Friday, July 12, 2019

এক অচেনার সঙ্গে পাড়ি

এক অচেনার সঙ্গে পাড়ি
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

    বাবা,মা আদর করে নাম রেখেছিলেন শ্যামলী।না গায়ের রং তার শ্যামলা ছিলোনা।সে ছিলো কালো কুচকুচে।তার এই গায়ের রংএর জন্য স্কুল,কলেজে কম কথা শুনতে হয়নি।বন্ধু বলতে ঠিক যা বোঝায় কোনদিনও শ্যামলীর সে অর্থে কেউ ছিলোনা।কোমর অবধি ঘন কালো চুল,পড়াশুনায় তুখোড়।প্রতি ক্লাসেই প্রথম হয়ে ওঠাটা কেউ আটকাতে পারেনি।শিক্ষক,শিক্ষিকাদের প্রিয় ছাত্রী হলেও ক্লাসমেটদের কাছে এই ব্যপারটা খুব হিংসানীয় ছিলো।যদি কখনো সে ক্লাসে না আসতে পারার কারনে  নোটস এর ব্যপারে কোন ক্লাসমেটের কাছে সাহায্য চেয়েছে কেউই তাকে কোনদিন  সাহায্য করেনি।শ্যামলী কিন্তু যখন যে পড়াশুনার ব্যপারে সাহায্য চেয়েছে তাকে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
  গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগে থেকেই চাকরীর চেষ্টা চালিয়ে গেছে।পরবর্তীতে সে ব্যাঙ্কে কেরানীর একটি চাকরী জুটিয়েও নেয়।কারন সে জানতো তার যে গায়ের রং কোনদিনও কোন ছেলে তাকে পছন্দ করবেনা।জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে চাকরী একটি তাকে জোগাড় করতেই হবে।তার পরিশ্রমের ফলও সে পায়।প্রথম প্রথম বাবা,মায়ের জন্য তাকে ছেলে পক্ষর সামনে বসতে হয়েছে।কিন্তু প্রত্যেকেরই সেই এক কথা,'পড়ে খবর দেবো'- খবর আর কেউ কোনদিন দেয়না।এখন সে পরিষ্কার বাবা,  মাকে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে সে করবেনা।
  অফিস আর বাড়ি।অবসর সময়ে মাকে কাজে সাহায্য করা আর গল্পের বই পড়া।বেশ কেটে যাচ্ছে দিনগুলি।একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে শ্যামলী দেখে এক ভদ্রলোক রাস্তার উপর পড়ে গিয়ে খুব হাপাচ্ছে।পথচারীরা একটু উঁকি দিয়ে দেখেই যে যার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।শ্যামলী কিছু মানুষের সাহায্যে একটি ট্যক্সি ডেকে ভদ্রলোককে নিয়ে হাসপাতাল আসে।ভদ্রলোকের কাছ থেকে ফোন নিয়ে তার বাড়ির কন্টাক্ট জেনে বাড়িতে খবর দেয়।কিছুক্ষণের মধ্যে ভদ্রলোকের বোন-ভগ্নিপতি এসে উপস্থিত হন।সে বাড়িতে চলে আসে।
  পরদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সে ওই ভদ্রলোককে দেখতে যায়। ততক্ষণে তার বোন সেখানে পৌঁছে গেছে দাদার কাছে।ভদ্রলোকের বেডের কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চায়,'কেমন আছেন আজ?'
   ভদ্রলোকের বোনের কাছ থেকেই জানতে পারে হঠাৎ করেই  বুকে একটা ব্যথা অনুভূত হয় আর সাথে সাথে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় রাস্তা উপর তিনি বসে পড়েন।থাকেন আসানসোল।বোন শ্রেয়ার বাড়ি কলকাতা।সেখানেই এসেছিলেন।কিছু ব্যক্তিগত কাজে বেরিয়ে হঠাৎ এই বিপত্তি।শ্রেয়ার সাথে ব্যক্তিগত আলাপে জানতে পারে শ্যামলী তার দাদার বয়স বিয়াল্লিশ বছর।এখনও বিয়ে করেনি।মাকে নিয়ে আসানসোলেই থাকে।বিয়ে করতে চায়না যদি বৌ এসে মাকে না দেখে।ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মা অনেক কষ্ট করে দুই ভাই, বোনকে মানুষ করেছেন।বাবা একটা সাধারণ প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করতেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বাবা মারা যান।তখন দাদার বয়স সাত আর আমার পাঁচ।মা সারাদিন ধরে কয়েকটা বাড়িতে রান্না করতেন। এইভাবেই দিন চলতো তাদের । এখন দাদা আসানসোলে একটা স্কুলের হেড মাষ্টার।
  শ্যামলী ভাবে এতো স্বল্প পরিচয়ে শ্রেয়া কি অবলীলায় তার পরিবারিক গল্প বলে চলেছে তার সাথে।খুব ভালো লাগে শ্রেয়াকে তার।ভিজিটিং আওয়াজ শেষ হওয়ার পর প্রায় ঘন্টা দুয়েক দুজনে বসে গল্প করে চা কিছু টিফিন করে দুজন দুজনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
  শ্রেয়ার দাদা শতদলও সুস্থ্য হয়ে বোনের বাড়ি ফিরে যায়।শ্যামলী রোজই নিয়ম করে সন্ধ্যায় শ্রেয়ার কাছে ফোন করে তার দাদার খবর নিয়েছে।আর রোজ অনেক রাতে ফোন করে দুজনে গল্প করে সেই থেকে।খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় পরস্পরের সাথে।
  শতদল আসানসোল ফিরে যায়।দিন গড়িয়ে যেতে থাকে।শ্রেয়া ও শ্যামলী পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে।উভয়ে উভয়ের বাড়িতেও এসেছে।খুব মিশুকে মেয়ে শ্রেয়া।খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নেয়।একদিন অফিস ছুটির দিনে শ্যামলী দুপুরে খেয়েদেয়ে সবে একটু বিশ্রাম নেওয়ার তোড়জোড় করছে হঠাৎ শ্রেয়ার ফোন,
---তুমি বাড়িতে আছো?
--হ্যাঁ কেন বলো তো ?
--আমি আসছি এসে সামনাসামনি সব বলবো।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে শ্রেয়া ও তার স্বামী এসে উপস্থিত।
--ভীষন দরকারী একটা কথা আছে তোমার সাথে।
--হ্যাঁ বলো ---
--না, সকলের সামনে না, আগে তোমার কাছে বলবো তারপর সেরূপ হলে পরে  মাসিমা,মেশোমশাইকে বলবো।চলো তোমার ঘরে চলো।
  শ্যামলী কিছুই বুঝতে পারছেনা।সে শ্রেয়াকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। শ্রেয়া বলতে শুরু করে,
--মায়ের শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালোনা।বলতে গেলে ডক্টর জবাব দিয়েই দিয়েছেন।দাদার এতোবছর বয়সেও আমরা কোনদিন তার বিয়ে দিয়ে উঠতে পারিনি।কিন্তু মায়ের এই মৃত্যুশয্যায় মা দাদার হাত ধরে তার বৌ দেখে যেতে চেয়েছেন।দাদা মাকে না করতে পারেনি।আমার দাদা রাজি হয়েছে।
--বাহ!এতো বেশ ভালো কথা।কিন্তু আমায় এসব বলছো কেন?
--কারন তুমিই পারো এই সমস্যা থেকে আমাদের উদ্ধার করতে---1
--মানে ---?
--আমার দাদা খুব ভালো মানুষ জানো
নিজের দাদা বলে বলছিনা---
--আরে দাঁড়াও দাঁড়াও , আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলো তো কি বলতে চাইছো?
--তোমাকে দাদা বিয়ে করতে চায়---
শ্যামলী শুনেও যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।সুপুরুষ বলতে যা বোঝায় শ্রেয়ার দাদা ঠিক তাই।তিনি বিয়ে করতে চান কিনা ----। আত্মীয়স্বজন মহলে সে তো কালিন্দীর বলেই পরিচিত।
--তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে শ্রেয়া।আমার মত এইরূপ কুৎসিত একটি মেয়েকে---তোমার দাদা কত সুন্দর দেখতে তিনি কেন আমায় বিয়ে করতে ....
শ্যামলীর কথা শেষ হয়না শ্রেয়া বলে ওঠে,
--দাদা নিজে মুখে ফোনে কাল আমায় একথা বলেছে।প্লিজ তুমি রাজি হয়ে যাও --।
--তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে শ্রেয়া।
--কিচ্ছু ভুল হচ্ছেনা।জানো দাদা কাল ফোনে আমায় বলেছে মানুষের মনটাই হচ্ছে আসল।চেহারা সেখানে গৌণ।চেহারা বাহ্যিক মনকে আকৃষ্ট করে ঠিকই কিন্তু সংসার করতে গেলে দরকার একটি সুন্দর মনের।আর শ্যামলীর সেটা আছে।এই বয়সে এসে বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে শ্যামলীর মত একটি সুন্দর মনের মানুষকেই বিয়ে করবো।
   বিয়ে হয়ে গেলো শ্যামলী ও শতদলের।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শ্যামলী আসানসোল বদলী হয়ে যায়।একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের হাত ধরে সাঁইত্রিশ বছর বয়সে শ্যামলী তার নূতন জীবনে দুরুদুরু বুক নিয়ে বাড়ি থেকে এতোটা দূরত্বে আসার সময় অনেক আশঙ্কা নিয়েই পা বাড়িয়েছিলো।একমাত্র ভরসা ছিলো শ্রেয়া।কিন্তু নূতন জীবনে প্রবেশ করে শতদলের মত স্বামী পেয়ে অনেক সময় খুশীতেই তার দু'চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নির্গত হয়েছে।একদিন শতদল দেখতে পেয়ে জানতে চেয়েছিলো,
--কাঁদছ কেন তুমি?আমি কি তোমায় কোন কষ্ট দিয়েছি?
কান্না যেন তখন দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হয়েছে।শতদলকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,
--এতো ভালো কেন তুমি?আমি তো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমার বিয়ে হবে।আর এমন দেবতার মত স্বামী পাবো।আমার গায়ের রং নিয়ে ছেলেবেলা থেকে নানান কটূক্তি শুনতে শুনতে জীবনের সাঁইত্রিশটা বছর পার করেছি।বাবা মা ছাড়া অন্তর থেকে কেউ কোনদিন ভালোবাসেনি এটা আমি সবসময় বুঝতাম।
--তারা তোমার বাহ্যিক রূপটা দেখেছে।মানুষের অন্তরটা দেখতে গেলে ঠিক তার মতই আর একটি মন চায়।আমি প্রথমদিনই তোমার অন্তরটা দেখতে পেয়েছিলাম।মা যদি আমার বিয়ের জন্য জিদ না ধরতেন এই বয়সে মনেহয় কলকাতা গিয়ে  তোমাকে প্রেম নিবেদন করতে হত।
বলে শতদল হাসতে থাকে।শ্যামলী আরও নিবিড়ভাবে শতদলকে জড়িয়ে ধরে। 

No comments:

Post a Comment