Wednesday, March 31, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩২)

সুখের ঘরে আগুন (৩২)

     নিলয়ের ট্রেন ছেড়ে দিল।কোন উপায় নেই,চাকরি বাঁচানোর দায়।যেতেই হবে তাকে, কালই জয়েন করতে হবে।অনেক বলেও সে আর একদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি।অগত্যা রাতের অপেক্ষায় থাকা।রাত ঠিক দশটা।নিলয় অম্বিকাকে ফোন করে।
  আর এদিকে জ্ঞান ফেরার পর থেকে অম্বিকা নিলয়ের ফোনের অপেক্ষায়।খুব খারাপ লাগছে তার আজ নিলয়ের জন্য।সে নিজেই বুঝতে পারছে না,কেন নিলয়ের একটু সঙ্গ পাওয়ার জন্য তার মনটা এত উতলা হয়ে উঠেছে।সে জানতো আজই তাকে ফিরতে হবে আর সে নিশ্চয় রাতে ফোন করবে।কিন্তু তা স্বর্তেও তাকে ফোনের সুইচ অফ করে দিয়ে শুতে হয়।বাড়িতে ফেরার পর থেকেই হয় বাবা নতুবা মা কেউ না কেউ তার সাথেই আছেন।আর মা আজ তার কাছেই শুয়েছেন। সুতরাং ফোন করলেও সে নিলয়ের সাথে কথা বলতে পারবে না।তাই বাধ্য হয়েই সে ফোনের সুইচ অফ করে দেয়।নিলয় অম্বিকাকে ফোন করে যখন সুইচ অফ পায় তখন সে প্রলয়কে ফোন করে।তার কাছ থেকেই সে জানতে পারে নিশিতার সাথে তার কথা হয়েছে যে মা আজ তার কাছেই শোবেন।আর সম্ভবত সেই কারণেই অম্বিকা ফোনের সুইচ অফ করে দিয়েছে।কিছুটা হলেও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নিলয়।
  সকালের দিকে একটু সময় পেয়েই অম্বিকা নিলয়কে ফোন করে।নিলয় কিছুক্ষণ আগেই তার কোয়ার্টারে ফিরেছে।তখন তার অফিস বেরোনোর তাড়া।তবুও সে দৌড়ে আসে ফোনটার কাছে দেখে অম্বিকার ফোন।ফোনটা রিসিভ করেই উদ্বিগ্ন স্বরে নিলয় অম্বিকার কাছে জানতে চায়,
--- আমি সেই থেকে ফোনের অপেক্ষা করছি,কেমন আছো তুমি?সরি ভেরি সরি!আপনি কেমন আছেন এখন?
--- ভালো আছি।বিশেষ কোন আঘাত পাইনি।কিন্তু এই সরি শব্দটা কানে ভীষণ বাজলো।
--- না আসলে,মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো।
--- জানেন তো কথা আর তীর একবার নিজের থেকে বেরিয়ে গেলে আর ফেরৎ নেওয়া যায় না।
--- তাহলে অভয় দিচ্ছ?
--- একদম
--- একটা শর্ত আছে
--- বলুন
--- উল্টোদিকের মানুষটির কাছ থেকেও ওই তুমিটাই শুনতে চাই
--- আমার কোন সমস্যা নেই।আর সত্যি বলতে কি খুব পরিচিত মানুষগুলোর সাথে আমি তুমিতেই কম্ফোর্টেবল।
 এইভাবেই নিলয় আর অম্বিকার কথা এগিয়ে যেতে থাকে রোজ।সামনাসামনি যখন কোন সুযোগই আসছে না, ফোনে রোজ কথা বলে তারা খুব ফ্রী হতে থাকে।দুজনেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে রাতের জন্য।আর অপেক্ষায় থাকে কবে তাদের সামনাসামনি দেখা হবে।
  
    সেদিন নিলয়ের বাবা ওই বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর তার কাছে মলিনাদেবী সবকিছু শুনলেন।তারপর বললেন, 
--- যাক অল্পের পর থেকে গেছে সেই মঙ্গল।আমি কাল সন্ধ্যার দিকে অচলাকে নিয়ে মেয়েটাকে একটু দেখে আসবো।মেয়েটার জন্য কেন জানি না মনটা খুব ছটফট করছে।আজকে তোমার কাছে স্বীকার করতে আমার একটুও লজ্জা করছে না, হ্যাঁ সত্যিই সেদিন আমি ওর সাথে ভালো ব্যবহার করিনি।ওকে দেখে আমার মনে হচ্ছিল আমার নীলুর সাথে ওর যদি বিয়ে হতো তাহলে হয়তো আমার নীলুর জীবনে এরকম একটা অঘটন ঘটতো না।কিন্তু আমার সেদিন যে কি হলো আমি নিজেই বুঝতে পারলাম না।কোনদিন কারো সাথে তো খারাপ ব্যবহার করিনি বিনা কারণে। নীলুর জীবনের এই ঘটনার জন্য সব রাগ গিয়ে পড়লো ওই মেয়েটাকে দেখেই তার উপর।
--- যাক তুমি যে সেটা বুঝতে পেরেছো এই ঢের।আর ওই যে বলছিলে না?কোনদিন কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করোনি,ওটা একটু ভুল হল।জীবনে কোনদিন আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছো?
--- এই শুরু হল!বয়স যত বাড়ছে ততই যেন আমার পিছনে লাগার স্বভাবটা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
 অচলা পাশেই দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলো এবার তা দেখতে পেয়ে মলিনাদেবী বলে উঠলেন,
--- এবার দেখা যাবে কে কার পিছনে লাগে।এখন আমার মেয়ে আছে।ওই বলবে।
--- ও শুধু তোমার মেয়ে?আমার নয়?
--- তুমি তো দেখছি পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করেই চলেছ?
বলি তোমার মতলবটা কি?রাত কত হয়েছে খেয়াল আছে?চল অচলা,আমরা খাবার বের করি চল।
 তারপর অচলাকে নিয়ে যেতে যেতে বললেন," তুই  আসাতে আমার খুব ভালো হয়েছে।ওই বুড়োর সাথে দিনরাত খিচিরমিচির আমার আর ভালো লাগে না।তোর সাথে কথা বলে একটু শান্তি পাচ্ছি।"
অচলা হাসতে হাসতে বললো,
--- তোমরা দুজনেই দেখছি খুব ছেলে মানুষ।আমি বেশ মজা পাচ্ছি তোমাদের এই ঝগড়ায়।আসলে এটা ঝগড়া তো নয় এটা তোমাদের ভালোবাসা।
--- ওরে মেয়ে!আমরা দুজনে ঝগড়া করছি আর তুই দেখছিস ভালোবাসা?
 খাবার সব টেবিলে সাজিয়ে বললেন," নে হয়েছে এবার তোর বাবাকে ডাক।এরপর আর দেরি করলে তার আবার খাবার হজম হবে না।তখন তো আমাকেই ভুগতে হবে।'
অচলা হাসতে হাসতে নরেশবাবুকে ডাকতে চলে গেলো।
 পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ মলিনাদেবী অচলাকে  নিয়ে অম্বিকাদের বাড়িতে গেলেন। অম্বিকার মা রাধাদেবী তাদের দেখে বলে উঠলেন,
---- ও দিদি, খবরটা শুনছেন?মাইয়া আমার এক্সিডেন্ট করছে!বড় কিছু আঘাত পায় নাই এডাই অনেক বেশি।আয়েন, ওর ঘরে আয়েন।
অম্বিকার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-- দেখ অমু তরে কিডা দ্যাখতে আইছে।আমি খুব খুশি হইছি দিদি।আমরা হলাম গিয়ে প্রতিবেশী।একের বিপদে অন্য একটু খোঁজখবর না রাখলে হয়?
 এবার অচলার দিকে তাঁকিয়ে বললেন,
--- ও দিদি,হ্যারে তো চিনলাম না।আপনার আত্মীয় বুঝি?
--- ও আমার একটা মেয়ে দিদি।ভগবান আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।খুব ভালো মেয়ে।ওর নাম অচলা।
 (অচলা নিচু হয়ে রাধাদেবীকে প্রণাম করে।)
ওর গল্প আর একদিন একদিন করবো দিদি।আজ মেয়েটার সাথে একটু গল্প করি।
 অম্বিকা আর মলিনাদেবী দু'জনে গল্প করতে লাগলেন।অচলা নীরব শ্রোতা।আর এদিকে মলিনাদেবী ওদের জন্য চা করতে চলে গেলেন।অমলবাবু বাড়িতে ছিলেন না। মলিনাদেবী অম্বিকার কাছে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা শুনে বললেন,
--- আমি আমার নীলুর জীবনের ঘটনা দেখে বুঝতে পেরেছি ,মানুষ তার ভাগ্য নিয়েই জন্মায়।কপালে যা থাকবে তা কেউ খন্ডন করতে পারবে না।এই আঘাতটা তোর কপালে ছিল।ভগবান রক্ষা করেছেন যে বড় কোন বিপদ ঘটেনি।সাবধানে চলাফেরা করবি।মা,বাবার বয়স হয়েছে।তুই ছাড়া তাদের তো আর কেউ নেই।
 ইতিমধ্যে রাধাদেবীও চা নিয়ে এসে ওদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- বাবা, ন'টা বাজতে যায়।এবার উঠি দিদি।চল অচলা তোর বাবা আবার একা রয়েছেন।
 অচলা যাওয়ার সময় অম্বিকাকে বলে গেলো," দিদি আমাদের বাড়িতে যেও কিন্তু।"অম্বিকা হেসে সম্মতি জানালো।
  এর বেশ কয়েকদিন পর  নিলয়ের সাথে কথা প্রসঙ্গে অচলার কথা উঠলে নিলয় সবিস্তারে অচলার সাথে দেখা হওয়া,তার জীবন কাহিনী সবকিছুই অম্বিকাকে জানায়।সব শুনে অম্বিকা বলে,
--- ওই মুহূর্তে ওকে আশ্রয় না দিলে হয়তো ওর জীবনটাই শেষ হয়ে যেত।তাই তুমি যা করেছো একদম ঠিক করেছো।মেয়েটাকে দেখলেই বোঝা যায় খুব সরলসাধা । ও এখানে এসে খুব চুপচাপই বসে ছিলো।
--- আমি ভাবছি প্রাইভেটে ওকে মাধ্যমিকটা পাস করাবো।তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। ও যদি স্কুলে গিয়ে পড়তে চায় তাহলে কোন একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবো।আর যদি রাজি নাহয় তাহলে প্রাইভেটেই পড়াবো।সামনের মাসে বাড়ি যাবো ভাবছি।তখন গিয়ে কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।ওকে নিজের পায়ে আমি দাঁড় করাবোই।
--- যদি এই ব্যাপারে আমার কোন হেল্প এর দরকার হয় তবে বোলো;আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
--- ব্যাস!তাহলে তো আমার কোন চিন্তায় থাকলো না।প্রাথমিক কাজটা আমি করে দিয়ে আসবো,বাকিটা তুমি আর বাবা দুজনে মিলেই শেষ করবে।এমনিতে এ কটাদিনে যা বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে ও খুব ইন্টেলিজেন্ট।একটু সুযোগ পেলেই ও নিজেকে তুলে ধরতে পারবে।

ক্রমশঃ-

    

Saturday, March 27, 2021

বাতাসে বহিছে প্রেম

বাতাসে বহিছে প্রেম

  প্রাণের বন্ধু স্বরূপের বোনকে সেই ছোট্টবেলা থেকেই ভালো লাগতো দেবেশের।সেই ভালোলাগা কবে যে ভালোবাসায় গিয়ে ঠেকেছে তার হিসাব দেবেশ নিজেও দিতে পারবে না।সুস্মিতা এখন কলেজ ছাত্রী।যেহেতু দেবেশ দাদার বন্ধু তাই সে দেবেশকে সে দেবুদা বলেই ডাকতো।দেবেশ কোনদিনও তার মনের কথা সুস্মিতাকে খুলে বলেনি।স্বরূপ চাকরি পেয়ে যখন পন্ডিচেরী চলে যায় তখন মা,বোনের দেখাশুনার দায়িত্ব দেবেশকেই দিয়ে যায়।দেবেশ রোজ রাতে একবার করে তার বন্ধুর বাড়িতে আসে তার মা,বোনের খবর নিতে।দেবেশ আসার পর সুস্মিতা এককাপ চা করে দেয় সেটা খেয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে দেবেশ চলে যায়।
 দেখতে দেখতে সুস্মিতার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হয়।শুরু হয় তার বিয়ের জন্য ছেলে দেখা।দেবেশ তখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে একজন সূচাকুরে।স্বরূপ ছুটিতে বাড়িতে এসে বোনকে প্রস্তাব দেয় দেবেশকে বিয়ে করার জন্য।
--- তুই কি বলছিস দাদা?আমি দেবেশদাকে ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু সেটা কখনোই প্রেমের দৃষ্টিতে নয়।
--- কিন্তু সুমি আমি জানি তুই ওকে বিয়ে করলে খুব সুখী হবি।ওকে সেই ছেলেবেলা থেকে চিনি।আমার বন্ধু বলে বলছি না,ও খুবই ভালো ছেলে রে!আর তাছাড়া আমি যদি খুব ভুল করে না থাকি ওর দৃষ্টিতে তোর প্রতি আমি ভালোবাসা দেখেছি।
--- না দাদা,এটা আমি মেনে নিতে পারবো না।
  সুস্মিতার বিয়ে ঠিক হল সরকারি চাকরি করা ছেলের সাথে।দেবেশ তার ভালোবাসার কথা বুকেই চেপে রাখলো।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর যেহেতু ছমাস দেরি ছিল বিয়ে হতে তাই রিতেশ ও সুস্মিতা দুজনেই দেখা সাক্ষাৎ,বেড়ানো সবই করতো।দুবাড়ির কেউ কোন আপত্তিও করেনি।
  বিয়ের তখনও মাস খানেক বাকি।সুস্মিতা আর রিতেশ সেদিন বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল।কিছু কেনাকাটা করে রেস্টুরেন্টে খেয়ে বাড়ির পথে যখন রওনা দেয় তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে দশটার কাটা পেরিয়ে গেছে।দুবাড়ীর সকলেই চিন্তা করছে। ফোনে কাউকেই পাচ্ছে না।সুস্মিতার মা অস্থির হয়ে দেবেশকে ফোন করেন।দেবেশ আসে রাত তখন পৌনে বারোটা।কোথায় খুঁজবে?কি করবে কিছুই বুঝতে পারে না সে।সারে বারোটা নাগাদ অচেনা নম্বর থেকে একটি ফোন আসে সুস্মিতার মায়ের মোবাইলে।ফোনটা ধরে অবশ্য দেবেশ।কথা শেষ করেই সে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়।যেতে যেতে মাসিমাকে বলে যায়,
--- সুস্মিতার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।আমি সেখানে যাচ্ছি ,চিন্তা করবেন না।আমি ফোন করে সব জানাবো।
 নার্সিংহোম পৌঁছে খবর নিয়ে জানতে পারে দুজনেরই অবস্থা মারত্মক।তবে রিতেশের হাত পায়ের কোন ক্ষতি না হলেও ডক্টররা মনে করছেন সুস্মিতার বা পায়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে।তবে জ্ঞান কারোরই ফেরেনি। রিতেশদের বাড়ির থেকেও সকলে হাজির হল সেখানে।ভোরের দিকে রিতেশের জ্ঞান ফিরলেও দুদিনের মধ্যে সুস্মিতার জ্ঞান ফেরে না।স্বরূপ খবর পেয়েই প্লেনে চলে আসে কলকাতায়।দুই বন্ধু সব সময়ের জন্য নার্সিংহোম বসে।তিনদিনের মাথায় সুস্মিতার জ্ঞান আসে।তারপর তার পায়ের অপারেশন।রিতেশ ছাড়া পেয়ে বাড়ি চলে যায়।ফোনেই সে যোগাযোগ রাখে স্বরূপের সাথে।
 অপারেশনের পর ডক্টর জানিয়ে দেন সুস্মিতা হাঁটাচলা করতে পারবে ঠিকই কিন্তু একটু খুঁড়িয়ে।কান্নায় ভেংগে পরে স্বরূপ।দেবেশ তাকে শান্তনা দেয়,
--- কোন বড় ধরণের বিপদ যে ঘটেনি এটাই বড় প্রাপ্তি।      আস্তে আস্তে সুস্মিতা সুস্থ্য হয়ে উঠতে থাকে।তার কাছে কথাটা গোপন রাখা হয়।রিতেশ তাকে দেখতে এসে সব যেদিন শুনলো তারপর থেকে সে আর সুস্মিতাকে দেখতে আসেনি।সুস্মিতা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সাতদিনের মাথায় রিতেশদের বাড়ি থেকে ফোন করে বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হয়।ততদিনে সুস্মিতা জেনে গেছে তাকে আজীবনের জন্য খুঁড়িয়ে হাঁটাচলা করতে হবে।কষ্ট পেয়েছে ঠিকই কিন্তু ভেঙ্গে পড়েনি।বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে শুনেও বিন্দুমাত্র চোখের জল না ফেলে বলেছে,
--- ভাগ্যিস বিয়েটা হয়ে যায়নি,মানুষ চিনতে পারলাম।
 তবে সে যে রিতেশকে খুব ভালোবেসে ফেলেছিল দাদার কাছে সে কথা গোপন করেনি।
 আজ দোল পূর্ণিমা।দেবেশ ও স্বরূপ দুজনে বসে স্বরূপের ঘরে গল্প করছে।মনমেজাজ কারোই ভালো নেই।সুস্মিতা তার ঘর লাগোয়া বারাদায় বসে।হঠাৎ স্বরূপ দাঁড়িয়ে বলে,
--- দেবু তুই একটু বোস আমি এক্ষনি আসছি।
 কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ফিরে আসে হাতে কিছুটা আবির নিয়ে।এসে দেখে দেবেশও সেখানে নেই।সে সুস্মিতার ঘরে ঢুকে তার সাথে গল্প জুড়েছে।মা ও সেখানে।সকলেই সুস্মিতাকে নিয়ে,তার ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে থাকে। মায়ের পায়ে আবির দিয়ে এ ওকে আবির মাখায়।সুস্মিতা দেবেশকে আবির দিলেও দেবেশ চুপ করেই দাঁড়িয়ে থাকে।মাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যায় স্বরূপ।জানতে চায় দেবেশ যদি রাজি থাকে তাহলে সুমির বিয়ে যদি ওই তারিখেই তার সাথে দেওয়া হয় তাহলে মায়ের কোন আপত্তি আছে কিনা।মা সম্মতি জানান।
 ঘরের মধ্যে তখন দেবেশ আর সুস্মিতা।দেবেশ সুস্মিতাকে বলে,
--- তোকে একটা কথা বলার ছিল।
--- বলো,তুমি আমাকে কিছু বলবে তা এত আমতা আমতা করার কি আছে?
--- আছে , এ কথাটা আর পাঁচটা সাধারণ কথার মত নয় --।
--- আরে বলেই ফেলো।তবে একটা কথা, রিতেশের সাথে বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়া নিয়ে কোন কথা আমি শুনতে চাই না।আমার ভাগ্য ভালো বিয়েটা হয়ে যায়নি।অন্তত তার মানসিকতাটা বিয়ের আগেই আমার সামান্য খুতের বিনিময়ে জানতে পেরেছি এটাই আমার কাছে বড় পাওনা।এই বিয়েটা ভেঙ্গে যাওয়ায় আমার মনে কোন আক্ষেপ নেই।এবার বলো তুমি কি বলবে?
--- আমি -- আমি -- মানে -- তোকে বিয়ে করতে চা -- ই
--- এটা কি আমার প্রতি অনুকম্পা?অপারেশনের পরে আমার একটা পা স্বাভাবিক পা টা থেকে ছোট হয়ে গেছে।আমি খুঁড়িয়ে হাঁটি।আমাকে নিয়ে বাইরে বেরোতে তোমার খারাপ লাগবে না?
--- আমি যে তোকে সেই কবে থেকে  ভালোবাসি রে !বলতে পারিনি,যেহেতু তুই বন্ধুর বোন।
--- দাদা তাহলে ঠিকই বুঝেছিল।
--- কি বলেছে রূপ?
-- বিয়েটা ঠিক হওয়ার আগেই দাদা আমায় বলেছিলো তোমার চোখে আমার প্রতি ও ভালোবাসা দেখেছে।আমিই বোকা! সেটা বুঝতে পারিনি।আসলে তোমায় দাদার বন্ধু বলে দাদার চোখেই দেখতাম।আজ বুঝতে পারছি  রাখি,ভাইফোঁটার সময় বারবার বলা স্বর্তেও তুমি আমাদের বাড়ি আসতে না কেন?
--- আমার প্রশ্নের উত্তরটা দে --- 
--- আজ দোল পূর্ণিমা,এমন দিনে তুমি আমার গোটা জীবনটা রঙ্গিন করে দিতে চাইছো ---- আমি কি তোমায় ফিরিয়ে দিতে পারি?তবে তোমার মনের কথাটা তুমি আরো আগে কেন আমায় জানালে না দেবুদা?
--- ভয় পেয়েছিলাম,যদি তুই আমায় ফিরিয়ে দিস।
--- তবে আজ বললে কেন?
--- সে কথা বলতে পারবো না।হয়তো রাধাগোবিন্দই চেয়েছেন,তিনিই আমায় সাহস যুগিয়েছেন।
 দেবেশ তার পকেট থেকে লাল আবির বের করে সুস্মিতার মুখটা পুরো রাঙ্গিয়ে দিলো।সুস্মিতাও দেবেশের মুখে আবির মাখিয়ে দিলো।বাইরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্বরূপ আর তার মা সব দেখে সেখান থেকে দুজনেই সরে গেলেন।জীবনের একটা ধাক্কা সুস্মিতার গোটা জীবনটাকে আবিরের লাল রঙে রঞ্জিত করে দিলো।

Thursday, March 25, 2021

এ ভাঙ্গা বসন্ত বেলা

এ ভাঙ্গা বসন্ত বেলা

  মাত্র পাঁচটা বছরেই জীবনের সব রং যেন মুছে গেছে।ভালোবেসে অঙ্কিতা বিয়ে করেছিল শাশ্বতকে বাড়ির সকলের অমতে। কিন্তু শাশ্বতদের বাড়ির সকলেই তাকে মেনে নিয়েছিল। শাশ্বতদের বাড়িতে কুলদেবতা রাধা কৃষ্ণের এক  মন্দির ছিল। দোল পূর্ণিমার দিনে খুব ঘটা করে পুজো হত।পুরো পাড়ার লোক ওই দিনে হাজির হয়ে যেত তাদের বাড়িতে পুজো দেখা আর রং খেলার জন্য। এমনই এক দোল পূর্ণিমার দিনে বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে পরিবারের একমাত্র ছেলে শাশ্বত রায় চলে যায় চিরতরে।জীবনের সব রং যেন এক নিমেষে বেরঙিন হয়ে যায় অঙ্কিতার জীবনে।অঙ্কিতার শ্বশুর শ্বাশুড়ি খুবই ভেঙ্গে পড়েন।বিয়েতে অঙ্কিতার বাবা-মার আপত্তি থাকলেও এই দুর্ঘটনার কথা শুনে তারা দূরে সরে থাকতে পারেন না।তারা এসে অঙ্কিতাকে তাদের কাছে নিয়ে যান।অঙ্কিতা শাশ্বতর চাকরি এবং সমস্ত টাকা-পয়সা পায়।কারণ বিয়ের পরে শাশ্বত তার সমস্ত কিছুর নমিনি অঙ্কিতাকে করেছিল।চাকরি পাওয়ার দিন পনেরর মধ্যে অঙ্কিতা বাপের বাড়ি থেকে চিরদিনের জন্য শ্বশুরবাড়িতে পুনরায় ফিরে আসে।সে তার বাবা-মাকে যুক্তি দেখায় শাশ্বত না থাকাকালীন সময়ে যদি তার চাকরি এবং সমস্ত কিছু অধিকারী সে হয় তাহলে তার বাবা-মায়ের দেখাশোনার দায়িত্বও তার।সে কোনো অবস্থাতেই এই চাকরি এবং  টাকা পয়সা নেওয়ার পর এই বাড়ীতে থেকে যেতে পারবে না।তাকে তবে ওই বাড়িতে ফিরে যেতে হবে এবং তাদের সমস্ত দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে।
  শাশ্বতর অফিস এখন অঙ্কিতার অফিস।সহকর্মী সুদীপ্ত বোসের সাথে অঙ্কিতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।হোলির দুদিন আগে অফিসের সকলেই অল্পবিস্তর সকলকেই রঙ মাখায়। সুদীপ্ত কিন্তু অঙ্কিতাকে কোন রং দেয় না।যেহেতু সুদীপ্ত অঙ্কিতাকে রঙ মাখায় না সেইহেতু অঙ্কিতাও কোন রং সুদীপ্তকে ছোঁয়ায় না। শাশ্বত চলে যাওয়ার পর এটা তার জীবনের দ্বিতীয় হোলি।প্রথম বছর হোলির দিনে খুবই মনমরা হয়ে ছিল অঙ্কিতা।কিন্তু সময় যে মানুষের জীবনে একটা বড় ওষুধ। আস্তে আস্তে ক্ষতগুলির উপর একটা প্রলেপ ফেলে দেয়।ঢাকা পড়ে যায় দগদগে ঘা টা ।তখন যন্ত্রণাটা ভিতরে থাকলেও ওই প্রলেপটা কিছুটা হলেও লোকালয়ে ব্যথার উপশম আনতে সাহায্য করে।কারণ ফেলে আসা অতীতে যে ঘা সৃষ্টি হয় তার যন্ত্রণাটা শুরু হয় নির্জনে একাকী অবস্থায়।
  শাশ্বত চলে যাওয়ার পরেই তাদের বাড়িতে ঘটা করে দোল পূর্ণিমার উৎসব আর পালন করা হয়না।নিত্য পুজোর মতোই দোল পূর্ণিমার দিনেও সামান্য পুজো হয়।আর পাঁচটা দিনের মত এ দিনটাও কাটে। এ বাড়িতে গতবছর দোলের দিন আর কেউ আসেনি।কিন্তু এবারে সকাল এগারোটা নাগাদ হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে ওঠায় সবাই একটু হকচকিয়েই যায়।দরজা খুলে অঙ্কিতা দেখে সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে। বুকটার ভিতর অঙ্কিতার ধরাস করে ওঠে।কারণ বোধকরি সে মনেমনে সুদীপ্তকে ভালোবেসে ফেলেছিল কিন্তু প্রকাশভঙ্গি তার ছিলোনা।অঙ্কিতার পিছনে কিছুটা দূরেই কৌতূহলবশত দাঁড়িয়ে তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ী।সুদীপ্ত কোন ভনিতা না করেই বললো,
--- কিছুটা লাল আবির নিয়ে এসেছি যদি অভয় দাও তোমার লাল রঙে রাঙিয়ে দিতে চাই।
--- মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি ?
 অঙ্কিতা অবাক বিস্ময়ে কথাটা বলে।সুদীপ্তর উত্তর দেওয়ার আগেই অঙ্কিতার শ্বশুর ,শ্বাশুড়ী এসে অঙ্কিতার কাছে দাঁড়িয়ে বলেন,
--- তোমায় তো বাবা ঠিক চিনতে পারলাম না।
--- আমি অঙ্কিতার সাথে চাকরি করি।ওকে ভালবাসি,বিয়ে করতে চাই --- অবশ্য আমি জানিনা ওর এতে মত আছে কিনা।আর সেটা জানতেই আজ আমার এখানে আসা।
--- মেয়েকে সংসারী করা প্রত্যেক বাবা মায়ের কর্তব্য। ও একটি বাচ্চা মেয়ে।আমরা আজ আছি কাল নেই।ওর ভালোমন্দের দায়িত্ব আমাদের ।আমরা বলছি তুমি ওকে আবির মাখিয়ে দাও।কোন এক দোলের দিনে আমরা আমাদের একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছি।আর আজ এই দোলের দিনেই তুমি আমাদের সেই সন্তান হয়েই আবার ফিরে এসেছ।তোমার মধ্যেই আমরা আমাদের ছেলেকে খুঁজে নেবো।
 সুদীপ্ত এগিয়ে গিয়ে তাদের সামনেই অঙ্কিতাকে লাল আবিরে রঞ্জিত করে দিলো।

Sunday, March 21, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩১)

সুখের ঘরে আগুন (৩১)

  মা আর অচলা রান্নাঘরে চলে গেলে বাবার সাথে একটু কথাবার্তা বলে নিলয় তার ফোনটা নিয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে।অম্বিকাকে ফোন করে।অম্বিকা ফোনটা ধরেই বলল,
---  আমি তো ভাবলাম আপনি ফোন করবেন আমায় বলেছিলেন সেই কথাটিই বুঝি ভুলে গেছেন।
---আচ্ছা আপনি আমাকে কি ভাবেন বলুনতো?আমি এত ভুলোমন?আমি তো সবসময়ই আপনার কথা---
--- কি হলো চুপ করে গেলেন যে?আমার কথা কি?
--- না থাক যদি কোনোদিন সুযোগ আসে  না হয় সেদিন বলবো।
--- শুনুন জীবনে কিছু কথা আছে যা ফেলে  রাখতে নেই। ফেলে রাখলে সেই কথার গুরুত্ব হারিয়ে যায়। হয়তো এমন সময়ে আপনি কথাটা বললেন সেই কথাটাই আগে বললে যে কাজ হত দেরি করে বলাতে জীবনে পস্তাতে হল।
 কথাগুলো বলে অম্বিকা হো হো করে হাসতে লাগলো।তারপর হাসি থামিয়ে বললো,
--- বলুন আজ কোথায় আর কখন দেখা করতে চান?
--- দুপুর তিনটে কফি হাউজে। হাতে একটু সময় নিয়ে আসবেন কিন্তু।
অম্বিকা পুনরায় দুষ্টুমি করে বললো,
---গল্পটা কি খুব বড়?
--- আজ দেখছি আপনার মুডটা বেশ ফুরফুরে !
--- বলতে পারেন ---
-- কোন কারণ আছে কি ?
--- আগে আপনার সব কথাগুলো শুনবো তারপর আমার ফুরফুরে মুদের কারণটা আপনাকে জানাবো।
--- তথাস্তু,আমি আগেই বলবো ।
    কথা শেষ করে নিলয় ঘরে এসে ঢুকে দেখলো মা আর অচলা  লুচি আর আলুর তরকারি নিয়ে টেবিলে সবেমাত্র রাখছেন।সে তাড়াতাড়ি করে বেসিনে হাত ধুয়ে টেবিলে বসে গেল।
---দাও দাও মা, ভীষণ খিদে পেয়েছে।
তারপর অচলার দিকে ফিরে বলল,
--- মা আমাদের দুজনকে দিয়ে দেবেন।তুই ও বসে পর।
---নানা দাদা, আগে তুমি আর বাবা খেয়ে নাও।আমি আর মা একসাথে খাবো। জানো দাদা জন্মের পর এই প্রথম কাউকে মা বলে ডাকলাম।এই ডাকের মধ্যে আলাদা একটা অনুভূতি, আবেগ কাজ করে প্রথম বুঝতে পারলাম।আমি ভাবতাম রক্তের সম্পর্ক না থাকলে কেউ কখনো আপন হয়না।তোমায় দেখে সেই ধারণা আমার পাল্টাতে শুরু করেছিল। আর আজ এখানে এসে মা বাবাকে দেখে আমার সেই ধারনা সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে।তোমাদের না দেখলে কোনদিনও বুঝতে পারতাম না রক্তের সম্পর্ক থেকে এমন অনেক সম্পর্ক আছে যা আরো বেশি করে মানুষকে কাছে টেনে নেয়। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মা আমাকে এতটাই আপন করে নিয়েছেন যে আমি ছেলেবেলায় মাকে হারিয়ে যে কষ্ট পেতাম আজ এখানে এসে মাকে মা বলে ডেকে আমার সেই কষ্ট কোথায় যেন এক নিমেষে উড়ে গেছে।
 মলিনা দেবী হেসে বললেন,
--- সত্যি নিলু তুই এই কাজটা খুব ভালো করেছিস আমাকে একটা লক্ষী মেয়ে এনে দিয়েছিস যে সব সময় আমার পাশে পাশে থাকবে।অল্প সময়েই মেয়েটার প্রতি আমার মায়া পরে গেছে।একটা কাজ করিস বাবা, এবার তো  সময় নেই হাতে পরেরবার হাতে সময় নিয়ে এসে অচলাকে পড়াশুনার ব্যবস্থা করে দিস।অবশ্য তোর বাবা ই সবকিছু করতে পারবে কিন্তু এখন তো তার বয়স হয়েছে।তোরা তো এখন কম্পিউটারে সবকিছু করিস।তোর বাবা তো আবার এই কম্পিউটারে অতটা সরগর নয়।তুই বরং ওখানে থেকে ল্যাপটপে যদি কিছু করে ওর পড়াশোনার ব্যবস্থাটা করে দিস তাহলে তোর বাবা বাকি সবকিছু নিজে করতে পারবে।
----  হ্যাঁ মা আমিও সেটাই ভেবেছি।ওকে প্রাইভেটে মাধ্যমিকটা আগে পাশ করাই। বাবা প্রথম দিকে ওর পড়াশুনার দায়িত্বটা নেবেন। পরে আস্তে আস্তে টিচার রেখে দেবো।
 অচলা সব শুনে বলে উঠলো,
--- এই বয়সে এসে আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু করলে আমি কি পারবো সবকিছু?
মলিনাদেবী অচলার কথা শুনে হেসে পরে বললেন,
--- খুব পারবি।আর এই বয়সের এসে মানে?তোর কত বয়স? তুই কি বুড়ি হয়ে গেছিস নাকি?আমার একটা মেয়ে থাকলে আমি তাকে লেখাপড়া শেখাতাম না?তোর যাতে ভাল হবে আমরা সেটাই করবো;আর তুই এই ব্যাপারে একটাও কথা বলবিনা।
নিলয় অচলার দিকে তাকিয়ে বললো,
--- বড়দের মাঝখানে কথা বলতে নেই।এখন থেকে তোর ভাবনাটা আমরা ভাববো।তুই শুধু আমাদের কথা শুনে চলবি।
  দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর নিলয় একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পরলো ।একটা উবের ধরে নিদ্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই কফিহাউস পৌঁছে গেলো।প্রথমে সে গেটের সামনেই অপেক্ষা করছিল।তারপর দোতলায় উঠে গিয়ে কোণের দিকে একটা টেবিলে অম্বিকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।কিন্তু নিদ্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার অনেক পরেও অম্বিকার দেখা না পেয়ে তাকে ফোন করে।রিং হয়ে যায় অম্বিকা ফোন তোলে না।কিছুই বুঝতে পারে না সে। এতদিনে অম্বিকাকে সে যে টুকুন চিনেছে তাতে তার মনেহচ্ছে সে ইচ্ছাকৃত না আসা করেনি। নিশ্চয়ই তার কোন বিপদ হয়েছে।প্রায় সাড়ে চারটে পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করে সে বেরিয়ে পরে মাথায় একগাদা প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে।ইচ্ছাকৃত সে অম্বিকাদের বাড়ির সামনে থেকেই আসে।ঘরে যথারীতি আলো জ্বলছে আশেপাশে এসে সে রকম কোন মানুষজনকেও দেখতে পায়না।খুবই মনক্ষুন্ন হয়ে পরে।যতবার ফোন করছে অম্বিকা ফোন তুলছে না।
 বেরোনোর তাড়া ছিল।বাড়িতে এসে খেয়েদেয়ে যখন বেরোবে ঠিক তখনই ফোনটা রিং হয়।ভাবে বুঝি অম্বিকাই ফোন করেছে।দেখে প্রলয়ের ফোন।হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে প্রলয় বলে ওঠে,
--- একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে।
--- কার কি হয়েছে?
--- অম্বিকা আর নিশিতা একসাথেই বেরিয়েছিল।ওরা দুজনেই বাসে উঠবে বলে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটার দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই একটা বাইক এসে অম্বিকাকে ধাক্কা দেয়।অম্বিকা ছিটকে গিয়ে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের উপর গিয়ে পরে।সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায়।পথচারীদের সহয়তায় নিশিতা অম্বিকাকে নার্সিংহোম নিয়ে যায় আর আমাকে ফোন করে সব জানায়।এখন ওর জ্ঞান ফিরেছে।মাথায় সামান্য চোট পেয়েছে।মাসিমা, মেসোমশাই এসেছেন কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে। কিন্তু তুই তো আবার ওদের বাড়িতে যাস না।রাতের দিকে একটা ফোন করে খবর নিস।অম্বিকাই আমাকে বললো তোকে খবরটা দিতে।
  নিলয় খবরটা শুনে বসে পড়লো।বাবা ছিলেন কাছে দাঁড়িয়ে।নিলয়ের মুখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন।জানতে চাইলেন,
--- কার কি হয়েছে?
 নিলয় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
--- আমার এক বন্ধু ফোন করেছিলো।ওই যে আমাদের পাড়ায় অম্বিকা সেনের একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।
--- সে কি ?কেমন আছে মেয়েটি এখন?
--- তেমন বিশেষ কিছু হয়নি তবে হতে পারতো।জ্ঞান ফিরেছে।ছেড়ে দেবে আজই।
--- মেয়েটি বড্ড ভালো রে!সেদিন এসেছিল।বেশ মিশুকে মেয়ে।তাহলে আমি এক কাজ করি।তোর সাথে বেরিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে ওদের বাড়িতে একবার দেখে আসি।
--- আর একটু রাত করে যাও।এখনো ওরা বাড়িতে ফেরেনি।আমাকে তো যেতেই হবে আজ।
 ওদের কথার মাঝখানে মলিনাদেবী আর অচলা একটা টিফিনবক্স গুছিয়ে নিয়ে এলেন নিলুর রাতের খাবার।অচলা এসে দাদার হাতে টিফিনবক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
--- দাদা,তোমার রাতের খাবার।
--- পেট ভরে তো টিফিন করলাম;আবার রাতের খাবার?
মলিনাদেবী ছেলের কথা শুনে বললেন,
--- রাতে ঠিক খিদে পেয়ে যাবে।তুই তখন কি করবি?না খেয়েই থাকবি?
 নিলয়ের মনটা মোটেই ভালো ছিলোনা।সে আর কথা না বাড়িয়ে টিফিনবক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো।মা,বাবাকে প্রণাম করে অচলার মাথায় হাত রেখে বললো,
--- সাবধানে থাকিস।নিজের খেয়াল রাখবি ।কোনরকম কোন অসুবিধা হলে সঙ্গে সঙ্গেই আমায় ফোন করবি।
 নিলয় বেরিয়ে যাওয়ার পর নরেশবাবু কিছুক্ষণ পর বেরোতে গেলে মলিনাদেবী বলে উঠলেন,
--- তুমি আবার এই রাতে কোথায় চললে?
--- যাবো একটু অমল সেনের বাড়ি।উনার মেয়েটা আজ একটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।
--- সে কি?তুমি কার কাছে খবর পেলে?
--- ওই তো নিলুকে ওর এক বন্ধু ফোন করে জানাল।তাই ভাবলাম সেদিন মেয়েটা এসে আমাদের খোঁজ খবর নিয়ে গেলো।আজ ওর বিপদের দিনে একটু পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
--- তা সাবধানে যেও।আজ শরীর আর দিচ্ছে না।আমি নাহয় কাল অচলাকে সাথে করে নিয়ে ওকে একটু দেখে আসবো।
 নরেশবাবু মুখে কিছু বললেন না,কিন্তু মনেমনে ভাবলেন,' বুঝি না বাপু,এই মহিলার মনের মতিগতি।সেদিন মেয়েটা বাড়ি আসলে ঐ ব্যবহার আর আজ বলছে কাল তাকে দেখতে যাবে ---।"

ক্রমশঃ
    

Thursday, March 11, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৩০)

সুখের ঘরে আগুন (৩০)

   মনটা সন্ধ্যা থেকেই অম্বিকার  খারাপ ছিল।এখন ফোনটা আসায় কিছুটা হলেও তার ভালো লাগলো।ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে নিলয় বলল,
---  ডিস্টার্ব করলাম? ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি?
--- আরে না না সবে খেয়ে আসলাম।আর এই কথাটা আমার একদম ভালো লাগলো না।বিরক্ত কেন হব?আমি তো বলেছি আপনাকে বেশি রাতেই ফোন করতে।ওহোএকটা কথা বলার আছে আপনাকে।আজকে আপনাদের বাড়িতে গেছিলাম।মাসিমা,মেসোমশাই ভালো আছেন। মেসোমশাইয়ের সাথে অনেকক্ষণ কথা হলো।খুব ভালো মানুষ উনি।
--- আর মা?
--- হ্যাঁ উনার সাথেও কথা হয়েছে। উনি তো কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তাই সেভাবে কথা বলতে পারিনি।তবে মাঝে মাঝে আমাদের নানান আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন।বলুন আপনি কেমন আছেন?
নিলয় একটু চুপ করে থেকে বলল,
--- কাল সকালে আসছি।পরদিনই চলে যাবো।একটু দেখা করতে চাই,কিছু বলার ছিল 
 অম্বিকা নিলয়ের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো,
---  সে তো ভুবনেশ্বরে যাওয়ার আগেও বলেছিলেন, 'কথা আছে আপনার সাথে ফোন নাম্বারটা দিন-' কই সেখানে পৌঁছে মাত্র একদিন ফোন করেছিলেন আর কিছুই তো বলেননি।ইনফ্যাক্ট একদিন ছাড়া আর ফোনও করেননি।
--- এখানে আসার মাঝপথ থেকেই একটা সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে গেছি। সেটা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম, যে কথা বলবো বলে ফোন নাম্বার নিয়েছিলাম সে কথা বলা হয়ে ওঠেনি।আর এই না-বলা কথাগুলো জমতে জমতে এখন পাহাড় সমান হয়েছে।সুতরাং আপনাকে একটু বেশি সময় দিতে হবে আমাকে।অবশ্য আপনি বলতেই পারেন যে কেন আপনি আমার জন্য এতটা সময় নষ্ট করবেন?কিন্তু সত্যি বলছি আমার এই কথাগুলো একমাত্র আপনাকে বলা যায় বা বলতে পারেন বলা উচিত।
--- আচ্ছা ঠিক আছে আপনার জমানো পাহাড় সমান কথাগুলো আমি শুনবো।কিন্তু সেটা আমার বা আপনার কারো বাড়িতে সম্ভব নয়, পাড়াতে তো নয়ই।তাহলে কি নিশিতাদের ফ্ল্যাটে কথা বলবেন?
--- না না সেখানেও সম্ভব নয়।আমরা বরং বাইরে কোথাও মিট করি।আমি পৌঁছে আপনাকে কাল ফোন করে সকালেই জানিয়ে দেবো।আমরা সন্ধ্যার দিকে দেখা করব।আজ তবে রাখছি।
 অম্বিকা ফোনটা কেটে দিয়ে ভাবতে লাগলো সে যা ভাবছে নিলয়দা কি তাকে সেই কথা বলতে চায়?? বিয়ের সাথে সাথে ডিভোর্স হয়ে গেলেও মা তখন নিলয়ের সাথে তার বিয়েতে রাজি থাকলেও এখন রাজি হবেন বলে মনে হয় না। তবে বাবা তার ইচ্ছাকে ঠিকই প্রাধান্য দেবেন।মাকে নিয়ে তার চিন্তা।তবে সে যে মনে-মনে নিলয়কে ভালোবেসে ফেলেছে এটা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের মাথায় নিজেই একটা টোকা দিয়ে হেসে দিয়ে অজান্তেই মুখ থেকে তার বেরিয়ে এলো, "বড্ড বেশি ভাবছি নিলয়দাকে নিয়ে।কি না কি বলবে আর আমি কিনা উল্টোপাল্টা ভেবে চলেছি।"
 মলিনাদেবী এমনিতেই খুব সকালে ওঠেন আর আজ তার নিলু আসবে বলে সারা রাত যেন কিছুতে ঘুমাতেই পারেননি। কাকডাকা ভোরে তিনি উঠে পড়েছেন।
  সকাল আটটা নাগাদ বেলটা বেজে উঠার সাথে সাথে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই পড়িমড়ি করে ছুটলেন দরজা খুলতে। মলিনাদেবীকে ছুটে আসতে দেখে নরেশবাবু একটু সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিলেন। মলিনাদেবী দরজা খুলে নিলুকে দেখেই বলে উঠলেন, 
---এত দেরি হল যে বাবা?ট্রেন কি লেট ছিল?
--- নাতো মা ট্রেন তো সঠিক সময়েই এসেছে।
 ঘরের ভেতর থেকে নরেশবাবু চিৎকার করে বলে উঠলেন, --তোর মা তো সারারাত না ঘুমিয়ে সেই ভোর থেকে বসে আছে তার নিলু কখন আসবে?
মদিনাদেবী বলে উঠেন, বসেই যদি ছিলাম তাহলে তোমার চা টা কে করে দিল?
 এতক্ষণ তারা খেয়াল করেননি যে নিলুর সাথে ধীর পায়ে একটি মেয়েও ভিতরে এসে ঢুকেছে। তার হাতেও একটি লাগেজ রয়েছে।তাকে দেখে মলিনাদেবী বললেন,
-- এ কাকে সাথে করে নিয়ে এসেছিস নিলু?
--- বলছি মা সবকিছু বলছি তোমাদেরকে।
তারপর অচলার দিকে ফিরে বললো,
 --- অচলা তুই এই চেয়ারটাতে বোস। বুঝতেই পারছিস এঁরা আমার বাবা মা। আজ থেকে তোরও বাবা-মা।তুই যখন আমাকে দাদা বলে ডাকিস আমার বাবা-মা তোর বাবা-মা।
 নিলয়ের অচলাকে কথাগুলি বলার উদ্দেশ্য ছিল বাবা মা যাতে অচলা আর  তাকে নিয়ে কোনরকম কোন খারাপ চিন্তা না করেন।
নরেশবাবু বললেন,
---এক কাজ কর নিলু, হাত-পা ধুয়ে আয় একটু ফ্রেস হয়ে  এসে চা খেতে খেতে তুই ওর সম্পর্কে আমাদের জানাস। নিশ্চয়ই এমন কোন পরিস্থিতির মধ্যে তুই পড়েছিলি;তাই মানবিকতার খাতিরে ওকে ফেলে দিতে পারিসনি,সাথে করে নিয়ে এসেছিস।আমিতো তোকে চিনি।তুই কি করতে পারিস আর না পারিস তা আমার জানা আছে।তাই বলছি কি এত তাড়াহুড়ো করার কোন দরকার নেই।তুই তো কাল বেরোবি; অনেক সময় আছে, একটু বিশ্রাম নে, টিফিন কর তারপর না হয় সব কথা শুনবো আমরা।
 স্বামীর কথা শুনে মলিনাদেবী একটু চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালেন।তারপর বললেন,
---  যা তবে হাত মুখ ধুয়ে আয়।
এবার তিনি অচলার দিকে ফিরে বললেন,
 -- নিলু বাথরুম থেকে বেরোনোর পর তুমিও এসো হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু চা জলখাবার খাও।
কথাগুলো বলে তিনি রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।তবে দরজা খুলতে যাওয়ার সময় তার ভিতরে যে আনন্দ আর উচ্ছাস ছিল অচলাকে নিয়ে ঘরে ঢোকার সাথে সাথে এক নিমেষে মলিনাদেবীর মুখ থেকে সেই আনন্দ,উচ্ছাস উধাও হয়ে গেল।স্বামীর সামনে গলা চড়িয়ে কথা বললেও তিনি তার ছেলের সামনে কখনোই সে ভাবে কথা বলেন না।কারণ তিনি তার ছেলেকে ভালো ভাবেই চেনেন যে সে ঝামেলা ঝক্কি একদম পছন্দ করেনা।
 নিলয় বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে ঢুকে অচলাকে বলল, 
--- তুই ব্যাগের ভেতর থেকে জামা কাপড় নিয়ে আমার সাথে আয়। আমি তোকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিই।একদম লজ্জা পাবি না এখানে।এটা তোর নিজের বাড়িই ভাববি।
 ছেলের কথা শুনে মলিনাদেবী তার স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। নরেশবাবু চোখের ইশারায় তাকে চুপ করতে বললেন।অচলা ব্যাগ থেকে একটা শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ বের করে নিলয়ের সাথে মাথা নিচু করে এগিয়ে গেল।নিলয় ফিরে এসে বাবা মাকে অচলা সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করলো।
 অচলা সম্পর্কে সব কথা শুনে নরেশবাবু বললেন,
---তুমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো আমি মনে করি তুমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছো আমার ছেলে হিসেবে।একটা মেয়ের সম্মান এবং জীবন বাঁচানোর তুমি চেষ্টা করছ এতে তোমার বাবা হিসেবে আমার গর্ব বোধ হচ্ছে।তুমি ওকে নিয়ে কোন চিন্তা করো না।আমরা আছি তো।ওর কোন অসুবিধা আমরা হতে দেবো না।এখন তুমি এখানে থাকো না সুতরাং মেয়েটি যদি এখানে থাকে তাহলে আমাদেরও ভালো লাগবে।কথাটা স্বার্থপরের মত শোনাচ্ছে ঠিকই; কিন্তু এটাই বাস্তব।তুমি একটা অচেনা অজানা মেয়ের জন্য এতটা রিক্স নিতে পেরেছো আর আমরা তার মাথার উপরে একটুখানি ছাদের আশ্রয় দিতে পারব না?পেট ভরে দুবেলা খেতে দিতে পারবো না?নিশ্চয়ই পারবো বাবা।আমি তোমার এই কাজটাকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি।আর আমার মনেহয় তোমার মাও এতে কোন আপত্তি করবেন না।ও এখানে খুব ভালো থাকবে এটুকু নিশ্চয়তা আমি তোমাকে দিতে পারি।
 কথার মাঝখানেই অচলা এসে উপস্থিত হলো।সে একবারে স্নান করে এসেছে। মলিনাদেবী ওর চা টা ঢেকে রেখেছিলেন টেবিলের উপর। অচলাকে  আসতে দেখে নরেশবাবু বললেন,
---   আয় মা চা টা তো প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল।
নরেশবাবুর মুখে মা ডাক শুনে অচলা এসে নরেশবাবুর পায়ের কাছে বসে পা দুটো ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।তা দেখে মলিনাদেবী বলে উঠলেন,
---  আর তো তোর কন্যা মানায় না মা।তুই দাদা পেয়েছিস, বাবা-মা পেয়েছিস।এখন তো সবকিছুই তোর আছে।তাই তোর চোখে জল মানায় না। ওঠ উঠে বস।
 কথাগুলো বলে তিনি হাত ধরে অচলাকে তুলে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।অচলা চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললো,
--- দাদাকে দেখেই বুঝেছিলাম যে তোমরা খুব ভালো মানুষই হবে।তোমাদের শিক্ষায় শিক্ষিত বলেই দাদা এত ভালো।এতদিন ভাবতাম আমার কপালটা খুব খারাপ।কিন্তু এখন দেখছি আমার কপাল যদি ভালো নাই হবে তোমাদের সাথে আমার পরিচয়ই হত না।সেদিন যদি দাদা আমার পাশে না  দাঁড়াতো আজ হয়তো আমি কোথায় হারিয়ে যেতাম।
 নিলয় ওর কথা শুনে বলে উঠলো,নে  হয়েছে এত বড় বড় কথা আর বলতে হবেনা।আমি ক'দিন পরে ফিরে আসি, আবার তোকে পড়াশোনা শুরু করতে হবে।আমার বোন পড়াশোনা জানে না এটা তো আর হতে পারে না।তোকে প্রাইভেটে আমি মাধ্যমিক পাস করাবো। তারপর উচ্চমাধ্যমিক আর কলেজে যখন ঢুকবি তখন অবশ্য তোকে ক্লাস করতে হবে।
এরপর মায়ের দিকে ফিরে বলল,
--- মা, লুচি আর তোমার সেই বিখ্যাত হলুদ ছাড়া কালো জিরে কাঁচা লঙ্কা ফোঁড়ন দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি আলুর তরকারিটা করো।ভীষণ খিদে পেয়েছে।
 নিলয়ের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে অচলা টেবিলের উপর থেকে কাপ প্লেটগুলো গুছিয়ে নিয়ে মলিনাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-- মা, তুমি আমাকে দেখিয়ে দাও আমি করছি।
--- আরে তুই কি করবি? সবেমাত্র এলি, একটা দিন অন্তত আমি করে তোকে খাওয়ায় তারপরে না হয় একটু আধটু  আমাদের করে খাওয়াবি।এক্ষুনি তোকে কিছু করতে হবে না।
--- আমি তোমার সাথে রান্নাঘরে যাই চলো।ময়দাটা মেখে আলুগুলো কেটে দিই। কাজ করলে আমার সময় কেটে যাবে আর আমি কাজ করতেই ভালোবাসি।আসলে ছেলেবেলা থেকেই তো কাজ করি তাই কাজ ছাড়া আমি বসে থাকতে পারিনা।
--- তাহলে চল দুজনে গল্প করতে করতে আমরা কাজ করি। আজ থেকে আমার খুব সুবিধা হল।আমি মেয়ে প্লাস একটা বন্ধুও পেলাম।

ক্রমশঃ

Friday, March 5, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২৯)

সুখের ঘরে আগুন (২৯)

  নরেশবাবু অম্বিকার সাথে কথা বলে খুব খুশি হন। অনেকক্ষণ সেদিন নরেশবাবুর সাথে অম্বিকার কথা হয়। মাঝেমধ্যে অবশ্য মলিনাদেবি এসে তাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। মলিনাদেবী তাদের কথার মাঝখানে এসে যতবারই কথা বলেছেন বলা যেতে পারে তিনি তাদের কথার মাঝে ফোড়ন কেটেছেন। অম্বিকা অবশ্য তা বুঝতে না পারলেও নরেশ বাবু ঠিকই বুঝেছেন।বা অম্বিকা বুঝতে পেরেও তাদের ধরা দেয়নি।মলিনাদেবী তার ছেলের বিয়ে, ডিভোর্স সবকিছুই যেন অম্বিকা ঘটিয়েছে এরকম একটা ভাবসাব তার। তাই তার সমস্ত রাগ যেন অম্বিকার উপর গিয়ে পড়েছে।
  তিনজনে ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিলেন আর চা জলখাবার খাচ্ছিলেন।এমন সময় ল্যান্ড ফোনটা বেজে ওঠে। নরেশ বাবু ফোনটার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে মলিনাদেবী তাকে বাধা দিয়ে বলে ওঠেন,
--- তুমি গল্প করো আমি দেখছি।
 সোফার দিকে ফিরে আসতে আসতে নরেশবাবু বলতে লাগলেন "এই সময় কেউ তো ফোন করে না কে ফোন করল?"এমনিতেই অম্বিকাকে দেখে মলিনাদেবীর মাথা ছিল গরম।তার উপর অম্বিকার জন্য তৈরি করতে হয়েছে চা, জলখাবার।আর এখন নরেশবাবুর এই কথা শুনে তিনি তিড়িং করে বলে উঠেন,
-- ফোনটা কে করেছে সেটা না ধরলে বুঝবো কি করে?আগে গিয়ে কথা বলি, তারপর ফিরে এসে তোমাকে জানিয়ে দেবো এই সময়ে কে ফোন করেছিল?নরেশবাবু বুঝতে পারেন তার  মলির মেজাজটা আজ সপ্তমে।কারণ ছেলের জীবনে যা কিছু ঘটেছে এখন মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্যই তার মলি এই নিরীহ মেয়েটাকে দায়ী করে বসে আছেন। কিন্তু মেয়েটার সামনে তিনি মুখ বুঝেই থাকলেন।মলিনাদেবীকে কোন কথায় বললেন না।অম্বিকা চলে যাওয়ার পরে তাকে বুঝিয়ে বলবেন এটা ভেবে তিনি আপাতত চুপ থাকলেন।আর এদিকে মলিনাদেবী ফোনে কিছুক্ষন কথা বলে এসে পুনরায় সোফার উপর বসে পড়লেন।কিন্তু কোন কথা তিনি নরেশবাবুকে জানালেন না। নরেশবাবুও নিজের থেকে তার স্ত্রীকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করলেন না।কারণ একটাই, তিনি অম্বিকা থাকতে তার স্ত্রীকে ঘাটালেন না নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য। আরো কিছুক্ষণ থেকে নরেশবাবুকে পুনরায় আসার আশ্বাস দিয়ে অম্বিকা নিলয়দের বাড়ির থেকে বেরিয়ে পরলো।
 ---  কে ফোন করেছিল?তুমি মেয়েটার সাথে এরকম ব্যবহার করলে কেন?তোমার ছেলের যা ভাগ্যে ছিল সেটাই ঘটেছে। তার জন্য তুমি অন্য মেয়েকে বিনা কারণে দোষারোপ করবে, তার সাথে খারাপ ব্যবহার করবে, এটা ঠিক না।এটা তুমি ঠিক করোনি। নিলু যদি জানতে পারে তাহলে কিন্তু সে ভাল মনে এটা মেনে নেবে না। আমি নিশ্চিত নিলুর সাথে ওর একবার নয়, বহুবার দেখা হয়েছে।আর ও যদি আজকে তোমার ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে আর সেটা যদি নিলুকে জানায় তাহলে কিন্তু সম্ভাব্য একটা ঝামেলা থেকেই যাচ্ছে। যে মেয়েটা তোমার নিলুর ব্যাপারে কোন কিছুই জানেনা, এমনকি আমরা যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছিলাম নিলুর সাথে তার;আমরা তো সেই প্রস্তাব তার বাবা-মাকেই দিইনি। এই ব্যাপারে অম্বিকাও কিছুই জানত না।তুমি এমন ভাব করলে তাকে দেখে যেন তোমার ছেলের ভাগ্য অম্বিকা নিজে হতেই লিখেছে।তোমার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আমি আশা করিনি।
--- কি এমন ব্যবহার করলাম আমি তার সাথে যে তুমি আমাকে এত কথা শোনাচ্ছ?তোমার কথা মত তাকে টিফিন করে দিলাম, চা করে দিলাম, বসে গল্প করলাম তারপরেও দোষ হয়ে গেল আমার!আসলে তোমার ব্যাপারটা হয়েছে "দেখতে নারি তার চলন বাঁকা"- আমাকে তো তুমি কোনদিনও সহ্য করতেই পারো না।কি কুক্ষণে যে তোমার গলায় মালা পরিয়েছিলাম!
--- শুধরে নেওয়ার যদি উপায় থাকে নিতে পারো আমার কোন আপত্তি নেই ---।
--- এই বুড়ি বয়সে কি আর উপায় থাকবে শুনি -- ।
--- তা বুড়ি হওয়ার আগে উপায় ছিল বুঝি ?তখন কেন শুধরে নাও নি শুনি ---।
তোমার এত কথা শোনানোর মাঝে তোমাকে সুখবরটাই  আমার দিতে ইচ্ছা করছে না।
নরেশ বাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন,
---আমার জীবনে আর সুখবর!বল দেখি,কে ফোন করেছিল?আর সে তোমাকে কি সুখবর দিল?
--- নিলু আসছে কাল সকালে।সাথে আরো একজন আসছে, বলল এসে সব কিছু বলবে।একদিন মাত্র থাকবে।দু'দিনের ছুটি পেয়েছে মাত্র।আসলে নতুন জয়েন করেছে তো তাই সেখান থেকে ছুটি দিতে চায়নি।
--- বাহ্!খুব ভালো কথা।সে আসবে শুনে আনন্দ হচ্ছে আমার ঠিক কথা।কিন্তু এইতো সবেমাত্র গেল।পনেরো দিনও হয়নি।এরমধ্যে আবার আসার কি দরকার ছিল?আবার সাথে একজনকে নিয়ে আসছে সে আবার কে?কি কারণে তাকে সাথে নিয়ে আসছে? কিছুই তো  মাথায় আসছে না।
--- সবকিছু মাথায় আসার দরকার বা কি এই বয়সে?একটা রাতের তো ব্যাপার সে আসলেই সব কিছু বোঝা যাবে।
--- আচ্ছা একটা কথা আমায় বলতো?অম্বিকা যখন ছিল নিলু ফোন করলো অথচ তুমি তার সামনে নিলুর আসার কথাটা বললে না?এর কারণটা কি?মেয়েটা বাড়ি বয়েএসে আমাদের খবর নিতে এলো তুমি তো তার সাথে ভালো ব্যবহার করলেই না উপরন্তু নিলুর আসার খবরটাও তার সামনে দিলেনা,তুমি মেয়েটা সম্পর্কে কী ধারণা করছো বলতো?
--- আমিও তো একটা কথা কিছুতেই মাথায় আনতে পাচ্ছিনা সেই থেকে তুমি আমাকে দোষারোপ করে যাচ্ছ কেন? আসলে মেয়েটার পরে আমার রাগের কারণ হচ্ছে, মেয়েটা যদি সেদিন বেকে না বসতো তাহলে তার সাথে নিলুর বিয়েটা হত।তাহলে নিলুর জীবনটা তছনছ হয়ে যেত না।
--- বাহ! চমৎকার!তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পাচ্ছি না। কি করলে কি হত সেটা ভাবছো কিন্তু তোমার ছেলের কপালে যে এটা লেখা ছিল এটা কোন অবস্থাতেই খন্ডানো যেত না সেটা একবারও ভাবছো না।উল্টে তার সাথে তোমার ছেলের বিয়ে হয়নি বলে তুমি তাকেই দোষারোপ করছো! বুদ্ধির বলিহারি তোমার!
--- হ্যাঁ আমি তো বোকা, হাবা কিছুই বুঝিনা।তুমি সবকিছু বুঝে বসে আছো--- ।
--- এই চুপ করো তো এবার।আমার আর ভাল লাগছে না। মেয়েটার সাথে তোমার ওই ব্যবহার আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা।প্রয়োজনে আমি নিলুকে সব কথা জানাবো
--- হ্যাঁ তাতো জানাবেই। সে যে আমায় একটু বেশি ভালোবাসে তার জন্য তোমার যে হিংসা হয় সেটা কি আর জানি না।তার কাছে তার মাকে তো ছোট করতেই হবে তোমার।
--- আজ ত্রিশ বছর ধরে সামান্য ব্যাপারে তোমার এই আমার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করার স্বভাবটা কিছুতেই গেল না।একবার সুযোগ পেলেই হল। তুমি থাকো এখন তোমার সিরিয়ালের সময় হয়ে গেছে।তুমি সিরিয়াল দেখো।আমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি যদি তোমার ঝগড়াটা অন্তত থামানো যায়।
--- আসলে আমার সাথে তোমার এই ঝগড়া করা একটা বাহানা মাত্র বাইরে বেরোনোর জন্য।যাও- বাইরে থেকে ঘুরে আসো।আমিও সিরিয়ালটা একটু মন দিয়ে দেখতে পারি।শ্রীময়ীর কপালটা যেন ঠিক আমারই মত। কিছুতেই শান্তি তার কপালে নেই। মলিনাদেবী শ্রীময়ীর দুঃখে ভরা জীবন নিয়ে বকবক করতেই থাকেন আর এই সুযোগ পেয়ে নরেশ বাবু একটা পাঞ্জাবী গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েন।
  অম্বিকা নিলয়দের বাড়ি থেকে বেরনোর পর তার মাথার ভিতর একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে- 'কি কারনে মাসিমা তার সাথে এমন ব্যবহার করলেন?সে তো আগে কোনদিনও তাদের বাড়িতে যায়নি।তারা যেদিন তাদের বাড়িতে এসেছিলন সেদিন তো বাবা-মা বা সে নিজে কেউই তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। তবে তার যাওয়াটা মাসিমা  ভালো চোখে দিলেন না কেন?বাবা-মা একসময় চেয়েছিলেন  যাতে নিলয়দার সাথে তার বিয়ে হয়।তখন সেই ই রাজি হয়নি।কারণ নিজের পায়ে না দাঁড়িয়ে বিয়ে করতে সে  চায়নি। কিন্তু সে কথা তো নিলয়দার  বাবা-মায়ের জানার কথা নয়। এটাতো তার বাবা-মায়ের মনের কথা ছিল। কি জানি বাবা মানুষকে চেনা বড় শক্ত। নিলয়দা বলে গেছিলো তাই আজ সুযোগ পেয়ে তার বাবা-মাকে দেখতে গেছিল।তবে জীবনে আর কোনদিনও ওই বাড়িমুখো সে হবেনা বলেই মনেমনে প্রতিজ্ঞা করলো। যদিও মেসোমশাই অনেক করে বলে দিয়েছেন তাকে ওই বাড়িতে যেতে কিন্তু মাসিমার ব্যবহার তার কিছুতেই  বোধগম্য হচ্ছে না।
  অম্বিকা চাকরি পাওয়ার পর থেকে তার মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচি আগের থেকে অনেক কমে গেছে। এখন সে নির্বিঘ্নে বাড়ির বাইরে বেরোতে পারে এবং সময়মতো ফিরতে না পারলেও তাকে জবাবদিহি করতে হয়না।বাড়ির ছাদে  এখন এসে কাল,ছিল ও মনেহয় বসে। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সে তার বাবাকে বলেই বেরিয়েছিল যে সে নিলয়দার  কথামতো সে তার বাবা-মায়ের খবর আনতে যাচ্ছে এবং এই কথাটা যেন বাবা তার মাকে জানিয়ে দেন।কারণ সেই মুহূর্তে তার মা সামনে ছিলেন না।তাই বাবাকেই কথাটা বলে বেরোনো।নাহলে সে মাকে বলেই সব সময় বেরোয় চাকরি পাওয়ার পর থেকে।
বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে অম্বিকার মা জানতে চান নিলয়ের বাবা মা কেমন আছেন?অম্বিকা "ভালো আছেন"- বলে ভিতরে ঢুকে যায়।কারণ মলিনাদেবীর ওই টাস টাস কথাগুলি কিছুতেই অম্বিকা হজম করতে পারছে না। আর গাল বাড়িয়ে থাপ্পড় খাওয়ার মত নিলয়ের কথা শুনে ওই বাড়িতে যাওয়া তার ঠিক হয়নি বলে এখন অম্বিকার মনে হচ্ছে। অম্বিকা নিলয়দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের বাড়িতে সেই যে নিজের ঘরে ঢোকে তারপর সে সেই ঘর থেকে আর বেরোয় না। ডিনারটা তারা একসাথেই করে।অম্বিকাকে সময় মত খাবার টেবিলে দেখতে না পেয়ে রাত দশটা নাগাদ তার বাবা গিয়ে তাকে খাবার টেবিলে ডেকে নিয়ে আসেন এবং তার কাছে জানতে চান তার কি হয়েছে? অম্বিকা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
 --- মাথাটা একটু যন্ত্রণা করছিল তাই এসে শুয়ে ছিলাম।অমলবাবু সরল মনে সেটাই বিশ্বাস করেন। খাওয়া-দাওয়ার পর অম্বিকা যখন ঘরে শুতে যায় তখন রাত প্রায় পৌনে এগারটা। হঠাৎ তার মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠে।এত রাতে ফোনটা বাজার সাথে সাথে রিসিভ না করেই সে বুঝতে পারে কে তাকে ফোন করেছে।

ক্রমশঃ

    

Monday, March 1, 2021

সুখের ঘরে আগুন (২৮)

সুখের ঘরে আগুন (২৮)

     নিখিলেশের সাথে কথা বলে অচলাকে নিয়ে কলকাতায় যাওয়াই মনস্থ করে নিলয়। নিখিলেশের কথা অনুযায়ী নিলয় ওর জন্য কিছু ভিন্ন ধরনের পোশাক কিনে আনে। এইসব তালমাতাল অবস্থায় দিনান্তে বাবা মায়ের সাথে একবার করে কথা হলেও অম্বিকার সাথে সেই একদিন ছাড়া নিলয়ের আর কোন কথা হয়নি। একদিন রাতে শেষ ট্রেন ধরে তারা কলকাতা যাওয়া ঠিক করে।সেদিন সন্ধ্যাবেলা  নিখিলেশ নিলয়ের কোয়ার্টারে চলে আসে।রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে অচলাকে জিন্স আর টি-শার্ট পরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে একদম কোয়ার্টারে ভেতর থেকে প্রথমে নিখিলেশ ও অচলা স্টেশনে পৌঁছে যায়।তারপর নিলয় আরেকটি ট্যাক্সি ধরে জিনিসপত্র নিয়ে তাদের কাছে পৌঁছে যায়।কোয়ার্টার থেকে বেরোনোর সময় অচলা নিলয়কে বারবার বলে এইসব পোশাক পরতে সে অভ্যস্ত নয়।তার খুবই অস্বস্তি হচ্ছে আর এত তাড়াতাড়ি তার যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।অচলা আরও বলে যে সে চলে গেলে তার দাদার খাওয়া-দাওয়ার খুব কষ্ট হবে,তাই আর কটা দিন দেরি করে গেলে কি এমন ক্ষতি হত?সে তো ঘরের ভিতরেই থাকতো।কিন্তু নিলয় তাকে জানায় তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য একটা দিনও সে ওকে এখানে রাখবে না।অচলাকে আর কোন কথা বলার সুযোগে নিলয় দেয় না।
  টাক্সির ভিতর নিখিলেশের পাশে অচলা জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল।নিখিলেশ তা দেখতে পেয়ে তাকে বলে,
---. আমাকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি তোমার দাদার বন্ধু।সেই হিসেবে আমি তোমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। নিলয় আমাকে বিশ্বাস করে এই দায়িত্বটা দিয়েছে আর আমি মনে করি বিপদে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোটা বন্ধুরে  কর্তব্য।তুমি সম্পূর্ণ সেফ আমার কাছে।
অচলা চুপ করে নিখিলেশের কথাগুলো মাথা নিচু করে শুধু শুনে যায়। নিখিলেশ পুনরায় তাকে বলে,
--- নিলয় তোমাকে পড়াশোনা করাবে বলেছে তুমি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা কোরো।মানুষ সবসময় সুযোগ পায় না আবার অনেকে সুযোগ পেয়েও হারিয়ে ফেলে।তুমি তোমার জীবনে তোমার দাদার কাছ থেকে যে সুযোগ পেয়েছ সেই সুযোগটা তুমি হেলায় হারিয়ে ফেলো না।
এই কথাগুলো তোমাকে বলার আমার কোন অধিকার হয়তো নেই,কিন্তু একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে কথাগুলো বললাম।
 কোয়ার্টার থেকে স্টেশনের দূরত্ব খুব একটা বেশি নয় কথা বলতে বলতে তারা স্টেশনে পৌঁছে যায় নিখিলেশ অচলার হাত ধরে আগে অচলাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তারপর নিজে উঠে। তখনো নিলয় সেখানে পৌঁছায়নি।নিখিলেশ অচলার পাশে বসে অচলাকে বলে,
--- আমাদের আবার দেখা হবে।আমি কলকাতায় মাঝেমধ্যে যাই।ওখানে আমার আত্মীয়-স্বজনেরা আছে।তখন তোমার সাথে দেখা করে আসবো।আসলে আমি মানুষ বড্ড ভালোবাসি।ছেলেবেলা থেকে আমি মামা বাড়িতে মানুষ হয়েছি।আমার জন্মের সাথে সাথে আমার মা মারা যান। যখন বয়স আমার আট বছর তখন আমার ঠাকুমা মারা যান।আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমার ঠাকুমাই আমার  দেখাশোনা করতেন।কিন্তু ঠাকুমা মারা যাওয়ার পর আমি বাড়িতে সম্পুর্ন একা হয়ে যাই।আত্মীয়-স্বজনের চাপে আমাকে দেখাশোনা করার জন্য বাবা আবার বিয়ে করেন। কিন্তু সেই মা আমায় মেনে নিতে পারেন না।আমি তখন পুনরায় মামা বাড়িতে চলে যাই।মামার কোনো সন্তান ছিল না।তাই তাদের হেফাজতে আমি বিএ পাস করি এবং নিজের চেষ্টায় রেলে এই চাকরিটা পাই। এখনো আমি নিলয়কে আমার জীবনের কোন কথা জানায়নি কিন্তু কেন জানিনা তোমার কাছে সব কথা আমি বলে ফেললাম।আমি কলকাতা থেকে চাকরি পেয়ে এই ভুবনেশ্বরে জয়েন করি। আজ আমার মামা,মামি কেউ বেঁচে নেই।আমি সম্পূর্ণ একাই পৃথিবীতে।একাই থাকি কোয়ার্টারে। অফিসে কারো সাথে সেরকম মিশতে পারি না কিন্তু তোমার দাদা এখানে আসার পর প্রথম দিন থেকে তার সাথে আমার খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।তারপর তোমার দাদার কোয়ার্টারে এসে তোমাকে দেখে আমার ভাল লেগে যায়।
 নিখিলেশের কথা শুনে অচলা তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবারো মুখটা নিচু করে নেয়।নিখিলেশ তা দেখে বলে ওঠে,
---- এতে তুমি কিছু মনে করো না।আমি রাখঢাক রেখে কোন কথা বলতে পারিনা।যা মুখে আসে সেটাই সরাসরি বলে ফেলি। আমার কথায় তুমি কিন্তু অন্য কিছু মনে করোনা।
   নিখিলেশের কথা শেষ হতে না হতেই সেখানে নিলয় হাজির হয়।নিলয় ট্রেনে উঠে নিখিলেশকে জড়িয়ে ধরে বলে,
--- তোমার এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না। আমি পরশুদিন ফিরে আসবো।তুমি যেভাবে অচলাকে কোয়ার্টার থেকে বের করে নিয়ে আসলে আমি একা ঠিক পারতাম না।তোমার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম।
 নিখিলেশ তখন নিলয়কে বলল,
--- একটা অপরিচিত মেয়েকে নিজের বোনের জায়গা দিয়ে তার জন্য তুমি যা করছো তার তুলনা হয়না এর জন্য তোমাকে আমার স্যালুট ভাই আর তোমার বন্ধু হিসেবে তোমার বোনের জন্য কিছু করতে পেরেছি মনে করে আমি মনেমনে আনন্দিত।
    ভুবনেশ্বরে পৌঁছানোর একদিন পরে নিলয় অম্বিকাকে ফোন করার পর অম্বিকা ভেবেছিল হয়তো নিলয় তাকে রোজই ফোন করবে। কিন্তু নিলয় তাকে ফোন না করাতে অম্বিকার সত্যিই খুব অভিমান হয়।তাই সে রাগ করে কোন ফোন নিলয়কে করে না। এরপর সে একদিন বিকেলে নিলয়দের বাড়িতে যায়।অম্বিকাকে বাড়িতে দেখে নিলয়ের বাবা-মা খুবই অবাক হয়ে যান। তারা কখনোই ভাবতে পারেননি যে অম্বিকা তাদের বাড়িতে আসবে।অম্বিকাকে দেখে মলিনাদেবী মনেমনে ভেবে বসলেন হয়তো তার ছেলের বউয়ের সব ঘটনা জানার পর সেগুলো সরোজমিনে অম্বিকা জানতে এসেছে।তাই প্রথম অবস্থায় তাকে দেখে তিনি খুশি হতে পারেনি।কিন্তু নিলয়ের বাবা নরেশ বাবু অম্বিকাকে দেখে খুবই খুশি হন।আজ বেশ কয়েকটা দিন ছেলেটা বাড়ি নেই।তারও মন মেজাজটা ভালো নয়। আর বিয়ের 30 বছর পর স্ত্রীর সাথে নিত্যদিন গল্প করতে কার আর ভালো লাগে?আর তিনি বাইরে বেরোলেই তো সেই প্যানপ্যানানি!" আমি সারাক্ষন একা একা থাকি।তাও তুমি ঘরে থাকলে মনেহয় একটা মানুষ অন্তত বাড়িতে আছে।সেই তুমিও যদি বেরিয়ে যাও তাহলে তো আমাকে সেই ভূতের মত বাড়ি পাহারা দিতে হয়।" আর ঘরে থাকলে সেই একই কথা- ছেলের ভবিষ্যৎ, ছেলেটার কপালটা কেন এমন হলো? ছেলে বাইরে গিয়ে ঠিকভাবে খেলো ঘুমালো কিনা ;সেই ভাঙ্গা রেকর্ড!এসব কথা নরেশবাবুর  মাথার মধ্যে ঘুরপাক করলেও সব সময় অন্যের মুখ থেকে শুনতে কার আর ভালো লাগে?তাই মেয়েটি যখন তার বাড়িতে এসেছে তাকে দেখে ভাবলেন অন্তত কিছুটা সময় গল্প করে  কাটানো যাবে।
  অম্বিকা ঘরে ঢুকেই ঢিপ হয়ে মলিনাদেবী ও নরেশবাবুকে প্রণাম করে।তারা দুজনে দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে অম্বিকার উদ্দেশ্যে মলিনাদেবী বললেন,
--- তা মা হঠাৎ কি মনে করে?আগে তো কোনদিন আমাদের বাড়িতে আসোনি?
--- এমনিই এলাম মাসিমা।আপনারা কেমন আছেন জানতে। আসলে নিলয়দা তো এখানে নেই তাই ভাবলাম যাই একটু আপনাদের সাথে দেখা করে আসি।
স্বামী,স্ত্রী দুজনে আকাশ থেকে পড়লেন।তারা ভাবলেন নিলয় যে এখানে নেই অম্বিকা সে কথা জানলো কি করে?
মলিনা দেবী অনেক চেষ্টা করে মুখে হাসি এনে বললেন, --- --- নীলু যে এখানে নেই তুমি কি করে জানলে? তোমার সাথে কি নিলুর কথা হয়?
--- না না মাসিমা, মাঝে একটা বিয়েবাড়িতে নিলয়দার সাথে আমার দেখা হয়েছিল।তখনই জানতে পারি নিলয়দা ভুবনেশ্বরে ট্রান্সফার হয়ে গেছেন।আর তখন বলেছিলেন আমি যেন মাঝেমধ্যে এসে আপনাদের সাথে দেখা করে যাই। তাহলে আপনাদেরও ভালো লাগবে।আজ  ছুটি ছিল তাই একটু সময় পেয়ে চলে এলাম দেখা করতে।আসলে আমার তো আসতে আসতে সেই সন্ধ্যা হয়ে যায়।
এতক্ষণ পরে নরেশবাবু স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
--- আরে এতো কথার কি আছে?পাড়ার মেয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। তা কিসের জন্য, কেন এলো, কি প্রয়োজন? এত প্রশ্ন করার তো কোন দরকার নেই।যাও একটু চা, জলখাবার করে নিয়ে এসো।তিনজনে বসে একটু গল্পগুজব করি। নিলুটা বাড়ি নেই সত্যিই বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।তাও মেয়েটার সাথে বসে একটু সময় কাটানো যাবে।তা না হলে তো তোমার ওই টিভি খুলে বসে সিরিয়াল দেখা,আর তা না হলে ছেলের জন্য বসে বসে টেনশন করা। তোমাদের মেয়েদের একটা মস্ত বড় দোষ ছেলেমেয়েরা যতই  বড় হোক না কেন তাদের সারা জীবনই তোমরা ছোট করে রাখবে।আর তারা কিছু জানেনা, বোঝেনা, পারেনা বলেই চালিয়ে দেবে। 
তারপর তিনি নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হাসতে লাগলেন। মলিনাদেবী স্বামীর এই রসিকতায় মোটেই খুশি হতে পারলেন না।তিনি বলে উঠেন,
-- তোমরা কি করে বুঝবে মায়ের কি জ্বালা!
--- হ্যাঁ তাই তো মায়েরাই সবকিছু বোঝে!বাপেরা কিচ্ছু বোঝে না।তারা তো কোনো দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেনা। আর সেই জন্য বাপেদের জ্বালাও থাকে না। যত্তসব!

ক্রমশঃ