মধ্যরাতের ভয় |
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
(পর্ব ১)
অর্থ চাহিদা যখন প্রবলভাবে দেখা দেয় আর ঠিক তখনই সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটির যদি প্রমোশন হয় তখন কোথায় তার বদলী হল তা নিয়ে তিনি মাথা না ঘামিয়ে তার মাইনের টাকাটাই যে বেড়েছে এটা নিয়েই তিনি মশগুল থাকেন | ঠিক তেমনই পিয়াল রায়ের অবস্থা |
পিয়াল বাংলাতে এমএ করেছেন | মফস্বল শহরে একটি প্রাইমারি স্কুলে দশ বছর বেকার থাকার পর শিক্ষক পদে নিযুক্ত আছেন বেশ কয়েক বছর | চাকরি পাওয়ার পরেই মায়ের চাপে বিয়ে , আর বিয়ের পরেই বংশ প্রদীপের মুখ দেখার চাপ | পরপর দুটি কন্যা সন্তান কিন্তু বড় হয়ে ওরা তো পরের ঘরে চলে যাবে তাই বংশধর তার চাইই | তৃতীয়বার তার ঘরে বাতি দিতে এলো বহু আকাঙ্খিত তার বংশ প্রদীপটি | এক থেকে দেড় বছরের ব্যবধানে এই তিন তিনটি বাচ্চার পিছনে যে খরচ , সংসার চালনা তার উপর মায়ের বার্ধক্যজনিত নানান অসুখের তালগোলে পিয়ালের ওই সামান্য কটা মাইনের টাকায় চলা ভীষণ দুস্কর হয়ে পড়লো | গ্রামে সেভাবে টিউশনিও তখন পাওয়া যেত না | আর যারা পড়তে আসতো তাদের টাকা দেওয়ার ক্ষমতা না থাকার ফলে ক্ষেতের কফি , মূলো, বেগুন , লাউ দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন | ঠিক এমন সময়ে পিয়ালকে প্রমোশন ও গলাধাক্কা দুটোই একসাথে খেতে হল | যেখানে তাকে বদলি করা হল চৌদ্দ পুরুষ সে জায়গার নাম শুনেছে বলে মনেহয়না পিয়ালের | কিন্তু তিনি খুশি মনেই এই প্রমোশন ও বদলী মেনে নিয়ে একদিন রওনা দিলেন পাঠকাঠি গ্রামের উদ্দেশ্যে |
শীতের রাত | হাড় হিম করা ঠান্ডা পড়েছে | দুপুরের দিকে বেরোলেও ট্রেন লেটের বদৌলতে তিনি গাড়িতে চাপলেন সেই সন্ধ্যা নাগাদ | ট্রেনের কামরায় হাতে গোনা কয়েকজন যাত্রী | বগির ভিতরে জানলার কাঁচ ভাঙ্গা | সকলেই সেদিকটা বাঁচিয়ে অন্য জায়গায় বসতে ব্যস্ত | কিন্তু ট্রেনের ভিতরের ভাঙ্গা কাঁচের ভিতর দিয়ে হাওয়াকে কি আর আটকানো যায় ? তবুও সকলে নিজেদের ঢেকেঢুকে চলন্ত ট্রেনের শীতের হাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে শুধু চোখদুটি ছাড়া শরীরের সব অংশ ঢেকে শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন | এই শীতের মধ্যেই অনেককেই আবার ঢুলতে শুরু করেছেন | কিন্তু পিয়ালের মনে অজানা এক আশংকা কাজ করে চলেছে | পাশের যাত্রীর কাছে তিনি শুনলেন রাত দশটা বাজবে তাদের পাঠকাঠি স্টেশনে পৌঁছাতে | কিন্তু তিনি ওই দশটার সময় অজানা জায়গায় কোথায় গিয়ে উঠবেন ?
ট্রেন থেকে নেমে সকলের মত তিনিও তার ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন | একটু চা খেতে ইচ্ছা করছিলো | কিন্তু গুমটিগুলো সবই বন্ধ হয়ে গেছে | উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটে চলেছেন | রাস্তাঘাটে কোন আলো নেই | হয়তো লোডশেডিং হবে | হঠাৎ তিনি দেখতে পান একটি হ্যারিকেন হাতে লালশার্ট আর কালোপ্যান্ট পরা এক ভদ্রলোক তার দিকে এগিয়ে এসেছেন | হঠাৎ করেই তিনি যে কোথা থেকে উদয় হলেন তা তার বোধগম্য হলনা |
--- বাবু চলুন, আপনাকে নিতে এসেছি --
--- কে তুমি? আমায় কোথায় নিয়ে যাবে ?
--- আপনিই তো আমাদের স্কুলের মাষ্টার | আপনার যেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানেই নিয়ে যাবো |
--- পিয়ালের পরানে একটু যেন জল এলো | প্রশ্ন অনেক মাথার মধ্যে কিলবিল করলেও সেগুলিকে আপাতত সরিয়ে রেখে ব্যাগদুটি লোকটির কাছে হস্তান্তর করে নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করতে লাগলো |
লোকটা হাঁটছে তো হাঁটছেই | অন্ধকার রাস্তায় ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কিছুই তার কানে ঢুকছে না | অনেকক্ষণ পরে লোকটি এসে দাঁড়ালো একটা বেশ বড়সড়ো দালানবাড়ির কাছে | লোকটি ভাঙাচোরা বড় একটা গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো ,
--- একসময় এই বাড়িটা লালকুঠি বলেই ছিল | তখন সাহেবরা এদেশে ছিল | এখন অবশ্য কেউ আর লালকুঠি বলে না | সাহেবদের বাংলোই বলে | এখানে কেউ এসে থাকতে চায় না | তাই এই গ্রামের মধ্যে কোন শিক্ষার আলো ঢোকেনি | যে যখন এসেছে একদিন কি দুদিন বাদে চলে গেছে |
কথা বলতে বলতে তারা একটি রুমের ভিতরে প্রবেশ করলো | হ্যারিকেনের স্বল্প আলোতে পিয়াল রায় দেখলেন ঘরে সেরূপ কোন আসবাব না থাকলেও যা আছে তার পক্ষে যথেষ্ট | কথা বলতে বলতে লোকটি হঠাৎ পিয়ালের দিকে ফিরে বললো ,
--- বাবু , আপনার থাকা , খাওয়ার কোন অসুবিধা হবেনা | শুধু মনে একটু সাহস রাখবেন | বাকিটা আমি সামলে নেবো | ছোটছোট বাচ্চাগুলো যাতে একটু লেখাপড়া শিখতে পারে সেটা দেখবেন | আমি আপনার রাতের খাবার ওই টেবিলেই রেখে দিয়েছি |
লোকটি হ্যারিকেনটি রেখে বেরিয়ে গেলো | পিয়ালও হাতমুখ ধুয়ে খাবারের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন চিকেন আর রুটি | সারাদিনের ক্লান্তির শেষে এই খাবার দেখে মনেমনে খুব খুশি হয়ে গেলেন পিয়াল | তিনি খাবার খেয়ে লোকটির করে রাখা পরিষ্কার বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলেন ' এই লোকটি কে ? সে জানলো কি করে যে আমি আজ আসবো ?
( পর্ব ২)
ভাবতে ভাবতেই একসময় তার চোখদুটি ঘুমে জড়িয়ে গেলো | ঘুমের মধ্যেই পিয়াল শুনতে পেলেন একজন বৃদ্ধের কাতর অনুরোধ " সাহেব এই স্কুল ঘরটি আপনি ভাঙ্গবেন না , ছোটছোট বাচ্চাগুলো খুব অসহায় হয়ে পড়বে , ওদের অন্তত অক্ষরজ্ঞানটা হতে দিন |" পিয়াল শুনতে পেলেন আর একজনের অট্টহাসি | ধড়মড় করে উঠে বসলেন | গলা শুকিয়ে কাঠ | মাথার কাছে রাখা জলের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পুরো জলটা খেয়ে নিলেন | বাকি রাতটুকু ঘুম আর তার এলো না |
খুব ভোরে দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেন | কিন্তু প্রচন্ড কুয়াশায় কোনকিছুই দেখা যাচ্ছে না | তিনি আবার ঘর অভিমুখে রওনা দিলেন | পিছনে শুনতে পেলেন এক বৃদ্ধের কাশির আওয়াজ | মুখ ঘোরাতেই দেখলেন , একজন ধুতি পরিহিত , সাদা চুল দাঁড়ির অধিকারী এক বৃদ্ধ তার দিকেই এগিয়ে আসছেন |
--- মাষ্টার এই গ্রামের বাচ্চাগুলির লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্বটা তুমি নাও | এখান থেকে চলে যেওনা |
--- আপনি কি করে জানলেন আমি মাস্টার ?
কথার উত্তর না দিয়ে বৃদ্ধ একটু হেসে দিয়ে বললেন ," মনে সাহস রেখো আমরা সবাই তোমার সাথে আছি | তোমার জীবনের কোন ক্ষতি হবেনা | এখানেই তোমার ভাগ্য ফিরে যাবে | পুরনো বাড়ি | অনেকেই বলে ভূতপ্রেতের আস্তানা | তুমি স্কুলে থিতু হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে |"
পিয়াল কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই বৃদ্ধ কুয়াশার ভিতর মিলিয়ে গেলেন |
কিচেনে ঢুকে দেখলেন সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানো | যেন কেউ পাকা হাতে এইমাত্র গুছিয়ে রেখে গেছে | একটু চা করে খেয়ে সেদ্ধভাত চাপিয়ে দিলেন | নটা নাগাদ খেয়েদেয়ে তিনি তার স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন | অনেক হেঁটে দু একজনের কাছে জেনে নিয়ে অবশেষে তিনি পাঠকাঠি ফ্রীরি প্রাইমারি স্কুলে এসে হাজির হলেন | জনাদশেক বাচ্চা সেখানে ঘুরাঘুরি করছে | অফিসরুমে ঢুকে দেখলেন একটি বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে বসে | সেই একমাত্র এই স্কুলের শিক্ষিকা | তার কাছ থেকে এই স্কুল সম্পর্কিত অনেক কথাই জানলেন | গ্রামে লোকবসতি খুবই কম | যারা এখানে বাস করে সবাই দরিদ্রশ্রেণীর | সবাই চাষবাস করে খায় | এই একটিমাত্র স্কুল | গতদুবছর হল সরকারি অনুদান পেয়েছে | কিন্তু কোন মাস্টার এসে এখানে টিকতে পারেনা | কি এক অজানা ভয়ে ভীত হয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যায় | পিয়াল সব শুনলেন | তিনি এখানে হেডমাষ্টার পদেই বদলি হয়ে এসেছেন | মাইনে একধাক্কায় অনেকটাই বেড়েছে | তার মনেও যে ভয় কাজ করছে না তা নয় | কিন্তু এই পদটিকে টিকিয়ে রাখতে গেলে এই ভয়কে তার জয় করতেই হবে |
বিকালে তার আস্তানায় ফিরে এসে তালা খুলে ঘরে ঢুকে অবাক | টেবিলের উপরে গরম গরম লুচি আর আলুরদম | অদ্ভুত ব্যাপার তো! ঘরে তালা দেওয়া অথচ কেউ এই ঘরে ঢুকে তার খাবার তৈরী করে রেখে গেছে !কি মারাত্মক ভৌতিক কান্ড | পিয়ালের এই ভাবনার মধ্যেই গতকাল রাতে যে লোকটি তাকে নিয়ে এসেছিলো সে এসে হাজির |
--- ভাবছেন তো বাবু খাবারগুলো কে দিয়ে গেলো আর ঘরেই বা কিভাবে ঢুকলো ? আসলে ওই তালার একটি চাবি আমার কাছে আছে |
--- তা কি করে সম্ভব ? তালাটা তো আমি বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি | চাবি তো আমার কাছে |
--- আপনি ওই তালাটা দিয়েছিলেন না | ভুলবশত এই কুঠির পুরনো তালাটাই লাগিয়েছিলেন |
পিয়াল উঠে গিয়ে টেবিলের উপর দেখে তার আনা তালা এটা নয় অথচ তার দিব্যি মনে আছে সে ব্যাগের থেকে তালাচাবি বের করে তালা লাগিয়েছিল | মাথায় কিছুই ঢুকছে না এসব কি হচ্ছে | ব্যাগের ভিতর থেকে নিজের আনা তালাটা সে বের করে আরও অবাক হয়ে যায় | এটা কি করে সম্ভব ? সে তো তালাচাবি রাতেই বের করে রেখেছিলো |
টিফিনটা এতো খাওয়া হয়ে গেছিলো রাতে আর পিয়াল কিচেনে ঢোকে না | দুগ্লাস জল খেয়ে ঘুমিয়ে পরে | ঘুমের ভিতর হঠাৎ পিয়াল শুনতে পায় তার কানের কাছে কেউ বলছে ,
--- টুমি এখান হইতে পালিয়ে যাও , এখানে থাকিলে টুমায় আমি মারিয়া ফেলিবো--
ধড়মড় করে পিয়াল উঠে বসে | হারিকেনটা তখন তেলের অভাবে নিভে গেছে | আবার তার কানে আসে --
--- সাহেব , তুই আবার এসেছিস ? তোর উদ্দেশ্য আমরা এবার কিছুতেই সফল হতে দেবো না |
ভয়ে ঠকঠক করে পিয়াল তখন কাঁপছে | সাহেব আর বেশ কয়েকটি মানুষের সাথে তর্কাতর্কি হয়েই চলেছে | সাহেব চিৎকার করে উঠে ,
--- টুমাদের সকলকে হামি সুট করিবো |
সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকটি গুলির আওয়াজ | পিয়াল অজ্ঞান হয়ে যায় | সকালে যখন পিয়ালের জ্ঞান ফেরে দেখে সেই পথ প্রদর্শক যার নাম সে বলেছিলো দুর্গাদাস চৌকিদার সে তার মাথার কাছে বসে | পিয়াল উঠে বসে কিছুটা ধাতস্ত হয়ে দুর্গাদাসের কাছে জানতে চায়
--- আচ্ছা দুর্গাদাস এই বাড়িতে রোজ রাতে একজন সাহেব আর কিছু মানুষের কার্যকলাপ আমি দু'রাতেই টের পেলাম | ব্যাপারটা কি তুমি জানো ?
--- আপনি ভয় পাননি তো বাবু ?
--- একেবারে যে ভয় পাইনি তা কিন্তু নয় --- কিন্তু ব্যাপারটা জানতে পারলে একটু সুবিধা হত |
--- ভয় পাবেন না বাবু | আমরা সবাই আছি | আপনি ভয়কে জয় করতে পারলেই সাহেবের ভূত এখান থেকে পালাবে | ঘটনাটা তবে খুলেই বলি |
(শেষ পর্ব)
আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে যখন এদেশে ইংরেজরা রাজত্ব করতো তখন এখানে এক সাহেব এই কুঠিতেই বাস করতো | গ্রামে একটা পাঠশালা ছিল | ওই 'ওইখানে' আঙ্গুল দিয়ে দুর্গাদাস জালনার ফাঁকা দিয়ে বাইরের দিকে দেখিয়ে দিলো | তা হলো কি - সাহেব বেড়ার পাঠশালা টাকে ভেঙ্গে ওখানে ফুলের বাগান করবে মনস্থির করলো।গ্রামের লোকেরা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেও ভয়ে সাহেবকে কিছু বলতে পারলো না।কিন্তু গ্রামের দুজন একজন চৌকিদার আর একজন বয়স্ক মানুষ যাকে সকলে খুড়ো বলে ডাকতো।তারা দুজনে গ্রামের গরীব মানুষগুলি নিয়ে ওই পাঠশালা ভাঙ্গার সময় বাঁধা দেয়।পরিণামে অসহায় মানুষগুলোর উপর সাহেব গুলি চালায়।সঙ্গে সঙ্গেই খুড়ো মারা যায়।আর চৌকিদার ছুঁটে গিয়ে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পরে সকলের অলক্ষ্যেই;যেখানে সে আগে থাকতেই রেখে এসেছিল তার তীর ধনুক ।সে সাহেবের বুক লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারে ।চৌকিদারের অব্যর্থ নিশানায় সাহেব লুটিয়ে পরে।সাহেব কাতরাতে কাতরাতে বলে,
-- মরে গেলেও হামি এখানে স্কুল হতে দিবো না। ঘোষ্ট হয়ে এখানেই থাকিবো।যে এখানে আসিবে তাহাকেই ভয় দেখাইবো।
চৌকিদার গাছের আড়াল থেকে পালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ করতেই একজন সেপাই তাকে গুলি করে, সেও মারা যায়।সেই থেকে এখানে কেউ আসলেই সাহেবের আত্মা তাদের উপর চড়াও হয় তখন ওই চৌকিদার আর খুড়োর আত্মা ওই শিক্ষককে বাঁচাতে ছুঁটে আসে । কিন্তু এত কিছু করেও যারা এখানে তারপর থেকে এসেছে সকলেই ভয়ে পালিয়ে গেছে। এখান থেকে পরে স্কুলটা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু সেখানেও সেই একই সমস্যা। কেউ যখনই বাইরে থেকে এই স্কুলে পড়ানোর জন্য এসেছে সাহেব রাত হলেই তাকে ভয় দেখাতে শুরু করে।সবাই পালিয়ে যায় ভয়ে।কেউ যদি অন্তত কয়েকটা দিন স্কুলে টিকে যেত তাহলে সাহেবের আত্মা কিছু করতে না পেরে এখন থেকে চলে যেত।
চুপ করে পিয়াল সব শুনছিল।তারমানে বোঝা যাচ্ছে সাহেব ভয় দেখাবে ঠিকই কিন্তু খুড়ো আর চৌকিদার ঠিক বাঁচিয়ে নেবে ।তিন তিনটে ভূতের ভয় জয় করতে হবে । মেরে ফেলে দেবার আশঙ্কা যখন নেই তখন দাঁতে দাঁত চিপে কয়েকটা দিন দেখায় যাক না ---।
পিয়ালকে চুপ করে থাকতে দেখে দুর্গাদাস বললো,
--- আপনিও কি ভয় পেলেন মাষ্টারমশাই?
--- আরে না,ভয় পায়নি -- না মানে একেবারে যে ভয় পাইনি তা কিন্তু নয় । কথাগুলো দাঁত চিপে বললেন।
সেদিনটা পিয়াল আর বাইরে কোথাও বেরোলো না। সন্ধার সময় দুর্গাদাস এসে আবার দেখা করে গেলো এবং রাতে যাতে সাহেবের ভূতকে ভয় না পায় তারজন্য বারবার বলে গেলো। এও বললো,"আপনাকে চৌকিদার আর খুড়ো রক্ষা করবে,আপনি শুধু একটু মনে সাহস রাখবেন।"দুর্গাদাসের কথা শুনে পিয়াল নিজের মনেই বলে উঠলো,"এমনভাবে কথাগুলো বলছো যেন ওদের তুমি চেন --"
কিন্তু কথাটা মুখ ফুটে না বললেও দুর্গাদাস কিন্তু পিয়ালের মনের কথাটা ধরে নিয়ে হেসে বললো,"আজ্ঞে ছেলেবেলা থেকে তাদের এতো গল্প শুনেছি মনেহয় সত্যিই আমি তাদেরকে চিনি।"
পিয়াল একটু অবাক হল ,ভাবলো যা মনেমনে ভাবলাম তা দুর্গাদাস বুজলো কি করে?কিন্তু রাতের ভয়কে জয় করার চিন্তায় তার কাছে জিজ্ঞাসা করা আর হয়ে ওঠেনা ।
পিয়াল সেদিন অনেক রাত অবধি ই জেগে বই পড়ছিল।একসময় হ্যারিকেনটা দবদব করতে করতে নিভে গেলো।আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সাহেবের গলার আওয়াজ শুনতে পেলো সে।
--- টিচার,কবে যাইবে টুমি এখান হইতে ?
ভয়ে ভয়ে পিয়াল অন্ধকারের মাঝেই কথা ছুঁড়ে দিল --
--- আমি তো এখান থেকে যাবো না সাহেব --।
--- তাহা হইলে আই উইল কিল ইউ--।
--- তুমি আমাকে মারতে পারবে না সাহেব
কথাটা বললো বটে পিয়াল কিন্তু তখন তার হাত,পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে ।
পিয়াল হঠাৎ শুনতে পায় এক বৃদ্ধের গলা।সে সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলছে,
--- তুমি হেরে গেছো সাহেব এবার তোমাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। এ মাস্টার এখানেই থাকবে।আমাদের স্কুল আবার এই জমিতেই গড়ে উঠবে।
বৃদ্ধের গলাটা তার আগে শোনা মনে হল।কিন্তু ভয়ে মস্তিষ্ক তখন তার কাজ করছে না।এবার সে আবারও বললো,
--- দুর্গাদাস,আজ সাহেবকে এখান থেকে আমরা তাড়িয়ে ছাড়বো।
পিয়াল তখন ঠকঠক করে কাঁপছে।দুর্গাদাস মানে চৌকিদার --। এ কটাদিন সে ভূতের সাথে গল্প করে কাটিয়েছে?একটু পরেই শুরু হল ঘরের মধ্যে এক প্রলয় নাচন।যেন ঘরের ভিতরেই কালবৈশাখীর তাণ্ডব চলছে। কতক্ষণ ধরে এ তাণ্ডব চলেছিল তা পিয়াল জানে না।সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গে স্কুলের সেই অল্প বয়সী টিচারের ডাকে।ধড়মড় করে উঠে বসে সে।একটু ধাতস্থ হয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সে।ঘরের ভিতর হুড়মুড় করে মেয়েটির সাথে কিছু গ্রামবাসীও ঢুকে পরে। পিয়াল অবাক হয়।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মেয়েটির মুখের দিকে তাকালো।মেয়েটি তাকে জানালো কাল খুড়ো আর চৌকিদার তাকে ঘুমের ভিতর জানিয়ে গেছে সাহেবের আত্মাকে তারা কুঠি থেকে বের করে দিয়েছে।আর কখনো সাহেব এখানে আসবে না। এই কুঠিতেই স্কুল শুরু হবে এখন থেকে।আর কোন ভয় নেই ।সাহেব আর কোন মানুষকে ভয় দেখাতে পারবে না।
সব শুনে পিয়াল তার চাকরিটা টিকে থাকবে এই আশ্বাস পেয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিলো।শুধু যে খুশিই হল তা নয়,সে চৌকিদার মানে দুর্গাদাস আর খুড়ো মানে যেদিন সে এসেছিল তার পরদিন যে বৃদ্ধ তার সাথে কথা বলে গেছিলো এই দুজনের আত্মাও যে এতদিন এই কুঠীতেই আটকে ছিল এটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো।আসার দিন থেকে দুজনেই তাকে এখানে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে।দুটো স্বল্প শিক্ষিত মানুষ কয়েকশ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এই স্কুলটাকে বাঁচিয়ে রাখতে।শ্রদ্ধায় তাদের প্রতি পিয়ালের মাথা নত হয়ে এলো।
বছর দুয়েকের মধ্যে কুঠিবাড়ি সেজে উঠলো নূতন স্কুলরুপে। কলকাতা গিয়ে নামকরা আর্টিস্ট দিয়ে তার দেখা খুড়ো আর দুর্গাদাসের ছবি এঁকে পরে পাথরের মূর্তি তৈরি করে স্কুল বাড়ির প্রাঙ্গণে তা রাখা হয়।প্রতিদিন পিয়াল তো বটেই প্রায় সব ছাত্র ছাত্রীই স্কুল আসার পথে যে যেমন ফুল পায় এনে মূর্তিতে দিয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করে।এখন স্কুলের ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা তিনশর উপরে।শিক্ষক পাঁচজন।পিয়ালের পরিবারও মাঝে মধ্যে এসে এখানে থাকে এখন।স্কুল চত্বরের ভিতরেই তৈরি করা হয়েছে প্রধান শিক্ষকের আবাসস্থল।পিয়ালকে সকলে খুব ভালোবাসে আর মান্যও করে।পিয়ালের ইচ্ছা কলকাতার বাড়ি বিক্রি করে এই পাঠকাঠি গ্রামেই একটু জমি কিনে বসবাস করা।কারণ ষাট বছর বয়স হলেই তো তাকে এই কুঠির আবাস ছাড়তে হবে।সে যে এই গ্রাম আর গ্রামের মানুষগুলিকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে।
শেষ