ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়
হঠাৎ পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর শুনে পায়েল ঘুরে দেখে মানুষটাকে।একমুহুর্ত ও সময় লাগেনা মানুষটিকে চিনতে ।পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় সেই পরিচিত মানুষটির কাছে।সেই আগের মতই উস্কোখুস্কো চুল। নূতন সংযোজন মুখে কাচাপাকা একগাল দাঁড়ি,আর কাঁধ থেকে ঝুলছে বহু পুরনো রংচটা ছেঁড়া একটি ব্যাগ । ব্যাগটি র উপর থেকে উঁকি দিচ্ছে কিছু আঁকার সরঞ্জাম।
জনবহুল একটি ব্যস্ত রাস্তার মোড়ে ফুটপাথের একটি চায়ের স্টল থেকে চা খাওয়া র পর পয়সা দিতে না পারায় দোকানদার তাকে নানানভাবে হেনস্থা করছে ।আর ভদ্রলোকটি হাত জোড় করে সমানে বলে যাচ্ছে,"বিশ্বাস করো আমার পকেটে পয়সা ছিল কিন্তু পকেটটা ছেঁড়া থাকাই পকেট থেকে পয়সাগুলো সব পড়ে গেছে।" দোকানের আশেপাশের মানুষগুলো একথা শুনে অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ে । এদের কথা শুনে পায়েল এগিয়ে যায় দোকানদারের সামনে। সে তার ব্যাগ থেকে তিনটে টাকা বের করে দোকানদারের হাতে দেয়।পরে সে ভদ্রলোকের হাত ধরে ওই দোকানের সামনে থেকে বাইরে বের করে আনে।l পায়েল তার হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে আর লোকটি কোন প্রতিবাদ না করে পায়েলের সাথে বাচচাদের মত দৌড়াতে লাগে। একটু ফাঁকা জায়গায় এসে পায়েল তার হাতটা ছেড়ে দেয়। লোকটি উৎসুক দৃষ্টিতে পায়েলের মুখের দিকে তাকায়। পায়েলকে তার খুবই চেনা মনে হয় কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না ।স্মৃতির অতল গহবরে হাত ঢুকিয়ে সে চিন্তা করতে থাকে এই মেয়েটিকে সে যেন কোথাও দেখেছিল কিন্তু কোন কুল সে খুঁজে পায়না। পায়েলকে যে সে চিনতে পারছেনা পায়েল সেটা বুঝতে পারে তাই সে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে,
--- তুমি আমার মুখের দিকে তাকাও রঞ্জিতদা ,আমি পায়েল, আমার মুখের দিকে একটু তাকিয়ে দেখো ঠিক চিনতে পারবে।
কিন্তু রঞ্জিতবাবু পায়েলের কথার কোন উত্তর না দিয়ে তার ব্যাগের ভেতর সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে কি যেন খুঁজে চলেছেন আর মাঝে মাঝে কি খুঁজছেন মনে না পড়ায় নিজের মাথার চুলগুলো নিজেই টেনে ছিঁড়ছেন। পায়েল বুঝতে পারে রঞ্জিতদার মাথাটাই পুরো গেছে।
সে ফিরে যায় এক যুগ আগের দিন গুলিতে। তার মনে পড়তে থাকে পায়েলের দিদি পামেলা ভালোবাসতো রঞ্জিতদাকে। রঞ্জিতদাও পাগলের মত ভালবাসত তার দিদি পামেলাকে।পায়েল তখন সবে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে। রঞ্জিতদা খুব সুন্দর ছবি আঁকতো। বাড়ির সবাই রঞ্জিতদাকে মেনে নিয়েছিল।তাই প্রায়ই রঞ্জিতদা পায়েলদের বাড়িতে আসত। আর যে ছবিগুলো রঞ্জিতদা আঁকতো সেই ছবিগুলো এনে বাড়ির সবাইকে দেখাতো। টুকটাক ছবি আঁকতে পায়েল ও জানতো। তাই রঞ্জিতদা যখন তার আঁকা ছবিগুলো নিয়ে পায়েলদের বাড়িতে আসত সে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে রঞ্জিতদার কাছ থেকে ছবি আঁকার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জেনে নিত। যেহেতু পামেলার সাথে রঞ্জিতের বিয়ের সব কিছু ফাইনাল হয়ে গেছিল তাই পায়েলের সাথে সময় কাটানো বাড়ির লোক কেউ কিছু মনে করতো না।কিন্তু পায়েল মনেমনে তার রঞ্জিতদাকে কিছুটা হলেও ভালোবেসে ফেলেছিল।কিন্তু মুখে কোনদিনও তা প্রকাশ করেনি কারণ দিদি এবং রঞ্জিতদা পরস্পর পরস্পরকে ভীষণ ভালোবাসতো।হঠাৎ পায়েলদের সংসারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত হঠাৎ একটি অঘটন ঘটে যায়। একদিন পামেলা কলেজ থেকে ফেরার সময় মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট করে।পাগলের মতন রঞ্জিত হাসপাতাল আর বাড়ি ছোটাছুটি করতে থাকে ।কিন্তু পামেলাকে সে ধরে রাখতে পারেনা। চল্লিশটা দিন যমে মানুষে টানাটানি করার পর পামেলা সব মায়া ত্যাগ করে চিরতরে সবাইকে ছেড়ে চলে যায়। বাবা-মা ভীষণ ভেঙে পড়েন আর রঞ্জিতদা পুরো পাগলের মতন হয়ে যায়।রঞ্জিতদা ছিল বাবা - মায়ের একমাত্র সন্তান।
পামেলার বাবা-মা এ শোক সামলাতে পারলেও রঞ্জিত এ শোক সামলাতে পারেনা।সে আস্তে আস্তে চুপচাপ থাকতে থাকতে কেমন নির্জীব হয়ে যেতে থাকে।ঘরে থাকে কারো সাথে কথা বলে না, কোথাও বেড়াতে বের হয়না বাবা মার সাথে প্রয়োজন না হলে কথা বলেনা, বন্ধুবান্ধবের সাথে কোন যোগাযোগ রাখে না। পামেলার মৃত্যুর মাস দুয়েক পরে হঠাৎ একদিন খুব ভোরে তার আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে সে বাড়ি থেকে কোথায় যেন বেরিয়ে যায়।অনেক খোঁজাখুঁজি করেও বাড়ির লোক তার কোন সন্ধান পায় না। যেহেতু রঞ্জিতদার প্রতি পায়েলের আলাদা একটা ফিলিংস ছিল তাই রঞ্জিতদার এই চলে যাওয়াটাকে সে কিছুতেই মন থেকে মানতে পারেনি।হয়তো সেই কারণেই সে বাবা-মার কথাও রাখতে পারেনি। এই পর্যন্ত রঞ্জিতদাকে খুঁজেছে সে প্রচুর তাই হয়ত বাবা মার পছন্দ করা ছেলেকে সে বিয়ে করতে রাজি হয়নি।
পায়েল এই আত্মভোলা, স্মৃতিভ্রংশ মানুষটিকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে চলে যায়।রঞ্জিতদার বাবা,মা কয়েক বছর আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। পরদিন পায়েল এই মানুষটিকে নিয়ে একজন মনোবিদ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। ডাক্তার রনজিতকে কোন ওষুধ দেন না, শুধু পায়েলকে জানিয়ে দেন একটু ভালোবাসা একটু সেবা-যত্ন পেলেই রঞ্জিত সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠবে। শুরু হয় পায়েলের জীবনে এক নতুন অধ্যায়। অফিস,ঘরের কাজ আর রঞ্জিতের সেবা যত্ন এই হয়ে ওঠে পায়েলের জীবন। বছর চারেক আগে পায়েলের বাবা মা দুজনই পায়েলকে ছেড়ে সারা জীবনের মতো চলে যান ।পায়েল হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ একা। সে তার বাড়ি বিক্রি করে একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানে উঠে আসে। পায়েল অফিস যাওয়ার সময় তালা বন্ধ করে রঞ্জিতকে ঘরে রেখে যেত আর যখন ফিরে আসতো এসে দেখতো ঘরের সমস্ত জিনিস লন্ডভন্ড করা। চারিদিকে আঁকার সরঞ্জাম ছড়ানো আর কাগজের ঢিপ।
আস্তে আস্তে রঞ্জিতের ভিতর পরিবর্তন লক্ষ্য করতে থাকে পায়েল। একদিন অফিস থেকে তালা খুলে ঘরে ঢুকে পায়েল দেখে রঞ্জিত বেশ কয়েকটি ছবি এঁকেছে। তারমধ্যে দু-তিনটি ছবি পামেলার। পায়েল বুঝতে পারে রঞ্জিত আস্তে আস্তে সুস্থর দিকে যাচ্ছে।
এরইমধ্যে হঠাৎ একদিন পায়েলের খুব জ্বর হয়। পায়েল অফিস যেতে পারে না।সারাদিন ঘরে শুয়ে থাকে। রঞ্জিত খেতে গিয়ে তার খাবার গুছানো না পেয়ে এবং পায়েলকে দেখতে না পেয়ে সন্ধ্যার দিকে আস্তে আস্তে সে পায়েলের ঘরে ঢোকে। পায়েলের ঘরে ঢুকে সে দেখে পায়েল গায়ের চাদর দিয়ে শুয়ে আছে। সে পায়েলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পায়েল রক্তবর্ণ চোখ খুলে তার দিকে তাকায়। রঞ্জিত তার কপালে হাত রেখে বুঝতে পারে পায়েলের খুব জ্বর, সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রান্না ঘরে ঢুকে একটি বাটি নিয়ে পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে পায়েলের কপালে জলপট্টি দিতে থাকে। জ্বরটা একটু কমলে সে পায়েলের জন্য একটু খাবারও করে আনে। রঞ্জিতের এই উন্নতি দেখে পায়েল খুব খুশি হয়। এইভাবে আরও বেশ কয়েকটা দিন কেটে যায় রঞ্জিত নিজেও বুঝতে পারে সে আস্তে আস্তে পায়েলের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ছে। সে তখন চেষ্টা করতে থাকে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ার।
ঠিক যেভাবে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল সেই একইভাবে এবার সে পায়েলের ফ্ল্যাট থেকেও বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।কিন্তু পায়েল আগে থাকতেই এটা অনুমান করেছিল। তাই ফ্ল্যাটের দরজায় তালা দিয়ে চাবি তার কাছেই রেখে দিয়েছিল। রঞ্জিত শত ছিদ্র, নোংরা ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে অপারগ হয়। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে পায়েল দাঁড়ানো,
--- কি চিরঞ্জিতদা আমার ফ্ল্যাট থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলে বুঝি?
--- একি তুমি ফ্ল্যাটে তালা দিয়ে রেখেছো বুঝি? তোমার কি মনের ইচ্ছা আমায় এখানেই থাকতে হবে ?আমাকে কি তুমি আটকে রাখতে পারবে?
---- আমার ঘরের দরজা দিয়ে তুমি হয়তো বেরিয়ে যেতে পারবে কিন্তু আমার মনের ঘরে যেখানে তোমায় আমি বন্ধু করেছি সেখান থেকে তুমি ইচ্ছে করলেও পালিয়ে যেতে পারবেনা রঞ্জিতদা। আমি তোমায় ভালোবাসি রঞ্জিতদা। আর তোমাকে ভালোবাসি বলেই আজও আমি একা। কাউকেই আমি তোমার জায়গাটা দিতে পারিনি। দিদি চলে যাওয়ার পর তুমি যখন বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলে আমি তোমাকে পাগলের মত সব জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু কোথাও তোমাকে পাইনি। আজকে আমার বলতে একটুও বাধা নেই আমি তোমাকে দিদি থাকতেই ভালবাসতে শুরু করেছিলাম কিন্তু কোনদিন মুখে বলতে পারিনি কারণ আমি জানতাম দিদি আর তুমি পরস্পরকে ভীষণ ভালবাসতে। আমি তোমার প্রতিক্ষাতেই আজও রয়েছি ।পারবেনা আমাকে আপন করে নিতে ?তোমার মনে দিদির জন্য যে জায়গাটা পাতা আছে সেই জায়গাটায় আমি কোনদিনও বসতে চাইব না কিন্তু তবুও তোমার মনের যেকোনো জায়গায় আমার জন্য একটু জায়গা হবে না?
কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে রঞ্জিত আস্তে আস্তে পায়েলের দিকে এগিয়ে যায় পায়েলের মুখটা আলতো করে তুলে ধরে বলে,
--- তোমার দিদিকে যখন ভালবাসতাম তখন তুমি খুব ছোট ছিলে। আমার কাছে আঁকার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো জানতে চাইতে ভালো লাগতো। তারপর নিজেকে হারিয়ে ফেললাম অনেক কিছু ভুলে ছিলাম বেশ কয়েক বছর। কিন্তু এই কটা দিনে তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছো ।আমি বুঝতে পেরেছি আমিও বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। না, না এটা আমার কৃতজ্ঞতা নয় আমি সত্যিই তোমায় ভালবাসি পায়েল। ভালোবাসা জীবনে বহুবার আসতে পারে ভালোবাসা বয়স মানে না, ভালোবাসা সম্পর্ক মানে না, ভালোবাসা অর্থ দেখেও হয় না।শুধু দুটি মনের মিলনেই ভালোবাসার জন্ম নেয়। বয়সটা হয়ত আমার একটু বেশিই হয়েছে, তুমিও ম্যাচিওর হয়েছো।এই বয়সে এসে আমরা দুজনেই একটা সুখনীড় রচনা করতে অনায়াসেই পারবো। ভুলে যাব আমরা অতীতকে। যে অতীত আমাদের বারবার কষ্ট দেয়, যে অতীত আমাদের সামনে এগোতে বাঁধা দেয়, সেই অতীতকে আমরা আর ধরে রাখবো না। সবকিছু ভুলে আমরা সামনে এগিয়ে যাবো।
No comments:
Post a Comment