Thursday, June 27, 2019

পরাজিত

পরাজিত
   নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

  ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।রোগীর কাছে এইসময় একজন মাত্র থাকতে পারবেন।সকাল থেকে মা ই ছিলেন।রাতে অপরাজিতা নিজে এসে মাকে মামার সাথে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে জোর করে।অবাক হয় এই মহিলাকে দেখে অপরাজিতা।কোনদিন স্বামী সুখ কি জিনিস তা তিনি জানেননা।অথচ শুনেছে মায়ের কাছে মা নাকি ভালোবেসেই বাবাকে বিয়ে করেছিলেন।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই অপরাজিতা দেখে আসছে বাবা কোনদিনও মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করেননা।প্রতিবাদ করতে গেলে অপরাজিতাও বাবার কুকথার হাত থেকে রেহাই পায়নি।আর বাবার অনুপস্থিতিতে মা সবসময়ই বাবার পক্ষ নিয়ে বলে গেছেন, ' মানুষটা এরকম ছিলোনা রে ..'কিন্তু অপরাজিতা কোনোদিনও মায়ের প্রতি এই মানুষটার কোন সহানুভূতি দেখেনি।তাই মানুষটাকেও কোনদিন সম্মান তো দূরহস্ত বিন্দুমাত্র ভালবাসতেও পারেনি।
   আজ বাবার মৃত্যুশয্যার শিয়রে বসে অনেক কথায় তার মনে পড়ছে।খুব ছেলেবেলার একটা ঘটনা।আবছা আবছা মনে আছে।মায়ের সাথে সেদিন মামাবাড়ি গেছিলো।ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়।বাড়ি ফিরে বারবার ডাকার পরেও বাবা এসে দরজা খোলেননি।শেষে মা পাশের ফ্লাটের কাকুকে ডেকে এনে বাবাকে ডেকে তোলেন।সেদিন বাবা মাকে মারতে মারতে বাথরুমের ভিতর আটকে রেখেছিলেন কয়েক ঘন্টা।আর মেয়েকে বলেছিলেন,
--যদি তুই বাথরুমের দরজা খুলে দিস তাহলে তোকেও মেরে বাথরুমে আটকে রাখবো।
এইরূপ ছোটখাটো অনেক ঘটনা।আর একদিনের ঘটনা অপরাজিতার মনকে খুব কষ্ট দেয় মামা আর মাসি এসেছিলো বাড়িতে বেড়াতে।সেদিন মা গিয়ে বাবাকে বলেছিলেন একটু মিষ্টি নিয়ে আসতে।বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যতক্ষণ মামা , মাসি ছিলেন বাড়িতে তিনি ফেরেননি।অনেক রাত্রে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম থেকে জেগে দেখে বাবা মাকে মেঝেতে ফেলে ভীষনভাবে মারছে।খাট থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অপরাজিতা।সঙ্গে সঙ্গে বাবা তাকে বাহু ধরে টেনে তুলে এক ধাক্কা মারে ।দেওয়ালের গায়ে পড়ে সে গিয়ে জ্ঞান হারায়।
   বাবা মাঝে মাঝে ড্রিংক করে বাড়িতে আসতেন।কিন্তু কোনদিন এই অবস্থাতে সে বাবাকে চিৎকার,চেঁচামেচি করতে শোনেনি।কোন মহিলার সাথেও কোনরকম সম্পর্ক আছে বলেও বড় হয়েও শোনেনি।তবে তিনি যে কেন এরূপ ব্যবহার করতেন মায়ের সাথে আজ পর্যন্ত তা অজ্ঞাতই থেকে গেছে।একটা প্রাইভেট ফার্মে বাবা চাকরী করতেন।মোটামুটি চলে যেত সংসার । মায়ের কোনদিনও কোন চাহিদা সে দেখেনি।মা অন্ধের মত ভালোবাসতেন বাবাকে।আর বাবা----
চিন্তায় ছেদ পড়ে নার্সের ডাকে।
---এবার আপনি বাইরে যান।সকালে ডেকে নেবো।
কোন কথা না বলে একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাজিতা বাইরে বেরিয়ে আসে।বুকের ভিতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে।কিন্তু এই লোকটাকে সেতো কোনদিন ভালবাসতে পারেনি।তবে কেন তার আজ এতো কষ্ট হচ্ছে?মনেহচ্ছে কান্না দলা পাকিয়ে তার গলার কাছে আটকে আছে।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই অত্যাচারী মানুষটাকে সে এড়িয়েই চলেছে। তবে কেন আজ তার সেই মানুষটার জন্যই গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।নিজের অজান্তেই অঝোর ধারায় চোখ থেকে জল পড়ে যাচ্ছে।হঠাৎ কাঁধে মায়ের স্পর্শে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মা ও মামা দাঁড়িয়ে। মামা বললেন,
--তোর মা কিছুতেই বাড়ি গেলোনা।এখান থেকে কিছু খাইয়ে নিয়ে আসলাম।
অপরাজিতা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা।মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।হঠাৎ করেই যেন সুমিতা শক্ত হয়ে গেছেন।আস্তে আস্তে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন,
--কাঁদিস না মা।এই দেখ না আমি কেমন শক্ত হয়ে গেছি।মানুষটা সত্যিই খুব ভালো ছিলো।আমাদের বিয়ের পরে তুই আসার আগে একবার আমি আর তোর বাবা বাইকে মারত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম।পরদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলেও তোর বাবার তিনদিন কোন জ্ঞান ছিলোনা।মাথায় খুব আঘাত পেয়েছিলো।তিনমাস হাসপাতালে ছিলো।তখনই ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন উনার সাথে কোন ব্যপারে মতের অমিল হলে উনি উনার মেজাজ ধরে রাখতে পারবেননা।অনেক চেষ্টা করেছি যাতে তোর বাবা মেজাজ হারিয়ে না ফেলে কখনো।চুপচাপ অত্যাচার সহ্য করে গেছি।কিন্তু তবুও দেখ মানুষটাকে বাঁচাতে পারলামনা।সেই এ্যাকসিডেন্ট এরই রেশ হয়তো।ব্রেনস্ট্রোক ।
   অপরাজিতা কাঁদতে কাঁদতেই মাকে বলবো,
---এতদিন কেন বলনি মা?এটা তো বাবার রোগ ছিলো।কিন্তু আমি যে বাবাকে কোনোদিনও ভালবাসতে পারিনি।তবুও আজ আমার বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হচেছ।
-- সেটাই তো স্বাভাবিক রে ! সে যে তোর বাবা।নিজেকে শক্ত কর।এইসময় আর কান্নাকাটি করে তার যাওয়ার পথটা পিছিল করে দিসনা।
  ঘোষণা শুনে মা,মেয়ে দৌড়ে উপরে ওঠে।কান্নায় ভেঙ্গে পরে অপরাজিতা।আর সুমিতা যেন পাথর হয়ে গেছেন।কুড়ি বছর ধরে যুদ্ধ শেষে আজ সে সম্পূর্ণ পরাজিত।

নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

একেই বলে ভাগ্য
      নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

পাত্রপক্ষর সামনে যে মেয়েটি জলখাবার নিয়ে ঢুকলো তার অতি সাধারণ বেশভূষা।অমিয় একটু অবাকই হোল।মেয়ে দেখতে আসার আগে শুনেছিল মেয়েটি বিটেক করেছে।একটি ঘরোয়া মেয়ে বিয়ে করার ইচ্ছা ছিলো।
  মেয়েটিকে দেখে অমিয় মুগ্ধ হয়ে যায়।জলখাবার নামিয়ে রেখে মেয়েটি ভিতরে চলে যায়।তখনই অমিয় বুঝতে পারে যাকে সে দেখতে এসেছে এ সে নয়।
   এবার আসল পাত্রী সামনে আসে।মা পাত্রীর সাথে গল্পগুজব শুরু করেন।অমিয় ইশারায় মাকে বাইরে ডেকে ওই মেয়েটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে বলে।
   বিএ পাশ করার পর হঠাৎ বাবার মৃত্যু।মাকে হারিয়েছে ছেলেবেলার।একা সোমত্ত মেয়ে বাধ্য হয়ে মামাবাড়িতে আশ্রয়।আসার পরই ঝি এর কাজটা মামী ছাড়িয়ে দেয়।
  বিয়ে হোল ডক্টর অমিয় ব্যানার্জীর সাথে।

Monday, June 10, 2019

অপূর্ণতা

অপূর্ণতা
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

   গতকাল রাত থেকেই দু'চোখের পাতা এক করতে পারেনি সুজাতা।বারবার শুধু অতীনের তাকে বলা শেষ কথাগুলো মনে পড়ছিলো।সারাটা জীবন ধরে শুধু কষ্টই পেয়ে গেলো মানুষটা।অথচ পরোপকারী,হাসিখুশি,বিনয়ী এই মানুষটাকে ভালোবাসেনা এমন পরিচিত মানুষ খুব কমই আছে।
   পাশাপশি বাড়িতে থাকার ফলে ছেলেবেলা থেকেই দু'জনের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিলো প্রগাঢ়।বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় পরিণত হয়।কিন্তু দুইবাড়ির কেউই তা জানতো না।দুজনের চোখে চোখেই যেন সব বলা হয়ে যেত।বি.কম পাশ করে অনেক চেষ্টা করেও অতীন একটা চাকরী জোগাড় করতে পারেনি।
     এদিকে সুজাতার গ্রাজুয়েশন শেষ হবার পরই বাড়ির লোক তার বিয়ের সম্মন্ধ দেখতে শুরু করে।পাগলের মত সুযোগ খুঁজতে থাকে সুজাতা অতীনকে কথাটা জানাবার জন্য।অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একদিন অতীন টিউশন থেকে ফিরবার পথে রাস্তাতেই তাকে সবকথা জানায়।অতীন তখনও বেকার।অথচ সুজাতার বিয়ে ঠিক হয়েছে একজন সরকারী চাকুরিজীবী ছেলের সাথে।বুকে পাথর বেঁধে এই বিয়েতে মত দিতে অনুরোধ করে অতীন সুজাতাকে।
  না,সুজাতা প্রথমে অতীনের কথা মানতে চায়নি। আর অতীন চায়নি সুজাতাকে সঙ্গী করে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়িয়ে তার জীবনটাকে নষ্ট করতে।অসহায়ের মত সে বিয়েতে মত দিতে বাধ্য হয়।বিয়ের দু'দিন আগে থাকতেই অতীন চলে যায় তার মামাবাড়ি ভুবনেশ্বর।
  বাপের বাড়িতে সুজাতা খুব কমই আসতো।ভয় ছিলো অতীনকে দেখলে যদি দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায়।বিয়ের তিন বছরের মাথায় অতীনের সাথে একবার তার দেখা হয়েছিলো।জানতে চেয়েছিলো,
--বিয়ে করছো না কেন?ছ'মাস তো হোল চাকরী পেয়েছো।
--জীবনের শুরুতেই যে জায়গাটা তোমায় দিয়েছি সেটা তো নূতন করে আর কাউকেই দিতে পারবোনা।
  কেটে গেছে কতগুলো বছর।দেখা হয়নি আর অতীনের সাথে সুজাতার।গতকাল বাড়ি থেকে ফোন করে জানালো অফিস থেকে ফেরার পথে বাসে উঠতে গিয়ে অতীন পড়ে যায়।অন্য একটা বাস এসে তাকে চাপা দিয়ে চলে যায়।স্পট ডেথ।
   সারাটা জীবন ধরে নীরবে ভালোবেসে নিজের জীবন দিয়ে অতীন বুঝিয়ে গেলো সত্যিকারের ভালোবাসাও অনেক সময় পূর্ণতা পায়না। 

Wednesday, June 5, 2019

সামনে তাকাও

সামনে তাকাও
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী

    কোনদিন মা,বাবাকে ছাড়া বাইরে থাকিনি।বাবার মৃত্যুর পর শুধুমাএ মামাবাড়িতে তাও মায়ের সাথেই।মা অনেক কষ্ট করে সামান্য কয়েকটি পেনশনের টাকায় আমায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছেন।তারজন্য সংসারে অভাব ছিলো নিত্যসঙ্গী।ক্যাম্পাস থেকে একটা চাকরী পেতেই হবে এই মনোবলকে সম্বল করে আমিও চেষ্টা চালিয়ে গেছি।ঈশ্বরের অপার কৃপায় সে ইচ্ছা আমার পূরণও হয়েছে।কিন্তু আমার পোষ্টিং হোল ভিন রাজ্যে।জীবনে এই প্রথমবার একাএকা বাড়ির বাইরে পা রাখলাম।আসবার সময় মায়ের কান্না দেখে আমারও খুব কান্না পাচ্ছিলো।
   অচেনা অজানা শহর।কাউকেই চিনিনা।ভাষারও সমস্যা।দুদিন হোটেলে থেকে একটা মেস দেখে উঠে গেলাম।মানুষ অভ্যাসের দাস।আস্তে আস্তে আমিও সবকিছু মানিয়ে নিতে লাগলাম।আসবার সময় কম দামে মাকে একটা মোবাইল কিনে দিয়ে এসেছি সে মায়ের কাছ থেকেই টাকা নিয়ে।রোজই মায়ের সাথে দু'তিনবার কথা হয়।
দেখতে দেখতে চাকরীর বয়স আমার একমাস হয়ে গেলো।হাতে প্রথম মাসের মাইনের টাকা পেয়ে মাকে যেন আরও বেশি মিস করতে লাগলাম।মা ফোনে জানালেন,"এখন টাকা পাঠানোর দরকার নেই,তুই যখন আসবি তখন নিয়ে আসবি।"
  মাস দুয়েকের মধ্যে ওই অফিসেরই একটি মেয়ের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।সে মাঝে মাঝে আমার জন্য বাড়ি থেকে খাবারও নিয়ে আসতো।মেয়েটি এমনিতে খুব ভালো  কিন্তু নিজের চারিপাশে কেমন যেন একটা গণ্ডি কেটে রাখতো।
  কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ছ'মাস পরে বাড়ি আসি।মা আমার বন্ধুর মত।অনামিকার কথা মাকে সব জানাই।মা আমায় বলেন,  "যদি ওকে তোর ভাললাগে তুই ভালোবাসিস তাহলে আমার কিন্তু কোন আপত্তি নেই।"
--মা আমি এখনও এসব কিছু ভাবিনি।
--বেশ তো।আরও চেন আরও জান ওকে ।তোকে আমি আমার মতটা জানিয়ে দিলাম।
  কয়েকটা দিন মায়ের আদর আর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে একটা ঘর ভাড়া করে মাকে নিয়ে যাবো এই মর্মে অনেক কাকুতিমিনতি করে মায়ের মত নিয়ে আবার আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে আসি।
ইতিমধ্যে অনামিকার সাথে বন্ধুত্বটা আরও গাঢ় হয়েছে।ওর সম্মন্ধে জেনেছি-বাবা,মায়ের একমাত্র মেয়ে ও।বাবা এখনও চাকরী করেন।মা গৃহবধূ।কিন্তু নিজের সম্পর্কে ও বিশেষ কিছুই বলেনা। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারছি অনামিকার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি। একদিন সুযোগ পেয়ে অনামিকাকে আমি আমার মনের কথাগুলো বলে ফেললাম।হা করে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নীচু করে সেখান থেকে চলে গেলো।আমি লক্ষ্য করলাম তার চোখদুটো জলে ভরা।
পরদিন সে অফিসে আসলোনা।নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগলো।কিন্তু মনের কথাটা না জানিয়েও তো উপায় ছিলোনা।আমি কি অজান্তেই ওকে কোন আঘাত দিয়ে ফেললাম?নিজেকে নিজেই বারবার প্রশ্ন করছি।কাজে একটুও মন বসাতে পারছিনা।ফোন করতেও ভয় হচ্ছে যদি কিছু মনে করে?এইসব সাতপাঁচ যখন ভাবছি হঠাৎ আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো।দেখলাম অনামিকায় ফোন করেছে।হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে সে বললো সন্ধ্যা ছ'টার সময় অফিস থেকে অনতিদূরে যে কফিসপটা আছে তার বাইরে দাঁড়াতে। 

আমি সেখানে ছটার আগেই পৌঁছে দেখি সে এসে দাঁড়িয়ে আছে।আমরা ভিতরে গিয়ে একটা টেবিলে বসি।আমি দু'কাপ কফির অর্ডার করি। অনামিকা কোন ভণিতা না করেই বললো,
--আমার জীবনের কিছু কথা আছে যেগুলো আপনার জানা খুব দরকার।এই কথাগুলো শোনার পর আপনি আমাকে ঘৃণাও করতে পারেন।কিন্তু পাশপাশি টেবিলে কাজ করতে গেলে আপনার যে মনোভাবটা আমার কাছে প্রকাশ করেছেন আমি যদি সেটাকে সরাসরি না বলে দিই তাহলে দুজনেরই একটা অস্বস্থি কাজ করবে।আর যদি আপনার কথায় সায় দিই তাহলে আপনাকে ঠকানো হবে।তাই আমার অতীতটা আপনাকে জানানো উচিত মনে করলাম।
কিশোরী বয়সের বুদ্ধি হীনতায় সতের বছর বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করলাম।কারন আমি জানতাম বাবা মা কিছুতেই সামান্য প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করা ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেবেননা। সাহেবদের পরিবারিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিলোনা।কিন্তু সাহেবের মা,বাবা আমায় মেনে নিলেন।সাহেব একমাত্র সন্তান তার মা, বাবার।যৎসামান্য যা রোজগার সংসারে তা সাহেবই করে।মাধ্যমিকে ভালো নম্বর নিয়ে পাশ করে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম।কিন্তু বিয়ের পর পড়াশুনা বন্ধ হোল।শ্বশুর, শ্বাশুড়ী কেউই চাননা আমি আর পড়াশুনা করি।মেনে নিলাম।ছ'মাস বেশ ভালোই কাটলো।অভাব থাকলেও ভালোবাসাটা ছিলো বলে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম।একদিন সন্ধ্যায় দু'জনে ঘুরতে বেরিয়ে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।বাইকে করে যখন অনেক রাতে দু'জনে ফিরছি হঠাৎ একটা প্রাইভেট কার এসে আমাদের বাইকের সামনে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে পরে।তিন,চারজন মিলে আমাকে জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়।সাহেব বাঁধা দিতে গেলে ওকেও জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়ে গুলি করে।ওরা সকলে মিলে আমার উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওখানেই ফেলে রেখে চলে যায়।আমার যখন জ্ঞান ফেরে আমি তখন হাসপাতালে।সামনে বসা মা ও বাবা।সেই জঙ্গলের মধ্যেই ওদের কথাবার্তা শুনে আমি জেনে গেছিলাম ওই গুলিতেই সাহেবের মৃত্যু হয়েছে।
  মা এসে আস্তে আস্তে আমার মাথায় হাত রাখেন।তখন আমরা তিনজনেই কেঁদে চলেছি।পুলিশের জেরায় জেরায় জেরবার হয়ে আমি যখন ক্ষতবিক্ষত,  নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা প্রবলভাবে জাগ্রত ঠিক তখনই বাবা আমায় নূতন করে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করলেন।চলে এলাম বাবা মায়ের সাথে বাড়ি।ন'মাস গৃহবন্দী হয়ে কাটালাম।মা বাবার উৎসাহে আর অনুপ্রেরণায় একাদশ শ্রেণীর বইগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম।এই ন'মাস ধরে বাবা দৌড়াদৌড়ি ছুটোছুটি করে তার বদলীর ব্যবস্থা করেন।বাড়িটা ছিলো ভাড়াবাড়ি।চলে এলাম তিনজনে এই অজানা শহরে।ভর্তি হলাম একাদশ শ্রেণীতে।তারপর আর পিছন ফিরে তাকাইনি।যে বাবা মাকে হেলায় অবহেলা করে হারিয়ে ফেলেছিলাম তারা পুণরায় আমাকে নূতন জীবন দান করেছেন।মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখিয়েছেন।আপনার কথা আমি তাদের জানিয়েছি।তাঁরাই আমাকে বলেছেন সব কথা আপনাকে জানাতে।এরপর যদি আপনার মনেহয় আমি আপনার জীবনসঙ্গী হতে পারি তাহলে বাবা, মা আপনার মায়ের সাথে কথা বলতে রাজি।
কফি দু'কাপ টেবিলেই ঠান্ডা হয়ে গেছে।আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা।শুধু বললাম আমাকে আজকের রাতটা একটু সময় দাও।কাল অফিসে তোমায় জানাচ্ছি।
রাতে ফোন করে আমার আজীবন বন্ধু মাকে সব জানালাম।মা সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
--ওর অতীত দিয়ে কি তুই ধুয়ে জল খাবি?ও তো তোকে এই কথাগুলো নাও বলতে পারতো।তোর কাছে সবকিছু লুকিয়েও তো যেতে পারতো।কিন্তু ও তো তা করেনি।ওর জীবনের উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তারজন্য জখম হয়েছে ও নিজে।মনের জোরে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছ বাবা,মায়ের সাহায্যে।এখন আমরা আর একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওকে একটা সুন্দর জীবন দিতে পারি।
আজ পাঁচবছর অনামিকার সাথে আমার বিবাহিত জীবন।আমাদের দু'বছরের ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে আছে।তাকে মা ই সামলান। আজও দু'জনে একই অফিসে আছি।অনামিকা আমার জীবনে না এলে জীবনের মানেটাই হয়তো অধরা থেকে যেত।আমার জীবনের উপলব্ধিটা ঠিক এই রকম 'বর্তমান ই জীবন,ভবিষ্যৎটা অনিশ্চিত স্বপ্নের ঘোর আর অতীত কখনো ফিরে আসেনা,তাকে নিয়ে ভেবে কোন লাভ নেই।দুর্বল অতীতকে মেরে ফেলায় বুদ্ধিমানের কাজ।'