Thursday, March 11, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩০)

সুখের ঘরে আগুন (৩০)

   মনটা সন্ধ্যা থেকেই অম্বিকার  খারাপ ছিল।এখন ফোনটা আসায় কিছুটা হলেও তার ভালো লাগলো।ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে নিলয় বলল,
---  ডিস্টার্ব করলাম? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি?
--- আরে না না সবে খেয়ে আসলাম।আর এই কথাটা আমার একদম ভালো লাগলো না।বিরক্ত কেন হব?আমি তো বলেছি আপনাকে বেশি রাতেই ফোন করতে।ওহোএকটা কথা বলার আছে আপনাকে।আজকে আপনাদের বাড়িতে গেছিলাম।মাসিমা,মেসোমশাই ভালো আছেন। মেসোমশাইয়ের সাথে অনেকক্ষণ কথা হলো।খুব ভালো মানুষ উনি।
--- আর মা?
--- হ্যাঁ উনার সাথেও কথা হয়েছে। উনি তো কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তাই সেভাবে কথা বলতে পারিনি।তবে মাঝে মাঝে আমাদের নানান আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন।বলুন আপনি কেমন আছেন?
নিলয় একটু চুপ করে থেকে বলল,
--- কাল সকালে আসছি।পরদিনই চলে যাবো।একটু দেখা করতে চাই,কিছু বলার ছিল 
 অম্বিকা নিলয়ের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো,
---  সে তো ভুবনেশ্বরে যাওয়ার আগেও বলেছিলেন, 'কথা আছে আপনার সাথে ফোন নাম্বারটা দিন-' কই সেখানে পৌঁছে মাত্র একদিন ফোন করেছিলেন আর কিছুই তো বলেননি।ইনফ্যাক্ট একদিন ছাড়া আর ফোনও করেননি।
--- এখানে আসার মাঝপথ থেকেই একটা সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে গেছি। সেটা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম, যে কথা বলবো বলে ফোন নাম্বার নিয়েছিলাম সে কথা বলা হয়ে ওঠেনি।আর এই না-বলা কথাগুলো জমতে জমতে এখন পাহাড় সমান হয়েছে।সুতরাং আপনাকে একটু বেশি সময় দিতে হবে আমাকে।অবশ্য আপনি বলতেই পারেন যে কেন আপনি আমার জন্য এতটা সময় নষ্ট করবেন?কিন্তু সত্যি বলছি আমার এই কথাগুলো একমাত্র আপনাকে বলা যায় বা বলতে পারেন বলা উচিত।
--- আচ্ছা ঠিক আছে আপনার জমানো পাহাড় সমান কথাগুলো আমি শুনবো।কিন্তু সেটা আমার বা আপনার কারো বাড়িতে সম্ভব নয়, পাড়াতে তো নয়ই।তাহলে কি নিশিতাদের ফ্ল্যাটে কথা বলবেন?
--- না না সেখানেও সম্ভব নয়।আমরা বরং বাইরে কোথাও মিট করি।আমি পৌঁছে আপনাকে কাল ফোন করে সকালেই জানিয়ে দেবো।আমরা সন্ধ্যার দিকে দেখা করব।আজ তবে রাখছি।
 অম্বিকা ফোনটা কেটে দিয়ে ভাবতে লাগলো সে যা ভাবছে নিলয়দা কি তাকে সেই কথা বলতে চায়?? বিয়ের সাথে সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলেও মা তখন নিলয়ের সাথে তার বিয়েতে রাজি থাকলেও এখন রাজি হবেন বলে মনে হয় না। তবে বাবা তার ইচ্ছাকে ঠিকই প্রাধান্য দেবেন।মাকে নিয়ে তার চিন্তা।তবে সে যে মনে-মনে নিলয়কে ভালোবেসে ফেলেছে এটা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের মাথায় নিজেই একটা টোকা দিয়ে হেসে দিয়ে অজান্তেই মুখ থেকে তার বেরিয়ে এলো, "বড্ড বেশি ভাবছি নিলয়দাকে নিয়ে।কি না কি বলবে আর আমি কিনা উল্টোপাল্টা ভেবে চলেছি।"
 মলিনাদেবী এমনিতেই খুব সকালে ওঠেন আর আজ তার নিলু আসবে বলে সারা রাত যেন কিছুতে ঘুমাতেই পারেননি। কাকডাকা ভোরে তিনি উঠে পড়েছেন।
  সকাল আটটা নাগাদ বেলটা বেজে উঠার সাথে সাথে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পড়িমড়ি করে ছুটলেন দরজা খুলতে। মলিনাদেবীকে ছুটে আসতে দেখে নরেশবাবু একটু সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিলেন। মলিনাদেবী দরজা খুলে নিলুকে দেখেই বলে উঠলেন, 
---এত দেরি হল যে বাবা?ট্রেন কি লেট ছিল?
--- নাতো মা ট্রেন তো সঠিক সময়েই এসেছে।
 ঘরের ভেতর থেকে নরেশবাবু চিৎকার করে বলে উঠলেন, --তোর মা তো সারারাত না ঘুমিয়ে সেই ভোর থেকে বসে আছে তার নিলু কখন আসবে?
মদিনাদেবী বলে উঠেন, বসেই যদি ছিলাম তাহলে তোমার চা টা কে করে দিল?
 এতক্ষণ তারা খেয়াল করেননি যে নিলুর সাথে ধীর পায়ে একটি মেয়েও ভিতরে এসে ঢুকেছে। তার হাতেও একটি লাগেজ রয়েছে।তাকে দেখে মলিনাদেবী বললেন,
-- এ কাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিস নিলু?
--- বলছি মা সবকিছু বলছি তোমাদেরকে।
তারপর অচলার দিকে ফিরে বললো,
 --- অচলা তুই এই চেয়ারটাতে বোস। বুঝতেই পারছিস এঁরা আমার বাবা মা। আজ থেকে তোরও বাবা-মা।তুই যখন আমাকে দাদা বলে ডাকিস আমার বাবা-মা তোর বাবা-মা।
 নিলয়ের অচলাকে কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য ছিল বাবা মা যাতে অচলা আর  তাকে নিয়ে কোনরকম কোন খারাপ চিন্তা না করেন।
নরেশবাবু বললেন,
---এক কাজ কর নিলু, হাত-পা ধুয়ে আয় একটু ফ্রেস হয়ে  এসে চা খেতে খেতে তুই ওর সম্পর্কে আমাদের জানাস। নিশ্চয়ই এমন কোন পরিস্থিতির মধ্যে তুই পড়েছিলি;তাই মানবিকতার খাতিরে ওকে ফেলে দিতে পারিসনি,সাথে করে নিয়ে এসেছিস।আমিতো তোকে চিনি।তুই কি করতে পারিস আর না পারিস তা আমার জানা আছে।তাই বলছি কি এত তাড়াহুড়ো করার কোন দরকার নেই।তুই তো কাল বেরোবি; অনেক সময় আছে, একটু বিশ্রাম নে, টিফিন কর তারপর না হয় সব কথা শুনবো আমরা।
 স্বামীর কথা শুনে মলিনাদেবী একটু চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালেন।তারপর বললেন,
---  যা তবে হাত মুখ ধুয়ে আয়।
এবার তিনি অচলার দিকে ফিরে বললেন,
 -- নিলু বাথরুম থেকে বেরোনোর পর তুমিও এসো হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু চা জলখাবার খাও।
কথাগুলো বলে তিনি রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।তবে দরজা খুলতে যাওয়ার সময় তার ভিতরে যে আনন্দ আর উচ্ছাস ছিল অচলাকে নিয়ে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে এক নিমেষে মলিনাদেবীর মুখ থেকে সেই আনন্দ,উচ্ছাস উধাও হয়ে গেল।স্বামীর সামনে গলা চড়িয়ে কথা বললেও তিনি তার ছেলের সামনে কখনোই সে ভাবে কথা বলেন না।কারণ তিনি তার ছেলেকে ভালো ভাবেই চেনেন যে সে ঝামেলা ঝক্কি একদম পছন্দ করেনা।
 নিলয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে ঢুকে অচলাকে বলল, 
--- তুই ব্যাগের ভেতর থেকে জামা কাপড় নিয়ে আমার সাথে আয়। আমি তোকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিই।একদম লজ্জা পাবি না এখানে।এটা তোর নিজের বাড়িই ভাববি।
 ছেলের কথা শুনে মলিনাদেবী তার স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। নরেশবাবু চোখের ইশারায় তাকে চুপ করতে বললেন।অচলা ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ বের করে নিলয়ের সাথে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল।নিলয় ফিরে এসে বাবা মাকে অচলা সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করলো।
 অচলা সম্পর্কে সব কথা শুনে নরেশবাবু বললেন,
---তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমি মনে করি তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছো আমার ছেলে হিসেবে।একটা মেয়ের সম্মান এবং জীবন বাঁচানোর তুমি চেষ্টা করছ এতে তোমার বাবা হিসেবে আমার গর্ব বোধ হচ্ছে।তুমি ওকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না।আমরা আছি তো।ওর কোন অসুবিধা আমরা হতে দেবো না।এখন তুমি এখানে থাকো না সুতরাং মেয়েটি যদি এখানে থাকে তাহলে আমাদেরও ভালো লাগবে।কথাটা স্বার্থপরের মত শোনাচ্ছে ঠিকই; কিন্তু এটাই বাস্তব।তুমি একটা অচেনা অজানা মেয়ের জন্য এতটা রিক্স নিতে পেরেছো আর আমরা তার মাথার উপরে একটুখানি ছাদের আশ্রয় দিতে পারব না?পেট ভরে দুবেলা খেতে দিতে পারবো না?নিশ্চয়ই পারবো বাবা।আমি তোমার এই কাজটাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি।আর আমার মনেহয় তোমার মাও এতে কোন আপত্তি করবেন না।ও এখানে খুব ভালো থাকবে এটুকু নিশ্চয়তা আমি তোমাকে দিতে পারি।
 কথার মাঝখানেই অচলা এসে উপস্থিত হলো।সে একবারে স্নান করে এসেছে। মলিনাদেবী ওর চা টা ঢেকে রেখেছিলেন টেবিলের উপর। অচলাকে  আসতে দেখে নরেশবাবু বললেন,
---   আয় মা চা টা তো প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল।
নরেশবাবুর মুখে মা ডাক শুনে অচলা এসে নরেশবাবুর পায়ের কাছে বসে পা দুটো ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।তা দেখে মলিনাদেবী বলে উঠলেন,
---  আর তো তোর কন্যা মানায় না মা।তুই দাদা পেয়েছিস, বাবা-মা পেয়েছিস।এখন তো সবকিছুই তোর আছে।তাই তোর চোখে জল মানায় না। ওঠ উঠে বস।
 কথাগুলো বলে তিনি হাত ধরে অচলাকে তুলে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।অচলা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললো,
--- দাদাকে দেখেই বুঝেছিলাম যে তোমরা খুব ভালো মানুষই হবে।তোমাদের শিক্ষায় শিক্ষিত বলেই দাদা এত ভালো।এতদিন ভাবতাম আমার কপালটা খুব খারাপ।কিন্তু এখন দেখছি আমার কপাল যদি ভালো নাই হবে তোমাদের সাথে আমার পরিচয়ই হত না।সেদিন যদি দাদা আমার পাশে না  দাঁড়াতো আজ হয়তো আমি কোথায় হারিয়ে যেতাম।
 নিলয় ওর কথা শুনে বলে উঠলো,নে  হয়েছে এত বড় বড় কথা আর বলতে হবেনা।আমি ক'দিন পরে ফিরে আসি, আবার তোকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে।আমার বোন পড়াশোনা জানে না এটা তো আর হতে পারে না।তোকে প্রাইভেটে আমি মাধ্যমিক পাস করাবো। তারপর উচ্চমাধ্যমিক আর কলেজে যখন ঢুকবি তখন অবশ্য তোকে ক্লাস করতে হবে।
এরপর মায়ের দিকে ফিরে বলল,
--- মা, লুচি আর তোমার সেই বিখ্যাত হলুদ ছাড়া কালো জিরে কাঁচা লঙ্কা ফোঁড়ন দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি আলুর তরকারিটা করো।ভীষণ খিদে পেয়েছে।
 নিলয়ের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে অচলা টেবিলের উপর থেকে কাপ প্লেটগুলো গুছিয়ে নিয়ে মলিনাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-- মা, তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও আমি করছি।
--- আরে তুই কি করবি? সবেমাত্র এলি, একটা দিন অন্তত আমি করে তোকে খাওয়ায় তারপরে না হয় একটু আধটু  আমাদের করে খাওয়াবি।এক্ষুনি তোকে কিছু করতে হবে না।
--- আমি তোমার সাথে রান্নাঘরে যাই চলো।ময়দাটা মেখে আলুগুলো কেটে দিই। কাজ করলে আমার সময় কেটে যাবে আর আমি কাজ করতেই ভালোবাসি।আসলে ছেলেবেলা থেকেই তো কাজ করি তাই কাজ ছাড়া আমি বসে থাকতে পারিনা।
--- তাহলে চল দুজনে গল্প করতে করতে আমরা কাজ করি। আজ থেকে আমার খুব সুবিধা হল।আমি মেয়ে প্লাস একটা বন্ধুও পেলাম।

ক্রমশঃ

No comments:

Post a Comment