Monday, August 2, 2021

তিন রমণীর কথা (প্রথম পর্ব)

তিন রমণীর কথা (প্রথম পর্ব)
  জীবনে প্রচুর ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এই শেষ বয়সে এসে ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে তিনটি রমণী হয়ে উঠেছে তিনজনের কাছের মানুষ।তাদের সুখ দুঃখ গুলো তাদের নিজেদের মতো করে তারা আলোচনা করেন। ফেলে আসা অতীতের সুখ দুঃখের ঘটনাগুলি তারা আলোচনা করে কিছুটা হলেও মনের ভার লাঘব করতে পারেন।পরস্পরের এইসব ঘটনাগুলি তাদের একে অপরকে কখনো সান্তনা দেয় কখনো তাদের  কাঁদায় আবার কখনোবা হাসায়। এই বয়সে এসে এইসব ঘটনাগুলি তারা পরস্পরের মধ্যে  আলোচনা করে কিছুটা সময় হলেও ফেলে আসা অতীতে যেন ফিরে যান।তাই প্রতিদিনই তারা মুখিয়ে থাকেন সেই বিকেলের আসায় কখন তাদের দেখা হবে আর কখন তারা তিনজনে মুখোমুখি বসে  নিজেদের ফেলে আসা অতীতের সুখ দুঃখগুলো ভাগ করে নেবেন।
  তিন বন্ধু মিলে পার্কে বসে মুড়ি মাখা খেতে খেতে নিজেদের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে এইভাবে প্রতিদিনই আলোচনা করেন। সন্ধ্যা হয়ে যায় কিন্তু যতক্ষণ না পার্কের সেন্ট্রি এসে তাদেরকে উঠতে বলে তারা সেখানেই বসে থাকেন,আর এটাই তাদের রোজ নামচা। এইভাবে ওই পার্কে সেন্ট্রিও যেন তাদের কাছের একজন হয়ে উঠেছে।পার্কের নির্দিষ্ট জায়গা তাদের জন্য বাধা।যদি কখনো কেউ এসে সেখানে বসে পড়ে সেন্ট্রি ঠিক সুযোগমতো তাদেরকে উঠিয়ে দিয়ে তিন দিদিকে জায়গা করে দেয়।
 খুব কাছের আপনজনদের কাছ থেকে আঘাত অপমান অসম্মান সহ্য করার পর যখন বাইরের কেউ একটু সামান্য মিষ্টি কথা বলে,সম্মান দেয় তখন সেই মানুষটা খুব কাছের হয়ে ওঠে।জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় তারা পিছনে ফেলে এসেছেন।প্রথম থেকেই তারা ফেসবুক বন্ধু।মানুষ বলে, ছেলেবেলার বন্ধুত্ব নাকি খুব গাঢ় হয়।কিন্তু এই বয়সে এসে এই তিন রমণী তাদের বন্ধুত্বটাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। ফেসবুক কার কি ক্ষতি করে বা করেছে জানা নেই এই সমবয়সী পৌরত্বে পৌঁছানো তিন রমণীর। কিন্তু তারা এটা ভালোভাবে জানেন ফেসবুক তাদের একাকীত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে,তাদের তিনজনকে কাছে এনেছে তাদের নূতন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।এখন তারা নিজেদের জন্য ভাবতে শিখেছেন।অধিকাংশ নারী তাদের জীবনের স্বর্ণময় সময়টা শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই কাটিয়ে দেয় অন্যদের কথা ভেবে,অন্যদের মনোরঞ্জনে।এই তিন নারীও তাদের ব্যতিক্রম নয়।
  প্রথমে এই তিন নারীর মধ্যে যে নারীর কথা আমরা জানবো তার নাম সুছন্দা।
    ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনায় মেধাবী সুছন্দা গ্রাজুয়েশনের পরেই একটা বড় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী পেলেও তার ইচ্ছা ছিলো একটি সরকারি চাকরির।অনেক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে।কিন্তু মনের ইচ্ছা মনেই থেকে গেছে।
         অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে সুছন্দা ছিলো সকলের ছোট।বাবাকে হারিয়েছে দ্বাদশশ্রেনীতে পড়ার সময়েই।বড়দা কেন্ত্রীয় সরকারের অধীনে ভালো চাকরী করতেন।বিয়ে করার সুযোগ তার জীবনে আসেনি।তিনিই পরিবারের বড় সন্তান,বাবার মৃতু্র পর স্বভাবতই সংসারের জোয়াল তার কাঁধে এসে পরে।আর পাঁচজনের মতই সংসারের এই দায়িত্বকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি।এক বোনের বিয়ে বাবা দিয়েই গেছিলেন বাকি তিন বোনের ও ছোট ভায়ের যথাযথ শিক্ষা গ্রহনের পর তাদেরও বিয়ে দিয়ে সংসারী করেন।এসবের মধ্যে মা-ও চিরতরে বিদায় নেন।সব দায়িত্ব পালন যখন শেষ হোল তখন ছন্দার বড়দার বিয়ের বয়সও পার হয়ে গেছে।সুছন্দা তার বড়দাকে পিতৃসম শ্রদ্ধা, ভক্তি করতো।তিনি তার আদরের স্বাধীনচেতা ছোট বোনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেমন ছেলে তার পছন্দ।সুছন্দা তার বড়দাকে বলেছিলেন,"রূপ মানুষের পরিচয় নয়।রূপবান চাইনা, তুমি চেষ্টা করো একজন প্রকৃত ভালো মনের মানুষ খুঁজে আনতে।আর কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরী করা ছেলে নয়;চেষ্টা কোর যে কোন পোষ্টেই হোকনা কেন একজন সরকারী চাকুরিজীবি ছেলে খুঁজতে।যার বর্তমান আর আমার কপালে যদি থাকে তাকে হারানো তার অবর্তমানেও আমি তারটাই খাবো।ভবিষ্যতে সন্তানের মুখাপেক্ষী হতে আমি রাজি নই।কারন মেয়েদের জীবনে স্বামী এমন একজন মানুষ যার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবো, যার সাথে ঝগড়া করবো,মন-অভিমান, ভালোবাসা, তার সেবাযত্ন সব-সব করবো;তারপরেই সব জোর খাটাবো।আমার চেহারা, গাড়ি, বাড়ি কিছুরই কোন দরকার নেই।আমার কপালে থাকলে ওই সামান্য চাকরী থেকে আমি নিজেই সব করে নিতে পারবো কারন চাকরিটা থাকবে পার্মানেন্ট।সামান্য মাইনে হলেও সেটা থাকবে নির্দিষ্ট।বড়দা দেবাঞ্জন ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় ঠিক এমনই একটি ছেলের সন্ধান পেয়েছিলেন দূর সম্পর্কের এক বোনপোর মাধ্যমে।রূপে বা অর্থে নয় সে ছিলো গুনের আধার এবং সরকারী একজন সাধারন কর্মচারী। 
       ঊনত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সুছন্দা ও তার স্বামী বিজিত খুব সুন্দর বাড়ি করে।মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বেশ বড় ঘরেই ব্যবসায়ী ছেলের সাথে বিয়ে দেয়।ছেলে যখন ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে ঠিক তখনই সুছন্দার জীবনের ছন্দপতন!হঠাৎ করেই মাত্র কা'দিনের জ্বরে বিজিত তার ছন্দাকে ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করে।বড্ড একা হয়ে পড়ে ছন্দা।মেয়ে তার সংসার ফেলে কতদিন মাকে আগলে রাখবে?একসময় সেও তার স্বামীর কাছে চলে যায়।সম্পূর্ণ একাকী সুছন্দা তখন মোবাইলকেই সময় কাটানোর বন্ধু বানিয়ে ফেলে। 
          সুছন্দার মেধাবী ছেলে রাহুল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে ক্যাম্পাস থেকেই চাকরী পেয়ে যায়।পোষ্টিংও কলকাতাতেই হয়।বিশাল তিনতলা বাড়ির নিচুটা ভাড়া দিয়ে তিনি স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে দোতলা ও তিনতলা নিয়ে থাকতেন।স্বামী বেঁচে থাকাকালীন সময়েই বিচক্ষণ সুছন্দা তিনতলাতে সম্পূর্ণভাবে একটি আলাদা ফ্লাট তৈরি করে রাখেন।তার মনের ইচ্ছা ছিলো ছেলেকে যদি তিনি বিয়ের পরেই আলাদা করে দেন তাহলে আজকের দিনে ঝামেলা এড়িয়ে ছেলে, বৌকে নিয়ে একই ছাদের তলায় থাকতে পারবেন।কারন দুটি বাসন একজায়গায় থাকলে শব্দ হবেই।তিনি মোটা টাকার পেনশন পান।ছেলে আর বৌকে দেবেন ছাড়া তাদের কাছ থেকে একটি টাকাও তিনি নেবেন না।আর ঠোকঠুকির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একটাই উপায় তোমরা আলাদা থাকো, আমরাও আলাদা থাকি কিন্তু একই ছাদের তলায় ঝগড়াঝাটি ছাড়া থাকি।কিন্তু স্বামী চলে যাওয়ার পর তিনি তার সিদ্ধান্তের কিছুটা পরিবর্তন করেন।বিজিতবাবু না থাকাতে আত্মীয়-পরিজনের আসাও অনেকাংশেই কমে গেছে।তাছাড়া দোতলার এত বড় বড় ঘরে যার প্রতি কোণায় কোণায় স্বামীর স্মৃতি যা তাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছিলো।তাই রাহুলের বিয়ের পর তিনি দোতলা তাদের ছেড়ে দিয়ে তিনতলায় উঠে যান । স্বামী চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বড়দাও চলে যান।বাবাকে হারিয়ে সুছন্দা বড়দাকেই বাবার আসন দিয়েছিলেন। শ্রদ্ধা,ভালোবাসায় বড়দাকেই জীবনের আদর্শ পুরুষ হিসাবে দেখতেন।মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে পিতৃসম বড়দা আর জীবনের সব থেকে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ছন্দা একেবারেই চুপসে গেছিলেন।
 মেয়ে, জামাই একবার তাকে জামাইষষ্ঠীতে একটি স্মার্ট ফোন কিনে এনে দিয়ে কিছুটা হলেও শান্তির আভাস এনে দিয়েছে।ছেলে, বৌ ও এক নাতির সান্নিধ্যে তার মাঝে মাঝে সময় খুব ভালোই কাটে।বাকি সময় তিনি তার ফেসবুক নিয়েই থাকেন।বৌমার সংসারে তিনি বিন্দুমাত্র নাক গলান না।নিজের রান্না নিজেই করে খান।ঘরভাড়া ও স্বামীর পেনশনে তার খুব ভালোভাবেই চলে যায়।উপরন্তু তিনি পুরো বাড়ির ইলেকট্রিক বিল, বৌমার গ্যাসের দাম এবং তার টুকটাক হাত খরচ তিনিই দেন। ছেলের প্রিয় খাবারগুলো তিনি মাঝে মাঝেই রান্না করেন আর বাটি ভর্তি করে ছেলেবউয়ের ঘরে চালান করেন।কিন্তু বৌমা তার কোন কাজ করতে গেলে স্বাধীনচেতা সুছন্দার মিষ্টি সুরে একটাই কথা,"এখন আমি সবকিছু করে নিতে পারি মা,আমার শরীর যখন দেবেনা যখন আমি পারবোনা তখন যদি তোমার মনেহয় আমার কোন কাজ করে দেবে তখন কোর।এখন আমার জন্য তোমাদের কিচ্ছু করতে হবেনা।" তবে তার ছেলের বৌ মাঝে মধ্যে এটাসেটা রান্না করে বা কখনো বা এক কাপ চা করে তার শ্বাশুড়ীমাকে দিয়ে আসে।সুছন্দা সেগুলি হাসি মুখেই গ্রহন করেন।ঝগড়া, অশান্তির কোন সুযোগই তিনি দেননা।
 তার সময় কাটে নাতির সাথে খেলে,গল্পের বই পড়ে।আর এমন সময় স্মার্ট ফোনটি হাতে পেয়ে জামাই,ছেলে,বউ সকলের সাহায্যেই তিনি বেশ পোক্ত হয়ে ওঠেন।ভার্চুয়াল জগতে ঢুকে অনেকের গল্প,কবিতা পড়তে পড়তে তার ছেলেবেলার অভ্যাসটাকে ঝালিয়ে নিতে শুরু করলেন।পুরনো ডাইরি বের করে নতুনভাবে আবার গল্প,কবিতা লেখায় মন দিলেন।খুব তাড়াতাড়িই তারা ফ্রেন্ড লিস্টের সংখ্যা বাড়তে লাগলো।অনেকেই তার লেখার প্রসংশা করতে থাকেন।তিনিও দ্বিগুণ উৎসাহে লেখায় মনোনিবেশ করেন।সম,অসম বয়সী অনেক বন্ধুর সাথেই টুকটাক কথাও হত ইনবক্সে।তাদেরই মধ্যে একজন সালেহা আক্তার।

  ক্রমশঃ

    

No comments:

Post a Comment