আজ তিয়াসা আর নিলয়ের ফুল শয্যা। সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো খাটে তিয়াসাকে নিয়ে বাড়ির বউ, মেয়েরা ইয়ার্কি ঠাট্টায় মেতেছে।হঠাৎ একজনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
-- এই রে দুটো বাজে,সবাই চল।নিলয়টা এই হিমের মধ্যে সেই থেকে বাইরে অপেক্ষা করছে।
সকলে যে যার মত হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। তিতাসা আপাদমস্তক ফুল এবং সোনার গয়নায় সজ্জিত হয়ে গুটিসুটি মেরে খাটের মাঝখানে বসে তার জীবনের বহু আকাঙ্খিত রাতটির জন্য। কিন্তু সময় তো বয়েই চলেছে নিলয়ের কোন পাত্তা নেই।এক সময় তিয়াসার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।তার বারবার হাই উঠতে থাকে। সে একটা বালিশে মাথা দিয়ে সবে শুয়েছে এরমধ্যে দরজা দেওয়ার শব্দে পুনরায় উঠে বসতে গেলে নিলয় তাকে বলে,
--- উঠতে হবে না। তোমার ঘুম পেয়েছে বুঝতে পারছি।ঘুমিয়ে পরো। আজ আর কোন কথা নয়। কাল সব কথা হবে।
তিয়াসা উঠে বসেছিল।নিলয় কথা শেষ করে বিছানার থেকে মাথার বালিশটা নিয়ে সোফার দিকে এগোতে লাগলে তিতাসা প্রচণ্ড অবাক হয়ে তাকে বলে,
--- তুমি খাটে শোবে না?
নিলয় কিছুটা থমকে যায়। পিছন ফিরেই উত্তর দেয়
--- কিছু কথা আমার বলার আছে । আজ খুব টায়ার্ড আছি। কিন্তু কথাগুলো তোমাকে বলার খুব দরকার। আজ রাতটা যাক কাল সব বলবো। তুমি খাটে শুয়ে পরো আমি সোফায় শুচ্ছি।
বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিয়ে মনের মধ্যে সুখের সংসারের স্বপ্নকে লালিত করে বিয়ের পিঁড়িতে বসা তিয়াসা নতুন জীবনের শুরুতেই এ ধাক্কাটা খেয়ে কী বলবে কিংবা কী করবে বুঝতে না পেরে একটা আহত পাখির মত নাইট ল্যাম্পের আলোয় কিছুক্ষণ- শুয়ে থাকা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে একবুক কষ্ট নিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে।বুক চিরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে।বুঝতে পারে তার জীবনটা শুরু হতে চলেছে ফুলশয্যায় নয় কাঁটা মোড়া শয্যায়!কিন্তু একটু আগে যে রাজ্যের ঘুম তার দু'চোখ জুড়ে ছিল সেই ঘুম যেন এক অদৃশ্য মায়াবলে কোথায় উধাও হয়ে গেছে। সারাটা রাত আর তার ঘুম আসেনি।
পরদিন সকালবেলা সবই স্বাভাবিক। তিয়াসা ঘুম থেকে উঠে দেখে নিলয় তখনো সোফায় শুয়ে। সে স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখে নিলয় তার মাথার বালিশ আর গায়ের চাদরটা ভাঁজ করে খাটের উপর রেখে গেছে। কাল রাতের টাটকা ফুলগুলো আজ শুকিয়ে সব নেতিয়ে পড়েছে। ঠিক তার জীবনের স্বপ্ন দেখা রাতটির মত।একটা প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ এনে তিয়াসা সমস্ত ফুলগুলো ব্যাগের ভিতর পুরে খাটটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিচুতে নামে। নিলয় আর তার বাবা ডাইনিংয়ে বসে চা খাচ্ছিলেন। তিয়াসাকে দেখতে পেয়ে তিনি বলে উঠলেন,
-- আয় মা এখানে এসে বোস। জানিস তো মা আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। আজ সে অভাবটা আমার পূরণ হয়েছে তুই এ বাড়িতে বউ নয় মেয়েই হয়ে থাকবি। আমার আর তোর মায়ের কাছে আবদার করবি। এই যে নীলুকে দেখছিস একে কিচ্ছু তোর বলতে হবে না। আমি তো বাড়িতে বউ আনিনি একটা মেয়ে এনেছি। মেয়ে মানেই ঘরের লক্ষী। তুই এ বাড়ির লক্ষী।
তিয়াসা চুপ করে তার শ্বশুরের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।তিনি অনর্গল কথা বলেই চলেছেন এরই মাঝে শ্বাশুড়ী নীলিমা নিজের ও তার পুত্রবধূটির জন্য চা নিয়ে এসে বসলেন একটা চেয়ার টেনে।স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
--- ওরে তুমি এবার একটু থামো। সেই থেকে কথা বলেই চলেছ। হ্যাঁরে মা তুই বোয়াল মাছ খাস তো?
তিয়াসা মাথা নেড়ে "না" বলতেই নীলিমা স্বামীর দিকে মুখ করে বলে উঠলেন,
--- নিজে যা যা ভালো খায় আজ তাই বাজার করে নিয়ে এসেছে। আমি বলেছিলাম বোয়াল মাছ সকলে পছন্দ করে না।ছেলেকে বললেন,
--- এই নীলু তুই একবার বাজার যা তো।অন্য কোন মাছ নিয়ে আয়।
নিলয় চা খাওয়া শেষ করে পেপার নিয়ে পড়ছিল। মায়ের কথা শুনে একটু বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
--- কেন তোমার ফ্রিজে আর কোন মাছ নেই।আজকের দিনটা চালিয়ে দাও না - কাল ---
কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াসা খুব আস্তে বলল,
--- মা, যা আছে আজ তাই দিয়েই খাবো।নতুন করে আবার বাজারে যাওয়ার দরকার নেই।
নীলিমার হঠাৎ মনে পড়ল ফ্রিজে তো গলদা চিংড়ি রয়েছে।তিনি বললেন,
--- ও হরি! আমি তো ভুলেই গেছিলাম ফ্রিজে তো গলদা চিংড়ি রয়েছে।নিলয়ের আইবুড়ো ভাত দিতে আনা হয়েছিল।কিছু রান্না হয়েছিল আর কিছু ফ্রীজে রেখেছিলাম।আজ তাহলে চিংড়ির মালাইকারি করি।বোয়াল কাল করবো।
--- তুমি চিংড়ির মালাইকারি করো আর আমি বাবার জন্য বোয়ালটা রান্না করি।
তিয়াসার কথা শুনে শ্বশুর অজয় হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
--- দেখো গিন্নি দেখো কেমন মেয়ে পছন্দ করেছি।
নিলয় তখন আড়চোখে তিয়াসাকে দেখে আবার পেপার পড়ায় মন দেয়। কিন্তু নিলয়ের এই আড়চোখে তাকানো তিয়াসার নজর এড়ায় না। কাল রাতের কথাগুলো তিয়াসার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেই থেকে। কালকে নিলয়ের বলা কথাগুলো এটাই প্রমাণ করে তারমানে এ বিয়েতে নিলয়ের কোন মত ছিলো না। সে হয়ত অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ির ব্যবহারে নিলয়ের কালকের বলা কথাগুলো একটু সময়ের জন্য হলেও ভুলে ছিল। কিন্তু নিলয়ের এই তাকানোতে আবার তারমধ্যে কিছুটা উদাস ভাব চলে আসে।নীলিমার কথায় তার সম্বিত ফেরে।
--- চল মা আমরা দু'জনে গিয়ে টিফিনটা করে ফেলি।
২.
কলেজ ফেস্টে গান শুনে নিলয়ের মত অনেক ছেলের বুকেই একটা সুর ধরিয়ে দিয়েছিল শ্রাবণী দত্ত।সুন্দরী শ্রাবণী অবশ্য কাউকেই পাত্তা দিত না। অনেক ছেলেই কারণে,অকারণে তার সাথে কথা বলতে এসেছে।ভদ্রতার খাতিরে তাদের সেসব কথার জবাব দিলেও কাউকেই সেভাবে কোনদিন অন্য কোন কথা বলার সুযোগ দেয়নি। নিজের ভিতর সব সময় একটা গাম্ভীর্য ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। কারণ সে জানতো তার রক্ষণশীল পরিবারের পিতামাতা কোনদিনও তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যখন সে কলেজে ভর্তি হয় তখনই তার বাবা তাকে ডেকে স্মরণ করিয়ে দেন,
-- ছেলেদের সাথে একসাথে পড়তে যাচ্ছ খুব ভালো কথা। সবাই সেখানে ক্লাসমেট এবং সেই নজরেই তাদের দেখো। কোন ছেলের সাথে বেশি মেলামেশা করতে যেও না। পড়াশুনা শেষ করো ওসব নিয়ে আমরা ভাববো পরে।
বাবার জীদ, বাবার রাগ সম্পর্কে ছোট থেকেই শ্রাবণী ওয়াকিবহাল। মা আজও বাবাকে জমের মত ভয় পান পান থেকে চুন খসলেই তিনি বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে তোলেন। বাড়িতে মাত্র তিনটে প্রাণী। মা,মেয়ে কেউই প্রয়োজন না হলে জেদী, রাগী,একগুঁয়ে মানুষটার সাথে কথা বলেন না।আর তিনিও নিজের মনেই থাকেন।
শ্রাবণীর বাবা সাত্যকী দত্ত বেসরকারি একটি কোম্পানির ম্যানেজার হিসাবে সৎ পথে চাকরি করার পর আজ বছর খানেক হল তিনি রিটায়ার করেছেন। অফিসে তিনি নরম স্বভাবের মানুষ হলেও বাড়িতে তার কথার উপর কেউ কথা বলতে পারে না।মা,মেয়ে সর্বদাই তার ভয়ে যুজুবুরি হয়ে থাকে।
কলেজ পিকনিকে সকলে যাচ্ছে। শ্রাবণীরও ইচ্ছা সে যাবে। কিন্তু বাবার ভয়ে সে কথাটা তাকে বলতেই পারছে না।মাকে গিয়ে বলায় তার মা ভয়ে ভয়ে স্বামীকে কথাটা জানান কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যান।কিন্তু সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ফিরতে হবে সে কথা জানিয়ে দেন।
ঠাকুরপুকুর কলেজের সামনের থেকেই বাস ছাড়ে। সকলে সময় মত সেখানে উপস্থিত হয়ে যায়।নির্দিষ্ট সময়ে বাস ডায়মন্ড হারবার গঙ্গার কাছে পিকনিক স্পটে চলে আসে। শ্রাবণী তার এক বন্ধুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে পিকনিক স্পট থেকে অনেকটা দুর চলে আসে। দুপুরে খাওয়ার সময় তাদের দেখতে না পেয়ে নিলয় ও তার এক বন্ধু তাদের খুঁজতে যায়। হঠাৎ তারা লক্ষ্য করে কিছুটা দূরে আর একটি পিকনিক দলের বেশ কয়েকটি ছেলে শ্রাবণী এবং তার বন্ধুকে মধ্যপ অবস্থায় ঘিরে ধরে উত্যক্ত করে চলেছে। কিছুতেই ওরা দু'জনে ওদের কাছ থেকে সরে আসতে পারছে না। নিলয় ও তার বন্ধু দৌড়ে গিয়ে তাদের রক্ষা করে।কিন্তু শ্রাবণীর ওড়নাটি তাদের দখলেই চলে যায়। কাঁধের কাছে জামার কিছুটা অংশও ছেড়া দেখতে পেয়ে নিলয় তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে তার দিকে এগিয়ে দেয়।
বিনা বাক্যব্যয়ে শ্রাবণী জ্যাকেটটা নিয়ে গায়ে পরে নেয়। সেই থেকেই শ্রাবণী একটু উদাস হয়ে যায় যা নিলয়ের চোখ এড়ায় না। নিলয় সুযোগ বুঝে শ্রাবনীকে বলে,
--- এতটা ভাবার কী আছে? যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ কী? এনজয় কর।
--- আমার একটা কথা আছে তোর সাথে --- তুই বাসের ভিতর আমার পাশে বসিস তখন বলবো --
নিলয়ের বুকের ভিতর তখন কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে --
ক্রমশ