ভুলের মাশুল
নন্দা মুখাৰ্জী রায় চৌধুরী
বিয়ের পর তিনবছর সবই ঠিকঠাক চলছিল | কিন্তু তিনবছর পর হঠাৎ করেই যেন শ্রেষ্ঠার জীবনে সবকিছু ওলটপালট হতে শুরু করে | রোজ যেমন ঠিক ছটার মধ্যেই অফিসের গাড়ি এসে একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার স্বামী অভিমান মুখাৰ্জীকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি | জলখাবার করে রেখে শ্রেষ্ঠা রোজের মত হালকা সেজে বাড়ির এক চিলতে উঠোনে অভিমানের জন্য অপেক্ষা করছিলো | তিনবছর ধরে এটাই চলছে | অভিমান বাড়ির ভিতরে ঢোকার সাথে সাথেই তার মোবাইল বেজে ওঠে | অভিমান দাঁড়িয়ে পরে | শ্রেষ্ঠাকে ইশারায় চা করতে বলে বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলতে শুরু করে | কিছুক্ষণ পরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে বলে ,
--- আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে | আমি এসে টিফিন করবো |
শ্রেষ্ঠা কিছু বলার সুযোগই পায়না | অভিমান লাফ দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় | অভিমানের এই ব্যবহারে শ্রেষ্ঠা পুরো থ হয়ে যায় | সেই শুরু | বাড়িতে ফেরার কোন সময় নেই , আগের মত গল্প , হাসি , আদর নেই | প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা নেই | কোনদিন বা সকালে অফিসের গাড়ি আসার আগেই বেরিয়ে পরে আর ফিরতে ফিরতে সেই অনেক রাত | কোনদিন ফিরে এসে ডিনার করে আবার কোনদিন বা বলে ' খিদে নেই '--| যথারীতি শ্রেষ্ঠারও সেদিন খাওয়া হয়না | অনেকবার জানতে চেয়েছে শ্রেষ্ঠা কি সমস্যা হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই একই উত্তর পেয়েছে ' সময় হলে সব বলবো |'
অভিমানী শ্রেষ্ঠা এ উপেক্ষা মেনে নিতে পারেনা | একদিন সত্যিই সে তার স্বামীকে ছেড়ে বাবা , মায়ের আশ্রয়ে ফিরে আসে | অভিমান অনেকবার তাকে ফিরিয়ে আনতে গেছে | কিন্তু ফিরে আসা তো দূরের কথা সে কোনদিন অভিমানের সাথে দেখাও করেনি |
বছর পাঁচেক পর হঠাৎই রাস্তায় অভিমানের সাথে শ্রেষ্ঠার দেখা | সাথে অল্পবয়সী এক কিশোরী | অভিমানই প্রথম কথা বলে ,
--- কেমন আছো শ্রেষ্ঠা ?
--- এই আছি আর কি ? এই মেয়েটি তোমার কে হয় ?
মেয়েটি মানে মানালী অভিমানের গা ঘেসে দাঁড়িয়ে বলে ,
--- দাদা এটা কি বৌদি ?
--- অভিমান ও শ্রেষ্ঠা তখন পরস্পরের মুখের দিকে তাকায় | কিন্তু কেউ কোন উত্তর দেয়না | শ্রেষ্ঠার সমস্ত অনুনয় , বিনয় ,আকুতি অগ্রাহ্য করে মানালী জোর করে তাকে নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে | সেখানে গিয়ে দেখে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলা|ওদের চা খাওয়া হয়ে গেলে যিনি চোখের ইশারায় শ্রেষ্ঠাকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে যান | রান্নাঘরের দরজাটা একটু ভেজিয়ে দিয়ে তিনি শ্রেষ্ঠাকে তার জীবনের গল্প শোনাতে শুরু করলেন |
অভিমানের জম্মের কয়েক বছর পর তার বাবা আবার বিয়ে করে ওই বাড়িতেই বৌ এনে তোলেন | তখন অভিমানের মা তাকে নিয়ে বাড়ি ত্যাগ করেন | তিনি অনেক কষ্টে একটু একটু করে অভিমানকে আজ এই জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করেন | কিন্তু অভিমানের মায়ের কপালে সুখ ছিলোনা | অভিমান চাকরি পাওয়ার ছমাসের মধ্যেই তিনি মারা যান | ছেলের উন্নতিতে অভিমানের বাবা আবার তার সাথে সখ্যতা শুরু করেন | কিন্তু অভিমান তার এই ভালোমানুষি মুখোশটা মেনে নেয়নি | সে শুধু তার বাবার চাহিদা মত টাকা দিয়েই ক্ষান্ত থাকতো | দ্বিতীয়পক্ষে তার একটি মেয়ে হয় | প্রথম থেকেই তিনি মদ খেতেন তবে আস্তে আস্তে মদ তাকে খেতে শুরু করলো | লিভার শেষ হয়ে গেলো | হাত শূন্য | কারণ তখন তিনি রিটায়ার করেছেন | করতেন একটা প্রাইভেট ফার্মে সামান্য চাকরি | সামান্য মাইনে পেতেন | প্রফিডেন্ট ফান্ড বলে কিছু ছিলোনা | মাইনের টাকাটাই ছিল ভরসা |উপায় না দেখে একদিন সন্ধ্যায় অভিমানকে ফোন করে সব জানালাম | এতক্ষণে তুমি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো আমি অভিমানের সৎ মা আর মানালী ওর সৎ বোন | অভিমান অবশ্য কখনোই আমাদের সে চোখে দেখেনা | সে আমাকে ও মানালীকে খুবই ভালোবাসে | যাহোক যা বলছিলাম | সেই থেকে একটানা চার মাস ও ওর বাবার জন্য ছুটাছুটি করেছে | কিন্তু মানুষটাকে ফিরিয়ে আনতে যেমন পারেনি আমাদেরও পর ভেবে আর ফেলে দিতে পারেনি | এরজন্য ওর সংসার ভেঙ্গেছে তুমি ওকে ভুল বুঝে চলে গেছো |কিন্তু বলতো নিজের বাবার কথা সেই মুহূর্তে তোমাকে ও কেমন করে বলতো ? বলেছিলো তো সময়মত সব বলবে | কিন্তু তুমি তো সে সুযোগটাই ওকে দিলেনা |
শ্রেষ্ঠার চোখের থেকে জল পড়ছে দেখে বললেন ,
--- চোখের জল না ফেলে একবার আমার ছেলেটার বুকে কান পেতে শোনো সেখানে একটা স্পন্দনই পাবে শুধু ' শ্রেষ্ঠা'| পারবেনা একটিবারের জন্য মাথা নিচু করে তার কাছে যেতে?সেতো দুহাত বাড়িয়েই আছে একবার শুধু ঝাঁপিয়ে পড়ো | সব মান-অভিমান ভুলে তার কাছে ফিরে এসো | খুব কষ্টে আছে সে |
শ্রেষ্ঠা হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো | পম্পাদেবী বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন , ' দেবতার মত স্বামী তোর তবুও ভুল বুঝলি | একটু তো ধর্য্য ধরতে পারতিস | ছেড়ে যাওয়ার সময় তো পালিয়ে যাচ্ছিলোনা |'
ওই বাড়ি থেকে দুজনে একসাথেই বেরোলো | অনেকক্ষণ দুজনে চুপচাপ পাশাপাশি হেঁটে এগোতে লাগলো | অভিমানই প্রথমে বলে ,
--- তোমায় একটা ক্যাব বুক করে দি
--- হ্যাঁ তা করো কিন্তু তুমিও আমার সাথে যাবে |
--- মানে ?
--- মানে এই আর কি এতরাতে বাবা একা আমায় ছাড়বেননা |
--- আমি কিছু বুঝতে পারছিনা |
--- কেন বুঝতে পারছো না ?আমি আমার বাড়ি যাবো |
--- কোন বাড়ি ?
--- আমার স্বামীর বাড়ি | এখান থেকে যেতে পারবোনা কারণ মা বাবা চিন্তা করবেন আগে ওখানে যাবো তারপর সেখান থেকেই তোমার সাথে বাড়ি ফিরবো |
রাস্তাটা একটু অন্ধকার ছিল | অভিমান দাঁড়িয়ে পরে শ্রেষ্ঠাকে হাত ধরে টেনে বুকের কাছে নিয়ে বলে
--- সত্যি বলছো ?
--- পারবেনা আমার এই ভুলের জন্য ক্ষমা করে দিতে | সবকিছু যদি আমায় খুলে বলতে তাহলে দুজনকেই এ কটা বছর এতো কষ্ট পেতে হতনা | কেন লুকালে আমার কাছে ?আর তারজন্য আমি তোমায় ভুল বুঝলাম | প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও | কান্নায় ভেঙ্গে পরে শ্রেষ্টা |
--- আর কোনদিন কিচ্ছু তোমার কাছে লুকাবোনা কথা দিচ্ছি | শুধু একটাই অনুরোধ তুমি আমায় এভাবে আর কষ্ট দিওনা | ( চোখদুটি মুছিয়ে দিয়ে বললো ) রাস্তায় এভাবে কান্নাকাটি কোরোনা |
ওরা একটা ক্যাব বুক করে তাতে দুজনে উঠে পড়লো | যে কটা বছর পিছনে ফেলে এসেছে তারজন্য আক্ষেপ না করে সামনের দিনগুলির ভবিৎষত পরিকল্পনায় মশগুল হয়ে ক্যাবের মধ্যে দুজনে একে অপরের হাত শক্ত করে ধরে থাকলো |
No comments:
Post a Comment