এ ভাঙ্গা বসন্ত বেলা
মাত্র পাঁচটা বছরেই জীবনের সব রং যেন মুছে গেছে।ভালোবেসে অঙ্কিতা বিয়ে করেছিল শাশ্বতকে বাড়ির সকলের অমতে। কিন্তু শাশ্বতদের বাড়ির সকলেই তাকে মেনে নিয়েছিল। শাশ্বতদের বাড়িতে কুলদেবতা রাধা কৃষ্ণের এক মন্দির ছিল। দোল পূর্ণিমার দিনে খুব ঘটা করে পুজো হত।পুরো পাড়ার লোক ওই দিনে হাজির হয়ে যেত তাদের বাড়িতে পুজো দেখা আর রং খেলার জন্য। এমনই এক দোল পূর্ণিমার দিনে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে পরিবারের একমাত্র ছেলে শাশ্বত রায় চলে যায় চিরতরে।জীবনের সব রং যেন এক নিমেষে বেরঙিন হয়ে যায় অঙ্কিতার জীবনে।অঙ্কিতার শ্বশুর শ্বাশুড়ি খুবই ভেঙ্গে পড়েন।বিয়েতে অঙ্কিতার বাবা-মার আপত্তি থাকলেও এই দুর্ঘটনার কথা শুনে তারা দূরে সরে থাকতে পারেন না।তারা এসে অঙ্কিতাকে তাদের কাছে নিয়ে যান।অঙ্কিতা শাশ্বতর চাকরি এবং সমস্ত টাকা-পয়সা পায়।কারণ বিয়ের পরে শাশ্বত তার সমস্ত কিছুর নমিনি অঙ্কিতাকে করেছিল।চাকরি পাওয়ার দিন পনেরর মধ্যে অঙ্কিতা বাপের বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য শ্বশুরবাড়িতে পুনরায় ফিরে আসে।সে তার বাবা-মাকে যুক্তি দেখায় শাশ্বত না থাকাকালীন সময়ে যদি তার চাকরি এবং সমস্ত কিছু অধিকারী সে হয় তাহলে তার বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্বও তার।সে কোনো অবস্থাতেই এই চাকরি এবং টাকা পয়সা নেওয়ার পর এই বাড়ীতে থেকে যেতে পারবে না।তাকে তবে ওই বাড়িতে ফিরে যেতে হবে এবং তাদের সমস্ত দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
শাশ্বতর অফিস এখন অঙ্কিতার অফিস।সহকর্মী সুদীপ্ত বোসের সাথে অঙ্কিতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।হোলির দুদিন আগে অফিসের সকলেই অল্পবিস্তর সকলকেই রঙ মাখায়। সুদীপ্ত কিন্তু অঙ্কিতাকে কোন রং দেয় না।যেহেতু সুদীপ্ত অঙ্কিতাকে রঙ মাখায় না সেইহেতু অঙ্কিতাও কোন রং সুদীপ্তকে ছোঁয়ায় না। শাশ্বত চলে যাওয়ার পর এটা তার জীবনের দ্বিতীয় হোলি।প্রথম বছর হোলির দিনে খুবই মনমরা হয়ে ছিল অঙ্কিতা।কিন্তু সময় যে মানুষের জীবনে একটা বড় ওষুধ। আস্তে আস্তে ক্ষতগুলির উপর একটা প্রলেপ ফেলে দেয়।ঢাকা পড়ে যায় দগদগে ঘা টা ।তখন যন্ত্রণাটা ভিতরে থাকলেও ওই প্রলেপটা কিছুটা হলেও লোকালয়ে ব্যথার উপশম আনতে সাহায্য করে।কারণ ফেলে আসা অতীতে যে ঘা সৃষ্টি হয় তার যন্ত্রণাটা শুরু হয় নির্জনে একাকী অবস্থায়।
শাশ্বত চলে যাওয়ার পরেই তাদের বাড়িতে ঘটা করে দোল পূর্ণিমার উৎসব আর পালন করা হয়না।নিত্য পুজোর মতোই দোল পূর্ণিমার দিনেও সামান্য পুজো হয়।আর পাঁচটা দিনের মত এ দিনটাও কাটে। এ বাড়িতে গতবছর দোলের দিন আর কেউ আসেনি।কিন্তু এবারে সকাল এগারোটা নাগাদ হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে ওঠায় সবাই একটু হকচকিয়েই যায়।দরজা খুলে অঙ্কিতা দেখে সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে। বুকটার ভিতর অঙ্কিতার ধরাস করে ওঠে।কারণ বোধকরি সে মনেমনে সুদীপ্তকে ভালোবেসে ফেলেছিল কিন্তু প্রকাশভঙ্গি তার ছিলোনা।অঙ্কিতার পিছনে কিছুটা দূরেই কৌতূহলবশত দাঁড়িয়ে তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ী।সুদীপ্ত কোন ভনিতা না করেই বললো,
--- কিছুটা লাল আবির নিয়ে এসেছি যদি অভয় দাও তোমার লাল রঙে রাঙিয়ে দিতে চাই।
--- মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি ?
অঙ্কিতা অবাক বিস্ময়ে কথাটা বলে।সুদীপ্তর উত্তর দেওয়ার আগেই অঙ্কিতার শ্বশুর ,শ্বাশুড়ী এসে অঙ্কিতার কাছে দাঁড়িয়ে বলেন,
--- তোমায় তো বাবা ঠিক চিনতে পারলাম না।
--- আমি অঙ্কিতার সাথে চাকরি করি।ওকে ভালবাসি,বিয়ে করতে চাই --- অবশ্য আমি জানিনা ওর এতে মত আছে কিনা।আর সেটা জানতেই আজ আমার এখানে আসা।
--- মেয়েকে সংসারী করা প্রত্যেক বাবা মায়ের কর্তব্য। ও একটি বাচ্চা মেয়ে।আমরা আজ আছি কাল নেই।ওর ভালোমন্দের দায়িত্ব আমাদের ।আমরা বলছি তুমি ওকে আবির মাখিয়ে দাও।কোন এক দোলের দিনে আমরা আমাদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছি।আর আজ এই দোলের দিনেই তুমি আমাদের সেই সন্তান হয়েই আবার ফিরে এসেছ।তোমার মধ্যেই আমরা আমাদের ছেলেকে খুঁজে নেবো।
সুদীপ্ত এগিয়ে গিয়ে তাদের সামনেই অঙ্কিতাকে লাল আবিরে রঞ্জিত করে দিলো।
No comments:
Post a Comment