ভালোবাসার বন্ধন (২য় পর্ব)
নলিনী কলেজে ভর্তি হল। তাপসবাবু তার জমির কিছুটা বিক্রি করে নলিনীর জন্য এক গাড়ি কিনে বসলেন। গ্রামের লোকেরা মুখ টিপে হাসাহাসি, টোন-টিটকারি যে তার কানে আসেনি তা কিন্তু নয়। কারণ সেই যে ছেলে ঠাকুমার কাজ শেষে বেরিয়েছে তারপর আর আসেনি। কিন্তু মাসের শেষে ছেলের বরাদ্দ টাকা তাপসবাবু ঠিক পাঠিয়ে দেন। বাবার খবরাখবরও তপেশ রাখে ফোনের মাধ্যমেই। কিন্তু নলিনী সম্পর্কে কোন কথা বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করতে সে সাহস পায় না।
গ্রামে থেকেও যে লেখাপড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হওয়া যায় সেটাই যেন তাপসবাবু নলিনীকে দিয়ে তার ছেলেকে দেখিয়ে দিতে চান।
নলিনী দু' একবার বাপেরবাড়িতে গেলেও সে দিনই ফিরে এসেছে তার বাবা একা থাকবেন বলে। তাপসবাবুও এখন যেন নলিনী ছাড়া অসহায়! পড়াশুনার মধ্যেই নলিনী জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি এমনকি সংসারের সবকিছুতেই সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছে। শুধু শ্বশুর,বৌমা নয় এখন তারা বাপমেয়ের থেকেও দু'জন দু'জনের কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছেন। দু'জনের মনের কষ্টের দিকটা পরস্পর গোপন রেখেই চলেন।
কোন কাজেই নলিনীর কোন না নেই। সবকিছুতেই সে যেন সিদ্ধহস্ত। সে সংসার,পড়াশুনা, বিষয় সম্পত্তি এমন কী পাঁচ সাতটা কাজের লোক থাকার পরেও শ্বশুরের সেবাযত্ন সব কিছুই তার নজর এড়ায় না। বয়স জনিত কারণে অনেক সময় জমিজমা সংক্রান্ত কোন ঝামেলায় নলিনী তাপসবাবুকে আর জড়ায় না নিজেই সমস্যার সমাধান করে থাকে। সবকিছু সত্ত্বেও বৃদ্ধের কোথাও যেন একটা কষ্ট কাজ করে তা নলিনী তাঁর মুখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে। একমাত্র সন্তান ছেড়ে থাকার যে যন্ত্রণা তা মাঝে মাঝে তাঁর মুখে ফুটে ওঠে।
কলেজে নিয়মিত যাতায়াত করতে না পারলেও বছর বছর পরীক্ষার রেজাল্ট তার মন্দ নয়। আসলে ছেলেবেলা থেকেই নলিনী ছিল খুব মেধাবী। কোন প্রাইভেট শিক্ষক কোনদিন তার পরিবার তার জন্য রাখতে পারেননি। সে যেটুকু পড়াশুনা করেছে নিজের চেষ্টায় আর মেধার গুনে।
খুব সুন্দরী সে না হলেও চেহারা তার মন্দ নয়। অভাবের মধ্যে মানুষ হওয়ার ফলে চেহারার লালিত্য সেভাবে ছিল না। ভালো থাকা,খাওয়া আর পরার দৌলতে এখন সে রীতিমত রূপসী। নিজের ব্যক্তিত্ব আর পুরুষের কুনজর থেকে নিজেকে রক্ষা করার সমস্ত গুন তার মধ্যে আছে।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে জীবন ঠিক এগিয়ে যায়। আগে তপেশ মাঝে মধ্যে বাড়ি আসলেও বিয়ের পর থেকে মোটামুটি আসা বন্ধ করেছে বলাই ভালো।
কেটে গেছে তিন তিনটে বছর। একদিন কলেজ থেকে ফিরে এসে জানতে পারে তপেস এসেছে। নিজের অজান্তেই বুকের ভিতর একটা ধাক্কা খায়। কলেজ থেকে বাড়িতে ফিরেই বাবার সাথে আগে দেখা করা তার নিত্য দিনের অভ্যাস। ঘরে ঢুকতে গিয়ে ঘরের বাইরে জুতো দেখে নলিনী বুঝতে পারে তপেশ এই ঘরেই আছে। সে ঘরে না ঢুকে বাইরে থেকেই তার শ্বশুরকে জানায় সে বাড়ি ফিরেছে। তপেশ বুঝতে পারে না নলিনী কোথায় গেছিলো কিন্তু তার মনের ভিতর প্রশ্নটা থেকেই যায়।
রান্নার মাসিকে দিয়ে তপেশের টিফিন জলখাবার সে বাবার ঘরেই পৌঁছে দেয়। তপেশ বাবার ঘরে টিফিন সেরে অনেকক্ষণ বসে থাকে। মামুলী দু'একটি কথা ছাড়া আর কোন কথা বাবার সাথে তার হয় না। নলিনী সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞাসা করার সাহস তার হয় না। আর তাপসবাবুও এ বিষয়ে কোন কথা তোলেন না। একসময় তপেশ উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। উঠে চলে যাওয়ার আগে বাবাকে বলে,
-- তোমাকে একটা খবর দিতে এসেছি। আমি একটা চাকরি পেয়েছি কলেজে লাইব্রেরিয়ান পদে। এখন থেকে তোমার আমাকে টাকা না পাঠালেও চলবে।
তাপসবাবু কোন উত্তর করেন না তপেশ তার ঘরে চলে যায়। তাপসবাবুর বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনেমনে বলতে থাকেন " যার কোটি টাকার উপরে সম্পত্তি সে সামান্য কয়েক হাজার টাকার জন্য এমন লক্ষ্মী প্রতিমার মত মেয়েটিকে বুঝতেই চাইলো না।
ঘরে এসে তপেশ স্নান করে ফ্রেশ হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে একটু বাইরে ঘোরার উদ্দেশ্য নিয়ে। রাস্তার মোড়ে এসে চায়ের দোকানে জটলা দেখে সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়।
অনেকদিন পর তপেশকে দেখে পরিচিতরা নানান কথা জিজ্ঞাসা করতে থাকে। সে হাসি মুখেই সকলের কথার উত্তর দিতে থাকে। হঠাৎ তার ছেলেবেলার বন্ধু বলে বসলো,
-- বউকে নিয়ে যখন সংসার করবি না তখন বিয়ে করলি কেন?
প্রথমটাই তপেশ কিছুটা ধাক্কা খায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
-- নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বাবার টাকায় বউ নিয়ে সংসার করার মনোবৃত্তি হয়নি তাই। সকলের মানসিকতা তো সমান নয়। আর তোদের কে বললো? আমি সংসার করতে চাই না? আমাদের তো কোন অসুবিধা হচ্ছে না। আমরা তো দিব্বি আছি।
বন্ধুটি আর কোন কথা বলার সুযোগ পেলো না। কারণ তপেশের কথা শেষ হতে না হতেই একজন বয়স্ক ব্যক্তি বলে উঠলেন,
-- সবাইকে কি তোমার মত ভাবো? নিজে তো কিছুই করো না। বিয়ে করে বসে আছো। শুনছি তোমার বউ নাকি পোয়াতি। সবটাই তো বাপের ঘাড়ে। বয়স তো কম হল না। এবার নিজে কিছু চেষ্টা করো। বসে বসে খেলে রাজকোষও শূন্য হয়ে যায়। আর শোনো হে আমাদের তপেশের বউ রূপেগুনে মা সরস্বতী। একহাতে কেমন সবদিক সামলে শ্বশুরের সেবাযত্ন করে লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছে।
তপেশ এখানেই শোনে তার বউ কলকাতা শহরে পড়াশুনা করতে রোজ ঘণ্টার পর ঘণ্টা জার্নি করে। তার বাবা একটা গাড়িও কিনে দিয়েছেন তার যাতায়াতের সুবিধার্থে। অবাক হয়ে শোনে সকলের মুখে নলিনীর প্রশংসা। ঘন্টা দু'য়েক সময় কোথা দিয়ে কেটে গেলো বুঝতেই পারলো না। কিন্তু মনের মধ্যে তার এখন অনেক প্রশ্ন। নলিনী কলকাতা কোন কলেজে পড়ে, কী পড়ে, কেমন করে এত পরিশ্রমের পরেও বাড়িতে এসে সংসারের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে নজর রাখে? জমিজমা ,হিসাবনিকাশ কিভাবে সামলায়?
কিন্তু কে দেবে তার এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর?
বাড়িতে ফিরতে তার প্রায় দশটা বেজে যায়। গেট থেকেই সে লক্ষ্য করে ব্যালকনিতে অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি। তার একটুও বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা নলিনীই। বুকটার ভিতর হঠাৎ করেই তার কেঁপে ওঠে। কাছে বসিয়ে নলিনীর মুখ থেকে তার সমস্ত ঘটনাগুলি জানতে ইচ্ছা করে। কিন্তু কোথায় যেন একটা বাধা এসে দাঁড়ায় তার সামনে। এক একবার ভাবে সে কী নিজের ভালো চাইতে নলিনীর সাথে ভীষণ অন্যায় করে ফেলেছে? নলিনীকে মেনে নিয়ে তার জীবন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো? নিজেকে নিজেই আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কিন্তু সঠিকবেঠিক বুঝতে পারে না।
তপেশকে গেট খুলতে দেখেই নলিনী সেখান থেকে সরে আসে। রান্নাঘরে গিয়ে তপেশের খাবার রেডি করতে থাকে। তপেশ উপরে উঠে দেখে বাবার ঘর অন্ধকার। তারমানে বাবা খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। নলিনীর ঘরে উঁকি দেয়। কোথাও তাকে দেখতে পায় না। এবার নিজের ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে ঢোকে ডিনার করতে। গিয়ে দেখে রান্নার মাসি খাবার গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তপেশ কোন কথা না বলে খেতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর সে জানতে চায় মাসির কাছে,
- বাড়ির সকলের খাওয়া হয়ে গেছে?
-- হ্যাঁ সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। শুধু বৌদিমনি আর আমি বাকি
-- এত রাত হয়ে গেছে তোমরা এখনো খাওনি কেন?
-- ওমা সে কী কথা! তুমি না ফিরতেই বৌদিমনি খেয়ে নেবে? বাড়ির একটা প্রাণীর খাওয়া না হলে বৌদিমনি খায় না। তাই আমিও বসে থাকি। দু'জনে একসাথেই রাতের খাবারটা খাই। আর যেদিন কলেজ থাকে না সেদিন দুপুরেও একসাথে খাই। কলেজ থাকলে তো তাকে আগেই খেতে হয়।
তপেশ চুপ করে আরও কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলো। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে নলিনী মাসিকে বললো,
-- মাসি এত কথা কেন বলছো? অনেক রাত হল ওনাকে খেতে দাও।
মাসি চুপ করে গেলো। নলিনী রান্নাঘরের দরজার আড়াল থেকে লক্ষ্য করলো তপেশের দু'টো চোখ রান্নাঘরের দরজার দিকেই। সে নিজেকে আরও কিছুটা আড়াল করে নিলো।
ক্রমশ :