Friday, March 5, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২৯)

সুখের ঘরে আগুন (২৯)

  নরেশবাবু অম্বিকার সাথে কথা বলে খুব খুশি হন। অনেকক্ষণ সেদিন নরেশবাবুর সাথে অম্বিকার কথা হয়। মাঝেমধ্যে অবশ্য মলিনাদেবি এসে তাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। মলিনাদেবী তাদের কথার মাঝখানে এসে যতবারই কথা বলেছেন বলা যেতে পারে তিনি তাদের কথার মাঝে ফোড়ন কেটেছেন। অম্বিকা অবশ্য তা বুঝতে না পারলেও নরেশ বাবু ঠিকই বুঝেছেন।বা অম্বিকা বুঝতে পেরেও তাদের ধরা দেয়নি।মলিনাদেবী তার ছেলের বিয়ে, ডিভোর্স সবকিছুই যেন অম্বিকা ঘটিয়েছে এরকম একটা ভাবসাব তার। তাই তার সমস্ত রাগ যেন অম্বিকার উপর গিয়ে পড়েছে।
  তিনজনে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিলেন আর চা জলখাবার খাচ্ছিলেন।এমন সময় ল্যান্ড ফোনটা বেজে ওঠে। নরেশ বাবু ফোনটার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে মলিনাদেবী তাকে বাধা দিয়ে বলে ওঠেন,
--- তুমি গল্প করো আমি দেখছি।
 সোফার দিকে ফিরে আসতে আসতে নরেশবাবু বলতে লাগলেন "এই সময় কেউ তো ফোন করে না কে ফোন করল?"এমনিতেই অম্বিকাকে দেখে মলিনাদেবীর মাথা ছিল গরম।তার উপর অম্বিকার জন্য তৈরি করতে হয়েছে চা, জলখাবার।আর এখন নরেশবাবুর এই কথা শুনে তিনি তিড়িং করে বলে উঠেন,
-- ফোনটা কে করেছে সেটা না ধরলে বুঝবো কি করে?আগে গিয়ে কথা বলি, তারপর ফিরে এসে তোমাকে জানিয়ে দেবো এই সময়ে কে ফোন করেছিল?নরেশবাবু বুঝতে পারেন তার  মলির মেজাজটা আজ সপ্তমে।কারণ ছেলের জীবনে যা কিছু ঘটেছে এখন মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্যই তার মলি এই নিরীহ মেয়েটাকে দায়ী করে বসে আছেন। কিন্তু মেয়েটার সামনে তিনি মুখ বুঝেই থাকলেন।মলিনাদেবীকে কোন কথায় বললেন না।অম্বিকা চলে যাওয়ার পরে তাকে বুঝিয়ে বলবেন এটা ভেবে তিনি আপাতত চুপ থাকলেন।আর এদিকে মলিনাদেবী ফোনে কিছুক্ষন কথা বলে এসে পুনরায় সোফার উপর বসে পড়লেন।কিন্তু কোন কথা তিনি নরেশবাবুকে জানালেন না। নরেশবাবুও নিজের থেকে তার স্ত্রীকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলেন না।কারণ একটাই, তিনি অম্বিকা থাকতে তার স্ত্রীকে ঘাটালেন না নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য। আরো কিছুক্ষণ থেকে নরেশবাবুকে পুনরায় আসার আশ্বাস দিয়ে অম্বিকা নিলয়দের বাড়ির থেকে বেরিয়ে পরলো।
 ---  কে ফোন করেছিল?তুমি মেয়েটার সাথে এরকম ব্যবহার করলে কেন?তোমার ছেলের যা ভাগ্যে ছিল সেটাই ঘটেছে। তার জন্য তুমি অন্য মেয়েকে বিনা কারণে দোষারোপ করবে, তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, এটা ঠিক না।এটা তুমি ঠিক করোনি। নিলু যদি জানতে পারে তাহলে কিন্তু সে ভাল মনে এটা মেনে নেবে না। আমি নিশ্চিত নিলুর সাথে ওর একবার নয়, বহুবার দেখা হয়েছে।আর ও যদি আজকে তোমার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে আর সেটা যদি নিলুকে জানায় তাহলে কিন্তু সম্ভাব্য একটা ঝামেলা থেকেই যাচ্ছে। যে মেয়েটা তোমার নিলুর ব্যাপারে কোন কিছুই জানেনা, এমনকি আমরা যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছিলাম নিলুর সাথে তার;আমরা তো সেই প্রস্তাব তার বাবা-মাকেই দিইনি। এই ব্যাপারে অম্বিকাও কিছুই জানত না।তুমি এমন ভাব করলে তাকে দেখে যেন তোমার ছেলের ভাগ্য অম্বিকা নিজে হতেই লিখেছে।তোমার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আমি আশা করিনি।
--- কি এমন ব্যবহার করলাম আমি তার সাথে যে তুমি আমাকে এত কথা শোনাচ্ছ?তোমার কথা মত তাকে টিফিন করে দিলাম, চা করে দিলাম, বসে গল্প করলাম তারপরেও দোষ হয়ে গেল আমার!আসলে তোমার ব্যাপারটা হয়েছে "দেখতে নারি তার চলন বাঁকা"- আমাকে তো তুমি কোনদিনও সহ্য করতেই পারো না।কি কুক্ষণে যে তোমার গলায় মালা পরিয়েছিলাম!
--- শুধরে নেওয়ার যদি উপায় থাকে নিতে পারো আমার কোন আপত্তি নেই ---।
--- এই বুড়ি বয়সে কি আর উপায় থাকবে শুনি -- ।
--- তা বুড়ি হওয়ার আগে উপায় ছিল বুঝি ?তখন কেন শুধরে নাও নি শুনি ---।
তোমার এত কথা শোনানোর মাঝে তোমাকে সুখবরটাই  আমার দিতে ইচ্ছা করছে না।
নরেশ বাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
---আমার জীবনে আর সুখবর!বল দেখি,কে ফোন করেছিল?আর সে তোমাকে কি সুখবর দিল?
--- নিলু আসছে কাল সকালে।সাথে আরো একজন আসছে, বলল এসে সব কিছু বলবে।একদিন মাত্র থাকবে।দু'দিনের ছুটি পেয়েছে মাত্র।আসলে নতুন জয়েন করেছে তো তাই সেখান থেকে ছুটি দিতে চায়নি।
--- বাহ্!খুব ভালো কথা।সে আসবে শুনে আনন্দ হচ্ছে আমার ঠিক কথা।কিন্তু এইতো সবেমাত্র গেল।পনেরো দিনও হয়নি।এরমধ্যে আবার আসার কি দরকার ছিল?আবার সাথে একজনকে নিয়ে আসছে সে আবার কে?কি কারণে তাকে সাথে নিয়ে আসছে? কিছুই তো  মাথায় আসছে না।
--- সবকিছু মাথায় আসার দরকার বা কি এই বয়সে?একটা রাতের তো ব্যাপার সে আসলেই সব কিছু বোঝা যাবে।
--- আচ্ছা একটা কথা আমায় বলতো?অম্বিকা যখন ছিল নিলু ফোন করলো অথচ তুমি তার সামনে নিলুর আসার কথাটা বললে না?এর কারণটা কি?মেয়েটা বাড়ি বয়েএসে আমাদের খবর নিতে এলো তুমি তো তার সাথে ভালো ব্যবহার করলেই না উপরন্তু নিলুর আসার খবরটাও তার সামনে দিলেনা,তুমি মেয়েটা সম্পর্কে কী ধারণা করছো বলতো?
--- আমিও তো একটা কথা কিছুতেই মাথায় আনতে পাচ্ছিনা সেই থেকে তুমি আমাকে দোষারোপ করে যাচ্ছ কেন? আসলে মেয়েটার পরে আমার রাগের কারণ হচ্ছে, মেয়েটা যদি সেদিন বেকে না বসতো তাহলে তার সাথে নিলুর বিয়েটা হত।তাহলে নিলুর জীবনটা তছনছ হয়ে যেত না।
--- বাহ! চমৎকার!তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পাচ্ছি না। কি করলে কি হত সেটা ভাবছো কিন্তু তোমার ছেলের কপালে যে এটা লেখা ছিল এটা কোন অবস্থাতেই খন্ডানো যেত না সেটা একবারও ভাবছো না।উল্টে তার সাথে তোমার ছেলের বিয়ে হয়নি বলে তুমি তাকেই দোষারোপ করছো! বুদ্ধির বলিহারি তোমার!
--- হ্যাঁ আমি তো বোকা, হাবা কিছুই বুঝিনা।তুমি সবকিছু বুঝে বসে আছো--- ।
--- এই চুপ করো তো এবার।আমার আর ভাল লাগছে না। মেয়েটার সাথে তোমার ওই ব্যবহার আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা।প্রয়োজনে আমি নিলুকে সব কথা জানাবো
--- হ্যাঁ তাতো জানাবেই। সে যে আমায় একটু বেশি ভালোবাসে তার জন্য তোমার যে হিংসা হয় সেটা কি আর জানি না।তার কাছে তার মাকে তো ছোট করতেই হবে তোমার।
--- আজ ত্রিশ বছর ধরে সামান্য ব্যাপারে তোমার এই আমার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার স্বভাবটা কিছুতেই গেল না।একবার সুযোগ পেলেই হল। তুমি থাকো এখন তোমার সিরিয়ালের সময় হয়ে গেছে।তুমি সিরিয়াল দেখো।আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি যদি তোমার ঝগড়াটা অন্তত থামানো যায়।
--- আসলে আমার সাথে তোমার এই ঝগড়া করা একটা বাহানা মাত্র বাইরে বেরোনোর জন্য।যাও- বাইরে থেকে ঘুরে আসো।আমিও সিরিয়ালটা একটু মন দিয়ে দেখতে পারি।শ্রীময়ীর কপালটা যেন ঠিক আমারই মত। কিছুতেই শান্তি তার কপালে নেই। মলিনাদেবী শ্রীময়ীর দুঃখে ভরা জীবন নিয়ে বকবক করতেই থাকেন আর এই সুযোগ পেয়ে নরেশ বাবু একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েন।
  অম্বিকা নিলয়দের বাড়ি থেকে বেরনোর পর তার মাথার ভিতর একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে- 'কি কারনে মাসিমা তার সাথে এমন ব্যবহার করলেন?সে তো আগে কোনদিনও তাদের বাড়িতে যায়নি।তারা যেদিন তাদের বাড়িতে এসেছিলন সেদিন তো বাবা-মা বা সে নিজে কেউই তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। তবে তার যাওয়াটা মাসিমা  ভালো চোখে দিলেন না কেন?বাবা-মা একসময় চেয়েছিলেন  যাতে নিলয়দার সাথে তার বিয়ে হয়।তখন সেই ই রাজি হয়নি।কারণ নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করতে সে  চায়নি। কিন্তু সে কথা তো নিলয়দার  বাবা-মায়ের জানার কথা নয়। এটাতো তার বাবা-মায়ের মনের কথা ছিল। কি জানি বাবা মানুষকে চেনা বড় শক্ত। নিলয়দা বলে গেছিলো তাই আজ সুযোগ পেয়ে তার বাবা-মাকে দেখতে গেছিল।তবে জীবনে আর কোনদিনও ওই বাড়িমুখো সে হবেনা বলেই মনেমনে প্রতিজ্ঞা করলো। যদিও মেসোমশাই অনেক করে বলে দিয়েছেন তাকে ওই বাড়িতে যেতে কিন্তু মাসিমার ব্যবহার তার কিছুতেই  বোধগম্য হচ্ছে না।
  অম্বিকা চাকরি পাওয়ার পর থেকে তার মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচি আগের থেকে অনেক কমে গেছে। এখন সে নির্বিঘ্নে বাড়ির বাইরে বেরোতে পারে এবং সময়মতো ফিরতে না পারলেও তাকে জবাবদিহি করতে হয়না।বাড়ির ছাদে  এখন এসে কাল,ছিল ও মনেহয় বসে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সে তার বাবাকে বলেই বেরিয়েছিল যে সে নিলয়দার  কথামতো সে তার বাবা-মায়ের খবর আনতে যাচ্ছে এবং এই কথাটা যেন বাবা তার মাকে জানিয়ে দেন।কারণ সেই মুহূর্তে তার মা সামনে ছিলেন না।তাই বাবাকেই কথাটা বলে বেরোনো।নাহলে সে মাকে বলেই সব সময় বেরোয় চাকরি পাওয়ার পর থেকে।
বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে অম্বিকার মা জানতে চান নিলয়ের বাবা মা কেমন আছেন?অম্বিকা "ভালো আছেন"- বলে ভিতরে ঢুকে যায়।কারণ মলিনাদেবীর ওই টাস টাস কথাগুলি কিছুতেই অম্বিকা হজম করতে পারছে না। আর গাল বাড়িয়ে থাপ্পড় খাওয়ার মত নিলয়ের কথা শুনে ওই বাড়িতে যাওয়া তার ঠিক হয়নি বলে এখন অম্বিকার মনে হচ্ছে। অম্বিকা নিলয়দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতে সেই যে নিজের ঘরে ঢোকে তারপর সে সেই ঘর থেকে আর বেরোয় না। ডিনারটা তারা একসাথেই করে।অম্বিকাকে সময় মত খাবার টেবিলে দেখতে না পেয়ে রাত দশটা নাগাদ তার বাবা গিয়ে তাকে খাবার টেবিলে ডেকে নিয়ে আসেন এবং তার কাছে জানতে চান তার কি হয়েছে? অম্বিকা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
 --- মাথাটা একটু যন্ত্রণা করছিল তাই এসে শুয়ে ছিলাম।অমলবাবু সরল মনে সেটাই বিশ্বাস করেন। খাওয়া-দাওয়ার পর অম্বিকা যখন ঘরে শুতে যায় তখন রাত প্রায় পৌনে এগারটা। হঠাৎ তার মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।এত রাতে ফোনটা বাজার সাথে সাথে রিসিভ না করেই সে বুঝতে পারে কে তাকে ফোন করেছে।

ক্রমশঃ

    

No comments:

Post a Comment