Saturday, August 7, 2021

পক্ষপাতিত্ব ৪

পর্ব ৪

--- আমি  একজন  ব্যবসায়ী  বাবা  | অনেক  লোক  আমার  দোকানে  আসে  | আর  তাছাড়া  আমার  ও  ভায়ের  কিছু  কমন বন্ধু  আছে  | এদের  সকলের  কাছ  থেকেই  একটু  একটু  করে  জেনেছি  | মনামীকে  দাদুই    ঠিক  চিনেছেন  | সে  চায়  এ  বাড়ির  টাকা  আর  সম্পত্তি  | আমাকে  বিয়ে  করতে  না  পেরে  এবার  বয়সে  ছোট  অরুপকে  ধরেছে  | আর  আমার  সাথে  সে  কি  করেছে  তা  তোমাদের  ছেলে  হয়ে  আমি  বলতে  পারবোনা  | তবে  তোমাদের  একটা  কথা  আমি  বলে  রাখি  সুমির  যদি  এ  বাড়িতে  অসম্মান  হয়  আমি  কিন্তু  এ  বাড়ি  ত্যাগ  করবো  | তখন  কিন্তু  তোমরা  আমাকে  দোষ  দিতে  পারবেনা  |

--- বৌয়ের  কাছে  আমাদের  নিন্দা  শুনে  সেটা  বিশ্বাস  করে  তার  হয়ে  আমাদের  সাথে  ঝামেলা  করতে  তোর  বিবেকে  বাঁধছে  না  ?

---  বৌয়ের  কাছে  শুনে  বিশ্বাস  করেছিলাম না।কিন্তু  আজ  নিজের  কানে  শুনেছি  |না  আমার  বিবেকে   বাঁধছে  না  আর  তার  কারণ  হচ্ছে  তাকে  সুখী  করা , তার  সম্মান  রক্ষা  করা  আমি  আমার  কর্তব্য  বলে  মনে  করি  | সেতো সংসারের  কাজ  করে, শুয়ে  বসে  থাকেনা  | তবে  কেন  তাকে  তোমরা  মেনে  নিতে  পারছোনা ? তোমাদের  প্রতি  সম্পূর্ণ  শ্রদ্ধা  রেখেই  বলছি  এরূপ  ঘটনার  পুনরাবৃত্তি  হলে  আমি  বাড়ি  ছাড়তে  বাধ্য  হবো  |

    কথাগুলো  বলে  অনুপ  আর  নিচে  দাঁড়ায়না | উপরে  গিয়ে  দেখে  সুমনা  তখনও কেঁদে  চলেছে  | অনুপ  তাকে  কাছে  টেনে  নিয়ে  মাথায়  হাত  বুলিয়ে  শান্তনা  দিয়ে  বলে  ,
--- তুমি  এভাবে  কাঁদলে  আমার  খুব  কষ্ট  হয়  | এতদিন  তুমি  আমাকে  বলেছো  ঠিকই  কিন্তু  সত্যি  বলতে  কি  আমি  ভেবেছিলাম  প্রত্যেকটা  পরিবারের  শ্বাশুড়ি  বৌয়ের  ঝামেলার  মতই এটাও  এক  সময়  ঠিক  হয়ে  যাবে  | মা  আমার  সাথে  যেহেতু  ভালো  ব্যবহার  ছোটবেলার  থেকে  করেননি  সেহেতু  আমি  ভাবতাম  আমার  বৌ  হিসাবে  তোমাকেও  মা  মেনে  নিতে  পারছেননা  | আমার  মত  তোমারও এটা গা  সওয়া হয়ে  যাবে  | কিন্তু  বিশ্বাস  করো  বাবাও  যে  তোমাকে  এভাবে  বলতে  পারেন  আমি  তা  স্বপ্নেও  ভাবিনি  | সেরকম  হলে আমি  এ  বাড়ি  ছেড়ে  তোমায়  নিয়ে  দূরে  কোথাও  ঘরভাড়া  নিয়ে  থাকবো  | 

               সেদিন  সারাটা  রাত সুমনা  অনুপের  বুকের  উপর  শুয়ে  কেঁদেছে  | স্বামী  স্ত্রীর  কেউই  আর  ঘুমায়নি  | আবার  ভোর  হতে  না  হতেই  অভ্যাসমত  সুমনা  বিছানা  ছেড়ে  উঠেই  রান্নাঘরে  ঢুকে  যায়  | শ্বশুর  শ্বাশুড়ির  দুজনেরই  মুখ  হাড়ি  | তারা  সুমনার  সাথে  কেউ  কোন  কথায়  বলছেনা | সুমনা  বাড়ির  সকলের  সকালের  টিফিন  রেডি  করে  টেবিলে  রাখার  সাথে  সাথেই  শ্বাশুড়ি  ডাইনিং  এ  ঢুকে  শ্বশুরের  টিফিনটা  তার  ঘরে  দিয়ে  আসেন  | সঞ্জয়বাবু  এখন  খুব  একটা  তার  ঘর  থেকে  বেরোননা | সকাল  ও  রাতের  খাবারটা  তিনি  ঘরে  বসেই  খান  | স্ত্রী  বিয়োগের  পর  থেকেই  এটা চলে  আসছে  | শ্বশুরকে  টিফিন  দেওয়া  হয়ে  গেলে  তিনি  তার  স্বামীকে  নিয়ে  খেতে  বসে  যান  | সুমনা,অনুপের  টিফিন  গুছিয়ে  রাখা  বা  খাওয়ার  কথা  কিছুই  বলেননা  | সুমনা  মনেমনে  হাসে  | তার  হাতে  তৈরী  করা  খাবার  খেতে  পারছে  সব  তার  সাথে  কথা  বন্ধ  রেখেছে  |

   ভাইপোর  বিয়েতে  অদিতি  আসতে পারেনি  | কারণ তার  স্বামীর  একটা  বাইক  একসিডেন্ট  হয়ে  তিনমাস  যাবৎ  কোমায় ছিলেন  | বিয়ের  আগেই  তার  প্রিয়  ভাইপোর  বিয়ের  মেয়ে  দেখে  গেছিলো  আর  তারপর  বাড়িতে  ফিরেই  এই  বিপত্তি  |তাই  বিয়ের  মাসতিনেক  পরে  সে  তার  মেয়েকে  নিয়ে  বাপের  বাড়িতে  এসে  দিন  পাঁচেক  থেকে  বৌদির  যে  তার  ছেলের  বৌ  পছন্দ  হয়নি  এটা সে  ভালোভাবেই  বুঝতে  পারে  | এই  পাঁচদিন  প্রতিনিয়ত  সে  বৌয়ের  নিন্দায়  শুনে  গেছে  | কিন্তু  স্বচক্ষে  সে  দেখেছে  তার  ভাইপোর  বৌটি  সংসারের  যাবতীয়  কাজ  করেও  কারও মনরঞ্জন  করতে  পারেনা  | সুমনাকে  খুব  ভালো  লাগে  অদিতির  | সে  অনুপকে  জানিয়ে  যায়  এই  বাড়িতে  থেকেই  তোরা  আলাদা  খাওয়াদাওয়া  কর  | এতো  বড়  সংসারের  জোয়াল  ওই  টুকুন  মেয়ে  টানতে  লাগলে  অসুস্থ্য  হয়ে  পড়বে | আর  তাছাড়া  আমি  নিজেই  তো  দেখলাম  দাদা  বৌদি  কেউই  সুমির  সাথে  ভালো  ব্যবহার  করেননা  | আমার  যেটুকু  বলার  আমি  বলেছি  | কিন্তু  দুজনের  কাউকেই  বুঝাতে পারিনি  | সুমিকে  নিয়ে  সুখী  থাকতে  গেলে  তোকে  আলাদা  হতেই  হবে  | আমি  তোর  সাথে  আছি  | 
   কিন্তু বাড়ি। ছাড়বো বললেই তো আর ছাড়া যায় না।ব্যবসাটা অনুপের বাড়িতেই।আবার ঠাকুমা মারা যাওয়ার সময় বারবার তাকে অস্ফুৎস্বরে বলেছিলেন,"ভাই তুই কিন্তু বাড়ি ছেড়ে কোনদিনও চলে যাবি না।আমি জানি বৌমা তোদের দুই ভাইয়ের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করে।অরূপকে তোর মা সারাজীবন একটু বেশীই ভালোবাসে।আগে তোর বাবা অবশ্য তোকে আর অরূপকে আলাদা চোখে দেখেনি।এখন মাঝেমধ্যে দেখি তোর বিরুদ্ধেও তার অভিযোগ আছে।এটা যে তোর মা বলে বলে করিয়েছে সেটাও বুঝতে পারি।মানুষের জন্মক্ষণকে তো আর অস্বীকার করা যায় না।হয়তো তোর কপালে বাবা,মায়ের স্নেহ,ভালোবাসা পাওয়া নেই।তাই যতই সমস্যার সৃষ্টি হোকনা কেন এ বাড়ি তুই ছাড়বি না।"সেদিন ঠাকুমাকে কথা দিয়েছিল অনুপ যে সে কোনদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে না।কিন্তু সুমনার সাথে তার বাবা,মায়ের দিনকে দিন এই তিক্ততা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
  অনুপ এখন বাড়িতে থাকলেই সে তার কান খাড়া করে থাকে সুমনা নিচুতে নামলেই।তার মনে সর্বদা এখন একটা আতংক!পিসি রুচিরাকে সব জানায় অনুপ।রুচিরা তাকে বলে,"বাড়ি ছেড়ে কেন যাবি?ওই বাড়ির মধ্যেই তুই হাঁড়ি আলাদা করে নে।যদি প্রয়োজন হয় আমি আর তোর পিসেমশাই গিয়ে কথা বলবো।আমার তো এখন ঝাড়া হাত,পা।তোর ভাই দিল্লিতে ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছে।আমরা বুড়ো,বুড়ি দিব্যি আছি এখন।তুই বললেই আমরা গিয়ে কথা বলবো ওদের সাথে।"
 কিন্তু অনুপ তাদের ডেকে কোন ফয়সালা করতে চায় না।সে ঝামেলা ছাড়াই একদিন তার মা,বাবাকে ডেকে বাড়ির ভিতরেই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা জানায়।অর্ণববাবু রাজি থাকলেও নন্দিনী কিছুতেই রাজি হতে চায় না।কারণ সে ভালোভাবেই জানে তারা আলাদা হয়ে গেলে রান্নাঘরের ঘানি আবার নন্দিনীকেই টানতে হবে।কিন্তু অনুপ পরিস্কার করে জানিয়ে দেয় তার এই নিত্য অশান্তি আর ভালো লাগছে না।তাই সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই সে করবে।
  এদিকে পাড়ার মেয়ে মনামীর বাড়িতে আসাটা প্রায় নিয়মিত হতে লাগলো।স্বামী, স্ত্রী উভয়েই বুঝলেই অনুপের কথাগুলি একটিও মিথ্যে নয়। মনামী এ বাড়ির বউই হতে চায়।সে প্রথমে অনুপকে টার্গেট করেছিলো তাকে বশে আনতে না পেরে অরূপকে এবারে বেশ ভালোভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে।মেয়েটি যে খুব একটা ভালো নয় এটা তাদেরও কানে এসেছে।কিন্তু মনামী সম্পর্কে তারা এতটাই প্রসংশা করে ফেলেছেন পরিবার এবং বাইরের লোকের কাছে এখন পিছিয়ে আসা মানে অনুপ সুমনার কাছে ছোট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ কিনা তাদের ইগোতে আঘাত লাগা।তাই তারা এ বিয়েটাকে মেনে নেন অরূপের জীবনকে বাজি রেখেই।
  অত্যন্ত গরীব ঘরের মেয়ে মনামী।সে যে শুধুমাত্র টাকা আর সম্পত্তির লোভেই এ বাড়ির বউ হতে চেয়েছে এ কথা সঞ্জয়বাবু বারবার তার ছেলে এবং বউকে বোঝানোর চেষ্টা করেও সফল হননি।কারণ এ ক্ষেত্রে নন্দিনী আর তার স্বামী ছিলেন জ্ঞান পাপীর মত।তারা জেনে বুঝেও শুধুমাত্র জেদের বসে অর্থাৎ কিনা অনুপ সুমনার কাছে ছোট হবেন না মনে করেই তারা বেশ ধুমধাম সহকারে তাদের বিয়ে দেন।এখন সঞ্জয়বাবু বৃদ্ধ ফলত তিনি অসহায়!তার কথার দাম এখন আর এ সংসারে নেই।কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষটির সবকিছু বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি।এক সময় এই সংসারে তার কথার অন্যথা কখনোই হয়নি।কিন্তু আজ আর তার কথার কোন দাম ছেলে,বউ আর দেয় না।তিনি তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন মানুষের বয়স হয়ে গেলে সে পুরনো আসবাবপত্রের মতই ঘরের এককোনে পড়ে থাকে।

ক্রমশঃ 


  

No comments:

Post a Comment