Saturday, May 2, 2020

অলক্ষ্যে

অলক্ষ্যে  
     নন্দা  মুখাৰ্জী  রায়  চৌধুরী  

   ছেলেবেলার  থেকেই  ঝিলিক  আর  আয়ুস  খুব  ভালো  বন্ধু | দুজনেরই  বাড়ি  বলতে  গেলে  একদম  পাশাপাশি | দুই  বাড়ির  সাথেও  খুব  ভালো  সম্পর্ক | আয়ুসদের তুলনায়  ঝিলিকেরা আর্থিক  দিক  থেকে  একটু  খাটো | আয়ুসের বাবা  একজন  বড় ব্যবসায়ী   | বিশাল  বাড়ি  , গাড়ি  নিত্যনূতন  জামাকাপড়  আর  আসবাবপত্রের  ছড়াছড়ি | আর  এদিকে  ঝিলিকের  বাবা  একজন  কলকাতা  মিউনিসিপ্যালিটির  সামান্য  ক্লাক | কিন্তু  অর্থের  ভেদাভেদ  দুটি  পরিবারের  মধ্যে  বন্ধুত্বের  সম্পর্কের  কোন  প্রভাব  ফেলতে  পারেনি | 
  ঝিলিক  এবং  আয়ুস  ছোট  থেকেই  একই  স্কুল থেকে  উচচমাধ্যমিক  পাশ  করে  উচচশিক্ষার্থে  দুজন  দুদিকে  ছিটকে  যায় | আয়ুস  জয়েন্টে  চান্স  পেয়ে  চলে  যায়  ডাক্তারী পড়তে ব্যাঙ্গালোর   আর  ঝিলিক  ইংলিশে  অনার্স  নিয়ে  নিজের  বাড়ি  থেকেই  কলেজে  যাতায়াত  করতে  থাকে | ফোনে  রোজই তাদের  দুজনের  কথা  হয়  | এখনো  ঝিলিক  আয়ুসদের বাড়িতে  যায়  তার  বাবা  মায়ের  সাথে  গল্পগুজব  করে  আসে | 
 একদিন  আয়ুস  অনেক  রাতে  ফোন  করে  ঝিলিককে  
--- ভীষণ  মনে  পড়ছে  তোর  কথা | তুই  কি  করছিস  এখন ?
--- কি  আর  করবো? ঘুম  আসছেনা  শুয়ে  শুয়ে  তোর  কথাই ভাবছি | তুই  বললি বলে  আমি  স্বীকার  করলাম  নাহলে  তো  তোর  যা  মুখ ,হয়তো  বলে  বসতিস আমি  তোর  প্রেমে  পড়েছি  |
 আয়ুস  হাসতে হাসতে বললো ,
--- প্রশ্নটা  আমাকেও  ভাবাচ্ছে -- আমি  কি  সত্যিই  তোর  প্রেমে  পড়েছি  ?
---   তোর  মাথাটা  একদম  গেছে | শুধু  উল্টোপাল্টা  কথা  ভাবছিস  | ফোন  রাখ  এখন  ঘুমা |
--- আচ্ছা  মনে  কর  আমি  যদি  তোর  প্রেমে  পড়ি  তাহলে  তুই  কি  আমায়  বিয়ে  করবি  ?
--- তোকে? আমি  বিয়ে  করবো?তুই  যা  ঝগড়াটে  সারাটাজীবন  আমার  সাথে  ঝগড়া  করে  কাটাবি  |
--- আচ্ছা  - প্রেমে  পড়লে  মানুষের  ফিলিংসটা  কেমন  হয়  ?
--- আগে  আমি  প্রেমে  পড়ি  কারও তারপর  নাহয়  জানাবো  --- 
  ফোনটা কেটে  দেয় ঝিলিক | কিন্তু  তারও  আয়ুস  পড়তে  যাওয়ার  থেকেই  ওর  জন্য  মনটা  খুব  খারাপ  থাকে | তাইতো  মাঝেমধ্যে  ওদের  বাড়িতে  গিয়ে  আয়ুসের ঘরে  ঢুকে  আয়ুসের জিনিসপত্র  নিয়ে  নাড়াচাড়া  করতে  ভালোবাসে  | আয়ুসের ঘরে  ঢুকলেই  ওর  মনটা  কিছুটা  সময়  হলেও  ভালো  হয়ে  যায় | এসব  নিয়ে  সেভাবে  তো  ঝিলিক  কোনদিনও  ভাবেনি | আজ  আয়ুসের বলা  কথাগুলো  তাকে  খুব  ভাবাচ্ছে | 
  পাঁচ  বছরে  পাঁচবার  আয়ুস  বাড়িতে  এসেছে শুধুমাত্র | তাও বেশিদিনের  জন্য  নয়  |আসলে  পড়াশুনা  হবেনা  -- তাই  বাবার  কড়া হুকুম  পাশ  করে  তো  বাড়িতেই  ফিরে  আসবে  তাই  এখন  ওখানে  পড়াশুনাটাই মন  দিয়ে  করো | 
  কথা  প্রতিরাতেই  দুজনের  হয়  কিন্তু  গল্পের  থেকে  ঝগড়াতেই  সময়  কাটে  ওদের | ঝিলিকের  পড়াশুনাও  শেষ | নানান  জায়গায়  চাকরির  পরীক্ষা  দিয়েই  চলেছে | হঠাৎ  করেই  এক  আত্মীয়ের  বিয়েতে  ব্যাঙ্ক  ম্যানেজারের  মায়ের  খুব  পছন্দ  হয়ে  গেলো  তাকে | তারা  ছেলেকে  নিয়ে  ঝিলিকদের  বাড়িতে  আসবেন  কথা  দিলেন | রাতে  সবকথা  ঝিলিক  আয়ুসকে  ফোনে জানালো | প্রথম  প্রথম  আয়ুস  ঝিলিকের  বিয়ে  নিয়ে  বেশ  মজা  করতো | কিন্তু ঝিলিককে  দেখতে  আসার দিন  যত এগিয়ে  আসতে থাকলো  আয়ুসও কেমন  থম  মেরে  যেতে  লাগলো  | 
 --- কি  রে  আমার  বিয়ে  হবে  শুনে  মনেহচ্ছে  তুই  মোটেই  খুশি  হোসনি  ?
--- তুই  খুশি ?
 না  কোন  উত্তর  ঝিলিক  সেদিন  আয়ুসকে  দেয়নি | শুধু  ফোনটা কেটে  দিয়েছিলো |
 ঝিলিককে  দেখে  ওরা পছন্দ  করে  গেলো | এবার  ঝিলিকের  বাবা , মাকে  তাদের  বাড়িতে  যাওয়ার  আমন্ত্রণ  জানিয়ে  গেলেন | 
   পাঁচদিন  ছুটি  থাকায়  হুট করে  আয়ুস  এসে  উপস্থিত  হয় | কাউকে  খবর  না  দিয়েই  সে  আসে  | ঝিলিক  জানতে  পেরেই  আয়ুসের কাছে  ছোটে | সেদিন  আয়ুসদের বাড়িতে  কেউ  ছিলোনা | চাবি  ছিল  ঝিলিকদের  বাড়ি | এটা দুইবাড়ির  বরাবরের  নিয়ম | কিন্তু  আয়ুসকে  দেখে  ঝিলিক  চমকে  ওঠে |
--- এই  কি  হয়েছে তোর ?এরকম  লাগছে  কেন  ?
 আয়ুস  নির্লিপ্তের  মত  জবাব  দিলো ,
--- কিছুই  হয়নি  , দুদিন  ট্রেনে  জার্নি  করেছি  তাই  এমন  লাগছে  | আয় ভিতরে  আয় |
--- না  তুই  ফ্রেস  হয়ে  নে আমি  তোর  জন্য  কিছু  খাবার  নিয়ে  আসি  |
 আয়ুস  ওর  একটা  হাত  ধরে  টেনে  নিয়ে  ঘরে  যেতে  যেতে  বললো ,
--- আমি  এতো  দূর  থেকে  খাবার  খেতে  আসিনি  তোর  সাথে  আমার  কথা  আছে  |
--- তোর  কি  হয়েছে? তুই  এরকম  করছিস  কেন ? 
 আয়ুস  ততক্ষণে ঝিলিককে  দুহাতে  নিজের  বুকের  কাছে  টেনে  নিয়েছে  |
--- আমি  তোকে  ভালোবাসি  ঝিলিক , ভালোবাসি  , ভীষণ  ভালোবাসি  | তুই  শুধু  আমার | তোর  অন্য কোথাও  বিয়ে  হতে  পারেনা  | 
--- তুই  কি  বলছিস  এসব  ?
--- তুইও  আমায়  ভালোবাসিস আমি  জানি  | কিন্তু  তুই  বুঝতে  পারছিসনা বা  মুখ  ফুটে  বলতে  পারছিস  না  আর  তার  প্রমাণটা  আমি  এখনি  দেবো |
 আয়ুস  আস্তে  আস্তে  ঝিলিকের  মুখটা  তুলে  নিজের  মুখটা  তার  দিকে  এগিয়ে  নিয়ে  যায় | ঝিলিক  চোখ  বুজে  আয়ুসের তপ্ত  নিশ্বাস  অনুভব  করে | নিজের  ঠোঁট  দুটি  দিয়ে  ঝিলিকের  ঠোঁট  দুটি  স্পর্শ  করে | ঝিলিক  তখন  ঠকঠক  করে  কাঁপছে | আয়ুস  তাকে  বাহুবন্ধন  থেকে  মুক্ত  করে  বলে ,
--- তুইও  যে  আমায়  ভালোবাসিস  এটাই  তার  প্রমাণ | যদি  আমায়  তুই  ভালো  না  বাসতিস তুই  আমাকে  বাধা  দিতিস  | কিন্তু  তা  তুই  দিতে  পারিসনি  | চোখ  বুজে  আমার  আদর  খেয়েছিস  ---| ভালোবাসি  তোকে  আমি  আর  তুই  ও  আমাকে  ---|
 আবারও এগিয়ে  গিয়ে  ঝিলিককে  কাছে  টেনে  নিয়ে  বলে ,
--- তোকে  ভালোবাসি  বুঝতে  অনেক  দেরি  হয়ে  গেছে | তাই  তো  ছুটতে  ছুটতে  চলে  এলাম  তোকে  কাছ  থেকে  কথাটা  বলবো  বলে | আর  দেরি  করলে  আমি  তোকে  হারিয়ে  ফেলতাম | তুই  কিচ্ছু   ভাবিসনা | তোকে  এ  বাড়ির  বৌ  করতে  কেউ  আপত্তি  করবেনা | মাকে  আমি  আজ  সব  বলবো  | 
  --- ঝিলিক  চুপচাপ  আয়ুসের কথাগুলো  শুনছিলো | হঠাৎ  দুইহাতে  আয়ুসকে  জড়িয়ে  ধরে  বললো ,
--- এবার  বুঝতে  পারছিস  তো  প্রেমে  পড়লে  ফিলিংসটা  কি  হয়  ?
--- দূর  পাগলী  আমি  তো  আগেই  বুঝেছি | বরং  তুইই  বুঝতে  পারিসনি |
--- অনেক  আগেই  পেরেছিলাম  রে | কিন্তু  তুই  যে  আমায়  ভীষণ  খ্যাপাস | আমি  তো  এই  বিয়েতে  রাজি  হয়েছিলাম  কারণ  আমার  দৃঢ়  ধারণা ছিল  তুই  কিছুতেই  এ  বিয়ে  হতে  দিবিনা  | তাই  তো  তোকে  রোজ  রাতে  ফোন  করে  বাড়িয়ে  বাড়িয়ে  আমার  বিয়ের  কথা  জানাতাম | কথাগুলো  শুনে  তোর  যে  রাগ  হত সেটাও  বুঝতাম | কষ্ট  হত আমার  কিন্তু  মনেমনে  খুব  হাসতাম  |
 আয়ুস  ঝিলিকের  কোমরটা  ধরে  এক  ঝটকায়  তাকে  আরো  কাছে  টেনে  নেয়  |
--- তবে  রে  তলে  তলে  এতো দুষ্ঠু  বুদ্ধি  তোর --- আর  আমার  পাগলের  মত  অবস্থা  ---
 ঝিলিক  আয়ুসের চুলগুলি  কপালের  উপর  থেকে  সরিয়ে  দিয়ে  বললো ,
--- আমার  সাথে  ঝগড়া  করবি  না  তো  আর  ---?
 আয়ুস  হাসতে হাসতে বললো ,
--- ভালোবাসা  যেখানে  ঝগড়াও  সেখানে | সারাজীবন  তোকে  ভালোবাসবো  আর  ঝগড়া  করবো | এবার  তো  আমায়  কিছু  খেতে  দে  -- খুব  খিদে  পেয়েছে---| তোকে  কথাগুলো  বলতে  পেরে  কতদিন  পরে  বুক  ভরে  নিঃশ্বাস নিলাম  |
  না, কোন  বাড়ির  থেকেই  কোন  আপত্তি  ওঠেনি  ওদের  বিয়েতে | আয়ুসের ডাক্তারী পড়া  শেষ  হয়ে  যাওয়ার  পর  চার  হাত  তারা  এক  করে  দিয়েছিলেন |

No comments:

Post a Comment