দেবমুনী
"উফফ!কি তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি।যেন মনের ভিতরের সবটুকু পড়ে নিচ্ছে এক লহমায়"!!পাহাড়ের ঢালু, এবরো-খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে আমরা যখন তার কাছে যাচ্ছিলাম দুপাশের খাদ দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো হঠাৎ যদি গাড়িটা খাদের মধ্যে পড়ে যায় মৃত্যু নির্ঘাৎ।কিন্তু অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছিলো।শিলিগুড়ি নামার পর প্রায় তিনঘন্টা ওই গাড়ির মধ্যে দম বন্ধ করে বসে থাকলেও মাঝে মাঝেই বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কোন মানুষকে ফিরে পাওয়ার এক অদম্য আনন্দ ঘিরে ধরছিলো আমায়।অথচ আমি কিন্তু কিছুই জানতাম না আগে থাকতে। কার সাথে দেখা করতে চলেছি।তবুও মনের মধ্যে একটা সুপ্ত ধারণা কাজ করছিল।
দেবলীনা,দেবমাল্যকে নিয়ে সুখের সংসার দীপায়ন ও সাগরিকা ব্যানার্জীর।দীপায়ন একজন একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।পিতৃ প্রদত্ত সম্পত্তির উপর প্রাসাদোপম এক অট্টালিকা।স্বামী,স্ত্রী দুজনেই মাটির মানুষ।তাদের আচার আচরণে প্রতিবেশীরা কখনোই মনে করে না যে তারা এত বিত্তশালী।আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই তারা প্রতিবেশীদের সাথে নানান অনুষ্ঠানে যোগদান করা,অষ্টমীতে পাত পেতে মায়ের মন্ডবে বসে খাওয়া সবই করতেন।নেশা বলতে ছেলে,মেয়ে,স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিবছর পাহাড় অঞ্চলে ভ্রমণ।প্রতি বছর এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে তিনি সকলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।
কতবার যে তিনি দার্জিলিং গেছেন তার হিসাব হয়তো তিনি নিজেও জানেন না।আবারও তিনি দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন পুরো পরিবার সহ। এতবার দার্জিলিং যাওয়ার সুবাদে বহু মানুষের সাথেই তার পরিচয় থেকে অনেকে খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছে।তাদেরই মধ্যে একজন ড্রাইভার রমেশ।একদম বাঁধাধরা।তারা দার্জিলিংয়ের যেখানেই যাবে না কেন রমেশেরই গাড়িতে যাবে। ইয়ং রমেশ পাহাড়িয়া অঞ্চলে গাড়ি চালায় দুর্দান্ত।পাহাড়ের ঢালু জমি বেয়ে কি অনায়াসে রমেশ গাড়ি নিয়ে নিচে নেমে যায়।দীপায়নবাবুর মেয়ের বয়স দশ বছর আর ছেলে দেবমাল্য পাঁচ বছর।গাড়ির ভিতর বসেই তারা আনন্দে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে। দীপায়নবাবু রমেশের পাশে বসে মাঝে মাঝে তার পিঠটা একটু চাপড়ে দিয়ে বলেন," এই রকম ঢালু রাস্তায় আমাকেও একটু গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিস রমেশ।" রমেশ হাসতে থাকে।পরিস্কার বাংলায় বলে," দাদা রিটায়ার করে চলে আসবেন দার্জিলিং।ছোট্ট একটা বাংলো কিনে বৌদিকে নিয়ে পাহাড়বাসী হয়ে যাবেন।আমরা খুব মজায় থাকবো তখন।গল্প করতে করতেই দক্ষ হাতে রমেশ এগিয়ে চলে তাদের গন্তব্যের দিকে।
কিন্তু জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যখন অযাচিতভাবে এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয় তখন কোন অভিজ্ঞতায় আর কাজ করে না।পাহাড়িয়া অঞ্চল।যখন তখন বৃষ্টি শুরু হয়।বৃষ্টির ভিতর থেকেই রমেশ গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।কিন্তু হঠাৎ করেই গাড়ির সামনে উপর থেকে একটি বড় পাথর গড়িয়ে পড়ে।পাথরে ধাক্কা খেয়ে গাড়ি হুমড়ি খেয়ে নীচে পরে যায়।সেখানে কিছু বসতি থাকায় সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মানুষজন উদ্ধারকাজ শুরু করে।গাড়ি গিয়ে বেশ কয়েকটা গাছের গোড়ায় আটকে যায়।সকলেই গাড়ির ভিতর থাকলেও দেবমাল্যকে খুঁজে পাওয়া যায় না।মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগায় সাগরিকা সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান।রমেশ,দেবলীনা আর দীপায়নবাবু অল্পবিস্তর আঘাত পেলেও সুস্থ্য হয়ে ওঠেন ডাক্তারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে।সুখের সংসার ভেঙেচুরে তছনচ হয়ে যায়।মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে তিনি এক যন্ত্রমানবে পরিণত হন।অফিস,বাড়ি আর সব সময় চুপচাপ থাকা।তারপর তিনি আর কখনোই মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হননি।দেবলীনা বড় হয়েছে তারপর থেকে তার মামাবাড়িতে।অবশ্য তাকে মানুষ করতে, বিয়ে দিতে অর্থের কার্পণ্য তিনি করেননি।
দেবলীনার বিয়ের তিন বছর পর স্বামীর অনেক জোরাজুরিতে স্বামী সহ সে এখন দার্জিলিংয়ের পথে।ওই ঘটনার পর আর দার্জিলিং যাওয়া হয়নি বাপ,মেয়ের।দুবছর হল বাবাও চলে গেছেন।গাড়ির মধ্যেই ড্রাইভারের সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে একজন সাধুর কথা।যিনি নাকি মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারেন তার অতীত,বর্তমান এবং ভবিৎসত। দার্জিলিং যাওয়ার পথে সেবক কালী মন্দিরের কাছাকাছি তিনি থাকেন একটি নির্জন এলাকায়।দেবলীনার বায়নাতে গাড়ি ছুটলো সাধুর কুটিরের দিকে।
দুর্গম পথ অতিক্রান্ত করে যখন স্বামী,স্ত্রী সেই সাধুর কুটিরের কাছে পৌঁছালো তখন প্রায় দুপুর।দু,একজন শিষ্যের সহয়তায় দেবলীনা ও তার স্বামী সাধুর সম্মুখীন হল।সাধু দেবলীনার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।দেবলীনা দেখতে পেলো তার চোখদুটি যেন অস্তগামী সূর্যের লাল আভার মত পরিবর্তিত হতে হতে তা জলে পূর্ণ হয়ে গেলো।সে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকা দেবলীনার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হল না।সে চোখ নামিয়ে নিলো।সাধুর মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসলো "দিদি" শব্দ।দেবলীনা তড়িৎ গতিতে সাধুর মুখের দিকে তাকালো।
ভাই,বোনের এই মিলন দৃশ্যে সাক্ষী থাকলো দেবলীনার স্বামী আর পাহাড় পর্বত,ঝর্না,গাছপালা ।সেদিন সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর একটি গাছের দুটি বড় শাখার মধ্যে ওই পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুটি অক্ষত অবস্থায় আটকে ছিল।পরদিন ভোরে শিশুটির কান্না শুনে তাকে উদ্ধার করেন কিছু পাহাড়বাসী।দেবমাল্য দিদির সাথে আর ফেরেনি।তার একটাই বক্তব্য ছিল ঈশ্বর চেয়েছিলেন তিনি তার সাধনায় তাকে পেতে।তিনি তা পেরেছেন।হয়ত তার পথটা ভিন্ন ছিলো কিন্তু উর্দেশ্য তার সফল হয়েছে।
No comments:
Post a Comment