কুঁড়ি থেকে ফুল
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
সতীশবাবু সাত পাঁচ না ভেবেই ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করা আট ন'বছরের মেয়েটিকে নিয়ে একদিন বাড়ি ফেরেন। কিছুদিন ধরে তিনি লক্ষ্য করছেন মেয়েটি একাএকা বসে ভিক্ষা করছে।যাওয়া আসার তাড়ায় সময় করে মেয়েটির কাছে জানাও হয়না আগে তার কাছে একজন বয়স্ক মহিলা বসে থাকতেন তিনি এখন থাকেননা কেন?
যাতায়াতের পথে রোজই তিনি তাদের কিছু পয়সা বা কোনদিন কিছু খাবার কিনে দিতেন।এটা প্রায় গত একবছর ধরে চলছে।প্রথম কয়েকদিন ভেবেছিলেন মহিলা হয়তো আশেপাশে কোথাও আছেন।কিন্তু বেশ কিছুদিন তাকে দেখতে না পেয়ে তিনি বাচ্চা মেয়েটির কাছে জানতে চান,
--তুমি একা কেন?
--ও তুমি দিদিমার কথা বলছো?সে তো আর নেই।
সতীশবাবু লক্ষ্য করলেন মেয়েটির চোখের কোনদু'টি জলে ভেজা।
--ও উনি তোমার দিদিমা হন।তা উনি কোথায় গেছেন?
--আমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন । এখন আমার আর কেউ নেই।একা একাই বস্তিতে থাকি।
সতীশবাবুর মুহূর্তে মনে পরে গেলো এই কয়েকদিন আগে স্টেশনে ঘুমন্ত মায়ের কোল থেকে ছ'বছরের শিশুকন্যাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মানুষরুপী দুটি দানব ----কি অত্যাচারই না করলো!শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে মেরেই ফেললো।মুহূর্তে নিজ কর্তব্য স্থির করেন।এই বাচ্চাটিকে কোন অবস্থায়ই তিনি এভাবে শেষ হতে দেবেননা।আগুপিছু না ভেবেই তিনি বললেন,
---যাবি তুই আমার সাথে আমার বাড়ি?সেখানে থাকবি,খেলবি,পড়াশুনা করবি।
---তাহলে ভিক্ষা করবো কখন?
---আর ভিক্ষা করতে হবেনা তোকে।চল মা,এখানে থাকলে তোকে কেউ বাঁচতে দেবেনা।
কিন্তু সতীশবাবুর স্ত্রী সেদিন স্বামীর এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি।সতীশবাবু অনেক বুঝিয়েছেন তার স্ত্রী সরলাদেবীকে।কিন্তু তার স্ত্রী নাছোড়বান্দা টুকটুকিকে আবার স্টেশনে রেখে আসতে হবে।তিনি তার ইংলিশমিডিয়ামে পড়া ছেলের সাথে চালচুলোহীণ একটি মেয়েকে কিছুতেই বড় হতে দেবেননা।এতে তার ছেলের জীবনে মারত্মক ক্ষতি হবে।
কলেজস্ট্রীটে বিশাল বই এর দোকান।ভাগ্যলক্ষ্মী তাকে ধরা দিয়েছেন। শান্তশিষ্ট পরোপকারী মানুষটি মেয়েটিকে নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন।কিছুতেই তিনি টুকটুকিকে নিজের কাছছাড়া করবেননা।টাকা পয়সার যেহেতু কোন অভাব নেই তাই বন্ধুদের পরামর্শ মত তিনি টুকটুকিকে একটি ভালো বোর্ডিং এ রাখার ব্যবস্থা করেন আর এই কথা তিনি বাড়িতে ও আত্মীয়স্বজনের কাছে সম্পূর্ণ গোপন করে যান।টুকটুকির জীবনের সমস্ত কথা তিনি বোর্ডিং প্রধানের কাছে খুলে বলেন এবং এও বলেন-স্কুল ছুটির দিনগুলোতে তিনি ওকে বাড়িতে নিয়ে আসতে পারবেননা।প্রধান তাকে আসস্ত্ব করেন এই ব্যপারে।তিনি টুকটুকির একটা সুন্দর নাম দেন-'অর্জিতা'।
ঘড়ির কাঁটার সাথে সাথে জীবনের কাঁটাও পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলে।সতীশবাবুর ছেলে এখন মস্তবড় ডাক্তার।বই এর দোকানে এখন তিনি আর নিত্য যাতায়াত করতে পারেননা।মাঝেমধ্যে ছেলের কেনা গাড়িতে যাতায়াত করেন।কর্মচারীরাই দেখাশুনা করে।আর সতীশবাবুর টুকটুকি তার মেধাশক্তির পরিচয় দিয়ে কলেজের পড়া শেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং এ শেষবর্ষ।
মস্তবড় এক জটলা দেখে গাড়ি থেকে নেমে ডক্টর সুশান্ত হালদার সেদিকে এগিয়ে যায়।সেখানে পৌছে দেখে একটি বাইশ তেইশ বছরের মেয়ে একজন বৃদ্ধের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে ঘিরে থাকা মানুষজনগুলোকে হাত জোর করে একটু সাহায্য প্রার্থনা করছে।বলাবাহুল্য জনতা নীরব দর্শক হয়েই বৃদ্ধের করুন পরিণতি দেখতেই ব্যস্ত।ডক্টর হালদার বেশ রাগত কণ্ঠে সকলকে সরে যেতে বলেন।তারপর নীচুতে বসে বৃদ্ধকে পরীক্ষা করে দু'একজনের সহয়তায় বৃদ্ধকে তার নিজ গাড়িতে তুলে মেয়েটিকেও উঠতে বলে।গাড়িতে উঠতে উঠতে মেয়েটি জানায় যে সে কিন্তু বৃদ্ধ ভদ্রলোককে চেনেনা।
ডক্টর সুশান্ত হালদার তাদের নিয়ে একটা পরিচিত নার্সিংহোম আসেন।ঘন্টা খানেক পড়ে বৃদ্ধের জ্ঞান ফিরে আসলে তার কাছ থেকে তার বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ করা হয়।ততক্ষণে মেয়েটি অথাৎ টুকটুকি ওরফে অর্জিতার কাছ থেকে ডক্টর সুশান্ত জানতে পারে সে কলেজ থেকে যখন হোস্টেলে ফিরছিলো তখন দেখতে পায় এই বয়স্ক ভদ্রলোকটি রাস্তার পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।কিছু লোক তাকে ঘিরে আছেন ঠিকই কিন্তু কেউই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি।ডক্টর সুশান্তর এই পরোপকারী মেয়েটিকে বেশ ভালো লেগে যায়।অর্জিতার আপত্তি সত্ত্বেও সে তাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে আসে।সেই শুরু।তারপর দুটি হৃদয় যে কখন কবে এক হয়ে গেছে তা বোধকরি তারা দুজনের কেউই টের পায়নি।
সতীশবাবু মাঝে মধ্যেই টুকটুকির সাথে দেখা করতে হোস্টেলে যান।কিন্তু টুকটুকি 'বলবো বলবো' করেও তার বাবাকে (বাবা বলেই ডাকে সে সতীশবাবুকে)ডক্টর সুশান্ত হালদারের কথা বলতে পারেনা।সতীশবাবু টুকটুকির সাথে একদিন দেখা করে যখন গাড়িতে উঠতে যাবেন ঠিক তখনই তার মাথাটা ঘুরে যায়।টুকটুকি দৌড়ে গিয়ে ধরে ফেলে এবং গাড়ির ড্রাইভারের সহয়তায় তাকে নিয়ে একটি বড় নার্সিংহোম আসে।ইতিমধ্যে ড্রাইভার তার ছেলে সুশান্তকে ফ়োন করে ঘটনাটা জানালে সুশান্তর নির্দেশমত সতীশ বাবুকে সেই নার্সিংহোমেই আনা হয়।গাড়ি থেকে নামার আগেই সেখানে হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীদের সাথে স্ট্রেচার নিয়ে সেখানে সুশান্তকে দেখে আর সুশান্তর উদ্বিগ্ন হয়ে সতীশবাবুর মুখের উপর পড়ে 'বাবা বাবা' ডাক শুনে টুকটুকির আর বাকি থাকেনা যে সে কত বড় মারাত্মক ভুল করেছে।ভীড়ের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে যাতে সুশান্তর চোখে না পড়ে।কিছুক্ষণ হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে থেকেও কোন সংবাদ সংগ্রহ করতে পারেনা।নিজেকে খুব অসহায় লাগে তখন।পুরনো কথা ভাবতে থাকে।বোর্ডিং এ থাকাকালীন সময়ে একবার তার খুব জ্বর হয়েছিলো।সতীশবাবু প্রায় সাতদিন ধরে সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি তার শিয়রে বসে থাকতেন।শুধু রাত্রে একটু সময়ের জন্য তিনি বাড়িতে ফিরতেন অশান্তির ভয়ে।একদিন মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করছিলেন যা আজও টুকটুকির স্পষ্ট মনে আছে,
'মা রে তুই খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যা-তানাহলে আমি যে হেরে যাবো---' আর আজ সেই মানুষটার এই অসুস্থ্যতার সময়ে সে একটু কাছে গিয়ে খবরও আনতে পারছেনা।গেলেই যে সুশান্তর কাছে নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।কি করবে সে এখন?আস্তে আস্তে সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে গাড়ির ড্রাইভারের শরণাপন্ন হয় বাবার একটু খবরের জন্য।বয়স্ক ড্রাইভার আজ তিনবছর ধরে সতীশবাবুর গাড়ি চালাচ্ছে টুকটুকির সাথে সে বাবুর সম্পর্কটা জানে।সে তার ফ়োন নংবরটা টুকটুকিকে দেয় ও টুকটুকিরটা নিজে নেয়- ছোটবাবু যখন বাড়ি ফিরবেন তখন জেনে জানাবে কারন এখন ভিতরে ঢুকলে ছোটবাবু রাগ করবেন।টুকটুকির সাথে যখন ড্রাইভারের কথা হচ্ছে ঠিক তখনই সতীশবাবুর স্ত্রী তার ভায়ের সাথে একটা ক্যাব থেকে নামতে দেখে টুকটুকি একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।টুকটুকি দেখে ড্রাইভারকে কিছু জিজ্ঞাসা করে দুজনেই হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে চলে যায়।চোখের ইশারায় টুকটুকিকে থাকতে বলে ড্রাইভারও তাদের পিছু নেয়।প্রায় পনের কুড়ি মিনিট পরে ড্রাইভার এসে খবর দেয়,'বড়বাবুর ছোট একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে তবে এখন ভালো আছেন।আপনি চিন্তা করবেননা দিদিমণি,আসলে উনার ছেলে তো ডক্টর তাই বড়বাবুর কোনই অসুবিধা হবেনা।'টুকটুকি কিছুটা নিশ্চিত হয়ে একটা ক্যাব বুক করে নিজের হোস্টেলে ফিরে আসলো।সারারাত সে একটুও ঘুমাতে পারলোনা।খুব ভোরে সে সুশান্তকে ফোন করলো।বেশী কয়েকবার রিং হওয়ার পর ঘুম জড়ানো কণ্ঠে সুশান্ত
'হ্যালো' বললো।নিজেকে সামলে নিয়ে টুকটুকি একটু অভিমানের সুরে বললো,
---কাল থেকে একটাও ফ়োন করোনি,তোমায় দেখতে খুব ইচ্ছা করছে,আজ একটু দেখা করা যাবে?
---কাল থেকে আমি একটুও সময় পাইনি। বাবার হঠাৎ করে খুব অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন।সারারাত নার্সিংহোম ছিলাম।কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছি।
টুকটুকি এই কথাটারই অপেক্ষায় ছিলো।সে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো,
---কি হয়েছে বাবার? এখন কেমন আছেন?আমি তাকে দেখতে যাবো।
---বাবা এখন আউট ওফ ডেঞ্জার।তবে দুটোদিন নার্সিংহোম থাকতে হবে।কিন্তু তোমার তো কলেজ আছে।কলেজ করে বিকালে এসো।
---না,আমি এক্ষুণি যাবো।
--কিন্তু এগারোটার আগে এসে কি করবে?ওই সময় আবার মা আসবেন।
---সে আমি জানিনা।ওখানকার তুমি ডক্টর।তুমি ব্যবস্থা করবে আমি আসছি।
---আসছি মানে?কোথায় আসছ?নার্সিংহোমের নামটা তো শোনো----।
সকাল ন'টার মধ্যে টুকটুকি নার্সিংহোম পৌঁছে সুশান্তকে কল করে।তখনও সে এসে পৌঁছায়নি।সুশান্ত তাকে সোজা icu এ চলে যেতে বলে আর একজন ডাক্তারের নামও বলে দেয়।বেড নম্বরটা জেনে নেয় টুকটুকি।
সোজা এসে বাবার বেডের কাছে দাঁড়ায় টুকটুকি।সতীশবাবু তখন চোখ বন্ধ করে ছিলেন।পাঁচমিনিট সময় বরাদ্দ।বাবার মাথায় হাত দিয়ে টুকটুকি ডাকে,'বাবা কেমন আছো এখন?'সতীশবাবু চোখ মেলে তাকান।অক্সিজেন চলছে।মুখে মাস্ক। ইশারায় বললেন ভালো আছেন।কিন্তু চোখে তার অনেক প্রশ্ন।বুঝতে পেরেই টুকটুকি বললো,
---বাবা আমি জানি অনেক প্রশ্ন তোমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।তুমি সুস্থ্য হও সব তোমায় বলবো।তুমি একদম আমায় নিয়ে ভেবোনা।আমি ভালো আছি।এখন আমি আসি।আর দাঁড়ালে বকাবকি করবে এখান থেকে।বিকালে আবার আসবো।
বাইরে বেরিয়ে এসে টুকটুকি দেখে সুশান্ত আসছে।
---দেখলে বাবাকে?কি পরিচয় দিলে?
---পরিচয় আবার কি দেবো?বললাম তোমার বন্ধু।বিকালে আবার আসবো বলেছি।
---সেই ভালো।তুমি কি দাঁড়াবে নাকি হোস্টেলে ফিরবে।আমার তো দেরি হবে।
---না না আমি হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছি তুমি বাবার কাছে যাও।
দুদিন বাদে সতীশবাবু বাড়ি ফেরেন।এই দুদিনই বিকাল করে টুকটুকি নার্সিংহোম গেছে তার বাবাকে দেখতে।সতীশবাবু বারবার জানতে চেয়েছেন সুশান্তকে কিভাবে সে চেনে?কিন্তু প্রতিবারই সে বলেছে 'তুমি সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফেরো সব বলবো।'সতীশবাবু বাড়ি ফেরার পরদিন টুকটুকি সুশান্তর সাথে বহুবছর বাদে আবার এই বাড়িতে ঢোকে।প্রথমেই সুশান্ত মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় তার বন্ধু বলে।পরে তাকে নিয়ে যায় তার বাবার ঘরে।টুকটুকি অবাক হয়ে দেখে বাড়ির সর্বত্র একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া আসলেও তার বাবার ঘরটা ঠিক সেই আগের মতই আছে।টুকটুকি আস্তে আস্তে খাটের উপর ঠিক বাবার পাশটিতেই বসে।
---এবার আমাকে খুলে বলতো মা,এ অসম্ভবকে সম্ভব করলি কি করে?
টুকটুকি সুশান্তর সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিন থেকে আজ পর্যন্ত ঘটা সব ঘটনায় তার বাবাকে জানায়।আর এও বলে,
---বাবা,তুমি কিন্তু আমার পরিচয় দেবেনা।তুমি সুস্থ্য হও আমি আস্তে আস্তে তোমার ছেলের কাছ থেকে দূরে সরে যাবো।
---দূরে সরে যাবি কি রে মা !তুই তো আমার একটা বড় কাজকে কত সহজ করে দিয়েছিস।আমি তোকে এবার আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধবো।
---কিন্তু বাবা মা তো কিছুতেই রাজি হবেনা।
---আরে ছেলের পছন্দ।তোর মায়ের আপত্তি টিকবেনা।বলেই হাসতে লাগলেন।
সুশান্তর মা চা,জল খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, পিছন পিছন সুশান্ত।
---খুব যে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে তোমার মেয়েটার সাথে দেখছি।তা মা তোমার নাম কি?কি করো তুমি?
---আমি অর্জিতা।অর্জিতা দত্ত।ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছি, ফাইনাল ইয়ার।
---কে কে আছেন বাড়িতে তোমার?
মুখ কাঁচুমাচু করে এবার টুকটুকি ওর বাবার দিকে তাকায়।সতীশবাবু প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলে ওঠেন,
---আরে চা টা দাও ওকে ---ওটা তো জল হয়ে গেলো।
--হ্যাঁ দিই।
দু'তিনদিন পরে একদিন ছেলেকে একা পেয়ে সতীশবাবু ছেলের কাছে জানতে চান,
---হ্যাঁরে ওই অর্জিতা মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
---বাবার মুখে হঠাৎ এই প্রশ্ন শুনে সুশান্ত হকচকিয়ে যায়।আমতা আমতা করে বলে,
---কেন ভালোই তো।
---মেয়েটিকে যদি তোর পছন্দ হয় তাহলে আমার ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে আসি।আমার কিন্তু মেয়েটিকে বেশ লেগেছে।
---আমার আপত্তি নেই।কিন্তু বাবা মা কি রাজি হবেন?
---তোর মাকে আমি তুই দুজনে মিলে বুঝাবো।ঠিক রাজি করাবো।দেখিস তুই বেঁকে বসলে কিন্তু হবেনা।
সুশান্ত হেসে পরে বলে,'না না আমি বেঁকে বসবোনা।'
সতীশবাবুর সাথে তার স্ত্রীর ঝামেলা এমন চরম পর্যায়ে পৌছালো শেষে সতীশবাবু ওষুধ খাবার কোনটাই খাবেননা বলেই প্রতিজ্ঞা করে বসলেন।ছেলে এসে সব শুনে মাকে জানিয়ে দিলো,
---বাবার যখন ওই মেয়েকে এতই পছন্দ আমি ওকেই বিয়ে করবো।আর তাছাড়া মেয়েটিকে আমারও ভালো লাগে।
সমস্যার সমাধান।মায়ের আপত্তি ধোপে টিকলোনা।বাপ ছেলে একান্তে হাসাহাসি করতে লাগলো।
বিয়ের ছ'মাস পরে---
'বলি জীবনে এই প্রথম একটা ভালো কাজ করেছো।অবশ্য সুশান্ত বেঁকে না বসলে আমি এই বিয়েতে কখনোই মত দিতামনা।সত্যিই মেয়েটা খুব ভালো।আমাকে তো রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয়না।খাবার গুছিয়ে আমায় খেতে ডাকে।আর তোমার দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।খুব লক্ষ্মী মেয়ে গো।এমনভাবে মা,বাবা বলে ডাকে যেন মনেহয় আমরা ওর নিজের মা বাবা ই'।
---বলছো গিন্নী?তাহলে আমি ঠকিণি বলো?
---তাই তো বলছি গো।
---অজানা ফুলগাছের কুঁড়ি দেখে কি বোঝা যায় সেই ফুল কত বড় হবে বা কতটা সুগন্ধ দেবে?আচ্ছা গিন্নী,তোমার মনে আছে সেই টুকটুকির কথা।
--ওর কথা ছাড়ো।চালচুলোহীন একটা মেয়ে। কোথায় সে আর কোথায় আমার বৌমা!কার সাথে কার তুলনা!
সতীশবাবু হো হো করে হাসতে লাগলেন।
---এতো হাসছো কেন?
---দাঁড়াও তোমায় একটা জিনিস দেখায়।
কথাটা বলেই তিনি জোরে জোরে ' টুকটুকি, টুকটুকি' বলে ডাকতে লাগলেন।
টুকটুকি হন্তদন্ত হয়ে এসে বাবার পিছনে দাঁড়ালো।তার পিছনে সুশান্ত।
---দেখো গিন্নী,এই সেই টুকটুকি -যাকে একদিন অনাদর অবহেলায় তোমার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলে।সুশিক্ষা তাকে আজ কোথায় পৌছে দিয়েছে।আমি তাকে ঠিক মানুষের মত মানুষ করেছি। আজ তুমি নিজমুখে তারই গুণকীর্তন করছো।আমি এতদূর সত্যিই ভাবিনি।আমার কাজটা সহজ করে দিয়েছে তোমার ছেলে।ওরা দুজন দুজনকে ভালবাসতো।অবশ্য তোমার ছেলে আমায় বলেনি।টুকটুকিই আমায় বলেছে।
সুশান্ত এগিয়ে এসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,''ওর সাথে আমার যখন পরিচয় হয়েছিলো তখনও আমি জানতামনা যে ওই সেই মেয়ে।কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়ার পর ও আমায় সব জানায়।আর বলে,'আমি তোমায় ভালোবাসি এটা ঠিক কিন্তু তোমায় ঠকাতে আমি পারবোনা'।ওর সততায় ওর প্রতি আমার ভালোবাসা আরও কয়েকগুণ বেরে গেলো।'
সুশান্তর মা এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন এবার তিনি টুকটুকিকে নিজের কাছে ডাক দিলেন।বাপ,ছেলে দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকালো।টুকটুকি ভয়ে কাঠ হয়ে অতি ধীরপায়ে শ্বাশুড়ীর দিকে এগিয়ে গেলো।তিনি দুইহাতে তার একমাত্র বৌমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে নিজের আঁচল থেকে চাবির গোছাটা টুকটুকির হাতে দিয়ে বললেন, 'আজ থেকে এ সংসারের দায়িত্ব তোর।সত্যিই আমি সেদিন ভুল করেছিলাম।আমায় ক্ষমা করে দিস।'টুকটুকি নীচু হয়ে মাকে প্রণাম করতে গেলে তিনি আবারও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।