সকলের শেখা উচিত |
মাম তখন খুব ছোট ওর মা কলপাড়ে বসে বাসন মেজে যখন ধুঁয়ে রাখতেন ও একটা একটা করে সেই বাসনগুলো রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে রাখতো | তখন কত আর বয়স হবে দুই কি আড়াই বছর | ছোট্ট একটা ঘর আর ততোধিক ছোট একটি রান্নাঘর | একটা বড় শপিংমলে সিকিউরিটির দায়িত্ব পালন করে পলাশ আর কটা টাকাই বা মাইনে পায় ?এর থেকে আর বেশিকিছু কিছু করা তার কাছে সাধ্যের বাইরে | মামের তখন বছর পাঁচেক বয়স | একদিন ছুটির দিনে পলাশ তার স্ত্রীর কাছে চাউমিন খাওয়ার আবদার করে | মাম তার বাবার কোলের মধ্যে বাবার বলা কথাগুলো শোনে | পারমিতা সন্ধ্যা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে দেখে এতটুকুন মেয়ে ধারালো বঁটি নিয়ে পেঁয়াজ কাটতে বসেছে | সে চুপিচুপি পলাশকে ডেকে দেখায় তার মেয়ের কান্ড | পলাশ ভয় পেয়ে পারমিতাকেই বকতে বকতে আস্তে করে মেয়েকে বঁটির সামনে থেকে তুলে নিয়ে যায় | ছোট্ট মাম বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে ,
--- তুমি মাকে কেন বকলে বাবা? মা তো সবসময় তোমায় রান্না করে খাওয়ায় | একদিন আমি রান্না করলে কি এমন হত ?
পলাশ হেসে পরে মামকে চুমু করে বলে ,
--- আমার লক্ষ্মী সোনা মেয়ে | আগে তুমি বড় হও তারপর আমায় রান্না করে খাওয়াবে |
--- মাকে তখন আমি রান্নাঘরে ঢুকতেই দেবোনা |
ছোট্ট মাম লেখাপড়ার সাথে সাথে মা রান্না করার সময় অধিকাংশ দিন সে রান্নাঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে মা কি করে রান্না করেন | আর রান্না করতে করতে মা যখন এদিক ওদিক যান মাম তখন খুন্তিটা নিয়ে কড়াইয়ের ভিতর নাড়াচাড়া করে | এখন সে যথেষ্ট বড় হয়েছে | নবম শ্রেণীতে পড়ে | দু একদিন দু একটা পদ ও রান্না করে বাবা মাকে খাওয়ায় | নুতন হাতে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করে সে খাবারটিকে সত্যিই সুস্বাদু করে তোলে | আর তার বাবা মা তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতে বারবার উচ্চারণ করেন " অসাধারণ হয়েছে |"
মামের মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ | মায়ের সাথে সে মামাবাড়ি গেলো কদিন ঘুরে আসার জন্য | সেখানে গিয়েও সে মামা মামীকে তার হাতের রান্নার জাদু দেখিয়ে আসলো | কিন্তু মামাবাড়ি থেকে ফেরার পথে মারাত্মক এক অটো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে মা মেয়ে দুজনেই হাসপাতালে ভর্তি হয় | মায়ের আঘাত ছিল অত্যন্ত বেশি | মামের আঘাত খুব একটা গুরুতর ছিলোনা | মামকে সেদিনই ছেড়ে দেয় | কিন্তু পারমিতার ছিল ইন্টারনাল হ্যামারেজ | কোথাও কোন রক্তক্ষরণ নেই অথচ দুদিন ধরে তার জ্ঞানও নেই | তৃতীয় দিনে পারমিতা তার মাম ও পলাশকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেলো |
অপটু হাতে অথচ ভীষণ দায়িত্ব সহকারে মাম রান্নাঘরের কাজ আর তার লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলো | দুবেলা রান্নাঘরে ঢুকলে মামের পড়াশুনার ক্ষতি হবে বলে কষ্ট হলেও পলাশ একটি ফ্রিজ কিনে আনে | কি অদ্ভুতভাবে মাম সকালে উঠেই বাবা বেরোনোর আগে তার ও নিজের টিফিন আর ভাতের সাথে একটা তরকারি করে নেয় | আর ওই তরকারিটাই রেখে দেয় রাতের জন্য | পলাশ ফেরার পর মাম রুটি করে | বাবা ফেরার পূর্ব পর্যন্ত সে তার পড়াশুনাটা চালিয়ে যায় | কোন কোনদিন পলাশ তাকে রুটিটা করতে সাহায্য করে | পলাশ মনেমনে ভাবে সেই ছোট্ট থেকে মেয়েটি রান্না করতে ভালোবাসে | মাম রান্নাঘরে ঢুকলেই পলাশ পারমিতাকে কত বকেছে | আর পারমিতা হেসে পরে বলতো ,
--- যতই তুমি তোমার মেয়েকে লেখাপড়া শেখাওনা কেন রান্না তো ওকে করতেই হবে | এখন থেকে টুকটাক যা করছে ওকে করতে দাও | মানুষের ভাগ্যের কথা তো বলা যায়না কখন কোন পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে কেউ বলতে পারেনা |
রান্নাঘরে মামের কাজকর্ম দেখে মাঝে মধ্যে অনেক কথাই পলাশের মনে পরে | শপিংমলে কাজ করতে করতেই সে একভদলোকের সহায়তায় ছোট একটি কোম্পানিতে অপেক্ষাকৃত বেশি মাইনের চাকরি পেয়ে যায় | আর তার বছর দুয়েক পরেই তার পারু তাকে ছেড়ে চলে যায় | তার আগেই অবশ্য পলাশ অপেক্ষাকৃত একটি ভালো ঘর পেয়ে উঠে আসে | দেখতে দেখতে মেয়ের গ্রাজুয়েশনও শেষ হয়ে যায় | মেয়ের ইচ্ছা সে ব্যবসা করবে আর বাবার ইচ্ছা সে সুস্থ্য থাকতে থাকতেই তার মামকে সুপাত্রস্থ করবে | মেয়ের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়ে সে মামকে বিউটিশিয়ান কোর্সে ভর্তি করে | ছমাসের কোর্স দেখতে দেখতেই কেটে যায় | ঘরের সমস্ত কাজ সে এখন একা হাতেই করে | বাবাকে কোন কাজই সে করতে দেয়না | সাধারণ তরিতরকারি দিয়ে নিত্যনূতন পদ রান্না করে বাবাকে চমকে দেয় | পাড়ার ভিতর বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সে ফেসিয়াল থেকে শুরু করে পার্লারের যাবতীয় কাজগুলি করে আসে | রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজ করেই সে এই কাজগুলি করে | এতো পরিশ্রম করতে বাবা যখন নিষেধ করে তখন সে বলে তার খুব শখ একটা পার্লার দেওয়ার আর এইজন্যই সে এইভাবে রোজগার করে টাকা জমিয়ে ব্যবসাটা শুরু করতে চায় | কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক | পলাশ একটি ভালো ছেলের সন্ধান পেয়ে অনেক বুঝিয়ে সে তার আদরের মামকে রাজি করায় | মাম রাজি হয় একটাই শর্তে ছেলের সাথে তাকে আলাদা কথা বলতে দিতে হবে | পলাশ হেসে বলে ,
--- এটা কোন ব্যাপার ? ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করে দেবো |
বিয়ে হয়ে যায় | অষ্টমঙ্গলের পরের দিন থেকে মাম তার বাবার জন্য টিফিনবক্স ভর্তি করে খাবার নিয়ে বাসে আধাঘন্টা জার্নি করে পৌঁছে যায় বাবার অফিসে | প্রথমদিন পলাশ মেয়েকে দেখে খুশি হলেও পরপর এটা ঘটতে থাকাই তিনি মামকে বলেন ,
--- এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছেনা মা | রোজরোজ তুই এটা করলে জামাই তোর শ্বশুরমশাই কি ভাববেন ?
--- ওটা নিয়ে তুমি ভেবোনা বাবা | আমার শ্বশুরমশাই খুবই ভালো মানুষ | আর তোমার জামাই? ওর কাছে তো বিয়ের আগে এটাই আমার শর্ত ছিল | ওই যে বিয়ের আগে যখন দেখা করেছিলাম না ? তখন বলেই দিয়েছিলাম আমার বাবা নিজে রান্না করতে পারেননা আর বাইরের খাবার খেতে পারেননা | বাবা যতদিন বাঁচবেন আমি রান্না করে বাবাকে খাবার দিয়ে আসবো আর এই কাজের জন্য আমি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে যেমন পার্লারের কাজগুলো করি ঠিক সেইভাবেই কাজ করবো | আর তারজন্য আমি আপনার বা আপনার বাবার সেবা যত্নের কোন ত্রুটি রাখবোনা | তাতে যদি আপনি রাজি হন তাহলেই তাহলেই আমি বিয়েতে রাজি | দেখো বাবা এরপরে তুমি যখন রিটায়ার করবে তখন কিন্তু আমার কাছে গিয়েই থাকবে | আমি আমার দুই বাবাকে একসাথে সেবাযত্ন করবো |
--- তখনকার কথা তখন ভাবা যাবে | আজ একটা কথা খুব বলতে ইচ্ছা করছে তোর মত লক্ষ্মী মেয়ে যেন প্রতিটা বাবা মায়ের হয় | তোর মা ঠিকই বলতো শুধু মেয়েরাই নয় প্রতিটা মানুষেরই সব কাজ জানা উচিত | বিশেষ করে রান্নাঘরের দায়িত্ব সামলানো |
পলাশ মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন যখন তার চোখদুটি তখন আনন্দাশ্রুতে ভর্তি হয়ে গেলো |
No comments:
Post a Comment