আর নয় ষষ্ঠী
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
সকালবেলা মাকে রান্নাঘরে অনেকবার চোখ মুছতে দেখেছে লিপি।বাবা সকাল থেকে পেপার মুখে গুম হয়ে বসে।আজ বাবা জলখাবারও খাননি।রান্নাঘরে সকালের দিকে টুকটাক সাহায্য করেছে লিপি তার মাকে।ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা।কিন্তু চেষ্টা করলেই কি ভুলে থাকা যায়।এই চার বছরে একমুহূর্তের জন্যও কি লিপি ভুলতে পেরেছে সেই দিনটির কথা?
চার বছর বাদে লিপিদের বাড়িতে আবার জামাইষষ্ঠী হচ্ছে।আজও ঠিক সেই চার বছর আগের দিনটির মত আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন।কিছুক্ষণের মধ্যেই নামবে মুষলধারে বৃষ্টি।সেদিনের সেই ঘটনার পর এ বাড়িতে আর জামাইষষ্ঠী হয়নি।বড়দি জানিয়েই দিয়েছে সে আর ষষ্ঠীতে আসবেনা।লিপিকা মেজ । আর ছোট লতিকা। চারমাস আগে বিয়ে হয়েছে সকলের আদরের ছোটবোন লতিকা ওরফে লতির।লতি বলেছিলো,'মা জামাইষষ্ঠী যখন উঠিয়ে দিয়েছো নূতন করে আর শুরু করতে হবেনা।মা ও রাজি ছিলেন।কিন্তু বাধ সাদলো লিপি।সে মাকে বললো,
---তা কি করে হয়?নূতন জামাই।তার কথা নাহয় বাদ ই দিলাম। ওদের বাড়ি থেকেই বা কি ভাববে?না মা তুমি এবার থেকে পূণরায় জামাইষষ্ঠী চালু কর। মায়ের অমত থাকলেও লিপিকার জেদের কাছে তাকে হার মানতেই হোল।
চার বছর আগে এমনই এক ষষ্ঠীর দিনে লিপিকা ও রাহুল মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে বাইক নিয়ে ষষ্ঠী নিতে হাজির।কাকভেজা ভিজে যখন দুজনে এসে ঘরে ঢোকে লিপিকার মা চিৎকার করতে থাকেন লিপি ও রাহুলের জামাকাপড় পাল্টানোর জন্য।কিন্তু দুজনের যেন কোন হেলদোল নেই।দুজনেই ওই ভিজে চপচপে জামাকাপড় পরে মেঝেতেই বসে চা খেতে শুরু করে।লিপির মা এসে জোর তাগাদা দেন পোশাক পাল্টে নেওয়ার জন্য।তখন রাহুল মাকে বলে,
--মা,বৃষ্টির মধ্যে ছাদে উঠে কটা ছবি তুলেই জামাকাপড় পাল্টে নেবো।
--কিন্তু বাবা পুরনো বাড়ি।দুদিন ধরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে।ছাদের গাঁথুনীর নানান জায়গায় ফাটল।তোমরা বরং ছবি তুলতে হলে উঠোনে গিয়ে তোলো।
রাহুল হেসে বলে ওঠে,
--মা আমরা বাচ্চা নয়।ঠিক নিজেদের সামলে নিতে পারবো।আপনি একটুও ভাববেন না।মিনিট পনের মধ্যে আমরা নেমে আসছি।
বৃষ্টিতে ভিজে ছবি তুলতে দুজনেই ছাদে চলে গেলো।তারা একটার পর একটা ছবি তুলেই চলেছে।ক্যামেরা যাতে না ভেজে যখন যে ছবি তুলছে তখন তার মাথায় ছাতাটা থাকছে।রাহুলের হাতে ক্যামেরা আর মাথায় ছাতা।লিপিকে পোজ দিতে বলে পিছন হাঁটছে।লিপি দু দুবার সাবধানে করেছে।সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের উত্তর এসেছে
---আরে বাবা আমার তো বোধবুদ্ধি আছে না কি?তুমি একটু এ্যানগেলে দাঁড়াও....হ্যাঁ তোমার সামনের দিকে তাকাও ...আরে হাঁটার মত করে পজিশনটা দা....আ ..আ ...আ ...
লিপি পিছন ঘুরেই দেখে ছাদের প্যারাপিট দেওয়ালের একাংশ ভেঙ্গে রাহুল নীচে পড়ে .....চারিদিকে রক্তে ভিজে যাচ্ছে ...দৌড়ে নিচুতে চিৎকার করতে করতে নেমে আসে ....হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ।
জামাইষষ্ঠীর আসন পাতা।সামনে উপকরণ সুন্দর করে সাজানো ...প্রদীপটা সকলের অলক্ষ্যে কখন যেন নিভে গেছে ....শববাহী গাড়ি হাজির...শ্বশুরবাড়ি থেকে পূণরায় চন্দনের ফোঁটা আর গলায় রজনীগন্ধার মালা পরে রাহুল রওনা দিলো চিরদিনের মত।সারা পৃথিবীতে রাহুল ছিলো একাই।তার কোন আত্মীয়স্বজন ছিলোনা।ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো অফিস কলিগ লিপিকাকে।যেখান থেকে সে জীবনের নূতন ইনিংস শুরু করেছিলো আজ সেখান থেকেই তার জীবনের শেষ ইনিংসটা খেলে গেলো।
তারপর এ বাড়িতে আর ষষ্ঠী হয়নি।দিদি সেই থেকে ষষ্ঠীতে আসা বন্ধ করেছে। আজও আসেনি।ভীষন জোরে বৃষ্টি শুরু হল।বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই লতি ও বিভাস এসে পৌঁছেছে।মা এবার ওদের ষষ্ঠী দেবেন।লিপি সকলের অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে ছাদে উঠে গেলো।না,সে নিজের ইচ্ছাতে আসেনি।কেউ যেন তাকে ঠেলে নিয়ে এসেছে।ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।লিপি ছাদে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়ানো।কোনদিকে তার যেন কোন খেয়াল নেই।নিজ মনেই ভিজে চলেছে।হঠাৎ একটি আলোর ঝলকানিতে সামনে তাকিয়ে দেখে ....'কে কে ও ...হ্যাঁ হ্যাঁ রাহুল তো ...ওই তো সেই হাতে ক্যামেরা ...লাল টি শার্ট আর কালো জিন্স পরা ...হাসছে খুব হাসছে ...একি এতো রক্ত কেন ছাদে ...এতো রক্ত কোথা দিয়ে আসলো ...রাহুল ...কোথায় গেলো ..রা ...হু...ল।
যখন লিপির জ্ঞান ফিরলো তখন বাড়ির সকলে তাকে ঘিরে আছে।মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
--এই বাড়িতে আজ থেকে আর কখনো জামাইষষ্ঠী হবেনা।
No comments:
Post a Comment