দাবার চাল
বনেদি রাশভারী দর্পনারায়ণ রায় চৌধুরীর কথায় পলাশপুর গ্রামে আজও বাঘে গরুতে একঘাটে জল খায় | জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি হলেও জমিদারী রক্তটা আজও শিরায় শিরায় বহমান | তা তার চালচলন কথাবার্তায় ফুটে ওঠে | পরিষ্কার ধুতি আর পাঞ্জাবীতে সাতফুটের কাছে লম্বা মানুষটিকে দেখলে আজও গ্রামের সকল মানুষের শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে | পরোপকারী ,ন্যায় বিচারক সর্বোপরি তিনি দীনবন্ধু | নানান গুন সম্পন্ন এই মানুষটির কথার উপরে আজও গ্রামের কেউ কোন কথা বলতে পারেননা | শুধুমাত্র গৃহকর্ত্রীর কাছেই তিনি ভিজে বিড়ালটি হয়ে থাকেন |
বেশ ধুমধাম করেই বড় ছেলের বিবাহের আয়োজন করেন পাশের গ্রাম নোয়াপাড়ার চ্যাটার্জী পরিবারের সাথে | চাহিদা তার কিছু ছিলোনা কিন্তু গিন্নীর চোখের ইশারায় তিনি আর দ্বিতীয়বার সে কথা বলতে সাহস পাননা | তাই দশ ভরি সোনা আর মেয়ের ব্যবহার্য সমস্ত রকমের আসবাব সহযোগে বাড়ির কর্ত্রী শুভদিনে তার একমাত্র পুত্র কৃশানুর বৌ তনুলতাকে বরণ করে ঘরে তোলেন | গ্রাম শুদ্ধ লোককে পেট পুরে ভুরিভোজও করান |
দুমাস পর থেকেই শ্বাশুড়ী শান্তিদেবী তার পুত্রবধুটির কাছে জানতে চান তার ঋতুস্রাব হয়েছে কিনা | উনার ভাবসাব দেখে মাঝেমাঝে তনুর মনেহয় তার বংশধরটিও যদি তনুলতা তার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে পারতো তাহলে তিনি মনেহয় খুশিই হতেন | সংসারে কোন কাজকর্ম করতে হয়না শুধু শ্বশুরমশাই খেতে বসলে অন্যান্য ঝি রাঁধুনির সাথে শ্বাশুড়ী মাতার কাছে মুখটি বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় | সারা দিনে এটাই শুধু কাজ | স্বামী তার আত্মভোলা সিধেসাদা | অন্দরমহলে শান্তিদেবীর কথায় শেষ কথা | বিয়ের তিনমাস পরেই ছিল দুর্গাপূজা | গ্রামে একটি দুটি বারোয়ারি পূজা হলেও সব ভিড় এই রায় চৌধুরীদের পরিবারেই | পূজার চারদিন সকলেই এখানে পেট পুরে খাবার খায় | এ বাড়ির দুর্গাপূজায় প্রতিদিন মাছ থাকবেই | এই বংশে যিনি এই পুজো শুরু করেছিলেন তিনিই এই নিয়ম করেছিলেন | তার মতে দূর্গা হচ্ছেন বাড়ির মেয়ে | আর মেয়ে বাপের বাড়িতে এসে নিরামিষ খাবার খায়না | তাই পূজার চারদিনেই ভোরবেলা থেকে বাড়ির চারটে পুকুরে পালাক্রমে জাল ফেলে মাছ ধরা হয় | আর এই কারণেই বাড়িতে চারটে পুকুর কাটা হয়েছে | সারাবছর ধরে তাতে মাছ চাষ করা হয় |
বিয়ের তিনমাস পরেই ছিল তনুলতার প্রথম দুর্গাপূজা | খুব আনন্দ সহযোগে সকলের সাথে হাত মিলিয়ে প্রথমপুজোতে সব কাজ করেছিল | কিন্তু দ্বিতীয় বছর পুজো আসার অনেক আগেই তার কপালে বাজা অপবাদটি জুটে গেছে | তাই দ্বিতীয় বছরের পুজোতে সে ছিল সব কাজে ব্রাত্য | ঠাকুর দালান থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলে মায়ের কাছে শুধু একটি সন্তান কামনা করে গেছে |
এভাবেই কেটে গেলো তার আরও একটি বছর | কিন্তু বাজা কথাটি তাকে দিনে পাঁচ থেকে সাতবার শুনতেই হবে | চোখের জলও তার শুকিয়ে গেছে | তৃতীয় বছরের অষ্টমী পুজোর ভোররাতে ঠিক সন্ধি পুজোর সময় এক সন্যাসী এসে উপস্থিত হন | তিনি এসে সোজা পুজোরস্থলে চলে যান | সকলে তাকে প্রণাম করতে হুমড়ি খেয়ে পরে | কিন্তু তিনি দুর্গামূর্তির সামনে প্রণাম নিতে অস্বীকার করেন | কিছুক্ষণ পরে তার চোখ যায় দূরে দাঁড়ানো তনুলতার দিকে | হাতের ইশারায় তাকে কাছে ডাকেন | তনুলতা কিছুদূর এগিয়ে শান্তিদেবীর ভয়ে দাঁড়িয়ে পরে | সন্যাসী আবার তাকে কাছে ডাকেন | তনুলতা ইতঃস্তত করতে করতে সন্যাসীর পায়ের কাছে এসে বসে |
--- এতো কিসের দুঃখ মা তোর ? দেখ মা সন্তান না হওয়ার এক জ্বালা আর হলে যে শত জ্বালা ---|
তনু নীরবে চোখের জল ফেলতে থাকে |
--- দেখ মা আমি জানি তোর এতো কষ্টের কারণ | যা ওই ঝুড়ি থেকে একটি পদ্মফুল তুলে আমার কাছে নিয়ে আয় |
এ কথা শুনে শান্তিদেবী রে রে করে
পড়লেন |
--- একথা ওকে বলবেননা বাবা | ও বাজা মেয়েছেলে |
সন্যাসী তার ডান হাতটা তুলে মন্ডব কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলেন ,
--- কি বললি পাপিষ্ঠা ?
এই হুঙ্কারে সকলেই ভয় পেয়ে গেলো | তনুলতাকে তিনি পুনরায় কাজটা করার জন্য ইশারা করলেন | সে সোজা মন্ডবে উঠে গিয়ে একটি পদ্ম এনে সন্যাসীর হাতে দিলো | তিনি ফুলটি নিয়ে মন্ত্র পরে তাতে ফুঁ দিয়ে তনুলতার শাড়ির আঁচলে সেটিকে দিয়ে মায়ের পায়ের দিতে বলেন | তনুলতা ঠিক তাই করে | ভোরের আলো ফোঁটার আগেই সকলের অলক্ষ্যে সন্যাসী বাড়ি ত্যাগ করেন | তাকে অনেক খুঁজেও কোন সন্ধান পাওয়া যায়না |
এর ঠিক দুমাস পরেই রায় চৌধুরী পরিবারে সাজো সাজো রব --- পরিবারে বংশধর আসছে | তনুলতার খাতির যত্ন বেশ বেরে গেলো | গিন্নী তো ধরেই নিয়েছেন বৌমা তার পুত্র সন্তান প্রসব করবে | কিন্তু অন্দরমহলের নানান কথাবার্তায় কর্তামশাই একটু ভয়েই আছেন | কারণ তিনি জানেন বৌমার যদি পুত্রসন্তান না হয় তাহলে বাড়িতে আগুন জ্বলবে |
যথা সময়ে তনুলতা একদিন ভোররাতে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জম্ম দেয় | নিজের শোবার ঘরে থেকেই তিনি গিন্নীর কপাল চাপড়ে কান্নার আওয়াজ পান | সারারাত দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় তিনিও ঘুমাতে পারেননি | এরকম একটা ঘটনা যে ঘটতে চলেছে তিনি তা আন্দাজ করেছিলেন | আস্তে আস্তে ঘরের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ক্রন্দনরত গিন্নীকে ডেকে বললেন ,
--- ওগো শুনছো , ভোররাতে স্বয়ং মা দূর্গা আমাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেন ,
' মাতৃশক্তির আরাধনা করিস | আমি মানব রূপে তোর সংসারে এলাম | আমার যেন কোন অযত্ন না হয় |'
কপালে চোখ তুলে গিন্নী বললেন ,
--- হ্যাগা কি বলছো তুমি ?সত্যিই মা দূর্গা এসেছেন আমার সংসারে ?
--- তাই তো তিনি বললেন | যাও শাঁখ বাজাও , উলু দাও |
--- কিন্তু আমার বংশ ?
--- হ্যা মায়ের কাছে আমি ওটা জানতে চেয়েছিলাম | তিনি বললেন ' সব হবে |'
( মা দুর্গাকে নিয়ে মিথ্যা বলছেন -- মনেমনে মায়ের কাছে সমানে ক্ষমা চেয়ে চলেছেন )
--- হ্যাগা তুমি কি বিড়বিড় করছো |
--- মাকে মনেমনে প্রণাম জানাচ্ছি | যাও যাও গিন্নী সকলকে মিষ্টি মুখ করাতে ভুলোনা |
রায় চৌধুরী মশাই মনেমনে ভাবলেন যাক বাবা কয়েকটা বছর শান্তির অশান্তির হাত থেকে মুক্ত হওয়া গেলো | ঠাকুর দালানে গিয়ে তিনি মায়ের কাছে তাকে নিয়ে মিথ্যা বলার জন্য মাথা কুটে ক্ষমা চাইতে লাগলেন | গিন্নীর চোখে পড়াতে তিনিও দূর থেকে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রণাম করে গেলেন |
এর ঠিক দু বছরের মাথায় তনুলতার এক পুত্রসন্তান হয় | গিন্নী দৌড়ে গিয়ে স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন ,
--- হ্যাগো তোমাকে কি শিবঠাকুর দর্শন দিলেন আজ ?
বুকের ভিতর হাতুড়ী পেটাচ্ছে তখন কর্তামশাইয়ের আর বুঝি আগুনের তাপ থেকে রেহাই পাওয়া গেলোনা | ম্লানমুখে জানতে চাইলেন
--- কেন বলো তো? বৌমার কি আবার--
--- ছেলে হয়েছে গো , প্রথমবার তো মা দূর্গা এসেছিলেন আমি ভাবলাম এবার বুঝি শিবঠাকুর এসেছেন |
ধড়ে যেন প্রাণ এলো কর্তামশায়ের | হাসতে হাসতে বললেন ,
--- আরে শিবঠাকুর কি করে আসবেন ? কার্তিক এসেছেন |
--- ও তাই তো আমারও মাথাটা গেছে |
কর্তামশাই মনেমনে বললেন ,' সেটা তো আমি বিয়ের পর থেকেই বুঝতে পারছি | কি দেখে যে বাবা মা নাম রেখেছিলো শান্তি --- আমি তো জীবনভর অশান্তিতেই মরণাপন্ন হয়ে বেঁচে আছি |
No comments:
Post a Comment