সুখের দিনগুলো
কলেজের প্রথম দিন থেকেই সৌরভের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায় | একটু বড় হওয়ার সাথে সাথেই একটা ব্যাপার আমি ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছি - মেয়েদের থেকে ছেলেদের মন থাকে ভীষণ পরিস্কার | হ্যাঁ আমি মেয়ে হয়েও এ কথাটা বলছি | আমি জানি অনেকেই আমার প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করবে | যা মুখে আসবে তাই বলবে | কিন্তু এটাই বাস্তব | ছেলেরা মেয়েদের মত পিএনপিসি করেনা , ওদের সাথে মন খুলে কথা বলা যায় | ওরা একের কথা শুনে অপরকে লাগায়না | সাধারণত কোন ছেলে মেয়েদের পোশাকআশাক , সাজগোজ নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেনা | কিন্তু প্রতিটা মেয়ের এই স্বভাবগুলো রয়েছে | তাই বলে আমিও কিন্তু ধোয়া তুলসীপাতা নই | আমার মধ্যেও কমবেশি এই স্বভাবগুলো রয়েছে | ছেলেদের মধ্যে যে কোন দোষ নেই তা কিন্তু নয় | ওদেরও অনেক দোষ আছে | তবে একটি মেয়ে নিজেকে যদি ঠিক রাখতে পারে আমি মনেকরি একটি মেয়ের বন্ধুত্ব থেকে একটি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করা অনেক ভালো | আমাদের বাঙ্গালী সমাজ অবশ্য একটি বয়সের পরে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের বন্ধুত্বটিকে ভালোভাবে নেয়না | কিন্তু আমাদের বাড়ির এমনই পরিবেশে আমি বড় হয়েছি এসব নিয়ে আমার বাবা , মা কোনদিনও ভাবেননি | বরং তারা এটাকে ভালো চোখেই দেখতেন |
অনেক ক্লাসমেটের ভিড়ে সৌরভ ছিল আমার বেস্টফ্রেন্ড | কলেজের অনেকেই মনে করতো ওর সাথে আমার আলাদা একটা সম্পর্ক আছে | অন্যদের এই 'মনেকরা'- ব্যাপারটিকে নিয়েই আমরা বেশ হাসিঠাট্টা করতাম | সৌরভের আমাদের বাড়িতেও ছিল অবারিত দ্বার | যেহেতু বাবা , মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি তাই সৌরভকে তারা নিজেদের ছেলের মতই দেখতেন | সৌরভ আসলেই মা জানতে চাইতেন ,
--- কি খাবি বল বাবা ?
ও নিজের ইচ্ছামত মাকে খাবার অর্ডার দিয়ে বসে থাকতো | সৌরভের প্রতি মায়ের ভালোবাসা দেখে সত্যি বলতে কি নিজেরই খুব হিংসা হত | আর সৌরভ হাসতে হাসতে মাথায় চাট্টি দিয়ে বলতো ," হিংসুটি কোথাকার |"
তখন কলেজে আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ | কলকাতায় পাতালরেল চালু হয়েছে তার কিছুদিন আগে | সৌরভ একদিন আমায় বললো ," এই মেট্রো চড়তে যাবি ?
--- মেট্রো চড়ে কোথায় যাবো ?
--- আমরা টালিগঞ্জ থেকে মেট্রোতে উঠে এসপ্ল্যানেড নামবো | সেখান থেকে একটু ফুসকাটুস্কা খেয়ে আবার মেট্রো ধরে সোজা টালিগঞ্জ |
--- তুই আগে উঠেছিস ?
--- আরে না , চলনা খুব মজা হবে | ভাবতেই কেমন অবাক লাগেনা মাটির তলা দিয়ে ট্রেন |
--- কবে যাবি ?
--- আজই চল | পরপর দুটো ক্লাস অফ আছে তারপর টিফিন পিরিয়ড | শেষের ক্লাসটা না করলে কিচ্ছু হবেনা |
--- কিন্তু আমি তো কোন পয়সাকড়ি আনিনি |
--- আমি নিয়ে এসেছি | আরে কলেজে আসার আগেই মনেহল আজ ইম্পর্টেন্ট কোন ক্লাস নেই তো আজ মেট্রোতে চড়বো | মায়ের কাছ থেকে চেয়েই পেয়ে গেলাম |
--- ঠিক আছে তবে চল |
আমাদের কলেজটা ছিল ঠাকুরপুকুর বিবেকানন্দ | আমরা কলেজ থেকে বেরিয়ে রাস্তার অপর প্রান্ত থেকে বাসে উঠে টালিগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম | দুপুরের সময় বাস ফাঁকাই ছিল | দুজনে বসেই গল্প জুড়ে দিলাম | গল্পে দুজনে এতটাই মশগুল ছিলাম বাস টালিগঞ্জ ছাড়িয়ে কখন বেরিয়ে গেলো দুজনের কারও হুস নেই | হুস ফিরলো তখন যখন বাস থেকে সমস্ত যাত্রী নেমে যাচ্ছে | সৌরভ কন্ডাক্টরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো
--- দাদা , এটা কি টালিগঞ্জ ?
কন্ডাক্টরদাদাটি হেসে পরে বললো ,
--- ভাই সেতো ত্রিশ মিনিট আগে পেরিয়ে এসেছি | তোমরা এক কাজ করো --- রাস্তা ক্রস করে যেকোন বাসে উঠে টালিগঞ্জ চলে যাও |
দুজনে মিলে এ ওকে দোষারোপ করে হাসতে হাসতে অপজিট ফুটে এসে অন্য বাসে উঠে টালিগঞ্জ আসলাম | কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বহু আকাঙ্খিত ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে আছি | তবে এর ভিতর আমি একটা কাজ করে বসেছি | আবার যাতে কোন ভুল না করি একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে বেশ বন্ধুত্ব করে নিয়েছি যিনি এসপ্ল্যানেড যাবেন | ট্রেন আসলো | ভদ্রলোকটি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো | ওখানে দাঁড়িয়েই এদিকওদিক তাকিয়ে আমার পথপ্রদর্শককে যখন খুঁজছি হঠাৎ হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান --- সৌরভ টানতে টানতে নিয়ে মেট্রোতে উঠলো | অদ্ভুত এক অনুভূতি | মাটির নিচের ট্রেন আর তাতে চড়ে চলেছি | দুজনেই কারণে অকারণে হেসে চলেছি | এনাউন্স শুনে আমরা এসপ্ল্যানেড নামলাম | খিদে পেয়েছিলো খুব | পেট ভরে দুজনে ফুসকা খেয়ে আবার মেট্রোস্টেশনে | এবার শখ হলো এক্সক্যালেটরে উঠার | আমরা দুজনেই আনাড়ী এই বিদ্যুৎচালিত সিঁড়ি দিয়ে উপরে ওঠার | বেশ বিজ্ঞের মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে অন্যদের ওঠা পর্যবেক্ষন করে ফিল্ডে নেমে পড়লাম | দুজনে একসাথে পা দেবো ঠিক করে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম | কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছিনা | শেষমেশ অবশ্য এ অভিযানও দুজনে উৎরে গেলাম |
এবার উঠে দুজনেই বসার জায়গা পেয়ে গেলাম | শুরু হল আবার বগবগানি ওই এক্সক্যারেটরিতে ওঠার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা নিয়ে দুজনের হাসাহাসি | হঠাৎ সৌরভ দাঁড়িয়ে পরে বললো ," এই নাম তাড়াতাড়ি আমরা টালিগঞ্জ এসে গেছি "
তড়িঘড়ি দুজনে নেমে পড়লাম | দু পা এগিয়েই সৌরভ বললো ,
--- যা ভুল হয়ে গেছে | এটা টালিগঞ্জ না , পরেরটা |
আবার ট্রেনের দিকে ছুটলাম --- কিন্তু ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে | অগত্যা বাসে করে টালিগঞ্জ | খুব মজা হয়েছিল সেদিন | কতদিন এই কথা নিয়ে দুজনে হাসাহাসি করেছি --- | বিয়ের পরেও স্বামী , সন্তানদের সাথে গল্প করেছি |
সৌরভের সাথে এখন আর কোন যোগাযোগ নেই | শেষ জেনেছিলাম রেলের চাকরির সুবাদে ও ভুবনেশ্বরে আছে | দুই সন্তানের পিতা | স্কুল , কলেজ জীবনের সোনালী দিনগুলো যেন হঠাৎ করেই কর্পূরের মত উবে যায় | কিন্তু মনের গহীনে একটা চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যায় যা কোনদিনও ভোলা যায়না |