Monday, May 4, 2020

মনের মত

মনের  মত  
     নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

   বিয়ের  পাঁচ  বছরের  মধ্যে  কোন  সন্তান  না  হওয়ায়  সুবিমল  আর  এলিসা খুবই  ভেঙ্গে পরে | ভারতবর্ষের  এ  প্রান্ত  থেকে  ওপ্রান্ত  সমস্ত  জায়গায়  চিকিৎসা  করে  বেরিয়েছে | কিন্তু  সবজায়গায়  সেই  একই  কথা  সন্তান  ধারণের এলিসার  অক্ষমতা | আত্মীয়স্বজন  বর্জিত  দুটি  প্রাণী  সম্পূর্ণ  একাকী | সুবিমল  অফিস  আর  বাড়ি  আর  এলিসা তার  সংসার  নিয়ে | 
  অবাঙালী মেয়ে  এলিসা | সুবিমল  মুখাৰ্জী  পরিবারের  বড়  ছেলে | কুলীন বংশজাত  ব্রাহ্মণ  পরিবারের  সন্তানের  সাথে  অবাঙালী পরিবারের  মেয়ের  বিয়ে  হতে  পারেনা  একথা  সুবিমলের  বাবা  তার  স্ত্রীকে  জানিয়ে  দিয়েছিলেন | পরিণামে  সুবিমল  মায়ের  আশীর্বাদ  নিয়ে  ঘর  ছেড়েছিলো | মস্তবড়  পরিবার  এই  মুখাৰ্জীদের   | সম্পত্তি , বাড়ি ,অর্থ  প্রাচুর্য্যে  জমজমাট  এই  পরিবারের  কাছে  শহরের  অনেক  গাড়ি  বাড়িয়ালা  ধনী পরিবারও মৃয়মান | বাড়িতে  ঠাকুর ,  দাসদাসী  আজকের  যুগেও  বর্তমান | এহেন  পরিবারের  ছেলে  সে  কিনা  ভালোবাসলো  এক শিখ  বংশজাত  একটি  মেয়েকে?সুবিমল  বাড়ি  থেকে  বেরিয়ে  গেলে  বাড়ির  কর্তা সকলকে  ডেকে  জানিয়ে  দিলেন  ' আজ  থেকে  সুবিমল  এই  পরিবারে  মৃত |' বাড়ির  সকলে  চমকে  উঠলো | আর  বাড়ির  কর্ত্রীর  বুকে  হাতুড়ি  পেটালেও  কোনদিন  পাশের  মানুষটি  যেমন  টের  পায়নি  আজও তার  অন্যথা  হলনা | এরকম  যে  হবে  তা  তিনি  জানতেন | সুবিমলের  হাত  দিয়েই  তিনি  তার  ভাবি  পুত্রবধূর  জন্য  তার  বাবার  দেওয়া  মোটা  মাছের  কাটার  সোনার  হারটি  পাঠিয়ে  দিয়েছিলেন  |
   সন্তান  না  হওয়ার  যন্ত্রণা ভুলতে  প্রত্যেক  রবিবার  স্বামী , স্ত্রী  দুজনেই  বেরিয়ে  পড়তো  লংড্রাইভিং  এ | কোনদিন  তারা  ফিরে আসতো আর  কোনদিন  বা  অনেক  দূরে  চলে  গেলে  ছোটবড় যেকোন  হোটেলে  রাত কাটিয়ে  ভোরবেলায়  বাড়ির  উদ্দেশ্যে  রওনা  দিত | এইরকমই  কোন  একদিন  তারা এক  হোটেলে  যখন  রাত্রিযাপন  করছিলো ; রাত তখন  তিনটে  কি  সাড়ে  তিনটে  হবে  , দরজায়  বারবার  ধাক্কা  পড়ছে  | ঘুম  চোখে  দুজনেই  ভয়  পেয়ে  যায় | পরে  হোটেল  ম্যানেজারের  গলার  আওয়াজ  পেয়ে  ভিতর  থেকেই  সুবিমল  জানতে  চায়  ' কি  হয়েছে ?' একজন  মহিলার  লেবার  পেইন  উঠেছে  তাকে  একটু  হাসপাতাল  নিয়ে  যেতে  হবে  গাড়িতে  করে | 
  মেয়েটির  সাথে  শুধু  তার  স্বামীই  আসে  | কাছেপিঠে  কোন  স্বাস্হ্যকেন্দ্রে  তাকে  ভর্তি  নেয়না | বাচ্চার  হাত  বেরিয়ে  এসেছে  মায়ের  জীবনহানির  সম্ভাবনা রয়েছে | এইভাবে  তিনচার  জায়গায়  ঘোরার পর  অবশেষে  একটি  নার্সিংহোমে  তাকে  ভর্তি  করা  হল  তার  স্বামীর  অর্থ  খরচ  করার  ক্ষমতা  নেই  জেনেও | এলিসা সুবিমলকে  রাজি  করালো সমস্ত  খরচ  বহন  করার  জন্য | ভোররাতে  সুন্দর  এক  ফুটফুটে  মেয়ের  জম্ম  দিয়ে  মহিলা  মারা  গেলেন | কিন্তু  তার  স্বামীটি  ওই  বাচ্চা  নিতে  অস্বীকার  করলেন | সংসারের  তিনি  একা মানুষ  এ  বাচ্চা  কিভাবে  তিনি  মানুষ  করবেন  ?এবং  কোন  একসময়  তিনি  লুকিয়ে  নার্সিংহোম  থেকে  পালিয়ে  গেলেন |
 এলিসা আর  সুবিমলের  আদরের  মেয়ে  হয়ে  লিজা  ওরফে  শাবানা  মানুষ  হতে  লাগলো | অনেক  কাঠখড়  পুড়িয়ে  ছুটাছুটি  দৌড়াদৌড়ির  পর  তার  বাবা  মোসলেমুদ্দিনের  জায়গায়  বাবা  সুবিমল  মুখাৰ্জী  আর  মা  আমিনা  খাতুনের  জায়গায়  এলিসা মুখার্জী  --- সরকারি  সমস্ত  নিয়মকানুন  মেনে | 
  শাবানা  মুখাৰ্জী  একজন  বড়  হার্ট  সার্জন | ডাক্তারি  পাশ  করার  পাঁচ  বছরের  মধ্যেই  ভারতবর্ষের  যেকোন  প্রান্তে  এই  নামটা  সুপরিচিত  হয়ে  উঠেছে | এই  মেয়ের  কথাও  সুবিমলের  মায়ের  অজানা  নয় | বাবা  বাড়িতে  না  থাকলে  মাঝে  মধ্যে  একটু  আধটু  কথা  সুবিমলের  সাথে  তার  মায়ের  হয়  তাও বাড়ির  সকলের  চোখ  এড়িয়ে | গতরাত্রে লিজা  বাড়িতে  ফিরতে  পারেনি  বেশ  কয়েকটি  ক্রিটিকাল  অপারেশন  থাকায় | স্বাভাবিক  ভাবেই  তার  বাবা, মা  সারাটা  রাত ভালোভাবে  ঘুমাতে  পারেনি | যদিও  মাঝেমধ্যে  লিজার  এরকম  হয়  কিন্তু  তারা  তো  মেয়েকে  চোখে  হারায় | একদম  ভোরের  দিকে  দুজনেরই  চোখটা  একটু  লেগে  এসছে অমনি  ল্যান্ডফোনের  আওয়াজ | উঠে  গিয়ে  ড্রয়িংরুমে  ফোন  তুলে  শোনে  মায়ের  গলার  আওয়াজ | খুব  চাপা  স্বরে  মা  যা  বললেন  তার  সারমর্ম  হল  কাল  থেকে  তার  বাবার  বুকের  বাদিকটা  ব্যথা  হচ্ছিলো  এখানকার  ডক্টর  বলে  গেছেন  কলকাতায়  নিয়ে  যেতে  --- সময়  খুব  কম  হাতে | সুবিমল  লিজাকে   ফোন  করে  সব  জানালো  এবং  এও বললো  ' উনি  তোমার  দাদু  কিন্তু  তুমি  ওনাকে  পরিচয়  দেবেনা | আমার  বাবার  জীবন  আজ  তোমার  হাতে  তুমি  আমার  বাবাকে  বাঁচিয়ে  দাও | তারা  রওনা  দিয়েছেন  খুব  তাড়াতাড়ি  পৌঁছে  যাবেন |'
 বাহাত্তর  ঘন্টা  ধরে  জমিমানুষে  টানাটানি  আর  বেলুন  সার্জারির  পর  সুকমল মুখাৰ্জী  চোখ  খোলেন | এই  তিনদিন  সুবিমলের  মা  ও  ছোটভাই  তার  বাড়ি  থেকেই  হাসপাতালে  যাতায়াত  করেছে | 
 --- কেমন  আছেন  মিষ্টার  মুখাৰ্জী  ?
--- ভালো  আছি  ম্যাডাম  | আপনার  হাতে  তো  জাদু  আছে  ম্যাডাম  |
 লিজা  হেসে  পরে  বললো ,
--- আপনি  আমার  দাদুর  বয়সী  | আমার  ডাক  নাম  লিজা | আপনি  আমাকে  এই  নামেই  ডাকেন  আর  তুমি  করে  বলুন |
--- তাহলে  তো  তোমাকেও  আমাকে  দাদু  ডাকতে  হয় | আর  তুমি  করে  বলতে  হয়  |
--- আমার  কোন  আপত্তি  নেই |
 ঠিক  এই  সময়ে  সুবিমলের  মা  আর  ভায়ের  প্রবেশ |
--- এই  দেখো | এতো  বড়  একজন  ডাক্তার  অথচ  কি  অমায়িক  ব্যবহার | আমরা  দুজনে  দাদু  নাতনি  হয়ে  গেছি  | এই  হচ্ছে  পরিবারের  শিক্ষা | ও ও  কিন্তু  মুখাৰ্জী  | তারপর  স্ত্রীর  মুখের  দিকে  তাকিয়ে  বললেন  - আচ্ছা  তোমরা  কোথায়  আছো  এ  কটাদিন ?
--- হো --টে -- লে  
  পূর্ব  প্লান মত  সুবিমল  আর  এলিসা এসে  ঢোকে | সঙ্গে  সঙ্গে  লিজা  দৌড়ে  গিয়ে  বাবার  দিকে  তাকিয়ে  বলে ,
--- বাবা  আমি  তোমার  কথা  রাখতে  পেরেছি | তোমার  বাবাকে  আমি  সুস্থ্য  করে  দিয়েছি | 
  সকলেই  নিঃশ্চুপ | কারো মুখে  কোন  কথা  নেই | নিস্তব্দতা  ভেঙ্গে সুবিমলের  দিকে  তাকিয়ে  তার  বাবা  বললেন ,
--- ঈশ্বরের  লীলা  বোঝা  দায় | অপমানের  যোগ্য  জবাবটা  দিয়েছো  | মেয়েকে  খুব  সুন্দর  মানুষ  করেছো | বাবা  হিসাবে  আমি  গর্বিত | পারলে  আমায়  ক্ষমা  কোরো | সুবিমল , এলিসা এগিয়ে  গিয়ে  প্রণাম  করে | গিন্নীর দিকে  তাকিয়ে  সুকমল  বলেন ,
--- আরে চুপ  করে  কি  বসে  আছো ? গলার  হারটা  খুলে  ওর  গলায়  পরিয়ে দাও | মুখাৰ্জী  বাড়ির  বড়  বৌ | খালি  হাতে  মুখ  দেখা  ঠিক  নয়  | 
 এলিসা গলায়  হাত  দিয়ে  হারটা  তুলে  বলে  ,
--- মা  তো  মুখ  দেখার  আগেই  আমাকে  এটা পাঠিয়ে  দিয়েছিলেন | আর  হাতটা  দেখিয়ে  বলে , সেদিন  বাড়িতে  ঢুকেই  নিজের  হাত  থেকে  খুলে  এই  বালা জোড়া  দিয়েছেন |
--- ও  তারমানে আমার  কাছে  মিথ্যা  বলা  হয়েছে  হোটেলের  কথা  |প্রথম  থেকেই  তোমাদের  মায়ের  সাথে  যোগাযোগ  ছিল | মাঝখান  থেকে  আমিই  খারাপ  হলাম | যাকগে  যাক  -- দিদিভাই  আমায়  কবে  ছাড়বি বলতো ?
--- তোমাকে  তো  আমি  আর  ছাড়বোনা  দাদু | এখান থেকে  ছেড়ে  দিয়ে  সাথে  করে  আমার  বাবার  বাড়ি  নিয়ে  যাবো  | এতে  যদি  তুমি  রাজি  না  থাকো  তাহলে  আরও কিছুদিন  এখানেই  থাকতে  হবে  | 
 --- না  রে  দিদিভাই  তুই  আমাকে  তোদের  কাছেই  নিয়ে  চল  | বৌমার  হাতের  একটু  সেবাযত্ন  নিয়ে  বাকি  জীবনটা  কাটিয়ে  দিই  | নিজের  অন্যায়  অনেকেই  নিজের  মুখে  স্বীকার  করতে  পারেনা | কিন্তু  আজ  স্বীকার  করতে  আমার  একটুও  বাধা  নেই  --- জাত , ধর্ম , বংশমর্যাদা  নয়  মানুষের  মনুষ্যত্বই  হচ্ছে  আসল | আর  এই  সহজ  সত্যতা  বুঝতে  আমার  সারাটা  জীবন  লেগে  গেলো  |
  

No comments:

Post a Comment