সুখের ঘরে আগুন (৩১)
মা আর অচলা রান্নাঘরে চলে গেলে বাবার সাথে একটু কথাবার্তা বলে নিলয় তার ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে।অম্বিকাকে ফোন করে।অম্বিকা ফোনটা ধরেই বলল,
--- আমি তো ভাবলাম আপনি ফোন করবেন আমায় বলেছিলেন সেই কথাটিই বুঝি ভুলে গেছেন।
---আচ্ছা আপনি আমাকে কি ভাবেন বলুনতো?আমি এত ভুলোমন?আমি তো সবসময়ই আপনার কথা---
--- কি হলো চুপ করে গেলেন যে?আমার কথা কি?
--- না থাক যদি কোনোদিন সুযোগ আসে না হয় সেদিন বলবো।
--- শুনুন জীবনে কিছু কথা আছে যা ফেলে রাখতে নেই। ফেলে রাখলে সেই কথার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। হয়তো এমন সময়ে আপনি কথাটা বললেন সেই কথাটাই আগে বললে যে কাজ হত দেরি করে বলাতে জীবনে পস্তাতে হল।
কথাগুলো বলে অম্বিকা হো হো করে হাসতে লাগলো।তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
--- বলুন আজ কোথায় আর কখন দেখা করতে চান?
--- দুপুর তিনটে কফি হাউজে। হাতে একটু সময় নিয়ে আসবেন কিন্তু।
অম্বিকা পুনরায় দুষ্টুমি করে বললো,
---গল্পটা কি খুব বড়?
--- আজ দেখছি আপনার মুডটা বেশ ফুরফুরে !
--- বলতে পারেন ---
-- কোন কারণ আছে কি ?
--- আগে আপনার সব কথাগুলো শুনবো তারপর আমার ফুরফুরে মুদের কারণটা আপনাকে জানাবো।
--- তথাস্তু,আমি আগেই বলবো ।
কথা শেষ করে নিলয় ঘরে এসে ঢুকে দেখলো মা আর অচলা লুচি আর আলুর তরকারি নিয়ে টেবিলে সবেমাত্র রাখছেন।সে তাড়াতাড়ি করে বেসিনে হাত ধুয়ে টেবিলে বসে গেল।
---দাও দাও মা, ভীষণ খিদে পেয়েছে।
তারপর অচলার দিকে ফিরে বলল,
--- মা আমাদের দুজনকে দিয়ে দেবেন।তুই ও বসে পর।
---নানা দাদা, আগে তুমি আর বাবা খেয়ে নাও।আমি আর মা একসাথে খাবো। জানো দাদা জন্মের পর এই প্রথম কাউকে মা বলে ডাকলাম।এই ডাকের মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি, আবেগ কাজ করে প্রথম বুঝতে পারলাম।আমি ভাবতাম রক্তের সম্পর্ক না থাকলে কেউ কখনো আপন হয়না।তোমায় দেখে সেই ধারণা আমার পাল্টাতে শুরু করেছিল। আর আজ এখানে এসে মা বাবাকে দেখে আমার সেই ধারনা সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে।তোমাদের না দেখলে কোনদিনও বুঝতে পারতাম না রক্তের সম্পর্ক থেকে এমন অনেক সম্পর্ক আছে যা আরো বেশি করে মানুষকে কাছে টেনে নেয়। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মা আমাকে এতটাই আপন করে নিয়েছেন যে আমি ছেলেবেলায় মাকে হারিয়ে যে কষ্ট পেতাম আজ এখানে এসে মাকে মা বলে ডেকে আমার সেই কষ্ট কোথায় যেন এক নিমেষে উড়ে গেছে।
মলিনা দেবী হেসে বললেন,
--- সত্যি নিলু তুই এই কাজটা খুব ভালো করেছিস আমাকে একটা লক্ষী মেয়ে এনে দিয়েছিস যে সব সময় আমার পাশে পাশে থাকবে।অল্প সময়েই মেয়েটার প্রতি আমার মায়া পরে গেছে।একটা কাজ করিস বাবা, এবার তো সময় নেই হাতে পরেরবার হাতে সময় নিয়ে এসে অচলাকে পড়াশুনার ব্যবস্থা করে দিস।অবশ্য তোর বাবা ই সবকিছু করতে পারবে কিন্তু এখন তো তার বয়স হয়েছে।তোরা তো এখন কম্পিউটারে সবকিছু করিস।তোর বাবা তো আবার এই কম্পিউটারে অতটা সরগর নয়।তুই বরং ওখানে থেকে ল্যাপটপে যদি কিছু করে ওর পড়াশোনার ব্যবস্থাটা করে দিস তাহলে তোর বাবা বাকি সবকিছু নিজে করতে পারবে।
---- হ্যাঁ মা আমিও সেটাই ভেবেছি।ওকে প্রাইভেটে মাধ্যমিকটা আগে পাশ করাই। বাবা প্রথম দিকে ওর পড়াশুনার দায়িত্বটা নেবেন। পরে আস্তে আস্তে টিচার রেখে দেবো।
অচলা সব শুনে বলে উঠলো,
--- এই বয়সে এসে আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলে আমি কি পারবো সবকিছু?
মলিনাদেবী অচলার কথা শুনে হেসে পরে বললেন,
--- খুব পারবি।আর এই বয়সের এসে মানে?তোর কত বয়স? তুই কি বুড়ি হয়ে গেছিস নাকি?আমার একটা মেয়ে থাকলে আমি তাকে লেখাপড়া শেখাতাম না?তোর যাতে ভাল হবে আমরা সেটাই করবো;আর তুই এই ব্যাপারে একটাও কথা বলবিনা।
নিলয় অচলার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- বড়দের মাঝখানে কথা বলতে নেই।এখন থেকে তোর ভাবনাটা আমরা ভাববো।তুই শুধু আমাদের কথা শুনে চলবি।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর নিলয় একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পরলো ।একটা উবের ধরে নিদ্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই কফিহাউস পৌঁছে গেলো।প্রথমে সে গেটের সামনেই অপেক্ষা করছিল।তারপর দোতলায় উঠে গিয়ে কোণের দিকে একটা টেবিলে অম্বিকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।কিন্তু নিদ্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার অনেক পরেও অম্বিকার দেখা না পেয়ে তাকে ফোন করে।রিং হয়ে যায় অম্বিকা ফোন তোলে না।কিছুই বুঝতে পারে না সে। এতদিনে অম্বিকাকে সে যে টুকুন চিনেছে তাতে তার মনেহচ্ছে সে ইচ্ছাকৃত না আসা করেনি। নিশ্চয়ই তার কোন বিপদ হয়েছে।প্রায় সাড়ে চারটে পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করে সে বেরিয়ে পরে মাথায় একগাদা প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে।ইচ্ছাকৃত সে অম্বিকাদের বাড়ির সামনে থেকেই আসে।ঘরে যথারীতি আলো জ্বলছে আশেপাশে এসে সে রকম কোন মানুষজনকেও দেখতে পায়না।খুবই মনক্ষুন্ন হয়ে পরে।যতবার ফোন করছে অম্বিকা ফোন তুলছে না।
বেরোনোর তাড়া ছিল।বাড়িতে এসে খেয়েদেয়ে যখন বেরোবে ঠিক তখনই ফোনটা রিং হয়।ভাবে বুঝি অম্বিকাই ফোন করেছে।দেখে প্রলয়ের ফোন।হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে প্রলয় বলে ওঠে,
--- একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
--- কার কি হয়েছে?
--- অম্বিকা আর নিশিতা একসাথেই বেরিয়েছিল।ওরা দুজনেই বাসে উঠবে বলে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটার দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই একটা বাইক এসে অম্বিকাকে ধাক্কা দেয়।অম্বিকা ছিটকে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের উপর গিয়ে পরে।সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায়।পথচারীদের সহয়তায় নিশিতা অম্বিকাকে নার্সিংহোম নিয়ে যায় আর আমাকে ফোন করে সব জানায়।এখন ওর জ্ঞান ফিরেছে।মাথায় সামান্য চোট পেয়েছে।মাসিমা, মেসোমশাই এসেছেন কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। কিন্তু তুই তো আবার ওদের বাড়িতে যাস না।রাতের দিকে একটা ফোন করে খবর নিস।অম্বিকাই আমাকে বললো তোকে খবরটা দিতে।
নিলয় খবরটা শুনে বসে পড়লো।বাবা ছিলেন কাছে দাঁড়িয়ে।নিলয়ের মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন।জানতে চাইলেন,
--- কার কি হয়েছে?
নিলয় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- আমার এক বন্ধু ফোন করেছিলো।ওই যে আমাদের পাড়ায় অম্বিকা সেনের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
--- সে কি ?কেমন আছে মেয়েটি এখন?
--- তেমন বিশেষ কিছু হয়নি তবে হতে পারতো।জ্ঞান ফিরেছে।ছেড়ে দেবে আজই।
--- মেয়েটি বড্ড ভালো রে!সেদিন এসেছিল।বেশ মিশুকে মেয়ে।তাহলে আমি এক কাজ করি।তোর সাথে বেরিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে ওদের বাড়িতে একবার দেখে আসি।
--- আর একটু রাত করে যাও।এখনো ওরা বাড়িতে ফেরেনি।আমাকে তো যেতেই হবে আজ।
ওদের কথার মাঝখানে মলিনাদেবী আর অচলা একটা টিফিনবক্স গুছিয়ে নিয়ে এলেন নিলুর রাতের খাবার।অচলা এসে দাদার হাতে টিফিনবক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
--- দাদা,তোমার রাতের খাবার।
--- পেট ভরে তো টিফিন করলাম;আবার রাতের খাবার?
মলিনাদেবী ছেলের কথা শুনে বললেন,
--- রাতে ঠিক খিদে পেয়ে যাবে।তুই তখন কি করবি?না খেয়েই থাকবি?
নিলয়ের মনটা মোটেই ভালো ছিলোনা।সে আর কথা না বাড়িয়ে টিফিনবক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।মা,বাবাকে প্রণাম করে অচলার মাথায় হাত রেখে বললো,
--- সাবধানে থাকিস।নিজের খেয়াল রাখবি ।কোনরকম কোন অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গেই আমায় ফোন করবি।
নিলয় বেরিয়ে যাওয়ার পর নরেশবাবু কিছুক্ষণ পর বেরোতে গেলে মলিনাদেবী বলে উঠলেন,
--- তুমি আবার এই রাতে কোথায় চললে?
--- যাবো একটু অমল সেনের বাড়ি।উনার মেয়েটা আজ একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।
--- সে কি?তুমি কার কাছে খবর পেলে?
--- ওই তো নিলুকে ওর এক বন্ধু ফোন করে জানাল।তাই ভাবলাম সেদিন মেয়েটা এসে আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে গেলো।আজ ওর বিপদের দিনে একটু পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
--- তা সাবধানে যেও।আজ শরীর আর দিচ্ছে না।আমি নাহয় কাল অচলাকে সাথে করে নিয়ে ওকে একটু দেখে আসবো।
নরেশবাবু মুখে কিছু বললেন না,কিন্তু মনেমনে ভাবলেন,' বুঝি না বাপু,এই মহিলার মনের মতিগতি।সেদিন মেয়েটা বাড়ি আসলে ঐ ব্যবহার আর আজ বলছে কাল তাকে দেখতে যাবে ---।"
ক্রমশঃ
No comments:
Post a Comment