অপেক্ষার প্রহর
"স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎটা বোঝার আগেই সবকিছু বদলে গেলো"- বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে।সৃজনী কথাগুলো বলেই জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তখনো তার চোখের থেকে অঝোর ধারায় জল পরে চলেছে।প্রচন্ড হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে তার চোখেমুখে লাগছে।বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার তখন।রণজিৎ আস্তে করে উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিলো।সম্বিত ফিরে পেয়ে সৃজনী আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলো।বেশ কিছুক্ষণ দুজনেই নীরব।
বাংলায় এম এ করা সৃজনী বাবা,মায়ের পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে।নিশীথ রেলের উচ্চপদস্থ কর্মচারী।পাগলের মত ভালোবাসে নিশীথ সৃজনীকে।সংসারে শ্বাশুড়ী ছাড়া আর কেউ নেই।তিনিও তার বৌমাটিকে নিজ কন্যার মতই দেখেন।মাঝে মাঝে সৃজনীর মনে হত এ সবকিছু যেন স্বপ্ন।জীবনে এত সুখ সে কোনদিন কল্পনাও করেনি।
কিন্তু সৃজনীর জীবনে এ সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।বিয়ের ছমাসের মাথায় অফিস থেকে ফেরার পথে বাইক অ্যাকসিডেন্ট করে নিশীথ চলে যায় সৃজনীর জীবন থেকে।বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান সে।এই আকস্মিক ঘটনায় বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়।তিনিও নিশীথ চলে যাওয়ার দুদিনের মধ্যে চলে যান।ওদিকের জামাই ও স্বামীর মৃত্যুর পর মায়ের পাগল হয়ে ওঠার জোগাড় আর এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে শ্বাশুড়ী মা বিছানা নিয়েছেন।খাওয়া,ঘুম সব বন্ধ।কোন দিকে যাবে সৃজনী?
শ্বাশুড়ী বিছানা ছেড়ে উঠতেই পারেন না।তাই মাকে হাতে, পায়ে ধরে তার কাছে নিয়ে আসা।নিশীথ চলে যাওয়ার পর চিৎকার করে কেঁদে নিজে হালকা হওয়ার সময়টুকুও সে পায়নি।
স্বামী ও বাবার কাজ মিটে যাওয়ার পরই তাদের অফিসে ছুটাছুটি।পেনশন মায়ের নামে করা আর নিশীথের অফিসে নিজের একটা চাকরি।তানাহলে ওই বৃদ্ধা মানুষটিকে নিয়ে বেঁচে থাকায় যে দায় হয়ে পড়বে।
রেলে জয়েন করার কিছুদিন পর থেকেই সে লক্ষ্য করে সহকর্মী রণজিৎ নানান চলছুতোই তার কাছাকাছি থাকতেই যেন ভালোবাসে।কিন্তু জীবনে এতো বড় আঘাতের পর নূতন করে তার আর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছা করে না।সে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে থাকে নানানভাবে।
হঠাৎ করেই রণজিৎ বদলী হয়ে যায়।চলে যাওয়ার আগে বারবার সৃজনীকে অনুরোধ করে তাকে একান্তে দশটা মিনিট সময় দেওয়ার জন্য।কিন্তু কিছুতেই সৃজনী রাজি হয় না।
এক ছুটির সন্ধ্যায় অপরিচিত এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা ও এক ভদ্রলোক এসে হাজির সৃজনীর বাড়িতে অর্থাৎ তার শ্বশুরবাড়িতে।তার শ্বাশুড়ী এখন কিছুটা স্বাভাবিক কিন্তু কথাবার্তা আগের মত আর বলেন না।এই তিন বছরে সৃজনীর মা নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন।আর মানুষের শোকের একমাত্র ওষুধ তো সময়।জীবন স্তব্ধ হলেও ঘড়ির কাটা তো স্তব্ধ হয় না।স্তব্ধ হওয়া জীবনও আস্তে আস্তে তার গতি ফিরে পায় সময়ের সাথে।
ভদ্রলোক,ভদ্রমহিলা দুজন রঞ্জিতের বাবা ও মা।তারা ছেলের বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছেন।সানন্দে শ্বাশুড়ী মা এ বিয়েতে মত দেন।কিন্তু তাদের সামনে বেঁকে বসে সৃজনী।সৃজনীর মা সেদিন ওখানে ছিলেন না।তিনি কয়েকদিনের জন্য দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়িতে গেছিলেন।তারা সৃজনীর শ্বাশুড়ীকে তার নিজের মা ই ভাবেন।শেষমেষ তাদের জোরাজুরিতে সৃজনী বলে আগে সে রঞ্জিতের সাথে কথা বলতে চায়।কিছু কথা তাকে জানানো দরকার।তারা তাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে যান।
সৃজনী যখন রঞ্জিতের সাথে দেখা করতে আসে তখন সন্ধ্যা হয় হয়।অফিস থেকে বেরিয়ে সে সোজা চলে আসে।আকাশ তখন ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।রণজিৎ কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে এসেছে।
পুরো ঘটনা শোনার পর রণজিৎ বলে,
--- জীবনের একটা স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে বলে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেবে - সেভাবে জীবন চলে না।
সব জানি,সব বুঝি।আমার আরও সময় চাই।জানিনা কোনদিন আমি আমার জীবনে যা ঘটে গেছে তা মেনে নিতে পারবো কিনা।যদি কোনদিন মানতে পারি তাহলে তোমার কাছেই প্রথম ছুটে আসবো।আজ চলি।
সৃজনী উঠে দাঁড়ায়।রঞ্জিতের মা চা, জলখাবার নিয়ে এসেছিলেন সৃজনী তাকে প্রণাম করে বলে,
-- আজ নয় মাসিমা।যদি সুযোগ হয় অন্য কোনদিন এসে পেট ভরে খেয়ে যাবো।
রণজিৎ সৃজনীর পিছন পিছন কিছুটা হেঁটে আসা।তারপর বলে,
--- আমি কিন্তু অপেক্ষা করবো।
সৃজনী পিছন ফিরে তাকায়।কিছুক্ষণ কি যেন ভাবে।তারপর কোন কথা না বলেই সামনের দিকে এগিয়ে যায়।