ভালোবাসা মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে তা বোধকরি দেবেশ নিজেও বুঝতে পারেনি | দেবেশ ভেবেছিলো আর পাঁচটা মেয়ের মতই অনামিকাকে নিয়ে একটু ঘুরে ,খেয়ে ফুর্তি করে বাকিদের মত ছুড়ে ফেলবে |কিন্তু না দেবেশও যেন এবার সম্পূর্ন অন্যরকম | অনামিকাকে নিয়ে ঘোরা, বেরোনো, খাওয়া সবই করছে কিন্তু তাকে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে কখনো স্পর্শ করতে পারছে না | কই বাকিদের ক্ষেত্রে তো তা হয়নি ;তবে অনামিকার ক্ষেত্রে কেন এটা হচ্ছে ?" তবে কি অনামিকাকে ভালোবেসে ফেললাম?" নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করে |
বড়লোকের বকে যাওয়া একমাত্র সন্তান দেবেশ রায় চৌধুরী| ব্যবসায়ী বাবার অঢেল টাকাপয়সা সম্পত্তি |কোনরকমে উচচমাধ্যমিকটা পাশ করে লেখাপড়ায় ইতি টেনেছে দেবেশ |ব্যবসায়ী পিতা অনেক চেষ্টা করেও ছেলেকে কলেজমুখি করতে পারেননি |ততদিনে দেবেশ মদ,সিগারেট,আর নারী আসক্ত হয়ে পড়েছে |কিন্তু অত্যন্ত চালাক প্রকৃতির ছেলে দেবেশ এ পর্যন্ত কোন ঝামেলায় কোন দিনও পড়েনি| টাকা উড়িয়েই সকলের মুখ বন্ধ করে দিতো |নিজেকে রক্ষা করার সমস্ত কৌশল অবলম্বন করেই সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতো| পুরুষ হিসাবে দেবেশ ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী | তাই সহজেই মেয়েরা তার প্রতি আকর্ষিত হত|
অনামিকা,মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে | কলেজে পড়ে |নম্ন স্বভাবের |পড়াশুনা ছাড়া বাড়িতে মাকে ঘরের কাজে সহায়তা করা - এর বাইরেও যে কিছু থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না | একদিন রাতে কোচিং থেকে ফেরার পথে কিছু অল্প বয়স্ক ছেলে তার পথ আটকায় |এদের কাউকেই সে চিনতো না |ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাত জোর করে ছেলেগুলির কাছে সে তার সম্মান ভিক্ষা করছিলো| আর ঠিক সেই সময়ে বাইকে করে দেবেশ ও তার দুই বন্ধু ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলো | দেবেশদের বাইক দাঁড়িয়ে যাওয়ায় ওই ছেলেগুলি তাদের দেখে মুহূর্তেই পালিয়ে যায় |দেবেশ তার নূতন শিকার মনে করে অনামিকাকে আস্তে আস্তে ঠিক তার ভালোবাসার প্রস্তাবে রাজি করায় |কিন্তু নিজের ভিতরেই অদ্ভুত এক পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকে |কিছুতেই আর পাঁচ জনের মত অনামিকার সাথে কোন খারাপ কিছু করতে পারে না|
এইভাবেই বছর খানেক গড়িয়ে যায় |অনামিকার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই তার বাড়ি থেকে বিয়ের সম্মন্ধ দেখতে থাকে|ছেলের মা,বাবা এসে তাকে দেখে পছন্দ করে | যেদিন ছেলের দেখতে আসার কথা অনামিকা লুকিয়ে দেবেশের সাথে দেখা করে সব জানায়| দেবেশ মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেয় তাকে বিয়ে করার |বাইকের পিছনে বসিয়ে সোজা কালীঘাট |বৌ নিয়ে রাতেই বাড়ি ফেরে|উরণচণ্ডী ছেলের এ বিয়ে মা প্রসন্নমনে মেনে নিলেও বাবা বেঁকে বসেন |তার বক্তব্য
-- রোজগারের কোন রাস্তা জানা নেই ,পড়াশুনা না করে নিজের হাতে নিজের ভবিষ্যত শেষ করলো ,কতদিন বলেছি নিজেদের ব্যবসাটা দেখতে ,না উনি গায়ে হওয়া লাগিয়েই ঘুরবেন |আমি এই বিয়ে কিছুতেই মানবো না |
দেবেশের মা নিজের গলার স্বর খাটো করে বললেন ,
--- তোমার এই তো সুযোগ |এটাই তুমি ওর কাছে শর্ত রাখো |এখন থেকে ওকেই ব্যবসা দেখতে হবে |
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিষ্টার রায় চৌধুরী বলেন,
--- ব্যবসায়ী মানুষের সাথে ঘর করতে করতে তোমার তো দেখছি বুদ্ধি হয়েছে গিন্নী| তা তোমার গুনোধরকে ডাকো কথাটা পাকা করে নিই |
দেবেশ এখন সম্পূর্ণ অন্য মানুষ |বাবার ব্যবসার পুরোটাই সে দেখাশুনা করে| তিনিও নিশ্চিত মনে ছেলের উপর ভরসা করতে শুরু করেছেন|ছেলের এই আমূল পরিবর্তনের স্বামী,স্ত্রী দুজনেই খুব খুশি |অনামিকাকে তারা ভীষণ ভালোবাসেন |দেবেশের এই পরিবর্তনের ফলস্বরূপ তারা অনামিকাকে লক্ষীমন্ত বৌ হিসাবেই মেনে নিয়েছেন |
দুবছরের মাথায় অনামিকা যখন তাদের মধ্যে নূতন এক অতিথি আসার খবর দিলো তখন সকলেই খুব খুশি হয়ে গেলো |অনামিকাকে প্রথম থেকেই তার শ্বাশুড়ী সংসারের কোন কাজই করতে দেন না |আর এই খবরে তিনি তার কন্যাসম পুত্রবধুকে নিজের বিছানাটাও তুলতে দেখলে দেবেশের উপর চড়াও হন |দেবেশ নিজেই কোনদিন ভাবতে পারেনি সে তার জীবনে কাউকে এভাবে ভালোবাসতে পারবে |
আট মাসের মাথায় অনামিকার সামান্য ব্লিডিং হয় |ডাক্তার তাকে হয় হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেন নুতবা বাড়িতেই হাসপাতালের মতই বেডরেষ্টে থাকতে থাকতে বলেন |তারা বাড়িতেই বেড রেষ্টে থাকা মনস্থির করে|
সেদিন রাতে দেবেশের বুকে মাথা দিয়ে অনামিকা বলে,
--- কেন জানিনা আমার খুব ভয় করছে |
--- দূর পাগলী আমরা সবাই আছি তো!আর তো মাত্র দুটো মাস|দেখতে দেখতেই কেটে যাবে |জানো আমার ভাবতেও ভালো লাগছে আমাদের দুজনের মাঝে ছোট্ট একটা পুতুল শুয়ে থাকবে |সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াবে,ছুটোছুটি করবে ---
কথা শেষ হওয়ার আগেই অনামিকা বলে উঠলো,
--- যদি আমার কিছু হয়ে যায় ---
দেবেশ খপ করে তার অনুর মুখটা চেপে ধরলো |
--- এইসব কথা আর কখনোই মুখে এনোনা|তুমি আমার জীবনে পরশপাথর |তোমাকে পেয়ে আমার জীবনের সবকিছু পাল্টে গেছে |আমি নিজেকে তুমি ছাড়া ভাবতেই পারিনা |আজকে আমায় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করো আর কোনোদিন ও এ ধরনের কথা বলবে না|
অনামিকা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দেবেশ কে জড়িয়ে ধরে বলে,"এত্ত ভালোবাসো আমায়?আচ্ছা বাবা আর কোনদিন বলবো না|"
নিদৃষ্ট সময়ের অনেক আগেই অনামিকাকে ভর্তি করতে হয় তার শারীরিক অবস্থা ভালো না থাকার জন্য|ডেলিভারীর সামান্য আগে বাচ্চার পজিশন পাল্টে যায় |বাড়ির লোকের মত নিয়ে তড়িঘড়ি সিজার করা হয় |কিন্তু তার আগেই অনামিকা অনেকটাই কাহিল হয়ে পড়ে|তারপর অ্যানস্তেসিয়া ;সেই জ্ঞান আর তার ফেরে না|
বাড়ির সকলেই ভীষণ ভেঙ্গে পরে|দেবেশ প্রায় উন্মাদ হয়ে যায় |মেয়ে দেবেশের মায়ের কাছেই মানুষ হতে থাকে|মেয়েটাকে দেখলেই দেবেশ যেন আরও বেশি করে কষ্ট পায় |
এখন মেয়ে অনেক টাই বড়|সারা বাড়ি মাতালের মত হেঁটে বেড়ায় |দেবেশের মা সব সময় খেয়াল রাখতে ও পারেননা |তারও বয়স হয়েছে|সর্ব ক্ষণের জন্য একটি মেয়ে থাকলেও এক বছরের একটি বাচ্চা কে চোখে চোখে রাখা চারটে খানি কথা নয় |একদিন ব্যবসার কাজে বেরোনোর একটু আগে সে খেতে বসেছিলো |মুস্কান টলোমলো পায়ে হেঁটে এসে বাবার হাঁটুর উপর হাত রেখে নিজে খাবে বলে হা করে|দেবেশ দুহাতে তাকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে |দুচোখ থেকে সমানে জল পরে যেতে থাকে | মনেমনে সে তার অনুকে বলে,
--- আর কখনো তোমার মেয়েকে আমি অবহেলা করবো না|ওকে দেখলেই আমার তোমার জন্য আরও বেশি করে কষ্ট হত | তাই এতদিন ওকে আমি দেখলেই ভাবতাম ওকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়েই তুমি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছো |কিন্তু ওকে বুকে নিয়ে আমি বুঝতে পারছি তুমি কোথাও হারাও নি ওর মধ্যেই আমার আমৃত্যু বেচেঁ থাকবে |
শেষ
No comments:
Post a Comment