Tuesday, February 1, 2022

পূর্ব বাংলার সদের বটতলার পুজো

পূর্ব বাংলার সদের বটতলার পুজো।
 বহু বহু বছর আগের কথা।তখনো দেশভাগ হয়নি।আমি যেমন আমার ছেলেবেলা থেকে এ গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়েছি ঠিক সেইরূপ বেশ কয়েকটি প্রজন্ম তাদের ছেলেবেলা থেকেই এ গল্প শুনে এসেছে।
 জমিদার পরিবারের কোন এক সদস্য-ধরা যাক তার নাম যজ্ঞেশ্বর রায় চৌধুরী।একদিন দুপুরের দিকে গ্রামের মাটির পথ ধরে বাড়ি ফিরছিলেন।রাস্তাটি ছিল খুবই ছোট এবং ধুলোবালিতে ভর্তি।যজ্ঞেশ্বরবাবু দেখতে পান একজন সধবা বৃদ্ধা অতীব মলিন লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে রাস্তার মাঝখানে শুয়ে আছেন।যজ্ঞেশ্বরবাবু ভদ্রমহিলার কাছে এসে বলেন,
--- মা যাতায়াতের পথের মাঝখানে এভাবে শুয়ে থাকলে লোক চলাচল তো করতে পারবে না।
 বৃদ্ধা অতি ক্ষীণস্বরে বললেন,
--- কি করবো বাবা!ছেলেমেয়েরা যে আমায় দেখে না।ঠিকভাবে দুটো খেতেও পারিনা।স্বামীটা গাজা, ভাং খেয়ে ঘুরে বেড়ায়।
 যজ্ঞেশ্বরবাবু নীচু হয়ে বৃদ্ধাকে বলেন,
--- মা তুমি আমাকে জানাও কোথায় থাকে তোমার ছেলেমেয়েরা আমি তাদেরকে তোমার কথা বলবো।আর নিতান্ত যদি তারা তোমায় না দেখে আমি আশ্রয় দেবো তোমায়।ঈশ্বরের আশীর্বাদে সে ক্ষমতাটুকু আমার আছে।
--- আচ্ছা পরে তোকে আমি সব জানাবো।
 সারা রাস্তা জমিদার যজ্ঞেশ্বরবাবু ভাবতে ভাবতে আসেন নিজের মাকে এভাবে বাড়িতে আশ্রয় না দিয়ে ছেলেরা খুব অন্যায় করেছে।যেভাবেই হোক কাল পুনরায় বৃদ্ধার কাছে এসে তার ছেলেদের আবাসস্থল জেনে তাকে সেখানে পৌঁছে দিতে হবে।
রাতে খেয়েদেয়ে শোয়ার পর মধ্য রাতে জমিদার স্বপ্ন দেখেন স্বয়ং মাকালি তাকে বলছেন যেখানে তিনি রাস্তার উপরে শুয়ে ছিলেন তার পাশেই যে ফাঁকা জমিটা আছে সেখানে একটি মন্দির স্থাপন করে তার থাকার ব্যবস্থা করতে।এবং কিভাবে তার পুজো করা হবে তাও তিনি বলে দেন।
 পরদিন থেকেই শুরু হয় মন্দির স্থাপনের কাজ।মন্দির বলতে সেই নীচু জমির একপ্রান্তে একটা পুকুর কেটে সেই মাটি দিয়ে উচুঁ করে একটি ভীত স্থাপন করা হয়।বাঁশের তৈরি বেড়া দিয়ে চারিদিক ঢাকা হয়।কাছেপিঠেই তৈরি হতে থাকে মূর্তি গড়ার কাজ।
 গ্রামটিতে হিন্দু,মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের বাস।সকলে মিলেমিশেই গ্রামের যেকোন পার্বণে অংশগ্রহণ করে থাকে।মূর্তি গড়ার কাজ যখন প্রায় শেষের পথে ঠিক তখনই পাশের পাড়া থেকে একই পরিবারের বেশ কয়েকজন কালি মায়ের মূর্তি দেখতে আসেন।তারা মায়ের মূর্তি দেখে খুব হাসিঠাট্টা করতে করতে বলেন যে হিন্দুদের ঠাকুরের মুখে পক্সসের মত এসব কি উঠেছে?তখনো মূর্তি গড়া ও মন্দিরের কাজ সম্পন্ন হয়নি।কাজ চলছে।ওইদিন রাতে জমিদার যে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন সেখানে মায়ের নির্দেশ ছিল একমাসব্যাপি রায় চৌধুরী পরিবার থেকে একটি কুলোতে চাল নিয়ে ওই কুলো নিয়ে গ্রামের প্রতিটা পরিবারের থেকে যার যেমন ক্ষমতা সে ঠিক সেইরূপ চাল দেবে মায়ের কুলোয়।তারপর সমস্ত চাল একত্রিত করে পুজোর সময় খিচুড়ি ভোগ রান্না হবে।কিন্তু ঘটনার মাঝপথে ঘটলো অন্যরকম কিছু।
 মুসলিম পরিবারটি ওই কথা বলে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখে পরিবারের বাকি যে সদস্যরা বাড়িতে ছিল তাদের সকলের গায়েই পক্স উঠেছে।দেখতে দেখতে পরিবারের সকলেই মারত্মক অসুস্থ্য হয়ে পড়ে।কান্নাকাটি হুলুস্থুল পরিস্থিতি।
 তখন তারা পুনরায় ওই মূর্তির কাছে আসে এবং হাত জোড় করে তাদের কথার জন্য ক্ষমা চাইতে থাকে।রাতে পরিবারের প্রধান সদস্য স্বপ্নাদেশ পায় এই পুজোতে একমাস ব্যাপী যে ভিক্ষা চালু হয়েছে তার ঠিক শেষ দিনের মাথায় ওই মুসলিম পরিবার থেকে কুলোতে ক্ষমতা অনুযায়ী চাল ও সবজি দেবে এবং ওই চাল ও সবজি দিয়ে মায়ের ভোগ হবে।
 আজও সেই রীতি চলে আসছে।জৈষ্ঠ্য মাসে কোন এক শনিবার এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়।আজ রায় চৌধুরী পরিবারের কেউ আর ওদেশে থাকেন না ঠিকই কিন্তু তারা দায়িত্ব অর্পণ করে এসেছেন অন্য একটি পরিবারের উপর।গত বছর এই করোনা পরিস্থিতিতেও সামান্য আয়োজন হলেও নিয়মের কোন পরিবর্তন হয়নি।
 গ্রামটি বাংলাদেশের খুলনা জেলার ফকিরহাট থানার( বর্তমানে নামগুলোর পরিবর্তন হলেও হতে পারে) পিলজঙ্গ গ্রাম।
 যুক্তিতর্ক,বিশ্বাস-অবিশ্বাস যার যার মনের ব্যাপার।ওই জমিদার পরিবারের সন্তান আমি।মন্দিরের সংস্কার হয়েছে ঠিকই কিন্তু রীতির কোন পরিবর্তন হয়নি।

No comments:

Post a Comment