পক্ষপাতিত্ব (পর্ব১)
দেশভাগের অনেক আগেই সঞ্জয় ব্যানার্জী পুরো পরিবার নিয়ে ভারতে চলে আসেন | তখন তার বড়ছেলের বয়স দশ আর ছোটছেলের বয়স পাঁচ | তার পত্নী তিনমাসের অন্তঃসত্বা | আসানসোলের এক প্রত্যান্ত গ্রামে একটি মুসলিম পরিবারে একচেঞ্জের মাধ্যমে নিজের কয়েক বিঘা সম্পত্তি আর বিশাল অট্টালিকা সম বাড়ির বিনিময়ে মাত্র সামান্য কয়েক কাঠা জমির উপর একতলার একটি বাড়ি -- এতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল | বেশ কয়েকবছর অভাব দুঃখ দারিদ্রের সাথে লড়াই করবার পর তিনি রেলে একটি চাকরি পান | তখন তিনি তিন সন্তানের পিতা | দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে | ছেলেদের তিনি উচচশিক্ষায় শিক্ষিত করলেও মেয়েকে তিনি মাধ্যমিক পাশ করার পরই বিয়ে দিয়ে দিতে চান | তখন বড়ছেলে অর্ণব তার বিরোধিতা করে আদরের বোনকে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয় | গ্রাজুয়েশন শেষ করে সঞ্জয় ব্যানার্জির বড় ছেলে অর্ণব সামান্য মাইনের ছোট এক কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায় | সঞ্জয় যে টাকা উপার্জন করেন তাতেই তার সংসার বেশ ভালোভাবেই চলে যায় | তিনি তার ছেলের উপার্জনের টাকায় লালায়িত ছিলেননা | আর এদিকে অর্ণব যেহেতু বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে বোনকে সুশিক্ষিত করে তুলতে চেয়েছে সে বোনের ব্যাপারে তার বাবার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেয়না | আর তাদের মা অথাৎ সঞ্জয় ব্যানার্জীর স্ত্রী স্বল্প শিক্ষিত মহিলা আজীবন তিনি তার সংসার নিয়ে থাকলেও রাগী , বদমেজাজি স্বামীর বিরুদ্ধে যখন ক্ষেপে যান তখন তার স্বামীটিও কিছুটা চুপসে যান | কারণ তিনি ভালোভাবেই জানেন সবকথা তার কথামত চললেও কোন কাজে যখন অন্নদা আপত্তি জানিয়েছে তখন সে সেটা কিছুতেই তার মতের বিরুদ্ধে করতে দেবেনা | পনের বছর বয়সে বৌ হয়ে যখন তিনি ব্যানার্জী পরিবারে এসেছিলেন স্বাভাবিক কারণেই ওই ছোট বয়সে বাইশ বছরের রগচটা স্বামীর সব অন্যায় অত্যাচার মেনে নিলেও ছেলেরা বড় হওয়ার পর তিনি তার স্বামীর মুখের উপর কথা বলতে শুরু করেন | কারণ দুটি ছেলেই সবসময় তার পাশেই থাকে | আর সত্যি বলতে অন্নদাদেবী স্বামীর অনৈতিক কাজগুলি নিয়েই মুখ খোলেন | মেয়ের উচচশিক্ষার ব্যাপারেও তিনি তার বড় ছেলে অর্ণবকে বাপের সিদ্ধান্তকে মেনে না নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন | তিনি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে ছেলেকে সাহস যোগান | মেয়ে অদিতি এখন সায়েন্স নিয়ে গ্রাডুয়েশন করছে |
বড় ছেলে অর্নবের বিয়ের জন্য তিনি মেয়ে দেখতে শুরু করেন | কিন্তু অর্ণব তার এই সামান্য চাকরিতে বিয়ে করতে রাজি হয়না | বড় কোন চাকরি পাওয়ার আশাও নেই | অন্নদাদেবী তাকে বুদ্ধি দেন ব্যবসা করার জন্য |
--- আমি তোকে একটা কথা বলি অর্ণব | তুই কিছু একটা ব্যবসা কর |
--- কি ব্যবসা করবো মা ? আর তাছাড়া ব্যবসা করতে গেলে প্রচুর টাকার দরকার | মাইনে যা পাই বোনের পিছনে খরচ ছাড়া আমার কোন খরচ নেই ঠিকই | বাকি টাকা আমি জমাই | কিন্তু সে আর কটা টাকা ? ঐসব চিন্তা করে কোন লাভ নেই |
--- টাকা আমি দেবো |
--- তুমি কোথায় টাকা পাবে ? আর তাছাড়া বাবা জানতে পারলে তোমায় আস্ত রাখবেনা সাথে আমাকেও কচুকাটা করবে |
--- তোর বাবা জানতেই পারবেনা | আমার অনেক ভারী ভারী গয়না আছে | তোর বাবার দেওয়া না | সবই আমাকে আমার বাবার দেওয়া | আমার যাকিছু তোদের তিন ভাইবোনের জন্যই | সেই গয়নার তিনভাগের একভাগ আমি তোকে দেবো | একভাগ থাকবে তোর ভায়ের জন্য আর একভাগ থাকবে অদিতির জন্য | আর রুচিরাকে বিয়ের সময় যা দেওয়া হবে সে তোর বাবা ই তৈরি করে দেবেন | কি ব্যবসা করতে চাস চিন্তা কর | টাকার অভাব হবেনা | তবে আমার একটা শর্ত আছে |
--- বলো কি তোমার শর্ত ?
--- তোর ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে বাড়িতে প্রতিবছর দুর্গাপূজা করবো | তখন তোর ভাইও নিশ্চয় কিছু রোজগার করবে | সেও তখন কিছু দেবে | এটা আমার বহুদিনের সাধ |
একথা বলে তিনি একটি কাপড়ে মোড়া কিছু গয়না এনে তার বড় ছেলের হাতে দিলেন |
--- শোনো মা , তোমার কথামত ব্যবসা আমি শুরু করবো | কিন্তু আমারও একটা শর্ত আছে |
--- তোর আবার কি শর্ত ?
--- ব্যবসা আমার যতদিন না দাঁড়ায় ততদিন কিন্তু তোমরা আমার বিয়ের কোন চেষ্টা করবেনা | তবে ব্যবসা দাঁড়িয়ে গেলে আমি নিজে থেকেই তোমাদের বিয়ের কথা বলবো |
--- তুই নিশ্চিন্ত থাক | তোর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে তোর বাবাকে আমি কিছুতেই তোর বিয়ে দিতে দেবোনা | তবে হ্যাঁ যদি কোন মেয়ে তোর পছন্দ থাকে তাহলে কিন্তু আমায় জানাস বাবা |
অর্ণব হেসে পরে বললো , ' এখনো সে রকম কাউকে পছন্দ হয়নি মা |' তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ |
বছর তিনেকের মধ্যে অর্ণবের ব্যবসায় বেশ লাভ হতে লাগলো | ডায়মন্ডহারবার রোডের উপর প্রথমে সামান্য কিছু ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস নিয়ে সে একাই বিজনেসটা শুরু করে | একবছরের মাথায় সে পাশের প্রায় অচল আর একটি দোকান কিনে নেয় | এরপর দুটি দোকানকে দোতলা করে এখন সর্বরকমের ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস তার বিশাল দোকানে | বেশকিছু কর্মচারীও এখন বিশ্বস্ততার সাথে সেখানে কাজ করে | সে তার শোরুমের নাম দিয়েছে 'অন্নদা শোরুম'- |
আজ অর্নবের বিয়ে | পাত্রী বাবা নিজে পছন্দ করেছেন | অর্ণব একবারের জন্য দেখতেও যায়নি | কিন্তু শুভদৃষ্টির সময় পাত্রীকে দেখে তার চোখ মুখ শুকিয়ে একেবারে আমসি হয়ে যায় | এখন সে বুঝতে পারছে মা কেন তাকে বারবার করে একবার মেয়েটিকে দেখতে আসতে বলেছিলেন | কিন্তু সে তাতে রাজি হয়নি | মাকে বলেছে ,
--- রূপ দিয়ে কি হবে ? গুন থাকলেই হবে |
কিন্তু সে একবারের জন্যও বুঝতে পারেনি নন্দিনী শুধু কালোই নয় মোটা আর মুখশ্রীও সুন্দর নয় | কি কারণে বাবা একে পছন্দ করেছেন তা অর্নবের বোধগম্য হলোনা | কিন্তু এখন আর আফসোস করে কি হবে ? যা হবার তা তো হয়েই গেছে | তাই বুদ্ধিমান অর্ণব প্রথম অবস্থায় একটু ঘাবড়ে গেলেও কিছুটা সময় পরে সে এটাকে তার ভাগ্য বলেই মেনে নেয় আর মন খারাপের থেকেও বেরিয়ে আসে |
বৌ নিয়ে অর্ণব বাড়িতে পা দিলো | হঠাৎ গেটে পিওনের গলা ,' অভিক ব্যানার্জী বাড়িতে আছেন ?'
সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে সবে ঢলে পড়েছে | নূতন বৌ এর সামনে দুধ-আলতার থালা | বাইরে পিওনের গলা | অভিক ও অর্ণব দুই ভাই এগিয়ে গেলো | অভিকের হাতে পিওন একটি খাম ধরিয়ে দিলো | অভিক সেখানে দাঁড়িয়েই খাম খুলে সেটি দেখে দাদাকে লাফ দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো ,' দাদা, দাদা বৌদি তো আমাদের ঘরের লক্ষ্মী রে | ব্যাঙ্কের চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি |,
দরোজার সামনে তখন ঘনঘন শাঁকের আওয়াজ আর উলুধ্বনি পড়ছে নূতন বৌ বরণ করে অন্নদাদেবী ঘরে তুলছেন | মুহূর্তেই বাড়ির সকলের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো নন্দিনী লক্ষ্মী রূপে | এতক্ষণ তার চেহারা নিয়ে আত্মীয়স্বজন , পাড়াপ্রতিবেশীর মধ্যে যে চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিলো তারাই এখন ফিসফাস করে নন্দিনীর ভাগ্যের প্রশংসা করতে শুরু করলেন | আর কিছুটা হলেও অর্ণবের মধ্যে নন্দিনীর চেহারা নিয়ে যে ক্ষোভ ছিল এই ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে সে ক্ষোভ কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসায় পরিণত হয়ে উঠলো | তখনও সে জানেনা জীবনে সবথেকে বড় ধাক্কাটা নন্দিনীর কাছ থেকেই আসতে চলেছে |
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment