Thursday, August 26, 2021

প্রশ্ন

প্রশ্ন

   জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সনু ওরফে সায়ন শুনে আসছে এ বাড়ির ঠাম্মা আছেন কিন্তু কোথায় আছেন তা সে জানে না।তার মা তাকে বলেছেন,"এ বাড়ির ঠাম্মা এমন একটা বাড়িতে থাকেন যেখানে আরও অনেক ঠাম্মারা থাকেন।" কিন্তু সে বাড়ির নামটা এত বড় সনু কিছুতেই সেই নামটা মনে রাখতে পারে না।সে কিছুতেই ভেবে পায় না তার ঠাম্মা তো তাদের সাথেই থাকেন তাহলে মা যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়িতে এতগুলি ঘর থাকার পড়েও নীলা দিদিমনির ঠাম্মা কেন অন্য কোথাও থাকে।
  নীলা ব্যারিস্টার অজয় নন্দীর একমাত্র মেয়ে।সনুর প্রায় সমবয়সী।সনু যখন খুব ছোট ছিল তখন মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই নীলা দিদিমনির সাথে খেলার জন্য ওই বাড়িতে যেত।ব্যারিস্টার অজয় নন্দী এবং তার সুন্দরী স্ত্রী অদৃজা সনুর এই বাড়িতে আসাটাকে মোটেই পছন্দ করতেন না।বিশেষত নীলার সাথে খেলাটা।তাই একদিন বাসন্তিকে জানিয়ে দেন যাতে সে সনুকে নিয়ে কাজে না আসে।তারপর থেকে আর কোনদিনও সনু এ বাড়িতে আসেনি।
  এখন সনুর বয়স বারো বছর।সে সবকিছুই বুঝতে পারে।গতকাল অনেক রাতে মায়ের কাছে ফোন এসেছিল তাই মা খুব ভোরে বেরিয়ে গেছে।এখন রাত নটা বাজে।মা যাওয়ার সময় সে ঘুমাচ্ছিল বাবার কাছে।বাবা কাজে বেরোনোর সময় ঠাকুমার সাথে বাবার কথায় সনু জানতে পেরেছে নীলা দিদিমনির ঠাম্মা মারা গেছেন।
 আগেরদিন রাত তিনটের সময় বৃদ্ধাশ্রম সুখনীড় থেকে খবর আসে ব্যারিস্টার অজয় নন্দীর কাছে তার মা মনীষাদেবী মারা গেছেন।সারাদিনের ধকলের পর রাতে বিশ্রামের সময়ে এরূপ একটা খবর পেয়ে অজয়বাবু আশ্রমে জানিয়ে দেন তিনি সকালে শ্মশানে পৌঁছাবেন।তারা যেন যা করণীয় সেই মুহূর্তে করে নেয়।তিনি গিয়ে যা টাকা দেওয়ার দিয়ে দেবেন।
  পরদিন সকালে অজয়বাবু যখন শশ্মানে পৌঁছলেন তখন তার দাহকার্য সম্পন্ন হয়ে গেছে।তিনি আশ্রম কতৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা ধরিয়ে গঙ্গা স্নান করে ধরা পড়ে বাড়ি ফিরলেন।
 নীলা খুবই কান্নাকাটি করছিলো ঠাম্মাকে একবার দেখতে যাবে বলে।কিন্তু নীলাকে স্বামী,স্ত্রী না নিয়েই দুজনে শশ্মানে গেছিলেন।নীলা ছিল বাসন্তীর কাছে।তারা বাড়িতে ফিরলে বাসন্তী তার বাড়িতে ফিরে আসে।অদৃজা যাওয়ার সময় বাসন্তীকে বলেই গেছিলো সে যেন রান্নাঘর পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন করে রাখে।এসে তো সেই সেদ্ধিভাত খেতে হবে।
 নীলার বয়স তখন তেরোবছর।দুপুরে খেতে বসে সে দেখে মা,বাবা ফেরার সময় হোটেল থেকে খাবার নিয়েই ফিরেছেন।অথচ কয়েক মাস আগেই সে দেখেছে তার দিদিমা যখন মারা গেছিলেন মামা সেদিন শুধু ফল খেয়েই ছিলেন।পরেরদিন থেকে নিজের হাতে রান্না করে শুধু ভাত খেয়েছিলেন।সে ভাতগুলো দেখতে কেমন কাদার মত।খেতে বসে হোটেলের খাবার দেখে আজ আর তার কোন আনন্দ হলনা।সে মায়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে জানতে চাইলো,
--- বাবা আজ মামার মত সেই ভাত খাবে না?
 অজয়বাবু কটাক্ষ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে নিজের মনে খেয়ে উঠে গেলেন। অদৃজা মেয়ের মনের কথা বুঝতে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
--- তোমার বাপী তো ওই ভাত খেতে পারে না তাই এইগুলো খেয়েছে তুমি একথা কিন্তু কাউকেই বলবে না।
 তারপর সে নিজে বাসনগুলো মেজে নেয় যাতে বাসন্তী এসে কিছু বুঝতে না পারে।
  ছলছল চোখে সে মায়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকলো।
 সনুর মা আজ সনুকে বলেছে নীলার ঠাকুমার শ্রাদ্ধে ওকে নিয়ে যাবে।বেশ ভালোমন্দ খেতেও পারবে।সনুর আজ খুবই আনন্দ।আজ অনেকদিন পর নীলা দিদিমণির সাথে তার দেখা হবে।মায়ের সাথে সে বাড়িতে পৌঁছে সেখান থেকে অন্য একটা ভাড়া করা অনুষ্ঠান বাড়িতে পৌঁছে তার তো চক্ষু চড়কগাছ।এত আয়োজন!দলে দলে লোক আসছে।কেউ কেউ বসে খাচ্ছে আবার অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেরা নিয়ে খাচ্ছে। কত রকমের খাবার।সনু কিছুতেই ভেবে পারছে না যে বিশাল বাড়িতে ঠাম্মার একটু থাকার জায়গা হয়নি তার মৃত্যুর পর এত মানুষকে ডেকে খাওয়ানোর কি দরকার?সবাই বিয়েবাড়িতে আসার মত সেজেগুজে এসেছে। কত হাসছে গল্প করছে।আসার পর থেকেই সে নীলা দিদিমনিকে খুঁজে চলেছে।কিন্তু কোথাও তাকে সে দেখতে পাচ্ছে না।ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পাচ্ছে না।
 অনেক খোঁজার পর একটা ঘরে সে তার নীলা দিদিমনিকে খুঁজে পায়।দু,চারটে লোকের মাঝে সে চুপটি করে বসে ছিল।সনুকে দেখতে পেয়ে সে সেখান থেকে উঠে সনুকে নিয়ে কথা বলতে বলতে বাইরে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসে।
--- দিদিমণি,তোমাদের বাড়িতে আজ এত্ত লোক।তোমার মনটা এত খারাপ কেন?
--- আমার ঠাকুমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু বাপি,মামণি কেউই সেটা বুঝছে না।ওরা কত হেসে হেসে সকলের সাথে কথা বলছেন। জানো সনু,ঠাকুমার সাথে ওরা কেউ কোনদিন এইভাবে কথা বলতো না।সব সময় ঠাকুমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলতো।ঠাকুমা শুধু কাঁদতো।আমি তো তখন খুব ছোট ছিলাম একটু একটু মনে আছে।একদিন বাপী,মামণি দুজনে মিলে ঠাকুমাকে নিয়ে গিয়ে কোথায় যেন রেখে আসলো।আমি খুব কান্নাকাটি করলে একটু সময়ের জন্য আমায় নিয়ে যেত।আর তখন ঠাকুমা আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতো।
--- কিন্তু আজকে তো ওনার শ্রাদ্ধ।আমি বুঝতে পারছি না সবাই এত সেজেগুজে এসেছে কেন? হাতে সকলের মিষ্টির প্যাকেট।আবার গিফটও এনেছে অনেকে।শুধু ফুলের মালাটা ছবিতে দিচ্ছে বাকি সব তো ম্যাডামের হাতেই দিচ্ছে।এগুলো তো বিয়ে বাড়ীতে হয় দেখেছি।আমি অবশ্য এরকম কোন শ্রাদ্ধ বাড়িতে কোনদিন যাইনি। কারো মনে কোন দুঃখ নেই।সবাই কেমন মজা করছে।
--- আমারও এগুলো দেখতে ভালো লাগছে না।আজকে আমার এসব দেখে মনে হচ্ছে যেন ঠাকুমা মরে যাওয়াতে সকলের খুব আনন্দ হয়েছে।আর আমায় ঠাকুমা বলেছিলেন
'আনন্দ অনুষ্ঠানে সকলে মিষ্টি নিয়ে আসে।' কিন্তু আজ তো শোকের দিন সবাই তবে কেন এত বড় বড় মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসছে?অনেকে আবার আমাদের জন্য কত দামী দামী জামাকাপড়ও নিয়ে আসছে।কেন করে মানুষ এগুলো তুমি জানো?
--- আমিও তো এটাই ভাবছি।কি জানি আমরা তো ছোট তাই হয়তো নিয়মকানুনগুলো ঠিক জানিনা।তবে এগুলো দেখতে আমারও ভালো লাগছে না।যখন বড় হবো তখন এইসব নিয়মের মানে হয়ত বুঝতে পারবো।চলো এখন আমরা ভিতরে যাই।ম্যাডাম তোমাকে আমার সাথে দেখলে আবার বকবে তোমায়।
  দুটো অবোধ শিশুর মনে যে প্রশ্নের উদয় হোল আমাদের সমাজ কবে খুঁজবে সেই প্রশ্নের উত্তর? 
 
    শেষ

Saturday, August 14, 2021

পক্ষপাতিত্ব শেষ পর্ব

শেষ পর্ব 


   সঞ্জয়বাবু  এখন  এতটাই  অসুস্থ্য  যে  তিনি  আর  কোন  ব্যাপারে  নাক  গলাননা | কখনো  কিছু  বললেও  নন্দিনী  তার  কোন  কথা  শোনেও  না  | তাই  আস্তে  আস্তে  তিনি  নিজেকে  সংসার  থেকে  গুটিয়ে  নিয়েছেন  |  তবুও  তিনি  চেষ্টা  করেন  এ  বিয়ে  আটকাতে  | ছেলে  আর  ছেলের  বৌকে  অনেক  বুঝান  | কিন্তু  তারা  বোঝেনা  বা  বলা  ভালো  নন্দিনী  অর্ণববাবুকে  বুঝতে  দেয়না  |
    অরূপ ও  মনামীর  বিয়েটা  বেশ  ধুমধাম  করেই  হল  | কয়েকটা  দিন  যেতে  না  যেতেই  মনামী তার  খোলস  ছেড়ে  নিজ  মূর্তি  ধারণ  করলো  | সে  সংসারে  কোন  কাজ  করবেনা অথচ  সব  ব্যাপারে  তার  মতামতকে  গুরুত্ব  না  দিলে  সে  তুলকালাম  শুরু  করে  | এবং  তাকে  সমর্থন  করে  তার  সাথে  যোগ  দেয় অরূপ | এ  যেন  আগুনের  সাথে  ঘিয়ের  সংমিশ্রণ  |সে  তার  এক  অদ্ভুত  জাদুবলে  শ্বশুর  শ্বাশুড়িকেও  হাতের  মুঠোই নিয়ে নেয়| একদিন  সুমনা  রান্নাবান্না  করে  উপরে  তার  ঘরে  এসে  টুকটাক  কাজ  সেরে অনুপকে  সাথে  নিয়ে   যখন  নিচুতে  রান্নাঘরে  খাবারের  জন্য  ঢোকে  তখন  দুজনেই  শুনতে  পায় অনুপের  বাবা  মা  চাপা  স্বরে  কিছু  কথা  বলছেন  তাদের  ঘরে  | রান্নাঘর  ও  তাদের  ঘরটা  এতটাই  কাছাকাছি  রান্নাঘরের  দরজার  কাছে  দাঁড়ালেই  তাদের  গলার  আওয়াজ  পাওয়া  যায়  | অর্ণববাবু  বলছেন ,


--- ওকে  যখন  আমি  নিজ  সন্তান  স্নেহে  মানুষ  করেছি  তখন  আমি  মনেকরি  ও  আমারই সন্তান  | তাই  তোমার  কথা  শুনতে  আমি  পারবোনা  | এতদিন  তো  তোমার  কথা  শুনে  চললাম  | কি  লাভ  হল  তাতে ?তুমি  তোমার   নিজের  সন্তানের  সাথে  ভালো  ব্যবহার  তো  করোইনা  পরের  মেয়েটার  সাথেও  দুর্ব্যবহার  করো  | সে  সবকাজ  সংসারে  করেও  তোমার  মন  পায়না  | আর  তোমাকে  খুশি  করতে  তোমার  অন্যায়টাকে  আমি  প্রশ্রয়  দিয়েই  চলেছি  |কিন্তু আর নয়।বিবেক দংশনে শেষ হয়ে যাচ্ছি।অন্যদিকে  মনামী সংসারে  কোন  কাজ  না  করে  , সকলের  উপরে  ছড়ি  ঘুরিয়েও  তোমার  প্রিয়  পাত্রী  | তার  কারণ তুমি  ভালোভাবেই  জানো তোমার  ছোটছেলে  এতটাই  বদমেজাজি  তার  বৌকে  কিছু  বললে  তোমাকে  সে  ছেড়ে  কথা  বলবেনা  | আমি  অনুপের  জন্মদাতা  পিতা না  হলেও  এ  কথা  আমাকে  স্বীকার  করতেই  হবে  অনুর  মত  সহজ  সরল  বাধ্য  ছেলে  আজকের  দিনে  পাওয়া  দুর্লভ  | তাই  আমি  বেঁচে  থাকতে  থাকতে  আমি  আমার  সমস্ত  বিষয়  সম্পত্তি  আমার  দুই  ছেলের  মধ্যেই  ভাগ  করে  দেবো | 


  দরজার  কাছে  দাঁড়িয়ে  একথা  শোনার  পর  স্বামী  স্ত্রীর  সেদিন  আর  খাওয়ার  ইচ্ছা  ছিলোনা  | অনুপ  তো  সেই  মুহূর্তেই  সেখান  থেকে কাঁদতে  কাঁদতে  দৌড়ে  পালিয়ে  আসে  | আর  সুমনা  খাবারগুলোকে  ফ্রিজে  ঢুকিয়ে  ঘরে  ঢুকে  দেখে  অনুপ  প্রচন্ডভাবে  কান্নাকাটি  করছে  | হতভম্ব  সুমনা  কি  বলে  তার  স্বামীকে  শান্তনা  দেবে  তা  সে  নিজেই  বুঝতে  না  পেরে  অনুপের  পাশে  এসে  বসে  | অনুপ  কোন  কথা  না  বলে  কেঁদেই  চলে  | সুমনাও চুপচাপ  বসে  থাকে  | সারাটা  রাত তাদের  এক  ভয়ানক  পরিস্থিতির  মধ্য দিয়ে  কাটে  |

  একটা  একটা  বছর  করে  বেশ  কয়েক  বছর  কেটে  যায়  | মনামী এবং  অরূপ ছলে বলে  কৌশলে  বাবার  গচ্ছিত  টাকা  আর  নন্দিনীর  গয়নার  অধিকাংশই  নিজ  হেফাজতে  নিয়ে  নেয়  | বাবাকে  দিয়েই  মনামীর  নামে একটা  ফ্লাট  কিনেও  নেয়  | পরে  থাকে  শুধু  বসতভিটে  | বছর  দুয়েক  আগে  সঞ্জয়বাবুও  সকলকে  ছেড়ে  চিরতরে  চলে  যান  | দাদু  অবশ্য  জেনেই  যান  তার  প্রিয়  নাতবৌ  মা  হতে  চলেছে  | অনুপ  ও  সুমনার   সুন্দর  ফুটফুটে একটি  মেয়ে  হয়  | নন্দিনীর  এখন  যথেষ্ট  বয়স  হয়েছে  | একা রান্নাঘরের  দায়িত্ব  সামলাতে  হিমশিম  খায়  | কিন্তু  তা  সর্ত্বেও  ছোট  ছেলের  ভয়ে  সে  কখনোই  মনামীকে  কোন  সাহায্য  করার  কথা  বলতে  পারেনা  | একদিন  রাতে  এইসব  নিয়ে  নন্দিনী  তার  স্বামীর  সাথে   কথা  বলতে  বলতে  হঠাৎ চিৎকার  করে  তার  ছোটছেলেকে  ডাকে  অর্ণববাবুর  শরীর  খারাপ  হয়েছে  বলে  | উপর  থেকে  অরূপ ও  মনামী নেমে  আসে  আর  তাদের  পিছন  পিছন  অনুপ  ও  সুমনা  | শহরের  নামকরা  নার্সিংহোম  'মানবী'- তে  নিয়ে  যাওয়ার  কথা  বলে  নন্দিনী  | মনামী আপত্তি  জানায়  | সে  যুক্তি  দেখায়  এতো  বড়  নার্সিংহোমে  নিয়ে  গেলে  প্রচুর  খরচ  | হয়তো  গ্যাসের ব্যথা  | তার  থেকে  বরং একটা  সরকারি  হাসপাতালে  নিয়ে  যাওয়া  হোক  | অরূপ তাকে  সমর্থন  করে  | নন্দিনী  হা  করে  ছোটছেলের  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  থাকে  | অনুপ  এতক্ষণ চুপচাপ  দাঁড়িয়ে  সব  কথা  শুনছিলো  | হঠাৎ  সে  সেখান  থেকে  বেরিয়ে  নিজের  গাড়িটা  বের  করে  ঘরে  এসে  বাবাকে  তুলে  বলে ,

--- আমি  তোমাকে  নিয়ে  যাবো  'মানবী'- নার্সিংহোমে  | মা  তুমি  সাথে  চলো  | 

নন্দিনী  চুপ  করে  দাঁড়িয়ে  আছে  দেখে  অনুপ  চিৎকার  করে  বলে  ওঠে  ,

--- আগে  বাবা  সুস্থ্য  হয়ে  বাড়ি  আসুক  তারপর  নাহয়  তোমার  কিছু  বলার  থাকলে  বোলো  | আমাকে  নিজ  সন্তান  স্নেহে  উনি  মানুষ  করেছেন  , বাবা  হিসাবে  আমি  উনাকেই  জানি  | উনার  প্রতি  আমারও কিছুটা  দায়িত্ব  আছে  | আমিই  বাবাকে  নিয়ে  যাবো  | ভায়ের  ইচ্ছা  হলে  আমাদের  সাথে  যেতে  পারে  | কথাগুলি  অর্ণববাবুর  কানে  গেলেও  উত্তর  দেওয়ার  মত  পরিস্থিতি  তার  ছিলোনা  | আর  নন্দিনীও  অনুপের  মুখে  একথা  শুনে  কিছুটা  অপ্রস্তুত  হয়ে  পরে  | অরূপ মনামী  কিছুই  বুঝতে  না  পেরে  নিজেরা  নিজেদের  মুখের  দিকে  কিছুক্ষণ তাকিয়ে  থাকে  | এমন  একটা  পরিস্থিতিতে  অনুপ  কথাটা  বলে  -- কথাটা সবাইকে  ভাবালেও গভীরভাবে  ভাবার  সেই মুহূর্তে  কারও সময়  ছিলোনা  |

   মনামীর  আপত্তি  সর্ত্বেও  অরূপ দাদার  সাথে  বাবাকে  নিয়ে  নার্সিংহোম  যায়  | হার্টের  মারাত্মক  সমস্যা  কিছু  না  হলেও  ডক্টরবাবু  বলে  দেন  কোন  অবস্থাতেই  উনি  যেন  উত্তেজিত  না  হন  | দিন  সাতেক  অর্ণববাবুকে   নার্সিংহোম  থাকতে  হয়  | অনুপ  নিজেই  হাসপাতালের  বিল  প্রেমেন্ট  করে  |

বাড়িতে বাবাকে নিয়ে ফিরে আসার পর  প্রতিদিন  দুবেলা  করে  অর্ণববাবুর  কাছে  গিয়ে  অনুপ  তার  শরীরের  খোঁজ  খবর  নেয়  এবং  কিছুক্ষণ সময়  বসে  থেকে  তার  সাথে  গল্পগুজব  করে  | নন্দিনী  এসে  মাঝেমধ্যেই  তাদের  আলোচনায়  অংশগ্রহণও  করে  | আজও রান্নাঘরের  সব  দায়িত্বই  নন্দিনীকেই  পালন  করতে  হয়  | মনামী কোন  কাজই করেনা |কিন্তু ফেলে আসা অতীত সম্পর্কে অনুপ কি করে জানলো সে কথা উত্থাপন করতে স্বামী স্ত্রী কখনোই সাহস পান না।

একদিন  সকালের  দিকে  হঠাৎ  করেই  নন্দিনীর  কাঁপুনি  দিয়ে  প্রচন্ড  জ্বর  হয়  | স্বাভাবিক  ভাবেই  নন্দিনী  বিছানা  ছেড়ে  উঠতে  পারেনা  | মনামী নিচুতে  চা  খেতে  এসে  দেখে  শ্বাশুড়ি  বিছানা  ছেড়ে  ওঠেননি  | ঘরে  ঢুকে  জানতে  পারে  তার  জ্বর  | সে  নিজের  ও  তার  স্বামীর  জন্য  দুকাপ  চা  করে  নিয়ে  উপরে  চলে  যায়  | নিচু  থেকে  অর্ণববাবু  ফোন  করে  অনুপকে  তার  মায়ের  শরীর  খারাপের  কথা  জানালে  সে  তৎক্ষণাৎ  নিচুতে  এসে  মাকে কোনরকমে  মুখ  ধুইয়ে  দুটো  বিস্কুট  খাইয়ে  দিয়ে  জ্বরের  ওষুধ  দিয়ে  যায়  | সুমনা  এসে  তাদের  চা  করে  দেয় | আর  দুপুরে  তাদের  দুজনের  খাবার  দিয়ে  যাবে  বলে  যায়  | 

এদিকে  মনামী তো  কিছুই  পারেনা  বা  করতে  চায়না | অরূপ না  খেয়েই  অফিস  চলে  যায়  | আর  মনামী অর্ডার  করে  খাবার  আনে | অরূপ বাইকে  করেই  অফিস  যাতায়াত  করে  | সন্ধ্যার  দিকে  অনুপের  কাছে  একটা  ফোন  আসে  যে  অরূপ বাইকে  মারাত্মক  একসিডেন্ট  করেছে  | সঙ্গে  সঙ্গেই  অনুপ  কাউকে  কিছুই  না  বলে  হন্তদন্ত  হয়ে  বেরিয়ে  যায়  | সুমনা  বারবার  জানতে  চায়  কি  হয়েছে  " এসে  বলছি  "-  বলেই  ছুঁটে বেরিয়ে  যায়  | অনেক  রাত দুছেলের  কেউই  বাড়ি  ফেরেনা  | অরূপের  সুইচ  অফ  আর  অনুপের  ফোন  বেজে  যাচ্ছে  সে  ধরছেনা  | বাড়ির  সবাই  অস্থির  হয়ে  পড়ছে  | সুমনা  শ্বশুর , শ্বাশুড়ির  খাবার  এনে  নিচুতে  দিয়ে  যায়  | কিন্তু  কেউই  খায়না  সে  খাবার  | রাত একটা  নাগাদ  অনুপ  বাড়িতে  ফিরে আসে  | উস্কোখুস্কো  চুল  , চোখদুটি  লাল  জবাফুলের  মত  | মাথা  নিচু  করে  গিয়ে  বাবা  , মায়ের  সামনে  দাঁড়ায়  |

--- খুব  খারাপ  একটা  খবর  আছে  মা  |

--- অরূপ কোথায় ? ওর  সুইচ  অফ  কেন  ?

এগিয়ে  গিয়ে  মাকে ধরে  অরূপ খাটের উপর  বসিয়ে  দেয় | অনুপ  চুপ  করে  আছে  দেখে  ওর  বাবা  বলে  ওঠেন  ,

--- চুপ  করে  থাকিসনা  অনু  কি  হয়েছে  খুলে  বল  | আর  ধর্য্য  ধরতে  পারছিনা  | সত্যিটা  কতক্ষণ লুকিয়ে  রাখবি  ?

--- বাবা , রূপের  একটা  মারাত্মক  একসিডেন্ট  হয়েছে  ---|

--- বেঁচে  আছে  তো  ?

নন্দিনী  চিৎকার  করে  কেঁদে  ওঠে  | অনুপ  ওর  বাবার  দিকে  তাকিয়ে  মাথা  নেড়ে  'না'  বলে  | নন্দিনীর  চোখে  পরে  যায়  অনুপের  মাথা  নাড়ানো  | সে  সঙ্গে  সঙ্গে  জ্ঞান  হারায়  | এই  চিৎকার  চেঁচামেচি  শুনে  সুমনা  ও  মনামী দুজনেই  নিচুতে  নেমে  এসেছিলো  | সকলে  তখন  নন্দিনীর  জ্ঞান  ফেরাতে  ব্যস্ত  | অর্ণববাবু  একদৃষ্টে  তখন  তার  ছেলের  মুখেভাতের  বাঁধানো  একটা  ছবির  দিকে  তাকিয়ে  | অন্যমনস্কভাবে  অর্ণববাবু  বললেন  ,

--- অনু  , তোর  কাকাকে  একটা  খবর  দে  |

অনুপ  বললো ,

--- কাকা  ই  আমায়  ফোন  করে  ডেকেছিলেন  | রূপ  যেখানে  একসিডেন্ট  করেছে  ওখানে  কাকার  পরিচিত  একজন  ছিলেন  যিনি  কাকাকে  ফোনে সব  জানিয়েছিলেন  | আমি  পৌঁছানোর  আগেই  কাকা  পৌঁছে  গেছিলেন  | কিন্তু  ভাই  আমাদের  কোন  সুযোগই  দেয়নি  | হাসপাতালে  নিয়ে  গেছি  ঠিকই  কিন্তু  তার  আগেই  সব  শেষ  | 

         বাড়িটা  পুরো  নিস্তব্ধ  হয়ে  থাকলো  |নন্দিনীর বারবার মনে পড়তে লাগলো জ্যোতিষীর সেই ভবিৎসৎবাণী।"শেষ বয়সে এসে মারত্মক এক আঘাত পাবি।"বাড়িতে কেউ আর কারো সাথে কথা বলে না।সবাই  যেন  কথা  বলতেই  ভুলে  গেছে  | সামান্য  যা  নিয়ম  রক্ষার্তে  শ্রাদ্ধ  করা  হল  তা  অনুপই করলো  | কাজের  পরেই মনামী তার  বাপের  বাড়িতে  চলে  গেলো  বড়  বড়  দুটি  ব্যাগ  নিয়ে  | তার  ভাই  এসে  তাকে  নিয়ে  গেলো  | 

  মাস  ছয়েক পরে  অর্ণববাবু  একবার  ব্যাঙ্কে গেলেন  কিছু  ফিক্সড  ডিপোজিট রিনিউ  করতে  | গিয়ে  দেখেন  তার  সেভিংসে  কোন  টাকা  নেই  | অথচ  মোবাইলেও  কোন  মেসেজ  নেই  | মোবাইল  থেকেই  ট্রানজেকশন  করা  হয়েছে  | খোঁজ  খবর  করে  জানতে  পারলেন  সমস্ত  টাকা  যখন  তিনি  হাসপাতাল  ভর্তি  ছিলেন  তখন  অরূপ  বা  মনামী তাদের  একাউন্টে  ট্রান্সফার   করে  নিয়েছে এবং মোবাইল মেসেজ সব ডিলিট করে দিয়েছে। বাড়িতে  এসে  নন্দিনীকে  সবকিছু  জানালে  সে  মনামীকে  ফোন  করলে  সে  জানায়  সে  এই  ব্যাপারে  কিছু  জানেনা  | স্বামী  স্ত্রী দুজনেই  বুঝতে  পারেন  হাসপাতালে  অর্ণববাবু  যখন  ভর্তি  ছিলেন  ফোনটা ছিল  তাদের  ঘরেই  | আর  আলমারির  চাবি  থাকতো  ড্রেসিং  টেবিলের  ড্রয়ারে  | আলমারির  ভিতর  একটি  ডাইরি  থাকে  তাতে  এটিএম  থেকে  শুরু  করে  মোবাইলের  মাধ্যমে  টাকা  পাঠানোর  কোড  নম্বর  সব  লেখা  থাকে  | তারা  আলমারির  ভিতর  সেই  ডাইরি  খুঁজে  পাননা | সাথে  নন্দিনীর  গয়নার  বাক্স  | বেশ  কয়েক  ভরি  সোনা  আর  কিছু  ফিক্সডিপোজিটের  কাগজপত্র  যার  নমিনী অরূপ | 

    সন্তান  হারানোর  শোকের  কাছে  এ  শোক  তাদের  সেভাবে  নাড়া দিতে  পারলোনা  | যা  গেছে  তাকে  ভবিতব্য  বলেই  মেনে  নিলেন  | অরূপ চলে  যাওয়ার  পর  থেকেই  সুমনা  উপর  থেকে  রোজ  রান্না  করে  শ্বশুর  শ্বাশুড়ীকে  খাবার   দিয়ে  যাচ্ছে  | 

এই  সবকিছু  ঘটে  যাওয়ার  পর  অর্ণববাবু  একদিন  নন্দিনীকে  ডেকে  বললেন  ,

--- এবার  তো  তুমি  তোমার বড়   ছেলে  আর  তার  বৌকে  মেনে  নাও  | এতদিন  তো  তুমি  মনামীকে  সমর্থন  করেই  গেছো  | মন  তোমার  স্বীকার  করলেও  মুখে  কোনদিনও স্বীকার  করলেনা সুমনা  ভালো  মেয়ে  | কবে  কি  জোতিষী  বলে  গেছে  সেই  শুনে  এতগুলি  বছর  ভুল  সিদ্ধান্ত  নিয়ে  সব  কাজ  করে  গেলে  | অনুপকে  দূরে  সরিয়ে  দিয়ে  সুমনার  মত  মেয়ের  সাথে  দুর্ব্যবহার  করে  সারাটাজীবন  ধরে  ওই  রান্নাঘর  নিয়েই  পরে  থাকলে  | সেই  প্রথম  থেকেই  মনামীকে  সমর্থন  করে  গেছো  | বাবা  কিন্তু  ঠিক  বুঝেছিলেন  মেয়েটি  ভালো  নয়  | ওর  লোভ  ছিল  সম্পত্তি  আর  টাকার  | গয়নাগাঁটিগুলো  আত্মসাৎ  করেছে  | কাশটাকা , রূপের  নামে যে  ফিক্সড  ডিপোজিটগুলো  ছিল  সেগুলোও  নিয়েছে  | অনুপকে  না  জানিয়ে  তোমার  কথায়  রূপকে  যে  ফ্ল্যাটটা  কিনে  দিয়েছিলাম  সেটা  মনামী নিজের  নামে  রূপকে  জোর  করে  রাজি  করিয়ে করে   নিলো  | তারমানে  বাবা  যা  যা  বলেছিলেন  ওর  সম্পর্কে  সব  খেটে গেলো  | টাকাপয়সা  , গয়নাগাঁটিগুলো  ফেরৎ পাওয়া  যেত পুলিশে  গেলে  | কিন্তু  আমার  মন  সায় দিলোনা  | এতবড়  শোকটা মেনে  নিতে  পারলাম  আর  এই  সামান্য  টাকার  শোক  ঠিক সামলে  যাবো  | কাল  থেকেই  অনুপকে  তার  জায়গা  ফিরিয়ে  দাও  | সুমনা  আর  তাদের  মেয়েকে  বুকে  টেনে  নাও  | যে  কটাদিন বাঁচবো  ওদের  নিয়েই  ভালোভাবে  বাঁচি  | যে  চলে  গেছে  সে  তো  আর  ফিরে  আসবেনা  | যদি  একটা  বাচ্চাও  থাকতো  ওদের  তবুও  একটা  কথা  ছিল  | কিন্তু  ভগবান  সেদিক  থেকেও  মুখ  ফিরিয়ে  নিলেন  | এটা ঈশ্বর মনেহয়  ঠিকই  করেছেন  | 

 নন্দিনী  এতক্ষণ চুপ  করে  কথা  শুনছিলো  আর  চোখ  থেকে  তার  টপটপ  করে  জল  পড়ছিলো  | 

--- একটা  কথা  বলবো  তোমায়  ?

--- হ্যাঁ বলো  --- আমি  তো  তোমার  মতামতটা  শুনতে  চাই  |

--- তুমি  কয়েকদিনের  মধ্যেই  সব  সম্পত্তি  অনুপ  আর  সুমনার  নামে করে  দাও  | তানাহলে  মনামী আবার  কোন  ঝামেলা  করবে  |

--- যাক  তুমি  যে  আঘাত  পেয়ে  এই  সহজ  সত্যটা  বুঝতে  পেরেছো  তারজন্য  আমি  খুশি  | আমিও  কথাটা  ভেবেছি  | কয়েকদিনের  মধ্যেই  আমি  এ  ব্যবস্থা  করবো  | আর  অনুপ  আমাদের  যে  ধরনের  ছেলে  ও  কোনদিনও  আমাদের  কোন  অবহেলা,  অযত্ন  করবেনা | 

   অনুপ  আর  সুমনার  বিয়ের  দশ  বছর  পর  অর্ণব  ব্যানার্জীর  সংসারটা  সত্যিই  সুখের  সংসার  হয়ে  উঠলো ।জীবনে ভালো কিছু পেতে গেলে অনেক সময় কষ্ট আর আঘাতের মধ্য দিয়েই আলোর রশ্মি দেখা যায়।

                               শেষ  

    


  

Saturday, August 7, 2021

পক্ষপাতিত্ব ৪

পর্ব ৪

--- আমি  একজন  ব্যবসায়ী  বাবা  | অনেক  লোক  আমার  দোকানে  আসে  | আর  তাছাড়া  আমার  ও  ভায়ের  কিছু  কমন বন্ধু  আছে  | এদের  সকলের  কাছ  থেকেই  একটু  একটু  করে  জেনেছি  | মনামীকে  দাদুই    ঠিক  চিনেছেন  | সে  চায়  এ  বাড়ির  টাকা  আর  সম্পত্তি  | আমাকে  বিয়ে  করতে  না  পেরে  এবার  বয়সে  ছোট  অরুপকে  ধরেছে  | আর  আমার  সাথে  সে  কি  করেছে  তা  তোমাদের  ছেলে  হয়ে  আমি  বলতে  পারবোনা  | তবে  তোমাদের  একটা  কথা  আমি  বলে  রাখি  সুমির  যদি  এ  বাড়িতে  অসম্মান  হয়  আমি  কিন্তু  এ  বাড়ি  ত্যাগ  করবো  | তখন  কিন্তু  তোমরা  আমাকে  দোষ  দিতে  পারবেনা  |

--- বৌয়ের  কাছে  আমাদের  নিন্দা  শুনে  সেটা  বিশ্বাস  করে  তার  হয়ে  আমাদের  সাথে  ঝামেলা  করতে  তোর  বিবেকে  বাঁধছে  না  ?

---  বৌয়ের  কাছে  শুনে  বিশ্বাস  করেছিলাম না।কিন্তু  আজ  নিজের  কানে  শুনেছি  |না  আমার  বিবেকে   বাঁধছে  না  আর  তার  কারণ  হচ্ছে  তাকে  সুখী  করা , তার  সম্মান  রক্ষা  করা  আমি  আমার  কর্তব্য  বলে  মনে  করি  | সেতো সংসারের  কাজ  করে, শুয়ে  বসে  থাকেনা  | তবে  কেন  তাকে  তোমরা  মেনে  নিতে  পারছোনা ? তোমাদের  প্রতি  সম্পূর্ণ  শ্রদ্ধা  রেখেই  বলছি  এরূপ  ঘটনার  পুনরাবৃত্তি  হলে  আমি  বাড়ি  ছাড়তে  বাধ্য  হবো  |

    কথাগুলো  বলে  অনুপ  আর  নিচে  দাঁড়ায়না | উপরে  গিয়ে  দেখে  সুমনা  তখনও কেঁদে  চলেছে  | অনুপ  তাকে  কাছে  টেনে  নিয়ে  মাথায়  হাত  বুলিয়ে  শান্তনা  দিয়ে  বলে  ,
--- তুমি  এভাবে  কাঁদলে  আমার  খুব  কষ্ট  হয়  | এতদিন  তুমি  আমাকে  বলেছো  ঠিকই  কিন্তু  সত্যি  বলতে  কি  আমি  ভেবেছিলাম  প্রত্যেকটা  পরিবারের  শ্বাশুড়ি  বৌয়ের  ঝামেলার  মতই এটাও  এক  সময়  ঠিক  হয়ে  যাবে  | মা  আমার  সাথে  যেহেতু  ভালো  ব্যবহার  ছোটবেলার  থেকে  করেননি  সেহেতু  আমি  ভাবতাম  আমার  বৌ  হিসাবে  তোমাকেও  মা  মেনে  নিতে  পারছেননা  | আমার  মত  তোমারও এটা গা  সওয়া হয়ে  যাবে  | কিন্তু  বিশ্বাস  করো  বাবাও  যে  তোমাকে  এভাবে  বলতে  পারেন  আমি  তা  স্বপ্নেও  ভাবিনি  | সেরকম  হলে আমি  এ  বাড়ি  ছেড়ে  তোমায়  নিয়ে  দূরে  কোথাও  ঘরভাড়া  নিয়ে  থাকবো  | 

               সেদিন  সারাটা  রাত সুমনা  অনুপের  বুকের  উপর  শুয়ে  কেঁদেছে  | স্বামী  স্ত্রীর  কেউই  আর  ঘুমায়নি  | আবার  ভোর  হতে  না  হতেই  অভ্যাসমত  সুমনা  বিছানা  ছেড়ে  উঠেই  রান্নাঘরে  ঢুকে  যায়  | শ্বশুর  শ্বাশুড়ির  দুজনেরই  মুখ  হাড়ি  | তারা  সুমনার  সাথে  কেউ  কোন  কথায়  বলছেনা | সুমনা  বাড়ির  সকলের  সকালের  টিফিন  রেডি  করে  টেবিলে  রাখার  সাথে  সাথেই  শ্বাশুড়ি  ডাইনিং  এ  ঢুকে  শ্বশুরের  টিফিনটা  তার  ঘরে  দিয়ে  আসেন  | সঞ্জয়বাবু  এখন  খুব  একটা  তার  ঘর  থেকে  বেরোননা | সকাল  ও  রাতের  খাবারটা  তিনি  ঘরে  বসেই  খান  | স্ত্রী  বিয়োগের  পর  থেকেই  এটা চলে  আসছে  | শ্বশুরকে  টিফিন  দেওয়া  হয়ে  গেলে  তিনি  তার  স্বামীকে  নিয়ে  খেতে  বসে  যান  | সুমনা,অনুপের  টিফিন  গুছিয়ে  রাখা  বা  খাওয়ার  কথা  কিছুই  বলেননা  | সুমনা  মনেমনে  হাসে  | তার  হাতে  তৈরী  করা  খাবার  খেতে  পারছে  সব  তার  সাথে  কথা  বন্ধ  রেখেছে  |

   ভাইপোর  বিয়েতে  অদিতি  আসতে পারেনি  | কারণ তার  স্বামীর  একটা  বাইক  একসিডেন্ট  হয়ে  তিনমাস  যাবৎ  কোমায় ছিলেন  | বিয়ের  আগেই  তার  প্রিয়  ভাইপোর  বিয়ের  মেয়ে  দেখে  গেছিলো  আর  তারপর  বাড়িতে  ফিরেই  এই  বিপত্তি  |তাই  বিয়ের  মাসতিনেক  পরে  সে  তার  মেয়েকে  নিয়ে  বাপের  বাড়িতে  এসে  দিন  পাঁচেক  থেকে  বৌদির  যে  তার  ছেলের  বৌ  পছন্দ  হয়নি  এটা সে  ভালোভাবেই  বুঝতে  পারে  | এই  পাঁচদিন  প্রতিনিয়ত  সে  বৌয়ের  নিন্দায়  শুনে  গেছে  | কিন্তু  স্বচক্ষে  সে  দেখেছে  তার  ভাইপোর  বৌটি  সংসারের  যাবতীয়  কাজ  করেও  কারও মনরঞ্জন  করতে  পারেনা  | সুমনাকে  খুব  ভালো  লাগে  অদিতির  | সে  অনুপকে  জানিয়ে  যায়  এই  বাড়িতে  থেকেই  তোরা  আলাদা  খাওয়াদাওয়া  কর  | এতো  বড়  সংসারের  জোয়াল  ওই  টুকুন  মেয়ে  টানতে  লাগলে  অসুস্থ্য  হয়ে  পড়বে | আর  তাছাড়া  আমি  নিজেই  তো  দেখলাম  দাদা  বৌদি  কেউই  সুমির  সাথে  ভালো  ব্যবহার  করেননা  | আমার  যেটুকু  বলার  আমি  বলেছি  | কিন্তু  দুজনের  কাউকেই  বুঝাতে পারিনি  | সুমিকে  নিয়ে  সুখী  থাকতে  গেলে  তোকে  আলাদা  হতেই  হবে  | আমি  তোর  সাথে  আছি  | 
   কিন্তু বাড়ি। ছাড়বো বললেই তো আর ছাড়া যায় না।ব্যবসাটা অনুপের বাড়িতেই।আবার ঠাকুমা মারা যাওয়ার সময় বারবার তাকে অস্ফুৎস্বরে বলেছিলেন,"ভাই তুই কিন্তু বাড়ি ছেড়ে কোনদিনও চলে যাবি না।আমি জানি বৌমা তোদের দুই ভাইয়ের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব করে।অরূপকে তোর মা সারাজীবন একটু বেশীই ভালোবাসে।আগে তোর বাবা অবশ্য তোকে আর অরূপকে আলাদা চোখে দেখেনি।এখন মাঝেমধ্যে দেখি তোর বিরুদ্ধেও তার অভিযোগ আছে।এটা যে তোর মা বলে বলে করিয়েছে সেটাও বুঝতে পারি।মানুষের জন্মক্ষণকে তো আর অস্বীকার করা যায় না।হয়তো তোর কপালে বাবা,মায়ের স্নেহ,ভালোবাসা পাওয়া নেই।তাই যতই সমস্যার সৃষ্টি হোকনা কেন এ বাড়ি তুই ছাড়বি না।"সেদিন ঠাকুমাকে কথা দিয়েছিল অনুপ যে সে কোনদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে না।কিন্তু সুমনার সাথে তার বাবা,মায়ের দিনকে দিন এই তিক্ততা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
  অনুপ এখন বাড়িতে থাকলেই সে তার কান খাড়া করে থাকে সুমনা নিচুতে নামলেই।তার মনে সর্বদা এখন একটা আতংক!পিসি রুচিরাকে সব জানায় অনুপ।রুচিরা তাকে বলে,"বাড়ি ছেড়ে কেন যাবি?ওই বাড়ির মধ্যেই তুই হাঁড়ি আলাদা করে নে।যদি প্রয়োজন হয় আমি আর তোর পিসেমশাই গিয়ে কথা বলবো।আমার তো এখন ঝাড়া হাত,পা।তোর ভাই দিল্লিতে ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছে।আমরা বুড়ো,বুড়ি দিব্যি আছি এখন।তুই বললেই আমরা গিয়ে কথা বলবো ওদের সাথে।"
 কিন্তু অনুপ তাদের ডেকে কোন ফয়সালা করতে চায় না।সে ঝামেলা ছাড়াই একদিন তার মা,বাবাকে ডেকে বাড়ির ভিতরেই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা জানায়।অর্ণববাবু রাজি থাকলেও নন্দিনী কিছুতেই রাজি হতে চায় না।কারণ সে ভালোভাবেই জানে তারা আলাদা হয়ে গেলে রান্নাঘরের ঘানি আবার নন্দিনীকেই টানতে হবে।কিন্তু অনুপ পরিস্কার করে জানিয়ে দেয় তার এই নিত্য অশান্তি আর ভালো লাগছে না।তাই সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটাই সে করবে।
  এদিকে পাড়ার মেয়ে মনামীর বাড়িতে আসাটা প্রায় নিয়মিত হতে লাগলো।স্বামী, স্ত্রী উভয়েই বুঝলেই অনুপের কথাগুলি একটিও মিথ্যে নয়। মনামী এ বাড়ির বউই হতে চায়।সে প্রথমে অনুপকে টার্গেট করেছিলো তাকে বশে আনতে না পেরে অরূপকে এবারে বেশ ভালোভাবে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধেছে।মেয়েটি যে খুব একটা ভালো নয় এটা তাদেরও কানে এসেছে।কিন্তু মনামী সম্পর্কে তারা এতটাই প্রসংশা করে ফেলেছেন পরিবার এবং বাইরের লোকের কাছে এখন পিছিয়ে আসা মানে অনুপ সুমনার কাছে ছোট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ কিনা তাদের ইগোতে আঘাত লাগা।তাই তারা এ বিয়েটাকে মেনে নেন অরূপের জীবনকে বাজি রেখেই।
  অত্যন্ত গরীব ঘরের মেয়ে মনামী।সে যে শুধুমাত্র টাকা আর সম্পত্তির লোভেই এ বাড়ির বউ হতে চেয়েছে এ কথা সঞ্জয়বাবু বারবার তার ছেলে এবং বউকে বোঝানোর চেষ্টা করেও সফল হননি।কারণ এ ক্ষেত্রে নন্দিনী আর তার স্বামী ছিলেন জ্ঞান পাপীর মত।তারা জেনে বুঝেও শুধুমাত্র জেদের বসে অর্থাৎ কিনা অনুপ সুমনার কাছে ছোট হবেন না মনে করেই তারা বেশ ধুমধাম সহকারে তাদের বিয়ে দেন।এখন সঞ্জয়বাবু বৃদ্ধ ফলত তিনি অসহায়!তার কথার দাম এখন আর এ সংসারে নেই।কিন্তু অভিজ্ঞ মানুষটির সবকিছু বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি।এক সময় এই সংসারে তার কথার অন্যথা কখনোই হয়নি।কিন্তু আজ আর তার কথার কোন দাম ছেলে,বউ আর দেয় না।তিনি তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন মানুষের বয়স হয়ে গেলে সে পুরনো আসবাবপত্রের মতই ঘরের এককোনে পড়ে থাকে।

ক্রমশঃ 


  

Thursday, August 5, 2021

পক্ষপাতিত্ব ৩

পক্ষপাতিত্ব

   ৩ পর্ব

  জ্যোতিষী সেদিন নন্দিনীকে যা বলেন তার সারমর্ম করলে এটাই দাঁড়ায় অনুপের বৌ হবে সুন্দরী,শিক্ষিত, বুদ্ধিমতী।নন্দিনী শ্বাশুড়ী হয়েও অনুপের বউকে মারাত্মকভাবেই হিংসা করতে থাকবে।প্রতি পদে পদে তাকে হেয় করার চেষ্টা করতে থাকবে যা অনুপের চোখ এড়াবে না।সে তার প্রতিবাদ করবে আর তাতেই ঝামেলা চরম আকার নেবে।জ্যোতিষীর কথা অনুযায়ী মানুষ অনেক সময় অনেক কাজ হয়ত করতে চাইছে না কিন্তু তার ভবিতব্য তাকে সেই পথেই চালিত করছে।এটাই ভাগ্যের ফের।
   নিম্নমধ্যবিত্ত  পরিবারের  মেয়ে  নন্দিনী  | একভাই  আর  একবোন  তারা  | নন্দিনী  ছোট  আর  সুমিত  বড়  | সুমিতের  একটা  মুদিখানার  দোকান  আছে  | দুই  ভাইবোনই উচ্চমাধ্যমিক  পর্যন্ত  পড়ে  আর  পড়েনি  | ছেলেমেয়ে  দুটির  ইচ্ছা  থাকলে  তাদের  বাবা  সুশোভন  চক্রবর্তী  কষ্ট  করে  হলেও  তাদের  পড়াতে পারতেন  কিন্তু  দুজনের  কেউই  আর  পড়তে  রাজি  হলোনা  | একটা  প্রাইভেট  ফার্মে  সামান্য  মাইনের  চাকরি  করতেন  সুশোভনবাবু  | সামান্য  কিছু  রিটায়ারমেন্টের  সময়ে  টাকাকড়ি  পেয়েছিলেন  নন্দিনীর বিয়ের   জন্য  কিছু  রেখে  বাকি  টাকা  দিয়ে  তিনি  ছেলেকে  বাড়ির  মধ্যেই  একটি  মুদিখানার  দোকান  দিয়ে  দেন  | বাড়িটা  রাস্তার  উপরে  হওয়ায়  এই  সুবিধাটুকু  পেয়েছিলেন  | সুশোভনবাবু  পাড়ার  লোক  মারফৎ জানতে  পারেন  তার  মেয়ে  নন্দিনী  একটি  ছেলের   সাথে  মেলামেশা  করছে  | ছেলেটি  সম্পর্কে  খোঁজ  খবর  নিয়ে  তিনি আরও জানতে  পারেন  তার  স্বভাবচরিত্র  ভালো  নয়  | পারিবারিক  সচ্ছলতাও  নিম্নমানের  | এমতাবস্থায়  তার  মাথায়  আকাশ  ভেঙ্গে পরে  | তিনি  উঠে  পরে  লাগেন  মেয়ের  জন্য  ছেলে  দেখতে  | আর  ঠিক  তখনই সঞ্জয়বাবু  তার  বড়  ছেলের  জন্য  হন্যে  হয়ে  একটি  মেয়ে  খুঁজছেন  | নন্দিনীকে  দেখে  পছন্দ  করে  অর্ধেক  কথা  পাকা  করে  তিনি  নিশ্চিন্তমনে  বসে  ছিলেন  | সুশোভনবাবু  তার  মেয়েকে  ছেলেটির  সাথে  মেলামেশা  করতে  নিষেধও  করেন  | এখনকার  দিনে  মুঠোফোনের  এই  রমরমার  ফলে  উঠতি  বয়সী  ছেলেমেয়েগুলো  অনেকসময়ই ফোনের  মাধ্যমে  কথা  আদানপ্রদানের ফলে  ভুলপথে  পা  বাড়ায়  | নন্দিনীও  ঠিক  তাই  করলো  | পরিণামে  তার  জীবনে  যা  সর্বনাশ  হওয়ার  হয়ে  গেলো  | বুঝতে  পেরে  সে  তার  প্রেমিক  রজতের  কাছে  ছুঁটে গেছিলো  | সে  তাকে  জানিয়েও ছিলো  বর্তমানে  তার  শারীরিক  অবস্থার  কথা  | কিন্তু  রজত  তাকে  প্রত্যাখ্যান  করে  | বাড়িতে  ফিরে  এসে  নন্দিনী  কাঁদতে  কাঁদতে  তার  মায়ের  কাছে  এসে  যখন  সবকিছু  বলছিলো  দরজার  অপরপ্রান্ত  থেকে  তার  বাবা  সবকিছু  জানতে  পেরে  দুদিন  থম  মেরে  বসে  থেকে  নিজেকে  শক্ত  করে  একবার  শেষ  চেষ্টা  করার  জন্য  সঞ্জয়বাবুর  কথা  অগ্রাহ্য  করে  তার  বাড়িতে  উপস্থিত  হলেন।
     নন্দিনীর পরের সন্তানটিও ছেলে হয়।কিন্তু চেহারা,স্বভাব আচার আচরণে সে অনুপের থেকে সম্পূর্ন আলাদা।তাকে নিয়ে স্কুল এবং খেলার মাঠ অভিযোগের অন্ত নেই।সমবয়সীদের সাথে প্রতিদিনই তার মারপিট লেগেই থাকে।নন্দিনী ছোট ছেলেকে নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত থাকলেও অর্ণব কিন্তু নন্দিনীর এই পক্ষপাতিত্বটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।অনুপ তার নিজের সন্তান না হলেও তার প্রতি অর্ণবের একটা আলাদা অনুভুতি কাজ করে।শত হোক তার মুখ থেকেই তো সে প্রথম বাবা ডাকটা শুনেছে।আর অদ্ভুতভাবে অনুপের কিছু স্বভাবের সাথে অর্ণবের স্বভাবের কিছু মিল ও অর্ণব খুঁজে পায়।মাঝে মাঝে বদ্ধ দরজার ভিতরে স্বামী,স্ত্রীর চাপা বচসাও হয়।
    কন্যাসম রুচিরা ছেলেবেলা থেকেই সঞ্জয়বাবুদের বাড়িতেই মানুষ।সঞ্জয়বাবু যখন পূর্ববাংলা থেকে এদেশে আসেন তখন তাদের সাথেই তার বাল্যবন্ধু অখিলবাবুও তার পিতৃপুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে সঞ্জয়বাবুর মতই একটি আস্তানা পেয়ে যান।খুব পাশাপাশি না হলেও একই পাড়ার মধ্যে দুই বন্ধু তাদের নিজেদের মত করেই আবার সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।কিন্তু হঠাৎ করেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত রুচিরাকে ছেড়ে তার বাবা,মা দুজনেই ট্রেন অ্যাকসিডেন্ট এ মারা যান।মৃত্যুকালে হাসপাতালের বেডে শুয়ে বন্ধুর হাতদুটি ধরে অখিলবাবু তার চৌদ্দ বছরের মেয়েটির সমস্ত দায়িত্ব সঞ্জয়বাবুকে দিয়ে যান।বাল্যবন্ধুর কথা রাখতেই তিনি রুচিরাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন এবং উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে রেলে চাকুরীরত ছেলের সাথে বিয়ে দেন।রুচিরার বাবার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে তিনি রুচিরার নামেই ফিক্সড করে রাখেন। সঞ্জয়বাবু রূচিরার লালনপালন ও শিক্ষার জন্য রুচীরার বাবার কোন টাকায় ব্যয় করেন না। সম্পূর্ণ নিজের খরচে তিনি মেয়েটিকে বড় করে তোলেন।
  ওই সংসারে তখনো অদিতি আসেনি। দাদারা তাকে ছোট বোন হিসেবে খুবই ভালোবাসে।আর সঞ্জয়বাবু এবং অন্নদাদেবী তাকে কন্যাসম দেখেন।খুব একটা কাজও সংসারে কখনোই করতে হয়নি কারণ কাজের লোক ছাড়াও অন্নদাদেবী নিজের হাতেই সবকিছু সামলাতেন।তাই বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির সংসারে কাজ করা নিয়েই প্রথম সমস্যার সৃষ্টি হয়।আর সেখান থেকেই অশান্তির সূত্রপাত।
   বিয়ের পরে রুচিরা তার স্বামীর সংসারে মানিয়ে নিতে কিছুতেই পারছিল না।নিত্য অশান্তি হওয়ায় সে তার স্বামীকে আলাদা ঘর নিতে অনুরোধ করে।কিন্তু স্বামী তাকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয় 'বাবা,মা বহু কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছেন।স্ত্রীকে ভালো রাখা তার দায়িত্ব ঠিকই কিন্তু সেটা কখনোই বাবা,মাকে কষ্ট দিয়ে নয়।তোমায় বিয়ে করেছি তোমার প্রতিও আমার দায়িত্ব আছে।কিন্তু সে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি আমার বাবা,মাকে অবহেলা করা হয় তাহলে দায়িত্ব পালনের ধরনটা আমাকে একটু পাল্টাতে হবে।তুমি যদি একেবারেই আমার মা,বাবার সাথে অ্যাডজাস্ট করতে না পারো সে ক্ষেত্রে তুমি তোমার বাপের বাড়িতে চলে যেতে পারো অবশ্য যদি সেটা তোমার কাছে সন্মানের হয়।আমি মাসের প্রথমেই তোমার খাওয়া পরার টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবো।রুচিরা তার বড়দাকে সব জানায়।অর্ণব এসে রুচিরাকে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে যায় ও পড়ে সবাই মিলে তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে আবার তাকে তার নিজ সংসারে ফেরত দিয়ে যায়। আস্তে আস্তে রুচিরা মানিয়ে নিতে সমর্থ হয় তার নিজ সংসারে।
।। রুচিরার খুব ইচ্ছা তার মাসতুত ননদের সাথে অনুপের বিয়েটা দেবে।কিন্তু সুমনা অনুপের থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট।আর তাছাড়া অনুপ সুমনাকে বেশ কয়েকবার দুর্গাপূজার সময় অনুপদের বাড়িতে দেখলেও কোনদিন অনুপের সাথে কোন কথা হয়নি।অনুপ এতটাই লাজুক প্রকৃতির ছেলে পুজোর সময় বিশাল বাড়ির যেখানে মহিলা মহল সেখান থেকে সে বিশ হাত দূরে।রুচিরা পুজোর সময় এসে আভাসে ইঙ্গিতে এমন কি সরাসরিও অনেকবার মেয়েটাকে দেখতে তার সাথে কথা বলতে অনুপকে বলেছে।কিন্তু মুখচোরা অনুপ তার এই পিসির কথায় কোনদিন কোন পাত্তাই দেয় না।অদিতি ফি বছর শুধুমাত্র দুর্গাপুজোর সময়ই বাপের বাড়িতে আসার ছাড়পত্র পায় পনেরদিনের জন্য।রুচিরা এবং বয়সে অনেক ছোট অদিতি দুজনে মিলে ঠিক করে এবার সুমনার সাথে অনুপের বিয়ের কথাবার্তা বলেই তারা যে যার সংসারে ফিরবে।
 
  বাড়ির কর্তা, কর্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী অনুপের এবার বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে দেখতে হবে।সঞ্জয়বাবু দু একটি মেয়ে দেখলেও মনের মত পাত্রীর সন্ধান তিনি পান না।আর ঠিক তখনই দুই বোন মিলে সুমনার সাথে অনুপের বিয়ের কথাটা পারে।অন্নদাদেবী রাজি হলেও সঞ্জয়বাবু বেঁকে বসেন। কারণ সুমনার বাপের বাড়ি এ দেশীয়।আর তিনি এ দেশীয়দের মোটেই পছন্দ করেন না।কর্তা,গিন্নী দুজনেই এই নিয়ে ঝামেলা শুরু করেন।
--- শোনো গিন্নী আমি কিছুতেই ওই ঘটি বাড়ির মেয়েকে আমার নাতবৌ করবো না।
--- কেন ঘটিরা কি তোমার পাকা ধানে মই দিয়েছে?মেয়েটা দেখতে সুন্দর,লেখাপড়া জানে।সেই ছেলেবেলার থেকে রুচিরা ওকে চেনে।সংসারের কাজকর্মও সব জানে।আমার বড় নাতির বিয়ে আমি যেখানে ঠিক করবো সেখানেই হবে।
--- আর আমি ঠুঠো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকবো ?
  এ ঝগড়া চলতেই থাকে অনুপের বিয়ের কথা উঠলেই।এরই মাঝে অনুপ এক বিশেষ প্রয়োজনে এসপ্লানেড থেকে ফেরার পথে রাস্তায় জটলা দেখে তার বাইকটা থামিয়ে ভির ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখে সুমনা এক বয়স্ক ভদ্রলোকের মাথাটা কোলে নিয়ে রাস্তার উপরে বসে সকলের কাছে কাকুতি মিনতি করছে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটু সাহায্য করতে।অনুপকে দেখে পরিচিত লোক হওয়ায় সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়।তাকে অনুরোধ করে ভদ্রলোকটি হাসপাতাল নিয়ে যেতে তাকে সাহায্য করতে।অনুপ জানতে চায় কে হন উনি তার?
--- পথচারী।আমার চোখের সামনেই একটা বাইক ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়।কিন্তু কেউই উনার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে না।
 দুজনে মিলে একটা উবের ধরে তাকে হাসপাতাল নিয়ে যায়।অনুপের বাইকটা সেখানেই তালাবন্ধ অবস্থায় থাকে।ভদ্রলোক জ্ঞান হারিয়েছিলেন।তার পকেট হাতড়ে একটি মোবাইল পাওয়ায় ডায়াল লিষ্ট দেখে সর্বাপেক্ষা বেশি ফোন করা  দু একটি নম্বরে ফোন করে তার বাড়ির সাথে কন্টাক্ট করতে পারে।
 সেদিন অনুপই সুমনাকে বাড়িতে বাইকে করে পৌঁছে দেয়।কিছুটা হলেও অনুপের সুমনাকে ভালো লেগে যায়।রুচিরা সুমনার কাছে সব জানতে পেরে এই সুযোগটাকেই কাজে লাগায়।
  
  দুই  বাড়িতেই  বিয়ের  তোড়জোড়  শুরু  হয়  | বিধানবাবু  কোন  কার্পণ্য  করেননা  তার  সুমির  বিয়েতে  | ছন্দাদেবী  ও  বিধানবাবুর  আতিথেয়তায়  সঞ্জয়বাবুর  বাড়ির  সকলেই  খুব  খুশি  | পাড়াপ্রতিবেশী , আত্মীয়স্বজন মিলে পুরো  বাড়িটা  বিয়ের  আগে  পরে  মিলে দিনসাতেক গমগম  করার  পর  এখন  বাড়িটা  পুরো  শান্ত  | ছন্দাদেবী  খুবই  ভেঙ্গে পড়েন  | বিতান  দিদি  চলে  যাওয়ার  পর  পুরো  নিশ্চুপ  হয়ে  যায়  | সবসময়  দিদির  সাথে  মারপিট  , ঝামেলা  লেগেই  থাকতো  | আজ  দিদি  নিজের  বাড়ি  ছেড়ে  চলে  যাওয়াতে  নিজের  ঘরে  দরজা   বন্ধ  করে  একাকী  কেঁদে  চলেছে  | বিধানবাবু  তাকে  ডেকে  এনে  ছন্দাদেবীর  কাছে  বসতে  বলেন  | মেয়ে  অন্তঃপ্রাণ  মানুষটি  নিজের  বুকে  পাথর  বেঁধে  ছেলে  আর  স্ত্রীর  দিকে  নজর  রেখে  চলেছেন  | মাঝে  মাঝে  সকলের  অলক্ষ্যে  অবাধ্য  চোখদুটি  মুছে  চলেছেন  | 

      অষ্টমঙ্গলের  পরেরদিন  থেকেই  সুমনাকে  ডেকে  নন্দিনী  রান্নাঘরের  দায়িত্ব  সব  বুঝিয়ে  দেয় | নিজে  রান্নাঘরে  আর  কাজের  জন্য  ঢোকেননা  |অন্নদাদেবী এখন আর আগের মত হাঁটাচলা করতে পারেন না।তাই রান্নাঘরের দায়িত্ব নন্দিনীকেই পুরোটা দেখতে হত।কিন্তু সুমনা এ বাড়িতে  আসার পরে তার হাতেই দায়িত্ব সোপ অধিকাংশ  সময়  সেখানে  থেকে  সর্বদা  সুমনার  কাজের  খুঁদ ধরে  চলেন  | সুমনা  মুখ  বন্ধ  করে  সব  কাজ  করে  চলে  | কিন্তু  কখনোর   জন্যই নন্দিনী  সুমনার  কাজে  সন্তুষ্ট  হননা  | সুমনা  রান্নাঘরের  সব  দায়িত্ব  নিষ্ঠা  ভরে  করলেও কাউকে  খাবার  দেওয়ার  অধিকার  তার  ছিলোনা | এমনকি  নিজের  স্বামীকেও  নয়  | খাবার  দেওয়ার  সময়  নন্দিনী  ঠিক  এসে  উপস্থিত  হতেন  | সুমনা  খেয়াল  করে  দেখেছে সবসময়   ছোট  মাছের  পিসটাই  অনুপকে  দেওয়া  হয়  | তরকারির  পরিমাণ ও  তাই  | মাথা  ঘামিয়েও  এর  কারণ  সে  বুঝতে  পারেনা  | অনুপকে  বললে  সে  বলে ," আরে তাতে  কি  হবে ? আমার  তাতে  কোন  অসুবিধা  হয়না | এসব  নিয়ে  তুমি  একদম  ভাববেনা আর  মোটেই  মন  খারাপ  করবেনা |" এভাবেই  সুমনা  মানিয়ে  নেওয়ার  চেষ্টা  করে  যায়  | কিন্তু  সবকিছু  করেও  নন্দিনীর  মন  সে  পায়না  | স্বামীর  কাছে  বলতে  গেলে  সেও তাকে  মানিয়ে  নিতেই  বলে  | 
  
  বাড়ির  সকলের  সাথে  বিশেষ  করে  মায়ের  সাথে  তার  রোজই কথা  হয়  | কদিন  ধরেই  মায়ের  কাছ  থেকে  জানতে  পারে  বাবার  শরীরটা  খুব  একটা  ভাল যাচ্ছেনা  | হঠাৎ  সেদিন  দুপুরের  দিকে  ফোন  পায় বাবার  বুকে  ব্যথা  হওয়ায়  সরকারি  হাসপাতালে  তাকে  নিয়ে  যাওয়া  হচ্ছে  | সঙ্গে  সঙ্গেই  অনুপ  আর  সুমনা  চলে  আসে  | আত্মীয়স্বজনেরাও  কেউ  কেউ  হাসপাতাল  এসে  উপস্থিত  হয়  | কিন্তু  ডাক্তারের  সব  প্রচেষ্টা  আর  বাড়ির  ও  শুভার্থীদের  প্রার্থণা কোনোই  কাজে  আসেনা  | চলে  যান  বিধানবাবু  তার  সোনার  সংসার  ফেলে  | সুমনা  মা  আর  ভায়ের  কাছে  মাসখানেক  থেকে  তারপর  শ্বশুরবাড়ি  ফেরে  | অনুপ  অবশ্য  কাজ  মিটে গেলেই  চলে  যায়  | অনুপের  কাছে  তার  মা  সুমনার  বাপের  বাড়িতে  থাকা  নিয়ে  ঘ্যান  ঘ্যান  করলেও  চুপচাপ  স্বভাবের  অনুপ  তার  কোন  উত্তর  দিতো  না  | সুমনা  ফেরার  পরেই নন্দিনী  যেন  আরও তার  অত্যাচারের  মাত্রা  বাড়িয়ে  দেয় | উঠতে  বসতে  তাকে  কথা  শুনাতে লাগে  এতদিন  কোন  আক্কেলে  সে  বাপেরবাড়ি বসে  ছিল  | এখন  মাঝে  মধ্যেই  সুমনা  শ্বাশুড়ির  কথার  প্রতিবাদ  করে  | আর  যখনই সে  তার  শ্বাশুড়ির  কথার  পরে  কথা  বলে  তখনই তার  শ্বশুরমশাই  চিৎকার  চেঁচামেচি  শুরু  করেন  | একদিন  সামান্য  এক  বিষয়  নিয়ে  নন্দিনী  ও  সুমনার  মধ্যে  বাকবিতণ্ডার  মধ্যে  হঠাৎ  অর্ণববাবু  এসে  সুমনার  উপর  চড়াও  হন  | হুট্  করে  তিনি  বলে  বসেন ,
--- তোমার  বাবা  মা  কি  তোমায়  কোন  শিক্ষায়  দেননি  | বড়দের  সম্মান  টুকু  করার  শিক্ষাও  কি  পাওনি?এর থেকে মনামীর সাথে বিয়ে হলেই ভালো হত।
সদ্য পিতা হারা  সুমনা  এ  কথা  শুনে  কেঁদে  দিয়ে  বলে  ,
--- তোমরা  আমাকে  যা  খুশি  তাই  বলো  আমি  মেনে  নিই কিন্তু  আমার  বাবা ,  মাকে  তুলে  কোন  কথা  বলবেনা  | আজ  আমার  বাবা  বেঁচে  নেই  তবুও  তোমাদের  কথার  ঝাঁঝ  তাকে  নিয়েও  চলছে  | আর  এই  যে  বললে  বড়দের  শিক্ষা  সম্পর্কে  --- আমার  বাবা  মা  তোমাদের  গুরুজন  নয় ? তাদের  অসম্মান  করছো  কোন  শিক্ষায়  ?
নিচুতে  চেঁচামেচি  শুনে  ঠিক  সেই  মুহূর্তেই  অনুপ  নিচে  নেমে  এসেছিলো  | সুমনার  কথা  শুনে  তার  শ্বশুর  তার  দিকে  তেড়ে  যান  আর  ঠিক  সেই  মুহূর্তেই  অনুপ  এসে  সুমনার  সামনে  দাঁড়ায়  | সুমনা  হাউ  হাউ  করে  কেঁদেই  চলেছে  তখনও |
--- তুমি  উপরে  যাও সুমি  | এখানে  আর  একটুও  দাঁড়াবেনা   | আমি  একটু  পরে  আসছি  | 
সুমনা  কাঁদতে  কাঁদতে  উপরে  চলে  গেলো  |
  খুব  শান্তভাবে  অনুপ  বাবার  দিকে  তাকিয়ে  বললো ,
--- কিসব  কথা  বলছো  তুমি ? আমি  তো  ভাবতেই  পারছিনা  তুমি  এইসব  কথা  বলতে  পারো  | এই  কথাগুলো  যদি  আমি  নিজের  কানে  না  শুনতাম  কোনদিনও  বিশ্বাস  করতে  পারতামনা  তুমি  এ  ধরণের কথা  বলতে  পারো  | সুমনার  শিক্ষা  নিয়ে  কথা  বলছো ? ওতো ঠিক  কথাই বলেছে  --- তুমি  শিক্ষার  বড়াই  করছো  অথচ  তোমার  শিক্ষা  নিয়ে  ওর  বাবা  মাকে  অপমান  করছো ?সবেমাত্র ও  ওর  বাবাকে  হারিয়েছে  | আর  তাকে  নিয়ে  ওকে  কথা  শুনাচ্ছ ?এখন  দেখছি  আমাকে  এতদিন  ও  যা  বলেছে  তোমাদের  সম্পর্কে  তা  সবই  সত্যি  | অথচ  আমি  বিশ্বাস  করিনি  | আজ  যদি  সুমি  ওর  মা  ভাইকে  তোমাদের  বলা  এই  ভাষাগুলো জানায়  তাহলে  কি  তোমাদের  আত্মসম্মানে  লাগবে  না ? কি  চোখে  তার  মা  ভাই  দেখবে  তোমাদের ? মেয়ে  তো তোমরা  পছন্দ  করেছো  আমি  তো  তোমাদের  জোর  করিনি  ওখানে  বিয়ে  দেওয়ার  জন্য ?আর  বিয়ে  যখন  করেছি  ওর  সম্মান  রক্ষা  করা  আমার  কর্তব্য  | তুমি   মনামীর  কথা  বলছো ? ভেবোনা  ও  এ  বাড়িতে  বৌ  হয়েই  ঢুকবে  একদিন  | বাইরের  খবর  তো  তোমরা  রাখোনা  - একসময়  সে  ভাইকে  রাখি  পরিয়ে আমায়  বিয়ে  করতে  চেয়েছিলো  কিন্তু  পারেনি  কারণ  আমি  তাকে  পছন্দ  করিনা  |   একমাত্র  দাদুই  তাকে  ঠিক  চিনেছিলেন  | আর  এখন  সে  ভাইকে  বিয়ে  করে  এ  বাড়িতে  ছোট  বৌ  হিসাবে  ঢুকতে  চায়  | ভায়ের  থেকে  চার  বছরের  বড়  সে  | আমি  অনেক  বুঝিয়েছি  তাকে  | ভাই  আগে  যাকে ভালোবাসতো  সে  মেয়েটির  সাথে  ওর  ব্রেকআপ হয়ে  গেছে  | বলতে  পারো  মনামীই ঘটনাটা  ঘটিয়েছে  | 

--- তুই  এতো  কথা  জানলি  কি  করে  ?

  ক্রমশঃ



    

Wednesday, August 4, 2021

পক্ষপাতিত্ব ২

পর্ব ২

    যতদিন  নন্দিনী সংসারে  একা বৌ  ছিল  ঠিক  ততদিনই  সংসার  ছিল  সুখের  এবং  নির্ঝঞ্ঝাট | কিন্তু  মেজছেলের  বিয়ে  ঠিক  হওয়ার  পর  থেকেই  শ্বাশুড়ির  সাথে  তার  মতের  অমিল  হতে  শুরু  করে | তবে  একথা  অস্বীকার  করবার  কারো  ক্ষমতা  হবেনা  এ  সংসারে  নন্দিনী  প্রকৃতভাবেই   লক্ষ্মী  রূপেই  এসেছে | শুধু তার অতীতটা  অর্ণব ছাড়া বাড়ির অন্য কেউ জানেনা |  অর্ণব  আরও কয়েকটি নুতন   শোরুম  খুলেছে  , মেজোছেলে  তিনবছরের  মধ্যে  অফিসার  পদে  উন্নীত  হয়েছে  অদিতির  ভারত  পেট্রোলিয়াম  উচ্চপদে  চাকুরীরত  ছেলের  সাথে  বিয়ে  হয়েছে  এবং  সে  খুব  সুখেই  আছে | অদিতি  গ্রাজুয়েশন  শেষ  করে  বড়দার কথামত  বিএড  ট্রেনিংটা  নিয়েছিল  | ট্রেনিং  শেষের  মাস  ছয়েকের  মধ্যেই  সে  সরকারি  স্কুলে  একটি  চাকরিও  পেয়ে  যায় | যেহেতু  সবকিছুই  নন্দিনী  এই  বাড়িতে  ঢোকার  মুহূর্ত  থেকে  হয়েছে  তাই  সকলের  কাছে  'লক্ষ্মী  বৌ  লক্ষ্মী  বৌ '- শুনতে  শুনতে  তার  নিজের  মধ্যেও  কেমন  একটা  অহংকারবোধ  কাজ  করতে  থাকে | ভাবখানা  মাঝে  মাঝে  তার  এমন  প্রকাশ  পায় ' যেন  তোমরা  ভালোভাবে  খেয়েপরে  বেঁচে  আছো  সে  যেন  আমারই দান | 
  নন্দিনী  ও  অর্নবের  বিয়ের  পর  তারা  একদিন  রাতে  সিনেমা  দেখে  যখন  নিজেদেরই  গাড়িতে  উঠতে  যাবে  ঠিক  তখনই দুটি  ছেলে  তাদের  দিকে  এগিয়ে  আসে | তাদের  মধ্যে  একটি  ছেলে  নন্দিনীর  খুব  কাছে  এসে  দাঁড়িয়ে  সরাসরি  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  বলে ,
--- এখন  বুঝতে  পারছি  বড়লোকের ছেলেকে  পেয়ে  আমার  সাথে  প্রেম  প্রেম  খেলাটা  কেন  বন্ধ  করে  দিলে | সুন্দরী  তকমা  তো  তোমায়  দেওয়া  যায়না  ; তাই  ভেবেছিলে  হয়তো  আমার  গলায়  ঝুলে  পড়বে | কিন্তু  হঠাৎ  করে  বড়  গাছে  নাও  বেঁধে  ফেললে | কপাল  মাইরি  তোমার ! এই  চেহারা  নিয়ে  বড়লোকের  বাড়ির  বৌ  হয়ে  গেলে |' অর্ণব প্রথমে    কিছুটা  হকচকিয়ে  গেলেও  পরে  বেশ  জোর  দিয়েই  বলে ,
--- বিয়ের  আগে  অনেকের  সাথেই  অনেকের  সম্পর্ক  গড়ে  ওঠে | সব  সম্পর্ক  ছাদনাতলা  পর্যন্ত  পৌছায়না | তাই  বলে  জীবনটা  তো  থেমে  থাকেনা |
--- আরে ব্যস এতো  দেবতার  মত  স্বামী  পেয়েছো | যাও সুখে  ঘরকন্যা  করো | আমি  আর  বিরক্ত  করবোনা | তবে আমার সাথে ঘটে যাওয়া কিছুটা সময় এই ভদ্রলোকটিকে তো বলতেই হবে | দেখো উনি ফিরিয়ে দিলে কিন্তু আমি ঠাই দেবোনা এটা মনে রেখো | 
এতক্ষণ নন্দিনী  স্বামীর  পিছনে ভয়ে  জড়সড়  হয়ে    দাঁড়িয়ে  ছিল | এবার  অর্নবের  ইশারা  পেয়ে  গাড়িতে  উঠে  চুপ  করে  বসে  থাকলো | রাস্তায়  তাদের  কোন  কথায়  আর  হলনা | নন্দিনী  এক  অজানা  আশঙ্কায় দুরুদুরু  বুকে  রাতে  বিছানায়  শুতে  গেলো | 
অর্ণব  তাকে  বললো ,
--- কিছু  কথা  ছিল  তোমার  সাথে |
নন্দিনীর  বুকটা  ধড়াস  করে  উঠলো | কোনরকমে  উচ্চারণ  করলো ,
--- হ্যাঁ বলো  ---
--- আজকে  যে  ঘটনা  ঘটেছে  বাড়ির  কেউ  যেন  না  জানে | তোমার  অতীতে  কি  ঘটেছিলো  তা  জানার  কোন  আগ্রহ  আমার  নেই | অতীত  একদিন  না  একদিন  ঠিক  মুছে  যায় | বর্তমান  আর  ভবিৎষত  নিয়েই  মানুষের  জীবন | এ  কটাদিনে এটুকু  অন্তত  বুঝতে  পেরেছি  আমার  প্রতি  তোমার  ভালোবাসার  কোন  খামতি  নেই | 
  নন্দিনী  হাউহাউ  করে  কাঁদতে  থাকে  | কাঁদতে  কাঁদতেই  বলে ,
--- খুব  বড়  একটা  অপরাধ  করেছি  | আমায়  তুমি  তাড়িয়ে  দিওনা  |
--- কি  এমন  অপরাধ  করেছো  --
নন্দিনী  পায়ের  উপর  আছড়ে  পরে  কাঁদতে  থাকে  | কাঁদতে  কাঁদতেই  বলে  ,
--- সেদিন  রাস্তায়  যে  ছেলেটি  আমাদের  পথ  আগলে  দাঁড়িয়েছিল  ওকে  আমি  ভালবাসতাম  | কিন্তু ও আমায় ভীষণভাবে ঠকিয়েছে | আমার ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে ----   ওর  সন্তানই  আমার  গ ---কথা শেষ করতে পারেনা , নন্দিনী ডুকরে কেঁদে ওঠে 
অর্ণব  আঁতকে ওঠে | বহুক্ষণ সে  চুপচাপ  বসে  থাকলো  | নন্দিনী  তার  পায়ের  উপরেই  পরে  আছে  | তারপর  আস্তে  আস্তে  নিজেকে  কিছুটা  সামলে  নিয়ে  বলে  ,
--- পরিবারের  মানসম্মান  ধূলিসাৎ  হয়ে  যাবে  একথা  বাইরে  জানাজানি  হলে  | তুমি  যেমন  আছো  তেমনিই  থাকো  | শুধু  আমাকে  একটু  সময়  দাও  এসবকিছু  মানিয়ে  নিতে  | তারপর  আস্তে  আস্তে  নন্দিনীকে  পায়ের  উপর  থেকে  তুলে  ধীরপায়ে  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  যায়  | আর  নন্দিনী  সেখানে  বসেই  সারাটা  রাত কেঁদেই  চলে  | কিন্তু এই বিশাল লজ্জার কথাটা আজীবন ধরে ভারী পাথরের মত অর্ণবের বুকের উপর চেপে বসে থাকলেও কোনদিন সে এ সম্পর্কে নন্দিনীকে কিছুই বলেনি |

  রান্নাঘরের  দায়িত্ব  শ্বাশুড়ি  বৌ  দুজন  মিলেই  পালন  করে | কিন্তু  যেদিন  থেকে  অভিকের  বিয়ের  জন্য  মেয়ে  দেখা  শুরু  হয়েছে  সেদিন  থেকেই  নন্দিনী  কারণে অকারণে শ্বাশুড়ির  সঙ্গে  একটু  মেজাজি  সুরেই  কথা  বলতে  শুরু  করে | প্রথম  প্রথম  অন্নদাদেবী  বুঝতে  না  পারলেও  সময়  যত এগোতে  থাকে  অভিজ্ঞ  অন্নদাদেবী  ব্যাপারটা  ধরে  ফেলেন |নন্দিনীর  প্রথম  সন্তান  অনুপের   বয়স  তখন  মাত্র  ছমাস | 
  অভিক  বিয়ে  করে  বৌ  নিয়ে  বাড়িতে  আসে | প্রথমে  অন্নদাদেবী  ও  পরে  নন্দিনী  বৌ  বরণ করে  ঘরে  তোলে | শ্বাশুড়ির  সাথে  হাতে  হাত  লাগিয়ে  নন্দিনী  সব  কাজ  করে  ঠিকই  কিন্তু  মুখটা  সে  মাঝে  মাঝে  হাড়ি  করেই  রাখে | শ্বাশুড়ি  একটু  ফাঁকা  পেয়ে  নন্দিনীকে  বললেন ,
--- আমি  এখনো  বেঁচে  আছি  বৌমা | তোমার  এতো  চিন্তার  কোন  কারণ  আমি  খুঁজে  পাচ্ছিনা  | হ্যাঁ অর্নবের  রোজগার  বেশি  বলে  তাকে  সংসারে  সিংহভাগটি  দিতে  হবে  তা  কিন্তু  নয় | তোমার  শ্বশুরমশাই  ভালো  টাকাই পেনশন  পান  | অভিকও  যে  মাস  থেকে  রোজগার  করতে  শুরু  করেছে  সেই  মাস  থেকেই  আমার  হাতে  সংসার  খরচের  টাকা  তুলে  দেয় | আগামীমাস  থেকে  সে  আরও বেশি  দেবে  আমার  সাথে  কথা  হয়েছে | আর  সংসার  খরচ  থাকে  আমার  কাছে | তোমার  তো  এসব  নিয়ে  ভাবার  কোন  কারণ নেই  | আর  আমি  কোন  অবস্থাতেই  অর্নবের  কাছে  বাড়তি  কোন  টাকা  চাইবোনা | 
ধরা  পরে  গিয়ে  নন্দিনী  কিন্তু  কিন্তু  করে  জবাব  দিলো ,
--- আমি  এসব  কিছু  ভাবিনি  মা --- |
অভিজ্ঞ  আনন্দাদেবী  এ  নিয়ে  কথা  না  বাড়িয়ে  শুধু  ছেলে বৌয়ের  মুখের  দিকে তাকিয়ে  একটু  হাসলেন | 
  নন্দিনীর  বাপের  বাড়ি  থেকে  তার  বৌভাতের  দিন  সেরকম  কোন  তত্ত্বই  আসেনি  বলতে  গেলে | কিন্তু  তা  নিয়ে  ব্যানার্জী  বাড়ির  আত্মীয়স্বজনেরা  বা  পাড়াপ্রতিবেশী  অন্নদাদেবীর  আড়ালে  আবডালে  সমালোচনা  করলেও  তার  সামনাসামনি  কেউই  মুখ  খুলতে  পারেনি কোনদিন  | কিন্তু  মেঝবৌয়ের  বাপের  বাড়ি  থেকে বিশাল  পরিমানের   তত্ত্ব  আসার  সাথে  সাথেই  বড়  বৌ  আর  মেঝবৌয়ের  বাপেরবাড়ির  মন  মানসিকতা  নিয়ে  পাঁচ  বছর  পরে  আলোচনা  শুরু  হয়ে  যায় | বড়বৌ  সেখানে  কথার  প্রতিবাদ  করতে  গেলে  তার  শ্বাশুড়ি  এসে  তাকে  এসবের  ভিতর  জড়াতে  নিষেধ  করেন  ও  সেখান  থেকে  চলে  যেতে  বলেন | নন্দিনী  সেখান  থেকে চলে  যাওয়ার  পর  অন্নদাদেবী  সকলের  উদ্দেশ্যে  বলেন ,
--- আমার  দুই  বৌমার  বাপেরবাড়ির  কারো  কাছ  থেকেই  আমরা  কোনকিছু  দাবি  করিনি | তারা  তাদের  ক্ষমতা  অনুযায়ী  কিছু  জিনিস  পাঠিয়েছেন | আমার  তো  কোনকিছুর  অভাব  নেই  | আমি  চাইনা  এসব  নিয়ে  আমার  বৌদের  মধ্যে  কোনরকম  তুলনা  করা  হোক  | অদিতি  যেমন  আমার  মেয়ে  আমার  বৌমারাও  আমার  মেয়ে  | আর রুচিরাকেও আমরা নিজ সন্তানের মতই মানুষ করেছি | পরের মেয়ে বলে আমাদের বাড়িতে কোন কথা নেই | তোমরা  এসব  নিয়ে  আলোচনা  করে  এই  আনন্দানুষ্ঠানটাকে  মাটি  করে  দিওনা |
নন্দিনীর  ছেলে  অনুপ  প্রথম  দিন  থেকেই  তার  মেঝমার  ভক্ত  হয়ে  ওঠে | অতটুকু  ছেলে  সে  তার  মায়ের  কাছ থেকে অবজ্ঞা আর অবহেলা পেতে পেতে মেজমায়ের কাছ থেকে মাতৃস্নেহ পেয়ে তাকেই সে আঁকড়ে  ধরেছিল |  শুধুমাত্র  রাতে  কয়েকঘন্টার  জন্য  সে  তার  মায়ের  কাছে  যেত | তাও সে  ঘুমিয়ে  থাকতো  তার  মেজমায়ের  কাছেই | রাতে  শুতে  যাওয়ার  সময়  নন্দিনী  তার  কাছে  কোন কোন দিন চক্ষুলজ্জার খাতিরে হয়তো   নিয়ে  যেত | প্রথম  থেকেই মেজ বউ রমার  প্রতি  এক  তীব্র  হিংসা  থেকে  আর  তার  ছেলে  অনুপের  তারপ্রতি  প্রচন্ড  ভালোবাসা  দেখে  আস্তে  আস্তে  তার  পেটের সন্তানের  প্রতিই ভালোবাসা  কমতে  থাকে | সাথে থাকে ছেলেকে  নিয়ে  জ্যোতিষীর  ভবিৎসৎবাণী  | ইতিমধ্যে  নন্দিনী  আবার  প্রেগন্যান্ট  হয়ে  পরে | ছেলেকে  নিয়ে  শুতে  নন্দিনীর  অনীহা  দেখে  অন্নদাদেবী  অনুপকে  নিজেই  নিয়ে  শুতে  শুরু  করলেন | আর  অনুপের  মেজোমা  তো  আছেই  | তখন  অনুপের  বয়স  তিন  কি  সাড়ে  তিন  হবে | হঠাৎ  একদিন  তার  খুব  ইচ্ছা  হল  মায়ের  কাছে  শোবে | ঠাকুমা  ঘুমিয়ে  গেলে  রাতে  এসে  মায়ের  দরজার  কাছে  ' মা  আমি  আজকে  তোমার  কাছে  শোবো, দরজাটা  একটু  খোলো  না  -- ওমা  শুনছো ?' কিন্তু  নন্দিনী  কিছুতেই  তার  ছেলেকে  দরজা  খুলে  তার  বুকের  কাছে  নিয়ে  শুলোনা | অনুপের  দুচোখ  দিয়ে  তখন  টপটপ  করে  জল  পড়ছে , চিৎকার  করে  সে  মা  মা  করে  কাঁদছে  ---
পাশের  ঘর  থেকে  বেরিয়ে  আসলো  তার  মেজোমা | অনুপকে  বুকে  চেপে  মুখে  চুমু  খেয়ে  তার  চোখের  জল  মুছিয়ে  দিয়ে  বললো ,' আজ  থেকে  তুই  আমার  কাছেই  শুবি | অতটুকু  বুকে  মায়ের  দেওয়া  এ  আঘাত  ভীষণভাবে  চেপে  বসলো | যার  ফলশ্রুতিতে  অনুপ  কোনদিনও  আর  মায়ের  কাছে  আর   ফ্রী হতে  পারলোনা | 

  অনুপের  জন্মের   পর  তার  কুষ্ঠীবিচার করতে  নন্দিনী  এক  জোতিষীর কাছে  গেছিলো | জোতিষী  অনুপের  জম্মছক  অনেকক্ষণ ধরে  দেখেশুনে  বলেছিলেন ,
--- ছেলে  তোমার  খুবই  ভাল  হবে  মা | জীবনে  রোজগারপাতি  তেমন  না  হলেও  জীবন  ঠিকই  কেটে  যাবে | উত্তরাধিকার  সূত্রে  তো  কিছু  সে  পাবেই | তবে  সে  বিদ্যান , বিজ্ঞ তীক্ষ্ণবুদ্ধি  সম্পন্ন , ও  শত্রুপরাভবকারী  হবে | এখানে  একটা  কথা  আছে  মা  | তুমি  তার  মা  কিভাবে  কথাটা  বলবো  সেটাই  ভাবছি  | আমার  গণনা  আজ  পর্যন্ত  ভুল  প্রমাণিত  হয়নি |
--- আমার  ছেলের  কি  কোন  ফাঁড়া আছে  বাবা  ?
--- না  না  কোন  ফাঁড়া নেই  | এই  সমস্যাটা  ঠিক  ছেলেকে  নিয়ে   নয় | সমস্যাটা  তোমাকে  নিয়ে  | আর  এ  সন্তান  তো  ---
--- হ্যাঁ বাবা  আমার  স্বামী  ছাড়া  এ  কথা  আর  কেউ  জানেনা  |
জোতিষী  নিজমনেই  বিড়বিড়  করেন  ,' সন্তানের  জীবনে  মা  তার  শত্রু  ?'
--- আমি  ঠিক  বুঝলামনা  বাবা  --
--- এতো  বয়স  হল  আমার  | জীবনে  অনেকের জন্মছক করেছি | কিন্তু  তোমার  ছেলের  ছকের মত  কোন  ছক আমার  হাতে  পড়েনি | 
--- বাবা  আমাকে  একটু  খুলে  বলুন | আমি  কিছু  বুঝতে  পারছিনা |
--- মনকে  শক্ত  করো  মা | আমি  যেটা  বলবো  তার  অন্যথা  করবেনা | এখন  থেকেই  তোমাকে  এ  যুদ্ধ  চালিয়ে  যেতে  হবে | কারণ সন্তানসুখ  প্রতিটা  বাবা  মায়েরই  কাম্য  | কিন্তু  সেই  সুখ  যদি  বাবা  বা  মায়ের  কারণেই  নষ্ট  হয়ে  যায়  তার  থেকে  কষ্টের  আর  কিছু  থাকতে  পারেনা | এখানে  তোমার  ছেলের  ছকে আমি  যা  দেখছি  তাতে   তোমার  ছেলের  বিবাহিত  জীবনে  তুমিই  হচ্ছ  তার  সুখের  পথের  অন্তরায় | মানুষের  কর্মফল  মানুষকে  কোথায়  নিয়ে  যায়  কেউ  বলতে  পারেনা  |
--- কি  বলছেন  আপনি  বাবা ? তা  কি  করে  সম্ভব ?
--- এটাই  সত্যি | হয়তো  তুমি  মনেপ্রাণে  তা  চাইছোনা  কিন্তু কোন এক  অলৌকিক  জাদুবলে  তুমি  তাইই করবে  আর  এখানেই  মানুষের  অসহায়তা  | ভাগ্যকে  কেউ  খন্ডন  করতে  পারেনা  |

ক্রমশঃ

পক্ষপাতিত্ব ১

পক্ষপাতিত্ব (পর্ব১)
    দেশভাগের  অনেক  আগেই  সঞ্জয়  ব্যানার্জী  পুরো  পরিবার  নিয়ে  ভারতে  চলে  আসেন | তখন  তার  বড়ছেলের  বয়স  দশ আর  ছোটছেলের  বয়স  পাঁচ | তার  পত্নী  তিনমাসের  অন্তঃসত্বা | আসানসোলের  এক  প্রত্যান্ত  গ্রামে   একটি  মুসলিম  পরিবারে একচেঞ্জের  মাধ্যমে  নিজের কয়েক  বিঘা  সম্পত্তি  আর  বিশাল  অট্টালিকা  সম  বাড়ির  বিনিময়ে  মাত্র  সামান্য  কয়েক  কাঠা জমির  উপর  একতলার  একটি  বাড়ি  -- এতেই  সন্তুষ্ট  থাকতে  হয়েছিল | বেশ  কয়েকবছর অভাব  দুঃখ  দারিদ্রের  সাথে  লড়াই  করবার  পর  তিনি  রেলে একটি  চাকরি  পান | তখন  তিনি  তিন  সন্তানের  পিতা | দুটি  ছেলে  আর  একটি  মেয়ে | ছেলেদের  তিনি  উচচশিক্ষায়  শিক্ষিত  করলেও  মেয়েকে  তিনি  মাধ্যমিক  পাশ করার  পরই বিয়ে  দিয়ে  দিতে  চান | তখন  বড়ছেলে  অর্ণব  তার  বিরোধিতা  করে  আদরের  বোনকে  একাদশ  শ্রেণীতে  ভর্তি  করে  দেয় | গ্রাজুয়েশন  শেষ  করে  সঞ্জয়  ব্যানার্জির  বড়  ছেলে  অর্ণব  সামান্য  মাইনের  ছোট  এক  কোম্পানিতে  চাকরি  পেয়ে  যায় | সঞ্জয়  যে  টাকা  উপার্জন  করেন  তাতেই  তার  সংসার  বেশ  ভালোভাবেই  চলে  যায় | তিনি  তার  ছেলের  উপার্জনের  টাকায় লালায়িত  ছিলেননা  | আর  এদিকে  অর্ণব  যেহেতু  বাবার  বিরুদ্ধে  গিয়ে  বোনকে সুশিক্ষিত  করে  তুলতে  চেয়েছে  সে  বোনের  ব্যাপারে  তার  বাবার  কাছ  থেকে  একটি  পয়সাও  নেয়না | আর  তাদের  মা  অথাৎ  সঞ্জয়  ব্যানার্জীর  স্ত্রী  স্বল্প  শিক্ষিত  মহিলা  আজীবন  তিনি  তার  সংসার  নিয়ে  থাকলেও  রাগী , বদমেজাজি  স্বামীর  বিরুদ্ধে  যখন  ক্ষেপে  যান  তখন  তার  স্বামীটিও  কিছুটা  চুপসে  যান | কারণ তিনি  ভালোভাবেই  জানেন  সবকথা  তার  কথামত  চললেও  কোন  কাজে  যখন  অন্নদা  আপত্তি  জানিয়েছে  তখন  সে  সেটা  কিছুতেই  তার  মতের  বিরুদ্ধে  করতে  দেবেনা  | পনের  বছর  বয়সে  বৌ  হয়ে  যখন  তিনি  ব্যানার্জী  পরিবারে  এসেছিলেন  স্বাভাবিক  কারণেই  ওই  ছোট  বয়সে  বাইশ  বছরের  রগচটা  স্বামীর  সব  অন্যায়  অত্যাচার  মেনে  নিলেও   ছেলেরা  বড়  হওয়ার  পর  তিনি  তার  স্বামীর  মুখের  উপর  কথা  বলতে  শুরু  করেন | কারণ  দুটি  ছেলেই  সবসময়  তার  পাশেই  থাকে | আর  সত্যি  বলতে  অন্নদাদেবী  স্বামীর  অনৈতিক  কাজগুলি  নিয়েই  মুখ  খোলেন | মেয়ের  উচচশিক্ষার  ব্যাপারেও  তিনি  তার  বড়  ছেলে  অর্ণবকে  বাপের  সিদ্ধান্তকে  মেনে  না  নেওয়ার  জন্য  চাপ  দিতে  থাকেন | তিনি  দরজার  আড়ালে  দাঁড়িয়ে  থেকে  ছেলেকে  সাহস  যোগান | মেয়ে  অদিতি  এখন  সায়েন্স  নিয়ে  গ্রাডুয়েশন  করছে | 
বড়  ছেলে  অর্নবের  বিয়ের  জন্য  তিনি  মেয়ে  দেখতে  শুরু  করেন | কিন্তু  অর্ণব  তার  এই  সামান্য  চাকরিতে  বিয়ে  করতে  রাজি  হয়না | বড়  কোন  চাকরি  পাওয়ার  আশাও  নেই | অন্নদাদেবী  তাকে  বুদ্ধি  দেন  ব্যবসা  করার  জন্য |
--- আমি  তোকে  একটা  কথা  বলি  অর্ণব | তুই  কিছু  একটা  ব্যবসা  কর | 
--- কি  ব্যবসা  করবো  মা ? আর  তাছাড়া  ব্যবসা  করতে  গেলে  প্রচুর  টাকার  দরকার  | মাইনে যা  পাই  বোনের  পিছনে  খরচ  ছাড়া  আমার  কোন  খরচ  নেই  ঠিকই  | বাকি  টাকা  আমি  জমাই | কিন্তু  সে  আর  কটা টাকা ? ঐসব  চিন্তা  করে  কোন  লাভ  নেই |
--- টাকা  আমি  দেবো | 
--- তুমি  কোথায়  টাকা  পাবে ? আর  তাছাড়া  বাবা  জানতে  পারলে  তোমায়  আস্ত  রাখবেনা সাথে  আমাকেও  কচুকাটা  করবে | 
--- তোর  বাবা  জানতেই  পারবেনা | আমার  অনেক  ভারী  ভারী  গয়না  আছে  | তোর  বাবার  দেওয়া  না  | সবই আমাকে  আমার  বাবার  দেওয়া | আমার  যাকিছু  তোদের  তিন  ভাইবোনের  জন্যই | সেই  গয়নার  তিনভাগের  একভাগ  আমি  তোকে  দেবো | একভাগ  থাকবে  তোর  ভায়ের  জন্য  আর  একভাগ  থাকবে  অদিতির  জন্য  | আর রুচিরাকে বিয়ের সময় যা দেওয়া হবে সে তোর বাবা ই তৈরি করে দেবেন |  কি  ব্যবসা  করতে  চাস চিন্তা  কর  | টাকার  অভাব  হবেনা | তবে  আমার  একটা  শর্ত আছে  |
--- বলো  কি  তোমার  শর্ত ?
--- তোর  ব্যবসা  দাঁড়িয়ে  গেলে  বাড়িতে  প্রতিবছর  দুর্গাপূজা  করবো | তখন  তোর  ভাইও  নিশ্চয়  কিছু  রোজগার  করবে | সেও  তখন  কিছু  দেবে  | এটা আমার বহুদিনের সাধ |
  একথা  বলে  তিনি  একটি  কাপড়ে  মোড়া কিছু  গয়না  এনে  তার  বড়  ছেলের  হাতে  দিলেন |
--- শোনো  মা , তোমার  কথামত  ব্যবসা  আমি  শুরু  করবো  | কিন্তু  আমারও একটা  শর্ত আছে |
--- তোর  আবার  কি  শর্ত  ?
--- ব্যবসা  আমার  যতদিন  না  দাঁড়ায়  ততদিন  কিন্তু  তোমরা  আমার  বিয়ের  কোন  চেষ্টা  করবেনা | তবে  ব্যবসা  দাঁড়িয়ে  গেলে  আমি  নিজে  থেকেই  তোমাদের  বিয়ের  কথা  বলবো |
--- তুই  নিশ্চিন্ত  থাক | তোর  মতের  বিরুদ্ধে  গিয়ে  তোর  বাবাকে  আমি  কিছুতেই  তোর  বিয়ে  দিতে  দেবোনা | তবে  হ্যাঁ  যদি  কোন  মেয়ে  তোর  পছন্দ  থাকে  তাহলে  কিন্তু  আমায়  জানাস  বাবা |
অর্ণব  হেসে  পরে  বললো , ' এখনো  সে  রকম  কাউকে  পছন্দ  হয়নি  মা |' তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ |
  বছর  তিনেকের  মধ্যে  অর্ণবের  ব্যবসায়  বেশ  লাভ  হতে  লাগলো | ডায়মন্ডহারবার  রোডের  উপর  প্রথমে  সামান্য  কিছু  ইলেক্ট্রনিক্স  জিনিস  নিয়ে  সে  একাই বিজনেসটা  শুরু  করে | একবছরের  মাথায়  সে  পাশের  প্রায়  অচল  আর  একটি  দোকান  কিনে  নেয়  | এরপর  দুটি  দোকানকে  দোতলা  করে  এখন  সর্বরকমের  ইলেক্ট্রনিক্স  জিনিস  তার  বিশাল  দোকানে  | বেশকিছু  কর্মচারীও  এখন  বিশ্বস্ততার  সাথে  সেখানে  কাজ  করে  | সে  তার  শোরুমের  নাম  দিয়েছে  'অন্নদা শোরুম'- | 
  আজ  অর্নবের  বিয়ে | পাত্রী  বাবা  নিজে  পছন্দ  করেছেন | অর্ণব  একবারের  জন্য  দেখতেও  যায়নি | কিন্তু  শুভদৃষ্টির  সময়  পাত্রীকে  দেখে  তার  চোখ  মুখ  শুকিয়ে  একেবারে  আমসি হয়ে  যায় | এখন  সে  বুঝতে  পারছে  মা  কেন  তাকে  বারবার  করে  একবার  মেয়েটিকে  দেখতে  আসতে বলেছিলেন | কিন্তু  সে  তাতে  রাজি  হয়নি | মাকে বলেছে ,
--- রূপ  দিয়ে  কি  হবে ? গুন  থাকলেই  হবে |
কিন্তু  সে  একবারের  জন্যও  বুঝতে  পারেনি  নন্দিনী  শুধু  কালোই নয়  মোটা  আর  মুখশ্রীও  সুন্দর  নয় | কি  কারণে বাবা  একে পছন্দ  করেছেন  তা  অর্নবের  বোধগম্য  হলোনা | কিন্তু  এখন  আর  আফসোস  করে  কি  হবে ? যা হবার  তা  তো  হয়েই  গেছে | তাই  বুদ্ধিমান  অর্ণব  প্রথম  অবস্থায়  একটু  ঘাবড়ে  গেলেও  কিছুটা  সময়  পরে  সে  এটাকে  তার  ভাগ্য  বলেই  মেনে  নেয়  আর  মন  খারাপের  থেকেও  বেরিয়ে  আসে |
বৌ  নিয়ে  অর্ণব  বাড়িতে  পা  দিলো | হঠাৎ  গেটে  পিওনের  গলা ,' অভিক  ব্যানার্জী  বাড়িতে  আছেন ?'
সূর্য  তখন  পশ্চিম  আকাশে  সবে ঢলে পড়েছে | নূতন বৌ  এর  সামনে  দুধ-আলতার থালা | বাইরে  পিওনের  গলা | অভিক  ও  অর্ণব  দুই  ভাই  এগিয়ে  গেলো | অভিকের  হাতে  পিওন  একটি  খাম  ধরিয়ে  দিলো | অভিক  সেখানে  দাঁড়িয়েই  খাম  খুলে  সেটি  দেখে  দাদাকে  লাফ  দিয়ে  জড়িয়ে  ধরে  বললো ,' দাদা, দাদা  বৌদি  তো  আমাদের  ঘরের  লক্ষ্মী  রে | ব্যাঙ্কের চাকরিটা  আমি  পেয়ে  গেছি |,
দরোজার  সামনে  তখন  ঘনঘন  শাঁকের আওয়াজ  আর  উলুধ্বনি  পড়ছে  নূতন বৌ  বরণ করে  অন্নদাদেবী  ঘরে  তুলছেন | মুহূর্তেই  বাড়ির  সকলের  প্রিয়পাত্র  হয়ে  উঠলো  নন্দিনী  লক্ষ্মী  রূপে | এতক্ষণ তার  চেহারা  নিয়ে  আত্মীয়স্বজন , পাড়াপ্রতিবেশীর  মধ্যে  যে  চাপা  গুঞ্জন  শোনা  যাচ্ছিলো  তারাই  এখন  ফিসফাস  করে  নন্দিনীর  ভাগ্যের  প্রশংসা  করতে  শুরু  করলেন | আর  কিছুটা  হলেও  অর্ণবের  মধ্যে  নন্দিনীর  চেহারা  নিয়ে যে   ক্ষোভ  ছিল  এই  ঘটনায়  মুহূর্তের  মধ্যে  সে  ক্ষোভ  কৃতজ্ঞতা  আর  ভালোবাসায়  পরিণত হয়ে  উঠলো | তখনও সে জানেনা জীবনে সবথেকে বড় ধাক্কাটা নন্দিনীর কাছ থেকেই আসতে চলেছে |

ক্রমশঃ
  

Monday, August 2, 2021

তিন রমণীর কথা (প্রথম পর্ব)

তিন রমণীর কথা (প্রথম পর্ব)
  জীবনে প্রচুর ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে এই শেষ বয়সে এসে ভার্চুয়াল জগতের মাধ্যমে তিনটি রমণী হয়ে উঠেছে তিনজনের কাছের মানুষ।তাদের সুখ দুঃখ গুলো তাদের নিজেদের মতো করে তারা আলোচনা করেন। ফেলে আসা অতীতের সুখ দুঃখের ঘটনাগুলি তারা আলোচনা করে কিছুটা হলেও মনের ভার লাঘব করতে পারেন।পরস্পরের এইসব ঘটনাগুলি তাদের একে অপরকে কখনো সান্তনা দেয় কখনো তাদের  কাঁদায় আবার কখনোবা হাসায়। এই বয়সে এসে এইসব ঘটনাগুলি তারা পরস্পরের মধ্যে  আলোচনা করে কিছুটা সময় হলেও ফেলে আসা অতীতে যেন ফিরে যান।তাই প্রতিদিনই তারা মুখিয়ে থাকেন সেই বিকেলের আসায় কখন তাদের দেখা হবে আর কখন তারা তিনজনে মুখোমুখি বসে  নিজেদের ফেলে আসা অতীতের সুখ দুঃখগুলো ভাগ করে নেবেন।
  তিন বন্ধু মিলে পার্কে বসে মুড়ি মাখা খেতে খেতে নিজেদের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলো নিয়ে এইভাবে প্রতিদিনই আলোচনা করেন। সন্ধ্যা হয়ে যায় কিন্তু যতক্ষণ না পার্কের সেন্ট্রি এসে তাদেরকে উঠতে বলে তারা সেখানেই বসে থাকেন,আর এটাই তাদের রোজ নামচা। এইভাবে ওই পার্কে সেন্ট্রিও যেন তাদের কাছের একজন হয়ে উঠেছে।পার্কের নির্দিষ্ট জায়গা তাদের জন্য বাধা।যদি কখনো কেউ এসে সেখানে বসে পড়ে সেন্ট্রি ঠিক সুযোগমতো তাদেরকে উঠিয়ে দিয়ে তিন দিদিকে জায়গা করে দেয়।
 খুব কাছের আপনজনদের কাছ থেকে আঘাত অপমান অসম্মান সহ্য করার পর যখন বাইরের কেউ একটু সামান্য মিষ্টি কথা বলে,সম্মান দেয় তখন সেই মানুষটা খুব কাছের হয়ে ওঠে।জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় তারা পিছনে ফেলে এসেছেন।প্রথম থেকেই তারা ফেসবুক বন্ধু।মানুষ বলে, ছেলেবেলার বন্ধুত্ব নাকি খুব গাঢ় হয়।কিন্তু এই বয়সে এসে এই তিন রমণী তাদের বন্ধুত্বটাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। ফেসবুক কার কি ক্ষতি করে বা করেছে জানা নেই এই সমবয়সী পৌরত্বে পৌঁছানো তিন রমণীর। কিন্তু তারা এটা ভালোভাবে জানেন ফেসবুক তাদের একাকীত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে,তাদের তিনজনকে কাছে এনেছে তাদের নূতন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।এখন তারা নিজেদের জন্য ভাবতে শিখেছেন।অধিকাংশ নারী তাদের জীবনের স্বর্ণময় সময়টা শ্বশুরবাড়িতে পা দিয়েই কাটিয়ে দেয় অন্যদের কথা ভেবে,অন্যদের মনোরঞ্জনে।এই তিন নারীও তাদের ব্যতিক্রম নয়।
  প্রথমে এই তিন নারীর মধ্যে যে নারীর কথা আমরা জানবো তার নাম সুছন্দা।
    ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনায় মেধাবী সুছন্দা গ্রাজুয়েশনের পরেই একটা বড় প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী পেলেও তার ইচ্ছা ছিলো একটি সরকারি চাকরির।অনেক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছে।কিন্তু মনের ইচ্ছা মনেই থেকে গেছে।
         অনেকগুলো ভাইবোনের মধ্যে সুছন্দা ছিলো সকলের ছোট।বাবাকে হারিয়েছে দ্বাদশশ্রেনীতে পড়ার সময়েই।বড়দা কেন্ত্রীয় সরকারের অধীনে ভালো চাকরী করতেন।বিয়ে করার সুযোগ তার জীবনে আসেনি।তিনিই পরিবারের বড় সন্তান,বাবার মৃতু্র পর স্বভাবতই সংসারের জোয়াল তার কাঁধে এসে পরে।আর পাঁচজনের মতই সংসারের এই দায়িত্বকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি।এক বোনের বিয়ে বাবা দিয়েই গেছিলেন বাকি তিন বোনের ও ছোট ভায়ের যথাযথ শিক্ষা গ্রহনের পর তাদেরও বিয়ে দিয়ে সংসারী করেন।এসবের মধ্যে মা-ও চিরতরে বিদায় নেন।সব দায়িত্ব পালন যখন শেষ হোল তখন ছন্দার বড়দার বিয়ের বয়সও পার হয়ে গেছে।সুছন্দা তার বড়দাকে পিতৃসম শ্রদ্ধা, ভক্তি করতো।তিনি তার আদরের স্বাধীনচেতা ছোট বোনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কেমন ছেলে তার পছন্দ।সুছন্দা তার বড়দাকে বলেছিলেন,"রূপ মানুষের পরিচয় নয়।রূপবান চাইনা, তুমি চেষ্টা করো একজন প্রকৃত ভালো মনের মানুষ খুঁজে আনতে।আর কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরী করা ছেলে নয়;চেষ্টা কোর যে কোন পোষ্টেই হোকনা কেন একজন সরকারী চাকুরিজীবি ছেলে খুঁজতে।যার বর্তমান আর আমার কপালে যদি থাকে তাকে হারানো তার অবর্তমানেও আমি তারটাই খাবো।ভবিষ্যতে সন্তানের মুখাপেক্ষী হতে আমি রাজি নই।কারন মেয়েদের জীবনে স্বামী এমন একজন মানুষ যার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাবো, যার সাথে ঝগড়া করবো,মন-অভিমান, ভালোবাসা, তার সেবাযত্ন সব-সব করবো;তারপরেই সব জোর খাটাবো।আমার চেহারা, গাড়ি, বাড়ি কিছুরই কোন দরকার নেই।আমার কপালে থাকলে ওই সামান্য চাকরী থেকে আমি নিজেই সব করে নিতে পারবো কারন চাকরিটা থাকবে পার্মানেন্ট।সামান্য মাইনে হলেও সেটা থাকবে নির্দিষ্ট।বড়দা দেবাঞ্জন ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় ঠিক এমনই একটি ছেলের সন্ধান পেয়েছিলেন দূর সম্পর্কের এক বোনপোর মাধ্যমে।রূপে বা অর্থে নয় সে ছিলো গুনের আধার এবং সরকারী একজন সাধারন কর্মচারী। 
       ঊনত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সুছন্দা ও তার স্বামী বিজিত খুব সুন্দর বাড়ি করে।মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে বেশ বড় ঘরেই ব্যবসায়ী ছেলের সাথে বিয়ে দেয়।ছেলে যখন ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে ঠিক তখনই সুছন্দার জীবনের ছন্দপতন!হঠাৎ করেই মাত্র কা'দিনের জ্বরে বিজিত তার ছন্দাকে ছেড়ে অমৃতলোকে যাত্রা করে।বড্ড একা হয়ে পড়ে ছন্দা।মেয়ে তার সংসার ফেলে কতদিন মাকে আগলে রাখবে?একসময় সেও তার স্বামীর কাছে চলে যায়।সম্পূর্ণ একাকী সুছন্দা তখন মোবাইলকেই সময় কাটানোর বন্ধু বানিয়ে ফেলে। 
          সুছন্দার মেধাবী ছেলে রাহুল ইন্জিনিয়ারিং পাশ করে ক্যাম্পাস থেকেই চাকরী পেয়ে যায়।পোষ্টিংও কলকাতাতেই হয়।বিশাল তিনতলা বাড়ির নিচুটা ভাড়া দিয়ে তিনি স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে দোতলা ও তিনতলা নিয়ে থাকতেন।স্বামী বেঁচে থাকাকালীন সময়েই বিচক্ষণ সুছন্দা তিনতলাতে সম্পূর্ণভাবে একটি আলাদা ফ্লাট তৈরি করে রাখেন।তার মনের ইচ্ছা ছিলো ছেলেকে যদি তিনি বিয়ের পরেই আলাদা করে দেন তাহলে আজকের দিনে ঝামেলা এড়িয়ে ছেলে, বৌকে নিয়ে একই ছাদের তলায় থাকতে পারবেন।কারন দুটি বাসন একজায়গায় থাকলে শব্দ হবেই।তিনি মোটা টাকার পেনশন পান।ছেলে আর বৌকে দেবেন ছাড়া তাদের কাছ থেকে একটি টাকাও তিনি নেবেন না।আর ঠোকঠুকির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একটাই উপায় তোমরা আলাদা থাকো, আমরাও আলাদা থাকি কিন্তু একই ছাদের তলায় ঝগড়াঝাটি ছাড়া থাকি।কিন্তু স্বামী চলে যাওয়ার পর তিনি তার সিদ্ধান্তের কিছুটা পরিবর্তন করেন।বিজিতবাবু না থাকাতে আত্মীয়-পরিজনের আসাও অনেকাংশেই কমে গেছে।তাছাড়া দোতলার এত বড় বড় ঘরে যার প্রতি কোণায় কোণায় স্বামীর স্মৃতি যা তাকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছিলো।তাই রাহুলের বিয়ের পর তিনি দোতলা তাদের ছেড়ে দিয়ে তিনতলায় উঠে যান । স্বামী চলে যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বড়দাও চলে যান।বাবাকে হারিয়ে সুছন্দা বড়দাকেই বাবার আসন দিয়েছিলেন। শ্রদ্ধা,ভালোবাসায় বড়দাকেই জীবনের আদর্শ পুরুষ হিসাবে দেখতেন।মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে পিতৃসম বড়দা আর জীবনের সব থেকে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ছন্দা একেবারেই চুপসে গেছিলেন।
 মেয়ে, জামাই একবার তাকে জামাইষষ্ঠীতে একটি স্মার্ট ফোন কিনে এনে দিয়ে কিছুটা হলেও শান্তির আভাস এনে দিয়েছে।ছেলে, বৌ ও এক নাতির সান্নিধ্যে তার মাঝে মাঝে সময় খুব ভালোই কাটে।বাকি সময় তিনি তার ফেসবুক নিয়েই থাকেন।বৌমার সংসারে তিনি বিন্দুমাত্র নাক গলান না।নিজের রান্না নিজেই করে খান।ঘরভাড়া ও স্বামীর পেনশনে তার খুব ভালোভাবেই চলে যায়।উপরন্তু তিনি পুরো বাড়ির ইলেকট্রিক বিল, বৌমার গ্যাসের দাম এবং তার টুকটাক হাত খরচ তিনিই দেন। ছেলের প্রিয় খাবারগুলো তিনি মাঝে মাঝেই রান্না করেন আর বাটি ভর্তি করে ছেলেবউয়ের ঘরে চালান করেন।কিন্তু বৌমা তার কোন কাজ করতে গেলে স্বাধীনচেতা সুছন্দার মিষ্টি সুরে একটাই কথা,"এখন আমি সবকিছু করে নিতে পারি মা,আমার শরীর যখন দেবেনা যখন আমি পারবোনা তখন যদি তোমার মনেহয় আমার কোন কাজ করে দেবে তখন কোর।এখন আমার জন্য তোমাদের কিচ্ছু করতে হবেনা।" তবে তার ছেলের বৌ মাঝে মধ্যে এটাসেটা রান্না করে বা কখনো বা এক কাপ চা করে তার শ্বাশুড়ীমাকে দিয়ে আসে।সুছন্দা সেগুলি হাসি মুখেই গ্রহন করেন।ঝগড়া, অশান্তির কোন সুযোগই তিনি দেননা।
 তার সময় কাটে নাতির সাথে খেলে,গল্পের বই পড়ে।আর এমন সময় স্মার্ট ফোনটি হাতে পেয়ে জামাই,ছেলে,বউ সকলের সাহায্যেই তিনি বেশ পোক্ত হয়ে ওঠেন।ভার্চুয়াল জগতে ঢুকে অনেকের গল্প,কবিতা পড়তে পড়তে তার ছেলেবেলার অভ্যাসটাকে ঝালিয়ে নিতে শুরু করলেন।পুরনো ডাইরি বের করে নতুনভাবে আবার গল্প,কবিতা লেখায় মন দিলেন।খুব তাড়াতাড়িই তারা ফ্রেন্ড লিস্টের সংখ্যা বাড়তে লাগলো।অনেকেই তার লেখার প্রসংশা করতে থাকেন।তিনিও দ্বিগুণ উৎসাহে লেখায় মনোনিবেশ করেন।সম,অসম বয়সী অনেক বন্ধুর সাথেই টুকটাক কথাও হত ইনবক্সে।তাদেরই মধ্যে একজন সালেহা আক্তার।

  ক্রমশঃ