ঝরাপাতা (চৌদ্দ পর্ব)
এবার দোদুল উঠে দাঁড়িয়ে তার চেয়ারটা নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওদের কাছাকাছি বসে।সুচন্দার দিকে তাকিয়ে বলে,
--- আমার দুবছরের ছোট একটা বোন ছিল।তার নাম ছিল সুনন্দা।তাই প্রথম যখন অস্মিতার মুখে তোমার নামটা শুনেছিলাম আমার বুকটার ভিতর ধড়াস করে উঠেছিল।বোনের মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।সেদিনই আমি ঠিক করেছিলাম তোমার সাথে যেদিন আমার দেখা হবে আমার বোনের জায়গাটা তোমায় দেবো ; তুমি আমার হারিয়ে যাওয়া বোনের শুন্য জায়গাটা ভরিয়ে দেবে?
এতক্ষণ ঠাট্টাবাজ যে দোদুলকে ওরা দেখছিল হঠাৎ করে দোদুলের গলার স্বরে এই পরিবর্তনে দুজনেই অবাক হয়ে যায়।দুজনেই খেয়াল করে দোদুল তার চোখের জল আড়াল করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।সুচন্দা উঠে দাঁড়িয়ে দোদুলের আরও কাছে এগিয়ে যায় ,
--- জন্মের থেকে আমারও দাদার জায়গাটা শুন্য পরেই আছে।আমাদের দুজনের জীবনের এই শূন্যস্থান আমরা দুজনেই পূরণ করে নিই ; কি বলো দাদা?
--- ঠিক বলেছিস!আমি কিন্তু তোকে তুই করেই কথা বলবো।
--- সেতো বলতেই হবে।পৃথিবীর কোথাও শুনেছ ভাইবোনেরা তুমি করে কথা বলে?
অস্মিতা চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল।নিজেও কিছুটা আবেগপ্রবন হয়ে পড়েছিল।কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একটু কেশে গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,
-- কিন্তু আমার ক্ষেত্রে একটু সমস্যা দেখা দিলো ---
সুচন্দা ও দোদুল দুজনেই একসাথে বলে উঠলো
-- এখানে আবার কি সমস্যা দেখা দিলো?
-- আমি ভাবছি আমার বিয়ের পর সুচন্দা আমাকে নাম ধরে ডাকবে নাকি বৌদি বলে ডাকবে?
তিনজনেই হো হো করে হাসতে লাগলো।
সুচন্দার জীবনে অনেককিছু হারানোর পরে অস্মিতা ও দোদুলের মত মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে নিজের জীবনের অনেক কষ্টই সে ভুলেছিল।সময় নামক ওষুধটা তো ছিলই।এরপর থেকে দোদুল যতবার বাড়িতে এসেছে সুচন্দার সাথে দেখা করেই গেছে।কখনো সুচন্দার দিদির বাড়িতে আবার কখনো বা অস্মিতাদের বাড়িতে।
গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার আগেই সুচন্দার জন্য একটা সম্মন্ধ আসে ছেলে সরকারী চাকুরীজীবী।দিদি,ভগ্নিপতি প্রাথমিক কথাবার্তার পর মাকে নিয়ে গিয়ে ছেলে এবং তাদের বাড়ির সবকিছু দেখিয়ে আনে।সুচন্দার মায়েরও খুব পছন্দ হয়।কিন্তু সুচন্দা নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে বসতে চায় না।এবারেও সে সকলকে বুঝাতে ব্যর্থ হল।হেরে গেলো সে বাড়ির সকলের কাছে।তার অনুনয়-বিনয়,কান্নাকাটি কোনকিছুই ধোপে টিকলো না।তার ভাঙ্গা মনটাকে যখন একটু একটু করে নিজের মত করে তৈরি করে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়ির থেকে বিয়ে ঠিক করে আবার সুচন্দার মনটাকে ভেঙ্গে তছনচ করে দিলো।
সৃষ্টিকর্তা সুচন্দার জীবনটাকে নিয়ে বারবার কেন যে এমন নিঠুর খেলা খেলছেন তা তিনি ছাড়া বোধকরি আর কেউই জানেন না।মাঝে মাঝে সুচন্দার মনেহয় তার এই ব্যর্থ জীবনটাকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানেই হয়না।নিজেকে শেষ করে দিতে মন চায়।কিন্তু পারে না।সকলের অলক্ষ্যে রাতের আঁধারে চোখের জল ঝরিয়ে শান্ত হতে চেষ্টা করে।সুমিতের কথা মনে পড়ে।কলকাতা গেলেই অন্যান্য বন্ধুদের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করে বন্ধু বিশাখার খোঁজ নিতে।কিন্তু কেউই তার খোঁজ জানে না।আসলে স্কুল জীবনের বন্ধুরা মাধ্যমিকের পরেই একটু একটু করে হারিয়ে যেতে থাকে অধিকাংশ মানুষের জীবনে।নূতন নূতন বন্ধু আজীবন ধরে আসে আর যায়।কিন্তু সেই সুন্দর,পবিত্র মন একমাত্র থাকে স্কুল জীবনেই।এই বয়সের বন্ধুরা হারিয়ে গেলেও তাদের কথা কখনোই ভোলা যায় না।আর বিশাখা এখানে সুমিতের বোন বিশাখার খোঁজ পাওয়া গেলেই পাওয়া যেত সুমিতকে নিজ জীবনে।
সুচন্দা তার জীবনের এই টানাপোড়েনের প্রতিবাদ করলেও কোথাও যেন তার প্রতিবাদের একটা ফাঁক থেকে যায় প্রতিবারই।অসীম এক অভিমানে নিজের মধ্যেই সে সেই পরিস্থিতিতে গুটিয়ে যেতে থাকে।প্রতিবাদ,রাগ,কান্না সবই থাকে কিন্তু সেভাবে জোরালো গলায় নিজের চাহিদাগুলো না পাওয়ায় চরম প্রতিবাদ না করেই সবকিছু মেনে নেয় বা নিতে বাধ্য হয়।এখানে কাজ করে তার জীবনের চরম অভিমান। এও এক ধরনের আত্মহত্যার নামান্তর।
হবু শ্বশুরবাড়িতে প্রচুর আত্মীয়স্বজন।সকলেই বিয়ের আগে সুচন্দাকে দেখতে চায়।কিন্তু বিয়ের আগে বারবার এত লোকের সমাগম ভাগ্নে সঞ্জয়ের শ্বশুরবাড়িতে ঠিক মেনে নিতে পারলেন না সঞ্জয়ের মামা গোবিন্দবাবু।ভগ্নিপতির মৃত্যুর পর এই মামাই তার বোনের সংসার দেখভালের দায়িত্ব সামলেছেন এবং আজও সামলে যাচ্ছেন।সঞ্জয়েরা চার ভাই।সঞ্জয়ই বড়।বাকি সকলেই এখনো পড়াশুনা করছে।
গোবিন্দবাবু সুচন্দার ভগ্নিপতিকে জানান তারা সুচন্দাকে একদিন তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান।কিন্তু ভগ্নিপতি আপত্তি জানান তার শ্যালিকার বিয়ের আগে উঠবি শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার।গোবিন্দবাবু তখন বলেন,
--- আমাদের আত্মীয়স্বজন একটু বেশি।রোজ রোজ উঠবি আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়াটা আমার ঠিক ভালো লাগছে না।তাই যদি আপনারা অনুমতি দেন তবে সুচন্দাকে একবেলার জন্য আমরা নিয়ে আসতে চাই।আপনারা চাইলে সঞ্জয়ও আপনাদের বাড়িতে যাবে।কিন্তু আপনারা মেয়েটিকে দয়া করে একবার পাঠালে আমাদের একটু সুবিধা হত।আমি তাহলে ওই একটা দিনে আমার সব আত্মীয়স্বজনকে আমার বাড়িতে ডেকে নিতাম।
সুচন্দা যেমন বিয়ের আগে তার মামাশ্বশুর বাড়িতে যায় ঠিক তেমনই সঞ্জয়কেউ একবার ডেকে নেওয়া হয় সুচন্দার দিদির বাড়িতে।সঞ্জয়ের সাথে সুচন্দার মামুলী কথাবার্তা হয়।কিন্তু বুদ্ধিমতী সুচন্দা বুঝতে পারে সঞ্জয় খুব সরল প্রকৃতির মানুষ।অতি সাধারণ পরিবার তাদের।তারা চার ভাই এবং তাদের মা সকলেই খুব সহজ সরল প্রকৃতির।সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারেন।অর্থ,বৈভব তাদের নেই ঠিকই কিন্তু তাদের প্রত্যেকের একটা সুন্দর মন আছে।একদিনের কিছুটা সময় তাদের সাথে কাটিয়ে তার অভিশপ্ত জীবনটার একটা ভালো দিক সে দেখতে পায়।বিয়েতে মত ছিলো না তার প্রথম থেকেই। অনিচ্ছা সত্বেও সে এই বিয়েতে মত দিতে বাধ্য হয়েছিল বাড়ির লোক আর নিজের প্রতি নিজের অভিমানবশত।কিন্তু এই বাড়িতে এসে উঠবি শ্বশুরবাড়ির সকলের সাথে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে সে বুঝে গেছিল অর্থ তাদের কম আছে ঠিকই কিন্তু তাদের সকলের মনে আছে উজাড় করা ভালোবাসা।যে ভালোবাসায় জড়িয়ে থেকে নিজের জীবনের না পাওয়াগুলিকে পুর্ণ করতে না পারলেও অন্তত ভুলে থাকতে পারবে।
সব থেকে তার ভালো লেগেছিলো সঞ্জয়ের একটা কথা।সঞ্জয় বহুক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছিল সুচন্দাকে একাকী কিছুক্ষণ পেতে।কিন্তু এত লোকের মাঝে তা ছিল একেবারেই অসম্ভব।কিন্তু মামা ভাগ্নের মনের কথা বুঝতে পেরে সেই সুযোগটা তাকে করে দিয়েছিলেন।তিনি সকলের মধ্যে এসে বলেছিলেন,
--- বাড়ির সকলের সাথে আমি একটা জরুরী কথা বলতে চাই।তোমরা একটু পাশের ঘরে এসো।
সুচন্দার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,
--- মা,মিনিট পাঁচেক তুমি একটু একা থাকো।
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment