সুখের ঘরে আগুন (৩২)
নিলয়ের ট্রেন ছেড়ে দিল।কোন উপায় নেই,চাকরি বাঁচানোর দায়।যেতেই হবে তাকে, কালই জয়েন করতে হবে।অনেক বলেও সে আর একদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি।অগত্যা রাতের অপেক্ষায় থাকা।রাত ঠিক দশটা।নিলয় অম্বিকাকে ফোন করে।
আর এদিকে জ্ঞান ফেরার পর থেকে অম্বিকা নিলয়ের ফোনের অপেক্ষায়।খুব খারাপ লাগছে তার আজ নিলয়ের জন্য।সে নিজেই বুঝতে পারছে না,কেন নিলয়ের একটু সঙ্গ পাওয়ার জন্য তার মনটা এত উতলা হয়ে উঠেছে।সে জানতো আজই তাকে ফিরতে হবে আর সে নিশ্চয় রাতে ফোন করবে।কিন্তু তা স্বর্তেও তাকে ফোনের সুইচ অফ করে দিয়ে শুতে হয়।বাড়িতে ফেরার পর থেকেই হয় বাবা নতুবা মা কেউ না কেউ তার সাথেই আছেন।আর মা আজ তার কাছেই শুয়েছেন। সুতরাং ফোন করলেও সে নিলয়ের সাথে কথা বলতে পারবে না।তাই বাধ্য হয়েই সে ফোনের সুইচ অফ করে দেয়।নিলয় অম্বিকাকে ফোন করে যখন সুইচ অফ পায় তখন সে প্রলয়কে ফোন করে।তার কাছ থেকেই সে জানতে পারে নিশিতার সাথে তার কথা হয়েছে যে মা আজ তার কাছেই শোবেন।আর সম্ভবত সেই কারণেই অম্বিকা ফোনের সুইচ অফ করে দিয়েছে।কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নিলয়।
সকালের দিকে একটু সময় পেয়েই অম্বিকা নিলয়কে ফোন করে।নিলয় কিছুক্ষণ আগেই তার কোয়ার্টারে ফিরেছে।তখন তার অফিস বেরোনোর তাড়া।তবুও সে দৌড়ে আসে ফোনটার কাছে দেখে অম্বিকার ফোন।ফোনটা রিসিভ করেই উদ্বিগ্ন স্বরে নিলয় অম্বিকার কাছে জানতে চায়,
--- আমি সেই থেকে ফোনের অপেক্ষা করছি,কেমন আছো তুমি?সরি ভেরি সরি!আপনি কেমন আছেন এখন?
--- ভালো আছি।বিশেষ কোন আঘাত পাইনি।কিন্তু এই সরি শব্দটা কানে ভীষণ বাজলো।
--- না আসলে,মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো।
--- জানেন তো কথা আর তীর একবার নিজের থেকে বেরিয়ে গেলে আর ফেরৎ নেওয়া যায় না।
--- তাহলে অভয় দিচ্ছ?
--- একদম
--- একটা শর্ত আছে
--- বলুন
--- উল্টোদিকের মানুষটির কাছ থেকেও ওই তুমিটাই শুনতে চাই
--- আমার কোন সমস্যা নেই।আর সত্যি বলতে কি খুব পরিচিত মানুষগুলোর সাথে আমি তুমিতেই কম্ফোর্টেবল।
এইভাবেই নিলয় আর অম্বিকার কথা এগিয়ে যেতে থাকে রোজ।সামনাসামনি যখন কোন সুযোগই আসছে না, ফোনে রোজ কথা বলে তারা খুব ফ্রী হতে থাকে।দুজনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে রাতের জন্য।আর অপেক্ষায় থাকে কবে তাদের সামনাসামনি দেখা হবে।
সেদিন নিলয়ের বাবা ওই বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর তার কাছে মলিনাদেবী সবকিছু শুনলেন।তারপর বললেন,
--- যাক অল্পের পর থেকে গেছে সেই মঙ্গল।আমি কাল সন্ধ্যার দিকে অচলাকে নিয়ে মেয়েটাকে একটু দেখে আসবো।মেয়েটার জন্য কেন জানি না মনটা খুব ছটফট করছে।আজকে তোমার কাছে স্বীকার করতে আমার একটুও লজ্জা করছে না, হ্যাঁ সত্যিই সেদিন আমি ওর সাথে ভালো ব্যবহার করিনি।ওকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমার নীলুর সাথে ওর যদি বিয়ে হতো তাহলে হয়তো আমার নীলুর জীবনে এরকম একটা অঘটন ঘটতো না।কিন্তু আমার সেদিন যে কি হলো আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না।কোনদিন কারো সাথে তো খারাপ ব্যবহার করিনি বিনা কারণে। নীলুর জীবনের এই ঘটনার জন্য সব রাগ গিয়ে পড়লো ওই মেয়েটাকে দেখেই তার উপর।
--- যাক তুমি যে সেটা বুঝতে পেরেছো এই ঢের।আর ওই যে বলছিলে না?কোনদিন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করোনি,ওটা একটু ভুল হল।জীবনে কোনদিন আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছো?
--- এই শুরু হল!বয়স যত বাড়ছে ততই যেন আমার পিছনে লাগার স্বভাবটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
অচলা পাশেই দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলো এবার তা দেখতে পেয়ে মলিনাদেবী বলে উঠলেন,
--- এবার দেখা যাবে কে কার পিছনে লাগে।এখন আমার মেয়ে আছে।ওই বলবে।
--- ও শুধু তোমার মেয়ে?আমার নয়?
--- তুমি তো দেখছি পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করেই চলেছ?
বলি তোমার মতলবটা কি?রাত কত হয়েছে খেয়াল আছে?চল অচলা,আমরা খাবার বের করি চল।
তারপর অচলাকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন," তুই আসাতে আমার খুব ভালো হয়েছে।ওই বুড়োর সাথে দিনরাত খিচিরমিচির আমার আর ভালো লাগে না।তোর সাথে কথা বলে একটু শান্তি পাচ্ছি।"
অচলা হাসতে হাসতে বললো,
--- তোমরা দুজনেই দেখছি খুব ছেলে মানুষ।আমি বেশ মজা পাচ্ছি তোমাদের এই ঝগড়ায়।আসলে এটা ঝগড়া তো নয় এটা তোমাদের ভালোবাসা।
--- ওরে মেয়ে!আমরা দুজনে ঝগড়া করছি আর তুই দেখছিস ভালোবাসা?
খাবার সব টেবিলে সাজিয়ে বললেন," নে হয়েছে এবার তোর বাবাকে ডাক।এরপর আর দেরি করলে তার আবার খাবার হজম হবে না।তখন তো আমাকেই ভুগতে হবে।'
অচলা হাসতে হাসতে নরেশবাবুকে ডাকতে চলে গেলো।
পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ মলিনাদেবী অচলাকে নিয়ে অম্বিকাদের বাড়িতে গেলেন। অম্বিকার মা রাধাদেবী তাদের দেখে বলে উঠলেন,
---- ও দিদি, খবরটা শুনছেন?মাইয়া আমার এক্সিডেন্ট করছে!বড় কিছু আঘাত পায় নাই এডাই অনেক বেশি।আয়েন, ওর ঘরে আয়েন।
অম্বিকার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-- দেখ অমু তরে কিডা দ্যাখতে আইছে।আমি খুব খুশি হইছি দিদি।আমরা হলাম গিয়ে প্রতিবেশী।একের বিপদে অন্য একটু খোঁজখবর না রাখলে হয়?
এবার অচলার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
--- ও দিদি,হ্যারে তো চিনলাম না।আপনার আত্মীয় বুঝি?
--- ও আমার একটা মেয়ে দিদি।ভগবান আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।খুব ভালো মেয়ে।ওর নাম অচলা।
(অচলা নিচু হয়ে রাধাদেবীকে প্রণাম করে।)
ওর গল্প আর একদিন একদিন করবো দিদি।আজ মেয়েটার সাথে একটু গল্প করি।
অম্বিকা আর মলিনাদেবী দু'জনে গল্প করতে লাগলেন।অচলা নীরব শ্রোতা।আর এদিকে মলিনাদেবী ওদের জন্য চা করতে চলে গেলেন।অমলবাবু বাড়িতে ছিলেন না। মলিনাদেবী অম্বিকার কাছে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা শুনে বললেন,
--- আমি আমার নীলুর জীবনের ঘটনা দেখে বুঝতে পেরেছি ,মানুষ তার ভাগ্য নিয়েই জন্মায়।কপালে যা থাকবে তা কেউ খন্ডন করতে পারবে না।এই আঘাতটা তোর কপালে ছিল।ভগবান রক্ষা করেছেন যে বড় কোন বিপদ ঘটেনি।সাবধানে চলাফেরা করবি।মা,বাবার বয়স হয়েছে।তুই ছাড়া তাদের তো আর কেউ নেই।
ইতিমধ্যে রাধাদেবীও চা নিয়ে এসে ওদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- বাবা, ন'টা বাজতে যায়।এবার উঠি দিদি।চল অচলা তোর বাবা আবার একা রয়েছেন।
অচলা যাওয়ার সময় অম্বিকাকে বলে গেলো," দিদি আমাদের বাড়িতে যেও কিন্তু।"অম্বিকা হেসে সম্মতি জানালো।
এর বেশ কয়েকদিন পর নিলয়ের সাথে কথা প্রসঙ্গে অচলার কথা উঠলে নিলয় সবিস্তারে অচলার সাথে দেখা হওয়া,তার জীবন কাহিনী সবকিছুই অম্বিকাকে জানায়।সব শুনে অম্বিকা বলে,
--- ওই মুহূর্তে ওকে আশ্রয় না দিলে হয়তো ওর জীবনটাই শেষ হয়ে যেত।তাই তুমি যা করেছো একদম ঠিক করেছো।মেয়েটাকে দেখলেই বোঝা যায় খুব সরলসাধা । ও এখানে এসে খুব চুপচাপই বসে ছিলো।
--- আমি ভাবছি প্রাইভেটে ওকে মাধ্যমিকটা পাস করাবো।তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। ও যদি স্কুলে গিয়ে পড়তে চায় তাহলে কোন একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবো।আর যদি রাজি নাহয় তাহলে প্রাইভেটেই পড়াবো।সামনের মাসে বাড়ি যাবো ভাবছি।তখন গিয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।ওকে নিজের পায়ে আমি দাঁড় করাবোই।
--- যদি এই ব্যাপারে আমার কোন হেল্প এর দরকার হয় তবে বোলো;আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
--- ব্যাস!তাহলে তো আমার কোন চিন্তায় থাকলো না।প্রাথমিক কাজটা আমি করে দিয়ে আসবো,বাকিটা তুমি আর বাবা দুজনে মিলেই শেষ করবে।এমনিতে এ কটাদিনে যা বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে ও খুব ইন্টেলিজেন্ট।একটু সুযোগ পেলেই ও নিজেকে তুলে ধরতে পারবে।
ক্রমশঃ-