Wednesday, November 30, 2022

একদিন ভালোবাসবে (প্রথম পর্ব)

একদিন ভালোবাসবে (প্রথম পর্ব)       

  আজ তিয়াসা আর নিলয়ের ফুল শয্যা। সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো খাটে তিয়াসাকে নিয়ে বাড়ির বউ, মেয়েরা ইয়ার্কি ঠাট্টায় মেতেছে।হঠাৎ একজনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
-- এই রে দুটো বাজে,সবাই চল।নিলয়টা এই হিমের মধ্যে সেই থেকে বাইরে অপেক্ষা করছে।
 সকলে যে যার মত হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলো। তিতাসা আপাদমস্তক ফুল এবং সোনার গয়নায় সজ্জিত হয়ে গুটিসুটি মেরে খাটের মাঝখানে বসে তার জীবনের বহু আকাঙ্খিত রাতটির জন্য। কিন্তু সময় তো বয়েই চলেছে নিলয়ের কোন পাত্তা নেই।এক সময় তিয়াসার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে।তার বারবার হাই উঠতে থাকে। সে একটা বালিশে মাথা দিয়ে সবে শুয়েছে এরমধ্যে দরজা দেওয়ার শব্দে পুনরায় উঠে বসতে গেলে নিলয় তাকে বলে,
--- উঠতে হবে না। তোমার ঘুম পেয়েছে বুঝতে পারছি।ঘুমিয়ে পরো। আজ আর কোন কথা নয়। কাল সব কথা হবে।
 তিয়াসা উঠে বসেছিল।নিলয় কথা শেষ করে বিছানার থেকে মাথার বালিশটা নিয়ে সোফার দিকে এগোতে লাগলে তিতাসা প্রচণ্ড অবাক হয়ে তাকে বলে,
--- তুমি খাটে শোবে না?
নিলয় কিছুটা থমকে যায়। পিছন ফিরেই উত্তর দেয়
--- কিছু কথা আমার বলার আছে । আজ খুব টায়ার্ড আছি। কিন্তু কথাগুলো তোমাকে বলার খুব দরকার। আজ রাতটা যাক কাল সব বলবো। তুমি খাটে শুয়ে পরো আমি সোফায় শুচ্ছি।
 বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিয়ে মনের মধ্যে সুখের সংসারের স্বপ্নকে লালিত করে বিয়ের পিঁড়িতে বসা তিয়াসা নতুন জীবনের শুরুতেই এ ধাক্কাটা খেয়ে কী বলবে কিংবা কী করবে বুঝতে না পেরে একটা আহত পাখির মত নাইট ল্যাম্পের আলোয় কিছুক্ষণ- শুয়ে থাকা নিলয়ের দিকে তাকিয়ে একবুক কষ্ট নিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ে।বুক চিরে একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসে।বুঝতে পারে তার জীবনটা শুরু হতে চলেছে ফুলশয্যায় নয় কাঁটা মোড়া শয্যায়!কিন্তু একটু আগে যে রাজ্যের ঘুম তার দু'চোখ জুড়ে ছিল সেই ঘুম যেন এক অদৃশ্য মায়াবলে কোথায় উধাও হয়ে গেছে। সারাটা রাত আর তার ঘুম আসেনি।
  পরদিন সকালবেলা সবই স্বাভাবিক। তিয়াসা ঘুম থেকে উঠে দেখে নিলয় তখনো সোফায় শুয়ে। সে স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখে নিলয় তার মাথার বালিশ আর গায়ের চাদরটা ভাঁজ করে খাটের উপর রেখে গেছে। কাল রাতের টাটকা ফুলগুলো আজ শুকিয়ে সব নেতিয়ে পড়েছে। ঠিক তার জীবনের স্বপ্ন দেখা রাতটির মত।একটা প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ এনে তিয়াসা সমস্ত ফুলগুলো ব্যাগের ভিতর পুরে খাটটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিচুতে নামে। নিলয় আর তার বাবা ডাইনিংয়ে বসে চা খাচ্ছিলেন। তিয়াসাকে দেখতে পেয়ে তিনি বলে উঠলেন,
-- আয় মা এখানে এসে বোস। জানিস তো মা আমার একটা মেয়ের খুব শখ ছিল। আজ সে অভাবটা আমার পূরণ হয়েছে তুই এ বাড়িতে বউ নয় মেয়েই হয়ে থাকবি। আমার আর তোর মায়ের কাছে আবদার করবি। এই যে নীলুকে দেখছিস একে কিচ্ছু তোর বলতে হবে না। আমি তো বাড়িতে বউ আনিনি একটা মেয়ে এনেছি। মেয়ে মানেই ঘরের লক্ষী। তুই এ বাড়ির লক্ষী।
  তিয়াসা চুপ করে তার শ্বশুরের কথাগুলো শুনে যাচ্ছে।তিনি অনর্গল কথা বলেই চলেছেন এরই মাঝে শ্বাশুড়ী নীলিমা নিজের ও তার পুত্রবধূটির জন্য চা নিয়ে এসে বসলেন একটা চেয়ার টেনে।স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
--- ওরে তুমি এবার একটু থামো। সেই থেকে কথা বলেই চলেছ। হ্যাঁরে মা তুই বোয়াল মাছ খাস তো? 
 তিয়াসা মাথা নেড়ে "না" বলতেই নীলিমা স্বামীর দিকে মুখ করে বলে উঠলেন,
--- নিজে যা যা ভালো খায় আজ তাই বাজার করে নিয়ে এসেছে। আমি বলেছিলাম বোয়াল মাছ সকলে পছন্দ করে না।ছেলেকে বললেন,
--- এই নীলু তুই একবার বাজার যা তো।অন্য কোন মাছ নিয়ে আয়।
 নিলয় চা খাওয়া শেষ করে পেপার নিয়ে পড়ছিল। মায়ের কথা শুনে একটু বিরক্তির সুরে বলে উঠলো,
--- কেন তোমার ফ্রিজে আর কোন মাছ নেই।আজকের দিনটা চালিয়ে দাও না - কাল ---
 কথা শেষ হওয়ার আগেই তিয়াসা খুব আস্তে বলল,
--- মা, যা আছে আজ তাই দিয়েই খাবো।নতুন করে আবার বাজারে যাওয়ার দরকার নেই।
 নীলিমার হঠাৎ মনে পড়ল ফ্রিজে তো গলদা চিংড়ি রয়েছে।তিনি বললেন,
--- ও হরি! আমি তো ভুলেই গেছিলাম ফ্রিজে তো গলদা চিংড়ি রয়েছে।নিলয়ের আইবুড়ো ভাত দিতে আনা হয়েছিল।কিছু রান্না হয়েছিল আর কিছু ফ্রীজে রেখেছিলাম।আজ তাহলে চিংড়ির মালাইকারি করি।বোয়াল কাল করবো।
--- তুমি চিংড়ির মালাইকারি করো আর আমি বাবার জন্য বোয়ালটা রান্না করি।
 তিয়াসার কথা শুনে শ্বশুর অজয় হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,
--- দেখো গিন্নি দেখো কেমন মেয়ে পছন্দ করেছি।
 নিলয় তখন আড়চোখে তিয়াসাকে দেখে আবার পেপার পড়ায় মন দেয়। কিন্তু নিলয়ের এই আড়চোখে তাকানো তিয়াসার নজর এড়ায় না। কাল রাতের কথাগুলো তিয়াসার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেই থেকে। কালকে নিলয়ের বলা কথাগুলো এটাই প্রমাণ করে তারমানে এ বিয়েতে নিলয়ের কোন মত ছিলো না। সে হয়ত অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার শ্বশুর,শ্বাশুড়ির ব্যবহারে নিলয়ের কালকের বলা কথাগুলো একটু সময়ের জন্য হলেও ভুলে ছিল। কিন্তু নিলয়ের এই তাকানোতে আবার তারমধ্যে কিছুটা উদাস ভাব চলে আসে।নীলিমার কথায় তার সম্বিত ফেরে।
--- চল মা আমরা দু'জনে গিয়ে টিফিনটা করে ফেলি।

২. 
 কলেজ ফেস্টে গান শুনে নিলয়ের মত অনেক ছেলের বুকেই একটা সুর ধরিয়ে দিয়েছিল শ্রাবণী দত্ত।সুন্দরী শ্রাবণী অবশ্য কাউকেই পাত্তা দিত না। অনেক ছেলেই কারণে,অকারণে তার সাথে কথা বলতে এসেছে।ভদ্রতার খাতিরে তাদের সেসব কথার জবাব দিলেও কাউকেই সেভাবে কোনদিন অন্য কোন কথা বলার সুযোগ দেয়নি। নিজের ভিতর সব সময় একটা গাম্ভীর্য ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে। কারণ সে জানতো তার রক্ষণশীল পরিবারের পিতামাতা কোনদিনও তার পছন্দ করা ছেলের সাথে বিয়ে দেবেন না। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে যখন সে কলেজে ভর্তি হয় তখনই তার বাবা তাকে ডেকে স্মরণ করিয়ে দেন,
-- ছেলেদের সাথে একসাথে পড়তে যাচ্ছ খুব ভালো কথা। সবাই সেখানে ক্লাসমেট এবং সেই নজরেই তাদের দেখো। কোন ছেলের সাথে বেশি মেলামেশা করতে যেও না। পড়াশুনা শেষ করো ওসব নিয়ে আমরা ভাববো পরে।
  বাবার জীদ, বাবার রাগ সম্পর্কে ছোট থেকেই শ্রাবণী ওয়াকিবহাল। মা আজও বাবাকে জমের মত ভয় পান পান থেকে চুন খসলেই তিনি বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে তোলেন। বাড়িতে মাত্র তিনটে প্রাণী। মা,মেয়ে কেউই প্রয়োজন না হলে জেদী, রাগী,একগুঁয়ে মানুষটার সাথে কথা বলেন না।আর তিনিও নিজের মনেই থাকেন।
  শ্রাবণীর বাবা সাত্যকী দত্ত বেসরকারি একটি কোম্পানির ম্যানেজার হিসাবে সৎ পথে চাকরি করার পর আজ বছর খানেক হল তিনি রিটায়ার করেছেন। অফিসে তিনি নরম স্বভাবের মানুষ হলেও বাড়িতে তার কথার উপর কেউ কথা বলতে পারে না।মা,মেয়ে সর্বদাই তার ভয়ে যুজুবুরি হয়ে থাকে।
 কলেজ পিকনিকে সকলে যাচ্ছে। শ্রাবণীরও ইচ্ছা সে যাবে। কিন্তু বাবার ভয়ে সে কথাটা তাকে বলতেই পারছে না।মাকে গিয়ে বলায় তার মা ভয়ে ভয়ে স্বামীকে কথাটা জানান কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল তিনি এক কথায় রাজি হয়ে যান।কিন্তু সন্ধ্যার আগেই বাড়িতে ফিরতে হবে সে কথা জানিয়ে দেন।
   ঠাকুরপুকুর কলেজের সামনের থেকেই বাস ছাড়ে। সকলে সময় মত সেখানে উপস্থিত হয়ে যায়।নির্দিষ্ট সময়ে বাস ডায়মন্ড হারবার গঙ্গার কাছে পিকনিক স্পটে চলে আসে। শ্রাবণী তার এক বন্ধুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে পিকনিক স্পট থেকে অনেকটা দুর চলে আসে। দুপুরে খাওয়ার সময় তাদের দেখতে না পেয়ে নিলয় ও তার এক বন্ধু তাদের খুঁজতে যায়। হঠাৎ তারা লক্ষ্য করে কিছুটা দূরে আর একটি পিকনিক দলের বেশ কয়েকটি ছেলে শ্রাবণী এবং তার বন্ধুকে মধ্যপ অবস্থায় ঘিরে ধরে উত্যক্ত করে চলেছে। কিছুতেই ওরা দু'জনে ওদের কাছ থেকে সরে আসতে পারছে না। নিলয় ও তার বন্ধু দৌড়ে গিয়ে তাদের রক্ষা করে।কিন্তু শ্রাবণীর ওড়নাটি তাদের দখলেই চলে যায়। কাঁধের কাছে জামার কিছুটা অংশও ছেড়া দেখতে পেয়ে নিলয় তার গায়ের জ্যাকেটটা খুলে তার দিকে এগিয়ে দেয়।
  বিনা বাক্যব্যয়ে শ্রাবণী জ্যাকেটটা নিয়ে গায়ে পরে নেয়। সেই থেকেই শ্রাবণী একটু উদাস হয়ে যায় যা নিলয়ের চোখ এড়ায় না। নিলয় সুযোগ বুঝে শ্রাবনীকে বলে,
--- এতটা ভাবার কী আছে? যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ কী? এনজয় কর।
--- আমার একটা কথা আছে তোর সাথে --- তুই বাসের ভিতর আমার পাশে বসিস তখন বলবো --
 নিলয়ের বুকের ভিতর তখন কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে --

ক্রমশ 



  
    

Monday, November 28, 2022

মাথা তুলে বাঁচো

মাথা তুলে বাঁচো 
  দেবেশের মৃত্যুর পর ছোট ছোট দু'টি ছেলেমেয়ে নিয়ে রেখা খুবই অসহায় হয়ে পড়ে।একটা সাধারণ প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করা দেবেশ সঞ্চয় বলতে কিছুই রেখে যেতে পারেনি।কাজের দিনে এসে অফিসের কিছু লোক কয়েক হাজার টাকা দিয়ে গেলো।কাজটাই শুধু হল।কারণ তাদের অবস্থার কথা যেহেতু সকলেই জানত তাই ওইদিন আসার কথা বললে অধিকাংশ পরিবারই জানিয়েছে তারা শ্রাদ্ধ বাড়ি খায় না। এসেছেন তারা সকলেই কাগজের ছোট প্যাকেট মুড়ে যার যেমন ক্ষমতা সেইরূপ টাকা নিয়ে।একটা মিষ্টি আর একগ্লাস জল ছাড়া তারা কিছুই মুখে দেননি।
 দিশেহারা রেখা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না কী করে ছেলেমেয়ে দু'টিকে মানুষ করবে। শেষে ঠিক করলো যদি দু'একটা বাড়িতে সে রান্নার কাজ নেয় তাহলে মাস গেলে অন্তত কিছু টাকা তো আসবে। মাধ্যমিক পাশ করা বিদ্যেই এর চেয়ে বেশি আর কিইবা সে করতে পারে। মাথা গোঁজার মত একটু নিজস্ব ঠাঁই ছিল তাই বাঁচোয়া। তানাহলে তো বাচ্চা দুটোকে নিয়ে মাথার উপর ছাদ হারা হতে হত।
  একজন ক্লাস ফোর আর একজন ক্লাস সেভেন। কোন রকমে দিন চলে যেতে থাকে। সকাল সন্ধ্যা দুটি বাড়িতে রান্না করে যে টাকা আসে তাতে ডালভাত দু'বেলা জুঠে যায় তিনজনে। তাছাড়া বোসগিন্নি বেশ ভালো মানুষ।সময়ে অসময়ে কিছু খাবার আবার অনেক সময় কাচা শাকসবজি,মাছও দিয়ে দেন বাচ্চা দু'টির জন্য। আস্তে আস্তে ওরা বড় হতে থাকে আর ওদের পড়ার খরচ বাড়তে থাকে। গয়না দু'একটি যা ছিল সেগুলো একটু একটু করে বিক্রি করতে থাকে।কিন্তু সে টাকায় ক'দিন?
আস্তে আস্তে আরো দুটি বাড়ি রান্নার জন্য ধরে নেয়। ভোর পাঁচটা থেকে তার ছোটা শুরু হয়। একফাঁকে বাড়িতে এসে ঝটপট বাচ্চাদের স্কুলে বেরোনোর আগে কিছু রান্না করে রেখে যায়।সে কোনদিন ডালভাত কিংবা আলু সেদ্ধ ভাত। ছেলেমেয়ে দুটিই মায়ের এই পরিশ্রম দেখে যা মা জোগাড় করতে পারে তাই দিয়েই খেয়ে নেয়। কখনোই কোন অভিযোগ কোনদিন করেনি।ছেলেটি ছোট আর মেয়ে বড়।দেখতে দেখতে সময় চলে যায়।সামনেই মেয়ে মাধ্যমিক দেবে। রান্নাতেও মায়ের মত পটু। এখন সকালে রেখা বেরিয়ে একবারে সব বাড়ি কাজ সেরে তবে ঘরে ঢোকে।মেয়েই ভায়ের স্কুলের খাবার নিজেদের দুপুরের খাবার করে নেয়।
 মায়ের এই পরিশ্রম তারা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে বলেই তারা দিনরাত চেষ্টা করে পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। আস্তে আস্তে তারা ক্লাসে ভালো ফল করতেও শুরু করে।বড় মেয়ে রুমনা মাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে পাশ করে। যে সব বিষয় রুমনা বুঝতে পারতো না স্কুল শিক্ষকদের কাছে বিনা পয়সায় তারা তাকে পড়িয়েছেন।
 অনেক কষ্ট,অনেক পরিশ্রমের পর রুমনা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে স্পকিং ইংলিশ কোর্স শিখে একটা নার্সিংহোমে রিসেপশনিষ্টে কাজ পেয়ে যায় আর প্রাইভেটে গ্র্যাজুয়েশনটা করার চেষ্টা করতে থাকে। মাকে দুটো বাড়ির রান্না ছাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। ছেলের মাধ্যমিক রেজাল্টও খুব ভালো হয়। রুমনা এখন একটা সরকারি হাসপাতালের ক্লাক।আর ভাইকে এডুকেশন লোন নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে। রেখা এখন সব বাড়ির রান্নার কাজ ছেড়ে দিয়েছে। বাড়িতেই থাকে সব সময়।মেয়েকে বিয়ের কথা বললে বলে," ভাই পড়াশুনা শেষ করে চাকরি পাওয়ার পর ভেবে দেখবো।"
  সময় তো বসে থাকে না। যতই বিপদ আসুক না কেন ভয় না পেয়ে এগিয়ে চলার একটা বিকল্প রাস্তা খুঁজে নিতে পারলে জীবনটা কারো থেমে থাকে না।

 

Sunday, November 27, 2022

শান্তি খুঁজে নিতে হয়

শান্তি খুঁজে নিতে হয়

 সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করেও কারো মন রাখতে পারেনি কোনদিন সুষমা।অথচ মিষ্টি স্বভাবের এ মেয়েটির এরকম হওয়ার কথা ছিল না। মেধাবী সুষমা বিটেক করেই চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিল। বিয়েতে তার মত ছিল না মোটেই।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার ফলে ওর মনের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল ছিল ও যদি শ্বশুরবাড়ি চলে যায় তাদের কে দেখবে? তাই বিয়ে করার মানসিকতা তার কোনদিন ছিল না। কিন্তু বাবা,মা কী আর সে কথা শোনেন? মেয়ে সন্তান তাকে তো বিয়ে দিতেই হবে। চাকরি পাওয়ার ছয়মাস থেকেই শুরু হয় মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি। অফিস,বাড়ি আর মাকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য বাকি সময়টুকু সংসারের কাজ।
  ভীষণ মিশুকে, হাসিখুশি, সংসারী মেয়েটাকে আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী সকলেই খুব ভালোবাসে।পরিবারের চাপে শেষ পর্যন্ত তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেই হল।সুফল একজন উচ্চপদস্ত ব্যাংক কর্মচারি। সংসারে পা দিয়েই সুষমা বুঝে গেলো স্বামী,শ্বশুর,শ্বাশুড়ী, দেওর আর ডিভোর্সী ননদ সকলের কথা শুনেই তাকে চলতে হবে তা না হলে অশান্তি অবশ্যম্ভাবী।স্বামী, দেওর, ননদ ,শ্বশুর সকলেই চাকরি করেন।সংসারে তারা কুটোটি নাড়েন না। শ্বাশুড়ী একার হাতেই সংসার সামলান। সকলেই অফিস থেকে ফিরে টায়ার্ড থাকেন। তাই কেউই তাকে সংসারের কাজে সহায়তা করে না।
  বিয়েতে মাসখানেক ছুটি নিয়েছিল সুষমা। তাই বৌভাতের পর সমস্ত আত্মীয়স্বজন চলে যাওয়ার পর শ্বাশুড়ির সাথে রান্নাঘরে থেকে বুদ্ধিমতী সুষমা বুঝে যায় পরিবারের কার কখন কোনটা দরকার। যার যা কিছুই সে তার হাতের কাছে পৌঁছে দিক না কেন কেউই কখনোই সাধারণ একটা ধন্যবাদও ছুঁড়ে দেয়নি কোনদিন। বরং একটা কাজ সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে অন্য আর একটা কাজের অর্ডার দিয়ে দেয়।সবকিছুই সে হাসিমুখে পালন করতে থাকে। জোর করে শ্বাশুড়ীকে রান্নাঘর থেকে ছুটি দেয়।মনেমনে ভাবে ছুটি ফুরালে তো তাকেই আবার রান্নাঘরে ঢুকতে হবে।তাই এ কটাদিন যাতে তিনি একটু বিশ্রাম পান সেই চেষ্টায় সে করে।
 কিন্তু কাল হল তার শ্বাশুড়ীকে বিশ্রাম দেওয়ার চেষ্টাটা করা। ছুটি ফুরিয়ে গেলে অফিসে যাওয়ার আগের দিন থেকেই শুরু হল চাপা গুঞ্জন।সংসারের এত কাজ কে করবে? ভাবখানা তাদের এমনই যেন এই সংসারে এ যাবৎকাল সুষমা ই সব কাজ করে এসেছে। ভোরবেলা উঠে যতদূর পারে রান্না করে সকলের অফিসের টিফিন গুছিয়ে নিজেরটা নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ননদ বলে উঠলো,
-- বৌদি, আজ কিন্তু আমি রাতে ভাত খাবো না ,আমার জন্য রুটি কোরো।
 সুষমা সে কথার কোন জবাব দিলো না দেখে শ্বশুর বললেন,
--- তুমি শুনতে পাওনি রমা কী বললো?
--- হ্যাঁ বাবা শুনেছি কিন্তু এখন তো অফিস যাচ্ছি আগে বাড়ি ফিরি তারপর এসব ভাববো।
 উত্তর শ্বশুরের পছন্দ হল না সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেলো।
 অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই সেদিন থেকে শুরু হল রান্নাঘরে ঢোকা। তারপর রাতের সমস্ত কাজ সেরে যখন সে ঘুমাতে যায় তখন স্বামীর আদর মনেহয় অত্যাচার।প্রথম প্রথম মুখ বুজে স্বামীর সোহাগ মেনে নিলেও পড়ে তাদের দূরত্ব বাড়তে লাগে।অবশেষে মায়ের চেষ্টায় সর্বক্ষণের একজন মহিলাকে বাড়িতে কাজের জন্য রাখে। প্রথম প্রথম সকলের আপত্তি থাকলেও পড়ে এটাতে তারা সুবিধায় পেয়ে যায়।আর মাইনেটা তো সুষমা দেয়। একমাত্র এই মহিলাই সুষমার কষ্টটা বোঝে।সুষমা কিছু করতে গেলেই হাত থেকে কাজ ছিনিয়ে নেয়। তবুও সুষমা সকালে অফিস যাওয়ার আগে আর অফিস থেকে ফিরেও ওই মহিলার হাতে হাতে কাজ করতে থাকে।রাতের খাবারটাও সেই দেয়।অথচ বাড়িতে যে চাকুরীরত ননদ রয়েছে সে এক গ্লাস জল ভরেও খায় না। সেটা কারোই চোখে লাগে না।কিন্তু অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে সে একটু শুয়ে থাকলেও সকলের মুখ ভার হয়ে যায়। তবে সুফল এখন অনেকটাই বোঝে সুষমাকে। কাজের মহিলাটি রাখার ফলে সুষমাও রাতে তার আদরে সাড়া দেয়।তাই তার মেজাজটাও থাকে ফুরফুরে। আর শ্বাশুড়ী মা ? তিনি তো একবার আরামের স্বাদ পেয়েছেন তাই ভুলেও রান্নাঘরে তিনি ঢোকেন না। তবে ভুল ধরতেও তিনি ছাড়েন না। কিন্তু সুষমা কখনোই কারো কথার উত্তর কোনদিন করে না। বুদ্ধিমতী সুষমা একটা কথা বেশ ভালোভাবেই জানে সকলকে নিয়ে চলতে গেলে সকলের সব কথার উত্তর দিলে নিজেরই মানসিক শান্তি নষ্ট হবে।কতটুকু সময়ই বা সে বাড়িতে থাকে? নিজেকে ভালো রাখতে গেলে ছোটখাটো ঝামেলা এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।


Friday, November 11, 2022

ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ

ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ

   অভাবের সংসারেও ভাবভালোবাসা ছিলো -
  আসলে চাহিদা আর মনের উপরেই নির্ভর করে মানুষের সুখ। অভাব কিংবা একটু কম ভালোবাসা থাকলেও বিশ্বাসের ভীতটা যদি মজবুত থাকে সেখানে সুখের কোন কমতি থাকে না। ভাবভালবাসা আছে মানেই পরস্পরকে সব সময় গদগদ হয়ে থাকতে হবে তা মোটেই নয়।
 সোনালী ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সোমেশকে। বড় লোকের মেয়ে না হলেও সোমেশদের থেকে তাদের অবস্থা ছিল ভালো। তাই স্বাভাবিক কারণেই সোনালীর মা,বাবার ছিল এ বিয়েতে আপত্তি। তিনবোনের মধ্যে সোনালী ছিল মেজ। বড়জনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছিলো। সোনালী বাড়িতে নানান অশান্তি সহ্য করতে করতে গ্র্যাজুয়েশনটা কমপ্লিট করে। ইতিমধ্যে সাধারণভাবে সোমেশও গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসাবে একটা কোম্পানিতে জয়েন করে। সোনালী বাবা,মায়ের অমতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সোমেশকে বিয়ে করে।
  সোমেশ আর তার মা। ছোট্ট দুটো ঘর। কোনরকমে একটা রান্নার জায়গা। দেড়কাঠা জমির উপর ছোট্ট একতলা একটা বাড়ি হলেও সুন্দর সাজানোগুছানো এবং বাড়ির পিছনে অল্প একটু ফাঁকা জমি যেখানে সোমেশের মা লাউ,বেগুন,লঙ্কা ,সিম ইত্যাদি সবজি চাষ করেন।খুব ভালোবাসেন তিনি বাগান করতে। সোনালী সেই পরিবারে এসে প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে তার বেশ কষ্ট হয়েছে। কিন্তু সোমেশের প্রতি অদম্য ভালোবাসা তার মনে কখনো কোন কষ্টকে কষ্ট মনে হয়নি। 
 সোনালী অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তার শ্বাশুড়ির মন জয় করে নেয়। খুব ভালোবাসেন মৃন্ময়ীদেবী সোনালীকে। নিজের মেয়ের মতোই তিনি তার ছেলের বউয়ের সাথে তুই করে নাম ধরে ডেকেই কথা বলতেন। সোনালীও তার শ্বাশুড়িমাকে নিজের মায়ের মতই তুমি করে কথা বলে।
  সংসারে অভাব থাকলেও ভালোবাসার কমতি ছিল না মোটেই। কিন্তু বছর খানেক পরে হঠাৎ করেই সোমেশের চাকরিটা চলে গেলো। সংসারে তখন চরম অভাব। সকলে মিলে পরামর্শ করে সোনালী আর সোমেশ কিছু টিউশনি করতে শুরু করলো। কিন্তু এই সামান্য টাকায় তো আর সংসার চলে না। সোমেশ আর সোনালী দু'জনে মিলেই তখন যেমন-তেমন একটা কাজ খুঁজতে শুরু করলো। একটা কাপড়ের দোকানে সোনালী সেলসের একটা কাজও পেয়ে যায়। এইভাবে কিছুদিন চলার পর সোমেশ আবার অন্য একটি কোম্পানিতে সেই একই মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজ পেয়ে যায়। সংসারটা তখন আবার অনুখাতে চলতে শুরু করে। এই যে সংসারের অর্থের উঠাপড়া তাদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়তে কেউই দেয়নি।যেদিন যেমন জুটেছে সেদিন সেই সামান্য খাবারই তিনজনে ভাগ করেই খেয়েছে ; সেখানে কারো কোন অভিযোগ ছিলো না। সংসারে ভালোবাসার বন্ধনটা যদি বিশ্বাসের ভীত দ্বারা তৈরি হয় কোন অভাব সেখানে বাসা বাঁধতে পারে না।
  আস্তে আস্তে সোমেশের পদোন্নতি হয়েছে।সংসারের শ্রীবৃদ্ধির সাথে সাথে ছোট্ট এক লক্ষীর আগমন ঘটেছে।  তাকে নিয়েই পরিবারের বাকি তিনজন হাসি,আনন্দেই দিন কাটিয়ে দেয়। কোন কারণে কোন অশান্তি সোনালী সোমেশের সংসারে প্রবেশ করতে পারে না ।

Monday, November 7, 2022

আইবল

আইবল 

  লুকিয়ে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলাম --- ব্যাস আর যায় কোথায়? বরবেশি কুন্তল তখন চোখ বড় বড় করে আমাদের একের অন্যের গায়ের উপর পড়া দেখতেই ব্যস্ত। আর সুমিত্রা ফুলশয্যার খাটে বসে আমাদের দেখে হেসেই অস্থির।
 ঘটনাটা খুলেই বলি। কলেজ লাইফ থেকেই আমাদের পাঁচজনের একটা দল ছিল। আমি মানে ছন্দা, কুন্তল, সুমিত্রা, শ্রাবন আর দেবেশ। আমার সাথে প্রেম পর্ব শেষ করে, না শেষ করে নয়; প্রেম চলতে চলতেই  বিয়ের কাজটি সম্পন্ন করে ফেলে শ্রাবন।দেবেশের বিয়ে হয় সম্মন্ধ করে। কুন্তল আর সুমিত্রার বিয়েটাই সকলের শেষে!আগে ছিলাম বন্ধু পাঁচজন এখন ছ'জন। দেবেশের বউ রিয়া একটু চুপচাপ হলেও দলের মধ্যে থাকলে তার নীরবতা ভাঙার জন্য সবাই প্রস্তুত।
  দেবেশের ফুলশয্যার রাতে আলমারির পিছন থেকে কুন্তলকে বের করা হয়েছিল। তারজন্য আলমারিটাকে একটু সামনে টেনে আনা হয়। লাইট অফ করে যখন দেবেশ খাটের উপর গিয়ে বসে ঠিক সেই মুহূর্তে দেবেশের ফোন বেজে ওঠে। খুব বিরক্ত হয়ে দেবেশ তার জামাইবাবুর ফোনটা রিসিভ করে জানতে পারে বন্ধুদের মধ্যে কুন্তলকে দেখা যাচ্ছে না। সে যেন ঘরের ভিতর ভালোভাবে দেখে তারপর লাইট অফ করে। ফোনে কথা শুনেই এক লাফে উঠে গিয়ে দেবেশ ঘরের লাইট জ্বালিয়ে চিরুনি তল্লাশী শুরু করে। জামার কলার ধরে কুন্তলকে আলমারির পিছন থেকে টেনে বের করে আনে।
 আজ প্রতিশোধ নেওয়ার পালা।সবাই যখন বৌভাতের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত দেবেশ তখন আমাকে আর শ্রাবনকে নিয়ে এসে এক ফাঁকে কুন্তলের ঘরের দরজার আইবল খুলে রেখে যায়। দেবেশের মিসেস তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরে যায় কারণ সে প্রেগন্যান্ট। 
  সব কাজকর্ম শেষের পড়ে সবাই মিলে কুন্তলকে ঘরে ঢুকিয়ে টাটা, বাইবাই, কাল সকালে দেখা হবে , বেশি রাত জাগিস না - ইত্যাদি নানান কথা বলে যে যার মত পিছন ফিরে চলে যায়। 
 কুন্তল ,সুমিত্রা দুজনেই ভাবে এত তাড়াতাড়ি ওদের চলে যাওয়ার নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। ওরাও দু'জনে বসে বসে অনেকক্ষণ গল্প করতে থাকে। ঘরে যত রকম ফার্নিচার আছে সেগুলোর পিছন, তলা সব দেখেশুনেও কাউকেই তারা খুঁজে পায় না। শেষে কুন্তল আইবল দিয়ে বাইরে দেখতে গিয়ে দুটো বড় বড় চোখ দেখে ঝটপট দরজা খুলে ফেলায় দেবেশ, শ্রাবন আর আমি পরপর তিনজন পুরো কুন্তলের দরজার কাছে একের উপর আর একজন করে তিনজনেই ভূপতিত।
 হাহা ,হিহি কিন্তু কেউ সেখান থেকে ওঠে না। তখন সুমিত্রা খাট ছেড়ে নেমে এসে আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে বলে
-- আরে তোরা তো আমাদের বলতে পারতিস আমরা একটা বড় হলরুম বাইরে কোথাও ভাড়া নিয়ে একঘরেই থাকতাম সবাই। 
 কোমর কাত করতে করতে দেবেশ আর শ্রাবন উঠে দাঁড়িয়ে একসাথেই বলে উঠলো,
--- ঘাট হয়েছে।আমাদের।এই আমরা চললুম।
-- এই তার আগে আমার আইবলটা লাগিয়ে দিয়ে যা।
  দেবেশ আর শ্রাবন তখন আইবল লাগাতে লাগলো।