Thursday, March 28, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার ( পঞ্চম পর্ব)

   কলেজ ফেষ্ট। স্বভাবতই সকলে খুব সেজেগুজে এসেছে। শ্যামলা গায়ের রং হলেও সুবর্ণার চোখ,মুখ খুব সার্ফ। হলুদ তাঁতের শাড়ি আর সাথে লাল ব্লাউজে তাকে খুব সুন্দর লাগছিল সেদিন।নামকরা শিল্পীর আগমনের ফলে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও কিছু বাইরের লোক, কিছু গার্জিয়ানের উপস্থিতিতে কলেজ ক্যাম্পাস ভিড়ে থিকথিকে হয়ে আছে। কেউই জায়গা ছেড়ে উঠতে পারছে না। আর ধাক্কাধাক্কি তো চলছেই। অনুষ্ঠান শেষ হতে রাত সাড়ে ন'টা। অনুষ্ঠান শেষে সুবর্ণা উঠতে গিয়ে ভিড়ের চাপে ঘেমেনেয়ে একসার। জায়গা থেকে নড়তেই পারছে না। হঠাৎ একটি ছেলে এসে তাকে বললো,
-- এই রোয়ের ভিতরে গিয়ে কোন একটা চেয়ারে বসে থাকো। দেখছো না অনেকেই বসে রয়েছে। এই ভিড়ের মধ্যে বেরোতে গেলে চাপেই দম বন্ধ হয়ে যাবে।
  মুখ তুলে ছেলেটির কথা শুনে বাধ্য মেয়ের মতোই সুবর্ণা একটা চেয়ার দখল করে বসে থাকে। কিন্তু তার মাথায় চিন্তা ঢুকে আছে এত রাত হয়েছে শিয়ালদহ গিয়ে যদি ট্রেন না পায় তাহলে বাড়ি পৌঁছাবে কিভাবে?
প্রায় মিনিট দশেক এভাবে বসে থেকে ভির কমলে সে উঠে দাঁড়ায়। এদিক - ওদিক তাকিয়ে ছেলেটিকে খোঁজে কিন্তু কোথাও দেখতে পায় না। বেশ জোড়ে পা চালিয়ে কলেজ গেটের কাছে এসে দেখে সেই ছেলেটি বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে। সুবর্ণার এই মুহূর্তে কেন যেন মনে হল ছেলেটি তাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে। দ্রুত হেঁটে সে ছেলেটির কাছে আসলো। ইতস্তত করতে করতে বলেই বসলো,
-- আমার মনেহচ্ছে এখন গিয়ে আমি ট্রেন পাবো না। অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি কি আমায় কোন সাহায্য করতে পারবে?
 আচমকা একটি মেয়ের কাছ থেকে এ কথা শুনে ওই ছেলেটি অর্থাৎ দেবেশ কিছুটা হকচকিয়ে গেলো। তারপর গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বললো,
-- কী সাহায্য চাও বলো।
-- আসলে এখন যদি আমি বাসে উঠি তাহলে শিয়ালদহ পৌঁছাতে আমার দেরি হয়ে যাবে। তাই ভাবছি ট্যাক্সি করে যাবো। কিন্তু এত রাতে একা ট্যাক্সিতে যেতে ভীষণ ভয় করছে। আমার সাথে শিয়ালদহ পর্যন্ত যদি তুমি ট্যাক্সিতে যেতে আমি ট্রেনটা পেয়ে যেতাম। যদিও জানি তোমার বাড়ি পৌঁছাতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। যদি আপত্তি না থাকে --
  নাম না জানা একটি অপরিচিত মেয়ে একই কলেজে পড়ে তাই কোনোকিছু না ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে দেবেশ একটা ট্যাক্সি ডেকে সুবর্ণাকে নিয়ে উঠে পড়লো। কারণ আজ পর্যন্ত সাহায্য চেয়ে ফিরে গেছে দেবেশের কাছ থেকে কেউ এটা ঘটেনি। দু'জনেই  পিছনের সিটে দু'টি জানালার পাশে, দু'জনেরই  চোখ বাইরের দিকে কিন্তু কারো মুখেই কোন কথা নেই।
  ট্যাক্সি শিয়ালদহ আসলে দেবেশ ভাড়া মিটাতে গেলে সুবর্ণা বাধা দেয়।সে ব্যাগ খুলে টাকাটা বের করতে গেলে দেবেশ তাকে বলে,
-- একই কলেজে পড়ি তো। অন্যভাবে টাকাটা কোন এক সময় শোধ দিয়ে দিও। তুমি এগোতে লাগো আমি টিকিট কেটেই আসছি। কোথাকার টিকিট কাটবো?
-- আরে না। তোমাকে আর আসতে হবে না। এতেই আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে।
-- সেতো পরের কথা। আপাতত তোমার নামটা বলো। আমি দেবেশ।
--- সুবর্ণা। বাংলা নিয়ে পড়ছি
--- আমার ইংলিশ।
 কথা বলতে বলতে ওরা কাউন্টারের কাছে চলে আসলো। সুবর্ণার কথামত নির্দিষ্ট জায়গার টিকিট কেটে দেবেশ তার হাতে দিলো।
-- এই টাকাটাও কিন্তু ঋণ হয়ে গেলো।
-- হিসাব রেখে দাও। পরে একসময় সুদ আসলে নিয়ে নেবো।
 ইতিমধ্যে ট্রেন এসে গেলে সুবর্ণা দৌড়ে গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়ে। দেবেশও তার পিছুপিছু ছুটে গিয়ে ট্রেনের জানালার কাছে দাঁড়ায়। দু'জন দু'জনকে হাত নাড়িয়ে টাটা করে। দু'জনের মনেই অদ্ভুত এক অনুভূতির অনুরণন খেলে যায়। দু'জনেরই মনেহয় এই প্রথম তাদের পরিচয় নয় যেন কত যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চেনে।
 সেদিন বাড়ি ফিরতে সুবর্ণার অনেক রাত হয়ে যায়। মা একটু চেঁচামেচি করলেও তার বাবা জানতেন কোন রকম বিপদআপদ না ঘটলে  সুবর্ণা ঠিক সময় মত ফিরে আসবে। যদিও সে বাড়িতে বলেই গেছিলো ফিরতে রাত হবে। মেয়ে না ফেরা পর্যন্ত তিনি বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একদম স্টেশন লাগোয়া বাড়ি তাদের। তাই শেষ ট্রেনে আসলেও ঘরে পৌঁছাতে কোন রকম বেগ পেতে হয় না।
  মা না খেয়েই বসে ছিলেন এবং মা যে এটা করবেন হাজার বারণ সত্বেও তিনি শুনবেন না এটা সুবর্ণা বেশ ভালোভাবেই জানতো। তাই ঘরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে রান্নাঘরে খেতে চলে আসে। মেঝেতে আসন পেতে খাবার গুছিয়ে মুখ গোমড়া করে মা বসে ছিলেন। মা রেগে থাকলে তার মুখ দেখেই সুবর্ণা বুঝে ফেলতো। তাই খেতে খেতে খাবারের খুব প্রশংসা করতে লাগলো যাতে মায়ের রাগটা একটু কমাতে পারে।
--- ছোলা আর নারকেল দিয়ে কচুশাকটা ভীষণ ভালো হয়েছে মা। বাজার থেকে আনলে কচুশাক?
 মা গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন,
-- না, স্কুল মাঠের পিছন দিকটা অনেক কচুগাছ হয়েছে সেদিন বাজার থেকে আসতে গিয়ে দেখলাম। আজ রান্নার কিছু ছিলো না তাই তুই বেরোনোর পর গিয়ে কেটে এনেছি।
-- দারুন হয়েছে খেতে মা
 এইভাবে গল্প করতে করতে মায়ের রাগটা কোথায় যেন উবে যায়।

 পরদিন ছিলো কলেজ বন্ধ। রাতে ঘুমানোর আগে পর্যন্ত সে দেবেশের কথা ভেবে গেছে। আজ যদি ছেলেটি না থাকতো সত্যিই সে আজ খুব বিপদে পড়তো। ওই ভিড়ের মধ্যে বেরোতে গেলে সত্যিই সেদিন খুব কষ্ট হত। অযাচিতভাবে দেবেশ এসে কথাগুলো না বললে সে ওই ভিরেই ধাক্কাধাক্কি করেই বেরোত। অনেক রাতে শিয়ালদহ এসে ট্রেনে উঠতে গেলেও কিছু বিপদ হতেই পারতো। হয়ত ঈশ্বর স্বয়ংই চাননি সে কোন বিপদে পড়ুক। তিনি তো নিজে এসে মানুষের উপকার করতে পারেন না তাই হয়ত দেবেশের মধ্য দিয়েই তার উপকার করেছেন। 
 কিন্তু প্রথম দেখাতেই দেবেশকে এত কাছের কেন মনে হচ্ছে ওর। মনেহয় যেন কত যুগ ধরে ওকে চেনে। রাস্তাঘাটে কত মানুষের সাথেই তো দেখা হয় কথা হয় কই কারো ক্ষেত্রে তো কখনোই এরূপ মনে হয়নি। তবে কি ---?
  এদিকে সেদিন দেবেশের বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়। সে শিয়ালদহ থেকেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি যায়। ডিনারটা সকলে একসাথেই করে। খাবার টেবিলেই তিনজনের যত আলোচনা। এতো রাত করে দেবেশ মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসে। তার কারণও অবশ্য আছে। পথেঘাটে কেউ কোন বিপদে পড়লে দেবেশ পাশ কাটিয়ে কোনদিনও আসতে পারে না। আর এটা বাবা, মা ভালোভাবে জানেন বলেই হাত খরচের টাকাটা তার হাতে দু'জনেই একটু বেশি দেন সব সময়। কারণ মানুষের উপকার করতে গেলে খালি পকেটে সে কাজ করা যায় না। তাই দেবেশের রাত করে ফেরার কোন কৈফিয়ত তারা কোনদিনই চাননি। বরং খাবার খেতে খেতে বিদিশা এবং স্বরূপ দু'জনেই বেশ আগ্রহ সহকারে সেই গল্প শোনেন। দেবেশ খাবার টেবিলে আসার সাথে সাথে বিদিশা একটু মজা করে বললেন,
-- পুত্র, আজ কোন রাজকার্য করে আসলে?
 দেবেশও কম যায় না। সেও মায়ের কথার উত্তর তার মায়ের মতোই করে দিল,
-- মাতা, আজ একজন নারীর বিপদে তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম।
 তারপর তিনজনেই হেসে উঠলো। খেতে খেতে সমস্ত ঘটনা দেবেশ তার মা, বাবাকে বললো। শুধু লুকিয়ে গেলো প্রথম দিনেই মেয়েটিকে তার খুব ভালো লেগে গেছে এই কথাটা। দু'জনেই দেবেশের সাথে খুব ফ্রী। তাই স্বরূপ বললেন,
-- সে তুমি যেভাবে পারো বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াও। কিন্তু মেয়েটিকে দেখতে কেমন? বয়স কত? মানাবে তো তোমার সাথে?
 চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
-- এরূপ কিছু ঘটলে তো তোমাদের বলতেই হবে। আজ শুধু তো পাশেই দাঁড়ালাম।
 মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মা মিটিমিটি হাসছেন। প্রায় প্রতিদিন খাবার টেবিলে এইরূপ হাসি,ঠাট্টার মধ্যেই খাওয়া শেষ হয়। মাঝে মধ্যে বিলাসী এসে ফোড়ন কাটে। কিন্তু আজ সে টেবিলে খাবার গুছিয়ে শুয়ে পড়েছে কারণ তার শরীরটা ভালো নেই।

ক্রমশ -

Monday, March 25, 2024

ভালোবাসি বলেছি অনেকবার (৪র্থ পর্ব)

সুবর্ণা বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সে কী করবে? কিভাবে দেবেশের মুখোমুখি হবে? সবই তো ঠিক চলছিল তবে এতগুলো বছর বাদে আবার কেন ও সামনে আসলো? ঈশ্বর কী চান? জীবনে প্রথম ভালোবাসার ঘটনা মানুষ কোনদিনও ভুলতে পারে না। সময় তার উপর একটা প্রলেপ ফেলে দেয় মাত্র। সুবর্ণার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। দেবেশকে ফিরিয়ে দিতে সেদিন সুবর্ণার বুক ফেটে গেলেও সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা তার মনকে করেছিল পাথর। আপ্রাণ চেষ্টা করে চোখের জল সংবরণ করে মুখে কঠোরতা এনে জানিয়েছিল,
-- বাবা,মায়ের অমতে আমি তোমাকে কোনদিনও মেনে নিতে পারবো না। আর তাছাড়া বিয়ে আমার ঠিক হয়ে গেছে। টুকটুক করে বাবা সবকিছুর আয়োজনও করে ফেলেছেন। তাই তোমাকে বিয়ে করা আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়।
-- তাহলে এতদিনের মেলামেশা? সবটাই অভিনয়? নাকি শুধুমাত্র সময় কাটানো?
-- তোমার যা ইচ্ছে ধরে নিতে পারো। 
 কথা শেষ করে সুবর্ণা বাড়ির রাস্তা ধরে। দেবেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দৌড়ে সুবর্ণার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
-- তোমার এই আচরণ আমাকে নারী জাতিকে চিনতে খুব সাহায্য করলো। এতকাল শুধু শুনে এসেছি নারী ছলনাময়ী। আজ সত্যিই তার প্রমাণ পেলাম। এজন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। 
 দেবেশ নিজেই সরে দাঁড়ালো সুবর্ণাকে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে দিয়ে। এরপর সুবর্ণার সাথে দেবেশের আর দেখা হয়নি। উভয়েই দেখা করার কোনরকম চেষ্টাও করিনি।
 দেবেশ মায়ের কাছে অনেকক্ষণ বসে ছিল মেয়েটির সাথে দেখা করবে বলে। কিন্তু এতক্ষণ বসে থেকেও সে আসছে না দেখে মাকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সুবর্ণা দরজার বাইরে একটা থামের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। দেবেশ চলে যায়। সুবর্ণা মনেমনে ভাবে ক'ঘন্টা কিংবা ক'টা দিন সে দেবেশের কাছ থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখবে?
 সে ঘরে ঢুকে বিদিশার পাশে গিয়ে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আর ভাবতে থাকে ভদ্রমহিলার কতই বা আর বয়স হবে। হয়ত মায়ের বয়সী কিংবা মায়ের থেকে দু'চার বছরের বড় হবেন। কিন্তু কোনদিনও মায়ের কাছে বসে মাথায়, গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি একমাত্র অসুস্থ্য হলে ছাড়া। সব সময় পড়াশুনা আর তার ফাঁকে ফাঁকে মাকে সংসারের কাজে যেটুকু পেরেছে সাহায্য করেছে। হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ হাতটা থেমে যাওয়ায় বিদিশা নিজের হাত দিয়ে সুবর্ণার হাতটা চেপে ধরে বললেন,
-- কী ভাবছো? মায়ের কথা মনে পড়ছে?
 সুবর্ণা একটু চমকে উঠলো। ভদ্রমহিলা কী করে বুঝলেন? কিন্তু মুখে হাসি এনে বললো,
-- না সেরকম কিছু না। আসলে আগে কখনো বাড়ি ছেড়ে কোথাও থাকিনি তাই ভাবছি --
-- কিচ্ছু ভাবতে হবে না। আমিও তো তোমার মায়ের মত। 
 তারপর হাতের ইশারায় একটি খাট দেখিয়ে বললেন,
-- রাতে তুমি ওই খাটটায় শুয়ে পড়বে। আমি শুয়ে পড়ার পর কেউ আর এঘরে রাতে আসে না। তার আগে এসেই বাবা,ছেলে দেখা করে যায়। 
 সুবর্ণা চুপচাপ বসে আছে কিন্তু মনের মধ্যে তার ঝড় বয়ে চলেছে। এখানে থাকতে গেলে তো দেবেশের সাথে তার দেখা হবেই। তার কাছে মিথ্যে কথা বলা আর শেষ পর্যন্ত এই আয়ার কাজ করতে আসার লজ্জা সে কোথায় লুকাবে? 
 বিদিশা একটু একটু করে সুবর্ণার কাছ থেকে তার পরিবার ও নিজ সম্পর্কে সব জেনে নিলেন।কিন্তু সুবর্ণা বিদিশার কাছে যা লুকিয়ে গেলো তা হল তার এডুকেশনাল কোয়ালিফিকেশন আর দেবেশের সাথে তার পূর্ব সম্পর্ক।
  দেবেশ কলেজে বেরোনোর সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মাকে ডেকে বলে যায় যে সে বেরোচ্ছে। ঠিক তার বাবাও স্বরূপবাবু ওই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীকে ডেকে বলে যান।
 দুপুরবেলা বিলাসী এসে বিদিশার খাবার দিয়ে যায়। বিলাসী ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় মেয়েটি ঘরের চেহারায় পাল্টে দিয়েছে। বৌদির মুখেও বেশ প্রসন্নতার হাসি। বিলাসী মনেমনে খুব খুশি হয় সুবর্ণার কাজে। সুবর্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,
-- হ্যাগো মেয়ে তোমার নাম কী? কী বলে তোমায় ডাকবো আমি? তুমি আমায় পিসি বোলো। দেবু আমায় পিসি বলেই ডাকে। আমার দেবুর সাথে তোমার দেখা হয়েছে? ও কিন্তু খুব লাজুক ছেলে।
 বিদিশা মৃদু ধমক দিয়ে উঠলো বিলাসীকে। 
-- তুই চুপ কর বিলাসী। এখানে ও আমার দেখভাল করার জন্য এসেছে। তোর দেবুর গল্প শুনতে আসেনি। কথা একবার যদি শুরু করিস তা যে কোথায় থামাতে হয় আজও সেটা বুঝলি না। 
-- হ্যাঁ তুমি তো সারাজীবন আমার কথাই শুনে গেলে। বাপ,ছেলে সকাল হলেই বেরিয়ে পড়েন আর সারাটাদিন আমি মুখ বুজে সংসারের কাজ করে করে আমারও তো পেট ফুলে ওঠে। কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করে। তুমি তো ঘুমিয়ে আর গল্পের বই পড়েই সময় কাটিয়ে দাও। আমার কথা একবারও ভাবো কেউ?
-- আচ্ছা এখন থেকে ভাববো। তুই এখন যা আমার খিদে পেয়েছে।
 সুবর্ণা বিদিশাকে ধরে খাটের উপর বসিয়ে দিলো। তারপর চামচে করে খাইয়ে দিতে লাগলো। মাছের কাঁটা বাছার সময় বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে বললো,
-- হাত দিয়ে কাঁটা না বাছলে তো কাঁটা থেকে যাবে মা
 বিদিশা সুবর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে তার মাথায় একটা হাত দিয়ে বললেন,
-- এই যে মা বলে ডাকলি এতেই তো তুই আমার মেয়ে হয়ে গেলি। আজ আমাকে তুই নিজেই মাছ বেছে খাইয়ে দে, কাল থেকে আমি নিজের হাতেই খাবো। ওরে আমি কি হাতে খেতে পারি না? নিশ্চয়ই পারি। কিন্তু কী জানিস? এই যে মেয়েগুলো আসে কেউ একটু ভালোবাসা,দরদ নিয়ে কথা বলতে জানে না। সব যেন প্রফেশনাল। আমার একটুও ভালো লাগে না। তুই কত সহজে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই আমায় আপন করে নিলি। 
 সুবর্ণা বিদিশার এই আবেগঘন কথা শুনে নিজেও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে দেখে বিদিশা হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,
-- কাঁদে না মা। তোকে দেখে প্রথমেই আমার মনে হয়েছে তুই ভালো পরিবারের মেয়ে। অভাবের তাড়নায় আয়ার কাজ করতে এসেছিস। মা বলে যখন দেখেছিস কোন অসুবিধা হবে না এখানে তোর। তোর বাবাকে বলে দেবো অন্যদের যে টাকা মাইনে দিতেন তার থেকে তোকে যেন বেশি টাকা দেন। এবার যা আমার তো খাওয়া হয়ে গেলো নিজে গিয়ে খেয়ে আয়। রান্নাঘরে চলে যা। বিলাসী তোর খাবার দিয়ে দেবে।
 বিশাল বাড়ির বেশ কয়েকটি ঘরের মধ্যে রান্নাঘরটি খুঁজে পেতে সুবর্ণাকে বেশ বেগ পেতে হল। রান্নাঘরে ঢোকার সাথে সাথেই বিলাসী তাকে বলে,
-- এই যে মেয়ে দেখো তোমার খাবার এখানে এই ছোট টেবিলে ঢাকা দেওয়া আছে। খেয়েদেয়ে বাসনগুলো সিনকে রেখে টেবিলটা মুছে ফেলো। এখন আমার একটু গড়াগড়ি দেওয়ার সময়। আমি চললুম। তুমি খেয়ে বৌদির ঘরে চলে যেও।
 বিলাসী বেরিয়ে যাওয়ার পর সুবর্ণা রান্নাঘরের চারিপাশে তাকিয়ে দেখে এত সুন্দর, এত বড় রান্নাঘরে চারিপাশে জিনিসপত্র ছড়ানোছিটানো। খিদেও পেয়েছিল খুব। আগে সে খেয়ে নিয়ে প্রথমে এটো বাসন যত পড়েছিল সেগুলি মেজে ফেলে যত্রতত্র জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। বাসন রাখার জায়গায় বাসনগুলিকে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে। হলুদ,নুন,তেল লাগানো কৌটোগুলো সার্ফজলে সুন্দর করে ধুয়ে পরিষ্কার করে।
এসব করতে করতে তার অনেকটাই সময় চলে যায়। এরপর যখন সে এসে বিদিশার ঘরে ঢোকে সে দেখতে পায় বিদিশা একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে বুকের উপর বইটি রেখে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বিদিশা আস্তে করে ঘরে ঢুকে বিদিশার বুকের উপর থেকে বইটি নিয়ে ভাঁজ করে টেবিলে রাখে। চশমাটা চোখ থেকে খুব সন্তর্পনে খুলে ভাঁজ করে বালিশের পাশেই রেখে দেয়। 
  ঘর থেকে আস্তে বেরিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ফিরে যায় সে তিন বছর আগের অতীতে। চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে দেবেশের সাথে পরিচয়ের প্রথম দিনের ঘটনা।

ক্রমশ -
    

Thursday, March 21, 2024

অজানা আশঙ্কা ( সহজ পাঠ)

অজানা আশঙ্কা

   বিয়ের ঠিক বছর দশেক আগে দার্জিলিং ট্যুরে আর্যের জীবনে এক সকালে একটি অঘটন ঘটে যায়। যে হোটেলে আর্য তার বন্ধুদের সাথে উঠেছিল সেই হোটেলে রোজ সকালে একটি পাহাড়িয়া মেয়ে এসে সমস্ত রুমে ঢুকে টেবিলে ফুল সাজিয়ে দিয়ে যেত। তিন বন্ধু এক হোটেলে উঠলেও যে যার মত সিঙ্গেল রুম নিয়েই থাকতো। মেয়েটি পাহাড়িয়া হলেও খুব সুন্দর দেখতে ছিলো। বনফুল খোঁপায় গুঁজে যখন সে অন্যান্য রুমের কাজ শেষ করে আর্যের রুমে ঢুকতো আর্য মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো। 
   মেয়েটি জানতো না আর্যরা কবে ফিরে যাবে। সপ্তম দিনের মাথায় সকালে ফুল নিয়ে এসে পরপর তিনটে ঘরে তালা দেওয়া দেখে ছুটে রিসেপশনে গিয়ে জানতে পারে গতকাল সন্ধ্যায় তারা কলকাতায় ফিরে গেছে। খুব অবাক হয় তবাসু বাঙ্গালীবাবুর এহেন আচরণে।
  কোনকিছুতেই জীবন থেমে থাকার নয়। জীবন সময়ের সাথে তাল মেলাতে না পারলেও ঠিক তার নিয়ম মেনেই এগিয়ে চলে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর্যর জীবন থেকে যেমন তবাসুর নামটা মুছে গেছে ঠিক তেমনই তবাসুর জীবন থেকেও বাঙ্গালীবাবুর কথা হারিয়ে গেছে। শুধু ন'বছরের সন্তান বিক্রমের মুখের দিকে তাকালেই সেদিনের ঘটনাগুলো তার ভীষণভাবে মনে পড়ে যায়। একটু উদাস হয়ে যায়, অজান্তেই চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিক্রমকে মানুষ করার তাগিদে কোমরে ওড়না জড়িয়ে আবার নেমে পড়ে কঠোর পরিশ্রমে।
 আর্য বিয়ে করেছে বছর সাতেক হল। এরমধ্যে সে তিন তিনবার দার্জিলিং ঘুরে গেছে। কিন্তু হোটেল মানবীতে সে ওঠেনি। দার্জিলিং আসলেই এক অজানা আশঙ্কায় তার বুকের ভিতর তোলপাড় করে ওঠে। এই সাত বছরে বহু চিকিৎসা করার পরেও তাদের কোন সন্তান হয় না। তার স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সন্তান ধারণের পক্ষে সহায়ক নয়।
 চতুর্থবার দার্জিলিং এসে মনের সাথে যুদ্ধ করে সে হোটেল মানবীতেই ওঠে। সারাটা রাত উৎকণ্ঠায় কাটে ভোরের আশায়। খুব ভোরে দরজার বেলের আওয়াজে দরজা খুলে সে তবাসুকে দেখতে পায়। ভূত দেখার মত চমকে ওঠে তবাসূ। কিন্তু কোন কথা না বলে তার কাজ সেরে সে বেরিয়ে যায়। আর্য আস্তে করে দরজা ভেজিয়ে লুকিয়ে ওর পিছন নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেখে পুরো তারই ছেলেবেলার মত দেখতে ন'বছরের একটি ছেলে স্কুল ড্রেস পরে উঠোনে বসে। লুকিয়ে দেখতে পায় মায়ের হাত ধরে সে পাহাড়িয়া রাস্তা ধরে হেঁটে স্কুলের পথে।
  ফিরে আসে আর্য হোটেলে। সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সাথে না নিয়েই তবাসুর বাড়ি পৌঁছে যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িতে মোবাইলের আলোতে আবিস্কার করে দরজায় তালা লাগানো। কিছুটা এগিয়ে একটি বাড়িতে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে বিক্রম স্কুল থেকে ফেরার পরেই এই ভাড়াবাড়ি ছেড়ে জিনিসপত্র নিয়ে হঠাৎ করেই তবাসু এই অঞ্চল ত্যাগ করেছে।

 শেষ