স্বপ্নপূরণ
--- ঘরে যা বাবা | বড় হয়েছিস এখন , এই রান্নাঘরে ঘুরঘুর করবিনা |
--- মা আমি তো হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়বো , তাই প্রাথমিক হাতেখড়িটা তোমার কাছ থেকে নিতে চাই | অক্ষর জ্ঞানটা তোমার কাছ থেকে হয়েছিল | খারাপ ফল হয়নি মাধ্যমিকের | আর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টটা বের হয়ে গেলেই আমি তিনবছরের জন্য রান্নাঘরটাকেই আমি আমার ঠাকুরঘর মনেকরে কাটিয়ে দেবো |
--- তোর বাবা শুনলে কিন্তু আবার চেঁচাবে | তিনি কিন্তু চাননা তুই হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়িস | তার খুব ইচ্ছা তোকে বিটেক এ ভর্তি করা | নিজে একজন ইঞ্জিনিয়ার তিনি তোকেও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে চান | তার মতে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়া মানে মেয়েদের মত রান্নাঘরে হাতাখুন্তি নাড়ানো |
--- বাবার এই কথাগুলো শুনলেই না আমার মাথাটা গরম হয়ে যায় |
প্রায় প্রতিদিনই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া ছেলের সাথে সুমনার এই ধরণের কথাবার্তা হয়েই থাকে | সুমনা হয়েছে শাকের করাত এদিকে ছেলেকে বলছে বাবার ইচ্ছানুযায়ী উচ্চমাধ্যমিকের পর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হবি আর ওদিকে স্বামী আদিত্যকে বলছে সেই ছোটবেলা থেকে ছেলেটা আমার সাথে রান্নাঘরে ঘুরঘুর করে বেড়ায় | ওর ইচ্ছানুযায়ীই ওকে পড়তে দাও | রোজ এই নিয়ে দুজনের যুক্তির উপর যুক্তি শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে সুমনা হাঁপিয়ে যায় |
( 2)
রেজাল্ট আউট হল | খুব ভালো নম্বর নিয়েই আশিক পাশ করেছে | বাপছেলের মান-অভিমান ,
ঝগড়া-চেঁচামেচি , ছেলের রাগ করে না খেয়ে শুয়ে পড়া - সব মিলিয়ে এক হুলুস্থূল পরিস্থিতি বাড়িতে | একদিন এই চেঁচামেচিতেই সে প্রচন্ড অসুস্থ্য হয়ে প্রেসার বেড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লো | সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে ডক্টর ডেকে আনা হল | ডাক্তারের কড়া নির্দেশ যতদিন না প্রেসার নর্মাল হচ্ছে একদম বেডরেষ্ট | এমন কি বাথরুমে যেতে গেলেও তাকে ধরে নিয়ে যেতে হবে | আদিত্যের মাথায় হাত | তার আঠারো বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খাননি | এমনিতেই তিনি কোনদিন এসব পারতেননা আর সুমনাকে বিয়ে করার পর থেকে সে তাকে কোনদিন কিছু করতেও দেয়নি | আর এতগুলি বছরে সুমনা বিছানা থেকে উঠতে পারবেনা - এমন অসুস্থ্যও কোনদিন হয়নি |কি করে চলবে ভাবতে ভাবতে তিনি ঠিক করেন সর্বক্ষণ দেখাশুনার জন্য একজন আয়া আর কাজের মাসিকে বলে একজন রান্নার মহিলা জোগাড় করা | কিন্তু তাও তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার | বললেই তো আর পাওয়া যাবেনা | রাতে খেতে খেতেই এই ঝামেলা | তারপরই সুমনার অসুস্থ্য হয়ে পড়া | দুশ্চিন্তা নিয়ে আদিত্য শুতে গেলেন | এদিকে অন্যঘরে আশিকের চোখে ঘুম নেই মায়ের চিন্তায় | ভোর হওয়ার মুখে আশিক পা টিপে টিপে বাবা , মায়ের ঘরের দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখে তার মা উঠে বসে খাটের উপর থেকে পা টা ঝুলিয়ে দিয়ে নামার চেষ্টা করছেন | আর বাবা পাশ ফিরে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন | দৌড়ে এসে সে মায়ের একটি হাত ধরে আস্তে আস্তে বলে ,
--- তুমি বাথরুমে যাবে ? বাবাকে ডাকোনি কেন ?
--- দুবার তোর বাবাকে ডাকলাম | সে আমার দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে পাশ ফিরে আবার নাক ডাকতে শুরু করলো | তাই ভাবলাম একা চেষ্টা করে দেখি | কিন্তু দাঁড়ালেই মাথাটা কেমন যেন ঘুরিয়ে নিয়ে আসছে | তাই বসেই আছি |
মাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যেতে যেতে আশিক বলে ,
--- ডাক্তারবাবু তো বলেই গেছেন একদম সাতদিন শুয়ে থাকতে হবে |
--- কি করে কি হবে কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছিনা | তোর বাবাকে আটটার মধ্যে অফিসের ভাত দিতে হয় |
--- কেন এতো ভাবছো আমি আছি তো |
মাকে আবার খাটে শুইয়ে দিয়ে পুণরায় সন্তর্পনে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো |
(3)
সকাল সাতটা | দরজা ঠেলে আশিক ঘরে ঢুকে দেখে বাবা মা দুজনেই ঘুমাচ্ছেন | বাবাকে গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ডেকে তুলে হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয় আর ইশারা করে বলে মায়ের যেন ঘুমের ডিসটার্ব নাহয় | আদিত্য ফ্যালফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতপেতে চায়ের কাপটা নেন |
এট্যাচ বাথরুম থেকে স্নান করে বেরিয়ে দেখেন সুমনা ঘুম থেকে জেগে গেছেন | তিনি অফিসে বেরোনোর জন্য তৈরী হতে হতে বলেন ,
--- শোনো তুমি কিছু চিন্তা কোরোনা | আমি অফিসে খেয়ে নেবো | কাজের মেয়েটি আসলে ওকে দিয়ে দুটি ডাল ভাত ফুটিয়ে নিয়ো | আর তোমার রাজপুত্রের যদি ডালভাত খেতে অসুবিধা হয় এই টাকা রেখে গেলাম অনলাইনে খাবার অর্ডার করে নিতে বোলো |
সেই মুহূর্তে আশিক ঘরে ঢুকে মায়ের দিকে তাকিয়ে জানতে চায় ,
-- এখন কেমন আছো তুমি মা ?
--- মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে রে |
--- তুমি একদম উঠোনা , এই নাও তোমার পেষ্ট ব্রাশ | এখানে বসেই দাঁতটা মেজে নাও |
বাবার দিকে তাকিয়ে বলে ," বাবা টেবিলে তোমার খাবার দিয়েছি |"
স্বামী , স্ত্রী দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়েন |
সুমনা ছেলের কাছে জানতে চাইলো ,
--- হ্যাঁ রে কি রান্না করলি তুই ?
--- ওই তো ডাল , ভাত আর একটু আলু ভেজেছি | কিন্তু মা জানো ভাতটা না একটু নরম হয়ে গেছে |
--- হাঁড়ি উপুড় দিলি কি করে ?
--- সে এক কান্ড করেছি | অনেকবার ট্রাই করলাম তোমার মত হাঁড়িটাকে উপুড় করতে | কিছুতেই পারলামনা | তখন কি করলাম জানো ?তোমার ওই অনেক ছিদ্রওয়ালা একটা থালা আছে না? ওই যে তুমি যার মধ্যে তরকারি সেদ্ধ করে ঢালো ওটার মধ্যে হাতায় করে ভাত উঠিয়ে ভাতের ফ্যান ঝরিয়ে আবার হাঁড়ির মধ্যে তুলে রেখেছি | এইসব করতে গিয়ে ভাতগুলো নরম হয়ে গেছে |
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আদিত্য হা করে তার কথা শুনছিলেন | তারপর কোন কথা না বলে টেবিলে গিয়ে দেখেন থালায় ভাত, বাটিতে ডাল আর থালার এককোণায় কিছুটা আলুভাজা | ছেলের হাতের ওই নরম ভাত আর মুসুরের ডাল রান্না তার কাছে আজ যেন অনুষ্ঠান বাড়ির রান্নাকেও হার মানিয়ে দিলো |
(4)
অনেক চেষ্টা করেও কোন রান্নার মাসি পাওয়া গেলোনা | সব কিছুই আশিক করে চলেছে অপটু হাতে অথচ নিপুণভাবে | আশিকের অনুপস্থিতিতে সুমনার কাছে চাপাস্বরে তারজন্য আদিত্যকে বকাও খেতে হচ্ছে | এমনকি যে কথা কোনদিন সে তার স্বামীকে বলেনি তাও হাসতে হাসতে বলে দিয়েছে |
--- সত্যিই তুমি একটা ঢেঁড়স --| একদম কিছুই পারোনা |
স্ত্রীর মুখে কথাটা শুনে হেসেছেন ঠিকই কিন্তু মনেমনে তিনিও নিজেকে একটা ঢেঁড়সই ভাবছেন | আজ তিনি অনুভব করতে পারছেন সংসারে প্রতিটা মানুষের সব কাজই জানতে হয় | মানুষ কোন সময় কি পরিস্থিতিতে পড়বে তা কেউ বলতে পারেনা | ঐটুকুই একটা ছেলে কি সুন্দরভাবে রান্নাঘরটিই শুধু নয় অসুস্থ্য মায়ের দেখভাল করছে , সময়মত তার অফিসের খাবার দিচ্ছে অথচ তিনি কিছুই পারেননা ওই অফিস করাটা ছাড়া |
পাঁচ দিনের মাথায় সুমনা বেশ সুস্থ্য হয়ে ওঠে | ছেলেকে বাজারে পাঠিয়ে আজ একটু মাছ এনে জোর করেই ঝোলভাত করে |
হায়ারস্টাডির অনলাইন ফর্মফিলাপ শুরু হয় | আশিক মনেমনে ভাবে বাবার কথামত ইঞ্জিনিয়ারিং এই ভর্তি হই | তানাহলে বাবার সাথে আবার ঝামেলা হবে | আর সেই ঝামেলার মধ্যে পরে মায়ের যদি আবার শরীর খারাপ হয় | আজই বাবা অফিস থেকে আসলে কথা বলতে হবে |
সন্ধ্যার দিকে শুয়ে শুয়ে মোবাইলটা নিয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে কে কোথায় ফর্মফিলাপ করছে , কি পড়তে চায় তাই নিয়ে ওদের হোয়াটসআপ গ্ৰুপে আলোচনা হচ্ছে | হঠাৎ খেয়াল করে বাবার নাম্বার থেকে একটা মেসেজ ঢুকলো | মেসেজটা দেখেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো | আর সেই মেসেজটা ছিল , "National Council Of Hotel Management Catering Tecnology"- ফর্মফিলাপ করার জন্য একটা লিংক | আর তার নিচুতে লেখা " কাল সকালে কোন সাইবার ক্যাফে গিয়ে ফর্মটা ফিলাপ করে এসো |"
#আমার_লেখনীতে
#হেঁসেলের_গোপনকথা
No comments:
Post a Comment