বাঁধন
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
আজ অরূপের কথা খুব মনে পড়ছে মহুয়ার।কিন্তু একদিন তো এই অরূপকেই মহুয়া প্রত্যাখান করেছিলো।দেয়নি তার ভালোবাসার মর্যাদা।তখন মহুয়া প্রেমে পাগল রাহুলের।ভালোবাসার আকাশে মুক্ত বিহঙ্গের মত তখন মহুয়া ও রাহুল উড়ছে।বড়লোকের একমাত্র ছেলে,বাবার অঢেল টাকা।মহুয়া সারাজীবনই উচ্চাকাঙ্খী।গরীবের ছেলে অরূপের ভালোবাসাকে সে কোনদিনও পাত্তা দেয়নি।
রাহুলের বাড়িতে মহুয়াকে মেনে না নেওয়ায় মহুয়া ঘর ছাড়ে রাহুলের সাথে।ভেবেছিল পরবর্তীতে সবকিছু বুঝি ঠিক হয়ে যাবে।রাহুল তখন বেকার।একাউন্টে যা টাকা ছিলো কোনরকমে ছ'মাস চলে।তারপরই শুরু হয় চরম দারিদ্র যা রাহুলের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে।চরম বিলাসিতার মধ্যে অতিবাহিত জীবনে হঠাৎ এ ছন্দপতনের জন্য সে মহুয়াকেই দায়ী করতে থাকে।অবশেষে সে মহুয়াকে ছেড়ে নিজের বাড়িতে বিলাসিতার মধ্যেই ফিরে যায়।
মহুয়া অথই সমুদ্রে পড়ে।বাবার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মুখ তার নেই।সে ভালোভাবেই জানতো তারা তাকে আর গ্রহণ করবেননা।একমাত্র যদি অরূপের কাছে গেলে কিছু সুরাহা সে করতে পারে।
রাহুলের চলে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সে অরূপদের বাড়িতে এসে জানতে পারে অরূপ চাকরী পেয়ে চেন্নাই চলে গেছে।মাথায় তখন তার আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।কি করবে এখন সে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনা।কয়েকদিনের মধ্যেই সে টের পায় এখন সে আর একা নয়।নূতন একটা প্রাণের সঞ্চার তার মধ্যে জানান দিচ্ছে।দিশেহারা মহুয়া বাবার বাড়িতেই ফিরে যাওয়া মনস্থির করে।
মহুয়ার যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখে সে একটি অজানা বাড়িতে শুয়ে।অনেক কষ্টে মনে পড়ে তার বাবা,মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য সে একটি বাসে উঠে বসেছিলো।হঠাৎ করেই শরীরটা খুব খারাপ লাগছিলো তার।তারপর আর কিছু তার মনে নেই।
আস্তে আস্তে মহুয়া উঠে বসলো।ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারলো যে বাড়িতে সে এখন আছে তারা খুবই ধনী।চুপচাপ বসে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে।আর ঠিক তখনই মাঝবয়সী এক ভদ্রমহিলা এসে ঘরে ঢোকেন।মহুয়া খাট থেকে নামতে যায়।ভদ্রমহিলা তাকে বাঁধা দেন।তিনি একটি চেয়ার টেনে নিয়ে মহুয়ার কাছাকাছি বসে সরাসরি জানতে চান,
----কোথায় যাচ্ছিলে এই অবস্থায়?
----আপনি আমায় চেনেন?
----হ্যাঁ চিনি আর তোমার সব কথাও আমি জানি।
মহুয়া অবাক হয়।সে জানতে চায়,
----কে আপনি?
----আমি কে সে পরিচয় তো আমি নিশ্চয় দেবো।কিন্তু তুমি কোথায় যাচ্ছিলে বললে না তো?
----ভালোবেসে বিয়ে করে ঘর ছেড়েছিলাম।দুই বাড়ির কেউই মেনে নেয়নি।এখন আমি প্রেগন্যান্ট।আমার স্বামী আমায় ছেড়ে তার মা,বাবার কাছে চলে গেছে।শুনেছি তারা খুব বড়লোক।আমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।একা হলে নিজেকে শেষ করে দিতাম।কিন্তু আমার ভিতরে যে আর একটা প্রাণের সঞ্চার হয়েছে তাকে কি করে মেরে ফেলি?তাই একবার শেষ চেষ্টা করতে সেই বাবা,মায়ের কাছেই যাচ্ছিলাম যদিও জানি তারা আমাকে হয়তো বাড়িতেই ঢুকতে দেবেননা। কিন্তু এই ছাড়া আমার কাছে অন্যকোন পথও খোলা ছিলোনা । কিন্তু আপনি কে বললেন নাতো?
---আমি কে শুনলে তুমি অবাক হবে আরও অবাক হবে এখানে কিভাবে এসেছো শুনলে।
---আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।আপনি পরিষ্কার করে বলুন কে আপনি আর কি করেই বা আমি এখানে এলাম?
---আমি রাহুলের মা।
---সেকি?আপনি আমাকে কি করে চিনলেন?
---তোমাদের বিয়েতে রাহুলের বাবার কোন মত ছিলোনা।আমি অনেক করে ওর বাবাকে বুঝিয়েছিলাম।কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি।ছেলেও হটকারীতা বশত বাড়ির থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো।ফোন করলেও ধরতো না।সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো।অনেক কষ্টে যখন তোমাদের ঠিকানা জোগাড় করি সেই লোক আমায় জানান কয়েকদিন আগেই রাহুল ওই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে।কিন্তু সে প্রথমে বাড়িতে আসেনি।কয়েকদিন বন্ধুর বাড়িতে ছিলো।আমি একজন নারী হয়ে আর একজন নারীর কষ্ট-দুঃখ মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলাম।তাই লোক মারফৎ তোমার উপর নজর রাখতাম।তুমি যখন বাসে যাচ্ছিলে সেখানেও আমার লোক ছিলো।তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়লে তারাই তোমাকে আমার বাড়ি পৌঁছে দেয়।কটাদিন বন্ধুর বাড়িতে কাটিয়ে রাহুল বাড়ি ফিরে আসলেই ওর বাবা ওকে নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে নিয়ে যান।এখন তারা কেউই বাড়িতে নেই।হয়তো তিনি ফিরে এসে আমার সাথে এমনকি তোমার সাথেও চরম ঝামেলা করবেন।কিন্তু মনে রেখো এ বাড়ির ছেলে তোমায় বিয়ে করেছে তাই এই বাড়িতে আছে তোমার ন্যায্য অধিকার।কোন পরিস্থিতিতেই তোমার অধিকার তুমি ছাড়বেনা।বাকিটা আমি দেখবো।
মহুয়া অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে।তার মুখে কোন কথা নেই।মনেমনে ভাবছে এ কোন দেবীর দর্শন সে পেলো।এ তো সে স্বপ্নেও কোনদিন কল্পনা করেনি।