Wednesday, September 1, 2021

আওয়াজ উঠুক

প্রতিবাদ

 অনেকক্ষণ ধরে কথা বলার পর পঞ্চাশোর্ধ নন্দিনী হাঁপাতে থাকেন। হাঁপাতে হাঁপাতেই তিনি ঘরের এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে থাকেন।তা দেখে বুঝতে পারে তার পাশে বসে থাকা অঙ্কিতা।সে এগিয়ে গিয়ে একটা জলের বোতল নন্দিনীর সামনে ধরে।নন্দিনী বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে তার অর্ধেকের বেশি জল পান করে ফেলেন। তার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে অঙ্কিতা আর ভাবতে থাকে যে কথাগুলো নন্দিনী বলছেন তার একটি বর্ণও তো মিথ্যা নয়।আমাদের সমাজ নানানভাবে নানান দিক থেকে মেয়েদের উপর সেই পুরুষতান্ত্রিক শাসনই ফলিয়ে এসেছে আজও আসছে।এতদিন তো সত্যিই এ কথাগুলো মাথায় আসেনি।সে তাকিয়ে দেখে নন্দিনীর চোখ থেকে টপটপ করে জল পরছে।কিছুটা সময় নিয়ে নন্দিনী আবার বলতে শুরু করেন।
  তখন আমার বয়স চৌদ্দ কি পনের।বাবা একটা অ্যাকসিডেন্ট করে শয্য্যাশায়ী।আমাদের পাড়াটা ছিলো বেশ ধনী পাড়া।তার মধ্যে আমরাই ছিলাম মধ্যবিত্ত।পাড়ার নানান বাড়িতে পুজানুষ্ঠানে এমন কি পাড়ার ক্লাবের দুর্গাপূজা,কালীপূজা থেকে শুরু করে বিয়ে,অন্নপ্রাশন এমন কি পৈতাতেও আমার মাকে কাজের জন্য নিয়ে যেত। হ্যাঁ এরজন্য তারা মাকে পারিশ্রমিকও দিত।প্রথম প্রথম বাবার আপত্তি ছিল মায়ের এইসব কাজে যাওয়ার।কিন্তু বাবার অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে তিনি এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাতেন না।আমিও মায়ের সাথে যেতাম।কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে যেগুলো মা বলতেন 'তুই ধরিস না' -।বুঝতে পারতাম না আমি সেই সব কাজ করতে পারবো না কেন?কিন্তু মায়ের কথা শুনে আমিও কিছু কিছু কাজ থেকে বিরত থাকতাম।মা খুব নিষ্ঠাভরে সেই সব কাজ করতেন।আমার মায়ের রান্নার হাত ছিল খুবই ভালো।তিনি রান্না করতেও খুব ভালোবাসতেন।তখনকার দিনে ব্রাহ্মণ ছাড়া ঠাকুরের ভোগ রান্না হত না কারো বাড়িতে।এখন তো সেই ব্যাপারটা অন্তত উঠে গেছে।যে যার বাড়িতে নিজে রান্না করে তার গৃহদেবতাকে অন্নভোগ নিবেদন করে।এরই মধ্যে দিদির বিয়ে ঠিক হয়।মা একা হাতে সব কাজ সামলান।এখানেও সেই একই ব্যাপার।আমাকে অনেক কাজই করতে দেওয়া হয় না।কেন করতে পারবো না মাকে জিজ্ঞাসা করাতে মা বললেন,'বিয়ে না হলে এইসব কাজ করা যায় না'।মেনে নিলাম তখন সরল বিশ্বাসে।এখনকার দিনের ছেলেমেয়েদের মত আমরা তো এতটা ফরোয়ার্ড ছিলাম না;তাই অনেক প্রশ্ন মাথার মধ্যে আসলেও সব জানতে চাইতে সাহস পেতাম না।এইভাবেই চলছিলো সবকিছু।মা এইসব কাজ করে যা পেতেন তাই দিয়েই কোনরকমে আমাদের তিনজনের চলে যেত।দিদির বিয়েতে সেভাবে কিছু আয়োজন না করলেও বাবার সঞ্চয়ের সব টাকায় খরচ হয়ে গেলো।ইতিমধ্যে আমিও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম।হঠাৎ করেই বাবা একদিন ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন।
  মায়ের ওইসব কাজগুলি বন্ধ হয়ে গেলো।কিন্তু বিশ্বাস করো অঙ্কিতা আমি তখনো বুঝতে পারিনি লোকের বাড়ির আনন্দানুস্থানে মাকে আগের মত কেন আর ডাকে না।আমরা তখন কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের মত ছিলাম না।আমরা যতই বড় হই না কেন কোন ব্যাপারেই নাক গলাতাম না।মায়ের কাছে জানতে চাইলাম কেন কাজগুলি চলে গেলো?মা বললেন 'বিধবা মহিলারা কোন শুভ কাজে অংশ নিতে পারে না।' 
 তাহলে ভাবো অঙ্কিতা কুমারী মেয়েরা শুভকাজে অংশ নিতে পারবে না কারণ তার পাশে একজন পুরুষ শয্যাসঙ্গী নেই।বিধবার ক্ষেত্রেও তাই।তারমানে আমাদের সমাজ বলতে চেয়েছে নিত্য একজন পুরুষের কাছে শুতে না পারলে মেয়েরা শুভ নয় বলেই তারা শুভ কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।আবার যদি কোন বিধবা মহিলা পুনরায় বিয়ে করেন তিনি শুদ্ধ হয়ে গেলেন।সব শুভ কাজে তিনি অধিকার পেয়ে গেলেন।সমাজের এটা কোন ধরণের নিয়ম?এখানেও আমাদের বাঙ্গালী সমাজ নারীকে সেই অন্ধকারেই রাখতে চেয়েছে। কোনো মা তার সন্তানের শুভ কাজের সময় বাঙ্গালী সমাজের আচার আচরণগুলো তখনই করতে পারবেন যদি তিনি সধবা হন।আর যদি তার স্বামী মারা যায় তিনি সন্তানের শুভ কাজেও অংশ নিতে পারবেন না।আরে কবে কে মায়ের থেকে সন্তানের মঙ্গল কামনা বেশি করেছে?বিধবা হয়েছেন বলে তিনি সন্তানের শুভ কাজে অংশ নিলে তার সন্তানের মঙ্গল কি অমঙ্গল হবে --- সেটা আমাদের সমাজ ঠিক করে দেবে?সমাজ আমাদের কি দেয়? কারা সমাজের এই নিয়মগুলি বানিয়েছেন?পুরুষের নিত্য শয্যাসঙ্গী হতে না পারলেই নারীরা অশুচি?তাহলে বেশ্যারা কেন ব্রাত্য?তারা নিত্য নূতন শয্যাসঙ্গী পাল্টায় বলে?যারা শাঁখা,সিঁদুর পরে পরপুরুষের সাথে পালিয়ে যাচ্ছে তাদের কিন্তু এসব কাজে কোন বাঁধা নেই।সমাজ এদের কোন দোষ দেয় না কোন শুভ কাজে কারণ তাদের রাতের শয্যাসঙ্গী শুধু পাল্টেছে কিন্তু মরে যায়নি!পাশে একজন পুরুষ থাকা নিয়ে কথা!আমার প্রতিবাদ এসব মহিলাদের বিরুদ্ধে নয়,প্রতিবাদ আমার সমাজের বিরুদ্ধে।স্ত্রী আচার বা মহিলা আচার কেন কুমারী বা বিধবারা করতে পারবেন না তার বিরুদ্ধে।এই সমাজ আমি মানি না।আর মানি না বলেই আমি আমার মত কিছু মহিলাদের নিয়ে এই আন্দোলনে নেমেছি।এর জন্য প্রাণ সংশয় হয়েছে অনেকবার কিন্তু আমি দমিনী।আজকের যুগে শহরে অনেক শিক্ষিত বাড়িতেই এসব আর মানে না।কিন্তু গ্রাম বা মফস্বল শহরে এখনো কেউই এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।আজ আমি এসেছিলাম কলকাতায় এক সাংবাদিকের কাছে।আমাদের মফস্বল শহরে এক বাড়িতে বিধবা মা তার মেয়ের বিয়ে দেবেন।তার আর কেউ নেই।তিনি আমার পরামর্শ অনুযায়ী মেয়ের বিয়ের যাবতীয় কাজ নিজেই করবেন ঠিক করেছেন।ওখানকার কোন সাংবাদিকই রাজি হয়নি খবরটা ছাপাতে।কারণ ওখানকার নেতারা চাননি।তাই এক সোর্স মারফত একজন আমাকে কলকাতা পাঠান ওনার সাথে কথা বলতে।কিন্তু ওরা যে আমায় ফলো করতে করতে এতদূর ধাওয়া করবে আমি বুঝতেই পারিনি।হয়ত মেরেই ফেলতো যদি না তুমি সেখানে হাজির হতে।
 অঙ্কিতা একজন সমাজ সেবিকা।বয়স চল্লিশের উপরে।একাই থাকেন।একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করেন।প্রতিবাদী চরিত্র।অন্যায় দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন।আজ দুপুরে তিনি যখন নিজেই ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছিলেন তখন দেখতে পান একজন মহিলাকে কিছু মানুষ ঘিরে বেশ উচ্চস্বরে বাকবিতণ্ডায় ওই স্থান সরগরম করে রেখেছেন।পথ চলতি কিছু দর্শক সেখানে থাকলেও কেউই মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে দুটি কথা বলেননি।অঙ্কিতা গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তাদের ভিতর থেকে নন্দিনীকে উদ্ধার করে এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে সামান্য কিছু শোনার পরই তাকে সাথে করে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে।সব শোনার পর নন্দিনীকে কথা দেন তার এই যুদ্ধে তার সাথে সে আজীবন থাকবে।সমাজের কালো দিকগুলো উন্মোচন করতে এইভাবে এক একজন করে মানুষকে দলে টানার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। বাঙ্গালী সমাজ আজও যে সেই পুরনো ধ্যান,ধারণা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তার যে কোন যুক্তি নেই এগুলো প্রতিটি মানুষের বোঝার সময় এসে গেছে।

   #সমাজের_একটি_কালো_দিক_উন্মোচনের_চেষ্টা_মাত্র
#মনমত_কারো_না_হলে_অযথা_কুমন্তব্য_থেকে_বিরত_থাকবেন।

No comments:

Post a Comment