কলেজ ফেষ্ট। স্বভাবতই সকলে খুব সেজেগুজে এসেছে। শ্যামলা গায়ের রং হলেও সুবর্ণার চোখ,মুখ খুব সার্ফ। হলুদ তাঁতের শাড়ি আর সাথে লাল ব্লাউজে তাকে খুব সুন্দর লাগছিল সেদিন।নামকরা শিল্পীর আগমনের ফলে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও কিছু বাইরের লোক, কিছু গার্জিয়ানের উপস্থিতিতে কলেজ ক্যাম্পাস ভিড়ে থিকথিকে হয়ে আছে। কেউই জায়গা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আর ধাক্কাধাক্কি তো চলছেই। অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত সাড়ে ন'টা। অনুষ্ঠান শেষে সুবর্ণা উঠতে গিয়ে ভিড়ের চাপে ঘেমেনেয়ে একসার। জায়গা থেকে নড়তেই পারছে না। হঠাৎ একটি ছেলে এসে তাকে বললো,
-- এই রোয়ের ভিতরে গিয়ে কোন একটা চেয়ারে বসে থাকো। দেখছো না অনেকেই বসে রয়েছে। এই ভিড়ের মধ্যে বেরোতে গেলে চাপেই দম বন্ধ হয়ে যাবে।
মুখ তুলে ছেলেটির কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতোই সুবর্ণা একটা চেয়ার দখল করে বসে থাকে। কিন্তু তার মাথায় চিন্তা ঢুকে আছে এত রাত হয়েছে শিয়ালদহ গিয়ে যদি ট্রেন না পায় তাহলে বাড়ি পৌঁছাবে কিভাবে?
প্রায় মিনিট দশেক এভাবে বসে থেকে ভির কমলে সে উঠে দাঁড়ায়। এদিক - ওদিক তাকিয়ে ছেলেটিকে খোঁজে কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। বেশ জোড়ে পা চালিয়ে কলেজ গেটের কাছে এসে দেখে সেই ছেলেটি বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। সুবর্ণার এই মুহূর্তে কেন যেন মনে হল ছেলেটি তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। দ্রুত হেঁটে সে ছেলেটির কাছে আসলো। ইতস্তত করতে করতে বলেই বসলো,
-- আমার মনেহচ্ছে এখন গিয়ে আমি ট্রেন পাবো না। অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি কি আমায় কোন সাহায্য করতে পারবে?
আচমকা একটি মেয়ের কাছ থেকে এ কথা শুনে ওই ছেলেটি অর্থাৎ দেবেশ কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। তারপর গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললো,
-- কী সাহায্য চাও বলো।
-- আসলে এখন যদি আমি বাসে উঠি তাহলে শিয়ালদহ পৌঁছাতে আমার দেরি হয়ে যাবে। তাই ভাবছি ট্যাক্সি করে যাবো। কিন্তু এত রাতে একা ট্যাক্সিতে যেতে ভীষণ ভয় করছে। আমার সাথে শিয়ালদহ পর্যন্ত যদি তুমি ট্যাক্সিতে যেতে আমি ট্রেনটা পেয়ে যেতাম। যদিও জানি তোমার বাড়ি পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। যদি আপত্তি না থাকে --
নাম না জানা একটি অপরিচিত মেয়ে একই কলেজে পড়ে তাই কোনোকিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে দেবেশ একটা ট্যাক্সি ডেকে সুবর্ণাকে নিয়ে উঠে পড়লো। কারণ আজ পর্যন্ত সাহায্য চেয়ে ফিরে গেছে দেবেশের কাছ থেকে কেউ এটা ঘটেনি। দু'জনেই পিছনের সিটে দু'টি জানালার পাশে, দু'জনেরই চোখ বাইরের দিকে কিন্তু কারো মুখেই কোন কথা নেই।
ট্যাক্সি শিয়ালদহ আসলে দেবেশ ভাড়া মিটাতে গেলে সুবর্ণা বাধা দেয়।সে ব্যাগ খুলে টাকাটা বের করতে গেলে দেবেশ তাকে বলে,
-- একই কলেজে পড়ি তো। অন্যভাবে টাকাটা কোন এক সময় শোধ দিয়ে দিও। তুমি এগোতে লাগো আমি টিকিট কেটেই আসছি। কোথাকার টিকিট কাটবো?
-- আরে না। তোমাকে আর আসতে হবে না। এতেই আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে।
-- সেতো পরের কথা। আপাতত তোমার নামটা বলো। আমি দেবেশ।
--- সুবর্ণা। বাংলা নিয়ে পড়ছি
--- আমার ইংলিশ।
কথা বলতে বলতে ওরা কাউন্টারের কাছে চলে আসলো। সুবর্ণার কথামত নির্দিষ্ট জায়গার টিকিট কেটে দেবেশ তার হাতে দিলো।
-- এই টাকাটাও কিন্তু ঋণ হয়ে গেলো।
-- হিসাব রেখে দাও। পরে একসময় সুদ আসলে নিয়ে নেবো।
ইতিমধ্যে ট্রেন এসে গেলে সুবর্ণা দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। দেবেশও তার পিছুপিছু ছুটে গিয়ে ট্রেনের জানালার কাছে দাঁড়ায়। দু'জন দু'জনকে হাত নাড়িয়ে টাটা করে। দু'জনের মনেই অদ্ভুত এক অনুভূতির অনুরণন খেলে যায়। দু'জনেরই মনেহয় এই প্রথম তাদের পরিচয় নয় যেন কত যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চেনে।
সেদিন বাড়ি ফিরতে সুবর্ণার অনেক রাত হয়ে যায়। মা একটু চেঁচামেচি করলেও তার বাবা জানতেন কোন রকম বিপদআপদ না ঘটলে সুবর্ণা ঠিক সময় মত ফিরে আসবে। যদিও সে বাড়িতে বলেই গেছিলো ফিরতে রাত হবে। মেয়ে না ফেরা পর্যন্ত তিনি বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একদম স্টেশন লাগোয়া বাড়ি তাদের। তাই শেষ ট্রেনে আসলেও ঘরে পৌঁছাতে কোন রকম বেগ পেতে হয় না।
মা না খেয়েই বসে ছিলেন এবং মা যে এটা করবেন হাজার বারণ সত্বেও তিনি শুনবেন না এটা সুবর্ণা বেশ ভালোভাবেই জানতো। তাই ঘরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে খেতে চলে আসে। মেঝেতে আসন পেতে খাবার গুছিয়ে মুখ গোমড়া করে মা বসে ছিলেন। মা রেগে থাকলে তার মুখ দেখেই সুবর্ণা বুঝে ফেলতো। তাই খেতে খেতে খাবারের খুব প্রশংসা করতে লাগলো যাতে মায়ের রাগটা একটু কমাতে পারে।
--- ছোলা আর নারকেল দিয়ে কচুশাকটা ভীষণ ভালো হয়েছে মা। বাজার থেকে আনলে কচুশাক?
মা গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন,
-- না, স্কুল মাঠের পিছন দিকটা অনেক কচুগাছ হয়েছে সেদিন বাজার থেকে আসতে গিয়ে দেখলাম। আজ রান্নার কিছু ছিলো না তাই তুই বেরোনোর পর গিয়ে কেটে এনেছি।
-- দারুন হয়েছে খেতে মা
এইভাবে গল্প করতে করতে মায়ের রাগটা কোথায় যেন উবে যায়।
পরদিন ছিলো কলেজ বন্ধ। রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত সে দেবেশের কথা ভেবে গেছে। আজ যদি ছেলেটি না থাকতো সত্যিই সে আজ খুব বিপদে পড়তো। ওই ভিড়ের মধ্যে বেরোতে গেলে সত্যিই সেদিন খুব কষ্ট হত। অযাচিতভাবে দেবেশ এসে কথাগুলো না বললে সে ওই ভিরেই ধাক্কাধাক্কি করেই বেরোত। অনেক রাতে শিয়ালদহ এসে ট্রেনে উঠতে গেলেও কিছু বিপদ হতেই পারতো। হয়ত ঈশ্বর স্বয়ংই চাননি সে কোন বিপদে পড়ুক। তিনি তো নিজে এসে মানুষের উপকার করতে পারেন না তাই হয়ত দেবেশের মধ্য দিয়েই তার উপকার করেছেন।
কিন্তু প্রথম দেখাতেই দেবেশকে এত কাছের কেন মনে হচ্ছে ওর। মনেহয় যেন কত যুগ ধরে ওকে চেনে। রাস্তাঘাটে কত মানুষের সাথেই তো দেখা হয় কথা হয় কই কারো ক্ষেত্রে তো কখনোই এরূপ মনে হয়নি। তবে কি ---?
এদিকে সেদিন দেবেশের বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়। সে শিয়ালদহ থেকেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি যায়। ডিনারটা সকলে একসাথেই করে। খাবার টেবিলেই তিনজনের যত আলোচনা। এতো রাত করে দেবেশ মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসে। তার কারণও অবশ্য আছে। পথেঘাটে কেউ কোন বিপদে পড়লে দেবেশ পাশ কাটিয়ে কোনদিনও আসতে পারে না। আর এটা বাবা, মা ভালোভাবে জানেন বলেই হাত খরচের টাকাটা তার হাতে দু'জনেই একটু বেশি দেন সব সময়। কারণ মানুষের উপকার করতে গেলে খালি পকেটে সে কাজ করা যায় না। তাই দেবেশের রাত করে ফেরার কোন কৈফিয়ত তারা কোনদিনই চাননি। বরং খাবার খেতে খেতে বিদিশা এবং স্বরূপ দু'জনেই বেশ আগ্রহ সহকারে সেই গল্প শোনেন। দেবেশ খাবার টেবিলে আসার সাথে সাথে বিদিশা একটু মজা করে বললেন,
-- পুত্র, আজ কোন রাজকার্য করে আসলে?
দেবেশও কম যায় না। সেও মায়ের কথার উত্তর তার মায়ের মতোই করে দিল,
-- মাতা, আজ একজন নারীর বিপদে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।
তারপর তিনজনেই হেসে উঠলো। খেতে খেতে সমস্ত ঘটনা দেবেশ তার মা, বাবাকে বললো। শুধু লুকিয়ে গেলো প্রথম দিনেই মেয়েটিকে তার খুব ভালো লেগে গেছে এই কথাটা। দু'জনেই দেবেশের সাথে খুব ফ্রী। তাই স্বরূপ বললেন,
-- সে তুমি যেভাবে পারো বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াও। কিন্তু মেয়েটিকে দেখতে কেমন? বয়স কত? মানাবে তো তোমার সাথে?
চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এরূপ কিছু ঘটলে তো তোমাদের বলতেই হবে। আজ শুধু তো পাশেই দাঁড়ালাম।
মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মা মিটিমিটি হাসছেন। প্রায় প্রতিদিন খাবার টেবিলে এইরূপ হাসি,ঠাট্টার মধ্যেই খাওয়া শেষ হয়। মাঝে মধ্যে বিলাসী এসে ফোড়ন কাটে। কিন্তু আজ সে টেবিলে খাবার গুছিয়ে শুয়ে পড়েছে কারণ তার শরীরটা ভালো নেই।
ক্রমশ -