Wednesday, June 5, 2019

সামনে তাকাও

সামনে তাকাও
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

    কোনদিন মা,বাবাকে ছাড়া বাইরে থাকিনি।বাবার মৃত্যুর পর শুধুমাএ মামাবাড়িতে তাও মায়ের সাথেই।মা অনেক কষ্ট করে সামান্য কয়েকটি পেনশনের টাকায় আমায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন।তারজন্য সংসারে অভাব ছিলো নিত্যসঙ্গী।ক্যাম্পাস থেকে একটা চাকরী পেতেই হবে এই মনোবলকে সম্বল করে আমিও চেষ্টা চালিয়ে গেছি।ঈশ্বরের অপার কৃপায় সে ইচ্ছা আমার পূরণও হয়েছে।কিন্তু আমার পোষ্টিং হোল ভিন রাজ্যে।জীবনে এই প্রথমবার একাএকা বাড়ির বাইরে পা রাখলাম।আসবার সময় মায়ের কান্না দেখে আমারও খুব কান্না পাচ্ছিলো।
   অচেনা অজানা শহর।কাউকেই চিনিনা।ভাষারও সমস্যা।দুদিন হোটেলে থেকে একটা মেস দেখে উঠে গেলাম।মানুষ অভ্যাসের দাস।আস্তে আস্তে আমিও সবকিছু মানিয়ে নিতে লাগলাম।আসবার সময় কম দামে মাকে একটা মোবাইল কিনে দিয়ে এসেছি সে মায়ের কাছ থেকেই টাকা নিয়ে।রোজই মায়ের সাথে দু'তিনবার কথা হয়।
দেখতে দেখতে চাকরীর বয়স আমার একমাস হয়ে গেলো।হাতে প্রথম মাসের মাইনের টাকা পেয়ে মাকে যেন আরও বেশি মিস করতে লাগলাম।মা ফোনে জানালেন,"এখন টাকা পাঠানোর দরকার নেই,তুই যখন আসবি তখন নিয়ে আসবি।"
  মাস দুয়েকের মধ্যে ওই অফিসেরই একটি মেয়ের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।সে মাঝে মাঝে আমার জন্য বাড়ি থেকে খাবারও নিয়ে আসতো।মেয়েটি এমনিতে খুব ভালো  কিন্তু নিজের চারিপাশে কেমন যেন একটা গণ্ডি কেটে রাখতো।
  কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ছ'মাস পরে বাড়ি আসি।মা আমার বন্ধুর মত।অনামিকার কথা মাকে সব জানাই।মা আমায় বলেন,  "যদি ওকে তোর ভাললাগে তুই ভালোবাসিস তাহলে আমার কিন্তু কোন আপত্তি নেই।"
--মা আমি এখনও এসব কিছু ভাবিনি।
--বেশ তো।আরও চেন আরও জান ওকে ।তোকে আমি আমার মতটা জানিয়ে দিলাম।
  কয়েকটা দিন মায়ের আদর আর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে একটা ঘর ভাড়া করে মাকে নিয়ে যাবো এই মর্মে অনেক কাকুতিমিনতি করে মায়ের মত নিয়ে আবার আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে আসি।
ইতিমধ্যে অনামিকার সাথে বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়েছে।ওর সম্মন্ধে জেনেছি-বাবা,মায়ের একমাত্র মেয়ে ও।বাবা এখনও চাকরী করেন।মা গৃহবধূ।কিন্তু নিজের সম্পর্কে ও বিশেষ কিছুই বলেনা। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারছি অনামিকার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি। একদিন সুযোগ পেয়ে অনামিকাকে আমি আমার মনের কথাগুলো বলে ফেললাম।হা করে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নীচু করে সেখান থেকে চলে গেলো।আমি লক্ষ্য করলাম তার চোখদুটো জলে ভরা।
পরদিন সে অফিসে আসলোনা।নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগলো।কিন্তু মনের কথাটা না জানিয়েও তো উপায় ছিলোনা।আমি কি অজান্তেই ওকে কোন আঘাত দিয়ে ফেললাম?নিজেকে নিজেই বারবার প্রশ্ন করছি।কাজে একটুও মন বসাতে পারছিনা।ফোন করতেও ভয় হচ্ছে যদি কিছু মনে করে?এইসব সাতপাঁচ যখন ভাবছি হঠাৎ আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো।দেখলাম অনামিকায় ফোন করেছে।হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে সে বললো সন্ধ্যা ছ'টার সময় অফিস থেকে অনতিদূরে যে কফিসপটা আছে তার বাইরে দাঁড়াতে। 

আমি সেখানে ছটার আগেই পৌঁছে দেখি সে এসে দাঁড়িয়ে আছে।আমরা ভিতরে গিয়ে একটা টেবিলে বসি।আমি দু'কাপ কফির অর্ডার করি। অনামিকা কোন ভণিতা না করেই বললো,
--আমার জীবনের কিছু কথা আছে যেগুলো আপনার জানা খুব দরকার।এই কথাগুলো শোনার পর আপনি আমাকে ঘৃণাও করতে পারেন।কিন্তু পাশপাশি টেবিলে কাজ করতে গেলে আপনার যে মনোভাবটা আমার কাছে প্রকাশ করেছেন আমি যদি সেটাকে সরাসরি না বলে দিই তাহলে দুজনেরই একটা অস্বস্থি কাজ করবে।আর যদি আপনার কথায় সায় দিই তাহলে আপনাকে ঠকানো হবে।তাই আমার অতীতটা আপনাকে জানানো উচিত মনে করলাম।
কিশোরী বয়সের বুদ্ধি হীনতায় সতের বছর বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলাম।কারন আমি জানতাম বাবা মা কিছুতেই সামান্য প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করা ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেবেননা। সাহেবদের পরিবারিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিলোনা।কিন্তু সাহেবের মা,বাবা আমায় মেনে নিলেন।সাহেব একমাত্র সন্তান তার মা, বাবার।যৎসামান্য যা রোজগার সংসারে তা সাহেবই করে।মাধ্যমিকে ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম।কিন্তু বিয়ের পর পড়াশুনা বন্ধ হোল।শ্বশুর, শ্বাশুড়ী কেউই চাননা আমি আর পড়াশুনা করি।মেনে নিলাম।ছ'মাস বেশ ভালোই কাটলো।অভাব থাকলেও ভালোবাসাটা ছিলো বলে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম।একদিন সন্ধ্যায় দু'জনে ঘুরতে বেরিয়ে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।বাইকে করে যখন অনেক রাতে দু'জনে ফিরছি হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার এসে আমাদের বাইকের সামনে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে পরে।তিন,চারজন মিলে আমাকে জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়।সাহেব বাঁধা দিতে গেলে ওকেও জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে গুলি করে।ওরা সকলে মিলে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওখানেই ফেলে রেখে চলে যায়।আমার যখন জ্ঞান ফেরে আমি তখন হাসপাতালে।সামনে বসা মা ও বাবা।সেই জঙ্গলের মধ্যেই ওদের কথাবার্তা শুনে আমি জেনে গেছিলাম ওই গুলিতেই সাহেবের মৃত্যু হয়েছে।
  মা এসে আস্তে আস্তে আমার মাথায় হাত রাখেন।তখন আমরা তিনজনেই কেঁদে চলেছি।পুলিশের জেরায় জেরায় জেরবার হয়ে আমি যখন ক্ষতবিক্ষত,  নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রবলভাবে জাগ্রত ঠিক তখনই বাবা আমায় নূতন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন।চলে এলাম বাবা মায়ের সাথে বাড়ি।ন'মাস গৃহবন্দী হয়ে কাটালাম।মা বাবার উৎসাহে আর অনুপ্রেরণায় একাদশ শ্রেণীর বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম।এই ন'মাস ধরে বাবা দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি করে তার বদলীর ব্যবস্থা করেন।বাড়িটা ছিলো ভাড়াবাড়ি।চলে এলাম তিনজনে এই অজানা শহরে।ভর্তি হলাম একাদশ শ্রেণীতে।তারপর আর পিছন ফিরে তাকাইনি।যে বাবা মাকে হেলায় অবহেলা করে হারিয়ে ফেলেছিলাম তারা পুণরায় আমাকে নূতন জীবন দান করেছেন।মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।আপনার কথা আমি তাদের জানিয়েছি।তাঁরাই আমাকে বলেছেন সব কথা আপনাকে জানাতে।এরপর যদি আপনার মনেহয় আমি আপনার জীবনসঙ্গী হতে পারি তাহলে বাবা, মা আপনার মায়ের সাথে কথা বলতে রাজি।
কফি দু'কাপ টেবিলেই ঠান্ডা হয়ে গেছে।আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা।শুধু বললাম আমাকে আজকের রাতটা একটু সময় দাও।কাল অফিসে তোমায় জানাচ্ছি।
রাতে ফোন করে আমার আজীবন বন্ধু মাকে সব জানালাম।মা সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
--ওর অতীত দিয়ে কি তুই ধুয়ে জল খাবি?ও তো তোকে এই কথাগুলো নাও বলতে পারতো।তোর কাছে সবকিছু লুকিয়েও তো যেতে পারতো।কিন্তু ও তো তা করেনি।ওর জীবনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তারজন্য জখম হয়েছে ও নিজে।মনের জোরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছ বাবা,মায়ের সাহায্যে।এখন আমরা আর একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওকে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারি।
আজ পাঁচবছর অনামিকার সাথে আমার বিবাহিত জীবন।আমাদের দু'বছরের ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে আছে।তাকে মা ই সামলান। আজও দু'জনে একই অফিসে আছি।অনামিকা আমার জীবনে না এলে জীবনের মানেটাই হয়তো অধরা থেকে যেত।আমার জীবনের উপলব্ধিটা ঠিক এই রকম 'বর্তমান ই জীবন,ভবিষ্যৎটা অনিশ্চিত স্বপ্নের ঘোর আর অতীত কখনো ফিরে আসেনা,তাকে নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই।দুর্বল অতীতকে মেরে ফেলায় বুদ্ধিমানের কাজ।' 

No comments:

Post a Comment