আমার চাচা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
হঠাৎ করে আমাদের গ্রামের হারুনচাচার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।ছেলেবেলার অনেক ঘটনা একসময়ের অনেক প্রিয় বা কাছের মানুষ বড় হওয়ার সাথে সাথে স্মৃতির পাতা থেকে গাছের শুকনো ঝরে যাওয়া পাতার মত হারিয়ে যায়।হারুনচাচার বাড়ি ছিলো আমাদের গ্রামেই।গরীব পরিবার হলেও যেটুকু জমি ছিলো দু'বেলা পেট ভরে খাওয়ার সংস্থান ছিলো।হারুনচাচার একটা খুব সুন্দর গুণ ছিলো।পুকুরে,নদীতে,খালে-বিলে খুব সুন্দর জাল ফেলতে পারতো।আর সেইসব মাছ বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতো।প্রথমেই সে মাছ নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতো।আমার বাবাকে দাদা আর মাকে বৌদি বলে ডাকতো।যদিও বাবা তার থেকে অনেকটাই বড় ছিলেন।তার মাছের প্রথম খদ্দের ছিলেন আমার বাবা।আমাদের পুকুরে জাল ফেলতে হলে হারুনচাচাকেই ডাকা হত।সে সব কয়েক যুগ আগের কথা।কিন্তু সেই চাচাকে কলকাতা শহরের এক বেসরকারী হাসপাতালে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে একটু অবাকই হই।প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি।রোগীর কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় সে যখন ঘটনার বিবৃতি দিচ্ছে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনতে শুনতেই তাকে চিনতে পারি।সেই মুহূর্তে তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় না গিয়ে রোগীকে সুস্থ্য করে তোলাটাই আমার কাছে জরুরী মনে হয়।আঘাত বিশেষ গুরুতর ছিলোনা। রিক্সা থেকে পড়ে গিয়ে সামান্য কেঁটে ছিড়ে গেছিলো।মাথায় দুটো সেলাই ও দিতে হয়েছে।পরদিনই তার মেয়েকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।হিসাবপত্র জানতে গিয়ে শোনে সব টাকা পেমেন্ট হয়ে গেছে।কাউন্টার থেকে তাকে ডক্টর দাসের সাথে তার চেম্বারে দেখা করতে বলা হয়।বৃদ্ধ হারুনচাচা আমার চেম্বারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
---স্যার আমায় ডেকেছেন।
---ভিতরে আসুন।
চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললাম।চাচা না বসেই আমায় হাত জোড় করে বললেন,
---আমার মেয়েটার আর কোন অসুবিধা হবেনা তো স্যার?
---না, না কোন অসুবিধা হবেনা।চাচা ও কি তোমার মেয়ে?
---কেন স্যার দেখলে মনে হয়না বুঝি?
---না,তা নয়।চাচা আমি কে জানো?
চাচা ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
---কেন আপনি ডাক্তার সাহেব।
---তুমি আমায় চিনতে পারোনি চাচা।আমি হলাম পিলজঙ্গ গ্রামের অধীর দাসের ছেলে বিনয়।
চাচা একগাল হেসে বললেন,
---তুমি আমাদের বিনু?কত বড় মানুষ হয়েছো।শুনেছিলাম দাদা মানে তোমার বাবার কাছে কলকাতায় থেকে তুমি ডাক্তারী পড়ছো।সে তো অনেককাল আগের কথা।দাদা মারা যাওয়ার পর আর তোমাদের বাড়িতে যেতামনা।বৌদি মাছ খেতো না।মাছ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম।তারপর একদিন শুনলাম তুমি ডাক্তারী পাশ করে বৌদিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছো।খুব ভালো করেছো বাবা।তা বৌদি এখন কেমন আছেন?
---মা আছেন এই বয়সে যেটুকু ভালো থাকা যায় আর কি?তা তুমি এখন কি করো চাচা?
---টানা রিক্সা চালায় বাবা।বাপ বেটিতে চলে যায়।
---আর চাচী?
---বিয়েই তো করিনি বাপ, চাচী কোথা দিয়ে আসবে?
---কিন্তু তোমার মেয়ে?
---সে অনেক কথা বাপ।পরে দেখা হলে একদিন বলবো।
চাচার জীবনের ঘটনা জানার জন্য মনটা উসখুস করতে লাগলো।কিন্তু চাচার সাথে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে।রাউন্ডে যেতে হবে।চাচাকে আমার একটা কার্ড দিলাম।বাইরে বেরিয়ে এসে একটা উবের ডেকে ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বললাম,
---চাচা অবশ্যই একদিন এসো মায়ের সাথে দেখা করতে।তোমার বৌমা আর নাতিকেও দেখে যাবে।
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস।বাড়িতে মায়ের সাথে মাঝে মধ্যেই চাচার কথা আলোচনা হয়।ইচ্ছা করে চাচার জীবনের কথা জানতে।একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি চাচা ড্রয়িংরুমে বসা।আভিজাত্যের প্রাচুর্যে আমার বাড়ি মোড়া হলেও মা ঠিক চাচাকে সোফায় বসিয়ে তার যথাযোগ্য আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেছেন।এবং আদেশ দিয়েছেন রাতে খেয়ে মেয়ের খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য।চাচা জড়োসড়ো হয়ে সোফার এককোণে বসে একমনে গল্প করে চলেছেন।ফ্রেস হয়ে এসে আমিও জাঁকিয়ে বসলাম গল্প করতে।মা উঠে গেলেন আমার স্ত্রীকে রান্নায় সাহায্য করতে।চাচার কাছে সরাসরি জানতে চাইলাম তার জীবনের ঘটনা।আজ আমি সমাজের যে উঁচুস্থরে রয়েছি তাতে অনেকেরই মনে হতে পারে একজন সামান্য রিক্সাওয়ালার জীবনের কথা জানতে আমি এতোটা উদগ্রীব কেন?হারুনচাচা হয়তো তার জীবিকার প্রয়োজনে আজ একজন টানা রিক্সাওয়ালা।তার পরিচয় আমার কাছে সে আমার বাবাকে দাদা বলে ডাকতেন। পরিবারিক যে কোন বিপদআপদে তাকে কাছে পাওয়া যেতো।সে আমার খুব কাছের মানুষ একজন।চাচা প্রথমে একটু আমতা আমতা করলেও পরে শুরু করলেন।
আব্বা,আম্মুর মৃত্যুর পর গ্রামে থাকতে আর মন চায়তো না।ট্রেনে চেপে হঠাৎ একদিন কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।গ্রামে বাস করা মূর্খ মানুষ।কিছুই চিনিনা।হাওড়া স্টেশনে নেমে মানুষের ভিড় দেখে আমি তো দিশেহারা।কোথায় যাবো কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।কিছু টাকাকড়ি নিয়েই বেরিয়েছিলাম।রাতে শোয়ার জন্য স্টেশনের একটা বেঞ্চিকে বেছে নিলাম।পকেটের টাকা আস্তে আস্তে খরচ হচেছ আর একটু একটু করে আমার বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।একদিন রাতে বেঞ্চে শুয়ে আছি হঠাৎ একজন আমার কানের কাছে 'কুলি কুলি' বলে ডাকতে লাগলো।ধড়মর করে উঠে বসলে ভদ্রলোক বললেন তার ব্যাগটা তার সাথে নিয়ে গেলে তিনি আমায় মোটা বকসিস দেবেন।ঘুমের মধ্যে কিছুই না বুঝে তার ভারী ব্যাগটা নিয়ে তার সাথে হাঁটতে শুরু করলাম।সেই শুরু গুলিগিরি করা।কিন্তু বেশিদিন এ কাজ করতে পারিনি।কুলিদের মধ্যেও হিংসা,রেষারেষি মাঝে মধ্যে আবার মারপিটও হত।এই সময় কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিলো।এর মধ্যে একজন রিক্সাচালক ছিলো।সে বালিগঞ্জ এলাকার বস্তিতে থাকতো।তারই সহায়তায় নিজের জমানো পুঁজি আর কিছু বাকীতে আমি একটা হাতেটানা রিক্সা কিনি।ওই রিক্সাচালক রমেশের বস্তিতেই একটা ঘর ভাড়া নিই।একা মানুষ বেশ চলছিলো জীবন।একদিন বেশ রাতের দিকে আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পার হয়ে যখন রিক্সা নিয়ে বস্তিতে ফিরছি তখন দেখি চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি মেয়ের কোলে ছোট একটি বাচ্চা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে আর কিছু যুবক ওই মেয়েটির হাত ধরে টানছে।রিক্সাটা রাস্তার পাশে রেখে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাঁধা দিলাম।বাচ্চা মেয়েটিকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে একজায়গায় বসিয়ে ওদের সাথে লড়তে লাগলাম।তখন গায়ে বলও ছিলো বেশ।মেয়েটিও চেঁচাচ্ছে সঙ্গে আমিও।কিছুক্ষণের মধ্যে কিছু লোক ওখানে জড়ো হয়ে যাওয়ায় ওদের মধ্যে একজন হঠাৎ করে মেয়েটির বুকে ছুড়ি বসিয়ে একনিমেষে পালিয়ে গেলো।আমি দৌড়ে মেয়েটির কাছে গেলাম।রক্তে ভেসে যাচেছ রাস্তা।কোন রকমে আমায় বললো,"ভাই আমার বীথিকে দেখো"।সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এসে মরদেহ তুলে নিয়ে গেলো আর যাবার সময় আমায় নির্দেশ দিয়ে গেলো আমি যেন শিশুটিকে নিয়ে যাই।সংসার নেই আমার,একটা হিন্দু ঘরের বাচ্চা মেয়ে।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাচ্চাটিকে নিয়ে বস্তিতে ফিরলাম।রমেশকে সব জানলাম।সেই আমায় সাহস দিলো।আর সত্যি বলতে কি ওই সামান্য সময়েই বাচ্চাটির প্রতি আমার খুব মায়া পরে গেছিলো।সারাদিন রিক্সা টানি আর অনেক রাতে ফিরি।আমি যখন ঘরে থাকিনা তখন বীথি রমেশের বৌ এর কাছেই থাকে।আমায় দেখতে পেলে ঝাঁপিয়ে আমার কোলে আসে।আমি পিতৃত্বের স্বাদ পেলাম।
আমার বীথি আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো।আর তার আধো আধো কথায় আমি একাই হেসে মরতাম।জীবনটা অন্য খাতে বইতে শুরু করলো।ওকে স্কুলে ভর্তি করলাম।পড়াশুনায় খুব ভালো সে।নিজে সারাটাদিন টানা রিক্সা চালালেও ওকে কোনদিন আমি কোন কষ্ট পেতে দিইনি।কখনো কোন প্রাইভেট শিক্ষক ওকে দিতে পারিনি।সম্পূর্ণ নিজের পরিশ্রমে ও আজ বারোক্লাস পরীক্ষা দিলো।আরও পড়তে চায় ও।বলেছে প্রচুর খরচ এখনকার পড়ার।ওই যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে যে পরীক্ষা দিতে হয় সেই পরীক্ষাও দিয়েছে।আমারও বয়স হয়েছে।আগের মত আর হেঁটে হেঁটে রিক্সা নিয়ে বেরোতে পারিনা। তাই খুঁজে খুঁজে তোমার ঠিকানাটা বের করে তোমার কাছে আসলাম একটা কাজের সন্ধান দিতে পারো কিনা।
এতক্ষণ বসে চাচার জীবনের কথা শুনছিলাম মন্ত্রমূগ্ধের মত।গ্রামের একজন অশিক্ষিত সামান্য গরীব মানুষ,শহরে এসে চালচুলোহীন অবস্থায় সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি শিশুর জন্য যে এতোটা করতে পারে তাকে পায়ে হাত দিয়ে আমার প্রণাম করতে ইচ্ছা করছিলো।মা খাবার খেতে ডাক দিলেন। চাচাকে মা আমার সাথে টেবিলেই খেতে দিলেন।আমাদের বাড়িতে কোনদিনও কোন জাত পাতের বিচার দেখিনি।আমাদের বাড়িতে পূজা-পার্বণের দিনে হিন্দু মুসলমান সকলেই দেখেছি এক সাথে কাজে হাত লাগাতো।আজও তার ব্যতিক্রম নেই।আমার স্ত্রী একটু আপত্তি করলেও মায়ের কাছে তা ধোপে টেকেনি।
খাওয়াদাওয়ার পর মা একটা টিফিন বক্সে চাচার মেয়ের জন্য খাবার গুছিয়ে দিলেন।বারবার করে বলে দিলেন মেয়েকে নিয়ে একদিন আসার জন্য।চাচা যাওয়ার সময় আমি বললাম,"চাচা এতদিন ধরে আমার না দেখা বোনটির জন্য তুমি যা করেছো তার কোন তুলনা নেই।তুমি তো দেবতা চাচা। যা করেছো তুমি তোমার সাধ্যের বাইরে গিয়ে করেছো।আর তোমাকে ভাবতে হবেনা।আমার ছোট্ট বোনটির বাকি পড়াশুনার দায়িত্বটা আমি নিলাম।ওকে নিয়ে তুমি একদিন আমার বাড়িতে চলে এসো।ওর সাথে আমি কথা বলবো ও কি পড়তে চায়।তুমি কিচ্ছু চিন্তা করনা।আর আমি দেখছি নার্সিংহোমে তোমার কোন কাজের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।"
চাচা জল ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"আল্লাহতালা তোমার ভালো করুন।মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তায় ছিলাম।আজ আমার সব চিন্তার অবসান হোল।"
চাচা বেরিয়ে গেলেন।মানুষের মধ্যেই যে দেবতার বাস সেটা জীবনে প্রথম উপলব্ধি করলাম।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
হঠাৎ করে আমাদের গ্রামের হারুনচাচার সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।ছেলেবেলার অনেক ঘটনা একসময়ের অনেক প্রিয় বা কাছের মানুষ বড় হওয়ার সাথে সাথে স্মৃতির পাতা থেকে গাছের শুকনো ঝরে যাওয়া পাতার মত হারিয়ে যায়।হারুনচাচার বাড়ি ছিলো আমাদের গ্রামেই।গরীব পরিবার হলেও যেটুকু জমি ছিলো দু'বেলা পেট ভরে খাওয়ার সংস্থান ছিলো।হারুনচাচার একটা খুব সুন্দর গুণ ছিলো।পুকুরে,নদীতে,খালে-বিলে খুব সুন্দর জাল ফেলতে পারতো।আর সেইসব মাছ বাড়ি বাড়ি বিক্রি করতো।প্রথমেই সে মাছ নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতো।আমার বাবাকে দাদা আর মাকে বৌদি বলে ডাকতো।যদিও বাবা তার থেকে অনেকটাই বড় ছিলেন।তার মাছের প্রথম খদ্দের ছিলেন আমার বাবা।আমাদের পুকুরে জাল ফেলতে হলে হারুনচাচাকেই ডাকা হত।সে সব কয়েক যুগ আগের কথা।কিন্তু সেই চাচাকে কলকাতা শহরের এক বেসরকারী হাসপাতালে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে একটু অবাকই হই।প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি।রোগীর কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় সে যখন ঘটনার বিবৃতি দিচ্ছে তখন তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনতে শুনতেই তাকে চিনতে পারি।সেই মুহূর্তে তার সাথে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় না গিয়ে রোগীকে সুস্থ্য করে তোলাটাই আমার কাছে জরুরী মনে হয়।আঘাত বিশেষ গুরুতর ছিলোনা। রিক্সা থেকে পড়ে গিয়ে সামান্য কেঁটে ছিড়ে গেছিলো।মাথায় দুটো সেলাই ও দিতে হয়েছে।পরদিনই তার মেয়েকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।হিসাবপত্র জানতে গিয়ে শোনে সব টাকা পেমেন্ট হয়ে গেছে।কাউন্টার থেকে তাকে ডক্টর দাসের সাথে তার চেম্বারে দেখা করতে বলা হয়।বৃদ্ধ হারুনচাচা আমার চেম্বারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
---স্যার আমায় ডেকেছেন।
---ভিতরে আসুন।
চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললাম।চাচা না বসেই আমায় হাত জোড় করে বললেন,
---আমার মেয়েটার আর কোন অসুবিধা হবেনা তো স্যার?
---না, না কোন অসুবিধা হবেনা।চাচা ও কি তোমার মেয়ে?
---কেন স্যার দেখলে মনে হয়না বুঝি?
---না,তা নয়।চাচা আমি কে জানো?
চাচা ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
---কেন আপনি ডাক্তার সাহেব।
---তুমি আমায় চিনতে পারোনি চাচা।আমি হলাম পিলজঙ্গ গ্রামের অধীর দাসের ছেলে বিনয়।
চাচা একগাল হেসে বললেন,
---তুমি আমাদের বিনু?কত বড় মানুষ হয়েছো।শুনেছিলাম দাদা মানে তোমার বাবার কাছে কলকাতায় থেকে তুমি ডাক্তারী পড়ছো।সে তো অনেককাল আগের কথা।দাদা মারা যাওয়ার পর আর তোমাদের বাড়িতে যেতামনা।বৌদি মাছ খেতো না।মাছ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম।তারপর একদিন শুনলাম তুমি ডাক্তারী পাশ করে বৌদিকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছো।খুব ভালো করেছো বাবা।তা বৌদি এখন কেমন আছেন?
---মা আছেন এই বয়সে যেটুকু ভালো থাকা যায় আর কি?তা তুমি এখন কি করো চাচা?
---টানা রিক্সা চালায় বাবা।বাপ বেটিতে চলে যায়।
---আর চাচী?
---বিয়েই তো করিনি বাপ, চাচী কোথা দিয়ে আসবে?
---কিন্তু তোমার মেয়ে?
---সে অনেক কথা বাপ।পরে দেখা হলে একদিন বলবো।
চাচার জীবনের ঘটনা জানার জন্য মনটা উসখুস করতে লাগলো।কিন্তু চাচার সাথে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে।রাউন্ডে যেতে হবে।চাচাকে আমার একটা কার্ড দিলাম।বাইরে বেরিয়ে এসে একটা উবের ডেকে ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বললাম,
---চাচা অবশ্যই একদিন এসো মায়ের সাথে দেখা করতে।তোমার বৌমা আর নাতিকেও দেখে যাবে।
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস।বাড়িতে মায়ের সাথে মাঝে মধ্যেই চাচার কথা আলোচনা হয়।ইচ্ছা করে চাচার জীবনের কথা জানতে।একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি চাচা ড্রয়িংরুমে বসা।আভিজাত্যের প্রাচুর্যে আমার বাড়ি মোড়া হলেও মা ঠিক চাচাকে সোফায় বসিয়ে তার যথাযোগ্য আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেছেন।এবং আদেশ দিয়েছেন রাতে খেয়ে মেয়ের খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য।চাচা জড়োসড়ো হয়ে সোফার এককোণে বসে একমনে গল্প করে চলেছেন।ফ্রেস হয়ে এসে আমিও জাঁকিয়ে বসলাম গল্প করতে।মা উঠে গেলেন আমার স্ত্রীকে রান্নায় সাহায্য করতে।চাচার কাছে সরাসরি জানতে চাইলাম তার জীবনের ঘটনা।আজ আমি সমাজের যে উঁচুস্থরে রয়েছি তাতে অনেকেরই মনে হতে পারে একজন সামান্য রিক্সাওয়ালার জীবনের কথা জানতে আমি এতোটা উদগ্রীব কেন?হারুনচাচা হয়তো তার জীবিকার প্রয়োজনে আজ একজন টানা রিক্সাওয়ালা।তার পরিচয় আমার কাছে সে আমার বাবাকে দাদা বলে ডাকতেন। পরিবারিক যে কোন বিপদআপদে তাকে কাছে পাওয়া যেতো।সে আমার খুব কাছের মানুষ একজন।চাচা প্রথমে একটু আমতা আমতা করলেও পরে শুরু করলেন।
আব্বা,আম্মুর মৃত্যুর পর গ্রামে থাকতে আর মন চায়তো না।ট্রেনে চেপে হঠাৎ একদিন কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।গ্রামে বাস করা মূর্খ মানুষ।কিছুই চিনিনা।হাওড়া স্টেশনে নেমে মানুষের ভিড় দেখে আমি তো দিশেহারা।কোথায় যাবো কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।কিছু টাকাকড়ি নিয়েই বেরিয়েছিলাম।রাতে শোয়ার জন্য স্টেশনের একটা বেঞ্চিকে বেছে নিলাম।পকেটের টাকা আস্তে আস্তে খরচ হচেছ আর একটু একটু করে আমার বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।একদিন রাতে বেঞ্চে শুয়ে আছি হঠাৎ একজন আমার কানের কাছে 'কুলি কুলি' বলে ডাকতে লাগলো।ধড়মর করে উঠে বসলে ভদ্রলোক বললেন তার ব্যাগটা তার সাথে নিয়ে গেলে তিনি আমায় মোটা বকসিস দেবেন।ঘুমের মধ্যে কিছুই না বুঝে তার ভারী ব্যাগটা নিয়ে তার সাথে হাঁটতে শুরু করলাম।সেই শুরু গুলিগিরি করা।কিন্তু বেশিদিন এ কাজ করতে পারিনি।কুলিদের মধ্যেও হিংসা,রেষারেষি মাঝে মধ্যে আবার মারপিটও হত।এই সময় কিছু মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছিলো।এর মধ্যে একজন রিক্সাচালক ছিলো।সে বালিগঞ্জ এলাকার বস্তিতে থাকতো।তারই সহায়তায় নিজের জমানো পুঁজি আর কিছু বাকীতে আমি একটা হাতেটানা রিক্সা কিনি।ওই রিক্সাচালক রমেশের বস্তিতেই একটা ঘর ভাড়া নিই।একা মানুষ বেশ চলছিলো জীবন।একদিন বেশ রাতের দিকে আমি বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পার হয়ে যখন রিক্সা নিয়ে বস্তিতে ফিরছি তখন দেখি চব্বিশ পঁচিশ বছরের একটি মেয়ের কোলে ছোট একটি বাচ্চা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে আর কিছু যুবক ওই মেয়েটির হাত ধরে টানছে।রিক্সাটা রাস্তার পাশে রেখে ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বাঁধা দিলাম।বাচ্চা মেয়েটিকে মায়ের কোল থেকে নিয়ে একজায়গায় বসিয়ে ওদের সাথে লড়তে লাগলাম।তখন গায়ে বলও ছিলো বেশ।মেয়েটিও চেঁচাচ্ছে সঙ্গে আমিও।কিছুক্ষণের মধ্যে কিছু লোক ওখানে জড়ো হয়ে যাওয়ায় ওদের মধ্যে একজন হঠাৎ করে মেয়েটির বুকে ছুড়ি বসিয়ে একনিমেষে পালিয়ে গেলো।আমি দৌড়ে মেয়েটির কাছে গেলাম।রক্তে ভেসে যাচেছ রাস্তা।কোন রকমে আমায় বললো,"ভাই আমার বীথিকে দেখো"।সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ এসে মরদেহ তুলে নিয়ে গেলো আর যাবার সময় আমায় নির্দেশ দিয়ে গেলো আমি যেন শিশুটিকে নিয়ে যাই।সংসার নেই আমার,একটা হিন্দু ঘরের বাচ্চা মেয়ে।সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাচ্চাটিকে নিয়ে বস্তিতে ফিরলাম।রমেশকে সব জানলাম।সেই আমায় সাহস দিলো।আর সত্যি বলতে কি ওই সামান্য সময়েই বাচ্চাটির প্রতি আমার খুব মায়া পরে গেছিলো।সারাদিন রিক্সা টানি আর অনেক রাতে ফিরি।আমি যখন ঘরে থাকিনা তখন বীথি রমেশের বৌ এর কাছেই থাকে।আমায় দেখতে পেলে ঝাঁপিয়ে আমার কোলে আসে।আমি পিতৃত্বের স্বাদ পেলাম।
আমার বীথি আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো।আর তার আধো আধো কথায় আমি একাই হেসে মরতাম।জীবনটা অন্য খাতে বইতে শুরু করলো।ওকে স্কুলে ভর্তি করলাম।পড়াশুনায় খুব ভালো সে।নিজে সারাটাদিন টানা রিক্সা চালালেও ওকে কোনদিন আমি কোন কষ্ট পেতে দিইনি।কখনো কোন প্রাইভেট শিক্ষক ওকে দিতে পারিনি।সম্পূর্ণ নিজের পরিশ্রমে ও আজ বারোক্লাস পরীক্ষা দিলো।আরও পড়তে চায় ও।বলেছে প্রচুর খরচ এখনকার পড়ার।ওই যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে গেলে যে পরীক্ষা দিতে হয় সেই পরীক্ষাও দিয়েছে।আমারও বয়স হয়েছে।আগের মত আর হেঁটে হেঁটে রিক্সা নিয়ে বেরোতে পারিনা। তাই খুঁজে খুঁজে তোমার ঠিকানাটা বের করে তোমার কাছে আসলাম একটা কাজের সন্ধান দিতে পারো কিনা।
এতক্ষণ বসে চাচার জীবনের কথা শুনছিলাম মন্ত্রমূগ্ধের মত।গ্রামের একজন অশিক্ষিত সামান্য গরীব মানুষ,শহরে এসে চালচুলোহীন অবস্থায় সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি শিশুর জন্য যে এতোটা করতে পারে তাকে পায়ে হাত দিয়ে আমার প্রণাম করতে ইচ্ছা করছিলো।মা খাবার খেতে ডাক দিলেন। চাচাকে মা আমার সাথে টেবিলেই খেতে দিলেন।আমাদের বাড়িতে কোনদিনও কোন জাত পাতের বিচার দেখিনি।আমাদের বাড়িতে পূজা-পার্বণের দিনে হিন্দু মুসলমান সকলেই দেখেছি এক সাথে কাজে হাত লাগাতো।আজও তার ব্যতিক্রম নেই।আমার স্ত্রী একটু আপত্তি করলেও মায়ের কাছে তা ধোপে টেকেনি।
খাওয়াদাওয়ার পর মা একটা টিফিন বক্সে চাচার মেয়ের জন্য খাবার গুছিয়ে দিলেন।বারবার করে বলে দিলেন মেয়েকে নিয়ে একদিন আসার জন্য।চাচা যাওয়ার সময় আমি বললাম,"চাচা এতদিন ধরে আমার না দেখা বোনটির জন্য তুমি যা করেছো তার কোন তুলনা নেই।তুমি তো দেবতা চাচা। যা করেছো তুমি তোমার সাধ্যের বাইরে গিয়ে করেছো।আর তোমাকে ভাবতে হবেনা।আমার ছোট্ট বোনটির বাকি পড়াশুনার দায়িত্বটা আমি নিলাম।ওকে নিয়ে তুমি একদিন আমার বাড়িতে চলে এসো।ওর সাথে আমি কথা বলবো ও কি পড়তে চায়।তুমি কিচ্ছু চিন্তা করনা।আর আমি দেখছি নার্সিংহোমে তোমার কোন কাজের ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।"
চাচা জল ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,"আল্লাহতালা তোমার ভালো করুন।মেয়েটাকে নিয়ে বড্ড চিন্তায় ছিলাম।আজ আমার সব চিন্তার অবসান হোল।"
চাচা বেরিয়ে গেলেন।মানুষের মধ্যেই যে দেবতার বাস সেটা জীবনে প্রথম উপলব্ধি করলাম।
No comments:
Post a Comment