Monday, September 20, 2021

মাতৃহারা

 মাতৃহারা

"জীবনের অনেকটা সময় হেলায় নষ্ট করেছি।ঠিক নষ্ট বলা যায় না এটাকে।পরিবারের বড় হওয়ার খেসারত দিয়েছি।অথচ আমি এটা না করলেই পারতাম।এই পরিবারের প্রতি আমার তো কোন দায় ছিলো না।ছেলেবেলায় কবে মাকে হারিয়েছি আমার মনে নেই।মা বলে যাকে ডাকতাম তিনি কোনদিনও আমাকে ভালোবাসেনি।বুঝতে পারতাম না আমার ভাই,বোনদের ভালো জামাকাপড়,ভালো খাবার আর আমার খাবার আমার জামাকাপড় এরূপ কেন?ছোট বয়স থেকেই আমার শোবার জন্য আলাদা একটা ঘর।রাতে যখন লোডশেডিং হয়ে যেত প্রথম প্রথম উঠে মা,বাবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কত ডাকতাম,কাঁদতাম।কিন্তু কোনদিন মা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে আমায় বুকের ভিতর নিয়ে শোয়নি।বাবা মাঝে মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আমায় বুকে তুলে নিলেও মায়ের তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে আমায় কোল থেকে নামিয়ে তার নির্দিষ্ট স্থানটিতে চলে যেতেন।আর মা দরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিতেন।
   পরে যখন একটু বুঝতে শিখেছি তখন জানতে পারি উনি আমার সৎমা।হঠাৎ করেই আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবার বিয়ে করেন।বিয়ের আগে আমার সৎমায়ের বাপের বাড়িতে আমাকে সন্তান হিসাবে মেনে নিতে হবে কথা হলেও তিনি কোনদিনও আমায় মেনে নিতে পারেননি।বাবা আমায় যেটুকু আদর করা বা কিছু কিনে দেওয়া সবই করতেন মায়ের অনুপস্থিতিতে। 
 স্থানীয় একটি সরকারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করি।বয়স যখন বারো কি তেরো তখন থেকেই নিজে টুকটাক কাজ করতে শুরু করলাম।দুটো পয়সা আসতো তাতে।নিজের প্রয়োজনটা মিটে যেত।ফ্রী স্কুল,ফ্রীতে বইপত্র পাওয়া ঘষেমেজে মাধ্যমিকটা পাশ করলাম।কপাল এমনই ঠিক তখনই বাবার একটা মস্তবড় অ্যাকসিডেন্ট হল।দুদিন হাপাতালে থেকে তিনি বিদায় নিলেন।ছোট ছোট দুটো ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হল।শত হোক সেই জন্মের পর থেকে ওদের দেখলেও কোনদিন ওদের প্রতি কোন ভালোবাসা অনুভব করিনি।কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মায়ায় জড়িয়ে গেলাম।কাছে টেনে নিলাম ওদের।নিজের ভিতর থেকেই কে যেন বলে উঠলো 'ওদের খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করার দায়িত্ব তোকেই নিতে হবে।' পড়াশুনা আর এগোতে পারলাম না।কাজ খুঁজতে শুরু করলাম।একটা মাধ্যমিক পাশ করা ছেলেকে কে কাজ দেবে?তবুও পাড়ার একজনের সুপারিশে একটা বইয়ের প্রেসে কাজ পেলাম। বারো ঘণ্টা ডিউটি করে যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতাম তখন ঐ ছোট্ট ভাইবোনদুটির নিষ্পাপ মুখদুটি দেখে আমার সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যেত।বাবার মৃত্যুর পর থেকেই মায়ের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম।আর সেটা হল আগে মা যখন আমায় খেতে দিতেন তখন মুখে যেন খই ফুটতো আর থালাটা এমনভাবে সামনে ছুড়ে দিতেন যেন কোন বিষধর প্রাণীর সামনে খাবার দিচ্ছেন।কিন্তু আমার পরিশ্রমে যখন সংসার চলতে শুরু করলো তখন এগুলো আর হত না তবে মা কিছুতেই যেন আমার কাছে ফ্রী হতে পারতেন না।তাকে দেখে বুঝতে পারতাম তিনি অপরাধ বোধে ভুগছেন।সেই হিসাবে আমিও কোনদিন তার কাছে ফ্রী হতে পারিনি ।শুধু কর্তব্যকর্মটাই করে গেছি।
  বোনকে মাধ্যমিক পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছি।ছোট ভাইটার পড়াশুনা এখনো চলছে।দিনের অধিকাংশ সময়ই তো বাইরেই থাকতাম।আগে বাড়িতে যখন ফিরতাম মনের ভিতর রাগের একটা আগুন জ্বলতো।কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়ি ফিরে কেমন যেন একটা শুন্যতা অনুভব করতাম।ভাইবোন দুটিকে নিয়েই থাকতাম।কাজে বেরোনোর আগে আর রাতের খাবারটা মা সামনে দিয়েই চলে যেতেন।এইভাবেই চলছিলো।বোনের বিয়ের পরেই মায়ের এক কঠিন অসুখ ধরা পড়লো।আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়লো।আমি তখন দিশেহারা!একদিন কাজের থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর নিজের সেই ছোট্ট ঘরটায় বসে আছি।মা এক কাপ চা নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আমি খুব অবাক হলাম।মুখটা না তুলেই জানতে চাইলাম,'কিছু বলবে?' তিনি আমার খাটে ঠিক আমার পাশটিতে বসে হঠাৎ আমার হাতদুটি ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।ক্ষমা চাইলেন তারপর আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন।আমি চুপচাপ ওখানেই বসে থাকলাম।     অনেকক্ষণ পর ভাই এসে খবর দিল মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছে।দুজনে মিলে মাকে নিয়ে যখন হাসপাতাল পৌঁছালাম ডাক্তার বললেন হার্ট অ্যাটাক।এমনিতেই মায়ের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছিলো।আগামী সপ্তাহ থেকে ডায়ালিসিস করার কথা ছিল।তারমধ্যেই এই ঘটনা।"এই পর্যন্ত বলে অনিরুদ্ধ মুখ নিচু করে থাকলো।তার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে।পাশে বসে থাকা আর এক শ্মশানবন্ধু অনিরুদ্ধের কাঁধে হাত রেখে শান্তনার সুরে বলেন,
--- মানুষ তার ভাগ্য নিয়েই জন্মায়।কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে শুধু দিতেই আসে।বিনিময়ে তারা কিছুই পায় না।তুমিও তাদের মত একজন।তবে শেষ সময়ে তিনি যে তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন সেটাই যথেষ্ঠ।আজ আমিও মাতৃহারা হলাম।তোমার সাথে তো তোমার ভাই আছে।আমি সম্পূর্ণ একা।
  মায়ের দাহকাজ সম্পন্ন হলে দুইভাই মিলে গঙ্গায় অস্তি বিসর্জন দিয়ে ধরা পরে বাড়ি ফিরলো।এই প্রথম অনিরুদ্ধ তার মায়ের ঘরে পা রাখলো।ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে সে যেন মায়ের গায়ের গন্ধ পেতে চাইছে;যা সে পেতে চেয়েছিলো সেই ছোট্টবেলা থেকে।
 
             শেষ

No comments:

Post a Comment