Monday, February 7, 2022

ঝরাপাতা (বারো পর্ব)

ঝরাপাতা ( বারো পর্ব)
  সবার আনন্দে যদি সবাই খুশি হত তাহলে তো মানুষের অনেক দুঃখ কষ্টই লাঘব হয়ে যেত।নাতি যত বড় হতে থাকলো সে মায়ের পাশে থেকে তার মায়ের প্রতি ঠাকুমার অন্যায় অত্যাচারের প্রতিবাদে সরব হতে থাকলো;প্রতিটা মুহূর্তে যা তার বাবা সুধীরও পারেনি সব সময়। সুধীরও প্রতিবাদ করতো ঠিকই কিন্তু শত হোক মা তো!
 তাই বলে সুবীর যে তার ঠাকুমাকে ভালোবাসে না তা কিন্তু নয়।সে তার ঠাকুমা এবং মা দুজনকেই প্রচণ্ড ভালোবাসে।কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তার মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধটা বড্ড বেশি কাজ করতে থাকে।
 প্রায় প্রতিটা পদক্ষেপেই ঠাকুমার প্রতি সুবীরের এই সরব হওয়াটা বিশাখার অনেক সময় ভালো লাগতো না।তাই মাঝে মাঝে সে তার ছেলেকে বলে,
--- ঠাকুমার বয়স হয়েছে কি বলতে কি বলেন সব সময় হয়তো মনেও রাখতে পারেন না।একটু চুপচাপ থাকলেই তো হয় বাবা।
--- তুমি কি ধাতুতে গড়া আমি জানিনা মা।সেই জ্ঞানের থেকে দেখে আসছি তোমার প্রতি ঠাকুমার এই ব্যবহার।নিজের তো প্রতিবাদ করার কোন ক্ষমতা নেই ;আমাকেও নিষেধ করছো?দিনরাত পরিশ্রম করো।স্কুল থেকে এসে ঘরের যাবতীয় কাজ করো।কিন্তু কখনোই দেখিনি ঠাকুমা তোমার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করছে।তারমানে সেই প্রথম থেকেই ঠাকুমা তোমার প্রতি এই আচরণই করে যাচ্ছে।তোমরা দুজন ছাড়া আমার আর কে আছে?তোমাদের দুজনকেই আমি খুব ভালোবাসি।তোমরা কেউ কষ্ট পেলে আমার তো ভালো লাগে না।তাই আমি এর প্রতিবাদ করবোই।ঠাকুমার মধ্যে আগের থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে দেখবে আস্তে আস্তে ঠাকুমাও একদিন ঠিক বুঝতে পারবেন তিনি এতদিন ধরে তোমার প্রতি যে আচরণ করেছেন তা ঠিক করেননি।
 হ্যাঁ বিশাখার শ্বাশুড়ী ঠিকই বুঝেছিলেন কিন্তু সেটা একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থায়।যখন তিনি সম্পূর্ণভাবে তার বৌমার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন।হাঁটাচলা পুরোপুরি বন্ধ তখন।প্রাকৃতিক কর্ম সব বিছানাতেই।বিশাখা যখন স্কুলে থাকে সেই কয়েক ঘণ্টা সে একজন আয়ার ব্যবস্থা করেছিলো।নার্সিং ট্রেনিংটা যেহেতু নেওয়া ছিল তাই সেক্ষেত্রে অনেকটাই উপকারে এসেছিল।সেই আয়ার কাছেই উগড়ে দিয়েছিলেন মৃতুপথ যাত্রী মানুষ তার একমাত্র ছেলের বউয়ের প্রতি করা অন্যায় অত্যাচারের কাহিনী।তিনি বলতেন,
--- আমি কেন যে ওর প্রতি এমন অন্যায় করতাম নিজেও বুঝতে পারতাম না।যখন সুধীর বেঁচে ছিলো তখন সে যখন আমাকে বোঝাতো মনেমনে ভাবতাম আর আমি বৌমার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না কিন্তু ও যখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াত আমায় মাথায় আগুন চরে যেত।নিজেকে সামলে নেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি পারিনি।পরবর্তীতে দাদুভাইও আমায় অনেক বুঝিয়েছে।আমি তারপর অনেক ভেবেছি আর ভেবে ভেবে এর কারণও বের করতে পেরেছি যখন ঠিক তখন আমার আর তারজন্য কিছু করার ক্ষমতা নেই।
 অল্পবয়সী আয়া বৃদ্ধার মুখে তার বোধোদয়ের সমাধান সূত্রটি জানতে চেয়ে বললো,
--- বলো তো ঠাকুমা এর কারণটা কি?
--- আসলে কি জানিস?অধিকাংশ বউয়েরা শ্বশুরবাড়ি এসে শ্বাশুড়ী দ্বারা অত্যাচারিত হয়।প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় তারা প্রতিবাদ করতে পারে না বা করলেও কোন লাভ হয়না।আবার সেই সব বউয়েরা যখন শ্বাশুড়ী হয় তখন নিজের প্রতি অত্যাচারের কথা মনেকরে নিরীহ বউটির প্রতি অত্যাচার করে প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে।অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো এইরূপই হয়েছিল।
--- সেটা কিছুটা হলেও হয়ত ঠিক ঠাকুমা।কিন্তু সর্বক্ষেত্রে নয়।কিছু শ্বাশুড়ী বৌমার মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্কও আছে।আবার কিছু মানুষ জানো তো জন্মগতই খারাপ হয়।তারা কারো সাথেই ভালো ব্যবহার করতে পারে না। প্রতিটা পাড়াতেই খুঁজলে দেখবে এরূপ বেশ কয়েকটা মানুষ পেয়ে যাবে। এরাই তাদের বউদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে থাকে।আসলে এরা কারো সাথেই ভালো ব্যবহার করতে জানে না।
--- অতশত জানিনা বাপু,আমার শ্বাশুড়ি আমার সাথে মারত্মক দুর্ব্যবহার করতো।আমার স্বামী,শ্বশুর তার ভয়ে জড়সড় থাকতো।কেউ কোনদিনও আমার হয়ে টু শব্দটি করতে পারেনি।কতদিন কোন কোন বেলা আমার অন্যায়ের শাস্তিস্বরূপ আমায় খেতে দেয়নি।অথচ জানিস আমিই কিন্তু রান্নাবান্না করতাম।কিন্তু কাউকেই খেতে দেওয়ার অধিকার আমার ছিল না।এমন কি তারা যখন খেতে বসতো রান্নাঘরে তাদের আসন পাতিয়ে,জলের গ্লাস গুছিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হত।
--- কেন তা কেন?দাদু কিছু বলতো না?
--- কেন যে তিনি এটা করতেন সেটা বলতে পারবো না।তবে ওই যে বললুম আমার শ্বাশুড়ি মায়ের ভয়ে ছেলে আর তার বাপ ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকতো।এখন বুঝি তখন তো কিছু করতে পারিনি তাই বৌমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে মনের জ্বালা মেটাতাম।
 মৃত্যুর প্রায় মাসখানেক আগে বিশাখাকে ডেকে তার শ্বাশুড়ী বলেন,
--- মরার আগে বোধোদয় হল বৌমা।তোমার উপর যে অন্যায় অত্যাচার করেছি তারজন্য আমায় ক্ষমা কোরো।তুমি ক্ষমা না করলে নরকেও আমার ঠাঁই হবে না।
 বিশাখা তার শ্বাশুড়ী মায়ের হাত দুটি ধরে সেদিন বলেছিলো,
--- আপনি যখন আমায় বকাবকি করতেন তখন সত্যিই খুব কষ্ট পেতাম মা।বুঝতে পারতাম না কি কারণে আপনি আমার সাথে ওই রকম ব্যবহার করতেন।কিন্তু মুখ বুঝে সব সহ্য করতাম মনেমনে ভাবতাম একদিন না একদিন আপনি আপনার ভুল বুঝতে পারবেন।আগে আপনার ছেলে আমায় শান্তনা দিত।তারপর আপনার নাতি বড় হওয়ার পর থেকে সেও তার বাবার মত আমায় আগলে রাখতে শুরু করে।আমার কষ্ট কমতে থেকে।আর আজ প্রায় বছর খানেক আপনার মধ্যে আমি পরিবর্তন দেখছি।এখন আমার আর কোন কষ্ট নেই।আমি সেসব ভুলে গেছি মা।ওইসব মনে করে আপনি কষ্ট পাবেন না।
তারপর বিশাখার শ্বাশুড়ী তার বালিশের তলা থেকে তার নিজের আলমারির চাবি বের করে বিশাখার হাতে দিয়ে বলেন আলমারি খুলে তার ভিতর থেকে গয়নার বাক্সটা নিয়ে আসতে।বিশাখা তার কথামত বাক্সটা নিয়ে এলে তিনি বলেন,
--- ওই বাক্সের ভিতরই তিনটি ছোট কানের দুলের বাক্স আছে যা তার বিয়ের সময় নিকট আত্মীয়রা দিয়েছিলেন তার হাতে।অথচ আমি সেগুলি কোনদিনও তোমার হাতে তুলে দিতে পারিনি।আমার অপরাধের শেষ নেই মা -- ।
--- পুরনো কোন কথা ভেবে কষ্ট পাবেন না মা। যা হয়ে গেছে তা আর কোনদিন ফিরে আসবে না।
 বিশাখার শ্বাশুড়ী সেই তিনটি কানের দুল ছাড়াও তার নিজের সব গয়না বৌমার হাতে দিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকেন।নাতি সুবীর কান্নার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে ঠাকুমার ঘরে এসে দেখে তার মা আর ঠাকুমা দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে চলেছে।এই দৃশ্য দেখে  তার চোখ দুটিও ঝাপসা হয়ে আসে।নিজেকে লুকোতে সে অন্য ঘরে চলে যায়।
 এই ঘটনার মাস খানেক পরে রাতে ঘুমের মধ্যেই তিনি আমৃতলোকে যাত্রা করেন।বিশাখার যেহেতু নার্সিং ট্রেনিংটা নেওয়া ছিল সে তার সর্ব শক্তি দিয়ে ,অর্থের দিকে না তাকিয়ে শ্বাশুড়ির সেবা-যত্নই শুধু নয় ডাক্তার ওষুধ ইনজেকশন করেও রোগ নিরাময় করতে পারেনি।এখন শুধু মা আর ছেলের সংসার।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment