সমাজ কি ভাববে (m)
ভুল একবারই হয়,বারবার করলে তা হয় অন্যায়।
আজ সিঙ্গেল মাদার শ্রেয়সীর একমাত্র মেয়ে শ্রীপর্ণা মাধ্যমিকে প্রথম হওয়ায় তার ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে সাংবাদিকদের হুড়োহুড়ি লেগে গেছে।
তিনদিনের শিশুটিকে গ্রহণ করার জন্য শ্রেয়সী অনেক কাকুটিমিনতি করেছিলো সেদিন উজানের কাছে।কিন্তু উজান শ্রেয়সীর কোন কথাই শোনেনি।তার একটাই কথা ছিল "আমাকে বিয়ে করতে হলে ওই বাচ্চাকে তুমি দত্তক নিতে পারবে না।অন্যের পাপের বোঝা আজীবন আমি টানতে পারবো না।"
দশ বছর হল উজানের বিয়ে হয়েছে।এক অফিসে এখন না থাকলেও উজানের খবর সবই জানে শ্রেয়সী।কোন সন্তান তাদের নেই।অফিসের আর একজন সহকর্মীর সাথে উজানের বিয়ে হয়।অন্যদের মুখেই শুনেছে শ্রেয়সী,সন্তান না হওয়ার দোষটা উজানেরই।
বিয়ের দশ বছর পর একটি কন্যা সন্তান দত্তক নেয় উজান ও তার স্ত্রী মানসী।
মাধ্যমিক পরীক্ষার পর শ্রেয়সী মেয়েকে নিয়ে যখন শপিংমলে শপিং করছে তখন হঠাৎ করেই উজানের সাথে তার দেখা।সেও এসেছে তার মেয়ের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে।আর তখনই শ্রেয়সীর মেয়ের আড়ালে উজান হাত জোড় করে শ্রেয়সীর কাছে ক্ষমা চায়।
মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়ে শ্রেয়সী একটা জায়গা ফাঁকা রেখেছিল;আর সেটা হচ্ছে ফাদার্স নেম।
হেড মিস্ট্রেস ফর্মটা আবার শ্রেয়সীর হাতে দিয়ে বললেন,
-- এখানে আপনার স্বামীর নামটা লিখুন।
-- নেই তো
-- নেই তো আপনাকে দেখেই বুঝতে পারছি।কিন্তু ফর্মে তো নামটা লাগবে।
--- যে নেই তার নাম কোথায় পাবো?
--- আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।আপনি আপনার সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে এসেছেন।সন্তানের বাবার নামটা লিখতে বা বলতে আপনার এত অসুবিধা হচ্ছে কেন?
--- হয় আপনি বুঝতে পারছেন না নয় আমি আপনাকে বুঝাতে পারছি না।আমি বিয়ে করিনি।কিন্তু আমিই ওর মা।
হেডমিস্ট্রেস চুপচাপ শ্রেয়সীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।পাহাড় সমান প্রশ্ন তার মাথায় কিলবিল করছে।কিন্তু কোনো প্রশ্নই না করে শ্রেয়সীর মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন।
কর্পোরেট দুনিয়ায় চাকুরীরত শ্রেয়সী ভালোবাসে তারই সহকর্মী উজানকে।দুই বাড়িতেই দু'জনকে মেনে নিয়েছে।বিয়ে ঠিকঠাক।পুরোদমে শপিং চলছে। হাতে গোনা মাত্র পনেরদিন বাকি।অফিস সেরে মাসতুত বোনের বাড়ি আইবুড়ো ভাত খেয়ে রাতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেছিলো।নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলো।বাড়িতে মা একাই।বেশ কয়েকবার ফোনে মেয়েকে বলা হয়ে গেছে "সাবধানে আসিস"।ফিরছিলো বাইপাস ধরেই।
বহুদূর থেকেই তার চোখ পড়ে রাস্তার একপাশে বেশ একটা জটলা।এত রাতে গাড়িটা থামাবে কিনা,কোন রকম বিপদ আসতে পারে কিনা বেশ কয়েকবার ভেবেও গাড়িটা একপাশে দাঁড় করিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়।একজন দরিদ্র জীর্ণ বস্ত্র পরিহিতা ভদ্রমহিলা প্রসব যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন আর কিছু মানুষ তার এই যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়ার চিৎকার দাঁড়িয়ে দেখে চলেছে। অদূরে তার নজরে আসে প্লাস্টিকের ছাউনী দেওয়া একটা আস্তানা।সেখানে যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন সকলেই পুরুষ সুতরাং তাদেরও ঠিক দোষও দেওয়া যায় না।এখন তো নানান সমস্যা।মানুষের উপকার করতে গেলেও প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে অনেক সময় দোষীও হয়ে যেতে হয়।
দু'একজনের সহায়তায় ওই ভদ্রমহিলাকে নিয়ে শ্রেয়সী তখনই একটি সরকারি হাসপাতালে আসে।এর মধ্যে বারকয়েক মায়ের ফোন আসাতে কোনরকমে লাউস্পিকারে দিয়ে মাকে জানিয়ে দেয় ফিরতে রাত হবে।
ভদ্রমহিলাকে হাসপাতালে ভর্তি করে বাড়ি ফিরতে রাত প্রায় দুটো।পরদিন অফিস যায় না।সকালে ফোন করে উজানকে সব জানায়।উজান চুপচাপ সব শোনে কিন্তু কোন কথার কোন উত্তর দেয় না।দুপুর বারোটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানায় ভর্তিরত ওই ভদ্রমহিলা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন।যেহেতু শ্রেয়সী তাকে ভর্তি করে নাম,ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিল তাই আজই তাকে দেখা করতে হবে।
উজানকে ফোন করে সব জানায় সে।উজান আসে তো না ই উপরন্তু এই উটকো ঝামেলায় তাকে জড়াতে নিষেধ করে।মাকে রাতে ফিরেই সব জানিয়েছিল।মা তাকে খুব সমর্থন জানিয়েছিলেন এতবড় মানসিকতার পরিচয় দেওয়ার জন্য।উজানকে ফোন করার পর মাকে এখনকার বিষয়টি জানিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
প্রথমেই সে আসে গতকাল যেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে হাসপাতাল ভর্তি করেছিলো সেখানে।কিন্তু প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া ছাউনীর ভিতর ঢুকে কাউকেই সে দেখতে পেলো না।আশেপাশে কোন বাড়িঘরও তার চোখে পড়লো না।বড় বড় প্রায় আকাশ ছোঁয়া সব বিল্ডিং।এমন একজন নারীর খোঁজ তারা কেউ রাখবে না এটা নিশ্চিত।প্রচণ্ড চিন্তিত হয়ে পড়লো শ্রেয়সী।গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছে এখন সে কি করবে?হঠাৎ সেখান থেকে এক ভদ্রলোককে সাইকেল করে যেতে দেখে তাকে দাঁড় করিয়ে তার কাছ থেকেই জানতে পারে ভদ্রমহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন।নিজেই কোথা থেকে ওই প্লাস্টিক জোগাড় করে রোদ বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে ওই ব্যবস্থা করেছে।তাহলে প্রেগন্যান্ট?
হায় ঈশ্বর!মানুষের কি রুচি!একজন মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকেউ হায়েনারা ছাড়েনি।
কিন্তু সুস্থ্য,সুন্দর সমাজ একজন শিক্ষিত,সুন্দরী,মাস গেলে হাজার হাজার টাকা রোজগার করা মহিলাকে অনায়াসে একজন শিক্ষিত পুরুষের জীবন থেকে ছেটে ফেলতে পারে কারণ একটা জারজ সন্তানকে সে দত্তক নিলে "সমাজ কি ভাববে এই ভাবনায়।"