স্মৃতিপটে আঁকা দিনটি
কলেজের ফেষ্টে প্রথম দেখা | তখনই রেশমি জানতে পারলো শাওন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র | এতবড় কলেজ ক্যাম্পাসের মধ্যে সকলের মুখ মনে রাখাও সম্ভব নয় | আর সেতো মাত্র কিছুদিন হল ভর্তি হয়েছে | স্মৃতির পাতা উল্টেও মনে করতে পারলোনা রেশমি কোনদিন শাওনকে দেখেছে বলে | মঞ্চে তখন বন্ধুদের অনুরোধে শাওন একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছে | গানের অনুরোধ নিয়ে অনেক চিরকুটও পৌঁছে যাচ্ছে তার কাছে | শাওনের গান শুনে সবাই মুগ্ধ | আর রেশমি শুধু গান শুনেই নয় শাওনের চেহারা দেখেও মুগ্ধ | রেশমি এই কলেজে মাত্র মাস দুয়েক হল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছে | বেশ কয়েকজনের সাথে সখ্যতাও গড়ে উঠেছে | তাদেরই মধ্যে একজন নীলিমা | নীলিমার কাছ থেকেই রেশমি জানতে পারলো শাওনের সম্মন্ধে টুকটাক কিছু |
বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে | পড়াশুনায় , গানবাজনায় তুখোড় | একবার যা দেখে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে হুবহু তাই এঁকে দেয় | গতানুগতিক ধারায় বড়লোকের বকে যাওয়া ছেলেদের মধ্যে শাওন পড়েনা | কেউ বিপদে পড়লেই তার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় |
--- হ্যারে নীলিমা তুই তো ওর নাড়িনক্ষত্র সব জানিস | তুই তো এ বছরই আমার সাথেই ভর্তি হয়েছিস ; তা তুই এতো জানলি কি করে ?আমি ভেবে অবাক হচ্ছি একটা ছেলের মধ্যে শুধুই গুনের ছড়াছড়ি নাকি তোর চোখে ওর কোন দোষ ধরা পড়েনি ?
--- তুই ওর সাথে মিশে দেখিস তোর চোখেও ওর দোষ ধরা পড়বেনা |
--- হ্যারে তুই কি ওর প্রেমে পড়েছিস ?
--- কলেজে যারা ওর সাথে মেশে সকলেই ওর প্রেমে পরে | কিন্তু ও কারও প্রেমে পড়েনা |
--- ওমা তাই নাকি ? ব্যাপারটা তো খুব ইন্টারেস্টিং |
(2)
রেশমি কিন্তু তারপরেও কোনদিন শাওনের দেখা পায়নি | নীলিমা অনেকদিন ওকে বলেছে ' চলনা তোর সাথে পরিচয় করে দিই ' --- ব্যাপারটাকে রেশমি কোন পাত্তাই দেয়নি | একদিন দ্বিতীয় বর্ষের একটি মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে হঠাৎ পরে গিয়ে মারাত্মক পায়ে আঘাত পায় | বাইরে থেকেই দেখে বোঝা যাচ্ছে তার পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙ্গে পা টা রীতিমত ঝুলছে | সে এক হুলুস্থূল কান্ড | ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে স্যার , ম্যাম সকলেই এসে উঁকি মেরে দেখে নানান উপদেশ দিয়ে সেখানে দাঁড়িয়েই তাদের কর্তব্য সারছেন | রেশমি সেখানে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বললো ,
--- ওর বাড়িতে একটা খবর দিতে হবে | মেয়েটি অথাৎ রিমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে ওর বাড়িতে রেশমিই ফোন করে | এইসবের মধ্যে কোথা থেকে শাওন এসে রিমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ভিড়ের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে "কেউ যদি যেতে চাস হাসপাতাল তাহলে যেতে পারিস আমার সাথে | আর যদি নিতান্তই যেতে না চাস আমার গাড়ির দরজাটা খুলে ওকে গাড়িতে তোলার জন্য একটু হেল্প কর | রিমা ব্যথা যন্ত্রণায় অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে | খুব রোগা প্যাটকা চেহারার রিমাকে তুলে নিয়ে গাড়ির কাছে শাওন পৌঁছে দেখে আগে থাকতেই গাড়ির দরজা খুলে একজন দাঁড়িয়ে | রিমাকে গাড়িতে তোলার পর কে যাবে আর কে যাবেনা তা নিয়ে হুড়োহুড়ি পরে যায় এতক্ষণে | একজন সামনে আর রিমাকে নিয়ে একজন পিছনে গাড়ি ছুটলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে |
এর বেশ কয়েকদিন পর রেশমি বাসে উঠবে বলে বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে | হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামে | কাঁচ নামিয়ে গাড়ির ভিতর থেকে একটি কাগজ গোল করে মোড়া রেশমির দিকে এগিয়ে দিয়ে শাওন বলে , " এটা তোমার |"
--- কি এটা ?
--- খুলে দেখো |
ওখানে দাঁড়িয়েই রেশমি খুলে দেখে জল রংয়ে আঁকা সে নিজে একটি গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে | সেদিন যে চুড়িদারটা তার পরা ছিল ঠিক সেই রংই ছবিতে চুড়িদারটির| অবাক হয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে | সেই শুরু দুটি হৃদয়ের এক হয়ে পথ চলার প্রতিশ্রুতি |
(3)
ক্যাম্পাস থেকেই চাকরি হয়ে যায় শাওনের | ফাইনাল পরীক্ষার পরেই শাওন চলে যায় ব্যাঙ্গালোর | ফোনে নিয়মিত যোগযোগ থাকে রেশমির সাথে | মাঝেমধ্যে ভিডিও কলও করে দুজনে কথা বলে | চাকরির বয়স যখন আটমাস তখন শাওন কিছুদিনের ছুটি নিয়ে কলকাতা আসে | ফোনেই রেশমির সাথে কথা হয় এবার সে বাবা মাকে তাদের সম্পর্কের কথাটা বলবে | কিন্তু বাড়িতে শাওনের জন্য অপেক্ষা করছিলো অন্যকিছু | বাড়িতে ফিরে বাবা মায়ের সাথে অনেকক্ষণ গল্পগুজবে পর মা তাকে জানালেন তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হয়েছে | শাওন খুব অবাক হয়ে বললো ,
--- সেকি আমার কাছে তোমরা তো কিছুই জানতে চাওনি ?
--- এতে জানতে চাওয়ার কি আছে ? ছেলেমেয়ে বড় হলে বাবা মায়ের একটা দায়িত্ব থাকে তাদের বিয়ে দিয়ে সংসারী করা |
--- সেতো নিশ্চয় কিন্তু তাদের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ?
--- মতের বিরুদ্ধে কেন হবে ? কেন তুই এখন বিয়ে করতে চাসনা ?
--- আমি একজনকে ভালোবাসি মা | আর তাকেই বিয়ে করবো |
---কিন্তু তোর বাবা যে কথা দিয়ে দিয়েছেন |
--- আমার কাছে না জেনে যখন কথা দিয়েছো তার দায় তো আমার নয় |
শাওনের বাবা তার কথা মেনে নিতে পারেননি | মুখাৰ্জী পরিবারের একমাত্র বংশধরের বিয়ে সাহা পরিবারের মেয়ের সাথে তিনি কিছুতেই দেবেননা | পরিশেষে বাপ , ছেলের বিরোধ | শাওন রেশমীকে বলেছিলো রেজিস্ট্রি বিয়ে করে মন্দিরে সিঁদুর পরিয়ে তার সাথে নিয়ে যেতে | রেশমির পরিবার শাওনকে মেনে নিয়েছিল | কিন্তু রেশমি রাজি হয়নি | শাওন তাকে অনেক বুঝিয়েছিল তার এক গো
" সময়ের ওপরে সব ছেড়ে দাও | বাবা মায়ের আশীর্বাদ ছাড়া কোনদিনও কেউ সুখী হতে পারেনা |" শাওন চলে আসতে বাধ্য হয় | কিন্তু ফোনে তাদের যোগাযোগ থাকে | গত পাঁচবছরে শাওন আর বাড়ি আসেনি |
দিনপনেরো ধরে শাওন ফোন রিসিভ করছেনা | রেশমি অস্থির হয়ে পরে | সমস্ত লাজলজ্জা ভয় বিসর্জন দিয়ে রেশমি শাওনদের বাড়ি হাজির হয় | সেখানে এসে সে যা দেখে এবং শোনে তাতে পুরোপুরি পাথর হয়ে যায় | নিজের মনকে শক্ত করে শাওনের হাতদুটি ধরে বলে ," তুমি এভাবে ভেঙ্গে পোড়ো না , তোমার চোখের অপারেশন হবে তুমি দেখতে পাবে আবার | আমি তো দুটো চোখ দিয়ে দেখি | এখন থেকে একটা চোখ দিয়েই দেখবো |আমার একটি চোখ দিয়ে তুমি দেখবে |"
--- তা হয়না রেশমি | বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন | সমস্ত হাসপাতালে খবর নিচ্ছেন | আর তাছাড়া তোমার বাবা মা রাজি হবেন কেন ?
--- ওটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও |
--- কিন্তু --
--- কোন কিন্তু না | আমি আজই মেশোমশাইয়ের সাথে কথা বলে যাবো |
(4)
অফিসের গাড়িতে করে অফিস যাওয়ার সময় অন্য একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে শাওনের দুটি চোখেই খুব বিশ্রীভাবে কাঁচ ঢুকে যায় | মারাত্মকভাবে রেটিনার ক্ষতি হয় | ব্যাঙ্গালোরের ডক্টররা হাল ছেড়ে দেন | একমাত্র চোখ প্রতিস্থাপন ছাড়া শাওনের দৃষ্টিশক্তি ফিরে আসা সম্ভব নয় বলে তারা জানান | শাওনের বাবা অসিত মুখার্জী রেশমির এই ত্যাগ দেখে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন | আর বলেন ,
--- আজ বুঝতে পারছি আমার শানু তার জীবনসঙ্গী ঠিকই খুঁজে বের করেছিল | আমার দুর্ভাগ্য আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম | আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিস মা |
যথাসময়ে অপারেশন হয়ে যায় | আর তার ঠিক ছমাস পরেই রেশমি তার স্বামীর সাথে তার কমস্থল ব্যাঙ্গালোরে চলে গেলো |
No comments:
Post a Comment