেনের  ভিতরের  ভাঙ্গা কাঁচের ভিতর  দিয়ে  হাওয়াকে  কি  আর  আটকানো  যায় ? তবুও  সকলে  নিজেদের  ঢেকেঢুকে  চলন্ত  ট্রেনের  শীতের  হাওয়ার  হাত  থেকে  রক্ষা  পেতে শুধু  চোখদুটি  ছাড়া  শরীরের  সব  অংশ  ঢেকে  শীতের  হাত  থেকে  রক্ষা  পেতে  আপ্রাণ  চেষ্টা  চালিয়ে  যাচ্ছেন | এই  শীতের  মধ্যেই  অনেককেই  আবার  ঢুলতে  শুরু  করেছেন | কিন্তু  পিয়ালের  মনে  অজানা  এক  আশংকা  কাজ  করে  চলেছে | পাশের  যাত্রীর  কাছে  তিনি  শুনলেন  রাত দশটা  বাজবে  তাদের  পাঠকাঠি  স্টেশনে  পৌঁছাতে | কিন্তু  তিনি  ওই  দশটার  সময়  অজানা  জায়গায়  কোথায়  গিয়ে  উঠবেন  ?
  ট্রেন  থেকে  নেমে  সকলের  মত  তিনিও  তার  ব্যাগ  নিয়ে  হাঁটতে শুরু  করলেন | একটু  চা  খেতে  ইচ্ছা  করছিলো | কিন্তু  গুমটিগুলো সবই  বন্ধ  হয়ে  গেছে | উদ্দেশ্যহীনভাবে  হেঁটে চলেছেন | রাস্তাঘাটে  কোন  আলো নেই  | হয়তো  লোডশেডিং  হবে | হঠাৎ  তিনি  দেখতে  পান  একটি  হ্যারিকেন  হাতে  লালশার্ট আর  কালোপ্যান্ট  পরা এক  ভদ্রলোক  তার  দিকে  এগিয়ে  এসেছেন | হঠাৎ  করেই  তিনি  যে  কোথা থেকে  উদয়  হলেন  তা  তার  বোধগম্য  হলনা | 
--- বাবু  চলুন,  আপনাকে  নিতে  এসেছি --
--- কে  তুমি?  আমায়  কোথায়  নিয়ে  যাবে  ?
--- আপনিই  তো  আমাদের  স্কুলের  মাষ্টার  | আপনার  যেখানে  থাকার  ব্যবস্থা  হয়েছে  সেখানেই  নিয়ে  যাবো  | 
--- পিয়ালের  পরানে একটু  যেন  জল  এলো | প্রশ্ন  অনেক  মাথার  মধ্যে  কিলবিল  করলেও  সেগুলিকে  আপাতত  সরিয়ে  রেখে  ব্যাগদুটি  লোকটির কাছে  হস্তান্তর  করে  নিঃশব্দে  তাকে  অনুসরণ  করতে  লাগলো |
 লোকটা  হাঁটছে তো  হাঁটছেই | অন্ধকার  রাস্তায়  ঝিঁঝি পোকার  ডাক  ছাড়া  আর  কিছুই  তার  কানে  ঢুকছে  না | অনেকক্ষণ পরে  লোকটি  এসে  দাঁড়ালো  একটা  বেশ  বড়সড়ো  দালানবাড়ির  কাছে | লোকটি  ভাঙাচোরা  বড়  একটা  গেট  পেরিয়ে  ভিতরে  ঢুকতে  ঢুকতে  বললো ,
--- একসময়  এই  বাড়িটা  লালকুঠি  বলেই   ছিল | তখন  সাহেবরা  এদেশে  ছিল | এখন  অবশ্য  কেউ  আর  লালকুঠি  বলে  না | সাহেবদের  বাংলোই   বলে | এখানে  কেউ  এসে  থাকতে  চায় না | তাই  এই  গ্রামের   মধ্যে কোন   শিক্ষার  আলো   ঢোকেনি | যে  যখন  এসেছে  একদিন  কি  দুদিন  বাদে  চলে  গেছে | 
 কথা  বলতে  বলতে  তারা  একটি  রুমের  ভিতরে  প্রবেশ  করলো | হ্যারিকেনের স্বল্প  আলোতে  পিয়াল  রায়  দেখলেন  ঘরে  সেরূপ  কোন  আসবাব  না  থাকলেও  যা  আছে  তার পক্ষে  যথেষ্ট | কথা  বলতে  বলতে  লোকটি  হঠাৎ  পিয়ালের  দিকে  ফিরে  বললো ,
--- বাবু , আপনার  থাকা , খাওয়ার  কোন  অসুবিধা  হবেনা | শুধু  মনে  একটু  সাহস  রাখবেন | বাকিটা  আমি  সামলে  নেবো | ছোটছোট  বাচ্চাগুলো  যাতে  একটু  লেখাপড়া  শিখতে  পারে  সেটা  দেখবেন | আমি  আপনার  রাতের  খাবার  ওই  টেবিলেই  রেখে  দিয়েছি  |
 লোকটি  হ্যারিকেনটি রেখে  বেরিয়ে  গেলো  | পিয়ালও  হাতমুখ  ধুয়ে  খাবারের  কাছে  এগিয়ে  গিয়ে  দেখলেন    চিকেন  আর  রুটি | সারাদিনের  ক্লান্তির  শেষে  এই  খাবার  দেখে  মনেমনে  খুব  খুশি  হয়ে  গেলেন  পিয়াল  | তিনি  খাবার  খেয়ে  লোকটির  করে  রাখা  পরিষ্কার  বিছানায়  গা  এলিয়ে  দিয়ে  ভাবতে  লাগলেন ' এই  লোকটি  কে ? সে  জানলো কি  করে  যে  আমি  আজ  আসবো ?

                                  ( পর্ব ২)

    ভাবতে  ভাবতেই  একসময়  তার  চোখদুটি  ঘুমে  জড়িয়ে  গেলো | ঘুমের  মধ্যেই  পিয়াল  শুনতে  পেলেন  একজন  বৃদ্ধের  কাতর  অনুরোধ  " সাহেব  এই  স্কুল  ঘরটি  আপনি  ভাঙ্গবেন না , ছোটছোট  বাচ্চাগুলো  খুব  অসহায় হয়ে  পড়বে , ওদের  অন্তত  অক্ষরজ্ঞানটা হতে  দিন |" পিয়াল  শুনতে  পেলেন  আর  একজনের  অট্টহাসি | ধড়মড় করে  উঠে  বসলেন | গলা  শুকিয়ে  কাঠ  | মাথার  কাছে  রাখা  জলের  গ্লাস  থেকে  ঢকঢক  করে  পুরো  জলটা  খেয়ে  নিলেন | বাকি  রাতটুকু  ঘুম  আর  তার  এলো  না | 
 খুব  ভোরে  দরজা  খুলে  বেরিয়ে  আসলেন | কিন্তু  প্রচন্ড  কুয়াশায়  কোনকিছুই  দেখা  যাচ্ছে  না | তিনি  আবার  ঘর  অভিমুখে  রওনা  দিলেন | পিছনে  শুনতে  পেলেন  এক  বৃদ্ধের  কাশির  আওয়াজ | মুখ  ঘোরাতেই  দেখলেন , একজন  ধুতি  পরিহিত  , সাদা  চুল  দাঁড়ির অধিকারী  এক  বৃদ্ধ  তার  দিকেই  এগিয়ে  আসছেন |
--- মাষ্টার  এই  গ্রামের  বাচ্চাগুলির  লেখাপড়া  শেখানোর  দায়িত্বটা  তুমি  নাও | এখান থেকে  চলে  যেওনা | 
--- আপনি  কি  করে  জানলেন  আমি  মাস্টার  ?
 কথার  উত্তর  না  দিয়ে  বৃদ্ধ  একটু  হেসে  দিয়ে  বললেন ," মনে  সাহস  রেখো  আমরা  সবাই  তোমার  সাথে  আছি | তোমার  জীবনের  কোন  ক্ষতি  হবেনা | এখানেই  তোমার  ভাগ্য  ফিরে  যাবে | পুরনো বাড়ি | অনেকেই  বলে  ভূতপ্রেতের আস্তানা | তুমি  স্কুলে  থিতু  হলেই  সব  ঠিক  হয়ে  যাবে |"
 পিয়াল  কিছু  বলতে  যাচ্ছিলেন  কিন্তু  তার  আগেই  বৃদ্ধ  কুয়াশার  ভিতর  মিলিয়ে  গেলেন | 
 কিচেনে  ঢুকে  দেখলেন  সবকিছু  নিখুঁতভাবে  সাজানো | যেন  কেউ  পাকা  হাতে  এইমাত্র  গুছিয়ে  রেখে  গেছে  | একটু  চা  করে  খেয়ে  সেদ্ধভাত  চাপিয়ে  দিলেন  | নটা নাগাদ  খেয়েদেয়ে  তিনি  তার  স্কুলের  উদ্দেশ্যে  বেরিয়ে  পড়লেন | অনেক  হেঁটে দু  একজনের   কাছে  জেনে  নিয়ে  অবশেষে  তিনি  পাঠকাঠি  ফ্রীরি প্রাইমারি  স্কুলে  এসে  হাজির  হলেন | জনাদশেক  বাচ্চা  সেখানে  ঘুরাঘুরি  করছে | অফিসরুমে  ঢুকে  দেখলেন  একটি  বাইশ তেইশ  বছরের  মেয়ে  বসে  | সেই  একমাত্র  এই  স্কুলের  শিক্ষিকা | তার  কাছ  থেকে  এই  স্কুল  সম্পর্কিত  অনেক  কথাই  জানলেন | গ্রামে  লোকবসতি  খুবই  কম  | যারা  এখানে  বাস  করে  সবাই  দরিদ্রশ্রেণীর | সবাই  চাষবাস  করে  খায় | এই  একটিমাত্র  স্কুল | গতদুবছর  হল  সরকারি  অনুদান  পেয়েছে | কিন্তু  কোন  মাস্টার  এসে  এখানে  টিকতে  পারেনা  | কি  এক  অজানা  ভয়ে  ভীত  হয়ে  কয়েকদিনের  মধ্যেই  চলে  যায় | পিয়াল  সব  শুনলেন  | তিনি  এখানে  হেডমাষ্টার  পদেই  বদলি  হয়ে  এসেছেন | মাইনে একধাক্কায়  অনেকটাই  বেড়েছে | তার  মনেও  যে  ভয়  কাজ  করছে  না  তা  নয় | কিন্তু  এই  পদটিকে  টিকিয়ে  রাখতে  গেলে  এই  ভয়কে  তার  জয়  করতেই  হবে |
 বিকালে  তার  আস্তানায়  ফিরে  এসে  তালা  খুলে  ঘরে  ঢুকে  অবাক  | টেবিলের  উপরে  গরম গরম লুচি  আর  আলুরদম | অদ্ভুত  ব্যাপার  তো!  ঘরে  তালা  দেওয়া  অথচ  কেউ  এই  ঘরে  ঢুকে  তার  খাবার  তৈরী  করে  রেখে  গেছে  !কি মারাত্মক  ভৌতিক  কান্ড | পিয়ালের  এই  ভাবনার  মধ্যেই গতকাল রাতে  যে  লোকটি  তাকে  নিয়ে  এসেছিলো  সে  এসে  হাজির |
--- ভাবছেন  তো  বাবু  খাবারগুলো  কে  দিয়ে  গেলো  আর  ঘরেই  বা  কিভাবে  ঢুকলো ? আসলে  ওই  তালার  একটি  চাবি  আমার  কাছে  আছে |
--- তা  কি  করে  সম্ভব ? তালাটা  তো  আমি  বাড়ি  থেকে  নিয়ে  এসেছি | চাবি  তো  আমার  কাছে |
--- আপনি  ওই  তালাটা  দিয়েছিলেন  না | ভুলবশত  এই  কুঠির  পুরনো তালাটাই  লাগিয়েছিলেন |
  পিয়াল  উঠে  গিয়ে টেবিলের  উপর  দেখে  তার  আনা তালা  এটা নয়  অথচ  তার  দিব্যি  মনে  আছে  সে  ব্যাগের  থেকে  তালাচাবি  বের  করে  তালা  লাগিয়েছিল  | মাথায়  কিছুই  ঢুকছে  না  এসব  কি  হচ্ছে  | ব্যাগের  ভিতর  থেকে  নিজের  আনা তালাটা  সে  বের  করে  আরও অবাক  হয়ে  যায় | এটা কি  করে  সম্ভব ? সে  তো  তালাচাবি  রাতেই  বের  করে  রেখেছিলো |
  টিফিনটা  এতো  খাওয়া  হয়ে  গেছিলো  রাতে  আর  পিয়াল  কিচেনে  ঢোকে  না | দুগ্লাস  জল  খেয়ে  ঘুমিয়ে  পরে  | ঘুমের  ভিতর  হঠাৎ  পিয়াল  শুনতে  পায় তার  কানের  কাছে  কেউ  বলছে ,
--- টুমি এখান হইতে  পালিয়ে  যাও , এখানে  থাকিলে টুমায় আমি  মারিয়া ফেলিবো-- 
 ধড়মড় করে  পিয়াল  উঠে  বসে | হারিকেনটা  তখন  তেলের  অভাবে নিভে  গেছে | আবার  তার  কানে  আসে  --
--- সাহেব , তুই  আবার  এসেছিস ? তোর  উদ্দেশ্য  আমরা  এবার  কিছুতেই  সফল  হতে  দেবো না | 
 ভয়ে  ঠকঠক  করে  পিয়াল  তখন  কাঁপছে | সাহেব  আর  বেশ  কয়েকটি  মানুষের  সাথে  তর্কাতর্কি  হয়েই  চলেছে  | সাহেব  চিৎকার  করে  উঠে ,
--- টুমাদের সকলকে হামি  সুট করিবো |
 সঙ্গে  সঙ্গে  বেশ  কয়েকটি  গুলির  আওয়াজ | পিয়াল  অজ্ঞান  হয়ে  যায়  | সকালে  যখন  পিয়ালের  জ্ঞান  ফেরে  দেখে  সেই  পথ  প্রদর্শক  যার  নাম  সে  বলেছিলো  দুর্গাদাস  চৌকিদার  সে  তার  মাথার  কাছে  বসে | পিয়াল  উঠে  বসে  কিছুটা  ধাতস্ত  হয়ে  দুর্গাদাসের  কাছে  জানতে  চায়  
--- আচ্ছা  দুর্গাদাস এই  বাড়িতে  রোজ  রাতে  একজন  সাহেব  আর  কিছু  মানুষের   কার্যকলাপ  আমি  দু'রাতেই  টের  পেলাম | ব্যাপারটা  কি  তুমি  জানো ?
--- আপনি  ভয়  পাননি  তো  বাবু  ?
--- একেবারে  যে  ভয়  পাইনি  তা  কিন্তু  নয়  --- কিন্তু  ব্যাপারটা  জানতে  পারলে  একটু  সুবিধা  হত | 
--- ভয়  পাবেন  না  বাবু | আমরা  সবাই  আছি | আপনি  ভয়কে  জয়  করতে  পারলেই  সাহেবের  ভূত এখান থেকে  পালাবে | ঘটনাটা  তবে  খুলেই  বলি | 

                                         (শেষ পর্ব)

        আজ  থেকে  কয়েকশ  বছর  আগে  যখন  এদেশে  ইংরেজরা  রাজত্ব  করতো  তখন  এখানে  এক  সাহেব  এই  কুঠিতেই  বাস  করতো | গ্রামে  একটা  পাঠশালা  ছিল | ওই  'ওইখানে' আঙ্গুল  দিয়ে  দুর্গাদাস  জালনার  ফাঁকা  দিয়ে  বাইরের  দিকে  দেখিয়ে  দিলো | তা হলো কি - সাহেব বেড়ার পাঠশালা টাকে ভেঙ্গে ওখানে ফুলের বাগান করবে মনস্থির করলো।গ্রামের লোকেরা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেও ভয়ে সাহেবকে কিছু বলতে পারলো না।কিন্তু গ্রামের দুজন একজন চৌকিদার আর একজন বয়স্ক মানুষ যাকে সকলে খুড়ো বলে ডাকতো।তারা দুজনে গ্রামের গরীব মানুষগুলি নিয়ে ওই পাঠশালা ভাঙ্গার সময় বাঁধা দেয়।পরিণামে অসহায় মানুষগুলোর উপর সাহেব গুলি চালায়।সঙ্গে সঙ্গেই খুড়ো মারা যায়।আর চৌকিদার ছুঁটে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পরে সকলের অলক্ষ্যেই;যেখানে সে আগে থাকতেই রেখে এসেছিল তার তীর ধনুক ।সে সাহেবের বুক লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারে ।চৌকিদারের অব্যর্থ নিশানায় সাহেব লুটিয়ে পরে।সাহেব কাতরাতে কাতরাতে বলে,
-- মরে গেলেও হামি এখানে স্কুল হতে দিবো না। ঘোষ্ট হয়ে এখানেই থাকিবো।যে এখানে আসিবে তাহাকেই ভয় দেখাইবো।
 চৌকিদার গাছের আড়াল থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই একজন সেপাই তাকে গুলি করে, সেও মারা যায়।সেই থেকে এখানে কেউ আসলেই সাহেবের আত্মা তাদের উপর চড়াও হয় তখন ওই চৌকিদার আর খুড়োর আত্মা ওই শিক্ষককে বাঁচাতে ছুঁটে আসে । কিন্তু এত কিছু করেও যারা এখানে তারপর থেকে এসেছে সকলেই ভয়ে পালিয়ে গেছে। এখান থেকে পরে স্কুলটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানেও সেই একই সমস্যা। কেউ যখনই বাইরে থেকে এই স্কুলে পড়ানোর জন্য এসেছে সাহেব রাত হলেই তাকে ভয় দেখাতে শুরু করে।সবাই পালিয়ে যায় ভয়ে।কেউ যদি অন্তত কয়েকটা দিন স্কুলে টিকে যেত তাহলে সাহেবের আত্মা কিছু করতে না পেরে এখন থেকে চলে যেত। 
       চুপ করে পিয়াল সব শুনছিল।তারমানে বোঝা যাচ্ছে সাহেব ভয় দেখাবে ঠিকই কিন্তু খুড়ো আর চৌকিদার ঠিক বাঁচিয়ে নেবে ।তিন তিনটে ভূতের ভয় জয় করতে হবে । মেরে ফেলে দেবার আশঙ্কা যখন নেই তখন দাঁতে দাঁত চিপে কয়েকটা দিন দেখায় যাক না ---।
পিয়ালকে চুপ করে থাকতে দেখে দুর্গাদাস বললো,
--- আপনিও কি ভয় পেলেন মাষ্টারমশাই?
--- আরে না,ভয় পায়নি -- না মানে একেবারে যে ভয় পাইনি তা কিন্তু নয় । কথাগুলো দাঁত চিপে বললেন।
 সেদিনটা পিয়াল আর বাইরে কোথাও বেরোলো না। সন্ধার সময় দুর্গাদাস এসে আবার দেখা করে গেলো এবং রাতে যাতে সাহেবের ভূতকে ভয় না পায় তারজন্য বারবার বলে গেলো। এও বললো,"আপনাকে চৌকিদার আর খুড়ো রক্ষা করবে,আপনি শুধু একটু মনে সাহস রাখবেন।"দুর্গাদাসের কথা শুনে পিয়াল নিজের মনেই বলে উঠলো,"এমনভাবে কথাগুলো বলছো যেন ওদের তুমি চেন --"
    কিন্তু কথাটা মুখ ফুটে না বললেও দুর্গাদাস কিন্তু পিয়ালের মনের কথাটা ধরে নিয়ে হেসে বললো,"আজ্ঞে ছেলেবেলা থেকে তাদের এতো গল্প শুনেছি মনেহয় সত্যিই আমি তাদেরকে চিনি।"
 পিয়াল একটু অবাক হল ,ভাবলো যা মনেমনে ভাবলাম তা দুর্গাদাস বুজলো কি করে?কিন্তু রাতের ভয়কে জয় করার চিন্তায় তার কাছে জিজ্ঞাসা করা আর হয়ে ওঠেনা ।
 পিয়াল সেদিন অনেক রাত অবধি ই জেগে বই পড়ছিল।একসময় হ্যারিকেনটা দবদব করতে করতে নিভে গেলো।আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সাহেবের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো সে।
--- টিচার,কবে যাইবে  টুমি এখান হইতে ?
ভয়ে ভয়ে পিয়াল অন্ধকারের মাঝেই কথা ছুঁড়ে দিল --
--- আমি তো এখান থেকে যাবো না সাহেব --।
--- তাহা হইলে আই উইল কিল ইউ--।
--- তুমি আমাকে মারতে পারবে না সাহেব 
 কথাটা বললো বটে পিয়াল কিন্তু তখন তার হাত,পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ।
 পিয়াল হঠাৎ শুনতে পায় এক বৃদ্ধের গলা।সে সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
--- তুমি হেরে গেছো সাহেব এবার তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। এ মাস্টার এখানেই থাকবে।আমাদের স্কুল আবার এই জমিতেই গড়ে উঠবে। 
 বৃদ্ধের গলাটা তার আগে শোনা মনে হল।কিন্তু ভয়ে মস্তিষ্ক তখন তার কাজ করছে না।এবার সে আবারও বললো,
--- দুর্গাদাস,আজ সাহেবকে এখান থেকে আমরা তাড়িয়ে ছাড়বো।
 পিয়াল তখন ঠকঠক করে কাঁপছে।দুর্গাদাস মানে চৌকিদার --। এ কটাদিন সে ভূতের সাথে গল্প করে কাটিয়েছে?একটু পরেই শুরু হল ঘরের মধ্যে এক প্রলয় নাচন।যেন ঘরের ভিতরেই কালবৈশাখীর তাণ্ডব চলছে। কতক্ষণ ধরে এ তাণ্ডব চলেছিল তা পিয়াল জানে না।সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গে স্কুলের সেই অল্প বয়সী টিচারের ডাকে।ধড়মড় করে উঠে বসে সে।একটু ধাতস্থ হয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে।ঘরের ভিতর হুড়মুড় করে মেয়েটির সাথে কিছু গ্রামবাসীও ঢুকে পরে। পিয়াল অবাক হয়।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো।মেয়েটি তাকে জানালো কাল খুড়ো আর চৌকিদার তাকে ঘুমের ভিতর জানিয়ে গেছে সাহেবের আত্মাকে তারা কুঠি থেকে বের করে দিয়েছে।আর কখনো সাহেব এখানে আসবে না। এই কুঠিতেই স্কুল শুরু হবে এখন থেকে।আর কোন ভয় নেই ।সাহেব আর কোন মানুষকে ভয় দেখাতে পারবে না।
 সব শুনে পিয়াল তার চাকরিটা টিকে থাকবে এই আশ্বাস পেয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিলো।শুধু যে খুশিই হল তা নয়,সে চৌকিদার মানে দুর্গাদাস আর খুড়ো মানে যেদিন সে এসেছিল তার পরদিন যে বৃদ্ধ তার সাথে কথা বলে গেছিলো এই দুজনের আত্মাও যে এতদিন এই কুঠীতেই আটকে ছিল এটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো।আসার দিন থেকে দুজনেই তাকে এখানে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে।দুটো স্বল্প শিক্ষিত মানুষ কয়েকশ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এই স্কুলটাকে বাঁচিয়ে রাখতে।শ্রদ্ধায় তাদের প্রতি পিয়ালের মাথা নত হয়ে এলো।
 বছর দুয়েকের মধ্যে কুঠিবাড়ি সেজে উঠলো নূতন স্কুলরুপে। কলকাতা গিয়ে নামকরা আর্টিস্ট দিয়ে তার দেখা খুড়ো আর দুর্গাদাসের ছবি এঁকে পরে পাথরের মূর্তি তৈরি করে স্কুল বাড়ির প্রাঙ্গণে তা রাখা হয়।প্রতিদিন পিয়াল তো বটেই প্রায় সব ছাত্র ছাত্রীই স্কুল আসার পথে যে যেমন ফুল পায় এনে মূর্তিতে দিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করে।এখন স্কুলের ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা তিনশর উপরে।শিক্ষক পাঁচজন।পিয়ালের পরিবারও মাঝে মধ্যে এসে এখানে থাকে এখন।স্কুল চত্বরের ভিতরেই তৈরি করা হয়েছে প্রধান শিক্ষকের আবাসস্থল।পিয়ালকে সকলে খুব ভালোবাসে আর মান্যও করে।পিয়ালের ইচ্ছা কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে এই পাঠকাঠি গ্রামেই একটু জমি কিনে বসবাস করা।কারণ ষাট বছর বয়স হলেই তো তাকে এই কুঠির আবাস ছাড়তে হবে।সে যে এই গ্রাম আর গ্রামের মানুষগুলিকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে।

                        শেষ

Saturday, December 12, 2020

আমার জীবনের এতো খুশি এতো হাসি

আমার জীবনের এতো খুশি এতো হাসি 

  গরীবের ঘরে জন্ম হলেও জীবনটা ছিল খুব উচ্ছ্বল | বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত সংসারে অর্থের অভাব থাকলেও হাসি,আনন্দ,সুখ আর ভালোবাসার কোন অভাব ছিলনা |অভাব ছিল শুধু অর্থের |
  কোনরকমে মাধ্যমিক টা পাশ করেছিল সুপ্তা |বাবা একটা বিল্ডার্সের দোকানে খাতাপত্র দেখাশুনা করতেন|মা পুরনো কাগজ কিনে এনে ঠোঙ্গা বানাতেন|দুই ভাইবোন সুপ্তারা|সুপ্তা বড় আর ভাই সুকুমার ছোট | সে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে|মাকে ঘরের কাজে সাহায্য ছাড়াও সে মায়ের সাথে ঠোঙ্গা বানায় দোকানে দোকানে দিয়ে আসে|একদিন ঠোঙ্গা দোকানে দিয়ে যখন বাড়ি আসছে মধ্যবয়সী এক ভদ্রমহিলা তাকে ডেকে নাম,ধাম জিজ্ঞাসা করে ন |বাড়িতে এসে মাকে সেকথা জানায়|মা ব্যাপারটা পাত্তা দেন না|
 পরদিন সন্ধ্যায় সেই ভদ্রমহিলা আর তারই বয়সী একটি মেয়ে আসে তাদের বাড়ি |ভদ্রমহিলা জানান তিনি তার ছেলের জন্য সুপ্তা কে পছন্দ করেছেন |ছেলে একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করে|বাড়িতে একটা ভাড়া আছে,মেয়ে রঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ,দাদার বিয়ের পরেই রঞ্জনার বিয়ে হবে|সব শুনে সুপ্তার মা জানান,
--- দিদি,সবই তো ঠিক আছে ;তবে দেখতেই তো পারছেন আমরা খুবই গরীব আপনাদের যদি কোন দাবি থাকে তাহলে কিন্তু আমরা পারবো না|
--- না,না আমাদের কোন দাবি নেই |রাস্তায় ওকে দেখে আমার পছন্দ হল তাই ওর কাছ থেকেই বাড়ির ঠিকানা জেনে আপনাদের সাথে কথা বলতে চলে এলাম|
--- ওর বাবা বাড়ি ফিরলে আমি সব জানাবো|তবে মেয়ের হাতে,কানে,গলায় আর একটা আলমারি আমরা দেবো|
  তিনমাসের মধ্যে সুপ্তা তার স্বামী সুকুমারের হাত ধরে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো |শ্বাশুড়ী, ননদ নিয়ে মাস দুয়েক বেশ ভালোই কাটলো |দেখতে দেখতে ননদের বিয়ের দিন এসে গেলো|কিন্তু ননদের বিয়ের খরচ আর সংসারের নেই,নেই আলোচনাটা মা,ছেলে সবসময় সুপ্তার সামনেই করতে থাকে|প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও পরে সে বুঝে ফেলে ওই গলায়,কানে আর হাতের ছ'গাছা চুড়ির জন্যই তার সামনে এই আলোচনা|বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে সুপ্তা|সুপ্তার দিক থেকে কোন সারা না পেয়ে একদিন সুকুমার রাতে তাকে বলেই ফেলে,
---  এখন ও তো আমি রঞ্জনার বিয়ের সব জোগাড় করে উঠতে পারিনি তুমি যদি আমাকে একটু হেল্প করতে তাহলে আমি পরে তোমাকে সব ফেরৎ দিয়ে দিতাম |
 সুকুমার রঞ্জনাকে আদর করতে করতে কথাগুলি বলে |নিজেকে সুকুমারের কাছ থেকে মুক্ত করে সুপ্তা সুকুমারের কাছে জানতে চায়,
--- কি করতে হবে আমাকে?বাবার দেওয়া ওই সামান্য গয়নাগুলো নেবে ?
--- না, মানে বলছিলাম তোমাকে আস্তে আস্তে আমি আবার সব গড়িয়ে দেবো|
 সুপ্তা নিজেকে মনেমনে শক্ত করে বলে,
--- গয়না দিয়ে আর কি হবে আমার?কিন্তু বাবার দেওয়া গয়না তো তাই মনটা খারাপ লাগছে|এরপর তুমি আমাকে যত গয়নায় বানিয়ে দাও না কেন আর তা যতই ভারী গয়না হোক না কেন,বাবার দেওয়া ওই সামান্য কটা গয়না আমার কাছে বহু মূল্যবান|
--- আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আবার সব গড়িয়ে দেবো |
 একটু আমতা আমতা করে সুকুমার বলে ,
--- আর যদি তোমার আলমারিটা ---?
--- তাহলে আমি কোথায় জামাকাপড় রাখবো?
--- যদি কটাদিন কষ্ট করে মায়ের আলমারি তে রাখো কয়েক মাসের মধ্যেই তোমায় আলমারি কিনে দেবো |অফিসে লোনের এপ্লাই করেছি কিন্তু এখনো পেতে বেশ কয়েক মাস লাগবে|শুধু কয়েকটা মাসের জন্য একটু কষ্ট করলেই আমি তোমাকে আরও ভালো আলমারি কিনে দিতে পারবো |
 চোখ ভর্তি জল অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে সুপ্তা তার স্বামীকে বলে
--- ঠিক আছে|আমার তো আর কিছু নেই ,তবে বিয়ের বেনারসি টা আছে|যদি দরকার হয় বোলো|
 সুকুমার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আর সুপ্তা নিজের চোখের জল লুকাতে পাশ ফিরে শুয়ে পরে|সুকুমার তাকে কাছে টেনে নিতে গেলে সে পাশ ফিরেই তাকে জানায়,
--- হঠাৎ মাথাটা ভীষণ যন্ত্রণা করছে গো ,আজ আর ভালো লাগছে না|
  সুকুমার বুঝতে পারে এটা সুপ্তার রাগের বা কষ্টের বহিঃপ্রকাশ |সেও তাকে আর ঘাটায় না| সেও জয়ের আনন্দে হাসি হাসি মুখে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে|
 সুপ্তা পুরো ঘটনাটা বাপের বাড়ি লুকিয়ে যায়|মাসের পর মাস সুপ্তার না আসে আলমারি না আসে গয়না |স্বামী,শ্বাশুড়ীর তার প্রতি ব্যবহারেরও আমূল পরিবর্তন |চাপা স্বভাবের সুপ্তা নিজমনে সংসারের যাবতীয় কাজ করে চলে | আলমারিটা দিয়ে দেওয়ার পর একটা ভাঙ্গা শোকেসের ভিতর সে তার কাপড়গুলো কোনরকমে গুছিয়ে রেখেছিলো| সুকুমারের জামাকাপড় তার মায়ের আলমারিতেই থাকে | অনেক ভেবেচিন্তে সে একদিন রাতে সুকুমার কে খেতে দিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে,
--- তোমার লোনটা পেতে আরও দেরি হবে ?
--- কিসের লোন?
--- রঞ্জনার বিয়ের আগে বলেছিলে না লোনের এপ্লাই করেছো ,লোনটা পেলে আলমারি কিনে দেবে |শোকেসটা তো ভাঙ্গা সেদিন দেখি ইদুর ধুঁকেছে ---|
--- করি তো সামান্য একটা চাকরি | মাইনে যা পাই সংসার চালাতেই হিমশিম। ওই কোম্পানী লোন কাউকে দেয় না।
--- তারমানে আমাকে তুমি মিথ্যা বলেছিলে?
--- এতদিনে যে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছো তাতেই কৃতার্থ হলাম|তোমার বাবাকে বোলো তিনি যেন ভালো দেখে এবার একটা আলমারি তোমায় কিনে দেন |বোনের আলমারিটা ভালো হয়নি তার শ্বশুরবাড়ি থেকে বলেছে | একটা খাট পর্যন্ত তোমার বাবা দেয়নি | আমার পুরনো খাটে রোজ ঘুমাচ্ছো --- বোনকে তো আর আমি খাট না দিয়ে পারিনি আর তাছাড়া ----
 কথা শেষ হওয়ার আগেই চুপচাপ থাকা মেয়েটা হঠাৎ মুখরা হয়ে উঠলো ।
--- তারমানে আমায় বিয়ে করেছিলে আমার বাবার আমাকে দেওয়া জিনিসগুলি নিয়ে বোনেরবিয়ে দেওয়ার জন্য ?
--- তাই ছাড়া আবার কি ?তুমি কি ভেবেছিলে ?মা তো ভাবতেই পারেনি ওই রকম পলকা গয়না তোমার বাবা তোমাকে দেবেন |মায়েরও ভীমরতি ধরেছিলো|
--- আমার বাবা তো পলকা হলেও দিয়েছিলেন তোমাদের তো সে মুরোদ ও নেই । এর থেকে আমার বাবার কাছে হাত জোড় করে দাঁড়ালে বাবা কিছুটা অর্থ সাহায্য করলেও করতে পারতেন ---।এককথা  দুকথায় ঝামেলা চরমে ওঠে। তেড়ে মারতে যায় সুকুমার সুপ্তাকে ।ঠিক সেই মুহূর্তে শ্বাশুড়ী এসে সুপ্তাকে মারের হাত থেকে বাঁচান | শ্বাশুড়ী চিৎকার করে বলেন ,
--- আমরা তো অনেক আগেই ভেবেছিলাম তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ,তোমার তো আবার গন্ডারের চামড়া ।অনেক তো হল বাপু এবার বিদায় হও ।
--- মানে?
--- তবে শোনো, আমাদের তো জমানো কোন ক্যাশ ছিল না ।এদিকে রঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়েছে তাকে তো আর খালি হাতে বিদায় দিতে পারিনা ।তাই অনেক ভেবেচিন্তে সুকুমারের তোমার সাথে বিয়েটা দিই।শুধুমাত্র ওই জিনিসগুলির জন্য।
--- আপনারা এতটা খারাপ !
সুকুমার বলে ওঠে ,
--- সেইজন্যই তো বলছি আমাদের সাথে থেকো না ।তোমার মা,বাবার কাছে চলে যাও|
  স্রোতের মত সময়ও বসে থাকেনা --- সুকুমার এখন জেলে |সেদিন ঝামেলার মধ্যে সুকুমার এক সময় সুপ্তার গলা টিপে ধরে |কোন রকমে ছাড়িয়ে সুপ্তা ঘর থেকে দৌড়ে বাইরে চলে যায়।পরিচিত একটি দোকান থেকে কিছু টাকা ধার করে সোজা বাড়ি চলে আসে ।কিন্তু সুকুমার ও তার মাকে অনেক চেষ্টার পরে শাস্তি দিতে সক্ষম হয়।জেলে থাকাকালীন সময়েই হার্ট অ্যাটাকে তার মা মারা যান |সুকুমার বিনা বিচারেই জেলার ঘানি টানছে ।রঞ্জনার শ্বশুরবাড়ি সমস্ত ঘটনা জানার পর রঞ্জনাকে জানিয়ে দিয়েছে দাদার সাথে কোন সম্পর্ক রাখলে সে বাড়ি তাকে ত্যাগ করতে হবে। তাই রঞ্জনাও দাদার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছে ।স্থানীয় পার্টির লোকজন ধরে পঞ্চায়েত অফিসে ক্লাস ফোর এর একটি চাকরি জোগাড় করেছে |কাউন্সিলর তাকে আশ্বাস দিয়েছেন কাজটা পার্মানেন্ট করতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।
 সুপ্তার জীবন নূতন খাতে বইতে শুরু করে।হয়তো একদিন সে তার সমস্ত অতীত ভুলে গিয়ে জীবনের সুখের ঠিকানাটা খুঁজে পাবে। 
                         শেষ 

Friday, December 11, 2020

যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে



  ভালোবাসা মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে তা বোধকরি দেবেশ নিজেও বুঝতে পারেনি | দেবেশ ভেবেছিলো আর পাঁচটা মেয়ের মতই অনামিকাকে নিয়ে একটু ঘুরে ,খেয়ে ফুর্তি করে বাকিদের মত ছুড়ে ফেলবে |কিন্তু না দেবেশও যেন এবার সম্পূর্ন অন্যরকম | অনামিকাকে  নিয়ে ঘোরা, বেরোনো, খাওয়া সবই করছে কিন্তু তাকে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কখনো স্পর্শ করতে পারছে না | কই বাকিদের ক্ষেত্রে তো তা হয়নি ;তবে অনামিকার ক্ষেত্রে কেন এটা হচ্ছে ?" তবে কি অনামিকাকে  ভালোবেসে ফেললাম?" নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করে |
  বড়লোকের বকে যাওয়া একমাত্র সন্তান দেবেশ রায় চৌধুরী| ব্যবসায়ী বাবার অঢেল টাকাপয়সা সম্পত্তি |কোনরকমে উচচমাধ্যমিকটা পাশ করে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছে দেবেশ |ব্যবসায়ী পিতা অনেক চেষ্টা করেও ছেলেকে কলেজমুখি করতে পারেননি |ততদিনে দেবেশ মদ,সিগারেট,আর নারী আসক্ত হয়ে পড়েছে |কিন্তু অত্যন্ত চালাক প্রকৃতির ছেলে দেবেশ এ পর্যন্ত কোন ঝামেলায় কোন দিনও পড়েনি| টাকা উড়িয়েই সকলের মুখ বন্ধ করে দিতো |নিজেকে রক্ষা করার সমস্ত কৌশল অবলম্বন করেই সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতো| পুরুষ হিসাবে দেবেশ ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী | তাই সহজেই মেয়েরা তার প্রতি আকর্ষিত হত|
   অনামিকা,মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে | কলেজে পড়ে |নম্ন স্বভাবের |পড়াশুনা ছাড়া বাড়িতে মাকে ঘরের কাজে সহায়তা করা - এর বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না | একদিন রাতে কোচিং থেকে ফেরার পথে কিছু অল্প বয়স্ক ছেলে তার পথ আটকায় |এদের কাউকেই সে চিনতো না |ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাত জোর করে ছেলেগুলির কাছে সে তার সম্মান ভিক্ষা করছিলো| আর ঠিক সেই সময়ে বাইকে করে দেবেশ ও তার দুই বন্ধু ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো | দেবেশদের বাইক দাঁড়িয়ে  যাওয়ায় ওই ছেলেগুলি তাদের দেখে মুহূর্তেই পালিয়ে যায় |দেবেশ তার নূতন শিকার মনে করে অনামিকাকে আস্তে আস্তে  ঠিক তার ভালোবাসার প্রস্তাবে রাজি করায় |কিন্তু নিজের ভিতরেই অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকে |কিছুতেই আর পাঁচ জনের মত অনামিকার সাথে কোন খারাপ কিছু করতে পারে না|
 এইভাবেই বছর খানেক গড়িয়ে যায় |অনামিকার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই তার বাড়ি থেকে বিয়ের সম্মন্ধ দেখতে থাকে|ছেলের মা,বাবা এসে তাকে দেখে পছন্দ করে | যেদিন ছেলের দেখতে আসার কথা অনামিকা লুকিয়ে দেবেশের সাথে দেখা করে সব জানায়| দেবেশ মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেয় তাকে বিয়ে করার |বাইকের পিছনে বসিয়ে সোজা কালীঘাট |বৌ নিয়ে রাতেই বাড়ি ফেরে|উরণচণ্ডী  ছেলের এ বিয়ে মা প্রসন্নমনে মেনে নিলেও বাবা বেঁকে বসেন |তার বক্তব্য 
-- রোজগারের কোন রাস্তা জানা নেই ,পড়াশুনা না করে নিজের হাতে নিজের ভবিষ্যত  শেষ করলো ,কতদিন বলেছি নিজেদের ব্যবসাটা দেখতে ,না উনি গায়ে হওয়া লাগিয়েই ঘুরবেন |আমি এই বিয়ে কিছুতেই মানবো না |
  দেবেশের মা নিজের গলার স্বর খাটো করে বললেন ,
--- তোমার এই তো সুযোগ |এটাই তুমি ওর কাছে শর্ত রাখো |এখন থেকে ওকেই ব্যবসা দেখতে হবে |
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিষ্টার রায় চৌধুরী বলেন,
--- ব্যবসায়ী মানুষের সাথে ঘর করতে করতে তোমার তো দেখছি বুদ্ধি হয়েছে গিন্নী| তা তোমার গুনোধরকে ডাকো কথাটা পাকা করে নিই |
দেবেশ এখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ |বাবার ব্যবসার পুরোটাই  সে দেখাশুনা করে| তিনিও নিশ্চিত মনে ছেলের উপর ভরসা করতে শুরু করেছেন|ছেলের এই আমূল পরিবর্তনের স্বামী,স্ত্রী দুজনেই খুব খুশি |অনামিকাকে তারা ভীষণ ভালোবাসেন |দেবেশের এই পরিবর্তনের ফলস্বরূপ তারা অনামিকাকে লক্ষীমন্ত বৌ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন |
দুবছরের মাথায় অনামিকা যখন তাদের মধ্যে নূতন এক অতিথি আসার খবর দিলো তখন সকলেই খুব খুশি হয়ে গেলো |অনামিকাকে প্রথম থেকেই তার শ্বাশুড়ী সংসারের কোন কাজই করতে দেন না |আর এই খবরে তিনি তার কন্যাসম পুত্রবধুকে নিজের বিছানাটাও তুলতে দেখলে দেবেশের উপর চড়াও হন |দেবেশ নিজেই কোনদিন ভাবতে পারেনি সে তার জীবনে কাউকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে |
 আট মাসের মাথায় অনামিকার সামান্য ব্লিডিং হয় |ডাক্তার তাকে হয় হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন নুতবা বাড়িতেই হাসপাতালের মতই বেডরেষ্টে থাকতে  থাকতে বলেন |তারা বাড়িতেই বেড রেষ্টে থাকা মনস্থির করে|
সেদিন রাতে দেবেশের বুকে মাথা দিয়ে অনামিকা বলে,
--- কেন জানিনা আমার খুব ভয় করছে |
--- দূর পাগলী আমরা সবাই আছি তো!আর তো মাত্র দুটো মাস|দেখতে দেখতেই কেটে যাবে |জানো আমার ভাবতেও ভালো লাগছে আমাদের দুজনের মাঝে ছোট্ট একটা পুতুল শুয়ে থাকবে |সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াবে,ছুটোছুটি করবে ---
কথা শেষ হওয়ার আগেই অনামিকা বলে উঠলো,
--- যদি আমার কিছু হয়ে যায় ---
দেবেশ খপ করে তার অনুর মুখটা চেপে ধরলো |
--- এইসব কথা আর কখনোই মুখে এনোনা|তুমি আমার জীবনে পরশপাথর |তোমাকে পেয়ে আমার জীবনের সবকিছু পাল্টে গেছে |আমি নিজেকে তুমি ছাড়া ভাবতেই পারিনা |আজকে আমায় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো আর কোনোদিন ও এ ধরনের কথা বলবে না|
অনামিকা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দেবেশ কে জড়িয়ে ধরে বলে,"এত্ত ভালোবাসো আমায়?আচ্ছা বাবা আর কোনদিন বলবো না|"
 নিদৃষ্ট সময়ের অনেক আগেই অনামিকাকে ভর্তি করতে হয় তার শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকার জন্য|ডেলিভারীর সামান্য আগে বাচ্চার পজিশন পাল্টে যায় |বাড়ির লোকের মত নিয়ে তড়িঘড়ি সিজার করা হয় |কিন্তু তার আগেই অনামিকা অনেকটাই কাহিল হয়ে পড়ে|তারপর অ্যানস্তেসিয়া ;সেই জ্ঞান আর তার ফেরে না| 
বাড়ির সকলেই ভীষণ ভেঙ্গে পরে|দেবেশ প্রায় উন্মাদ হয়ে যায় |মেয়ে দেবেশের মায়ের কাছেই মানুষ হতে থাকে|মেয়েটাকে দেখলেই দেবেশ যেন আরও বেশি করে কষ্ট পায় |
 এখন মেয়ে অনেক টাই বড়|সারা বাড়ি মাতালের মত হেঁটে বেড়ায় |দেবেশের মা সব সময় খেয়াল রাখতে ও পারেননা |তারও বয়স হয়েছে|সর্ব ক্ষণের জন্য একটি মেয়ে থাকলেও এক বছরের একটি বাচ্চা কে চোখে চোখে রাখা চারটে খানি কথা নয় |একদিন ব্যবসার কাজে বেরোনোর একটু আগে সে খেতে বসেছিলো |মুস্কান টলোমলো পায়ে হেঁটে এসে বাবার হাঁটুর উপর হাত রেখে নিজে খাবে বলে হা করে|দেবেশ দুহাতে তাকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে |দুচোখ থেকে সমানে জল পরে যেতে থাকে | মনেমনে সে তার অনুকে বলে,
--- আর কখনো তোমার মেয়েকে আমি অবহেলা করবো না|ওকে দেখলেই আমার তোমার জন্য আরও বেশি করে কষ্ট হত | তাই এতদিন ওকে আমি দেখলেই ভাবতাম ওকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়েই তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছো |কিন্তু ওকে বুকে নিয়ে আমি বুঝতে পারছি তুমি কোথাও হারাও নি ওর মধ্যেই আমার আমৃত্যু  বেচেঁ থাকবে |

                  শেষ 

 

Tuesday, December 8, 2020

সব গল্প মিথ্যে নয়

কালো অতীত  

  আমার জীবনে ফেলে আসা এক কালো অতীত আছে | যা আজ চল্লিশ বছর ধরে নীরবে একাকীই বয়ে চলেছি | যতদিন বাবা,মা বেঁচে ছিলেন -- তারা ছিলেন আমার অতীতের স্বাক্ষী | কিন্তু আজ আর কেউ নেই,যে সেই অতীতের কথা জানে|
   পনের বছর বয়স তখন | বাড়িতে কেউ না থাকার কারণে আমাদের বাগানের মালির ছেলে সুযোগ বুঝে কোন ফাঁকে উপরে আমার ঘরে ঢুকে আমার মুখ,হাত বেঁধে আমার উপরে যৌন নির্যাতন শুরু করে | তার ইচ্ছা ছিল তার এই খেলা সাঙ্গ করে সে আমায় মেরে ফেলবে | কিন্তু হঠাৎ বাবা , মায়ের আসার গাড়ির আওয়াজ পেয়ে ছুরিটা ঘরের মধ্যে ফেলেই সে ছুঁটে পালিয়ে যায় | 
 আমার প্রতি নরেশের একটা প্রবল রাগ ছিল | নরেশ তার বাবার সাথে বাগানে মাঝেমধ্যেই কাজ করতে আসতো | একবার বাবা ভুল করে গাড়ির মধ্যেই তার মানিব্যাগটা ফেলে গেছিলেন | নরেশকে আমি দেখে ফেলেছিলাম টাকা নিতে এবং বাবাকে সেকথা জানাতে বাবা নরেশের বাবাকে কথাটা জানিয়েছিলেন | মালিকাকু সেদিন নরেশকে খুব মেরেছিলেন | তারপর থেকে তার আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ | সেও  সুযোগ খুঁজতে থাকে | বাড়ি ফাঁকা পেয়ে সটান আমার ঘরে উপরে চলে আসে |
 পরের মাসেই মা ধরে ফেলেন আমি কনসিভ করেছি | বাবা তার প্রভাব খাঁটিয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে জেলে দেন | আমাকে বাবা,মা বড় নার্সিংহোমে নিয়ে যান |
  পড়াশুনায় খুব একটা কোনদিনও ভালো ছিলামনা | গ্রাজুয়েশনের পরেই সবকিছু লুকিয়ে আমার বিয়ে দেওয়া হয় | ছেলে রেলের উচচপদস্থ কর্মচারী | সুখী বৈবাহিক জীবন | কিন্তু এক অজানা আশংখায় বুকটা মাঝেমধ্যেই কেঁপে ওঠে | বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়ও যখন আমার কোন সন্তান হলনা তখন ডক্টরের শরণাপন্ন হলাম | পরীক্ষানিরীক্ষার পর নামকরা ডাক্তার জানিয়ে দিলেন নাড়ির একটি মুখ জন্মগত চাপা | সন্তান আসতে পারে কিন্তু আমার জীবনের আশংকা আছে | তখন আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিলো," না, এটা আমার জন্মগত দোষ নয়; ডাক্তারের ভুলের জন্য এরূপ হয়েছে | আগে একবার একজনে ভুল করেছে এবার আপনিও ভুল বলছেন |"কিন্তু  ওই কালো অতীতকে তো আমি সামনে আনতে পারবোনা | তাই জীবনের দ্বিতীয় পরাজয়ও মেনে নিলাম | 
  বিয়ের দশবছর পর একটি কন্যাসন্তান দত্তক নিলাম | নিজেরা তাকে কোনদিনও নিজেদের সন্তান ছাড়া কিছু ভাবিনি | উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিলাম | বিয়ের ছমাসের মাথায় জামাইয়ের প্রমোশন হয়ে বিদেশ পারি দিলো আমার মেয়ে সমেত | আর তারা দেশে ফিরলোনা | যোগাযোগ বলতে মাঝে মাঝে ফোনে সামান্য কথা | এটা আমার তৃতীয় পরাজয় |
 সুস্থ্য,সবল মানুষটি খেয়েদেয়ে বাথরুমে গেলো পরে তাকে দরজা ভেঙ্গে বের করতে হল | ব্রেনস্ট্রোক | এখানেও ঘটলো আর একটি পরাজয় | কিন্তু শত  পরাজয়ের মাঝেও আমি ভেঙ্গে পড়িনি | একা এই নির্জন বাড়িতে বসে যে কষ্ট আমি প্রতিনিয়ত পাচ্ছি - সব কষ্ট, সব পরাজয়ের থেকেও এই একাকিত্ব আমায় প্রতিনিয়ত পরাজিত করে চলেছে ; যার থেকে আমি বেরোতে পারিনা আর কোনদিনও বেরোতে পারবোও না | এখন যেন প্রতিনিয়ত ওই কালো অতীত অনেক বেশি করে আমার সামনে আসে | কিছুতেই  আমি তাকে সরিয়ে আমার জীবনের সুন্দর,সুন্দর মুহুর্ত্বগুলি নিয়ে সময় কাটাতে পারিনা | 
 বসে আছি সেই দিনটির জন্য যেদিন এইসব অতীত থেকে বেরিয়ে আমি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো |
                               (সমাপ্ত)
 শব্দসংখ্যা - 480

কালো অতীত

কালো অতীত  

  আমার জীবনে ফেলে আসা এক কালো অতীত আছে | যা আজ চল্লিশ বছর ধরে নীরবে একাকীই বয়ে চলেছি | যতদিন বাবা,মা বেঁচে ছিলেন -- তারা ছিলেন আমার অতীতের স্বাক্ষী | কিন্তু আজ আর কেউ নেই,যে সেই অতীতের কথা জানে|
   পনের বছর বয়স তখন | বাড়িতে কেউ না থাকার কারণে আমাদের বাগানের মালির ছেলে সুযোগ বুঝে কোন ফাঁকে উপরে আমার ঘরে ঢুকে আমার মুখ,হাত বেঁধে আমার উপরে যৌন নির্যাতন শুরু করে | তার ইচ্ছা ছিল তার এই খেলা সাঙ্গ করে সে আমায় মেরে ফেলবে | কিন্তু হঠাৎ বাবা , মায়ের আসার গাড়ির আওয়াজ পেয়ে ছুরিটা ঘরের মধ্যে ফেলেই সে ছুঁটে পালিয়ে যায় | 
 আমার প্রতি নরেশের একটা প্রবল রাগ ছিল | নরেশ তার বাবার সাথে বাগানে মাঝেমধ্যেই কাজ করতে আসতো | একবার বাবা ভুল করে গাড়ির মধ্যেই তার মানিব্যাগটা ফেলে গেছিলেন | নরেশকে আমি দেখে ফেলেছিলাম টাকা নিতে এবং বাবাকে সেকথা জানাতে বাবা নরেশের বাবাকে কথাটা জানিয়েছিলেন | মালিকাকু সেদিন নরেশকে খুব মেরেছিলেন | তারপর থেকে তার আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ | সেও  সুযোগ খুঁজতে থাকে | বাড়ি ফাঁকা পেয়ে সটান আমার ঘরে উপরে চলে আসে |
 পরের মাসেই মা ধরে ফেলেন আমি কনসিভ করেছি | বাবা তার প্রভাব খাঁটিয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে জেলে দেন | আমাকে বাবা,মা বড় নার্সিংহোমে নিয়ে যান |
  পড়াশুনায় খুব একটা কোনদিনও ভালো ছিলামনা | গ্রাজুয়েশনের পরেই সবকিছু লুকিয়ে আমার বিয়ে দেওয়া হয় | ছেলে রেলের উচচপদস্থ কর্মচারী | সুখী বৈবাহিক জীবন | কিন্তু এক অজানা আশংখায় বুকটা মাঝেমধ্যেই কেঁপে ওঠে | বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়ও যখন আমার কোন সন্তান হলনা তখন ডক্টরের শরণাপন্ন হলাম | পরীক্ষানিরীক্ষার পর নামকরা ডাক্তার জানিয়ে দিলেন নাড়ির একটি মুখ জন্মগত চাপা | সন্তান আসতে পারে কিন্তু আমার জীবনের আশংকা আছে | তখন আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছিলো," না, এটা আমার জন্মগত দোষ নয়; ডাক্তারের ভুলের জন্য এরূপ হয়েছে | আগে একবার একজনে ভুল করেছে এবার আপনিও ভুল বলছেন |"কিন্তু  ওই কালো অতীতকে তো আমি সামনে আনতে পারবোনা | তাই জীবনের দ্বিতীয় পরাজয়ও মেনে নিলাম | 
  বিয়ের দশবছর পর একটি কন্যাসন্তান দত্তক নিলাম | নিজেরা তাকে কোনদিনও নিজেদের সন্তান ছাড়া কিছু ভাবিনি | উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিলাম | বিয়ের ছমাসের মাথায় জামাইয়ের প্রমোশন হয়ে বিদেশ পারি দিলো আমার মেয়ে সমেত | আর তারা দেশে ফিরলোনা | যোগাযোগ বলতে মাঝে মাঝে ফোনে সামান্য কথা | এটা আমার তৃতীয় পরাজয় |
 সুস্থ্য,সবল মানুষটি খেয়েদেয়ে বাথরুমে গেলো পরে তাকে দরজা ভেঙ্গে বের করতে হল | ব্রেনস্ট্রোক | এখানেও ঘটলো আর একটি পরাজয় | কিন্তু শত  পরাজয়ের মাঝেও আমি ভেঙ্গে পড়িনি | একা এই নির্জন বাড়িতে বসে যে কষ্ট আমি প্রতিনিয়ত পাচ্ছি - সব কষ্ট, সব পরাজয়ের থেকেও এই একাকিত্ব আমায় প্রতিনিয়ত পরাজিত করে চলেছে ; যার থেকে আমি বেরোতে পারিনা আর কোনদিনও বেরোতে পারবোও না | এখন যেন প্রতিনিয়ত ওই কালো অতীত অনেক বেশি করে আমার সামনে আসে | কিছুতেই  আমি তাকে সরিয়ে আমার জীবনের সুন্দর,সুন্দর মুহুর্ত্বগুলি নিয়ে সময় কাটাতে পারিনা | 
 বসে আছি সেই দিনটির জন্য যেদিন এইসব অতীত থেকে বেরিয়ে আমি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবো |
                               (সমাপ্ত)
 শব্দসংখ্যা - 480

Friday, November 27, 2020

আশ্রিতা

আশ্রিতা 

--- কি  গো  মা এখনও চা  টা খেয়ে  পারোনি  ?
 সর্বক্ষণের  সঙ্গী  চঞ্চলা  এসে  শ্রদ্ধা  আর  ভালোবাসা  মিশ্রিত  বকা  দিয়ে  উঠলো  শোভনাদেবীকে | বহু  বছর  ধরে  এই  মেয়েটা  তার  বাড়িতে  রয়েছে | চোখ  বুজলেই  আজও রাতের  সেই  বিভীষিকাময়  ঘটনাটার  কথা  তার  মনেপড়ে | অনেক  রাতে  স্বামীর  সাথে  বাপেরবাড়ি  থেকে  শেষ  ট্রেন  ধরে  নিজের  বাড়িতে  ফিরছিলেন | মাঘমাসের  শীত  | লোকজন  খুবই  কম  স্টেশনে | তারা  ট্রেন  থেকে  নেমেই  প্লাটফর্ম  ধরে  হাঁটতে শুরু  করেন  | চোখ  দুটি  ছাড়া  সবই  গরম পোশাকে  ঢাকা  | ঠিক  সেই  মুহূর্তে   অপূর্ব  দেখেন    একটি  মেয়েকে  জোর  করে দুটি  ছেলে  টেনে  হিঁচড়ে নিয়ে  চলেছে | তার  গোঙানীর আওয়াজ  শুনেই  জাঁদরেল পুলিশ  অফিসারের  বুঝতে  একটুও  ভুল  হয়না  কলকাতার  বুকে  আর  একটা  ধর্ষণ  ঘটতে  চলেছে | স্ত্রীকে  কিছু  বলার  সুযোগও তিনি  পান  না | দৌড়ে  এগিয়ে  গিয়ে  দুটিকেই  ঘায়েল  করে  মেয়েটিকে  উদ্ধার করেন | ছেলেদুটি  পালিয়ে  যায় | তিনিও  তাদের  পিছে  ধাওয়া  করেন  | কিন্তু  অন্ধকারের  ভিতর  অচেনা  রাস্তায়  তাদের  কোন  হদিস না  পেয়ে  তিনি  মেয়েটির  কাছে  ফিরে  এসে দেখেন  ততক্ষণে তার  স্ত্রী  সেখানে  পৌঁছে  মেয়েটির  মুখের  বাঁধন  খুলতে  চেষ্টা  চালিয়ে  যাচ্ছেন | তিনিও  হাত  লাগান  এই  কাজে | মেয়েটির  কাছ  থেকে  জানতে  পারেন  মদ্যপ  স্বামী  সামান্য  কিছু  টাকার  বিনিময়ে  তাকে  বিক্রি  করে  দিয়েছে | তাও সে  জানতে  পেরেছে  ওই  লোকদুটির  কথা  থেকে | বাপেরবাড়িতে  কেউ  নেই | একটা  মেয়ে  ছিল  তিনমাসের | একদিন  স্বামী  তার  মদ  খেয়ে  এসে  তাকে  মারধর  করতে  করতে  মেয়েটিকে  আছাড় মেরে  মেরে  ফেলে  দিয়েছে | পুলিশে  ধরেও  নিয়ে  গেছিলো | নিজেই মিথ্যে  স্বাক্ষী  দিয়ে  তাকে  জেল  থেকে  ছাড়িয়ে  এনেছিল  যদি  এবার  তার  পরিবর্তন  হয় | কিন্তু  ফিরে এসেই  সে  স্বমূর্তি  ধারণ  করে | মেয়েটির  নাম  মরিয়ম | 
  শোভনাদেবী  ও  অপূর্ববাবু  মহাফ্যাসাদে  পরে  যান  | এখন  মেয়েটিকে  নিয়ে  কি  করবেন  কিছুই  বুঝে  উঠতে  পারেননা | মরিয়ম  কেঁদে  বলে ," আমাকে  একটু  আশ্রয়  দেবে  তোমরা ?আমি  বাড়ির  সব  কাজ  করে  দেবো | বিনিময়ে  একটু  মাথাগোঁজার  ঠাঁই আর  দুবেলা  আধপেটা  খেয়েও  থাকতে  পারবো |" কথাটা  শুনে  শোভনাদেবীর  খুব  মায়া হয়  মরিয়মের  প্রতি | তিনি  স্বামীকে  অনুরোধ  করেন  তাকে  সাথে  নিয়ে  যেতে  | কিন্তু  অপূর্ববাবুর  মনে  একটা  ভয়  কাজ  করতে  থাকে | মায়ের  গোপাল  রয়েছে  বাড়িতে | জাতিতে  মুসলিম  একটি  মেয়েকে  নিয়ে  গেলে  তিনি  কিছুতেই  তাকে  বাড়িতে  থাকতে  দেবেন  না | কথাটা  তিনি  তার  স্ত্রীকে বলেন | শোভনাদেবী  সেই  মুহূর্তেই  মরিয়মের  নাম  পাল্টে  চঞ্চলা  রেখে  দেন  আর  স্বামীকে  বলেন ,
--- মাকে  বলবো  ওকে  আমার  বাপেরবাড়ির  কাছ  থেকেই  নিয়ে  এসেছি | 
 মন  থেকে  মানতে  না  পারলেও  এই  মুহূর্তে  এই  যুবতী  মেয়েটাকে  তিনি  রাস্তায়  তো  আর  ছেড়ে  যেতে  পারেন  না  | তাই  তাকে  সাথে  করেই  বাড়ি  ফেরেন | কিন্তু  শোভনাদেবী  মরিয়মকে  বিশেষভাবে  বলে  দিয়েছিলেন  সে  যেন  মায়ের  ঘরে  না  ঢোকে  আর  তার  পুরনো কোন  কথা  যেন  আর  কাউকেই  না  বলে  | সেই  থেকে  মরিয়ম  চঞ্চলা  হয়েই  শোভনাদেবীর  বাড়িতে | চঞ্চলার  গুনে  শ্বাশুড়ি  মা  ও  তাকে  ভালোবেসে  ফেলেছিলেন  | তার  ঘরে  ঢোকা , অসুস্থ্য  সময়ে  তার  সেবাযত্ন  করা , খাইয়ে  দেওয়া  - সবকিছুই  করেছে | কিন্তু  তিনি  বারবার  বলা  স্বর্তেও  কোনদিন  ঠাকুরের  সিংহাসন  সে  ধরেনি | নানান  অজুহাতে  এড়িয়ে  গেছে  | 
  শোভনাদেবীর  এক  ছেলে  ও  এক  মেয়ে | তারাও  মানুষ  হয়েছে  চঞ্চলার  হাতে | মায়ের  থেকে  যেন  চঞ্চলাদিই  ছিল  তাদের  খুব  কাছের  বন্ধু | আর  শোভনাদেবীও  তার  সন্তানদের  ব্যাপারেই  শুধু  নয়  সংসারের  যাবতীয়  ব্যাপারে  চঞ্চলার  উপর  ছিলেন  নির্ভরশীল | বাজারঘাট  করার  সময়  চঞ্চলা  গিয়ে  যখন  তার  মায়ের  কাছে  টাকা  চেয়েছে  শোভনাদেবী  তখন  আঁচল থেকে  চাবিটা  খুলে  তার  হাতে  দিয়ে  বলেছেন ," তোর  বাজার  করতে  যা  লাগবে  নিয়ে  যা |" ভালোবাসা  আর  বিশ্বাস  দিয়ে  চঞ্চলা  এ  বাড়ির  একজন  হয়ে  উঠেছিল | 
 ছেলেমেয়ের  বিয়ে  হয়ে  গেছে  | মেয়ে  শ্বশুরবাড়ি  আর  ছেলে  কর্মসূত্রে  দিল্লী | বাড়িতে  এখন  সে  আর  তার  মা  শোভনাদেবী  | অপূর্ববাবু  যেদিন  মারা  যান  তার  পায়ের  কাছে  চঞ্চলা  বসে  কেঁদেই  চলেছিল | সবাই  যখন  শেষ  মুহূর্তে  তার  মুখে  জল  দিচ্ছে  শোভনাদেবীর  ছেলেমেয়ে বারবার  তাদের  চঞ্চলাদিকে  বাবার  মুখে  জল  দিতে  বলে | চঞ্চলা  ঠায়  বসে  আছে  দেখে  শোভনাদেবী  নিজেই  তাকে  ধমক  দিয়ে  বলে  ওঠেন ,
--- চঞ্চলা  ওঠ , বাবার  মুখে  জল  দে |
 অপূর্ববাবুর  মৃত্যুতে  সকলের  মত  চঞ্চলা  এতটাই  ভেঙ্গে পড়েছিল  যে  সে  প্রায়  মাসাধিক  কাল  খাবার  মুখেই  তুলতে  পারেনি | পরিণামে  লো  প্রেসার  | হাসপাতালে  তিনদিন  ভর্তি  থেকে  কয়েকটা  স্যালাইন  টেনে  বাড়িতে  ফেরা | সে  সময়  মেয়ে  সোমদত্তা  এসে  মায়ের  কাছে  ছিল  আর  সেই  হাসপাতালে  ছুটাছুটি  করেছে  তখন  | তারপর  সে  সুস্থ্য  হয়ে  উঠলে  সোমদত্তা  শ্বশুরবাড়ি  ফেরে |
 এখন  সংসারে  বসে  থাকাই শোভনাদেবীর  কাজ | বিকালে  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  ব্যালকনিতে  বসে  পুরনো কথা  ভাবতে  শোভনাদেবীর  খুব  ভালোলাগে | বেশিক্ষণ বসে  থাকতে  পারেন  না  চঞ্চলার  শাসনে | তার  উপর  এখন  আবার  একটু  একটু  ঠান্ডা  পড়ছে  | কিছুক্ষণ আগে  চা  দিয়ে  গিয়ে  হাতের  কাজ  সেরে  হাতে  একটা  গায়ের  চাদর  নিয়ে  এসে  মায়ের  গায়ে  চাপাতে  চাপাতে  সে  তার  মাকে  মৃদু  ধমক  দিয়ে  ওঠে | শোভনাদেবীও  ছোট  শিশুর  মত  ধমক  খেয়ে  তাড়াতাড়ি  চা  টা শেষ  করেন | 
  সেদিন  যদি  একটা  সামান্য  মিথ্যে  স্বামী  স্ত্রী  মিলে না  বলতেন  তাহলে  চঞ্চলার  জীবনটাই  হারিয়ে  যেত  কোন  অন্ধকার  গলিতে | চঞ্চলার  ভিতর  যে  একটা  দেবীমূর্তি  আছে  তার  প্রকাশ  কোনদিনও  হত না  |
    

Thursday, November 26, 2020

জীবন যেখানে কথা বলে

জীবন  যেখানে  কথা  বলে  

      যারা  প্রেম  করে  বিয়ে  করে  তাদের  ব্যপারটা আলাদা | কিন্তু  যাদের  দেখাশুনা  করে  বিয়ে  হয়  সেই  ছেলে  কিংবা  মেয়েটির  মনে  বিয়ের  আগে  নানান  প্রশ্ন  উঁকি  মারতে  থাকে | কিন্তু  হঠাৎ  মনে  আসা  এই  প্রশ্নগুলো  সেই  ছেলে  বা  মেয়েটি  কারও সাথেই  ভাগ  করতে  পারেনা | " ছেলেটি  ভালো  হবে  তো ? আমায়  ভালোবাসবে  তো?  আমার  বাবা  মাকে সম্মানের  চোখে  দেখবে  তো  ?-- অপরদিকে  ছেলেটির  মনেও  একই  ধরণের প্রশ্ন  উঁকি  মারতে  থাকে |
   দুইবাড়ির  পছন্দে অনামিকা  আর  অভিকের  বিয়ে  হয়  | অনামিকা  খুবই  বড়  ঘরের  সন্তান | তার  বাবা  বিশাল  ব্যবসায়ী | একমাত্র  সন্তান  অনামিকা | কোটিপতি  ব্যবসায়ী  অভিক আমেরিকান  ফার্মে  কর্মরত  জেনে  মনেমনে  অনেক  স্বপ্ন  দেখে  ফেলেছিলেন  তাই  সাত  তাড়াতাড়ি  বিয়েটা  দিয়ে  ফেললেন  | অনামিকা  শ্বশুরবাড়িতে  এসে  অভিকের  বাবা , মায়ের  ব্যবহার  আর  ভালোবাসা  পেয়ে  কখনোই  তার  মনে হয়নি  এঁরা তার  নিজের  বাবা , মা  নন | অভিকও  তাকে  ভীষণ  ভালোবাসে | কিন্তু  ছমাসের  মধ্যেই  অভিকের খোদ  আমেরিকাতেই     বদলির  অর্ডার  এসে  গেলো | অনামিকা  মানসিক  দিক  থেকে  ভীষণ  ভেঙ্গে পড়লো | বাড়িতে  গিয়ে  মায়ের  কাছে  জানতে  পারলো  বাবা  তার  প্রভাব  খাটিয়ে  এই  ব্যবস্থা  করেছেন | অনামিকা  যাবেনা  বলে  বেঁকে  বসলো | কিন্তু  শেষ  পর্যন্ত  অভিকের  ভালোবাসার  কাছে  তার  এই  জীদ চাপা  পরে  গেলো |  কিন্তু  বাবার  এই  কারসাজির  কথা  সে  শ্বশুরবাড়িতে  কাউকেই  জানাতে  পারলো  না  | শুধু  অভিকের  সাথেই  দরজা  বন্ধ  করে  যুদ্ধ  চালিয়ে  গেলো  |চোখের  জলে  ছেলে  আর  বৌমাকে  বিদায়  দিয়ে  খুবই  ভেঙ্গে পড়লেন  আলোকবাবু  ও  রেখাদেবী  |
 যাওয়ার  সময়  অনামিকা  ফুঁপিয়ে  ফুঁপিয়ে  কেঁদেছে | অসহায়ের  মত  স্বামীর  সাথে  যেতে  বাধ্যও  হয়েছে | প্রথম  প্রথম  বাবা , মায়ের  সাথে  অভিকের  যোগাযোগ  থাকলেও  পরে  আস্তে  আস্তে  সে  যোগাযোগ  কমতে  থাকে | কিন্তু  অনামিকার  সাথে  নিত্য  যোগাযোগ  রয়েই  যায় | অভিক  আর  দেশে  ফিরবেনা  জানিয়েও  দেয় | শ্বশুর ,  শ্বাশুড়ি  এক  বছরের  মধ্যেই  সেখান  থেকে  ঘুরেও  আসেন | কিন্তু  অভিকের  অসহায়  পিতামাতার  ওই  ফোনই  সম্বল | 
  দেখতে  দেখতে  বছর  পাঁচেক  কেটে  গেলো | রেখাদেবী  এখন  রোজই তার  বৌমাকে  বলেন  একটা  নাতি  নাতনির  মুখ  দেখে  যেতে  চান | রেখা  অভিক  দুজনেই  ভাবে  সত্যিই  তো  তাদের  একটা  বাচ্চা দরকার  এখন  | কিন্তু  না  ছমাসের  মধ্যেও  কোন  খবর  দিতে  না  পারায় তারা  ডক্টরের  শরণাপন্ন  হয়  | ডাক্তার  অনেক  পরীক্ষা  নিরীক্ষার  পর  জানিয়ে  দেন  অনামিকার  পক্ষে  মা  হওয়া কোনদিনও  সম্ভব  নয় | অনামিকার  সাথে  অভিকও  মানসিকভাবে  ভীষণ  ভেঙ্গে পরে | তখন  অনামিকা  নিজেই  বলে  অভিককে ," আমরা  একটা  বাচ্চা  দত্তক  নেবো |" কিন্তু  অভিক  যেমন  নিজেই  রাজি  হয়না  এবং  তার  মা  রাজি  হবেনা  বলেও  জানায় |
--- আমরা  মাকে  জানাবোই  না  
--- মানে  বাচ্চা  দত্তক  নেবো  আর  মা , বাবা  জানবেন  না  ?
--- বাচ্চাটা  দত্তক  নেবো  ঠিকই  কিন্তু  সকলে  জানবে  ও  আমাদেরই  বাচ্চা |
--- সেটা  কি  করে  সম্ভব  ?
--- দত্তক  আমরা  ইন্ডিয়াতে  ফিরে  গিয়েই    নেবো | 
--- সবাইকে  মিথ্যে  বলবো  ?
--- দেখো  জীবনে  এমন  অনেক  সময়  আসে  সেখানে  সত্যি  বলার  চেয়ে  মিথ্যে  বললে  সকলের  মঙ্গল হয়  সে  মিথ্যেতে  কোন  পাপ  নেই  | যেকোন  যুদ্ধে  জয়লাভ  করায় হচ্ছে  মূল  উদ্দেশ্য | যুদ্ধে  জয়লাভের  জন্য  ছলচাতুরির  আশ্রয়  নেওয়া  অন্যায়  নয়  | কুরুক্ষেত্রের  যুদ্ধ  ছিল  ধর্মযুদ্ধ  | সেখানে  স্বয়ং  ভগবান  কৃষ্ণই কিন্তু  চাতুরির  আশ্রয়  নিতে  অর্জুনকে  প্ররোচিত  করেছিলেন  | আর  ধর্মপুত্র  যুধিষ্ঠিরও  ঘুরিয়ে  মিথ্যা  বলেছিলেন | আর  আমরা  তো  সাধারণ  মানুষ  | শুধুমাত্র  নিজের  স্বার্থ  নয়  সম্মিলিত  স্বার্থের  কারণে মিথ্যা  বললে  কোন  অন্যায়  বা  পাপ  হয়না |
  সেদিন  থেকেই  শুরু  হয়  নানান  ওয়েবসাইট  ঘাটা | এইসব  ওয়েবসাইট  ঘেটে  তারা  জানতে  পারে  খোদ  কলকাতা  সল্টলেকেই  এইরূপ  একটি  সেন্টার  আছে  | সেখানে  তারা  যোগাযোগ  করে | কিন্তু  তারা  জানায়  ফর্মফিলাপ  করার  পর  কম  করে  চার  থেকে  পাঁচ  বছর  অপেক্ষা  করতে  হবে  একটি  বাচ্চা  পেতে | সেখান  থেকেই  নানান  রাজ্যের  নানান  সেন্টারের  কথা  জানতে  পারে  | শেষে  উড়িষ্যার  একটি  সেন্টারে  তারা  ফর্মফিলাম  করে  প্রাথমিক  কাজকর্মগুলি সেরে  ফেলে  | কথা  হয়  বছর  দেড়েকের  মধ্যে  তারা  বাচ্চা পাবে | ঠিক  তার  ছ,  সাত  মাস  পরেই দুইবাড়িতে  অনামিকার  বাচ্চা হবে  বলে  জানিয়ে  দেয় | আর  অভিক  কিছুতেই  কলকাতায়  ট্রান্সফার  নেওয়ার  জন্য  কোম্পানিকে  রাজি  করাতে না  পেরে  চাকরি  ছেড়ে  দেওয়ার  সিদ্ধান্তই  নিয়ে  ফেলে | 
  এদিকে  শ্বশুরমশাইয়ের  শরীর  মারাত্মক  খারাপ  হয়ে  পরে  | রেখাদেবী  রোজই তার  বৌমাকে  সাবধানে  থাকা  খাওয়ার  টিপস  দিয়েই  চলেছেন  | অনামিকার  মাঝে  মাঝে  খুব  খারাপ  লাগে  ঠিকই | কিন্তু  সেও  তো  নিরুপায় | মা  ডাক  শোনার  যে  তীব্র  আকাঙ্খা  তারজন্য  এই  মিথ্যার  আশ্রয়  টুকু  তাকে  নিতেই  হচ্ছে  | 
 সেন্টার  থেকে  তিনমাসের  একটি  ফুটফুটে  কন্যা  সন্তানের   ছবি  তাদের  পাঠায়  | তারা  বাচ্চাটি  পছন্দ  হয়েছে  বলে  জানালে  তাদের  সম্ভাব্য  একটি  তারিখ  জানিয়ে  দেওয়া  হয়  বাচ্চাটিকে  হাতে  পাওয়ার | অভিকও  এরইমাঝে  একদিন  দুইবাড়িতে  ফোন  করে  জানিয়ে  দেয় তাদের  একটি  মেয়ে  হয়েছে | ছবি  পাঠাতে  বললে  অভিক  ইন্টারনেট  থেকে  একটি  সদ্যজাত  বাচ্চার  ছবি  খুঁজে  বের  করে  দুবাড়িতে  পাঠিয়ে  দেয় | অভিক  চাকরি  ছেড়ে  দিয়েই  বাচ্চাটি হাতে  পাওয়ার  তারিখ  অনুযায়ী  টিকিট  কেটে  সরাসরি  উড়িষ্যায়  পৌঁছে  যায়  আমেরিকার  বাস  উঠিয়ে | দুই  বাড়িতেই  তাদের  আসার  খবর  গোপন  রাখা  হয় | বাচ্চাটি  হাতে  পাওয়ার  পরেও  বেশ  কিছুদিন  তারা  ওখানেই  হোটেলে  থেকে  যায়  কারণ  তাদের  আইনি  মারফত  দত্তক  নেওয়ার  জন্য  বেশ  কয়েকবার  কোর্টে হাজিরা  দিতে  হয়  | সব  কাজ  সেরে  তারা  বাড়িতে  ফেরার  কথা  জানায় | অনামিকার  বাবা  অসুস্থ্য  থাকার  জন্য  তিনি  এয়ারপোর্ট  যেতে  পারেননা | ড্রাইভারকে  নিয়ে  অভিকের  বাবা  এয়ারপোর্টে  হাজির  হয়ে  যান | নাতনির  মুখ  দেখে  তিনি  তো  বেজাই খুশি | অভিকের  মা  প্রদীপ  জ্বালিয়ে , শাঁখ বাজিয়ে , উলু  দিয়ে  তিনি  তার  অভিকের  মেয়েকে  ঘরে  তোলেন | 
  মাস  চারেকের  মধ্যে  অনামিকার  বাবা  মারা  যান | অভিকই  এখন  শ্বশুরের  ব্যবসার  মালিক | চাকরিটা  যে  সে  ছেড়ে  এসেছিলো  সেটাও  কাউকে  সে  জানিয়েছিল  না | তাদের  আদরের  আরাধ্যা  এখন  সমস্ত  ঘর  হামা  দিয়ে  বেড়ায় | অভিকের  বাবা  মায়ের  এখন  সময়  কাটে  তাদের  নাতনিকে  নিয়েই | আগে  অভিক  অনামিকার  মনে  কষ্ট  হলেও  এখন  আর  তাদের  কোন  কষ্ট  নেই | সামান্য  মিথ্যের  আশ্রয়  নিয়ে  এই  তিন  তিনটি  বয়স্ক  মানুষের  মুখের  হাসি  দেখে  তারা  দুজনেই  খুব  গর্বিত  এই  মিথ্যা  বলা  নিয়ে |

Wednesday, November 25, 2020

কবিতা

কবিতা  

  অনেকদিন  পর  স্টেশনে  নীলেশের  সাথে  দেখা  কবিতার | ছোট্ট  দুটি  হাত  ধরে কাঁধে  একটি  ব্যাগ  ঝুলিয়ে   নীলেশ প্লাটফর্ম  দিয়ে  এগিয়ে  চলেছে  | পাশাপাশিই  হাঁটছিলো কবিতা  | নীলেশের  দিকে  দৃষ্টি  যেতেই  কবিতা  বলে  ওঠে ,
--- এই  নীলেশ , চিনতে  পারছিস ?
 নীলেশ  দাঁড়িয়ে  পরে  কবিতার  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  একগাল  হেসে  পরে  --
--- আরে কবিতা -  কেমন  আছিস  বল  
--- চলে  যাচ্ছে  | এটা তোর  মেয়ে  বুঝি ? কি  মিষ্টি  দেখতে  হয়েছে | 
--- হ্যাঁ সবাই  বলে  ওকে  ওর  মায়ের  মত  দেখতে | 
 কবিতা  কষ্ট  হলেও  মুখে  হাসি  এনে  বলে ,
--- ওর  মাকে  দেখতে  পারছি  না , তুই  মেয়েকে  নিয়ে  একা একা কোথায়  চললি ?
 কথা  বলতে  বলতে  ওরা স্টেশন  থেকে  বাইরে  বেরিয়ে  এসছে তখন | নীলেশ  কবিতার  দিকে  ফিরে  বললো ,
--- বাড়ি  যাবি তো  একটা  উবের  বুক  করে  দিই  ?
--- আমি  এখন  ফ্ল্যাটে  থাকি | আমি  বুক  করে  নেবো  | যদি  কিছু  মনে  না  করিস তোর  নম্বরটা  দিতে  পারিস আমায়  | 
 নীলেশ  কবিতার  দিকে  তাকিয়ে  মানিব্যাগ  থেকে  কার্ডটা  বের  করতে  করতে  বলে ,
--- এভাবে  বলছিস  কেন  পুরনো সব কথাগুলি  আজও ধরে  বসে  আছিস  ?
 কবিতা  নিচু  হয়ে  নীলেশের  মেয়েটাকে  আদর  করে  জানতে  চাইলো ,
--- তোমার  নাম  কি  সোনা  ?
--- বাবাই  তো  আমাকে  তিতলি  বলে  |
--- আর  মা ?
 তিতলি  তার  বাবার  মুখের  দিকে  তাকালো  | আর  ঠিক  সেই  মুহূর্তেই  নীলেশের  মোবাইলে  উবের  ড্রাইভারের  ফোন |
--- পারলে  একদিন  আমার  বাড়িতে  আসিস | তবে  রবিবার  করে  আসবি  | ঐদিন  বাড়িতে  পাবি  আমায়  | 
 কবিতা  তার  উবের  বুক  করতে  করতে  মাথা  নাড়িয়ে  হ্যাঁ জানালো |
 প্রায়  একযুগ  আগে  কলেজ  চত্বরে  দুটো  ছেলের  মধ্যে  প্রচন্ড  হাতাহাতি  , মারামারি  | বাকি  ছাত্রছাত্রীরা  নীরব  দর্শক  মাত্র | কোথা থেকে  হঠাৎ  ছুঁটে এসে  কবিতা  দু'জনের  মাঝখানে  দাঁড়িয়ে  পরে | দু'জনের  মধ্যে  মারামারির  ভিতরে  হঠাৎ  একটি  মেয়েকে  দেখতে  পেয়ে  দু'জনেই  কিছুটা  দমে  যায়  | মেয়েটির  মুখটি  দু'জনেরই  চেনা  থাকলেও  কথা  কারও সাথেই  ছিল  না | একজন  চিৎকার  করে  ওঠে ,
--- সরে  যাও বলছিইই--
 এরই  মধ্যে  দর্শক  হয়ে  দাঁড়িয়ে  থাকা  কিছু  ছাত্রছাত্রী  দু'দিক  থেকে  দু'জনকে  সরিয়ে  নিয়ে  যায় | এই  দুটি  ছেলের  মধ্যে  একটি  ছিল  নীলেশ  চৌধুরী | আর  মেয়েটি  ছিল  কবিতা প্রামাণিক | কবিতা  আর  নীলেশ  দু'জনে  ভালো  বন্ধু  হয়ে  যায় | বন্ধুত্বের  গন্ডি  পেরিয়ে  যখন  তারা  কাছাকাছি  আসতে শুরু  করেছে  ঠিক  সেই  মুহূর্তেই  তৃতীয়  বর্ষ  চলাকালীন  সময়েই  নীলেশ  চাকরি  পেয়ে  যায়  রেলে | পড়ার  ইতি  টেনে  চলে  যায়  তার  কর্মস্থল  ভুবনেশ্বর | যোগাযোগটা  থেকে  যায়  ফোনে | কবিতার  গ্রাজুয়েশন  শেষ  হলেই  তারা  নিজেদের  বাড়িতে  বিয়ের  কথা  জানাবে  কথা  হয় | সময়  মত  নীলেশ  যখন  তার  বাবা , মাকে  কবিতাকে  বিয়ের  কথা  জানায়  তারা  বেঁকে  বসেন  শুধুমাত্র   কবিতা  নিচু  ঘরের  মেয়ে  বলে | অনেক  বুঝানোর  চেষ্টা  করে  নীলেশ | কিন্তু  তারা  বুঝতে  চাননি | রাগ  করে  বাড়িতে  আসা  বন্ধ  করে | কবিতা সবকিছু  শুনে  বলে  বাবা , মায়ের  কথা  শুনতে | যদিও  কথাটা  তার  মনের  কথা  ছিলো না | ওটা  ছিল  তার  মুখের  কথা | কবিতা  ও  নীলেশ  উভয়ই  তাদের  বাবা , মায়ের  একই  সন্তান | এ  নিয়ে  কবিতার  সাথেও  মান- অভিমান  চলতে  থাকে | মাসখানেক  পরেই নীলেশের  মায়ের  হার্টএটাক  হয় | ছুঁটে চলে  আসে  সে  বাড়িতে | মৃত্যুর  আগে  মা  তাকে  জানিয়ে  যান  সে  যেন  তার  পছন্দ  করা  মেয়েটিকেই  বিয়ে  করে  তাতে  তার  আত্মা  শান্তি  পাবে | ছেলের  হাতে  পায়ে  বেড়ি  পরিয়ে তিনি  চলে  যান  চিরতরে | 
  তারপর  নীলেশ  একবার  ফোন  করে  কবিতাকে  সব  জানিয়েছিল  | কবিতাও  বুকে  পাথর  বেঁধে  মায়ের  শেষ  অনুরোধ  রাখতে  অনুরোধ  জানিয়েছিল | কেউ  আর  কখনোই  যোগাযোগ  করেনি  | সেদিনই  দু'জনের  চলার  পথ আলাদা   হয়ে  গেছিলো  | সাত  বছর  পর  আজ  আবার  দেখা  দু'জনের  | এক  মুহুর্ত্ব  সময়  লাগেনি  পরস্পরকে  চিনতে  | চলন্ত  উবেরের  ভিতর  বসে  কবিতা  ফিরে  গেলো  সেই  আগের  দিনগুলিতে | ছেলেবেলাতেই  মাকে  হারিয়েছে  সে | বাবা'ই  তার  কাছে  মা  বাবা  দুইই | অভাব  থাকলেও  মেয়েকে  সেটা  লুকিয়ে  যাওয়ার  চেষ্টা  করেছেন  সর্বদা | গ্রাজুয়েশন  শেষ  করে  বিএড  ট্রেনিং  নিয়ে  বছর  দুয়েক  অনেক  চেষ্টা  তদবির  করে  শেষে  একটা  প্রাইমারি  স্কুলে  জয়েন  করতে  পারে  | বাবা  কয়েকবার  বিয়ের  কথা  বললেও  সে  এড়িয়েই  যায় | বছর  ছ'য়েক আগে  তিনিও  চলে  যান  নিউমোনিয়ায় | নিজেদের  ছোট্ট ভাঙ্গাচোরা  বাড়িটা  বিক্রি  করে  সে  এক  কামরার  একটা  ফ্লাট  কিনে  শহরের  দিকে  চলে  আসে  স্কুলের  যাতায়াতের  সুবিধার্থে | 
  আর  এদিকে  নীলেশ  তার  মায়ের  কথা  রাখতে  তার  পছন্দ  করা  মেয়েকে  বিয়ে  করে  মায়ের  আত্মাকে  শান্তি  দিতে  চেয়েছিলো  | কিন্তু  বিধাতা  লিখেছিলেন  কপালে  অন্যকিছু | কন্যা  সন্তানের  জন্ম  দিতে  গিয়ে  অতিরিক্ত  রক্ত  ক্ষরণের  ফলে  মারা  যায়  জয়া | ব্লাড  নেওয়ার  ক্ষমতাটুকুও  তার  ছিলো না  | সেই  থেকে  আয়ার কাছে  মানুষ  নীলেশের  আদরের  তিতলি | ভালো  নাম  কঙ্কনা |
 পরের  শনিবার  কবিতা  ফোন  করে  নীলেশকে  | জানতে  পারে  দু'দিন  ধরে  মেয়ের  জ্বর  তাই  সে  বাড়িতেই  আছে | পরদিন  কবিতা  নীলেশের  মেয়েকে  দেখতে  এসে  জানতে  চায় ,
--- তিতলির  মাকে  দেখতে  পারছি  না  | ওকে  এক্ষুণি জলপট্টি  দিতে  হবে  তো  | উনাকে  ডাক |
 নীলেশ  চুপ  করে  আছে  দেখে  বয়ষ্ক  আয়া সব  ঘটনা  কবিতাকে  জানায় | আয়া মাসির  কথা  শুরু  হতেই  নীলেশ  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  যায় | মাসি  নিজেই  জলপট্টি  দেওয়ার  তোড়জোড়  করছিলেন | কবিতা  তার  হাত  থেকে  নিয়ে  নিজেই  কাজটি  করে  যায় | নীলেশ  ডাক্তারকে  ফোন  করায় তিনি  জানান  বিকালের  মধ্যে  জ্বর  রেমিশন  না  হলে  তাকে  যেন  হাসপাতাল  ভর্তি  করা  হয় | নীলেশ  খুব  ভেঙে পড়ে| কবিতার  তদারকিতে  বিকালের  অনেক  আগে  থাকতেই  তিতলির  ঘাম  দিয়ে  জ্বর  কমে  যায় | যতবার  নীলেশ  তাকে  খাবারের  জন্য  ডাকতে  এসেছে  ততবারই  সে  এককথা  বলেছে ,
--- আগে  ওর  জ্বরটা  কমুক  পরে  খাবো | অগত্যা  নীলেশেরও  খাওয়া  হয় না | ড্রয়িংরুমে  সোফায় বসে  থাকতে  থাকতে  একসময়  সে  সেখানেই   শুয়ে    ঘুমিয়ে  পরে | বিকালের  দিকে  ঘুম  ভাঙলে নিজের  ঘরে  ঢুকে  দেখে  তিতলি  আর  কবিতা  একে অপরকে  জড়িয়ে  ধরে  পরম নিশ্চিন্তে  ঘুমাচ্ছে  | এ  দৃশ্য  দেখে  তার  মনটা  ভালো  হয়ে  যায় | মাসি  আর  সে  ছাড়া  আর  কেউ  কখনোই  তিতলিকে  এতো  স্নেহের  পরশ   বুলিয়ে  দেয়নি | 
   সন্ধ্যার  দিকে  তিতলি  বেশ  চনমনে  হয়ে  যায় | কবিতা  তার  ফ্ল্যাটে  ফিরতে  চায় | কিন্তু  তিতলি  তার  আঁচল জড়িয়ে  বলে ,
--- না , তুমি  যাবে  না | রাতে  তোমার  কাছে  আমি  খাবো , ঘুমাবো | তুমি   কাছে  থাকলে  আমার  খুব  ভালো  লাগছে | আচ্ছা  তোমায়  আমি  কি  বলে  ডাকবো ?
--- যা  তোমার  খুশি 
 কবিতা  তাকে  জড়িয়ে  ধরে  বলে,
 এরপর  তিতলি  বাবার  দিকে  তাকিয়ে  বলে ,
--- আচ্ছা  বাবা , তুমি  তো  আমায়  বলো  আমি  বড়  হলে  হঠাৎ  একদিন  আমার  মা  এসে  যাবে | তবে  কি  আমি  বড়  হয়ে  গেছি  তাই  মা  আমার  কাছে  এসে  গেছে  ?
 মাসি , নীলেশ , কবিতা  সকলেই  চুপ  করে  যায় | মাসি  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  যেতে  যেতে  বলে ," আমি  একটু  চা , জলখাবার  করি | তোমরা  দু'জনেই  তো  না  খেয়ে  আছো " মাসি  বেরিয়ে  যায় | নীলেশ  কবিতার  দিকে  তাকিয়ে  বলে , 
--- তুই  মেসোমশাইকে  একটা  ফোন  করে  দে ; আজ  এখানেই  থেকে  যাবি |
 কবিতা  নীলেশের  দিকে  তাকিয়ে  একটা  দীর্ঘশ্বাস  ছেড়ে  বলে ,
--- বাবা  আজ  বছর  ছ'য়েক হল  আমাকে  ছেড়ে  চলে  গেছেন | বাড়িটা  বিক্রি  করে  সন্তোষপুর  স্টেশন  লাগোয়া  একটা  ফ্লাট  কিনেছি | একাই থাকি | একটা  প্রাইমারী স্কুলে  পড়াই | 
--- তাহলে  তো  তোর  থাকার  কোন  অসুবিধা  নেই  | আজ  রাতটা  থেকেই  যা | তিতলি  যখন  এতো  করে  বলছে |
--- সত্যি  করে  বলতো  নীলেশ  শুধু  কি  তিতলি  বলছে  বলেই  থাকতে  বলছিস ? তোর  নিজের  কোন  ইচ্ছা  নেই ?
--- অনেক  কথাই  তো  জীবনে  বলা  হয়ে  ওঠে  না | আমার  জীবনের  সব  কথা  জানার  যার  সব  থেকে  আগে  অধিকার  ছিল  তার  সাথেই  তো  কোন  সম্পর্ক  ছিলো না  | আজ  মনেহচ্ছে  সবই  বুঝি  ঈশ্বরের  লীলা  | তানাহলে  আমার  এই  পরিস্থিতিতে  তোর  সাথে  হঠাৎ  দেখা  হবে  কেন  ?
 তিতলি  এতক্ষণ কবিতার  হাঁটুর  উপর  শুয়ে  ছিল | এবার  উঠে  সে  কবিতাকে  দু'হাতে  জড়িয়ে  ধরে  বললো ,
--- বাবা  তো  বললো  না  তোমায়  কি  বলে  ডাকবো ? কিন্তু  আমি  মনেমনে  ঠিক  করেছি  তোমায়  মা  বলেই  ডাকবো |
 নীলেশ  ও  কবিতা  দু'জন  দু'জনের  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  পড়লো | আর  নীলেশ  বলে  উঠলো , 
--- আমার  মনের  কথাটা  তিতলি  বলে  দিয়ে  আমাকে  রিলিফ  দিয়েছে | কবিতা , তোমার  আপত্তি  নেই  তো ?

    আজ  তিতলির  ভায়ের  অন্নপ্রাশন | তিতলি  খুব  খুশি  তার  পুতুলের  মত  এই  ভাইটাকে  পেয়ে | কবিতা  তার  চাকরিটা  ছেড়ে  দিয়েছে | দুই  দু'টো  বাচ্চাকে  নিয়ে  সে  এখন  এক  মুহুর্ত্ব  সময়  পায় না | তবে  তার  সারাদিনের  পরিশ্রম  জল  হয়ে  যায়  রাতে  নীলেশের   বুকে  মাথা  রাখলে। 

#মানবী

  

    

Saturday, November 21, 2020

সুখের ঘরে আগুন ( নবম পর্ব )

সুখের  ঘরে  আগুন  ( নবম  পর্ব )

       বৌভারের  পরে অনেকেই  সেদিন  বাড়ি  চলে  গেছেন | আবার  কেউবা  সকালে  টিফিন  করে , কেউবা  দুপুরে  খেয়েদেয়ে  যে  যার  বাড়ির  পথ  ধরেছেন | একমাত্র  নিলয়ের  অনুরোধে  প্রমিতা আর  রিতেশ  যায়নি  | অবশ্য  নিলয়  অনুরোধ  না  করলেও  প্রমিতা তার  দাদার  মনে  কিসের  এতো  কষ্ট  এই  বিয়ে  করে  সেটা  সে  না  জেনে  কিছুতেই  যেত  না | কারণ  দাদাকে  সে  খুব  ভালোবাসে | সেই  ছোট্ট  থেকে  তাকে  ভাইফোঁটা  দেয়, রাখি  পরায় | দুপুরবেলা  খাওয়াদাওয়ার  পর  নিলয়  সোফার  উপর  বসে  টিভি  দেখতে  দেখতে  ওখানেই  ঘুমিয়ে  পরে | এটা সে  করে  নিজের  ঘরে  যাবে  না  বলেই  প্ল্যানমাফিক | শালিনীও  তাকে  কিছু  বলার  সুযোগ  খুঁজছে  কিন্তু  নিলয়  তাকে  কোন  কথা  বলার  সুযোগই  দিচ্ছে  না | রাতে  খাওয়া  শেষ  করে  নিলয়  যখন  বেসিনে  হাত  ধুতে  যায়  শালিনী  তড়িঘড়ি  খাওয়া  শেষ  করে  নিলয়ের  কাছে  গিয়ে  দাঁড়িয়ে  বলে ,
--- আপনাকে  কিছু  বলার  ছিল |
 নিলয়ও খুব  চাপাস্বরে  উত্তর  দেয় ,
--- আপনার  যা  বলার  বিয়ের  আগেরদিন  তো  বলেই  দিয়েছেন | আমার  আর  কিছু  শোনার  ইচ্ছা  নেই | এবার  যা  করার  আমিই  করবো  | 
 কথাকটি বলে  নিলয়  আর  সেখানে  দাঁড়ায়  না | সকলেই  খেয়ে  উঠে  ড্রয়িংরুমে  বসে  গল্প  করছে | শালিনীও  সেখানে  কিছুক্ষণ বসে  থাকে | প্রমিতাই  তাকে  একসময়  বলে , " বৌদি  তোমার  তো  ঘুম  পেয়েছে | তুমি  গিয়ে  শুয়ে  পড়ো |
--- না  না  ঠিক  আছে  , এই  তো  গল্প  শুনছি  | 
 বাবা,  মা  একসময়  উঠে  শুতে  চলে  যান | কিন্তু  প্রমিতা, রিতেশ  আর  নিলয়  আর  কোন  কথা  খুঁজে  না  পেয়ে  টিভি  চালিয়ে  একটা  মুভি  নিয়ে  সব  বসে  পড়লো  | অনেকক্ষণ শালিনী  বসে  থেকে  শেষে  সেও  উঠে  পড়লো | তারপর  ওরা সবাই  মিলে ছাদে  এসে  একটা  শতরঞ্চি  পাতিয়ে  বসলো | 
--- হ্যাঁ এবার  বল  দাদা  বৌদিকে  নিয়ে  তোর  সমস্যাটা  কি  ?
--- বলছি  সব , বলবো  বলেই  তো  এতো  কান্ড  করে  এখানে  আসা  | একটু  দাঁড়া শুরুটা  নিজের  মনের  মধ্যে  সাজিয়ে  নিই ---|
 কিছুক্ষণ থেমে থেকে  নিলয়  শুরু  করলো  ---
 বিয়ের  আগেরদিন  রাতে  ----- আস্তে  আস্তে  নিলয়  সমস্ত  ঘটনাগুলি  প্রমিতা আর  রিতেশকে  জানালো | এমন  কি  বেসিনের  সামনে  দাঁড়িয়ে  শালিনী  কি  বলেছে  সেটাও  জানালো  | সব  শুনে  দুজনেই  কিছুক্ষণ স্তব্ধ  হয়ে  বসে  থাকলো | তারপর  প্রমিতা বলে  উঠলো , 
--- তাহলে  বিয়েটা  করতে  গেলি  কেন ? এখন  তো  বিষয়টা  আরও জটিল  হয়ে  দাঁড়ালো | 
 রিতেশ  বলে  উঠলো ,
--- বোকার  মত  কথা  বোলো  না | বাড়িতে  তখন  আত্মীয়স্বজন  ভর্তি | ওই  মুহূর্তে  বিয়েটা  ভেঙ্গে দিলে  বাবা , মায়ের  অবস্থাটা  ভেবে  দেখেছো?  দুশ লোক  নিমন্ত্রিত | সমস্ত  কিছুর  বায়না  দেওয়া | কত  লোকে  ছি  ছি  করতো , কত  মানুষ  বিষয়টা  নিয়ে  চর্চ্চা  করতো  ?
--- সেতো এখনো  করবে |
--- সেটা  সংখ্যায়  কম | এটাতে  জানবে  কম  লোকে |
  তারপর  নিলয়ের  দিকে  তাকিয়ে  বললো  ,
--- তুমি  এখন  কি  চাও ? ডিভোর্স  ?
--- তাই  ছাড়া  আর  উপায়  কি ?
 প্রমিতা দাদার  দিকে  করুন  দৃষ্টিতে  তাকিয়ে  বললো ,
--- তুই  একবার  বৌদির  সাথে  কথা  বল  না --
--- কি  কথা  বলবো ?
--- না - বলছি  যদি  এখন  তার  মতের  পরিবর্তন  হয়  ?
 নিলয়  ব্যঙ্গের হাসি  দিয়ে  বলে  উঠলো, 
--- তুই  কি  পাগল  নাকি ? যে  মেয়ে  বিয়ের  আগের  রাত্রে  তার  হবু  স্বামীকে  ফোন  করে  অন্য পুরুষকে  ভালোবাসার  কথা  জানায়  তার  সাথে  সংসার  করা  যায় ? আর  শুধু  সংসার  কেন  তার প্রতি  কোনদিন  ভালোবাসা  জন্মাতে  পারে  ?
--- কেন  পারে  না  দাদা ? দুটো  মানুষ  একসাথে  থাকতে  থাকতে  তাদের  মধ্যে  একটা  সুন্দর  সম্পর্ক  গড়ে  ওঠে  আর  সেই  সম্পর্ক  থেকেই  একের  প্রতি  অন্যের  প্রগাঢ়  ভালোবাসা  জন্মায়  | 
----অনেক  ক্ষেত্রে  তাও হয়না  | দেখ  একটা  ছেলে  বা  মেয়ের  জীবনে  বিয়ের  আগে  ভালোবাসা আসতেই  পারে | অনেক  সময়  এই  ভালোবাসা  বিয়ে  পর্যন্ত  গড়ায় না  | পরে  তাদের  অন্যের  সাথে  বিয়ে  হয়  তারা  অধিকাংশ  ক্ষেত্রে  সুখীও  হয় | আর  এইসব  ক্ষেত্রে  দেখা  যায়  উভয়ই  উভয়ের  ক্ষেত্রে  বিষয়টা  গোপনই রাখে | কিন্তু  যে  মেয়ে  বিয়ের  আগের  রাতে  তার  হবু  স্বামীকে  ফোন  করে  তার  অন্যের  প্রতি  ভালোবাসার  কথা  জানায়  সে  কতটা  ডেসপারেট  | একটা  কথাও  আমি  ভেবেছি  আর  সেটা  হচ্ছে  শালিনীর  বয়স  এখন  তেইশ  বছর | এতটাই  যখন  সে  ডেসপারেট  হয়ে  আমায়  সব  জানিয়েছে  সে  তো  পুলিশের  সাহায্য  নিতে  পারতো  | আমি  মেনে  নিলাম  তার  বাবা,  মা  তাকে  ঘরে  আটকে  রেখে  জোর  করে  বিয়ে  দিয়েছে  | কিন্তু  ফোনটা আমায়  না  করে  সে  তো  পুলিশকে  করতে  পারতো  |
 রিতেশ  এতক্ষণ পরে  বলে  উঠলো , 
--- আমাদের  মধ্যবিত্ত  বাঙ্গালী পরিবারগুলি  সহজে  পুলিশের  ঝামেলায়  যেতে  চায়  না | সেক্ষেত্রে  শালিনীও হয়তো   ভেবেছিলো  পুলিশকে  জানিয়ে  ঝামেলার  থেকে  তোমায়  জানালে  তুমি  যদি  বিয়েটা  করতে  না  চাও  তাহলে  অনেক  হ্যাপা  থেকে  সে  মুক্তি  পাবে | জানি  না  অবশ্য  তার  মনের  কথা | তবে  স্বাভাবিক  ভাবে  এটাই  আমার  মনে  হচ্ছে | আর  ডিভোর্সের  কথা  বলছো ?ওটা  পেতে  গেলেও  তো  কিছুটা  সময়  লাগবে |  ডিভোর্স  বললেই  তো  আর  ডিভোর্স  পাবে  না | কাল  আবার  তোমার  অষ্টমঙ্গল | সেখান  থেকে  ফিরে  এসো তারপর  দেখছি  কি  করতে  পারি |
--- আমি  কি  এবারই  ওখানে  ওকে  রেখে  আসবো ?
--- নারে  দাদা , একসাথেই  ফিরতে  হয় |
 নিলয়  তাচ্ছিল্যের  হাসি  হেসে  বললো ,
--- অনেক  তো  নিয়মকানুন  মানা হল  কি  লাভ  হল  তাতে  ? আসলে  কি  জানিস  তো  - এইসব  নিয়মকানুন  মানে  মানুষ  শুধুমাত্র  যে  কোন  অনুষ্ঠানে  একটু  আনন্দ - ফুর্তি  করতে | এই  নিয়মকানুন  কারও জীবনে  শান্তি  , ভালোবাসা  এনে  দিতে  পারে  না  | মানুষ  জন্মানোর  সময়ই  তার  ভাগ্য  নিয়ে  জন্মায় | কেউ  মানুক  বা  না  মানুক  - কপালের  লিখন  কেউ  খন্ডন  করতে  পারে  না | অনেক  সময়  মানুষ  তার  কঠোর  পরিশ্রম  দ্বারা  ভাগ্যকে  নিয়ন্ত্রণ  করতে  পারে | এখানে  কাজ  করে  সর্বদা  ঘূর্ণয়মান রাহু , কেতু  সহ আরও অন্যান্য  গ্রহ | ওই  গ্রহের  অবস্থান  অনুযায়ীই  ভাগ্য  নিয়ন্ত্রিত  হয়  | জন্মে  দশা  আর  মৃত্যুতে  দোষ  - এটা অবশ্যম্ভাবী | এখানে  কিন্তু  কে  বিশ্বাস  করলো  আর  কে  বিশ্বাস  করলো  না  সেটা  বড়  কথা  নয় | এই  গ্রহ  নক্ষত্র  ব্যাপারগুলো  কিন্তু  বিজ্ঞানও স্বীকার  করে | কিন্তু  বিজ্ঞান  ঠিকুজি  কুষ্ঠী মানে  না | জোতিষীরা  কিন্তু  গ্রহ  নক্ষত্র  অনুযায়ীই  ঠিকুজি , কুষ্ঠি  তৈরী  করে   মানুষের  ভাগ্য  গণনা  করে  থাকেন | আমি  এসব  মানি  আর  মানি  বলেই  এই  ঘটনা  নিয়ে  আমার  কোন  দুঃখ  নেই | আমার  ভাগ্যে  যা  ছিল  তাই  ঘটেছে |

  ক্রমশঃ-