Friday, September 24, 2021

দায়িত্ব

অপেক্ষার প্রহর

"স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎটা বোঝার আগেই সবকিছু বদলে গেলো"- বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।সৃজনী কথাগুলো বলেই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তখনো তার চোখের থেকে অঝোর ধারায় জল পরে চলেছে।প্রচন্ড হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে তার চোখেমুখে লাগছে।বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার তখন।রণজিৎ আস্তে করে উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো।সম্বিত ফিরে পেয়ে সৃজনী আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলো।বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব।
  বাংলায় এম এ করা সৃজনী বাবা,মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে।নিশীথ রেলের উচ্চপদস্থ কর্মচারী।পাগলের মত ভালোবাসে নিশীথ সৃজনীকে।সংসারে শ্বাশুড়ী ছাড়া আর কেউ নেই।তিনিও তার বৌমাটিকে নিজ কন্যার মতই দেখেন।মাঝে মাঝে সৃজনীর মনে হত এ সবকিছু যেন স্বপ্ন।জীবনে এত সুখ সে কোনদিন কল্পনাও করেনি।
  কিন্তু সৃজনীর জীবনে এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।বিয়ের ছমাসের মাথায় অফিস থেকে ফেরার পথে বাইক অ্যাকসিডেন্ট করে নিশীথ চলে যায় সৃজনীর জীবন থেকে।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান সে।এই আকস্মিক ঘটনায় বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়।তিনিও নিশীথ চলে যাওয়ার দুদিনের মধ্যে চলে যান।ওদিকের জামাই ও স্বামীর মৃত্যুর পর মায়ের পাগল হয়ে ওঠার জোগাড় আর এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শ্বাশুড়ী মা বিছানা নিয়েছেন।খাওয়া,ঘুম সব বন্ধ।কোন দিকে যাবে সৃজনী?
 শ্বাশুড়ী বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না।তাই মাকে হাতে, পায়ে ধরে তার কাছে নিয়ে আসা।নিশীথ চলে যাওয়ার পর চিৎকার করে কেঁদে নিজে হালকা হওয়ার সময়টুকুও সে পায়নি।
 স্বামী ও বাবার কাজ মিটে যাওয়ার পরই তাদের অফিসে ছুটাছুটি।পেনশন মায়ের নামে করা আর নিশীথের অফিসে নিজের একটা চাকরি।তানাহলে ওই বৃদ্ধা মানুষটিকে নিয়ে বেঁচে থাকায় যে দায় হয়ে পড়বে।
 রেলে জয়েন করার কিছুদিন পর থেকেই সে লক্ষ্য করে সহকর্মী রণজিৎ নানান চলছুতোই তার কাছাকাছি থাকতেই যেন ভালোবাসে।কিন্তু জীবনে এতো বড় আঘাতের পর নূতন করে তার আর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে না।সে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে থাকে নানানভাবে।
 হঠাৎ করেই রণজিৎ বদলী হয়ে যায়।চলে যাওয়ার আগে বারবার সৃজনীকে অনুরোধ করে তাকে একান্তে দশটা মিনিট সময় দেওয়ার জন্য।কিন্তু কিছুতেই সৃজনী রাজি হয় না।
 এক ছুটির সন্ধ্যায় অপরিচিত এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা ও এক ভদ্রলোক এসে হাজির সৃজনীর বাড়িতে অর্থাৎ তার শ্বশুরবাড়িতে।তার শ্বাশুড়ী এখন কিছুটা স্বাভাবিক কিন্তু কথাবার্তা আগের মত আর বলেন না।এই তিন বছরে সৃজনীর মা নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন।আর মানুষের শোকের একমাত্র ওষুধ তো সময়।জীবন স্তব্ধ হলেও ঘড়ির কাটা তো স্তব্ধ হয় না।স্তব্ধ হওয়া জীবনও আস্তে আস্তে তার গতি ফিরে পায় সময়ের সাথে।
 ভদ্রলোক,ভদ্রমহিলা দুজন রঞ্জিতের বাবা ও মা।তারা ছেলের বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছেন।সানন্দে শ্বাশুড়ী মা এ বিয়েতে মত দেন।কিন্তু তাদের সামনে বেঁকে বসে সৃজনী।সৃজনীর মা সেদিন ওখানে ছিলেন না।তিনি কয়েকদিনের জন্য দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।তারা সৃজনীর শ্বাশুড়ীকে তার নিজের মা ই ভাবেন।শেষমেষ তাদের জোরাজুরিতে সৃজনী বলে আগে সে রঞ্জিতের সাথে কথা বলতে চায়।কিছু কথা তাকে জানানো দরকার।তারা তাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যান।
 সৃজনী যখন রঞ্জিতের সাথে দেখা করতে আসে তখন সন্ধ্যা হয় হয়।অফিস থেকে বেরিয়ে সে সোজা চলে আসে।আকাশ তখন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।রণজিৎ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছে।
 পুরো ঘটনা শোনার পর রণজিৎ বলে,
--- জীবনের একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে বলে  স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবে - সেভাবে জীবন চলে না।
সব জানি,সব বুঝি।আমার আরও সময় চাই।জানিনা কোনদিন আমি আমার জীবনে যা ঘটে গেছে তা মেনে নিতে পারবো কিনা।যদি কোনদিন মানতে পারি তাহলে তোমার কাছেই প্রথম ছুটে আসবো।আজ চলি।
  সৃজনী উঠে দাঁড়ায়।রঞ্জিতের মা চা, জলখাবার নিয়ে এসেছিলেন সৃজনী তাকে প্রণাম করে বলে,
-- আজ নয় মাসিমা।যদি সুযোগ হয় অন্য কোনদিন এসে পেট ভরে খেয়ে যাবো।
 রণজিৎ সৃজনীর পিছন পিছন কিছুটা হেঁটে আসা।তারপর বলে,
--- আমি কিন্তু অপেক্ষা করবো।
 সৃজনী পিছন ফিরে তাকায়।কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে।তারপর কোন কথা না বলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়।


ভূতুড়ে কান্ড

"ভুতুড়ে কান্ড" ( নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী ) ^^^^^^^^^^^^^^^^^

  বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে কলেজে পড়াকালীন সময়ে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবেই বেড়িয়ে পড়লাম | সবাই মিলে প্রথমে আসলাম হুগলি | সেখানে আমার এক কাকার বাড়ি আছে | বাড়িটা একটু ভিতরের দিকে | পাঁচজন যেয়ে সেখানে উপস্থিত হলাম | নানান ধরণের গল্প ,গুজব হতে হতে আমার খুড়তুতো ভাই বললো ওখানেই একটি রাজবাড়ী আছে ; যেখানে শুধুমাত্র ভুতেরই বাস | অনেকেই নাকি নানান ভাবে তাদের অস্তিত্ব টের পেয়েছেন | সকলেরই বয়স কম , প্রত্যেকেই নিজেদের অসীম সাহসী ভাবি | ঠিক করলাম সকালেই ওই রাজবাড়িতে যাবো | উঠতে উঠতে একটু বেলায় হয়ে গেলো | কাকিমা বললেন স্নান , খাওয়া ,দাওয়া করে যাতে আমরা বেড়োই | এ সব সারতে সারতে আমাদের প্রায় বারোটা বেজে গেলো | খুড়তুতো ভাইটি আমাদের সাথে গেলো না , পথনির্দেশটা দিয়ে দিলো | অনেকটা পথ পেড়িয়ে আমরা এসে রাজবাড়ীর সিংহদুয়ারে পৌঁছলাম | বিশাল লোহার গেট | খুব বড়ও তালের মতো এক তালা ঝুলছে | ঢোকার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না , এমনকি আশেপাশেও কাউকেই দেখতে তেমন পাওয়া যাচ্ছে না | খুব মন খারাপ নিয়ে ওখানে দাঁড়িয়েই সকলে নানান পোজে ছবি তুলতে লাগলাম | হঠ্যাৎ আমাদের সকলকে অবাক করে দিয়ে বেশ মোটা কালো মতো একজন লোক সেখানে এসে হাজির হলেন | ভিতরে ঢোকার চাবি কোথায় পাবো তার কাছে জানতে ছায়ায় তিনি অত্যন্ত মিহি শুরে আমাদের বললেন ,"ওটা আমার কাছেই থাকে |" খুশিতে ডগমগ সব গেটটা খুলে দিতে বললাম | গেট খুলতে খুলতেই উনি আমাদের সতর্ক করে দিলেন যাতে পুরো রাজবাড়ী আমরা বাইরে থেকেই দেখি এবং সন্ধ্যার আগেই যেনো ওই রাজবাড়ী ছেড়ে বেড়িয়ে আসি | পরে রাতে এসে উনি তালা দিয়ে যাবেন | আমরা সম্মত হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম | রাজবাড়ীর ভিতরে কিছু কিছু জায়গা আগাছায় পূর্ণ | আবার অবাক করে দেওয়ার মতো কিছু জায়গা দেখলে মনেহয় সেখানে যেন নিত্য লোকের আনাগোনা | বিশেষত যে সব জায়গা গুলিতে বসবার মতো ব্যবস্থা রয়েছে | মনের আনন্দে সকলে সবকিছু ঘুরে দেখছি | হঠ্যাৎ খেয়াল হলো আবার ছবি তোলার | মোবাইল ফোনের তখনও চল হয়নি | ছবি তোলার জন্য আমার দামী ক্যামেরা ইয়াসিকা | পোজ নিয়ে সকলে দাঁড়িয়ে পড়লো | আমি ক্যামেরার পিছনে | কিন্তু একি ? চোখের সামনে যে মানুষগুলিকে দেখতে পাচ্ছি ,ক্যামেরার লেন্সে তাদের দেখতে পাচ্ছি না কেন ? শুধুই কালো আর কালো | সাধের ক্যামেরা আমার নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে নিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো | নষ্ট ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে আবার ঘুরতে লাগলাম | এত বড় রাজবাড়ী যেন শেষই হয়নি ঘোরা | সন্ধ্যা হয় হয় ; এমন সময় ওই লোকের কথা মনে পড়লো | বেড়িয়ে আসতে হবে | পুরোটা ঘুরে দেখা হোলোনা বলে মনটা সকলের খুব খারাপ হয়ে গেলো | আমরা বাইরে বেড়োনোর জন্য পিছন ঘুরে হাটতে লাগলাম | কিন্তু কোথায় বাইরে বেড়োনোর পথ ? যে পথ দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম সে পথই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না | হঠ্যাৎ কানে এলো ঘুঙঘুর এর আওয়াজ | অতি বড় সাহসী আমি -আমার বুকের মধ্যেও ধুকধুকানি শুরু হোলো | হঠাৎ করেই আমাদের সামনে একজন মহিলা এসে উপস্থিত হলেন | তিনি বললেন ,"আপনারা এত দেরি করলেন কেন ? ঢোকার আগে আমার স্বামী তো আপনাদের বলেই দিলো সন্ধ্যার আগেই এখান থেকে বেড়িয়ে যেতে | আমার পিছন পিছন তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসুন |মহিলার সহায়তায় আমরা রাজ্ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলাম | চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার |কিছুদূর এগিয়ে তারই মাঝে দেখতে পেলাম একটি ছোট চায়ের দোকান | সেখানে কিছু লোক বসে চা খাচ্ছে ; ওই মানুষগুলির মধ্যে যে আমাদের গেটের তালা খুলে দিয়েছিলেন তিনিও আছেন |আমরা সকলে যেয়ে চায়ের দোকানে চায়ের অর্ডারটা দিয়ে বাইরে বেঞ্চে বসে দাড়োয়ান ভদ্রলোককে বললাম ,"আপনার স্ত্রী যদি ওই সময় আমাদের কাছে না আসতেন আমরা তো বেড়োতেই পারতাম না | কিন্তু সন্ধ্যার সময় ওখান থেকে ঘুঙঘুরের আওয়াজ কোথা থেকে আসছিলো ?"হঠ্যাৎ চা বিক্রেতা আমাদের দিকে তাঁকিয়ে বললেন ,"আপনারা রাজবাড়িতে গেছিলেন ? আর একটাও কথা ওর কাছে জিজ্ঞেস করবেন না | আপনারা এদিকে উঠে আসুন |" যার সাথে এতক্ষন কথা বলছিলাম মুহূর্তে দেখি সে উধাও | দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম ,"এত তাড়াতাড়ি ভদ্রলোক উঠে কোথায় চলে গেলেন ?" " উনাকে শুধু আপনারাই দেখতে পারছিলেন এখানে আমরা কেউই তাকে দেখতে পাইনি | উনি মানুষ না | তবে কখনোই কারও ক্ষতি করেন না | কেউ রাজবাড়ী দেখতে আসলে উনি গেট খুলে দেন ; রাত হয়ে গেলে উনার স্ত্রী বাইরে বেড়োনোর পথ দেখিয়েও দেন | দুজনেই ছিলেন রাজার বিশ্বস্ত কর্মচারী | বেঁচে থাকতে তারা যে কাজ করেছেন মরে যেয়ে ভুত হয়েও একই কাজ করে চলেছেন | আর ওই যে ঘুঙঘুরের আওয়াজের কথা বললেন না - সন্ধ্যা হলেই ওখানে মাহফিল বসে | রাজপ্রাসাদের ভিতরে নানান প্রকারের আলোর রোশনাই, অনেক দূর থেকে সে আলো দেখা গেলেও কাছে গেলে তা ক্রমশ কমতে থাকে | অদ্ভুত একটা গা ছম্ছমে ভাব আসে | যারা দাঁড়োয়ানকে বা তার স্ত্রীকে একবার দেখেছে পরে তারা আর কখনোই তাকে দেখতে পায় না | কেউ সেখানে গেলে সেদিন দাঁড়োয়ান এখানে আসবেই |" আমরা সকলে হা করে কথাগুলি শুনছিলাম | হঠ্যাৎ আমার বন্ধু বিজন বলে উঠলো , তার মানে আমরা পুরোদিনটা ভুতের সাথেই কাটালাম ?" "হ্যা আপনারা রাজপ্রাসাদের কোনো কামরায় ঢোকেননি বলে বেঁচে এসেছেন ; যদি কোনো কামরায় ঢোকার চেষ্টা করতেন তাহলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারতেন না | ওরা কিন্তু আপনাদের সাথে সাথেই ছিলেন | ওখানে কেউ ছবি তুলতে গেলে কোনো ছবি উঠে না ,কারণ ওরা সাথে থাকে | 

অদ্ভুত ব্যাপার হলো সারাদিন আমরা ভুতের সাথে থেকেও কেউ কোনো ভয় পেলাম না | খুশি হলাম এই ভেবে যাক বাবা ! ক্যামেরাটা তাহলে নষ্ট হয়নি | ভুতের ছবি না উঠুক মানুষের ছবি তো উঠবে !!
""""""

নন্দা 24.9.16

Thursday, September 23, 2021

অপেক্ষার প্রহর

অপেক্ষার প্রহর

"স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎটা বোঝার আগেই সবকিছু বদলে গেলো"- বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।সৃজনী কথাগুলো বলেই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তখনো তার চোখের থেকে অঝোর ধারায় জল পরে চলেছে।প্রচন্ড হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে তার চোখেমুখে লাগছে।বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার তখন।রণজিৎ আস্তে করে উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো।সম্বিত ফিরে পেয়ে সৃজনী আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলো।বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব।
  বাংলায় এম এ করা সৃজনী বাবা,মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে।নিশীথ রেলের উচ্চপদস্থ কর্মচারী।পাগলের মত ভালোবাসে নিশীথ সৃজনীকে।সংসারে শ্বাশুড়ী ছাড়া আর কেউ নেই।তিনিও তার বৌমাটিকে নিজ কন্যার মতই দেখেন।মাঝে মাঝে সৃজনীর মনে হত এ সবকিছু যেন স্বপ্ন।জীবনে এত সুখ সে কোনদিন কল্পনাও করেনি।
  কিন্তু সৃজনীর জীবনে এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।বিয়ের ছমাসের মাথায় অফিস থেকে ফেরার পথে বাইক অ্যাকসিডেন্ট করে নিশীথ চলে যায় সৃজনীর জীবন থেকে।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান সে।এই আকস্মিক ঘটনায় বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়।তিনিও নিশীথ চলে যাওয়ার দুদিনের মধ্যে চলে যান।ওদিকের জামাই ও স্বামীর মৃত্যুর পর মায়ের পাগল হয়ে ওঠার জোগাড় আর এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শ্বাশুড়ী মা বিছানা নিয়েছেন।খাওয়া,ঘুম সব বন্ধ।কোন দিকে যাবে সৃজনী?
 শ্বাশুড়ী বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না।তাই মাকে হাতে, পায়ে ধরে তার কাছে নিয়ে আসা।নিশীথ চলে যাওয়ার পর চিৎকার করে কেঁদে নিজে হালকা হওয়ার সময়টুকুও সে পায়নি।
 স্বামী ও বাবার কাজ মিটে যাওয়ার পরই তাদের অফিসে ছুটাছুটি।পেনশন মায়ের নামে করা আর নিশীথের অফিসে নিজের একটা চাকরি।তানাহলে ওই বৃদ্ধা মানুষটিকে নিয়ে বেঁচে থাকায় যে দায় হয়ে পড়বে।
 রেলে জয়েন করার কিছুদিন পর থেকেই সে লক্ষ্য করে সহকর্মী রণজিৎ নানান চলছুতোই তার কাছাকাছি থাকতেই যেন ভালোবাসে।কিন্তু জীবনে এতো বড় আঘাতের পর নূতন করে তার আর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে না।সে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে থাকে নানানভাবে।
 হঠাৎ করেই রণজিৎ বদলী হয়ে যায়।চলে যাওয়ার আগে বারবার সৃজনীকে অনুরোধ করে তাকে একান্তে দশটা মিনিট সময় দেওয়ার জন্য।কিন্তু কিছুতেই সৃজনী রাজি হয় না।
 এক ছুটির সন্ধ্যায় অপরিচিত এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা ও এক ভদ্রলোক এসে হাজির সৃজনীর বাড়িতে অর্থাৎ তার শ্বশুরবাড়িতে।তার শ্বাশুড়ী এখন কিছুটা স্বাভাবিক কিন্তু কথাবার্তা আগের মত আর বলেন না।এই তিন বছরে সৃজনীর মা নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন।আর মানুষের শোকের একমাত্র ওষুধ তো সময়।জীবন স্তব্ধ হলেও ঘড়ির কাটা তো স্তব্ধ হয় না।স্তব্ধ হওয়া জীবনও আস্তে আস্তে তার গতি ফিরে পায় সময়ের সাথে।
 ভদ্রলোক,ভদ্রমহিলা দুজন রঞ্জিতের বাবা ও মা।তারা ছেলের বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছেন।সানন্দে শ্বাশুড়ী মা এ বিয়েতে মত দেন।কিন্তু তাদের সামনে বেঁকে বসে সৃজনী।সৃজনীর মা সেদিন ওখানে ছিলেন না।তিনি কয়েকদিনের জন্য দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।তারা সৃজনীর শ্বাশুড়ীকে তার নিজের মা ই ভাবেন।শেষমেষ তাদের জোরাজুরিতে সৃজনী বলে আগে সে রঞ্জিতের সাথে কথা বলতে চায়।কিছু কথা তাকে জানানো দরকার।তারা তাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যান।
 সৃজনী যখন রঞ্জিতের সাথে দেখা করতে আসে তখন সন্ধ্যা হয় হয়।অফিস থেকে বেরিয়ে সে সোজা চলে আসে।আকাশ তখন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।রণজিৎ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছে।
 পুরো ঘটনা শোনার পর রণজিৎ বলে,
--- জীবনের একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে বলে  স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবে - সেভাবে জীবন চলে না।
সব জানি,সব বুঝি।আমার আরও সময় চাই।জানিনা কোনদিন আমি আমার জীবনে যা ঘটে গেছে তা মেনে নিতে পারবো কিনা।যদি কোনদিন মানতে পারি তাহলে তোমার কাছেই প্রথম ছুটে আসবো।আজ চলি।
  সৃজনী উঠে দাঁড়ায়।রঞ্জিতের মা চা, জলখাবার নিয়ে এসেছিলেন সৃজনী তাকে প্রণাম করে বলে,
-- আজ নয় মাসিমা।যদি সুযোগ হয় অন্য কোনদিন এসে পেট ভরে খেয়ে যাবো।
 রণজিৎ সৃজনীর পিছন পিছন কিছুটা হেঁটে আসা।তারপর বলে,
--- আমি কিন্তু অপেক্ষা করবো।
 সৃজনী পিছন ফিরে তাকায়।কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে।তারপর কোন কথা না বলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়।


Monday, September 20, 2021

একটু জলের আশায়

একটু জলের আশায়

 " এই বাড়িতে যতবারই এসেছি ততবারই গা ছমছম করা একটা অস্বস্তি বোধ করেছি --- "।কথাটা বলে দেবিকা নিজে বসে থাকা চেয়ারটা টেনে নিয়ে অমিতের আরো কাছে এগিয়ে গেলো।এটা দেখতে পেয়ে অমিত হেসে দিয়ে বললো,
--- এই দিনের বেলাতেও তোমার হাবভাব দেখে মনেহচ্ছে তোমার এখনো গা ছমছম করছে।
--- হ্যাঁ করছে তো। এ বাড়িতে ঢুকলেই আমার মনেহয় কেউ যেন আমার সাথে সাথেই আছে।দিদিমা যখন আমার নামে বাড়িটা উইল করলেন আমি বলেছিলাম তুমি বাড়িটা বিক্রি করে টাকাটা ফিক্সড করে দাও।আমি যখন দেশে ফিরবো তখন কিছুতেই ওই বাড়িতে আমি থাকবো না।আসলে দিদিমার তো আমি ছাড়া আর কেউ ছিলোনা।বাবা,মায়ের অ্যাক্সিডেন্টের পর আমার দাদু আমায় দার্জিলিং পাঠিয়ে দিলেন।ওখানকার পড়াশুনার পাট চুকিয়ে যখন ফিরে এলাম কলকাতায় তখন আবার উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিলেন ব্রিটেন।মা একমাত্র মেয়ে ছিলেন দিদিমার।দাদুকে ছেলেবেলায় দেখেছি তবে মনে নেই।মায়ের সাথে যখন দিদিমার কাছে আসতাম তখন ছিলাম খুব ছোট।আর মা সাথে সাথেই থাকতেন।তাই তখনকার ফিলিংসটা আমার ঠিক মনে নেই।একটু বড় হওয়ার পরে যতবার দিদিমার সাথে দেখা করতে এসেছি ততবারই এই অদ্ভুত ফিলিংসটা আমার হয়েছে।
--- যদিও আমি এসব বিশ্বাস করিনা কিন্তু তুমি যখন বলছো অবিশ্বাসও করছি না।আসলে ছোটবেলা থেকেই এই ভূত-প্রেত ব্যাপারটা আমার বিশ্বাস হয় না।তবুও যখন বলছো বিষয়টা নিয়ে আমি আমার এক দূরসম্পর্কের ঠাকুমার সাথে আলোচনা করবো।আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছেই ওনার বাড়ি।তোমায় নিয়েই একদিন যাবো ওখানে।শুনেছি উনি নাকি আত্মার অস্তিত্ব টের পান এবং আত্মার সাথে কথাও বলেন।
 অমিত ব্যানার্জী।দেবিকার প্রেমিক।দুজনে একসাথেই ব্রিটেন থেকে ফিরেছে।আগামী মাসেই বিয়ে।বিদেশেই আলাপ।দেবিকার দাদু আজও বেঁচে।তিনি এ বিয়েতে সানন্দে মত দিয়েছেন।কারণ অমিত তার নাতনীর জন্য উপযুক্ত পাত্র।
 দেবিকা পুরো বাড়িটা অমিতকে ঘুরিয়ে দেখায়।কলকাতা শহরে এত বড় বাড়ি সচরচর দেখা যায় না।বাড়িটা ঘুরে দেখতে দেখতে অমিত বলে ওঠে,
--- তোমার এই গা ছমছমে ব্যাপারটা না থাকলে আমরা এই বাড়িতেই আমাদের নূতন জীবন শুরু করতে পারতাম একটু ঘষামাজা করে।
--- বাড়িটা তো আমারও খুব প্রিয়।যদি তাই হয় তো খুব ভালো হয়।কিন্তু তার আগে চলো তোমার ওই ঠাকুমার কাছে একবার যাই।দেখি এই ব্যাপারটার কোন সুরাহা করা যায় কিনা। জানো অমিত বড় হয়ে যতবার এখানে এসেছি প্রতিবারই আমি দিদিমাকে এ কথাটা বলতাম।কিন্তু দিদিমা কোন উত্তর না দিয়ে শুধু চোখ ভরা জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।দেখে মনেহত তিনি যেন এ রহস্যের মূল কারণটা জানতেন।শেষবার অন্যমনস্ক হয়ে বলেছিলেন, 'মায়া'।তারপর বহুবার জানতে চাওয়ার পরও কোন উত্তর দেননি।চোখ বন্ধ করে শুধু শুয়েই ছিলেন আর চোখ থেকে সমানে জল পড়ে গেছে।উনাকে দেখাশুনা করার জন্য যে দুজন মহিলা ছিলেন তারা দিদিমার ঘরে না থাকলে মাঝে মধ্যে তাদের মনে হয়েছে যে দিদিমা কারো সাথে কথা বলছেন।এসে জানতে চাইলে কখনোই স্বীকার করতেন না।বলতেন নাকি 'তোরা ভুল 'শুনেছিস''।
  অমিত দেবিকাকে সাথে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে তার সেই ঠাকুমাকে নিয়ে আসে।বাড়িতে পা দিয়েই বৃদ্ধা বলে ওঠেন,"কেন পড়ে আছো তুমি এখানে?"অমিত আর দেবিকা দুজনেই কিছু বলতে যায় --- কিন্তু তিনি হাতের ইশারায় তাদের চুপ করতে বলেন।তিনি কি উত্তর পান সেই অশরীরীর কাছ থেকে তা তারা জানতে পারে না ঠিকই কিন্তু বৃদ্ধা তখন বলেন," ঠিক আছে তোমার কথামত কাজ হবে।কিন্তু তোমায় কথা দিতে হবে এই বাড়ি তোমার পরিত্যাগ করতে হবে।"
  অমিত,দেবিকা তার ঠিক পরদিন জোগাড়-যন্ত্র করে বৃদ্ধার কথামত বাবা,মায়ের শ্রাদ্ধের আয়োজন করে।কাজ শেষে বাগানের এক বড় আমগাছের একটা মোটা ডাল হঠাৎ করেই ভেঙ্গে পড়ে।বৃদ্ধা হেসে পড়ে বলেন, " যাক আত্মা এবার মুক্তি পেলো।এতকাল ধরে মেয়ের হাতের একটু জল পাওয়ার জন্য এই বাড়িটা জুড়েই সে ছিলো।তোমার দিদিমা সে কথা জানতেন।কিন্তু তিনি তোমায় এ কাজের কথা কোনদিন বলেননি তার কারণ তিনি চাননি তার মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাক।আর এই কারণেই এ বাড়ি ছেড়ে তোমার দিদিমা কোথাও যেতেন না। হ্যাঁ তোমার বাবার আত্মা মুক্তি পেয়ে গেছিলো কিন্তু তোমার মায়ের আত্মা এই বাড়িটা ঘিরেই ছিলো।শুধু তোমার হাতের একটু জল পাওয়ার আশায়।

#আজকের_ব্লগিং_সূত্র

মাতৃহারা

 মাতৃহারা

"জীবনের অনেকটা সময় হেলায় নষ্ট করেছি।ঠিক নষ্ট বলা যায় না এটাকে।পরিবারের বড় হওয়ার খেসারত দিয়েছি।অথচ আমি এটা না করলেই পারতাম।এই পরিবারের প্রতি আমার তো কোন দায় ছিলো না।ছেলেবেলায় কবে মাকে হারিয়েছি আমার মনে নেই।মা বলে যাকে ডাকতাম তিনি কোনদিনও আমাকে ভালোবাসেনি।বুঝতে পারতাম না আমার ভাই,বোনদের ভালো জামাকাপড়,ভালো খাবার আর আমার খাবার আমার জামাকাপড় এরূপ কেন?ছোট বয়স থেকেই আমার শোবার জন্য আলাদা একটা ঘর।রাতে যখন লোডশেডিং হয়ে যেত প্রথম প্রথম উঠে মা,বাবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কত ডাকতাম,কাঁদতাম।কিন্তু কোনদিন মা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে আমায় বুকের ভিতর নিয়ে শোয়নি।বাবা মাঝে মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আমায় বুকে তুলে নিলেও মায়ের তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে আমায় কোল থেকে নামিয়ে তার নির্দিষ্ট স্থানটিতে চলে যেতেন।আর মা দরাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিতেন।
   পরে যখন একটু বুঝতে শিখেছি তখন জানতে পারি উনি আমার সৎমা।হঠাৎ করেই আমার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবার বিয়ে করেন।বিয়ের আগে আমার সৎমায়ের বাপের বাড়িতে আমাকে সন্তান হিসাবে মেনে নিতে হবে কথা হলেও তিনি কোনদিনও আমায় মেনে নিতে পারেননি।বাবা আমায় যেটুকু আদর করা বা কিছু কিনে দেওয়া সবই করতেন মায়ের অনুপস্থিতিতে। 
 স্থানীয় একটি সরকারি স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করি।বয়স যখন বারো কি তেরো তখন থেকেই নিজে টুকটাক কাজ করতে শুরু করলাম।দুটো পয়সা আসতো তাতে।নিজের প্রয়োজনটা মিটে যেত।ফ্রী স্কুল,ফ্রীতে বইপত্র পাওয়া ঘষেমেজে মাধ্যমিকটা পাশ করলাম।কপাল এমনই ঠিক তখনই বাবার একটা মস্তবড় অ্যাকসিডেন্ট হল।দুদিন হাপাতালে থেকে তিনি বিদায় নিলেন।ছোট ছোট দুটো ভাইবোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বড্ড মায়া হল।শত হোক সেই জন্মের পর থেকে ওদের দেখলেও কোনদিন ওদের প্রতি কোন ভালোবাসা অনুভব করিনি।কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মায়ায় জড়িয়ে গেলাম।কাছে টেনে নিলাম ওদের।নিজের ভিতর থেকেই কে যেন বলে উঠলো 'ওদের খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করার দায়িত্ব তোকেই নিতে হবে।' পড়াশুনা আর এগোতে পারলাম না।কাজ খুঁজতে শুরু করলাম।একটা মাধ্যমিক পাশ করা ছেলেকে কে কাজ দেবে?তবুও পাড়ার একজনের সুপারিশে একটা বইয়ের প্রেসে কাজ পেলাম। বারো ঘণ্টা ডিউটি করে যখন ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতাম তখন ঐ ছোট্ট ভাইবোনদুটির নিষ্পাপ মুখদুটি দেখে আমার সমস্ত কষ্ট দূর হয়ে যেত।বাবার মৃত্যুর পর থেকেই মায়ের মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিলাম।আর সেটা হল আগে মা যখন আমায় খেতে দিতেন তখন মুখে যেন খই ফুটতো আর থালাটা এমনভাবে সামনে ছুড়ে দিতেন যেন কোন বিষধর প্রাণীর সামনে খাবার দিচ্ছেন।কিন্তু আমার পরিশ্রমে যখন সংসার চলতে শুরু করলো তখন এগুলো আর হত না তবে মা কিছুতেই যেন আমার কাছে ফ্রী হতে পারতেন না।তাকে দেখে বুঝতে পারতাম তিনি অপরাধ বোধে ভুগছেন।সেই হিসাবে আমিও কোনদিন তার কাছে ফ্রী হতে পারিনি ।শুধু কর্তব্যকর্মটাই করে গেছি।
  বোনকে মাধ্যমিক পাশ করিয়ে বিয়ে দিয়েছি।ছোট ভাইটার পড়াশুনা এখনো চলছে।দিনের অধিকাংশ সময়ই তো বাইরেই থাকতাম।আগে বাড়িতে যখন ফিরতাম মনের ভিতর রাগের একটা আগুন জ্বলতো।কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে বাড়ি ফিরে কেমন যেন একটা শুন্যতা অনুভব করতাম।ভাইবোন দুটিকে নিয়েই থাকতাম।কাজে বেরোনোর আগে আর রাতের খাবারটা মা সামনে দিয়েই চলে যেতেন।এইভাবেই চলছিলো।বোনের বিয়ের পরেই মায়ের এক কঠিন অসুখ ধরা পড়লো।আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙ্গে পড়লো।আমি তখন দিশেহারা!একদিন কাজের থেকে বাড়িতে ফিরে আসার পর নিজের সেই ছোট্ট ঘরটায় বসে আছি।মা এক কাপ চা নিয়ে এসে আমার সামনে রেখে দাঁড়িয়ে থাকলেন।আমি খুব অবাক হলাম।মুখটা না তুলেই জানতে চাইলাম,'কিছু বলবে?' তিনি আমার খাটে ঠিক আমার পাশটিতে বসে হঠাৎ আমার হাতদুটি ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলেন।ক্ষমা চাইলেন তারপর আস্তে আস্তে উঠে চলে গেলেন।আমি চুপচাপ ওখানেই বসে থাকলাম।     অনেকক্ষণ পর ভাই এসে খবর দিল মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছে।দুজনে মিলে মাকে নিয়ে যখন হাসপাতাল পৌঁছালাম ডাক্তার বললেন হার্ট অ্যাটাক।এমনিতেই মায়ের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছিলো।আগামী সপ্তাহ থেকে ডায়ালিসিস করার কথা ছিল।তারমধ্যেই এই ঘটনা।"এই পর্যন্ত বলে অনিরুদ্ধ মুখ নিচু করে থাকলো।তার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে।পাশে বসে থাকা আর এক শ্মশানবন্ধু অনিরুদ্ধের কাঁধে হাত রেখে শান্তনার সুরে বলেন,
--- মানুষ তার ভাগ্য নিয়েই জন্মায়।কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে শুধু দিতেই আসে।বিনিময়ে তারা কিছুই পায় না।তুমিও তাদের মত একজন।তবে শেষ সময়ে তিনি যে তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন সেটাই যথেষ্ঠ।আজ আমিও মাতৃহারা হলাম।তোমার সাথে তো তোমার ভাই আছে।আমি সম্পূর্ণ একা।
  মায়ের দাহকাজ সম্পন্ন হলে দুইভাই মিলে গঙ্গায় অস্তি বিসর্জন দিয়ে ধরা পরে বাড়ি ফিরলো।এই প্রথম অনিরুদ্ধ তার মায়ের ঘরে পা রাখলো।ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে সে যেন মায়ের গায়ের গন্ধ পেতে চাইছে;যা সে পেতে চেয়েছিলো সেই ছোট্টবেলা থেকে।
 
             শেষ

Saturday, September 4, 2021

দেবমুনী

 দেবমুনী

  "উফফ!কি তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি।যেন মনের ভিতরের সবটুকু পড়ে নিচ্ছে এক লহমায়"!!পাহাড়ের ঢালু, এবরো-খেবড়ো রাস্তা পেরিয়ে আমরা যখন তার কাছে যাচ্ছিলাম দুপাশের খাদ দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো হঠাৎ যদি গাড়িটা খাদের মধ্যে পড়ে যায় মৃত্যু নির্ঘাৎ।কিন্তু অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছিলো।শিলিগুড়ি নামার পর প্রায় তিনঘন্টা ওই গাড়ির মধ্যে দম বন্ধ করে বসে থাকলেও মাঝে মাঝেই বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কোন মানুষকে ফিরে পাওয়ার এক অদম্য আনন্দ ঘিরে ধরছিলো আমায়।অথচ আমি কিন্তু কিছুই জানতাম না আগে থাকতে। কার সাথে দেখা করতে চলেছি।তবুও মনের মধ্যে একটা সুপ্ত ধারণা কাজ করছিল।
  দেবলীনা,দেবমাল্যকে নিয়ে সুখের সংসার দীপায়ন ও সাগরিকা ব্যানার্জীর।দীপায়ন একজন একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার।পিতৃ প্রদত্ত সম্পত্তির উপর প্রাসাদোপম এক অট্টালিকা।স্বামী,স্ত্রী দুজনেই মাটির মানুষ।তাদের আচার আচরণে প্রতিবেশীরা কখনোই মনে করে না যে তারা এত বিত্তশালী।আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই তারা প্রতিবেশীদের সাথে নানান অনুষ্ঠানে যোগদান করা,অষ্টমীতে পাত পেতে মায়ের মন্ডবে বসে খাওয়া সবই করতেন।নেশা বলতে ছেলে,মেয়ে,স্ত্রীকে নিয়ে প্রতিবছর পাহাড় অঞ্চলে ভ্রমণ।প্রতি বছর এপ্রিল থেকে মে মাসের মধ্যে তিনি সকলকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।
  কতবার যে তিনি দার্জিলিং গেছেন তার হিসাব হয়তো তিনি নিজেও জানেন না।আবারও তিনি দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন পুরো পরিবার সহ। এতবার দার্জিলিং যাওয়ার সুবাদে বহু মানুষের সাথেই তার পরিচয় থেকে অনেকে খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছে।তাদেরই মধ্যে একজন ড্রাইভার রমেশ।একদম বাঁধাধরা।তারা দার্জিলিংয়ের যেখানেই যাবে না কেন রমেশেরই গাড়িতে যাবে। ইয়ং রমেশ পাহাড়িয়া অঞ্চলে গাড়ি চালায় দুর্দান্ত।পাহাড়ের ঢালু জমি বেয়ে কি অনায়াসে রমেশ গাড়ি নিয়ে নিচে নেমে যায়।দীপায়নবাবুর মেয়ের বয়স দশ বছর আর ছেলে দেবমাল্য পাঁচ বছর।গাড়ির ভিতর বসেই তারা আনন্দে চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে। দীপায়নবাবু রমেশের পাশে বসে মাঝে মাঝে তার পিঠটা একটু চাপড়ে দিয়ে বলেন," এই রকম ঢালু রাস্তায় আমাকেও একটু গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিস রমেশ।" রমেশ হাসতে থাকে।পরিস্কার বাংলায় বলে," দাদা রিটায়ার করে চলে আসবেন দার্জিলিং।ছোট্ট একটা বাংলো কিনে বৌদিকে নিয়ে পাহাড়বাসী হয়ে যাবেন।আমরা খুব মজায় থাকবো তখন।গল্প করতে করতেই দক্ষ হাতে রমেশ এগিয়ে চলে তাদের গন্তব্যের দিকে।
 কিন্তু জীবনে কিছু কিছু মুহূর্ত আসে যখন অযাচিতভাবে এমন কিছুর সম্মুখীন হতে হয় তখন কোন অভিজ্ঞতায় আর কাজ করে না।পাহাড়িয়া অঞ্চল।যখন তখন বৃষ্টি শুরু হয়।বৃষ্টির ভিতর থেকেই রমেশ গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে।কিন্তু হঠাৎ করেই গাড়ির সামনে উপর থেকে একটি বড় পাথর গড়িয়ে পড়ে।পাথরে ধাক্কা খেয়ে গাড়ি হুমড়ি খেয়ে নীচে পরে যায়।সেখানে কিছু বসতি থাকায় সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু মানুষজন উদ্ধারকাজ শুরু করে।গাড়ি গিয়ে বেশ কয়েকটা গাছের গোড়ায় আটকে যায়।সকলেই গাড়ির ভিতর থাকলেও দেবমাল্যকে খুঁজে পাওয়া যায় না।মাথায় প্রচণ্ড আঘাত লাগায় সাগরিকা সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান।রমেশ,দেবলীনা আর দীপায়নবাবু অল্পবিস্তর আঘাত পেলেও সুস্থ্য হয়ে ওঠেন ডাক্তারদের অক্লান্ত পরিশ্রমে।সুখের সংসার ভেঙেচুরে তছনচ হয়ে যায়।মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এসে তিনি এক যন্ত্রমানবে পরিণত হন।অফিস,বাড়ি আর সব সময় চুপচাপ থাকা।তারপর তিনি আর কখনোই মেয়েকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হননি।দেবলীনা বড় হয়েছে তারপর থেকে তার মামাবাড়িতে।অবশ্য তাকে মানুষ করতে, বিয়ে দিতে অর্থের কার্পণ্য তিনি করেননি।
  দেবলীনার বিয়ের তিন বছর পর স্বামীর অনেক জোরাজুরিতে স্বামী সহ সে এখন দার্জিলিংয়ের পথে।ওই ঘটনার পর আর দার্জিলিং যাওয়া হয়নি বাপ,মেয়ের।দুবছর হল বাবাও চলে গেছেন।গাড়ির মধ্যেই ড্রাইভারের সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে একজন সাধুর কথা।যিনি নাকি মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েই বলে দিতে পারেন তার অতীত,বর্তমান এবং ভবিৎসত। দার্জিলিং যাওয়ার পথে সেবক কালী মন্দিরের কাছাকাছি তিনি থাকেন একটি নির্জন এলাকায়।দেবলীনার বায়নাতে গাড়ি ছুটলো সাধুর কুটিরের দিকে।
  দুর্গম পথ অতিক্রান্ত করে যখন স্বামী,স্ত্রী সেই সাধুর কুটিরের কাছে পৌঁছালো তখন প্রায় দুপুর।দু,একজন শিষ্যের সহয়তায় দেবলীনা ও তার স্বামী সাধুর সম্মুখীন হল।সাধু দেবলীনার দিকে চোখ তুলে তাকালেন।দেবলীনা দেখতে পেলো তার চোখদুটি যেন অস্তগামী সূর্যের লাল আভার মত পরিবর্তিত হতে হতে তা জলে পূর্ণ হয়ে গেলো।সে চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থাকা দেবলীনার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হল না।সে চোখ নামিয়ে নিলো।সাধুর মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসলো "দিদি" শব্দ।দেবলীনা তড়িৎ গতিতে সাধুর মুখের দিকে তাকালো।
 ভাই,বোনের এই মিলন দৃশ্যে সাক্ষী থাকলো দেবলীনার স্বামী আর পাহাড় পর্বত,ঝর্না,গাছপালা ।সেদিন সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর একটি গাছের দুটি বড় শাখার মধ্যে ওই পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশুটি অক্ষত অবস্থায় আটকে ছিল।পরদিন ভোরে শিশুটির কান্না শুনে তাকে উদ্ধার করেন কিছু পাহাড়বাসী।দেবমাল্য দিদির সাথে আর ফেরেনি।তার একটাই বক্তব্য ছিল ঈশ্বর চেয়েছিলেন তিনি তার সাধনায় তাকে পেতে।তিনি তা পেরেছেন।হয়ত তার পথটা ভিন্ন ছিলো কিন্তু উর্দেশ্য তার সফল হয়েছে।
  
 

Wednesday, September 1, 2021

আওয়াজ উঠুক

প্রতিবাদ

 অনেকক্ষণ ধরে কথা বলার পর পঞ্চাশোর্ধ নন্দিনী হাঁপাতে থাকেন। হাঁপাতে হাঁপাতেই তিনি ঘরের এদিকে ওদিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজতে থাকেন।তা দেখে বুঝতে পারে তার পাশে বসে থাকা অঙ্কিতা।সে এগিয়ে গিয়ে একটা জলের বোতল নন্দিনীর সামনে ধরে।নন্দিনী বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে তার অর্ধেকের বেশি জল পান করে ফেলেন। তার মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে অঙ্কিতা আর ভাবতে থাকে যে কথাগুলো নন্দিনী বলছেন তার একটি বর্ণও তো মিথ্যা নয়।আমাদের সমাজ নানানভাবে নানান দিক থেকে মেয়েদের উপর সেই পুরুষতান্ত্রিক শাসনই ফলিয়ে এসেছে আজও আসছে।এতদিন তো সত্যিই এ কথাগুলো মাথায় আসেনি।সে তাকিয়ে দেখে নন্দিনীর চোখ থেকে টপটপ করে জল পরছে।কিছুটা সময় নিয়ে নন্দিনী আবার বলতে শুরু করেন।
  তখন আমার বয়স চৌদ্দ কি পনের।বাবা একটা অ্যাকসিডেন্ট করে শয্য্যাশায়ী।আমাদের পাড়াটা ছিলো বেশ ধনী পাড়া।তার মধ্যে আমরাই ছিলাম মধ্যবিত্ত।পাড়ার নানান বাড়িতে পুজানুষ্ঠানে এমন কি পাড়ার ক্লাবের দুর্গাপূজা,কালীপূজা থেকে শুরু করে বিয়ে,অন্নপ্রাশন এমন কি পৈতাতেও আমার মাকে কাজের জন্য নিয়ে যেত। হ্যাঁ এরজন্য তারা মাকে পারিশ্রমিকও দিত।প্রথম প্রথম বাবার আপত্তি ছিল মায়ের এইসব কাজে যাওয়ার।কিন্তু বাবার অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে তিনি এসব নিয়ে আর মাথা ঘামাতেন না।আমিও মায়ের সাথে যেতাম।কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে যেগুলো মা বলতেন 'তুই ধরিস না' -।বুঝতে পারতাম না আমি সেই সব কাজ করতে পারবো না কেন?কিন্তু মায়ের কথা শুনে আমিও কিছু কিছু কাজ থেকে বিরত থাকতাম।মা খুব নিষ্ঠাভরে সেই সব কাজ করতেন।আমার মায়ের রান্নার হাত ছিল খুবই ভালো।তিনি রান্না করতেও খুব ভালোবাসতেন।তখনকার দিনে ব্রাহ্মণ ছাড়া ঠাকুরের ভোগ রান্না হত না কারো বাড়িতে।এখন তো সেই ব্যাপারটা অন্তত উঠে গেছে।যে যার বাড়িতে নিজে রান্না করে তার গৃহদেবতাকে অন্নভোগ নিবেদন করে।এরই মধ্যে দিদির বিয়ে ঠিক হয়।মা একা হাতে সব কাজ সামলান।এখানেও সেই একই ব্যাপার।আমাকে অনেক কাজই করতে দেওয়া হয় না।কেন করতে পারবো না মাকে জিজ্ঞাসা করাতে মা বললেন,'বিয়ে না হলে এইসব কাজ করা যায় না'।মেনে নিলাম তখন সরল বিশ্বাসে।এখনকার দিনের ছেলেমেয়েদের মত আমরা তো এতটা ফরোয়ার্ড ছিলাম না;তাই অনেক প্রশ্ন মাথার মধ্যে আসলেও সব জানতে চাইতে সাহস পেতাম না।এইভাবেই চলছিলো সবকিছু।মা এইসব কাজ করে যা পেতেন তাই দিয়েই কোনরকমে আমাদের তিনজনের চলে যেত।দিদির বিয়েতে সেভাবে কিছু আয়োজন না করলেও বাবার সঞ্চয়ের সব টাকায় খরচ হয়ে গেলো।ইতিমধ্যে আমিও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম।হঠাৎ করেই বাবা একদিন ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন।
  মায়ের ওইসব কাজগুলি বন্ধ হয়ে গেলো।কিন্তু বিশ্বাস করো অঙ্কিতা আমি তখনো বুঝতে পারিনি লোকের বাড়ির আনন্দানুস্থানে মাকে আগের মত কেন আর ডাকে না।আমরা তখন কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েদের মত ছিলাম না।আমরা যতই বড় হই না কেন কোন ব্যাপারেই নাক গলাতাম না।মায়ের কাছে জানতে চাইলাম কেন কাজগুলি চলে গেলো?মা বললেন 'বিধবা মহিলারা কোন শুভ কাজে অংশ নিতে পারে না।' 
 তাহলে ভাবো অঙ্কিতা কুমারী মেয়েরা শুভকাজে অংশ নিতে পারবে না কারণ তার পাশে একজন পুরুষ শয্যাসঙ্গী নেই।বিধবার ক্ষেত্রেও তাই।তারমানে আমাদের সমাজ বলতে চেয়েছে নিত্য একজন পুরুষের কাছে শুতে না পারলে মেয়েরা শুভ নয় বলেই তারা শুভ কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।আবার যদি কোন বিধবা মহিলা পুনরায় বিয়ে করেন তিনি শুদ্ধ হয়ে গেলেন।সব শুভ কাজে তিনি অধিকার পেয়ে গেলেন।সমাজের এটা কোন ধরণের নিয়ম?এখানেও আমাদের বাঙ্গালী সমাজ নারীকে সেই অন্ধকারেই রাখতে চেয়েছে। কোনো মা তার সন্তানের শুভ কাজের সময় বাঙ্গালী সমাজের আচার আচরণগুলো তখনই করতে পারবেন যদি তিনি সধবা হন।আর যদি তার স্বামী মারা যায় তিনি সন্তানের শুভ কাজেও অংশ নিতে পারবেন না।আরে কবে কে মায়ের থেকে সন্তানের মঙ্গল কামনা বেশি করেছে?বিধবা হয়েছেন বলে তিনি সন্তানের শুভ কাজে অংশ নিলে তার সন্তানের মঙ্গল কি অমঙ্গল হবে --- সেটা আমাদের সমাজ ঠিক করে দেবে?সমাজ আমাদের কি দেয়? কারা সমাজের এই নিয়মগুলি বানিয়েছেন?পুরুষের নিত্য শয্যাসঙ্গী হতে না পারলেই নারীরা অশুচি?তাহলে বেশ্যারা কেন ব্রাত্য?তারা নিত্য নূতন শয্যাসঙ্গী পাল্টায় বলে?যারা শাঁখা,সিঁদুর পরে পরপুরুষের সাথে পালিয়ে যাচ্ছে তাদের কিন্তু এসব কাজে কোন বাঁধা নেই।সমাজ এদের কোন দোষ দেয় না কোন শুভ কাজে কারণ তাদের রাতের শয্যাসঙ্গী শুধু পাল্টেছে কিন্তু মরে যায়নি!পাশে একজন পুরুষ থাকা নিয়ে কথা!আমার প্রতিবাদ এসব মহিলাদের বিরুদ্ধে নয়,প্রতিবাদ আমার সমাজের বিরুদ্ধে।স্ত্রী আচার বা মহিলা আচার কেন কুমারী বা বিধবারা করতে পারবেন না তার বিরুদ্ধে।এই সমাজ আমি মানি না।আর মানি না বলেই আমি আমার মত কিছু মহিলাদের নিয়ে এই আন্দোলনে নেমেছি।এর জন্য প্রাণ সংশয় হয়েছে অনেকবার কিন্তু আমি দমিনী।আজকের যুগে শহরে অনেক শিক্ষিত বাড়িতেই এসব আর মানে না।কিন্তু গ্রাম বা মফস্বল শহরে এখনো কেউই এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।আজ আমি এসেছিলাম কলকাতায় এক সাংবাদিকের কাছে।আমাদের মফস্বল শহরে এক বাড়িতে বিধবা মা তার মেয়ের বিয়ে দেবেন।তার আর কেউ নেই।তিনি আমার পরামর্শ অনুযায়ী মেয়ের বিয়ের যাবতীয় কাজ নিজেই করবেন ঠিক করেছেন।ওখানকার কোন সাংবাদিকই রাজি হয়নি খবরটা ছাপাতে।কারণ ওখানকার নেতারা চাননি।তাই এক সোর্স মারফত একজন আমাকে কলকাতা পাঠান ওনার সাথে কথা বলতে।কিন্তু ওরা যে আমায় ফলো করতে করতে এতদূর ধাওয়া করবে আমি বুঝতেই পারিনি।হয়ত মেরেই ফেলতো যদি না তুমি সেখানে হাজির হতে।
 অঙ্কিতা একজন সমাজ সেবিকা।বয়স চল্লিশের উপরে।একাই থাকেন।একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করেন।প্রতিবাদী চরিত্র।অন্যায় দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়েন।আজ দুপুরে তিনি যখন নিজেই ড্রাইভ করে বাড়ি ফিরছিলেন তখন দেখতে পান একজন মহিলাকে কিছু মানুষ ঘিরে বেশ উচ্চস্বরে বাকবিতণ্ডায় ওই স্থান সরগরম করে রেখেছেন।পথ চলতি কিছু দর্শক সেখানে থাকলেও কেউই মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে দুটি কথা বলেননি।অঙ্কিতা গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে তাদের ভিতর থেকে নন্দিনীকে উদ্ধার করে এবং রাস্তায় দাঁড়িয়ে সামান্য কিছু শোনার পরই তাকে সাথে করে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে।সব শোনার পর নন্দিনীকে কথা দেন তার এই যুদ্ধে তার সাথে সে আজীবন থাকবে।সমাজের কালো দিকগুলো উন্মোচন করতে এইভাবে এক একজন করে মানুষকে দলে টানার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে। বাঙ্গালী সমাজ আজও যে সেই পুরনো ধ্যান,ধারণা নিয়ে এগিয়ে চলেছে তার যে কোন যুক্তি নেই এগুলো প্রতিটি মানুষের বোঝার সময় এসে গেছে।

   #সমাজের_একটি_কালো_দিক_উন্মোচনের_চেষ্টা_মাত্র
#মনমত_কারো_না_হলে_অযথা_কুমন্তব্য_থেকে_বিরত_থাকবেন।