Monday, July 22, 2019

অদ্ভুত অনুভূতি

অদ্ভুত অনুভূতি
   নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

    স্মৃতির জানলাটা তখনই খুলে যায় যখন নন্দিতা এসে তার ছোট্ট ব্যালকনিটাই বসে।এই জায়গাটা প্রত্যুষেরও খুব প্রিয় ছিলো।অজস্র ছোটবড় ফুলের টবে নানান জাতের ফুলের গন্ধের ভিতর নন্দিতা আজও প্রত্যুষের গায়ের গন্ধ পায়।সকালে দাঁত ব্রাশ করেই প্রত্যুষ পেপারটা নিয়ে এখানেই ঘন্টা দেড় দুয়েকের ব্যবধানে দুকাপ চা শেষ করতো।অফিস থেকে এসেও ফ্রেশ হয়ে সে এখানেই বসতো।সকালের দিকে নন্দিতার সময় পেতোনা।কিন্তু সন্ধ্যায় প্রত্যুষ ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেই সেও চা,জলখাবার নিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসতো।আর গল্প চলতো সেই ডিনারের পূর্ব পর্যন্ত।বেশ কয়েকবছর ধরে এটাই ছিলো ওদের জীবনের রুটিন।ছুটির দিনগুলিতে প্রত্যুষ ব্যস্ত থাকতো তার গাছপালা নিয়ে।আর নন্দিতা মাঝে মাঝে চা নিয়ে এসে হাসি মুখে স্বামীর পাশে দাঁড়াতো। প্রত্যুষ হেসে পড়ে বলতো,
--এই জন্যই তোমায় এতো ভালোবাসি দিতি।আমার কখন কি চাই সেটা না বলতেই কেমন বুঝে যাও।
--অনেক বেলা হল গো।এবার গিয়ে স্নান করে নাও।
--এই আর একটু।দেখো জিনিয়া গাছটাই কেমন কুঁড়ি ধরেছে।গাছের গোড়াটা একটু আলগা করে দিই।আরে এরা সকলেই আমার সন্তান।যত্ন না করলে সুন্দর ফুল দেবে কেন?
নন্দিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
--সে তুমি ঠিক বলেছো।গর্ভের সন্তানকে কত যত্ন করে মানুষ করলাম।না,একটু ভুল বললাম,মানুষ নয় বড় করলাম।সেই আমাদের কথা ভাবলো না---
--ভুল করছো গো--সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব প্রত্যেকটা বাবা মায়ের।বাবা, মা কিন্তু সন্তানের কাছ থেকে কিছুই আশা করেনা।তারা ভালো থাক,সুখি থাক এটাই প্রত্যেক বাবামায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য।হ্যাঁ বড় হয়ে তারা তাদের শিক্ষা,রুচি,মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে যদি নিজেকে নিয়ে সুখি হতে চায় আমার মতে সেখানে কথা না বলায় ভালো।যত কথা বাড়াবে অশান্তি তত বাড়বে।সন্তানের সুখই যখন কাম্য তাদেরকে তাদের মতই থাকতে দাও।
--তাইবলে বৃদ্ধ বয়সে তারা বাবামাকে দেখবে না?
--যদি নাই দেখে ক্ষতি কি?ঈশ্বরের কাছে সুস্থ্য সন্তান কামনা করেছিলাম তখন তো ঈশ্বরের কাছে এটা চেয়েছিলাম না যে বৃদ্ধ বয়সে সে যেন আমাদের দেখে।
--ওসব ভেবোনা।প্রতীক ভালো আছে,সুখে আছে এর চেয়ে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে বলো?এই তো দুজনে বেশ আছি।আমি যখন থাকবোনা তখন তোমার কোন কষ্ট হবে নাগো।
--যত সব অলুক্ষুণে কথা।আজকাল মুখে তোমার কিছুই আটকায়না।
       দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো।হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘুমের মাঝেই প্রত্যুষ একদিন তার দিতিকে ছেড়ে চলে গেলো।ছেলেকে ফোন করেছিলো নন্দিতা।সে ছুটি পাবেনা জানিয়ে দিয়েছে মাকে।সে হয়তো ছেলেকে জানাতোও না।কিন্তু আত্মীয়স্বজনের মন রাখতেই ফোনটা করতে সে বাধ্য হয়েছিলো।না,ছেলের কথাতে সে অবাক হয়নি।সে জানতো এতো স্বার্থপর ছেলে তার সে কখনোই বাবার মুখাগ্নী করতে আসবেনা।আগে মাঝেমধ্যে তাও ফোন করতো।কিন্তু বিয়ের পর থেকেই ছেলেটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।প্রত্যুষ বা নন্দিতা কখনোই পরের মেয়েকে দোষারোপ করেনা।নিজের ছেলেই যখন বাবামাকে ত্যাগ করেছে তখন পরের মেয়েকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
    নিজের হাতে নন্দিতা তার স্বামীকে শেষবারের মত সাজিয়ে দেয়।সর্বক্ষণের সঙ্গী তার অবিবাহিত সেজদি।এই দিদিই তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে,বিয়ে দিয়েছে।বাবা তো সেই কবে ছেলেবেলায় মারা গেছেন।সেজদি ভালো চাকরী করতেন।বাবার মৃত্যুর পর সংসারের জোয়াল কাঁধে এসে পড়ায় সেজদির আর বিয়ের কথা মা উত্থাপনও করেননা।মা তিন দিদি,নন্দিতা, ভাই --সকলকে নিয়ে সে এক বিরাট সংসার।সেজদি একাই চাকুরে।বিপাকে পড়লে সকলেই কেমন স্বার্থপর হয়ে যায়।এই স্বার্থপরের তালিকায় অনেক সময় বাবামা ও থাকেন । চাকুরী করা মেয়ে সে যদি বিয়ে করে চলে যায় তখন সংসারটা ভেসে যাবে। তাই এক সন্তানের ত্যাগের বিনিময়ে অন্যদের সুখের ব্যবস্থা করা।একে একে বড়দি,মেজদি,ছোড়দি সকলের বিয়েই নন্দিতার সেজদি দেয়।সকলের ছোট ভাই আর নন্দিতা গ্রাজুয়েশন করে।দু'জনেই চাকরীর চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু এরই মধ্যে সেজদির অফিস সোশালে নন্দিতাকে দেখে সদ্য চাকরী পাওয়া তরুণ প্রত্যুষের খুব পছন্দ হয়ে যায়।সে সরাসরি এসে নন্দিতার সেজদির কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সেজদি নিরুপমা এতো ভালো পাত্র তার আদরের ছোটবোনের জন্য হাতছাড়া করেনা।মাস ছয়েকের মধ্যেই সে নন্দিতার বিয়ে দিয়ে দেয় প্রত্যুষের সঙ্গে।
   নন্দিতা খাটে শোয়া তার স্বামীকে আগলে বসে আছে মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।চোখের থেকে অবিরাম জল পড়ে চলেছে।অনেকেই চেষ্টা করেছে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু পারেনি।পাড়ার ছেলেরা এসে বললো,
---এবার বডি নিয়ে যাবো।বৌদিকে তোমরা ঘরে নিয়ে যাও।
  খুব আস্তে আস্তে নন্দিতা ছেলেটির মুখের দিকে তাকালো তারপর অতি ধীরভাবে বললো,
--বডি বোলনা ওকে তোমরা।আমার কানে ভীষন বাজছে কথাটা।ওকে তো তোমরা প্রত্যুষদা বলতে।সেটাই বলো।
  নন্দিতার সেজদি এগিয়ে এসে জোর করে তাকে ঘরে নিয়ে আসে।বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়।কিন্তু সেজদি থেকে যায় নন্দিতার সাথে।কিন্তু কতদিন?মায়ের বয়স নব্বই বছর।ভাই বিয়ে করেছে।তারও সন্তান আছে।তার উপর নির্ভর করে মাকে তো দিনের পর দিন ফেলে রাখা যায়না?তাছাড়া এই বয়সে ধকল নিতে পারবেননা বলে তার ছোট জামাই এর দুর্ঘটনাটা লুকিয়ে যাওয়া হয়েছে।নন্দিতা অবশ্য অনেকবারই দিদিকে বলেছে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা।
   একসময় সেজদিও বাড়ি চলে যায়।বিশাল দোতলা বাড়িতে নন্দিতা একা।কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তেই সে প্রত্যুষের উপস্থিতি টের পায়।সেদিন যখন প্রত্যুষকে নিয়ে কাঁচঢাকা গাড়িতে সকলে বেরিয়ে যায় সেজদি ওকে সাথে করে উপরে নিয়ে আসে।নিজের শোয়ার খাটে বসে নন্দিতার নাকে একটা কফ সিরাপের গন্ধ আসে।ঠান্ডা লাগলে বা কখনো কাশি হলে প্রত্যুষ এই সিরাপটা খেতো।নন্দিতা তখন আস্তে আস্তে দিদিকে বলে,
--দিদি,প্রত্যুষ কিন্তু আমার সাথে উপরে উঠে এসছে।ওর সিরাপটার গন্ধ বেরোচ্ছে।সেজদি ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
---কেন পাগলামী করছিস সোনা?যে চলে যায় সে চিরতরেই চলে যায়।
---আমি তো সে কথা অস্বীকার করছিনা দিদি।কিন্তু কেন জানি মনেহচ্ছে প্রত্যুষ আমায় ছেড়ে যায়নি।ও তো জানে আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা।
সেই শুরু।প্রত্যুষ থাকতে হয়তো কোন জিনিস নন্দিতা  খুঁজে পাচ্ছেনা তখন ওর সাথেই প্রত্যুষ ও খুঁজতে শুরু করে দিতো।সে রান্নাঘরের সাঁড়াশি থেকে শুরু করে আলমারীর ভিতরের কাপড়,সায়া,ব্লাউজ পর্যন্ত।ঠিক খুঁজে বের করে হাসতে হাসতে ওর হাতের কাছে এনে দিতো।ও চলে যাওয়ার পরেও মাঝে মাঝে কোন জিনিস খুঁজে না পেলে হঠাৎ করেই সেটি চোখের সামনে দেখতে পেয়েছে।প্রত্যুষ চা খেতে খুব ভালোবাসতো।আজকাল এই নেশাটা নন্দিতাকেও পেয়ে বসেছে।
  ভূত নন্দিতা কোনদিনও বিশ্বাস করেনা।এই অনুভূতিগুলি যখন তার হয় তখন সে ভয় যে পায় তাও কিন্তু না।কাজের মেয়ে জয়িতা মাঝে মাঝে তাকে বলেছে,
---বৌদি তুমি তোমার শোবার ঘরে না থাকলে আমার ওই ঘর মুছতে গেলে কেমন ভয় ভয় করে।দাদা মনেহয় ওই ঘরেই থাকে জানো?
জয়িতাকে জোরে এক তাড়া দিয়ে ওঠে নন্দিতা।তার অনুভূতিটাকে সে অন্যকারও সাথেই শেয়ার করতে চায়না।থাকুক না তার প্রত্যুষ সশরীরে না হোক অশরীরেই তার কাছে।
   এমন অনেক কথা থাকে এমন অনেক কষ্ট ব্যথা থাকে যা সারাজীবনেও কারও সাথে ভাগ করা যায়না।এমন অনেক অনুভূতি যা নিজের মনেও হয়তো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না।নন্দিতার জীবনে এ অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নিজেকেই নিজে দিতে পারেনা।বিশাল বাড়িতে এই অদ্ভুত অনুভূতিটুকুই প্রত্যুষকে হারিয়ে তার বেঁচে থাকার রসদ হয়ে উঠেছে।

Friday, July 19, 2019

আমায় কি পড়বে মনে

আমায় কি পড়বে মনে?
যখন আমি থাকবো না-
হারিয়ে যাবো অচিন দেশে,
একটুও কি কাঁদবে না?
টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো,
চোখের সামনে ভাসবে,
সবই থাকবে আগের মত,
আমায় কি খুঁজবে?
রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান,
সবই থাকবে পড়ে,
আমিই কাছে থাকবো নাগো,
যাবো অনেক দূরে-----।

                        মানবী

Wednesday, July 17, 2019

শহুরে কন্যা

শহুরে কন্যা
      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

    জিনিয়ার শ্বশুরবাড়ি বলতে গেলে গ্রামেই।বড় বড় শহরের কাছেপিঠের গ্রামগুলোকে আজকের দিনে ঠিক গ্রাম বলা যায়না।এখন সর্বত্রই পাকা রাস্তা,ইলেকট্রিক,পঞ্চায়েতের জল,ছোট বড় অজস্র দোকান।কিন্তু কয়েক বছর আগেও এটা জিনিয়ার কাছে অজপাড়াগাঁ ছিলো।সময়ের সাথে সাথে নানান ঝক্কি ঝামেলা,মান-অভিমান সবকিছু পিছনে ফেলে এই অজপাড়াগাঁ ই জিনিয়ার কাছে এখন খোদ কলকাতা শহর থেকেও বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে।
    ধনী পরিবারের বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান জিনিয়া।আহামরি সুন্দরী না হলেও কেউ তাকে কুৎসিত বলবেনা।ভীষন আদুরে,একগুঁয়ে আর জেদী।যখন যা চেয়েছে তখনই তাই পাওয়াতে হয়তো তাকে একগুঁয়ে আর জেদীতে পরিণত করেছে।কোচিং সেন্টারে যাতায়াতের পথে পরিচয় অর্পণের সাথে।তখন জিনিয়া সবে দ্বাদশ শ্রেণীতে উঠেছে। অর্পণের চেহারা পুরো নায়কোচিত।তাকে দেখলে মনেহয় বিশাল বড়লোক ঘরের ধনীর দুলাল।অর্পণ তাকে জানায় সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।জিনিয়া অর্পণের প্রেমে পড়ে যায়।শুরু হয় কোচিং ক্লাসের নাম করে অর্পণের বাইকে করে ঘোরাঘুরি।জিনিয়া অর্পণদের বাড়ি যেতে চায়।আজকাল করে অর্পণ বিষয়টা এড়িয়েই চলে।দিনের পর দিন স্কুল ও কোচিং ক্লাস কামাই করে অর্পণের সাথে ঘুরতে থাকার ফলস্বরূপ জিনিয়া দ্বাদশশ্রেণীর টেষ্ট পরীক্ষায় পাশ করতে পারেনা।বাবা,মা বাড়িতে এই নিয়ে প্রচণ্ড অশান্তি শুরু করেন।অর্পণকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বারবার চাপ দিতে থাকায় অর্পণ একদিন বাধ্য হয়ে  তাকে নিয়ে একটি ঝাঁ চকচকে তিনতলা  বাড়ি দেখিয়ে বলে এটা তাদের বাড়ি।কিন্তু ভিতরে নিয়ে যেতে না পারার কারন হিসাবে জানায় বাড়িতে মা,বাবা বোন কেউ নেই।অন্য একদিন তাকে নিয়ে আসবে।সরল বিশ্বাসে জিনিয়া মেনে নেয়।
   জিনিয়ার মায়ের সন্দেহ হয় মেয়ের আচার আচরণ আর বাড়িতে থাকলেই সর্বক্ষণ কানে ফোন গুঁজে ঘুরে বেড়ানো দেখে।তিনি বুঝতে পারেন মেয়ে কোন ভুলের মধ্যে পা দিয়েছে।একদিন তিনি জিনিয়াকে চেপে ধরেন।বহু বাক বিতন্ডা, ঝগড়াঝাটির পর জিনিয়া স্বীকার করে অর্পণ নামে একটি ছেলেকে সে ভালাবাসে।জিনিয়ার মা বুদ্ধিমতী মহিলা।মাথা ঠান্ডা রেখে অর্পণ সম্পর্কে তিনি মেয়ের কাছ থেকে সব খোঁজখবর নেন।তিনি মেয়েকে জানান,
--আমি কাল অর্পণদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলবো।কিন্তু তোকেও কথা দিতে হবে আমি তার সম্পর্কে সবকিছু না জানা পর্যন্ত তুই বাড়ি থেকে বেরোবি না।কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে অর্পণ যা তোকে জানিয়েছে তা সত্যি নয়।তোর বাবা যেন এসব কোনকথা না জানেন।এসব জানতে পারলে তিনি খুব কষ্ট পাবেন।তুই আমাদের একটি মাত্র সন্তান।কোনদিন তোকে আমরা কোন কষ্ট দিইনি।যখনই যা চেয়েছিস তখনই তাই দিয়েছি।এখন তোর বয়স সতের।তোকেও পড়াশুনা করতে হবে আবার অর্পণকেও ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে একটা চাকরী জোগাড় করতে হবে।আবেগের বশে জীবনটাকে তো নষ্ট করা যায়না।আগে মানুষ হ তারপর নাহয় ওই ছেলের সাথেই তোকে বিয়ে দেবো।
  চুপ করে জিনিয়া ওর মায়ের কথাগুলো শোনে।তারপর আস্তে আস্তে বলে,
--মা ও খুব ভালো ছেলে আমায় খুব ভালাবাসে।
--আমাকে একটু সময় দাও।আমি একটু খোঁজখবর আনি।
  পরদিন স্বামীকে না জানিয়ে বিশেষ কাজ আছে বলে কলেজ জীবনের বন্ধু ইন্সপেক্টর রোহিত পালের সাথে মিসেস চৌধুরী দেখা করেন।সবকিছু তাকে খুলে বলেন মিসেস চৌধুরী।কিছুদিন ধরেই খবরের কাগজ খুললেই মেয়ে পাচার চক্রের খবর দেখা যাচ্ছে।পুলিশ প্রশাসনের কাল ঘাম ছুট যাচ্ছে তাদের হদিস পেতে।এখনও কোন ক্লু তারা পাননি।মেয়ের মুখ থেকে সব কথা যখন জানতে পারেন তখন একটা কথাতে তার খটকা লাগে,'বারবার বলা স্বর্তেও অর্পণ আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়না।বাইরে থেকে বাড়িটা দেখায়'।
  ইন্সপেক্টর রোহিত একজন কনস্টেবল সাথে দেন তার কলেজ জীবনের বন্ধু লীলার সাথে।রোহিত কথা দেন প্রাথমিকভাবে লীলা সব খবর আনুক বাকিটা তিনি দেখছেন।
মিসেস চৌধুরী কনস্টেবলকে বাইরে রেখে মেয়ের বলা অনুযায়ী তিনতলা বাড়ির মালিক দ্বৈপায়ন  সেনের বাড়ি সটান উঠে যান।সেখানে গিয়ে জানতে পারেন অর্পণ নামে তাদের কোন সন্তান নেই।মিসেস চৌধুরী বুঝতে পারেন তিনি যা সন্ধেহ করেছিলেন সেটাই ঠিক আর এইটুকুই তার কাছে যথেষ্ঠ ছিলো। তিনি নেমে আসেন।ইতিমধ্যে কনস্টেবল দু একজনের কাছ থেকে অর্পণ নামে একটি ছেলের বাড়ির সন্ধান পান তবে সেটা বস্তিতে।কয়েক মাস হল মা ও বোনকে সাথে নিয়ে এখানে আছে।তবে ছেলেটির সাথে দেখা হয়না।ছেলেটি যাতে ওইদিনই থানায় দেখা করে সে কথা তার মা বোনকে কনস্টেবল জানিয়ে আসে।
  মিসেস চৌধুরী থানা হয়ে বাড়িতে ফিরে মেয়েকে কোথাও দেখতে পাননা।দারোয়ানের কাছ থেকে জানতে পারেন একটি ছেলে বাড়ির বাইরে রাস্তার ওপারে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো দিদিমনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে তার বাইকে করে উঠে চলে যায়।কিংকর্তব্যবিমূঢ় মিসেস চৌধুরী বুঝতে পারেন তার মেয়ের জীবনে কি অশনিসঙ্কেত নেমে এসেছে।একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে স্বামীকে অফিসে ফোন করে থানায় আসতে বলেন।
জিনিয়া নিখোঁজ।ফোনের সুইচ ওফ।পুলিশ বিকেলের মধ্যে অর্পণের বাসস্থান বস্তি রেট করে।ততক্ষণে তার ঘরে তালা পড়ে গেছে।অনুসন্ধান করে তারা যেটুকু জানতে পারে মাস ছয়েক আগে অর্পণ তার বোন ও মাকে সঙ্গে করে বস্তিতে এসে ওঠে।ভাড়া নিয়ে কখনোই কোন গন্ডগোল করেনি।সারাদিন সে একটা বাইকে করে ঘুরে বেড়াত।অনেক রাতে ঘরে ফিরতো।মা,বোন ঘরেই থাকতো।কারও সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলতোনা।বাইকটা খুব দামী ছিলো।জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলো একটা ওষুধের কোম্পানীতে চাকরী করে সেখান থেকে লোন নিয়ে এটা কিনেছে।
  শুরু হোল থানা,পুলিশ আর প্রতি মুহূর্তে ফোন।জিনিয়ার বাবা খুবই শান্ত স্বভাবের মানুষ।একটুতেই নার্ভাস হয়ে যান।এই ঘটনার পর তিনি আরও চুপচাপ হয়ে যান।মিসেস চৌধুরী একাই ছুটোছুটি করতে থাকেন।নানান সোর্স জোগাড় করে তিনি পুলিশের উপর মহল পর্যন্ত পৌঁছে যান।প্রশাসন নড়েচড়ে বসে।দশদিনের মাথায় মিসেস চৌধুরীর মোবাইলে একটি ফোন আসে, 'যদি মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখতে চান থানা পুলিশ করবেননা'।মিসেস চৌধুরী তৎক্ষণাৎ থানায় যোগাযোগ করেন।ওই ফোনের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে দুর্গাপুরের 'অম্বোরীশ' হোটেল থেকে ফোন এসছে।সেখানকার পুলিশের সাহায্য নিয়ে সাদা পোশাকের কিছু মহিলা পুলিশ ওই হোটেলে গিয়ে ওঠেন।আর বাইরে থাকে সাদা পোশাকে অন্য পুলিশেরা।হোটেলে মালিককে পুরো বিষয়টা জানানো হয়।তিনি আশ্বাস দেন সর্বরকম সাহায্য তিনি পুলিশকে করবেন।
   প্রতিটা রুমেই ভীষনভাবে কড়া নজরদারি রাখা হয়।কোন রুমে বাইরে থেকে তালা দেওয়া দেখলেই ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে হোটেল মালিকের সাহায্যে সে রুমে ঢুকে তল্লাশি চালানো হয়।দুদিন এভাবেই কাটে।তৃতীয়দিন সন্ধ্যাবেলায় একজন অসুস্থ্য একটি মেয়েকে নিয়ে তড়িঘড়ি হোটেল থেকে ডাক্তারখানার উদ্দেশে হোটেল ছেড়ে বেরোতে গেলে সাদা পোশাকের মহিলা পুলিশেরা এসে জানতে চান কি হয়েছে?লোকটি তাদের জানায় তিনি একাই সামলে নিতে পারবেন।ততক্ষণে সেখানে বাইরের সাদা পোশাকের পুলিশও হাজির।মেয়েটির মুখের সাথে তাদের পকেটে থাকা জিনিয়ার ছবির মিল পেয়ে লোকটিকে তারা অ্যারেস্ট করেন।জিনিয়া তখন ঠক ঠক করে কাঁপছে।পুলিশবাহিনী তাকে আশ্বস্ত করে যে তার কোন ভয় নেই।বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়ি তখনই স্টার্ট দেয়।ভিতরে চার,পাঁচজন বসা।পুলিশের তৎপরতায় তারাও ধরা পড়ে।
   প্রশাসনের কর্মদক্ষতার কারনে তারা জিনিয়া সহ আরও যে তিনজন মেয়েকে একই ফাঁদে ফেলে অপহরণ করেছিলো তাদের কাউকেই ভিনরাজ্যে পাচার করতে পারেনি।দুটি হোটেল মিলিয়ে তারা এই চারটি মেয়েকে রেখেছিলো।তাদের বলে রেখেছিলো যদি তারা মুখ খোলে সঙ্গে সঙ্গেই তাদের মেরে ফেলবে।অল্পবয়সী মেয়েগুলো ভয় পেয়ে চুপসে গেছিলো।ধরা পড়ে পাচার চক্রের মূল পান্ডা যাকে অর্পণ তার মা বলে পরিচয় দিয়েছিলো।অর্পণের মত এরূপ অল্পবয়সী সুন্দর দেখতে গরীবঘরের ছেলেগুলোকে পয়সার লোভ দেখিয়ে এই কাজে লাগায় অসীমা দলুই।
   জিনিয়াকে একরাত থানায় কাটাতে হয় যদিও মেয়ের বয়স কম বলে উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি এনে জিনিয়ার মা মেয়ের সাথে থানাতেই থাকেন।পরদিন অনেক হ্যাপা সামলে মেয়েকে নিয়ে মিসেস চৌধুরী বাড়িতে ফেরেন।
   অপহরণের কুড়িদিনের মাথায় মেয়ে বাড়ি ফিরে আসে।শারীরিক ও মানষিক নানান নির্যাতনের পর জিনিয়া একেবারেই চুপচাপ হয়ে যায়।তার বাবা,মা এতটাই স্বাভাবিক যেন কিছুই হয়নি।জিনিয়ার বাবা বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র যেতে চাইলেও তার মা জিদ ধরে ওই বাড়ি বিক্রি করতে দেননি।তিনি বলেন,
---কয়েক বছর পর এসব আর কেউ মনেও রাখবে না।এতো কষ্ট করে এ বাড়ি করেছি আমি কিছুতেই তা বিক্রি করতে দেবোনা।ওর কপালে যা ছিলো সেটাই হয়েছে।বাঁচবো মাথা উঁচু করে।ভবিষ্যৎ এ আর কখনো ভুলের মধ্যে ও পা দেবেনা।আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
    কিন্তু জিনিয়া প্রচণ্ড ভেঙ্গে পড়ে।সে একবার আত্মহত্যা করারও চেষ্টা করে।কিন্তু ওর মা সর্বদা ওর পাশে থেকে ওকে বুঝিয়ে স্বাভাবিক জীবনে আনতে সফল হন।পরের বছর উচ্চমধ্যমিক পরীক্ষাটা ও প্রাইভেটে দেয়।ভালোভাবেই পাশ করে। কলেজে ভর্তি হয়।গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে।
  পরিবারিক এক বিয়ের অনুষ্ঠানে মা,বাবার সাথে জিনিয়া শিলিগুড়ি যায়।সেখানে তাকে দেখে এক ভদ্রমহিলা তার ব্যাঙ্কে চাকুরীরত ছেলের জন্য পছন্দ করেন।জিনিয়ার মা রাজি হন।কিন্তু বাবা বেঁকে বসেন।তিনি ছেলের বাড়িতে সবকিছু জানাতে বলেন। কিন্তু জিনিয়ার মা কিছুতেই স্বামীর কথায় রাজি হননা।
--এই যে তোমার ভাইপোর বিয়ে হল ওই মেয়েটির অতীত কি আছে তা কি আমরা কেউ জানি?অতীতে কি ঘটেছে সেটা জেনে তা ধুয়ে কি ওরা জল খাবে?
--কিন্তু তবুও এতোবড় ঘটনা লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া ঠিক হবেনা।পরে যদি জানতে পারে তাহলে ওর সাজানো সংসারটা ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে যাবে।
--যদি কখনও এ সমস্যা আসে তখনকার কথা তখনই ভাবা যাবে।আমরা জিনিকে শিলিগুড়ি নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেবো।সারাজীবন সংসার নিয়ে তুমি মাথা ঘামাওনি আজও তোমায় বলছি তোমার এই ভালো মানুষের স্বভাবের দাম কেউ দেবেনা।আমাদের যা অর্থ সম্পত্তি তা ওই মেয়েই পাবে।টাকা আর সম্পত্তিতে সবকিছু চাপা পরে যাবে।সে এখানে বছরে হয়তো একবার আসবে।কোন অসুবিধা হবেনা দেখো।বিয়ের আগে অনেক মেয়ের জীবনেই অনেককিছু ঘটে থাকে।বিয়ের সময় সব কি তার বাপের বাড়ির লোকজন ছেলের বাড়িতে জানায়?একটা সত্যি ঘটনা লুকিয়ে গেলে যদি আমার মেয়ে সুখি হয় তাহলে মা হয়ে আমি সেটা করতেই পারি।সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার এই অন্যায় কাজকে ঈশ্বর ক্ষমা করে দেবেন। তুমি শুধু মুখটা বন্ধ রেখো।
  জিনিয়ার বিয়ে হয়ে গেলো শিলিগুড়ি জেঠুর বাড়ি থেকে।কলকাতা শহরের মেয়ে বিয়ে হল বলতে গেলে একটু গ্রামেই।নামেই অবশ্য গ্রাম।শহরের মত সর্বসুবিধাযুক্ত।প্রচুর জমিজমা,পুকুর, দু দুখানা গাড়ি।প্রথম প্রথম অতো বড় বাড়ি আর সন্ধ্যা নামলেই বাড়ির আম,কাঁঠালের বাগানের দিকে তাকালে অন্ধকারে জিনিয়ার বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠতো।এখন অবশ্য সেই ভয় আর ওর করেনা।দিনের বেলা চারিদিকের সবুজের সমারোহে তার মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। পাকা সিমেন্ট করা বিশাল বড় উঠোনে জমজ দুই মেয়েকে নিয়ে বিকাল থেকে বসে থাকা ওদের বাবা না ফেরা পর্যন্ত।একটা সত্যি ঘটনাকে চেপে এই জীবন কাটাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই জিনিয়া হাফিঁয়ে ওঠে।অন্ধকার ঘরে বসে কখনো সখনো চোখের জল ফেলে নিজের কষ্টকে লাঘব করতে চায়।আজকে তার সুখের জীবনে ওই অভিশপ্ত অতীত মাঝে মাঝেই সামনে এসে দাঁড়ায়।ভয় পায় সে।মনেমনে ভাবে তার স্বামীকে সে ঠকাচ্ছে।কিন্তু কিছুতেই পারেনা তার সেই কালো অতীতকে সামনে আনতে।হয়তো কোনদিনও পারবেওনা।


#সত্য_ঘটনার_উপর_আধারিত






Friday, July 12, 2019

এক অচেনার সঙ্গে পাড়ি

এক অচেনার সঙ্গে পাড়ি
    নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

    বাবা,মা আদর করে নাম রেখেছিলেন শ্যামলী।না গায়ের রং তার শ্যামলা ছিলোনা।সে ছিলো কালো কুচকুচে।তার এই গায়ের রংএর জন্য স্কুল,কলেজে কম কথা শুনতে হয়নি।বন্ধু বলতে ঠিক যা বোঝায় কোনদিনও শ্যামলীর সে অর্থে কেউ ছিলোনা।কোমর অবধি ঘন কালো চুল,পড়াশুনায় তুখোড়।প্রতি ক্লাসেই প্রথম হয়ে ওঠাটা কেউ আটকাতে পারেনি।শিক্ষক,শিক্ষিকাদের প্রিয় ছাত্রী হলেও ক্লাসমেটদের কাছে এই ব্যপারটা খুব হিংসানীয় ছিলো।যদি কখনো সে ক্লাসে না আসতে পারার কারনে  নোটস এর ব্যপারে কোন ক্লাসমেটের কাছে সাহায্য চেয়েছে কেউই তাকে কোনদিন  সাহায্য করেনি।শ্যামলী কিন্তু যখন যে পড়াশুনার ব্যপারে সাহায্য চেয়েছে তাকে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
  গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগে থেকেই চাকরীর চেষ্টা চালিয়ে গেছে।পরবর্তীতে সে ব্যাঙ্কে কেরানীর একটি চাকরী জুটিয়েও নেয়।কারন সে জানতো তার যে গায়ের রং কোনদিনও কোন ছেলে তাকে পছন্দ করবেনা।জীবনে ভালোভাবে বেঁচে থাকতে গেলে চাকরী একটি তাকে জোগাড় করতেই হবে।তার পরিশ্রমের ফলও সে পায়।প্রথম প্রথম বাবা,মায়ের জন্য তাকে ছেলে পক্ষর সামনে বসতে হয়েছে।কিন্তু প্রত্যেকেরই সেই এক কথা,'পড়ে খবর দেবো'- খবর আর কেউ কোনদিন দেয়না।এখন সে পরিষ্কার বাবা,  মাকে জানিয়ে দিয়েছে বিয়ে সে করবেনা।
  অফিস আর বাড়ি।অবসর সময়ে মাকে কাজে সাহায্য করা আর গল্পের বই পড়া।বেশ কেটে যাচ্ছে দিনগুলি।একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে শ্যামলী দেখে এক ভদ্রলোক রাস্তার উপর পড়ে গিয়ে খুব হাপাচ্ছে।পথচারীরা একটু উঁকি দিয়ে দেখেই যে যার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে।শ্যামলী কিছু মানুষের সাহায্যে একটি ট্যক্সি ডেকে ভদ্রলোককে নিয়ে হাসপাতাল আসে।ভদ্রলোকের কাছ থেকে ফোন নিয়ে তার বাড়ির কন্টাক্ট জেনে বাড়িতে খবর দেয়।কিছুক্ষণের মধ্যে ভদ্রলোকের বোন-ভগ্নিপতি এসে উপস্থিত হন।সে বাড়িতে চলে আসে।
  পরদিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে সে ওই ভদ্রলোককে দেখতে যায়। ততক্ষণে তার বোন সেখানে পৌঁছে গেছে দাদার কাছে।ভদ্রলোকের বেডের কাছে দাঁড়িয়ে জানতে চায়,'কেমন আছেন আজ?'
   ভদ্রলোকের বোনের কাছ থেকেই জানতে পারে হঠাৎ করেই  বুকে একটা ব্যথা অনুভূত হয় আর সাথে সাথে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় রাস্তা উপর তিনি বসে পড়েন।থাকেন আসানসোল।বোন শ্রেয়ার বাড়ি কলকাতা।সেখানেই এসেছিলেন।কিছু ব্যক্তিগত কাজে বেরিয়ে হঠাৎ এই বিপত্তি।শ্রেয়ার সাথে ব্যক্তিগত আলাপে জানতে পারে শ্যামলী তার দাদার বয়স বিয়াল্লিশ বছর।এখনও বিয়ে করেনি।মাকে নিয়ে আসানসোলেই থাকে।বিয়ে করতে চায়না যদি বৌ এসে মাকে না দেখে।ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর মা অনেক কষ্ট করে দুই ভাই, বোনকে মানুষ করেছেন।বাবা একটা সাধারণ প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করতেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বাবা মারা যান।তখন দাদার বয়স সাত আর আমার পাঁচ।মা সারাদিন ধরে কয়েকটা বাড়িতে রান্না করতেন। এইভাবেই দিন চলতো তাদের । এখন দাদা আসানসোলে একটা স্কুলের হেড মাষ্টার।
  শ্যামলী ভাবে এতো স্বল্প পরিচয়ে শ্রেয়া কি অবলীলায় তার পরিবারিক গল্প বলে চলেছে তার সাথে।খুব ভালো লাগে শ্রেয়াকে তার।ভিজিটিং আওয়াজ শেষ হওয়ার পর প্রায় ঘন্টা দুয়েক দুজনে বসে গল্প করে চা কিছু টিফিন করে দুজন দুজনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
  শ্রেয়ার দাদা শতদলও সুস্থ্য হয়ে বোনের বাড়ি ফিরে যায়।শ্যামলী রোজই নিয়ম করে সন্ধ্যায় শ্রেয়ার কাছে ফোন করে তার দাদার খবর নিয়েছে।আর রোজ অনেক রাতে ফোন করে দুজনে গল্প করে সেই থেকে।খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় পরস্পরের সাথে।
  শতদল আসানসোল ফিরে যায়।দিন গড়িয়ে যেতে থাকে।শ্রেয়া ও শ্যামলী পরস্পরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে।উভয়ে উভয়ের বাড়িতেও এসেছে।খুব মিশুকে মেয়ে শ্রেয়া।খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নেয়।একদিন অফিস ছুটির দিনে শ্যামলী দুপুরে খেয়েদেয়ে সবে একটু বিশ্রাম নেওয়ার তোড়জোড় করছে হঠাৎ শ্রেয়ার ফোন,
---তুমি বাড়িতে আছো?
--হ্যাঁ কেন বলো তো ?
--আমি আসছি এসে সামনাসামনি সব বলবো।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে শ্রেয়া ও তার স্বামী এসে উপস্থিত।
--ভীষন দরকারী একটা কথা আছে তোমার সাথে।
--হ্যাঁ বলো ---
--না, সকলের সামনে না, আগে তোমার কাছে বলবো তারপর সেরূপ হলে পরে  মাসিমা,মেশোমশাইকে বলবো।চলো তোমার ঘরে চলো।
  শ্যামলী কিছুই বুঝতে পারছেনা।সে শ্রেয়াকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে আসে। শ্রেয়া বলতে শুরু করে,
--মায়ের শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালোনা।বলতে গেলে ডক্টর জবাব দিয়েই দিয়েছেন।দাদার এতোবছর বয়সেও আমরা কোনদিন তার বিয়ে দিয়ে উঠতে পারিনি।কিন্তু মায়ের এই মৃত্যুশয্যায় মা দাদার হাত ধরে তার বৌ দেখে যেতে চেয়েছেন।দাদা মাকে না করতে পারেনি।আমার দাদা রাজি হয়েছে।
--বাহ!এতো বেশ ভালো কথা।কিন্তু আমায় এসব বলছো কেন?
--কারন তুমিই পারো এই সমস্যা থেকে আমাদের উদ্ধার করতে---1
--মানে ---?
--আমার দাদা খুব ভালো মানুষ জানো
নিজের দাদা বলে বলছিনা---
--আরে দাঁড়াও দাঁড়াও , আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলো তো কি বলতে চাইছো?
--তোমাকে দাদা বিয়ে করতে চায়---
শ্যামলী শুনেও যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।সুপুরুষ বলতে যা বোঝায় শ্রেয়ার দাদা ঠিক তাই।তিনি বিয়ে করতে চান কিনা ----। আত্মীয়স্বজন মহলে সে তো কালিন্দীর বলেই পরিচিত।
--তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে শ্রেয়া।আমার মত এইরূপ কুৎসিত একটি মেয়েকে---তোমার দাদা কত সুন্দর দেখতে তিনি কেন আমায় বিয়ে করতে ....
শ্যামলীর কথা শেষ হয়না শ্রেয়া বলে ওঠে,
--দাদা নিজে মুখে ফোনে কাল আমায় একথা বলেছে।প্লিজ তুমি রাজি হয়ে যাও --।
--তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে শ্রেয়া।
--কিচ্ছু ভুল হচ্ছেনা।জানো দাদা কাল ফোনে আমায় বলেছে মানুষের মনটাই হচ্ছে আসল।চেহারা সেখানে গৌণ।চেহারা বাহ্যিক মনকে আকৃষ্ট করে ঠিকই কিন্তু সংসার করতে গেলে দরকার একটি সুন্দর মনের।আর শ্যামলীর সেটা আছে।এই বয়সে এসে বিয়ে যদি করতেই হয় তাহলে শ্যামলীর মত একটি সুন্দর মনের মানুষকেই বিয়ে করবো।
   বিয়ে হয়ে গেলো শ্যামলী ও শতদলের।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শ্যামলী আসানসোল বদলী হয়ে যায়।একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের হাত ধরে সাঁইত্রিশ বছর বয়সে শ্যামলী তার নূতন জীবনে দুরুদুরু বুক নিয়ে বাড়ি থেকে এতোটা দূরত্বে আসার সময় অনেক আশঙ্কা নিয়েই পা বাড়িয়েছিলো।একমাত্র ভরসা ছিলো শ্রেয়া।কিন্তু নূতন জীবনে প্রবেশ করে শতদলের মত স্বামী পেয়ে অনেক সময় খুশীতেই তার দু'চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নির্গত হয়েছে।একদিন শতদল দেখতে পেয়ে জানতে চেয়েছিলো,
--কাঁদছ কেন তুমি?আমি কি তোমায় কোন কষ্ট দিয়েছি?
কান্না যেন তখন দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হয়েছে।শতদলকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,
--এতো ভালো কেন তুমি?আমি তো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমার বিয়ে হবে।আর এমন দেবতার মত স্বামী পাবো।আমার গায়ের রং নিয়ে ছেলেবেলা থেকে নানান কটূক্তি শুনতে শুনতে জীবনের সাঁইত্রিশটা বছর পার করেছি।বাবা মা ছাড়া অন্তর থেকে কেউ কোনদিন ভালোবাসেনি এটা আমি সবসময় বুঝতাম।
--তারা তোমার বাহ্যিক রূপটা দেখেছে।মানুষের অন্তরটা দেখতে গেলে ঠিক তার মতই আর একটি মন চায়।আমি প্রথমদিনই তোমার অন্তরটা দেখতে পেয়েছিলাম।মা যদি আমার বিয়ের জন্য জিদ না ধরতেন এই বয়সে মনেহয় কলকাতা গিয়ে  তোমাকে প্রেম নিবেদন করতে হত।
বলে শতদল হাসতে থাকে।শ্যামলী আরও নিবিড়ভাবে শতদলকে জড়িয়ে ধরে। 

Saturday, July 6, 2019

দাম্পত্য এক রসময় মাঠ

#আমার_লেখনীতে
   দাম্পত্য এক রসময় মাঠ

--সকাল থেকে যে বলছি একটু বাজার যাও তা বসে বসেই শুনে যাচ্ছ?উঠার কোন নামই নেই --
  পেপারটা থেকে মুখ সরিয়ে অর্ণববাবু কটাক্ষ দৃষ্টিতে স্ত্রী মনোরমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
--তুমি আজ একটু ডাল , ভাত করে চালিয়ে দাও , আজ অফিসে একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে।
---বাজার যেতে বললেই ওই এক কথা ডাল,ভাত করো নুতবা চালে ডালে চালিয়ে দাও।বলি রোজ রোজ ওই ডাল খেতে খেতে যে মুখে অরুচি ধরে গেছে।তুমি কি ভাবো গো তোমার একারই বয়স হয়েছে আমার হয়নি?
 অর্ণববাবু মুখে কুলুপ এঁটে স্নানে চলে গেলেন।রমাদেবী মুখে একটা টেপ রেকর্ডার চালিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দুই গ্যস জ্বালিয়ে ভাত ও ডাল চাপিয়ে দিয়ে একটু আলুর দম করার জন্য আলু নিয়ে কাটতে বসলেন।তারও বয়স হয়েছে হাঁটুতে ব্যথা, ডাক্তার নীচুতে বসতে একদম নিষেধ করেছেন কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে পড়ে কিছুই কাটতে পারেননা।তাই কষ্ট হলেও তিনি নীচুতেই বসেন।কাজের মেয়ে সরলা সাতদিনে চারদিন আসে তো তিনদিন আসেনা।তবুও রেখেছেন ছেড়ে দিলে পাবেন কোথায়?সবথেকে বড় কথা সরলাকে ছাড়িয়ে দিলে মেয়ের কানে গেলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ছাড়বে।
অর্ণববাবু স্নান করে ঘরে যেতে গিয়ে দেখেন রমাদেবী নীচুতে বসে আলু কাটছেন।
--তোমাকে ডাক্তার কতবার বলেছে তুমি নীচুতে বসবেনা এতে তোমার হাঁটুতে আরও বেশি কষ্ট হবে কেন কথা শোনানো বলো তো?
--থাক আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবেনা,তুমি তো বলে খালাস ডাল, ভাত করো।অফিস যাওয়ার সময় শুধু ওই ডাল,ভাত কি খাওয়া যায়।তুমি পারোনা আমি বুঝি কিন্তু আমিও বা কি করি বলো তো?
অর্ণববাবু ও রমাদেবীর বিবাহিত জীবন আজ পঁয়ত্রিশ বছরের।একমাত্র মেয়ে অনুষ্কা বছর পাঁচেক আগে বিয়ে হয়েছে।মাস ছয়েক বাকি অর্ণববাবুর রিটায়ারমেণ্টের।মেয়ে মাঝে মাঝে দুবছরের নাতিকে নিয়ে আসে।কিন্তু জামাই ওই বছরে একদিন।জামাইষষ্ঠীতে।ব্যবসায়ী মানুষ ভীষন ব্যস্ত একদম সময় পায়না।
  সকালের আলুরদম আর দোকানের তৈরী হাতে গড়া রুটি যা প্রতিদিন অর্ণববাবু অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়েই ফেরেন।খেতে খেতে দু'জনে গল্প করছিলেন।হঠাৎ অর্ণববাবু বললেন,
-- আর তো মাত্র ছ'মাস বাকি রিটায়ারমেণ্টের।টাকাপয়সা মোটামুটি ভালোই পাবো।চলো দু'জনে মিলে একটু তীর্থ করে আসি।
---তা কোথায় যাবে বলে ভেবেছো?
---কেদার বদ্রীনাথ।
রমাদেবী যেন আঁতকে উঠলেন..
---ওমা --ওখানে তো ঠান্ডা শুনেছি।তোমার তো আবার ঠান্ডার ধাত।একটুতেই ঠান্ডা লেগে যায়।তখন তো দু'মিনিট অন্তর তোমায় ফোঁসফোঁস (ইনহেলার , এটাকে রমাদেবী ফোঁসফোঁস বলেন তার কারণ এটা অর্ণববাবু যখন মুখে প্রেস করেন তখন ফোঁস করে একটা আওয়াজ হয়) নিতে হয়।সারারাত কাশতে থাকো।নিজেও ঘুমাতে পারো না আমাকেও ঘুমাতে দাওনা।
-- হ্যাঁ তাই তো আমি তোমাকে রাতে ঘুমাতে দিইনা! আর নিজে যখন হাঁটুর ব্যথায় , কোমর ব্যথায় সারারাত যন্ত্রণায় ছটফট করো তখন আমার ঘুমের ব্যাঘাত হয়না?কোনদিন শান্তিতে একটু ঘুমাতে পারি?
--রাত অনেক হোল।বলি এখানে বসে আমার সাথে ঝগড়া করেই কি রাত শেষ করবে নাকি?কাল তো আবার অফিস আছে।বাজার যেতে হবে বলে দিলাম কিন্তু ---
---হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে ।জীবনে কোনদিন একটু শান্তি পেলামনা।
---আমাকেও যেন কত শান্তিতে রেখেছো-
 এখন দয়া করে শুয়ে পরো।বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করলে তো আমি ছাড়া  গতি নেই ---
অর্ণববাবু কথা না বাড়িয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।রমাদেবীও রাতের টুকটাক কাজ সেরে স্বামীর পাশে শুয়ে পড়েন।অনেক রাতে রমাদেবীর কাতরানোর আওয়াজে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চান
--কি গো হাঁটুতে যন্ত্রণা হচ্ছে?
উত্তর পেয়ে আস্তে আস্তে উঠে লাইট জ্বালিয়ে ব্যথার বামটা নিয়ে গিয়ে স্ত্রীর হাঁটুতে অনেকক্ষণ ধরে মালিশ করেন।কিছুক্ষণ পর ব্যথা একটু কমাতেই রমাদেবী ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে উঠে বামটা রেখে লাইট ওফ করে স্ত্রীর পাশে এসে শুয়ে একসময় নিজেও ঘুমিয়ে পড়েন।
   সকালে রমাদেবী ঘুম থেকে উঠে দেখেন আগেই তার স্বামী উঠে পড়ে চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছেন।স্ত্রীকে দেখতে পেয়ে হেসে পড়ে জানতে চান,
--কি গো কেমন আছো এখন?  ঘুমাচ্ছ দেখে আর ডাকিনি তোমায়।নিস্পাপ শিশুর মত অকাতরে ঘুমাচ্ছিলে।তুমি মুখ ধুয়ে নাও আমি চা করে আসছি।চা খেয়েই বাজার যাবো।
--আরে আমি তো উঠে গেছি।আমি চা করছি।তুমি বরং যাও পেপারটা বারান্দা থেকে তুলে চোখ বুলাতে লাগো।
--আচ্ছা তবে তাই যাই।
  চা করে রমাদেবী ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসেন।
--বলি বাজারের ব্যাগটা দাও গো।আজ তো সত্যিই বাজার না গেলে হবেনা।রান্নাঘর থেকে বাজারের ব্যাগটা হাতে করে নিয়ে এসে আব্দারের সুরে স্বামীকে বললেন,
--চলো দুজনেই বাজার যাই।
--না না তোমাকে যেতে হবেনা।কাল রাতে অত কষ্ট পেয়েছো ব্যথায়।আজ আবার এতোটা পথ হেঁটে বাজার যাবে, এসে রান্না করে অফিসের ভাত দেবে , খুব কষ্ট হবে গো তোমার।
--না কষ্ট হবেনা।আর হলে তুমি আছো তো।বাম লাগিয়ে দিও।চলো দু' জনে কথা বলতে বলতে বাজারটা করে নিয়ে আসি।অর্ণববাবু আর আপত্তি করেননা।
---বেশ তবে তাই চলো।দুজনেই যাই।
  বেরিয়ে গেলেন দুজনে ঘরে তালা লাগিয়ে।বাজার শেষে বাজারের ভিতরেই দুজনের সাথে একপ্রস্ত জোর ঝামেলা হয়ে গেলো একবার।বাজারের ব্যাগ দু'জনেই টানবেন।কেউ ছাড়ার পাত্র নয়।পরস্পরের একই কথা, 'তোমার কষ্ট হবে আমাকে দাও---' একেই বলে বোধহয় দাম্পত্য----

Friday, July 5, 2019

আর নয় ষষ্ঠী


আর নয় ষষ্ঠী
       নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

   সকালবেলা মাকে রান্নাঘরে অনেকবার চোখ মুছতে দেখেছে লিপি।বাবা সকাল থেকে পেপার মুখে গুম হয়ে বসে।আজ বাবা জলখাবারও খাননি।রান্নাঘরে সকালের দিকে টুকটাক সাহায্য করেছে লিপি তার মাকে।ভুলে থাকার চেষ্টা করেছে সেই বিভীষিকাময় দিনটির কথা।কিন্তু চেষ্টা করলেই কি ভুলে থাকা যায়।এই চার বছরে একমুহূর্তের জন্যও কি লিপি ভুলতে পেরেছে সেই দিনটির কথা?
   চার বছর বাদে লিপিদের বাড়িতে আবার জামাইষষ্ঠী হচ্ছে।আজও ঠিক সেই চার বছর আগের দিনটির মত আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন।কিছুক্ষণের মধ্যেই নামবে মুষলধারে বৃষ্টি।সেদিনের সেই ঘটনার পর এ বাড়িতে আর জামাইষষ্ঠী হয়নি।বড়দি জানিয়েই দিয়েছে সে আর ষষ্ঠীতে আসবেনা।লিপিকা মেজ । আর ছোট লতিকা। চারমাস আগে বিয়ে হয়েছে সকলের আদরের ছোটবোন লতিকা ওরফে  লতির।লতি বলেছিলো,'মা জামাইষষ্ঠী  যখন উঠিয়ে দিয়েছো নূতন করে আর শুরু করতে হবেনা।মা ও রাজি ছিলেন।কিন্তু বাধ সাদলো লিপি।সে মাকে বললো,
---তা কি করে হয়?নূতন জামাই।তার কথা নাহয় বাদ ই দিলাম। ওদের বাড়ি থেকেই বা কি ভাববে?না মা তুমি এবার থেকে পূণরায় জামাইষষ্ঠী চালু কর। মায়ের অমত থাকলেও লিপিকার জেদের কাছে তাকে হার মানতেই হোল।
   চার বছর আগে এমনই এক ষষ্ঠীর দিনে লিপিকা ও রাহুল মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে বাইক নিয়ে ষষ্ঠী নিতে হাজির।কাকভেজা ভিজে যখন দুজনে এসে ঘরে ঢোকে লিপিকার মা চিৎকার করতে থাকেন লিপি ও রাহুলের জামাকাপড় পাল্টানোর জন্য।কিন্তু দুজনের যেন কোন হেলদোল নেই।দুজনেই ওই ভিজে চপচপে জামাকাপড় পরে মেঝেতেই বসে চা খেতে শুরু করে।লিপির মা এসে জোর তাগাদা দেন পোশাক পাল্টে নেওয়ার জন্য।তখন রাহুল মাকে বলে,
--মা,বৃষ্টির মধ্যে ছাদে উঠে কটা ছবি তুলেই জামাকাপড় পাল্টে নেবো।
--কিন্তু বাবা পুরনো বাড়ি।দুদিন ধরে সমানে বৃষ্টি হচ্ছে।ছাদের গাঁথুনীর নানান জায়গায় ফাটল।তোমরা বরং ছবি তুলতে হলে উঠোনে গিয়ে তোলো।
রাহুল হেসে বলে ওঠে,
--মা আমরা বাচ্চা নয়।ঠিক নিজেদের সামলে নিতে পারবো।আপনি একটুও ভাববেন না।মিনিট পনের মধ্যে আমরা নেমে আসছি।
 বৃষ্টিতে ভিজে ছবি তুলতে দুজনেই ছাদে চলে গেলো।তারা একটার পর একটা ছবি তুলেই চলেছে।ক্যামেরা যাতে না ভেজে যখন যে ছবি তুলছে তখন তার মাথায় ছাতাটা থাকছে।রাহুলের হাতে ক্যামেরা আর মাথায় ছাতা।লিপিকে পোজ দিতে বলে পিছন হাঁটছে।লিপি দু দুবার সাবধানে করেছে।সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের উত্তর এসেছে
---আরে বাবা আমার তো বোধবুদ্ধি আছে না কি?তুমি একটু এ্যানগেলে দাঁড়াও....হ্যাঁ তোমার সামনের দিকে তাকাও ...আরে হাঁটার মত করে পজিশনটা দা....আ ..আ ...আ ...
লিপি পিছন ঘুরেই দেখে ছাদের প্যারাপিট দেওয়ালের একাংশ ভেঙ্গে রাহুল নীচে পড়ে .....চারিদিকে রক্তে ভিজে যাচ্ছে ...দৌড়ে নিচুতে চিৎকার করতে করতে নেমে আসে ....হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ।
  জামাইষষ্ঠীর আসন পাতা।সামনে উপকরণ সুন্দর করে সাজানো ...প্রদীপটা সকলের অলক্ষ্যে কখন যেন নিভে গেছে ....শববাহী গাড়ি হাজির...শ্বশুরবাড়ি থেকে পূণরায় চন্দনের ফোঁটা আর গলায় রজনীগন্ধার মালা পরে রাহুল রওনা দিলো চিরদিনের মত।সারা পৃথিবীতে রাহুল ছিলো একাই।তার কোন আত্মীয়স্বজন ছিলোনা।ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো অফিস কলিগ লিপিকাকে।যেখান থেকে সে জীবনের নূতন ইনিংস শুরু করেছিলো আজ সেখান থেকেই তার জীবনের শেষ ইনিংসটা খেলে গেলো।
    তারপর এ বাড়িতে আর ষষ্ঠী হয়নি।দিদি সেই থেকে ষষ্ঠীতে আসা বন্ধ করেছে। আজও আসেনি।ভীষন জোরে বৃষ্টি শুরু হল।বৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই লতি ও বিভাস এসে পৌঁছেছে।মা এবার ওদের ষষ্ঠী দেবেন।লিপি সকলের অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে ছাদে উঠে গেলো।না,সে নিজের ইচ্ছাতে আসেনি।কেউ যেন তাকে ঠেলে নিয়ে এসেছে।ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে।লিপি ছাদে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়ানো।কোনদিকে তার যেন কোন খেয়াল নেই।নিজ মনেই ভিজে চলেছে।হঠাৎ একটি আলোর ঝলকানিতে সামনে তাকিয়ে দেখে ....'কে কে ও ...হ্যাঁ হ্যাঁ রাহুল তো ...ওই তো সেই হাতে ক্যামেরা ...লাল টি শার্ট আর কালো জিন্স পরা ...হাসছে খুব হাসছে ...একি এতো রক্ত কেন ছাদে ...এতো রক্ত কোথা দিয়ে আসলো ...রাহুল ...কোথায় গেলো ..রা ...হু...ল।
  যখন লিপির জ্ঞান ফিরলো তখন বাড়ির সকলে তাকে ঘিরে আছে।মা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
--এই বাড়িতে আজ থেকে আর কখনো জামাইষষ্ঠী হবেনা।

Monday, July 1, 2019

একলা থাকা


#একলা_থাকা
         নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
সব সম্পর্ক চিরজীবনের নয়
মাঝ পথেই কত সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়,
তবুও বারবার পিছন ফিরে তাকাই
হারানো দিনগুলি ফিরে পেতে চাই।
হয়না বলা অনেক কথা
জমা হয় বুকে গভীর ব্যথা,
শুরুতেই যা হয়ে যায় শেষ
আজীবন শুধু থাকে তার রেশ।
হৃদয়ে হয় কত রক্তক্ষরণ
সহস্রবার ক্ষতবিক্ষত,
জীবন মানেই একলা থাকা
কষ্ট নিয়েই বেঁচে থাকা।