পরাজিত
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।রোগীর কাছে এইসময় একজন মাত্র থাকতে পারবেন।সকাল থেকে মা ই ছিলেন।রাতে অপরাজিতা নিজে এসে মাকে মামার সাথে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে জোর করে।অবাক হয় এই মহিলাকে দেখে অপরাজিতা।কোনদিন স্বামী সুখ কি জিনিস তা তিনি জানেননা।অথচ শুনেছে মায়ের কাছে মা নাকি ভালোবেসেই বাবাকে বিয়ে করেছিলেন।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই অপরাজিতা দেখে আসছে বাবা কোনদিনও মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করেননা।প্রতিবাদ করতে গেলে অপরাজিতাও বাবার কুকথার হাত থেকে রেহাই পায়নি।আর বাবার অনুপস্থিতিতে মা সবসময়ই বাবার পক্ষ নিয়ে বলে গেছেন, ' মানুষটা এরকম ছিলোনা রে ..'কিন্তু অপরাজিতা কোনোদিনও মায়ের প্রতি এই মানুষটার কোন সহানুভূতি দেখেনি।তাই মানুষটাকেও কোনদিন সম্মান তো দূরহস্ত বিন্দুমাত্র ভালবাসতেও পারেনি।
আজ বাবার মৃত্যুশয্যার শিয়রে বসে অনেক কথায় তার মনে পড়ছে।খুব ছেলেবেলার একটা ঘটনা।আবছা আবছা মনে আছে।মায়ের সাথে সেদিন মামাবাড়ি গেছিলো।ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়।বাড়ি ফিরে বারবার ডাকার পরেও বাবা এসে দরজা খোলেননি।শেষে মা পাশের ফ্লাটের কাকুকে ডেকে এনে বাবাকে ডেকে তোলেন।সেদিন বাবা মাকে মারতে মারতে বাথরুমের ভিতর আটকে রেখেছিলেন কয়েক ঘন্টা।আর মেয়েকে বলেছিলেন,
--যদি তুই বাথরুমের দরজা খুলে দিস তাহলে তোকেও মেরে বাথরুমে আটকে রাখবো।
এইরূপ ছোটখাটো অনেক ঘটনা।আর একদিনের ঘটনা অপরাজিতার মনকে খুব কষ্ট দেয় মামা আর মাসি এসেছিলো বাড়িতে বেড়াতে।সেদিন মা গিয়ে বাবাকে বলেছিলেন একটু মিষ্টি নিয়ে আসতে।বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যতক্ষণ মামা , মাসি ছিলেন বাড়িতে তিনি ফেরেননি।অনেক রাত্রে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম থেকে জেগে দেখে বাবা মাকে মেঝেতে ফেলে ভীষনভাবে মারছে।খাট থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অপরাজিতা।সঙ্গে সঙ্গে বাবা তাকে বাহু ধরে টেনে তুলে এক ধাক্কা মারে ।দেওয়ালের গায়ে পড়ে সে গিয়ে জ্ঞান হারায়।
বাবা মাঝে মাঝে ড্রিংক করে বাড়িতে আসতেন।কিন্তু কোনদিন এই অবস্থাতে সে বাবাকে চিৎকার,চেঁচামেচি করতে শোনেনি।কোন মহিলার সাথেও কোনরকম সম্পর্ক আছে বলেও বড় হয়েও শোনেনি।তবে তিনি যে কেন এরূপ ব্যবহার করতেন মায়ের সাথে আজ পর্যন্ত তা অজ্ঞাতই থেকে গেছে।একটা প্রাইভেট ফার্মে বাবা চাকরী করতেন।মোটামুটি চলে যেত সংসার । মায়ের কোনদিনও কোন চাহিদা সে দেখেনি।মা অন্ধের মত ভালোবাসতেন বাবাকে।আর বাবা----
চিন্তায় ছেদ পড়ে নার্সের ডাকে।
---এবার আপনি বাইরে যান।সকালে ডেকে নেবো।
কোন কথা না বলে একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাজিতা বাইরে বেরিয়ে আসে।বুকের ভিতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে।কিন্তু এই লোকটাকে সেতো কোনদিন ভালবাসতে পারেনি।তবে কেন তার আজ এতো কষ্ট হচ্ছে?মনেহচ্ছে কান্না দলা পাকিয়ে তার গলার কাছে আটকে আছে।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই অত্যাচারী মানুষটাকে সে এড়িয়েই চলেছে। তবে কেন আজ তার সেই মানুষটার জন্যই গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।নিজের অজান্তেই অঝোর ধারায় চোখ থেকে জল পড়ে যাচ্ছে।হঠাৎ কাঁধে মায়ের স্পর্শে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মা ও মামা দাঁড়িয়ে। মামা বললেন,
--তোর মা কিছুতেই বাড়ি গেলোনা।এখান থেকে কিছু খাইয়ে নিয়ে আসলাম।
অপরাজিতা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা।মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।হঠাৎ করেই যেন সুমিতা শক্ত হয়ে গেছেন।আস্তে আস্তে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন,
--কাঁদিস না মা।এই দেখ না আমি কেমন শক্ত হয়ে গেছি।মানুষটা সত্যিই খুব ভালো ছিলো।আমাদের বিয়ের পরে তুই আসার আগে একবার আমি আর তোর বাবা বাইকে মারত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম।পরদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলেও তোর বাবার তিনদিন কোন জ্ঞান ছিলোনা।মাথায় খুব আঘাত পেয়েছিলো।তিনমাস হাসপাতালে ছিলো।তখনই ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন উনার সাথে কোন ব্যপারে মতের অমিল হলে উনি উনার মেজাজ ধরে রাখতে পারবেননা।অনেক চেষ্টা করেছি যাতে তোর বাবা মেজাজ হারিয়ে না ফেলে কখনো।চুপচাপ অত্যাচার সহ্য করে গেছি।কিন্তু তবুও দেখ মানুষটাকে বাঁচাতে পারলামনা।সেই এ্যাকসিডেন্ট এরই রেশ হয়তো।ব্রেনস্ট্রোক ।
অপরাজিতা কাঁদতে কাঁদতেই মাকে বলবো,
---এতদিন কেন বলনি মা?এটা তো বাবার রোগ ছিলো।কিন্তু আমি যে বাবাকে কোনোদিনও ভালবাসতে পারিনি।তবুও আজ আমার বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হচেছ।
-- সেটাই তো স্বাভাবিক রে ! সে যে তোর বাবা।নিজেকে শক্ত কর।এইসময় আর কান্নাকাটি করে তার যাওয়ার পথটা পিছিল করে দিসনা।
ঘোষণা শুনে মা,মেয়ে দৌড়ে উপরে ওঠে।কান্নায় ভেঙ্গে পরে অপরাজিতা।আর সুমিতা যেন পাথর হয়ে গেছেন।কুড়ি বছর ধরে যুদ্ধ শেষে আজ সে সম্পূর্ণ পরাজিত।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী
ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।রোগীর কাছে এইসময় একজন মাত্র থাকতে পারবেন।সকাল থেকে মা ই ছিলেন।রাতে অপরাজিতা নিজে এসে মাকে মামার সাথে মামাবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে জোর করে।অবাক হয় এই মহিলাকে দেখে অপরাজিতা।কোনদিন স্বামী সুখ কি জিনিস তা তিনি জানেননা।অথচ শুনেছে মায়ের কাছে মা নাকি ভালোবেসেই বাবাকে বিয়ে করেছিলেন।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই অপরাজিতা দেখে আসছে বাবা কোনদিনও মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করেননা।প্রতিবাদ করতে গেলে অপরাজিতাও বাবার কুকথার হাত থেকে রেহাই পায়নি।আর বাবার অনুপস্থিতিতে মা সবসময়ই বাবার পক্ষ নিয়ে বলে গেছেন, ' মানুষটা এরকম ছিলোনা রে ..'কিন্তু অপরাজিতা কোনোদিনও মায়ের প্রতি এই মানুষটার কোন সহানুভূতি দেখেনি।তাই মানুষটাকেও কোনদিন সম্মান তো দূরহস্ত বিন্দুমাত্র ভালবাসতেও পারেনি।
আজ বাবার মৃত্যুশয্যার শিয়রে বসে অনেক কথায় তার মনে পড়ছে।খুব ছেলেবেলার একটা ঘটনা।আবছা আবছা মনে আছে।মায়ের সাথে সেদিন মামাবাড়ি গেছিলো।ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়।বাড়ি ফিরে বারবার ডাকার পরেও বাবা এসে দরজা খোলেননি।শেষে মা পাশের ফ্লাটের কাকুকে ডেকে এনে বাবাকে ডেকে তোলেন।সেদিন বাবা মাকে মারতে মারতে বাথরুমের ভিতর আটকে রেখেছিলেন কয়েক ঘন্টা।আর মেয়েকে বলেছিলেন,
--যদি তুই বাথরুমের দরজা খুলে দিস তাহলে তোকেও মেরে বাথরুমে আটকে রাখবো।
এইরূপ ছোটখাটো অনেক ঘটনা।আর একদিনের ঘটনা অপরাজিতার মনকে খুব কষ্ট দেয় মামা আর মাসি এসেছিলো বাড়িতে বেড়াতে।সেদিন মা গিয়ে বাবাকে বলেছিলেন একটু মিষ্টি নিয়ে আসতে।বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যতক্ষণ মামা , মাসি ছিলেন বাড়িতে তিনি ফেরেননি।অনেক রাত্রে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ঘুম থেকে জেগে দেখে বাবা মাকে মেঝেতে ফেলে ভীষনভাবে মারছে।খাট থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অপরাজিতা।সঙ্গে সঙ্গে বাবা তাকে বাহু ধরে টেনে তুলে এক ধাক্কা মারে ।দেওয়ালের গায়ে পড়ে সে গিয়ে জ্ঞান হারায়।
বাবা মাঝে মাঝে ড্রিংক করে বাড়িতে আসতেন।কিন্তু কোনদিন এই অবস্থাতে সে বাবাকে চিৎকার,চেঁচামেচি করতে শোনেনি।কোন মহিলার সাথেও কোনরকম সম্পর্ক আছে বলেও বড় হয়েও শোনেনি।তবে তিনি যে কেন এরূপ ব্যবহার করতেন মায়ের সাথে আজ পর্যন্ত তা অজ্ঞাতই থেকে গেছে।একটা প্রাইভেট ফার্মে বাবা চাকরী করতেন।মোটামুটি চলে যেত সংসার । মায়ের কোনদিনও কোন চাহিদা সে দেখেনি।মা অন্ধের মত ভালোবাসতেন বাবাকে।আর বাবা----
চিন্তায় ছেদ পড়ে নার্সের ডাকে।
---এবার আপনি বাইরে যান।সকালে ডেকে নেবো।
কোন কথা না বলে একবার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাজিতা বাইরে বেরিয়ে আসে।বুকের ভিতরটা হঠাৎ মোচড় দিয়ে ওঠে।কিন্তু এই লোকটাকে সেতো কোনদিন ভালবাসতে পারেনি।তবে কেন তার আজ এতো কষ্ট হচ্ছে?মনেহচ্ছে কান্না দলা পাকিয়ে তার গলার কাছে আটকে আছে।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই অত্যাচারী মানুষটাকে সে এড়িয়েই চলেছে। তবে কেন আজ তার সেই মানুষটার জন্যই গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।নিজের অজান্তেই অঝোর ধারায় চোখ থেকে জল পড়ে যাচ্ছে।হঠাৎ কাঁধে মায়ের স্পর্শে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে মা ও মামা দাঁড়িয়ে। মামা বললেন,
--তোর মা কিছুতেই বাড়ি গেলোনা।এখান থেকে কিছু খাইয়ে নিয়ে আসলাম।
অপরাজিতা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা।মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো।হঠাৎ করেই যেন সুমিতা শক্ত হয়ে গেছেন।আস্তে আস্তে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলতে লাগলেন,
--কাঁদিস না মা।এই দেখ না আমি কেমন শক্ত হয়ে গেছি।মানুষটা সত্যিই খুব ভালো ছিলো।আমাদের বিয়ের পরে তুই আসার আগে একবার আমি আর তোর বাবা বাইকে মারত্মকভাবে এ্যাকসিডেন্ট করেছিলাম।পরদিন আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিলেও তোর বাবার তিনদিন কোন জ্ঞান ছিলোনা।মাথায় খুব আঘাত পেয়েছিলো।তিনমাস হাসপাতালে ছিলো।তখনই ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন উনার সাথে কোন ব্যপারে মতের অমিল হলে উনি উনার মেজাজ ধরে রাখতে পারবেননা।অনেক চেষ্টা করেছি যাতে তোর বাবা মেজাজ হারিয়ে না ফেলে কখনো।চুপচাপ অত্যাচার সহ্য করে গেছি।কিন্তু তবুও দেখ মানুষটাকে বাঁচাতে পারলামনা।সেই এ্যাকসিডেন্ট এরই রেশ হয়তো।ব্রেনস্ট্রোক ।
অপরাজিতা কাঁদতে কাঁদতেই মাকে বলবো,
---এতদিন কেন বলনি মা?এটা তো বাবার রোগ ছিলো।কিন্তু আমি যে বাবাকে কোনোদিনও ভালবাসতে পারিনি।তবুও আজ আমার বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হচেছ।
-- সেটাই তো স্বাভাবিক রে ! সে যে তোর বাবা।নিজেকে শক্ত কর।এইসময় আর কান্নাকাটি করে তার যাওয়ার পথটা পিছিল করে দিসনা।
ঘোষণা শুনে মা,মেয়ে দৌড়ে উপরে ওঠে।কান্নায় ভেঙ্গে পরে অপরাজিতা।আর সুমিতা যেন পাথর হয়ে গেছেন।কুড়ি বছর ধরে যুদ্ধ শেষে আজ সে সম্পূর্ণ পরাজিত।
নন্দা মুখার্জী রায় চৌধুরী