কেমন ভালোবাসা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
নিলয়ের সাথে প্রথম দেখাটা প্রথম বর্ষে পড়ার সময়।নিলয়ের ছিলো তৃতীয় বর্ষ।প্রথম থেকেই দুজনের মধ্যে একটা ভালোলাগা কাজ করতো।হয়তো পরষ্পর পরষ্পরকে ভালোও বাসতো।কিন্তু কেউ কোনদিনও তাদের দুর্বলতার কথা প্রকাশ করেনি।ঘটনাচক্রে উভয়ে এক আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরে।নিলয়ের দাদা ব্যাঙ্ককর্মী অপূর্বর সাথে রেখার দিদি সুলেখার বিয়ে হওয়াতে।সম্মন্ধ করেই বিয়ে।উভয়ের কেউই জানতোনা।বাড়ির অভিভাবকরা মিলে বিয়েটা ঠিক করেছিলেন।কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পর উভয়ের দেখা সাক্ষাৎ টাও সেভাবে আর হতনা।তখন ফোনেরও এতো রমরমা ছিলোনা।অনেকদিন পর উভয়ের দেখা হয় পরষ্পরের দাদা ও দিদির বিয়ের ছাদনাতলায়।আবারও নূতন করে সম্পর্কের দানা বেঁধে ওঠে।নিলয় অনেক চেষ্টা করেও একটা চাকরী জোগাড় করতে পারেনা।হয়তো আত্মমর্যাদাসচেতন নিলয় এই কারনেই রেখাকে তার মনের কথাটা মুখ ফুটে কোনদিনও বলতে পারেনা।দিদির বিয়ের দিনে একটু ফাঁকা পেয়ে রেখা নিলয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলো,
---তুমি কবে বিয়ে করবে নিলয়দা?
হো হো করে হাসতে হাসতে নিলয় বলেছিলো,
---বেকার ছেলের গলায় কেউ মালা দেয়না রেখা।
---কাউকে ভালোবাসো?
উদাস হয়ে নিলয় উত্তর দিয়েছিলো,
---আচ্ছা রেখা, তুমি বলো তো বেকার ছেলের ভালোবাসার কি কোন অধিকার থাকে?
রেখা কোন উত্তর দেওয়ার আগেই রেখাকে তার বান্ধবীরা টেনে নিয়ে যায়।বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে নিলয়ের।গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে আজ টানা দু'বছর একটা চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কিন্তু সামান্যতমও আশার আলো সে দেখতে পাচ্ছেনা।তাই রেখাকে তার মনের কথাটাও বলতে পারছেনা।কিন্তু এটাও সে বুঝতে পারছে রেখাকে তার বাড়ির লোক তার চাকরী পাওয়া অবধি বসিয়ে রাখবেনা।তাই মনের কথাটা খুলে বলার আগে পায়ের তলার মাটিটা শক্ত করা দরকার।
পরিবারিক নানান অনুষ্ঠানে উভয়ের দেখা হয়।উভয়েই উদগ্রীব হয়ে থাকে একটু নিরিবিলি সান্নিধ্য পাওয়ার।অধিকাংশ সময় সেটা সম্ভবই হয়না।একদিন দিদির বাড়িতে বেড়াতে এসে দেখে দিদি ও নিলয় বসে গল্প করছে।রেখাকে হঠাৎ দেখে নিলয় এতটাই খুশি হয় যে সুলেখা মানে তার বৌদির চোখ এড়ায়না।চা করতে যাওয়ার অছিলায় সে তার আদরের বোন ও দেবরকে একটু কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে যায়।দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর রেখায় শুরু করে,
---চাকরীর কোন ব্যবস্থা হোল নিলয়দা?
---আমার কপালে ভগবান এ জীবনে চাকরী লেখেননি।
---অমন করে বোলোনা।একদিন দেখবে তুমি ঠিক চাকরী পাবে।
---সেদিন হয়তো জীবন থেকে অনেককিছু হারিয়ে যাবে।
---দেখবে কিছুই হারাবেনা।যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকবে।
---জানিনা রেখা নিজের ভাগ্যের উপর আমার কোন আস্থা নেই।
দেখতে দেখতে আরও দু'বছর কেটে গেলো।সুলেখার ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে হয়েছে।মেয়েটি নিলয়ের প্রাণ।না, নিলয় আজও বেকার!সামান্য কয়েকটি টিউশনি করে নিজের হাত খরচ টুকু জোগাড় করে।
রেখা হন্তদন্ত হয়ে একদিন দিদির বাড়ি উপস্থিত।দিদি জানতে চাওয়ায় সে তাকে জানায় বাবা,মা তার বিয়ে ঠিক করছেন।
---ছেলে কি করে?
---সরকারি চাকরী।
---বাহ!এতো খুব ভালো কথা।
---কিন্তু দিদি-----
কথাটা শেষ হয়না।অপূর্ব এসে ঘরে ঢোকে।
---রেখা কখন এলে?কি শলাপরামর্শ চলছে দিদি আর বোনের?
---বাবা,মা রেখার বিয়ে ঠিক করছেন ছেলে সরকারি চাকরী করে।একমাত্র ছেলে,নিজেদের বাড়ি।
---বাহ!বাহ!এতো দারুন খবর!
রেখা এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে কোথাও নিলয়কে সে দেখতে পায়না।পুঁচকিটাকে কোলে নিয়ে দিদির পিছন পিছন রান্নাঘরের দিকে এগোতে এগোতে জানতে চায়,
---দিদি,নিলয়দা বাড়িতে নেই?
ওরা যে পরস্পরকে ভালোবাসে এটা সুলেখা অনেক আগেই টের পেয়েছে।কিন্তু নিলয় বেকার । সম্পর্কটাকে স্থায়ী করতে গেলে নিলয়ের একটা চাকরীর অবশ্যই দরকার।সবকিছু বুঝেও সুলেখা না বোঝার ভান করে থাকে বোনের ভবিষৎ ভেবে।রেখার কথার উত্তরে বলে সে,
--আজ দু'দিন ধরে নিলয়টা বাড়িতে নেই।ও চেন্নাই গেছে আমাদের এক আত্মীয়ের শরীর খুব খারাপ। তাকে নিয়ে ডক্টর দেখানোর জন্য।
---ও!
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে রেখা বলে।
সুলেখা বোনকে বুঝাতে থাকে সম্মন্ধটা খুব ভালো,তুই খুব সুখি হবি।বাবারও বয়স হয়ে গেছে।তোর বিয়েটা দিয়ে যেতে পারলে তিনিও শান্তি পাবেন।তুই রাজি হয়ে যা।জীবনে অনেককিছু বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয় নিজের আর সকলের মঙ্গলের কথা ভেবে।বলতে পারিস মেয়েদের পুরো জীবনটাকেই স্যাক্রিফাইস করতে হয় অপরের মঙ্গলের জন্য।রাজি হয়ে যা বোন, মরিচিকার পিছনে ছুটিসনা।
দু'মাস পরে যখন নিলয় আত্মীয়কে সুস্থ্য করে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরলো তখন রেখা অন্যের ঘরণী।না,রেখা তার বাবা,মায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি, জানাতে পারেনি তাদেরকে তার ভালোবাসার কথা,পারেনি বাবা,মা ও দিদির সম্মানহানি হয় এমন কোন কাজ করতে,পারেনি দু'টি পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা এনে দিদির সুখের রাস্তার কাঁটা হতে।এই এতগুলো না পারার মাঝে শুধু পেরেছে নিজের ভালোবাসার বলিদান দিতে।
বিয়ের পর দু'বছরের মধ্যে নিলয়ের সাথে আর রেখার দেখা হয়নি।রেখা এক সন্তানের জননী।এই দু'বছরে বাপের বাড়িতে আসলেও কোনদিন দিদির বাড়িতে আসেনি।কারন সে চায়নি নিলয়ের মুখোমুখি হতে। দিদিও খুব একটা জোর করেনি কোনদিন।
নিলয়ের বয়স এখন চৌত্রিশ বছর।বছর তিনেক আগে সে কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছিলো।সে নিজেও ভুলে গেছিলো সে কথা।এই বয়সে এসে হঠাৎ করে সে যে একটা সরকারি চাকরী পাবে এটা সে কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবেনি।ভাবেনি তার বাড়ির লোকও।এই চাকরীর জন্যই সে তার ভালাবাসা হারিয়েছে।যতটা আনন্দিত হওয়ার কথা ছিলো চাকরী পেয়ে ঠিক ততটা আনন্দিত হতে সে পারেনি।এখন রেখার মেয়ের বয়স প্রায় তিন বছর।রেখার বিয়ের পর তার সাথে আর নিলয়ের দেখা হয়নি।
কেটে গেছে আরও বেশ কয়েকটা বছর।রেখা আজ খুব সুখি।অবশ্য সেটা বাইরের লোকের কাছে।প্রথম ভালোবাসা তার অন্তরে আজও লুকানো।যখনই একা থাকে তখনই সে তার ভালোলাগা ভালোবাসার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসে।না,আজও সে নিলয়কে ভুলতে পারেনি।দিদির কাছ থেকে জেনেছে নিলয় এই বয়সে এসে সরকারি চাকরী পেয়েছে।জীবনের প্রথম প্রেমটাকে সে মেরে ফেলতে পারেনি।তাই তো আজও একাকী থাকলে তার একাকীত্বকে সঙ্গ দেয় তার চোখের জল।
আর নিলয়?না,বাড়ির লোক তাকে বিয়েতে রাজি করাতে পারেনি।মনের দিক থেকে দুমড়ে-মুচড়ে গেলেও কেউ তার মুখে কোনদিনও রেখার নাম পর্যন্ত শোনেনি।সবকিছুতেই সে উদাসীন।একমাত্র ভাইঝি দিশার সাথেই তার যত গল্প,হাসি, আনন্দ।অফিস বাড়ি আর লোকের বিপদ-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়া আর হাতে কাজ না থাকলে পুরনো দিনের গান শোনা।হয়তো গানের মাঝেই সে খুঁজে পেতে চায় তার অব্যক্ত ভালোবাসাকে।
কেটে গেছে আরও বেশ কয়েকটি বছর।রেখা বিয়ের পর কোনদিনও দিদির বাড়িতে আসেনি।হঠাৎ একদিন অপূর্ব দুপুর নাগাদ রেখার বাড়ি উপস্থিত।সেখানে পৌঁছেই রেখাকে তাগাদা দেয় খুব তাড়াতাড়ি তার সাথে বেরোনোর জন্য।অজানা আশঙ্কায় রেখার বুকটা কেঁপে ওঠে।
---অপুদা কার কি হয়েছে?
---অফিস থেকে ফেরার পথে নিলয়ের একটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।হাসপাতালে ভর্তি।তোমার দিদি তোমায় নিতে পাঠিয়েছে।নিলয় তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছে।
ডুকরে কেঁদে ওঠে রেখা।অপূর্ব তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
---একদম দেরি করিসনা বোন।অবস্থা বিশেষ ভালো নয়।চল বেরিয়ে পড়ি।
হাসপাতালে এসে রেখা দেখে দিদির বাড়ির সকলে সেখানে উপস্থিত।রেখাকে দেখতে পেয়ে তার দিদি তাকে নিয়ে উপরে নিলয়ের কাছে যায়।রেখা কেঁদেই চলেছে দেখে বলে,
---আমি জানি রে তোরা দু'জনকে দু'জন কতটা ভালোবাসিস।কিন্তু সব ভালোবাসা বিয়েতেই পূর্ণতা পায়না রে।এতদিন সে কখনোই তোর কথা কাউকে বলেনি।সারাজীবন বিয়ে না করে শুধু নীরবে তোকে ভালোবেসেই গেছে।এই প্রথম সে আমায় ডেকে বললো,"বৌদি একবার রেখাকে দেখতে চাই।যা বোন আমি বাইরে আছি তুই ওর সাথে গিয়ে কথা বল।"
রেখার দু'চোখের জলের ধারা যেন কিছুতেই আজ আর বন্ধ হয়না।নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে নিলয়ের বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে খুব আস্তে আস্তে ডাকলো,
---নিলয়দা,আমি এসেছি।চোখ খোলো নিলয়দা।
অতি কষ্টে নিলয় চোখ খুলে তাকালো।
---খুব দেখতে ইচ্ছা করছিলো তোমায়।একটা কথা সেই কলেজ লাইফ থেকে তোমায় বলবো বলবো করেও বলতে পারিনি রেখা।
---তুমি এতো কথা বোলোনা।তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
---আজ আর বাঁধা দিওনা।আর সময় পাবোনা।
---তুমি ভালো হয়ে যাবে নিলয়দা।
---রেখা,কলেজে প্রথম দেখার দিন থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগতো।সেই ভালোলাগা কবে যে ভালোবাসায় পরিণত হয়েছিলো আমি নিজেও জানিনা।কিন্তু কোনদিনও বলতে পারিনি কারন আমার বেকারত্ব।আজও আমি তোমায় সেই আগের মতই ভালোবাসি।তোমায় অধিকার আমি অন্য কাউকেই দিতে পারিনি।এই কথাগুলি না বলে গেলে আমি যে মরেও শান্তি পাবোনা।
রেখা কাঁদদে কাঁদদে বলে,
---সব জানি নিলয়দা।তুমি আমার অপারগতা ক্ষমা কোরো।
কথাগুলো বলে নিলয় প্রচন্ড হাঁফাতে লাগে।চেষ্টা করে একটা হাত চাদরের বাইরে আনে।রেখা হাতটা ধরে।খুব ধীরে ধীরে পরম শান্তিতে নিলয় চোখ দুটি বন্ধ করে।সিস্টার কাছেই ছিলেন। রেখা তাকে ডেকে বেডের কাছে আনে।তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে কল করেন।নিলয় চলে যায় ভেন্টিলেশনে।ডক্টর জানতে চান,
---কে হন আপনি?
সত্যিই তো রেখা নিলয়ের কে হয়?একটু ঢোক গিলে রেখা বলে,
---বন্ধু।
---আমাদের আর কিছুই করার নেই।বাড়ির লোককে মেন্টালি প্রস্তুতি নিতে বলুন।আমরা অবশ্য পেসেণ্ট পার্টিকে আগেই জানিয়ে দিয়েছি।
কাঁদদে কাঁদদে রেখা বেরিয়ে এলো।বাইরে দিদিকে দেখতে পেয়ে দিদিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। সুলেখা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
---চুপ চুপ এভাবে কাঁদেনা।কেউ দেখে ফেলবে।নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।মেয়েদের যে পদে পদে বিপদ।এতদিন ধরে নীরবে যে মানুষটাকে ভালোবেসে গেছিস,কারও কাছে কোনদিনও প্রকাশ করিসনি কেউ,সেই মানুষটার চলে যাওয়ার দিনে তাকে সম্মানের সাথেই যেতে দে।চল নীচুতে চল।
শেষ