Tuesday, February 15, 2022

ঝরাপাতা (তেরো পর্ব)

ঝরাপাতা (তেরো পর্ব)
  জীবনের বাঁক যেকোন সময় হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে যায়।কেউ বুঝতেও পারে না কোথা থেকে কি হয়ে গেলো।শিলিগুড়িতে পড়ার সময় অস্মিতা নামে একটি মেয়ের সাথে সুচন্দার খুব বন্ধুত্ব হয়। অস্মিতা পড়াশুনায় ছিলো মধ্যম মানের। সে ছিলো ধনীর দুলালী। কিন্তু এরজন্য তার মধ্যে কোন অহংকার ছিলো না।সুচন্দার দিদির বাড়িতে তার ছিল অবারিত দ্বার।ঠিক তদ্রুপ অস্মিতার বাবা,মা ও সুচন্দাকে খুবই ভালোবাসতেন। অস্মিতা পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে ছিলো বড়।
 কলকাতার বাড়ি ছেড়ে আসার পর নিজের জীবনের অনেক আশা,আকাঙ্খা,সুখ,আনন্দ এমনকি জীবনের প্রথম ভালোবাসা যা পাঁপড়ি মেলার আগেই ঝরে গেলো এইরূপ অনেককিছুই বিসর্জন দিতে হয়েছিলো সুচন্দাকে।এই সবকিছু হারানোর মধ্যেও অস্মিতার মত একজন মনের মত বন্ধু পেয়ে কিছুটা সময় অন্তত সুচন্দার ভালো কাটতো।
  অস্মিতার বাবা ছিলেন একজন নামকরা ডাক্তার।সুচন্দা ও অস্মিতা দুজনেই তাদের ভালোবাসা আর সুন্দর ব্যবহার গুনে দুটো অপরিচিত পরিবারকে আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো।
 তারা যে কলেজে পড়তো সেই কলেজের ঠিক কাছেই ছিলো অস্মিতাদের বাড়ি।যেদিন প্রাইভেট টিউশন থাকতো সুচন্দা স্কুল শেষে আর দিদির বাড়ি ফিরে আসতো না সোজা চলে যেত প্রিয় বন্ধুর সাথে তাদের বাড়িতে।ওখানে খেয়েদেয়ে দুজনে একসাথে স্যারের কাছে পড়তে যেত।একটু বেশি দেরি হয়ে গেলে সুচন্দার ভগ্নিপতি এসে অস্মিতাদের বাড়ি থেকেই তাকে নিয়ে যেতেন।
প্রাথমিক মন খারাপের শোক কাটিয়ে উঠতে সুচন্দার জীবনে অস্মিতা এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে শুধুমাত্র তার সঙ্গ দানের মাধ্যমে।পৃথিবীর একমাত্র প্রিয় বন্ধু অস্মিতার কাছেই সুচন্দা স্বীকার করেছিল সুমিতের কথা।এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যাবেলা বৃষ্টির কারণে পড়তে যাওয়া আর হয়ে ওঠে না দুই সখীর স্কুল থেকে ফেরার পর।অগত্যা দুজনে শুয়ে শুয়ে নিজেদের মনের কথা একে অপরকে শেয়ার করেছিলো। অস্মিতা তার মনের কথা অর্থাৎ তার ভালোবাসার কথা শেয়ার করতেই সুচন্দাও সেদিন অকপটভাবে  নিজের দুখের কাহিনী স্বীকার করেছিল।
 ওরা যখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী তখন অস্মিতার প্রেমিক দোদুল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দ্বিতীয় বর্ষ।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান।মধ্যবিত্ত পরিবার।দোদুলের বাবা,মা অস্মিতাকে তাদের ছেলের বউ হিসাবে মেনেই নিয়েছেন।তবে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত তারা ছেলের বিয়ে তো দেবেনই না উপরন্তু দেখা সাক্ষাৎ করা,ঘুরে বেড়ানো এসব তারা মোটেই পছন্দ করেন না।কিন্তু দোদুল যখন বাড়িতে আসে বাড়িতে অস্মিতাকে তারা অ্যালাউ করেন এবং সেটা রোজ হলেও তারা আপত্তি করেন না।শুধুমাত্র বাইরে ঘুরে বেড়ানোই তাদের আপত্তি।
  অনেক ছেলেমেয়েই আছে যারা বাবা মায়ের চোখের আড়ালে তাদের আপত্তিতে অনেক কাজই করে থাকে।কিন্তু অস্মিতা বা দোদুল কেউই সে ধরনের নয়।দুই পরিবার তাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছেন তাতেই তারা ভীষণ খুশি।তাই তাদের দুজনেরই এই সামান্য আপত্তিটা মেনে নিতে বিন্দুমাত্র ভাবতে হয়নি।
 সুচন্দার সাথে দোদুলের কথা শেয়ার করার পর দোদুল বাড়ি ফেরার পর সুচন্দাকে একদিন নিয়ে গিয়ে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।ভীষণ মিশুকে এবং খোলামেলা মনের মানুষ দোদুল।সুচন্দার সাথে তার খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে।প্রথম দিনেই দোদুল আচমকা তাকে বলে বসে,
--- সম্পর্কে ভবিষ্যতে তুমি আমার শ্যালিকা হবে কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা 
 দোদুলের কথা শুনে দুই সখী তার মুখের দিকে তাকিয়ে একইসাথে বলে ওঠে,
--- দাবিটা কি ?
--- দাবি একটা আছে বৈকি!
 দোদুলের কথা শেষ হওয়া মাত্র সুচন্দা অস্মিতার দিকে ফিরে বলে,
--- দেখ অস্মি,আমি কিন্তু কোন দাবিটাবি মেটাতে পারবো না 
--- আরে দাঁড়া কি বলতে চায় আমি একটু পরিস্কার করে বুঝে নিই
 দুই বন্ধুর কথাবার্তায় দোদুল খুব মজা পাচ্ছিলো।দোদুল খুব গম্ভীর হয়ে অস্মিতার দিকে ফিরে বলে,
--- এই ব্যাপারে তুমি কোন কথা বলবে না।এটা সম্পূর্ণ আমার আর সুচন্দার ব্যাপার
 আরও অবাক হওয়ার পালা দুই সখীর। অস্মিতা একটু জোরেই বলে ওঠে,
--- একটু ঝেড়ে কাশো তো ;কি বলতে চাইছো পরিস্কার করে বলো।
 দোদুল বেশ মজা পাচ্ছে।একদিকে সুচন্দা কিছুটা ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে চাইছে আর অন্যদিকে অস্মিতা একটু একটু করে রেগে যাচ্ছে।
-- আরে ঝেড়ে কাশির কি আছে?আমার সুচন্দার কাছে কিছু চাওয়ার আছে।ও যদি আমাকে সেটা দেয় আমার খুব ভালো লাগবে 
অস্মিতা একথাটা শুনে প্রথমে একটু রেগে গেলেও হঠাৎ দোদুলের মুখের দিকে চোখ পড়াতে দেখতে পায় মুখে একটা দুষ্টু হাসি লেগে আছে।আর তাতেই ও বুঝতে পারে দোদুল ইচ্ছাকৃত ওকে রাগানোর জন্যই এইসব কথা বলে চলেছে।দোদুলের মাথায় অন্য কোন ভাবনা রয়েছে।তাই সে এ ব্যাপারটাই খুব একটা পাত্তা না দিয়ে বললো,
--- তুমি আমার বন্ধুর কাছে কি চাইবে সেটা তোমার ব্যাপার।সবকিছু শুনেমিলে আমার বন্ধু তোমায় সেটা দেবে কিনা সেটা তার ব্যাপার;এখানে আমি থার্ড পার্সন। এখান থেকে আমার চলে যাওয়ায় ভালো অস্মিতা উঠে দাঁড়ায় সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য।বন্ধুর সাথে সুচন্দাও দাঁড়িয়ে পড়ে।এমনিতেই দোদুলের কথাবার্তায় সুচন্দা বেশ অবাক হয়ে যাচ্ছিল তারউপর অস্মিতা এ ঘর ছেড়ে চলে যাবে বলাতে সে খুবই ভয় পেয়ে যায়।অপরিচিত একটা মানুষ প্রথম দিনের পরিচয়ে কি যে চাইতে পারে তার কাছে এটাই বোধগম্য হচ্ছে না।
   অস্মিতার সাথে চার বছরের সম্পর্ক দোদুলের।দুই বাড়ি থেকে সম্পর্ক মেনে নেওয়ায় পড়াশুনা শেষে চাকরি পেলেই দোদুল আর অস্মিতার বিয়ে হবে ঠিক হয়েই রয়েছে।অবশ্য অস্মিতার ইচ্ছা সেও তার পড়াশুনা শেষ করে চাকরি করবে।নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে সে কিছুতেই বিয়ের পিড়িতে বসবে না।একথা সে তার বাবা,মাকে ছাড়া দোদুলকেও বলে দিয়েছে। দোদুলেরও ইচ্ছা অস্মিতা নিজের পায়ে দাঁড়ায়।দোদুল কিছুতেই নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার পক্ষপাতী নয়।সে তার এই মনোভাবের কথা বারবার নানান প্রসঙ্গে তার অস্মিকে জানিয়ে দিয়েছে।এই সব কথা অস্মিতা তার বান্ধবী সুচন্দার সাথে কখনও না কখনও শেয়ার করেছে। সুচন্দাও দোদুলের সম্পর্কে অনেককিছু জানার পর  মনেমনে তার সম্পর্কে একটা অন্যরকম উচ্চ ধারণা গড়ে তুলেছিল।কিন্তু আজকের পরিস্থিতি তার সেসব ধারণার উপর একেবারে জল ঢেলে দিলো।
 অস্মিতাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে দোদুল তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
-- আরে তুমি কোথায় যাচ্ছ?তুমি চলে গেলে তো কোন সাক্ষী থাকবে না আমার কথার।এরপর যদি তোমার বন্ধু অস্বীকার করে?
--- এই তুমি এত ভনিতা করছো কেন বলো তো? যা বলবে তাড়াতাড়ি বলে ফেলো।
 অস্মিতার কথার মাঝখানেই সুচন্দা বলে ওঠে,
--- আমারও অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে চল আমরা বাড়ি যাই।
--- কিন্তু আমি তোমার কাছে কি চাই সেটা না শুনেই চলে যাবে?
 কথাটা বলেই দোদুল হো হো করে হাসতে থাকে --।

ক্রমশঃ
 

No comments:

Post a Comment