অদ্ভুত অনুভূতি
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
স্মৃতির জানলাটা তখনই খুলে যায় যখন নন্দিতা এসে তার ছোট্ট ব্যালকনিটাই বসে।এই জায়গাটা প্রত্যুষেরও খুব প্রিয় ছিলো।অজস্র ছোটবড় ফুলের টবে নানান জাতের ফুলের গন্ধের ভিতর নন্দিতা আজও প্রত্যুষের গায়ের গন্ধ পায়।সকালে দাঁত ব্রাশ করেই প্রত্যুষ পেপারটা নিয়ে এখানেই ঘন্টা দেড় দুয়েকের ব্যবধানে দুকাপ চা শেষ করতো।অফিস থেকে এসেও ফ্রেশ হয়ে সে এখানেই বসতো।সকালের দিকে নন্দিতার সময় পেতোনা।কিন্তু সন্ধ্যায় প্রত্যুষ ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেই সেও চা,জলখাবার নিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসতো।আর গল্প চলতো সেই ডিনারের পূর্ব পর্যন্ত।বেশ কয়েকবছর ধরে এটাই ছিলো ওদের জীবনের রুটিন।ছুটির দিনগুলিতে প্রত্যুষ ব্যস্ত থাকতো তার গাছপালা নিয়ে।আর নন্দিতা মাঝে মাঝে চা নিয়ে এসে হাসি মুখে স্বামীর পাশে দাঁড়াতো। প্রত্যুষ হেসে পড়ে বলতো,
--এই জন্যই তোমায় এতো ভালোবাসি দিতি।আমার কখন কি চাই সেটা না বলতেই কেমন বুঝে যাও।
--অনেক বেলা হল গো।এবার গিয়ে স্নান করে নাও।
--এই আর একটু।দেখো জিনিয়া গাছটাই কেমন কুঁড়ি ধরেছে।গাছের গোড়াটা একটু আলগা করে দিই।আরে এরা সকলেই আমার সন্তান।যত্ন না করলে সুন্দর ফুল দেবে কেন?
নন্দিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
--সে তুমি ঠিক বলেছো।গর্ভের সন্তানকে কত যত্ন করে মানুষ করলাম।না,একটু ভুল বললাম,মানুষ নয় বড় করলাম।সেই আমাদের কথা ভাবলো না---
--ভুল করছো গো--সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব প্রত্যেকটা বাবা মায়ের।বাবা, মা কিন্তু সন্তানের কাছ থেকে কিছুই আশা করেনা।তারা ভালো থাক,সুখি থাক এটাই প্রত্যেক বাবামায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য।হ্যাঁ বড় হয়ে তারা তাদের শিক্ষা,রুচি,মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে যদি নিজেকে নিয়ে সুখি হতে চায় আমার মতে সেখানে কথা না বলায় ভালো।যত কথা বাড়াবে অশান্তি তত বাড়বে।সন্তানের সুখই যখন কাম্য তাদেরকে তাদের মতই থাকতে দাও।
--তাইবলে বৃদ্ধ বয়সে তারা বাবামাকে দেখবে না?
--যদি নাই দেখে ক্ষতি কি?ঈশ্বরের কাছে সুস্থ্য সন্তান কামনা করেছিলাম তখন তো ঈশ্বরের কাছে এটা চেয়েছিলাম না যে বৃদ্ধ বয়সে সে যেন আমাদের দেখে।
--ওসব ভেবোনা।প্রতীক ভালো আছে,সুখে আছে এর চেয়ে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে বলো?এই তো দুজনে বেশ আছি।আমি যখন থাকবোনা তখন তোমার কোন কষ্ট হবে নাগো।
--যত সব অলুক্ষুণে কথা।আজকাল মুখে তোমার কিছুই আটকায়না।
দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো।হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘুমের মাঝেই প্রত্যুষ একদিন তার দিতিকে ছেড়ে চলে গেলো।ছেলেকে ফোন করেছিলো নন্দিতা।সে ছুটি পাবেনা জানিয়ে দিয়েছে মাকে।সে হয়তো ছেলেকে জানাতোও না।কিন্তু আত্মীয়স্বজনের মন রাখতেই ফোনটা করতে সে বাধ্য হয়েছিলো।না,ছেলের কথাতে সে অবাক হয়নি।সে জানতো এতো স্বার্থপর ছেলে তার সে কখনোই বাবার মুখাগ্নী করতে আসবেনা।আগে মাঝেমধ্যে তাও ফোন করতো।কিন্তু বিয়ের পর থেকেই ছেলেটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।প্রত্যুষ বা নন্দিতা কখনোই পরের মেয়েকে দোষারোপ করেনা।নিজের ছেলেই যখন বাবামাকে ত্যাগ করেছে তখন পরের মেয়েকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
নিজের হাতে নন্দিতা তার স্বামীকে শেষবারের মত সাজিয়ে দেয়।সর্বক্ষণের সঙ্গী তার অবিবাহিত সেজদি।এই দিদিই তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে,বিয়ে দিয়েছে।বাবা তো সেই কবে ছেলেবেলায় মারা গেছেন।সেজদি ভালো চাকরী করতেন।বাবার মৃত্যুর পর সংসারের জোয়াল কাঁধে এসে পড়ায় সেজদির আর বিয়ের কথা মা উত্থাপনও করেননা।মা তিন দিদি,নন্দিতা, ভাই --সকলকে নিয়ে সে এক বিরাট সংসার।সেজদি একাই চাকুরে।বিপাকে পড়লে সকলেই কেমন স্বার্থপর হয়ে যায়।এই স্বার্থপরের তালিকায় অনেক সময় বাবামা ও থাকেন । চাকুরী করা মেয়ে সে যদি বিয়ে করে চলে যায় তখন সংসারটা ভেসে যাবে। তাই এক সন্তানের ত্যাগের বিনিময়ে অন্যদের সুখের ব্যবস্থা করা।একে একে বড়দি,মেজদি,ছোড়দি সকলের বিয়েই নন্দিতার সেজদি দেয়।সকলের ছোট ভাই আর নন্দিতা গ্রাজুয়েশন করে।দু'জনেই চাকরীর চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু এরই মধ্যে সেজদির অফিস সোশালে নন্দিতাকে দেখে সদ্য চাকরী পাওয়া তরুণ প্রত্যুষের খুব পছন্দ হয়ে যায়।সে সরাসরি এসে নন্দিতার সেজদির কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সেজদি নিরুপমা এতো ভালো পাত্র তার আদরের ছোটবোনের জন্য হাতছাড়া করেনা।মাস ছয়েকের মধ্যেই সে নন্দিতার বিয়ে দিয়ে দেয় প্রত্যুষের সঙ্গে।
নন্দিতা খাটে শোয়া তার স্বামীকে আগলে বসে আছে মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।চোখের থেকে অবিরাম জল পড়ে চলেছে।অনেকেই চেষ্টা করেছে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু পারেনি।পাড়ার ছেলেরা এসে বললো,
---এবার বডি নিয়ে যাবো।বৌদিকে তোমরা ঘরে নিয়ে যাও।
খুব আস্তে আস্তে নন্দিতা ছেলেটির মুখের দিকে তাকালো তারপর অতি ধীরভাবে বললো,
--বডি বোলনা ওকে তোমরা।আমার কানে ভীষন বাজছে কথাটা।ওকে তো তোমরা প্রত্যুষদা বলতে।সেটাই বলো।
নন্দিতার সেজদি এগিয়ে এসে জোর করে তাকে ঘরে নিয়ে আসে।বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়।কিন্তু সেজদি থেকে যায় নন্দিতার সাথে।কিন্তু কতদিন?মায়ের বয়স নব্বই বছর।ভাই বিয়ে করেছে।তারও সন্তান আছে।তার উপর নির্ভর করে মাকে তো দিনের পর দিন ফেলে রাখা যায়না?তাছাড়া এই বয়সে ধকল নিতে পারবেননা বলে তার ছোট জামাই এর দুর্ঘটনাটা লুকিয়ে যাওয়া হয়েছে।নন্দিতা অবশ্য অনেকবারই দিদিকে বলেছে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা।
একসময় সেজদিও বাড়ি চলে যায়।বিশাল দোতলা বাড়িতে নন্দিতা একা।কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তেই সে প্রত্যুষের উপস্থিতি টের পায়।সেদিন যখন প্রত্যুষকে নিয়ে কাঁচঢাকা গাড়িতে সকলে বেরিয়ে যায় সেজদি ওকে সাথে করে উপরে নিয়ে আসে।নিজের শোয়ার খাটে বসে নন্দিতার নাকে একটা কফ সিরাপের গন্ধ আসে।ঠান্ডা লাগলে বা কখনো কাশি হলে প্রত্যুষ এই সিরাপটা খেতো।নন্দিতা তখন আস্তে আস্তে দিদিকে বলে,
--দিদি,প্রত্যুষ কিন্তু আমার সাথে উপরে উঠে এসছে।ওর সিরাপটার গন্ধ বেরোচ্ছে।সেজদি ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
---কেন পাগলামী করছিস সোনা?যে চলে যায় সে চিরতরেই চলে যায়।
---আমি তো সে কথা অস্বীকার করছিনা দিদি।কিন্তু কেন জানি মনেহচ্ছে প্রত্যুষ আমায় ছেড়ে যায়নি।ও তো জানে আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা।
সেই শুরু।প্রত্যুষ থাকতে হয়তো কোন জিনিস নন্দিতা খুঁজে পাচ্ছেনা তখন ওর সাথেই প্রত্যুষ ও খুঁজতে শুরু করে দিতো।সে রান্নাঘরের সাঁড়াশি থেকে শুরু করে আলমারীর ভিতরের কাপড়,সায়া,ব্লাউজ পর্যন্ত।ঠিক খুঁজে বের করে হাসতে হাসতে ওর হাতের কাছে এনে দিতো।ও চলে যাওয়ার পরেও মাঝে মাঝে কোন জিনিস খুঁজে না পেলে হঠাৎ করেই সেটি চোখের সামনে দেখতে পেয়েছে।প্রত্যুষ চা খেতে খুব ভালোবাসতো।আজকাল এই নেশাটা নন্দিতাকেও পেয়ে বসেছে।
ভূত নন্দিতা কোনদিনও বিশ্বাস করেনা।এই অনুভূতিগুলি যখন তার হয় তখন সে ভয় যে পায় তাও কিন্তু না।কাজের মেয়ে জয়িতা মাঝে মাঝে তাকে বলেছে,
---বৌদি তুমি তোমার শোবার ঘরে না থাকলে আমার ওই ঘর মুছতে গেলে কেমন ভয় ভয় করে।দাদা মনেহয় ওই ঘরেই থাকে জানো?
জয়িতাকে জোরে এক তাড়া দিয়ে ওঠে নন্দিতা।তার অনুভূতিটাকে সে অন্যকারও সাথেই শেয়ার করতে চায়না।থাকুক না তার প্রত্যুষ সশরীরে না হোক অশরীরেই তার কাছে।
এমন অনেক কথা থাকে এমন অনেক কষ্ট ব্যথা থাকে যা সারাজীবনেও কারও সাথে ভাগ করা যায়না।এমন অনেক অনুভূতি যা নিজের মনেও হয়তো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না।নন্দিতার জীবনে এ অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নিজেকেই নিজে দিতে পারেনা।বিশাল বাড়িতে এই অদ্ভুত অনুভূতিটুকুই প্রত্যুষকে হারিয়ে তার বেঁচে থাকার রসদ হয়ে উঠেছে।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
স্মৃতির জানলাটা তখনই খুলে যায় যখন নন্দিতা এসে তার ছোট্ট ব্যালকনিটাই বসে।এই জায়গাটা প্রত্যুষেরও খুব প্রিয় ছিলো।অজস্র ছোটবড় ফুলের টবে নানান জাতের ফুলের গন্ধের ভিতর নন্দিতা আজও প্রত্যুষের গায়ের গন্ধ পায়।সকালে দাঁত ব্রাশ করেই প্রত্যুষ পেপারটা নিয়ে এখানেই ঘন্টা দেড় দুয়েকের ব্যবধানে দুকাপ চা শেষ করতো।অফিস থেকে এসেও ফ্রেশ হয়ে সে এখানেই বসতো।সকালের দিকে নন্দিতার সময় পেতোনা।কিন্তু সন্ধ্যায় প্রত্যুষ ব্যালকনিতে গিয়ে বসলেই সেও চা,জলখাবার নিয়ে ওর পাশে গিয়ে বসতো।আর গল্প চলতো সেই ডিনারের পূর্ব পর্যন্ত।বেশ কয়েকবছর ধরে এটাই ছিলো ওদের জীবনের রুটিন।ছুটির দিনগুলিতে প্রত্যুষ ব্যস্ত থাকতো তার গাছপালা নিয়ে।আর নন্দিতা মাঝে মাঝে চা নিয়ে এসে হাসি মুখে স্বামীর পাশে দাঁড়াতো। প্রত্যুষ হেসে পড়ে বলতো,
--এই জন্যই তোমায় এতো ভালোবাসি দিতি।আমার কখন কি চাই সেটা না বলতেই কেমন বুঝে যাও।
--অনেক বেলা হল গো।এবার গিয়ে স্নান করে নাও।
--এই আর একটু।দেখো জিনিয়া গাছটাই কেমন কুঁড়ি ধরেছে।গাছের গোড়াটা একটু আলগা করে দিই।আরে এরা সকলেই আমার সন্তান।যত্ন না করলে সুন্দর ফুল দেবে কেন?
নন্দিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
--সে তুমি ঠিক বলেছো।গর্ভের সন্তানকে কত যত্ন করে মানুষ করলাম।না,একটু ভুল বললাম,মানুষ নয় বড় করলাম।সেই আমাদের কথা ভাবলো না---
--ভুল করছো গো--সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব প্রত্যেকটা বাবা মায়ের।বাবা, মা কিন্তু সন্তানের কাছ থেকে কিছুই আশা করেনা।তারা ভালো থাক,সুখি থাক এটাই প্রত্যেক বাবামায়ের একমাত্র উদ্দেশ্য।হ্যাঁ বড় হয়ে তারা তাদের শিক্ষা,রুচি,মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে যদি নিজেকে নিয়ে সুখি হতে চায় আমার মতে সেখানে কথা না বলায় ভালো।যত কথা বাড়াবে অশান্তি তত বাড়বে।সন্তানের সুখই যখন কাম্য তাদেরকে তাদের মতই থাকতে দাও।
--তাইবলে বৃদ্ধ বয়সে তারা বাবামাকে দেখবে না?
--যদি নাই দেখে ক্ষতি কি?ঈশ্বরের কাছে সুস্থ্য সন্তান কামনা করেছিলাম তখন তো ঈশ্বরের কাছে এটা চেয়েছিলাম না যে বৃদ্ধ বয়সে সে যেন আমাদের দেখে।
--ওসব ভেবোনা।প্রতীক ভালো আছে,সুখে আছে এর চেয়ে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে বলো?এই তো দুজনে বেশ আছি।আমি যখন থাকবোনা তখন তোমার কোন কষ্ট হবে নাগো।
--যত সব অলুক্ষুণে কথা।আজকাল মুখে তোমার কিছুই আটকায়না।
দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো।হঠাৎ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ঘুমের মাঝেই প্রত্যুষ একদিন তার দিতিকে ছেড়ে চলে গেলো।ছেলেকে ফোন করেছিলো নন্দিতা।সে ছুটি পাবেনা জানিয়ে দিয়েছে মাকে।সে হয়তো ছেলেকে জানাতোও না।কিন্তু আত্মীয়স্বজনের মন রাখতেই ফোনটা করতে সে বাধ্য হয়েছিলো।না,ছেলের কথাতে সে অবাক হয়নি।সে জানতো এতো স্বার্থপর ছেলে তার সে কখনোই বাবার মুখাগ্নী করতে আসবেনা।আগে মাঝেমধ্যে তাও ফোন করতো।কিন্তু বিয়ের পর থেকেই ছেলেটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে।প্রত্যুষ বা নন্দিতা কখনোই পরের মেয়েকে দোষারোপ করেনা।নিজের ছেলেই যখন বাবামাকে ত্যাগ করেছে তখন পরের মেয়েকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
নিজের হাতে নন্দিতা তার স্বামীকে শেষবারের মত সাজিয়ে দেয়।সর্বক্ষণের সঙ্গী তার অবিবাহিত সেজদি।এই দিদিই তাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে,বিয়ে দিয়েছে।বাবা তো সেই কবে ছেলেবেলায় মারা গেছেন।সেজদি ভালো চাকরী করতেন।বাবার মৃত্যুর পর সংসারের জোয়াল কাঁধে এসে পড়ায় সেজদির আর বিয়ের কথা মা উত্থাপনও করেননা।মা তিন দিদি,নন্দিতা, ভাই --সকলকে নিয়ে সে এক বিরাট সংসার।সেজদি একাই চাকুরে।বিপাকে পড়লে সকলেই কেমন স্বার্থপর হয়ে যায়।এই স্বার্থপরের তালিকায় অনেক সময় বাবামা ও থাকেন । চাকুরী করা মেয়ে সে যদি বিয়ে করে চলে যায় তখন সংসারটা ভেসে যাবে। তাই এক সন্তানের ত্যাগের বিনিময়ে অন্যদের সুখের ব্যবস্থা করা।একে একে বড়দি,মেজদি,ছোড়দি সকলের বিয়েই নন্দিতার সেজদি দেয়।সকলের ছোট ভাই আর নন্দিতা গ্রাজুয়েশন করে।দু'জনেই চাকরীর চেষ্টা করতে থাকে।কিন্তু এরই মধ্যে সেজদির অফিস সোশালে নন্দিতাকে দেখে সদ্য চাকরী পাওয়া তরুণ প্রত্যুষের খুব পছন্দ হয়ে যায়।সে সরাসরি এসে নন্দিতার সেজদির কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। সেজদি নিরুপমা এতো ভালো পাত্র তার আদরের ছোটবোনের জন্য হাতছাড়া করেনা।মাস ছয়েকের মধ্যেই সে নন্দিতার বিয়ে দিয়ে দেয় প্রত্যুষের সঙ্গে।
নন্দিতা খাটে শোয়া তার স্বামীকে আগলে বসে আছে মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।চোখের থেকে অবিরাম জল পড়ে চলেছে।অনেকেই চেষ্টা করেছে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু পারেনি।পাড়ার ছেলেরা এসে বললো,
---এবার বডি নিয়ে যাবো।বৌদিকে তোমরা ঘরে নিয়ে যাও।
খুব আস্তে আস্তে নন্দিতা ছেলেটির মুখের দিকে তাকালো তারপর অতি ধীরভাবে বললো,
--বডি বোলনা ওকে তোমরা।আমার কানে ভীষন বাজছে কথাটা।ওকে তো তোমরা প্রত্যুষদা বলতে।সেটাই বলো।
নন্দিতার সেজদি এগিয়ে এসে জোর করে তাকে ঘরে নিয়ে আসে।বাড়ি ফাঁকা হয়ে যায়।কিন্তু সেজদি থেকে যায় নন্দিতার সাথে।কিন্তু কতদিন?মায়ের বয়স নব্বই বছর।ভাই বিয়ে করেছে।তারও সন্তান আছে।তার উপর নির্ভর করে মাকে তো দিনের পর দিন ফেলে রাখা যায়না?তাছাড়া এই বয়সে ধকল নিতে পারবেননা বলে তার ছোট জামাই এর দুর্ঘটনাটা লুকিয়ে যাওয়া হয়েছে।নন্দিতা অবশ্য অনেকবারই দিদিকে বলেছে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা।
একসময় সেজদিও বাড়ি চলে যায়।বিশাল দোতলা বাড়িতে নন্দিতা একা।কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তেই সে প্রত্যুষের উপস্থিতি টের পায়।সেদিন যখন প্রত্যুষকে নিয়ে কাঁচঢাকা গাড়িতে সকলে বেরিয়ে যায় সেজদি ওকে সাথে করে উপরে নিয়ে আসে।নিজের শোয়ার খাটে বসে নন্দিতার নাকে একটা কফ সিরাপের গন্ধ আসে।ঠান্ডা লাগলে বা কখনো কাশি হলে প্রত্যুষ এই সিরাপটা খেতো।নন্দিতা তখন আস্তে আস্তে দিদিকে বলে,
--দিদি,প্রত্যুষ কিন্তু আমার সাথে উপরে উঠে এসছে।ওর সিরাপটার গন্ধ বেরোচ্ছে।সেজদি ওকে জড়িয়ে ধরে বলে,
---কেন পাগলামী করছিস সোনা?যে চলে যায় সে চিরতরেই চলে যায়।
---আমি তো সে কথা অস্বীকার করছিনা দিদি।কিন্তু কেন জানি মনেহচ্ছে প্রত্যুষ আমায় ছেড়ে যায়নি।ও তো জানে আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা।
সেই শুরু।প্রত্যুষ থাকতে হয়তো কোন জিনিস নন্দিতা খুঁজে পাচ্ছেনা তখন ওর সাথেই প্রত্যুষ ও খুঁজতে শুরু করে দিতো।সে রান্নাঘরের সাঁড়াশি থেকে শুরু করে আলমারীর ভিতরের কাপড়,সায়া,ব্লাউজ পর্যন্ত।ঠিক খুঁজে বের করে হাসতে হাসতে ওর হাতের কাছে এনে দিতো।ও চলে যাওয়ার পরেও মাঝে মাঝে কোন জিনিস খুঁজে না পেলে হঠাৎ করেই সেটি চোখের সামনে দেখতে পেয়েছে।প্রত্যুষ চা খেতে খুব ভালোবাসতো।আজকাল এই নেশাটা নন্দিতাকেও পেয়ে বসেছে।
ভূত নন্দিতা কোনদিনও বিশ্বাস করেনা।এই অনুভূতিগুলি যখন তার হয় তখন সে ভয় যে পায় তাও কিন্তু না।কাজের মেয়ে জয়িতা মাঝে মাঝে তাকে বলেছে,
---বৌদি তুমি তোমার শোবার ঘরে না থাকলে আমার ওই ঘর মুছতে গেলে কেমন ভয় ভয় করে।দাদা মনেহয় ওই ঘরেই থাকে জানো?
জয়িতাকে জোরে এক তাড়া দিয়ে ওঠে নন্দিতা।তার অনুভূতিটাকে সে অন্যকারও সাথেই শেয়ার করতে চায়না।থাকুক না তার প্রত্যুষ সশরীরে না হোক অশরীরেই তার কাছে।
এমন অনেক কথা থাকে এমন অনেক কষ্ট ব্যথা থাকে যা সারাজীবনেও কারও সাথে ভাগ করা যায়না।এমন অনেক অনুভূতি যা নিজের মনেও হয়তো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না।নন্দিতার জীবনে এ অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা নিজেকেই নিজে দিতে পারেনা।বিশাল বাড়িতে এই অদ্ভুত অনুভূতিটুকুই প্রত্যুষকে হারিয়ে তার বেঁচে থাকার রসদ হয়ে উঠেছে।