পর্ব ২
যতদিন নন্দিনী সংসারে একা বৌ ছিল ঠিক ততদিনই সংসার ছিল সুখের এবং নির্ঝঞ্ঝাট | কিন্তু মেজছেলের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই শ্বাশুড়ির সাথে তার মতের অমিল হতে শুরু করে | তবে একথা অস্বীকার করবার কারো ক্ষমতা হবেনা এ সংসারে নন্দিনী প্রকৃতভাবেই লক্ষ্মী রূপেই এসেছে | শুধু তার অতীতটা অর্ণব ছাড়া বাড়ির অন্য কেউ জানেনা | অর্ণব আরও কয়েকটি নুতন শোরুম খুলেছে , মেজোছেলে তিনবছরের মধ্যে অফিসার পদে উন্নীত হয়েছে অদিতির ভারত পেট্রোলিয়াম উচ্চপদে চাকুরীরত ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে এবং সে খুব সুখেই আছে | অদিতি গ্রাজুয়েশন শেষ করে বড়দার কথামত বিএড ট্রেনিংটা নিয়েছিল | ট্রেনিং শেষের মাস ছয়েকের মধ্যেই সে সরকারি স্কুলে একটি চাকরিও পেয়ে যায় | যেহেতু সবকিছুই নন্দিনী এই বাড়িতে ঢোকার মুহূর্ত থেকে হয়েছে তাই সকলের কাছে 'লক্ষ্মী বৌ লক্ষ্মী বৌ '- শুনতে শুনতে তার নিজের মধ্যেও কেমন একটা অহংকারবোধ কাজ করতে থাকে | ভাবখানা মাঝে মাঝে তার এমন প্রকাশ পায় ' যেন তোমরা ভালোভাবে খেয়েপরে বেঁচে আছো সে যেন আমারই দান |
নন্দিনী ও অর্নবের বিয়ের পর তারা একদিন রাতে সিনেমা দেখে যখন নিজেদেরই গাড়িতে উঠতে যাবে ঠিক তখনই দুটি ছেলে তাদের দিকে এগিয়ে আসে | তাদের মধ্যে একটি ছেলে নন্দিনীর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে সরাসরি মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ,
--- এখন বুঝতে পারছি বড়লোকের ছেলেকে পেয়ে আমার সাথে প্রেম প্রেম খেলাটা কেন বন্ধ করে দিলে | সুন্দরী তকমা তো তোমায় দেওয়া যায়না ; তাই ভেবেছিলে হয়তো আমার গলায় ঝুলে পড়বে | কিন্তু হঠাৎ করে বড় গাছে নাও বেঁধে ফেললে | কপাল মাইরি তোমার ! এই চেহারা নিয়ে বড়লোকের বাড়ির বৌ হয়ে গেলে |' অর্ণব প্রথমে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও পরে বেশ জোর দিয়েই বলে ,
--- বিয়ের আগে অনেকের সাথেই অনেকের সম্পর্ক গড়ে ওঠে | সব সম্পর্ক ছাদনাতলা পর্যন্ত পৌছায়না | তাই বলে জীবনটা তো থেমে থাকেনা |
--- আরে ব্যস এতো দেবতার মত স্বামী পেয়েছো | যাও সুখে ঘরকন্যা করো | আমি আর বিরক্ত করবোনা | তবে আমার সাথে ঘটে যাওয়া কিছুটা সময় এই ভদ্রলোকটিকে তো বলতেই হবে | দেখো উনি ফিরিয়ে দিলে কিন্তু আমি ঠাই দেবোনা এটা মনে রেখো |
এতক্ষণ নন্দিনী স্বামীর পিছনে ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল | এবার অর্নবের ইশারা পেয়ে গাড়িতে উঠে চুপ করে বসে থাকলো | রাস্তায় তাদের কোন কথায় আর হলনা | নন্দিনী এক অজানা আশঙ্কায় দুরুদুরু বুকে রাতে বিছানায় শুতে গেলো |
অর্ণব তাকে বললো ,
--- কিছু কথা ছিল তোমার সাথে |
নন্দিনীর বুকটা ধড়াস করে উঠলো | কোনরকমে উচ্চারণ করলো ,
--- হ্যাঁ বলো ---
--- আজকে যে ঘটনা ঘটেছে বাড়ির কেউ যেন না জানে | তোমার অতীতে কি ঘটেছিলো তা জানার কোন আগ্রহ আমার নেই | অতীত একদিন না একদিন ঠিক মুছে যায় | বর্তমান আর ভবিৎষত নিয়েই মানুষের জীবন | এ কটাদিনে এটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার কোন খামতি নেই |
নন্দিনী হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে | কাঁদতে কাঁদতেই বলে ,
--- খুব বড় একটা অপরাধ করেছি | আমায় তুমি তাড়িয়ে দিওনা |
--- কি এমন অপরাধ করেছো --
নন্দিনী পায়ের উপর আছড়ে পরে কাঁদতে থাকে | কাঁদতে কাঁদতেই বলে ,
--- সেদিন রাস্তায় যে ছেলেটি আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল ওকে আমি ভালবাসতাম | কিন্তু ও আমায় ভীষণভাবে ঠকিয়েছে | আমার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে ---- ওর সন্তানই আমার গ ---কথা শেষ করতে পারেনা , নন্দিনী ডুকরে কেঁদে ওঠে
অর্ণব আঁতকে ওঠে | বহুক্ষণ সে চুপচাপ বসে থাকলো | নন্দিনী তার পায়ের উপরেই পরে আছে | তারপর আস্তে আস্তে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে ,
--- পরিবারের মানসম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে একথা বাইরে জানাজানি হলে | তুমি যেমন আছো তেমনিই থাকো | শুধু আমাকে একটু সময় দাও এসবকিছু মানিয়ে নিতে | তারপর আস্তে আস্তে নন্দিনীকে পায়ের উপর থেকে তুলে ধীরপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় | আর নন্দিনী সেখানে বসেই সারাটা রাত কেঁদেই চলে | কিন্তু এই বিশাল লজ্জার কথাটা আজীবন ধরে ভারী পাথরের মত অর্ণবের বুকের উপর চেপে বসে থাকলেও কোনদিন সে এ সম্পর্কে নন্দিনীকে কিছুই বলেনি |
রান্নাঘরের দায়িত্ব শ্বাশুড়ি বৌ দুজন মিলেই পালন করে | কিন্তু যেদিন থেকে অভিকের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই নন্দিনী কারণে অকারণে শ্বাশুড়ির সঙ্গে একটু মেজাজি সুরেই কথা বলতে শুরু করে | প্রথম প্রথম অন্নদাদেবী বুঝতে না পারলেও সময় যত এগোতে থাকে অভিজ্ঞ অন্নদাদেবী ব্যাপারটা ধরে ফেলেন |নন্দিনীর প্রথম সন্তান অনুপের বয়স তখন মাত্র ছমাস |
অভিক বিয়ে করে বৌ নিয়ে বাড়িতে আসে | প্রথমে অন্নদাদেবী ও পরে নন্দিনী বৌ বরণ করে ঘরে তোলে | শ্বাশুড়ির সাথে হাতে হাত লাগিয়ে নন্দিনী সব কাজ করে ঠিকই কিন্তু মুখটা সে মাঝে মাঝে হাড়ি করেই রাখে | শ্বাশুড়ি একটু ফাঁকা পেয়ে নন্দিনীকে বললেন ,
--- আমি এখনো বেঁচে আছি বৌমা | তোমার এতো চিন্তার কোন কারণ আমি খুঁজে পাচ্ছিনা | হ্যাঁ অর্নবের রোজগার বেশি বলে তাকে সংসারে সিংহভাগটি দিতে হবে তা কিন্তু নয় | তোমার শ্বশুরমশাই ভালো টাকাই পেনশন পান | অভিকও যে মাস থেকে রোজগার করতে শুরু করেছে সেই মাস থেকেই আমার হাতে সংসার খরচের টাকা তুলে দেয় | আগামীমাস থেকে সে আরও বেশি দেবে আমার সাথে কথা হয়েছে | আর সংসার খরচ থাকে আমার কাছে | তোমার তো এসব নিয়ে ভাবার কোন কারণ নেই | আর আমি কোন অবস্থাতেই অর্নবের কাছে বাড়তি কোন টাকা চাইবোনা |
ধরা পরে গিয়ে নন্দিনী কিন্তু কিন্তু করে জবাব দিলো ,
--- আমি এসব কিছু ভাবিনি মা --- |
অভিজ্ঞ আনন্দাদেবী এ নিয়ে কথা না বাড়িয়ে শুধু ছেলে বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন |
নন্দিনীর বাপের বাড়ি থেকে তার বৌভাতের দিন সেরকম কোন তত্ত্বই আসেনি বলতে গেলে | কিন্তু তা নিয়ে ব্যানার্জী বাড়ির আত্মীয়স্বজনেরা বা পাড়াপ্রতিবেশী অন্নদাদেবীর আড়ালে আবডালে সমালোচনা করলেও তার সামনাসামনি কেউই মুখ খুলতে পারেনি কোনদিন | কিন্তু মেঝবৌয়ের বাপের বাড়ি থেকে বিশাল পরিমানের তত্ত্ব আসার সাথে সাথেই বড় বৌ আর মেঝবৌয়ের বাপেরবাড়ির মন মানসিকতা নিয়ে পাঁচ বছর পরে আলোচনা শুরু হয়ে যায় | বড়বৌ সেখানে কথার প্রতিবাদ করতে গেলে তার শ্বাশুড়ি এসে তাকে এসবের ভিতর জড়াতে নিষেধ করেন ও সেখান থেকে চলে যেতে বলেন | নন্দিনী সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর অন্নদাদেবী সকলের উদ্দেশ্যে বলেন ,
--- আমার দুই বৌমার বাপেরবাড়ির কারো কাছ থেকেই আমরা কোনকিছু দাবি করিনি | তারা তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী কিছু জিনিস পাঠিয়েছেন | আমার তো কোনকিছুর অভাব নেই | আমি চাইনা এসব নিয়ে আমার বৌদের মধ্যে কোনরকম তুলনা করা হোক | অদিতি যেমন আমার মেয়ে আমার বৌমারাও আমার মেয়ে | আর রুচিরাকেও আমরা নিজ সন্তানের মতই মানুষ করেছি | পরের মেয়ে বলে আমাদের বাড়িতে কোন কথা নেই | তোমরা এসব নিয়ে আলোচনা করে এই আনন্দানুষ্ঠানটাকে মাটি করে দিওনা |
নন্দিনীর ছেলে অনুপ প্রথম দিন থেকেই তার মেঝমার ভক্ত হয়ে ওঠে | অতটুকু ছেলে সে তার মায়ের কাছ থেকে অবজ্ঞা আর অবহেলা পেতে পেতে মেজমায়ের কাছ থেকে মাতৃস্নেহ পেয়ে তাকেই সে আঁকড়ে ধরেছিল | শুধুমাত্র রাতে কয়েকঘন্টার জন্য সে তার মায়ের কাছে যেত | তাও সে ঘুমিয়ে থাকতো তার মেজমায়ের কাছেই | রাতে শুতে যাওয়ার সময় নন্দিনী তার কাছে কোন কোন দিন চক্ষুলজ্জার খাতিরে হয়তো নিয়ে যেত | প্রথম থেকেই মেজ বউ রমার প্রতি এক তীব্র হিংসা থেকে আর তার ছেলে অনুপের তারপ্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা দেখে আস্তে আস্তে তার পেটের সন্তানের প্রতিই ভালোবাসা কমতে থাকে | সাথে থাকে ছেলেকে নিয়ে জ্যোতিষীর ভবিৎসৎবাণী | ইতিমধ্যে নন্দিনী আবার প্রেগন্যান্ট হয়ে পরে | ছেলেকে নিয়ে শুতে নন্দিনীর অনীহা দেখে অন্নদাদেবী অনুপকে নিজেই নিয়ে শুতে শুরু করলেন | আর অনুপের মেজোমা তো আছেই | তখন অনুপের বয়স তিন কি সাড়ে তিন হবে | হঠাৎ একদিন তার খুব ইচ্ছা হল মায়ের কাছে শোবে | ঠাকুমা ঘুমিয়ে গেলে রাতে এসে মায়ের দরজার কাছে ' মা আমি আজকে তোমার কাছে শোবো, দরজাটা একটু খোলো না -- ওমা শুনছো ?' কিন্তু নন্দিনী কিছুতেই তার ছেলেকে দরজা খুলে তার বুকের কাছে নিয়ে শুলোনা | অনুপের দুচোখ দিয়ে তখন টপটপ করে জল পড়ছে , চিৎকার করে সে মা মা করে কাঁদছে ---
পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো তার মেজোমা | অনুপকে বুকে চেপে মুখে চুমু খেয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো ,' আজ থেকে তুই আমার কাছেই শুবি | অতটুকু বুকে মায়ের দেওয়া এ আঘাত ভীষণভাবে চেপে বসলো | যার ফলশ্রুতিতে অনুপ কোনদিনও আর মায়ের কাছে আর ফ্রী হতে পারলোনা |
অনুপের জন্মের পর তার কুষ্ঠীবিচার করতে নন্দিনী এক জোতিষীর কাছে গেছিলো | জোতিষী অনুপের জম্মছক অনেকক্ষণ ধরে দেখেশুনে বলেছিলেন ,
--- ছেলে তোমার খুবই ভাল হবে মা | জীবনে রোজগারপাতি তেমন না হলেও জীবন ঠিকই কেটে যাবে | উত্তরাধিকার সূত্রে তো কিছু সে পাবেই | তবে সে বিদ্যান , বিজ্ঞ তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন , ও শত্রুপরাভবকারী হবে | এখানে একটা কথা আছে মা | তুমি তার মা কিভাবে কথাটা বলবো সেটাই ভাবছি | আমার গণনা আজ পর্যন্ত ভুল প্রমাণিত হয়নি |
--- আমার ছেলের কি কোন ফাঁড়া আছে বাবা ?
--- না না কোন ফাঁড়া নেই | এই সমস্যাটা ঠিক ছেলেকে নিয়ে নয় | সমস্যাটা তোমাকে নিয়ে | আর এ সন্তান তো ---
--- হ্যাঁ বাবা আমার স্বামী ছাড়া এ কথা আর কেউ জানেনা |
জোতিষী নিজমনেই বিড়বিড় করেন ,' সন্তানের জীবনে মা তার শত্রু ?'
--- আমি ঠিক বুঝলামনা বাবা --
--- এতো বয়স হল আমার | জীবনে অনেকের জন্মছক করেছি | কিন্তু তোমার ছেলের ছকের মত কোন ছক আমার হাতে পড়েনি |
--- বাবা আমাকে একটু খুলে বলুন | আমি কিছু বুঝতে পারছিনা |
--- মনকে শক্ত করো মা | আমি যেটা বলবো তার অন্যথা করবেনা | এখন থেকেই তোমাকে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে | কারণ সন্তানসুখ প্রতিটা বাবা মায়েরই কাম্য | কিন্তু সেই সুখ যদি বাবা বা মায়ের কারণেই নষ্ট হয়ে যায় তার থেকে কষ্টের আর কিছু থাকতে পারেনা | এখানে তোমার ছেলের ছকে আমি যা দেখছি তাতে তোমার ছেলের বিবাহিত জীবনে তুমিই হচ্ছ তার সুখের পথের অন্তরায় | মানুষের কর্মফল মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারেনা |
--- কি বলছেন আপনি বাবা ? তা কি করে সম্ভব ?
--- এটাই সত্যি | হয়তো তুমি মনেপ্রাণে তা চাইছোনা কিন্তু কোন এক অলৌকিক জাদুবলে তুমি তাইই করবে আর এখানেই মানুষের অসহায়তা | ভাগ্যকে কেউ খন্ডন করতে পারেনা |
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment