ইচ্ছাই শক্তি
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
শেষ পর্যন্ত অনিন্দিতাকে ঘর ছাড়তেই হল তার এই অবস্থায় | অনেক চেষ্টা করেছে মানিয়ে নেওয়ার | বৌভাতের পরদিন থেকেই স্বামী,শ্বাশুড়ি আর মাসতুত বিধবা ননদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে সকলের সামনে থেকেই পিঠে গলায় সিগারেটের ছ্যাঁকা নিয়ে খুব ভোরেই প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস আর ভায়ের দেওয়া সামান্য গয়না নিয়ে বেরিয়ে পরে বিয়ের দেড় বছরের মাথায় |
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অনিন্দিতা | ছিল দুই ভাইবোনের সংসার | ভায়ের জম্মের পরেই মা মারা যান | বাবা ছোট একটা বেকারিতে সামান্য মাইনের চাকরি করতেন | কিন্তু খুব কষ্ট করে দুটি ছেলেমেয়েকেই লেখাপড়া শেখাচ্ছিলেন | হঠাৎ একদিন তিনিও চলে গেলেন | অনিন্দিতা তখন সবে টেন আর ভাই আনন্দ এইট | নিজের পড়া বন্ধ করে ভাইকে গ্রাজুয়েট করে অতি কষ্টে | একটা সেলাইয়ের দোকানে সামান্য মজুরিতে যা পেতো তাই দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দুই ভাইবোনের কোনরকমে দিন গুজরান | মাধ্যমিক পাশ করার পর কেজি থেকে আনন্দ বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করে | সেই থেকে সে টিউশনিটাকেই পেশা হিসাবে নিয়েছে | কয়েক বছরের মধ্যেই প্রাইভেট টিউটর হিসাবে তার বেশ নামডাক হয় | এখন সে ভালো টাকাই রোজগার করে|
শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে অনিন্দিতা সোজা চলে আসে তার ভায়ের কাছ | তার অত্যাচারের কাহিনী সব খুলে বলে তাকে | ভাই তাকে রাগারাগি করতে থাকে কেন আরও অনেক আগে সেখান থেকে সে চলে আসেনি | শুরু হয় আবার ভাইবোনের সংসার | একদিন রান্না করতে করতে অনিন্দিতা বমি করতে শুরু করে | আনন্দ খুব ভয় পেয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে সে ভাইকে জানায় ' এখন এটা মাঝে মাঝে হবে রে --- তুই যে মামা হবি |' খুশিতে আত্মহারা আনন্দ দিদির সামনেই নাচতে শুরু করে |
এর ঠিক কয়েকদিন পরে অনিন্দিতা নিজের সামান্য যা গয়না ছিল ভাইকে সেগুলি দিয়ে তার জন্য একটি হাত সেলাইমেশিন কিনে আনতে বলে | কিছুতেই আনন্দ রাজি হতে চায়না | কিন্তু অনিন্দিতা তাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করায় | শুরু হয় অনিন্দিতার জীবনে এক নূতন অধ্যায় | সেলাইয়ের দোকানে বিয়ের আগে কাজ করতে করতে সে কাটিংটাও শিখে নিয়েছিল | কিছুটা পরিচিতিও ছিল ভালো সেলাই জানে বলে | সেই পরিচয়টুকু সম্বল করে প্রতিবেশীদের কাজ থেকে ছোটখাট অর্ডার পেতে থাকে | তিনমাসের অন্তঃস্বত্বা অবস্থায় সে শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছিলো | দেখতে দেখতে বাকি দিনগুলিও কেটে যায় | সুন্দর ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের মা হয় | ভায়ের নিষেধ স্বর্তেও একমাস পরেই সে আবার সেলাই নিয়ে বসে | এবার সে উঠেপড়ে লাগে ভায়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য | কিন্তু আনন্দকে রাজি করাতে সে হিমশিম খায় |
আনন্দর বিয়ের ঠিক পনেরদিন পরে তার শত অনুনয়বিনয় অগ্রাহ্য করে সে তার সাতমাসের ছোট্ট অন্যাকে নিয়ে একটি ঘর ভাড়া করে চলে আসে | এতদিন তার কোন উপায় ছিলোনা | কিন্তু এখন সেলাই করে সে যা রোজগার করে তা দিয়ে সে ঘরভাড়া ও দুবেলা দুমুঠো জোগাড় করতে পারবে | আর তা ছাড়া ভায়ের সংসারে থাকলে ভাইবৌ সেটা ভালো চোখে নেবেনা |
পুরনো কোনকিছু নিয়ে সে আফসোস করেনা | প্রত্যেকটা মানুষ তার ভাগ্য নিয়ে জন্মায় | তার ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে | তার মেয়ের দায়িত্ব পৃথিবীতে একমাত্র তার | মেয়েকে সে মানুষের মত মানুষ করবে এটাই একমাত্র তার এখন ধ্যানজ্ঞান |
বাড়ি থেকে একটু দূরে রাস্তার উপর সে ছোট্ট একটা দোকান নিয়েছে | দুটি ভালো সেলাই মেশিনও কিনেছে | মেয়ে যখন খুব ছোট ছিল তখন থেকেই তাকে নিয়ে সে দোকানে যেত | প্রথম প্রথম সাথে যেত খেলনা তারপর বইপত্তর | কিন্তু এখন মেয়ে কলেজে পড়ছে | সে নিজেই নিজেকে সামলে নিতে পারে |
পুজোর সময় কাজের ভীষণ চাপ থাকে | মেয়ে মাঝে মধ্যে দোকানে আসলে অনিন্দিতা খুব রাগারাগি করে | তার বক্তব্য আগে পড়াশুনা শেষ কর পরে দোকানে আসবি | সবসময় মায়ের কথা তার পক্ষে শোনা সম্ভব হয়না | বাড়িতেও মাকে রান্না থেকে শুরু করে সেলাই কাটিংএ সাহায্য করে | নার্সিং ট্রেনিং এ মেয়েকে ভর্তি করে পড়াশুনা শেষে | অনিন্দিতার দোকানের দৌলতে আজ আর তাদের কোন অভাব নেই | আনন্দ আজও মাঝেমধ্যে এসে দিদি আর বোনঝির খবর নিয়ে যায় | সেও এখন দুই সন্তানের পিতা |
অনিন্দিতা সপ্তাহে একটা করে কর্মক্ষেত্র কিনে এনে মেয়েকে দেয় যেসব জায়গায় অন্যার শিক্ষাগত যোগ্যতায় চাকরির দরখস্ত করা সম্ভব তা করতে বলে |
--- দেখ মা প্রত্যেকটা মেয়ের উচিত যেভাবেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসা | মানুষের জীবনে ভবিৎষতে কি অপেক্ষা করে আছে আমরা কেউই আগে থাকতে জানতে পারিনা | যেকোন পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষ খাপ খাওয়াতে পারে তার যদি পায়ের তলার মাটিটা শক্ত হয় | আমি চাই আগে তুই একটা যেকোন চাকরি পা তারপর তোকে একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেবো |
--- আচ্ছা মা আমি একটা কথা কিছুতেই মাথায় আনতে পারিনা -- একটা মেয়ে যদি তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে অথাৎ তার ভরণপোষণ নিজেরটা নিজেই চালাতে পারে তবে তাকে বিয়ে করতেই হবে কেন ?
--- এখানেও একটা কথা আছে মা , আমাদের সমাজে এই মধ্যবিত্ত পরিবারে এখনো একটা মেয়ে তার নিজের ইচ্ছামত থাকতে পারেনা | নানান বিপদাপদের সম্মুখীন হতে হয় | সমাজের চারিপাশে হায়েনার দল সবসময় ঘুরছে | সেক্ষেত্রে তার দরকার একজন পুরুষসঙ্গীর | তবে পুরুষ সঙ্গীটিকেও হতে হবে সমাজস্বীকৃত অথাৎ দাঁড়াচ্ছে সেই বিয়ে | তবে সঙ্গীটি যে সবসময় তাকে রক্ষা করতে পারবে তা কিন্তু নয় | অনেকসময় দেখা যায় সে নিজেই হয়ে ওঠে অত্যাচারী | কিন্তু মেয়েটি যদি স্বাবলম্বী হয় এবং তার মনের যদি জোর থাকে তাহলে সে কিন্তু নূতন পথের দিশা খুঁজে নিতে পারে |
কয়েক বছর পর ---
এখন অনিন্দিতার মেয়ে অন্যা একটি বেসরকারি হাসপাতালের নার্স | শ্বশুরবাড়ির পাড়ার এক পরিচিতার সাথে মাঝে দেখা হয়েছিল তার কাছ থেকেই জেনেছে সে চলে আসার ছমাসের মধ্যে বিধবা মাসতুত ননদকে তার স্বামী বিয়ে করেছিল | শ্বাশুড়ি নিজে দাঁড়িয়ে সেই বিয়ে দিয়েছিলেন | বছর দুয়েক পরে তিনি মারা যান | কোন সন্তানাদি হয়নি | তার স্বামী এখন বদ্ধমাতাল | বাড়িতে সবসময় চিৎকারচেচাঁমেচি লেগেই আছে | যে কটাদিন সে স্বামীর সংসারে ছিল কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবেনি তার স্বামীর সাথে মাসতুত ননদের কোন সম্পর্ক আছে | ঘটনা শোনার পর তার কাছে জলের মত সব পরিষ্কার হয়ে গেলো কেন তার প্রতি অকারণ এতো অত্যাচার করা হত |
মেয়ে এখন তার ভালোই টাকা রোজগার করে | আর তার রোজগারও কম নয় | এখন অনিন্দিতা ভীষণ খুশি | যে পরিস্থিতিতে সে তার শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করেছিল সেখান থেকে অতি কষ্টে হলেও এখন সে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছে | নিজের মেয়েকে একাই মানুষের মত মানুষ তৈরী করতে পেরেছে কারও সাহায্য ছাড়াই | ইচ্ছা, মনোবল আর শক্তি থাকলে মানুষের জীবনের যেকোন দুর্গম পথ অতিক্রম করা সম্ভব অনিন্দিতা তার জীবনে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে |