জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সনু ওরফে সায়ন শুনে আসছে এ বাড়ির ঠাম্মা আছেন কিন্তু কোথায় আছেন তা সে জানে না।তার মা তাকে বলেছেন,"এ বাড়ির ঠাম্মা এমন একটা বাড়িতে থাকেন যেখানে আরও অনেক ঠাম্মারা থাকেন।" কিন্তু সে বাড়ির নামটা এত বড় সনু কিছুতেই সেই নামটা মনে রাখতে পারে না।সে কিছুতেই ভেবে পায় না তার ঠাম্মা তো তাদের সাথেই থাকেন তাহলে মা যে বাড়িতে কাজ করে সে বাড়িতে এতগুলি ঘর থাকার পড়েও নীলা দিদিমনির ঠাম্মা কেন অন্য কোথাও থাকে।
নীলা ব্যারিস্টার অজয় নন্দীর একমাত্র মেয়ে।সনুর প্রায় সমবয়সী।সনু যখন খুব ছোট ছিল তখন মায়ের সাথে মাঝে মাঝেই নীলা দিদিমনির সাথে খেলার জন্য ওই বাড়িতে যেত।ব্যারিস্টার অজয় নন্দী এবং তার সুন্দরী স্ত্রী অদৃজা সনুর এই বাড়িতে আসাটাকে মোটেই পছন্দ করতেন না।বিশেষত নীলার সাথে খেলাটা।তাই একদিন বাসন্তিকে জানিয়ে দেন যাতে সে সনুকে নিয়ে কাজে না আসে।তারপর থেকে আর কোনদিনও সনু এ বাড়িতে আসেনি।
এখন সনুর বয়স বারো বছর।সে সবকিছুই বুঝতে পারে।গতকাল অনেক রাতে মায়ের কাছে ফোন এসেছিল তাই মা খুব ভোরে বেরিয়ে গেছে।এখন রাত নটা বাজে।মা যাওয়ার সময় সে ঘুমাচ্ছিল বাবার কাছে।বাবা কাজে বেরোনোর সময় ঠাকুমার সাথে বাবার কথায় সনু জানতে পেরেছে নীলা দিদিমনির ঠাম্মা মারা গেছেন।
আগেরদিন রাত তিনটের সময় বৃদ্ধাশ্রম সুখনীড় থেকে খবর আসে ব্যারিস্টার অজয় নন্দীর কাছে তার মা মনীষাদেবী মারা গেছেন।সারাদিনের ধকলের পর রাতে বিশ্রামের সময়ে এরূপ একটা খবর পেয়ে অজয়বাবু আশ্রমে জানিয়ে দেন তিনি সকালে শ্মশানে পৌঁছাবেন।তারা যেন যা করণীয় সেই মুহূর্তে করে নেয়।তিনি গিয়ে যা টাকা দেওয়ার দিয়ে দেবেন।
পরদিন সকালে অজয়বাবু যখন শশ্মানে পৌঁছলেন তখন তার দাহকার্য সম্পন্ন হয়ে গেছে।তিনি আশ্রম কতৃপক্ষকে মোটা অংকের টাকা ধরিয়ে গঙ্গা স্নান করে ধরা পড়ে বাড়ি ফিরলেন।
নীলা খুবই কান্নাকাটি করছিলো ঠাম্মাকে একবার দেখতে যাবে বলে।কিন্তু নীলাকে স্বামী,স্ত্রী না নিয়েই দুজনে শশ্মানে গেছিলেন।নীলা ছিল বাসন্তীর কাছে।তারা বাড়িতে ফিরলে বাসন্তী তার বাড়িতে ফিরে আসে।অদৃজা যাওয়ার সময় বাসন্তীকে বলেই গেছিলো সে যেন রান্নাঘর পরিষ্কার,পরিচ্ছন্ন করে রাখে।এসে তো সেই সেদ্ধিভাত খেতে হবে।
নীলার বয়স তখন তেরোবছর।দুপুরে খেতে বসে সে দেখে মা,বাবা ফেরার সময় হোটেল থেকে খাবার নিয়েই ফিরেছেন।অথচ কয়েক মাস আগেই সে দেখেছে তার দিদিমা যখন মারা গেছিলেন মামা সেদিন শুধু ফল খেয়েই ছিলেন।পরেরদিন থেকে নিজের হাতে রান্না করে শুধু ভাত খেয়েছিলেন।সে ভাতগুলো দেখতে কেমন কাদার মত।খেতে বসে হোটেলের খাবার দেখে আজ আর তার কোন আনন্দ হলনা।সে মায়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে জানতে চাইলো,
--- বাবা আজ মামার মত সেই ভাত খাবে না?
অজয়বাবু কটাক্ষ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে নিজের মনে খেয়ে উঠে গেলেন। অদৃজা মেয়ের মনের কথা বুঝতে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,
--- তোমার বাপী তো ওই ভাত খেতে পারে না তাই এইগুলো খেয়েছে তুমি একথা কিন্তু কাউকেই বলবে না।
তারপর সে নিজে বাসনগুলো মেজে নেয় যাতে বাসন্তী এসে কিছু বুঝতে না পারে।
ছলছল চোখে সে মায়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে থাকলো।
সনুর মা আজ সনুকে বলেছে নীলার ঠাকুমার শ্রাদ্ধে ওকে নিয়ে যাবে।বেশ ভালোমন্দ খেতেও পারবে।সনুর আজ খুবই আনন্দ।আজ অনেকদিন পর নীলা দিদিমণির সাথে তার দেখা হবে।মায়ের সাথে সে বাড়িতে পৌঁছে সেখান থেকে অন্য একটা ভাড়া করা অনুষ্ঠান বাড়িতে পৌঁছে তার তো চক্ষু চড়কগাছ।এত আয়োজন!দলে দলে লোক আসছে।কেউ কেউ বসে খাচ্ছে আবার অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেরা নিয়ে খাচ্ছে। কত রকমের খাবার।সনু কিছুতেই ভেবে পারছে না যে বিশাল বাড়িতে ঠাম্মার একটু থাকার জায়গা হয়নি তার মৃত্যুর পর এত মানুষকে ডেকে খাওয়ানোর কি দরকার?সবাই বিয়েবাড়িতে আসার মত সেজেগুজে এসেছে। কত হাসছে গল্প করছে।আসার পর থেকেই সে নীলা দিদিমনিকে খুঁজে চলেছে।কিন্তু কোথাও তাকে সে দেখতে পাচ্ছে না।ম্যাডামকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পাচ্ছে না।
অনেক খোঁজার পর একটা ঘরে সে তার নীলা দিদিমনিকে খুঁজে পায়।দু,চারটে লোকের মাঝে সে চুপটি করে বসে ছিল।সনুকে দেখতে পেয়ে সে সেখান থেকে উঠে সনুকে নিয়ে কথা বলতে বলতে বাইরে একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসে।
--- দিদিমণি,তোমাদের বাড়িতে আজ এত্ত লোক।তোমার মনটা এত খারাপ কেন?
--- আমার ঠাকুমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু বাপি,মামণি কেউই সেটা বুঝছে না।ওরা কত হেসে হেসে সকলের সাথে কথা বলছেন। জানো সনু,ঠাকুমার সাথে ওরা কেউ কোনদিন এইভাবে কথা বলতো না।সব সময় ঠাকুমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলতো।ঠাকুমা শুধু কাঁদতো।আমি তো তখন খুব ছোট ছিলাম একটু একটু মনে আছে।একদিন বাপী,মামণি দুজনে মিলে ঠাকুমাকে নিয়ে গিয়ে কোথায় যেন রেখে আসলো।আমি খুব কান্নাকাটি করলে একটু সময়ের জন্য আমায় নিয়ে যেত।আর তখন ঠাকুমা আমায় জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতো।
--- কিন্তু আজকে তো ওনার শ্রাদ্ধ।আমি বুঝতে পারছি না সবাই এত সেজেগুজে এসেছে কেন? হাতে সকলের মিষ্টির প্যাকেট।আবার গিফটও এনেছে অনেকে।শুধু ফুলের মালাটা ছবিতে দিচ্ছে বাকি সব তো ম্যাডামের হাতেই দিচ্ছে।এগুলো তো বিয়ে বাড়ীতে হয় দেখেছি।আমি অবশ্য এরকম কোন শ্রাদ্ধ বাড়িতে কোনদিন যাইনি। কারো মনে কোন দুঃখ নেই।সবাই কেমন মজা করছে।
--- আমারও এগুলো দেখতে ভালো লাগছে না।আজকে আমার এসব দেখে মনে হচ্ছে যেন ঠাকুমা মরে যাওয়াতে সকলের খুব আনন্দ হয়েছে।আর আমায় ঠাকুমা বলেছিলেন
'আনন্দ অনুষ্ঠানে সকলে মিষ্টি নিয়ে আসে।' কিন্তু আজ তো শোকের দিন সবাই তবে কেন এত বড় বড় মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসছে?অনেকে আবার আমাদের জন্য কত দামী দামী জামাকাপড়ও নিয়ে আসছে।কেন করে মানুষ এগুলো তুমি জানো?
--- আমিও তো এটাই ভাবছি।কি জানি আমরা তো ছোট তাই হয়তো নিয়মকানুনগুলো ঠিক জানিনা।তবে এগুলো দেখতে আমারও ভালো লাগছে না।যখন বড় হবো তখন এইসব নিয়মের মানে হয়ত বুঝতে পারবো।চলো এখন আমরা ভিতরে যাই।ম্যাডাম তোমাকে আমার সাথে দেখলে আবার বকবে তোমায়।
দুটো অবোধ শিশুর মনে যে প্রশ্নের উদয় হোল আমাদের সমাজ কবে খুঁজবে সেই প্রশ্নের উত্তর?
শেষ