কারো গলগ্রহ হবো না
খিদের মুখে ভাত, ডালই অমৃত।
সারাটাদিন পথে পথে ঘুরে কোন কাজের সন্ধান না পেয়ে চলতি পথে একটা ছোট পার্কে ঢুকে চুপচাপ বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবছিলাম।সারাটা দিন পেটে জল ছাড়া কিছুই পড়েনি।
খিদে আর ক্লান্তিতে চোখটাও লেগে এসেছিলো।হঠাৎ একটা চিৎকারে কিছুটা সজাগ হয়ে তাকিয়ে দেখি চার,পাঁচটা ছেলে একটা তরুণীর উপর যেন হামলে পড়েছে।রাত তখন খুব একটা বেশি নয়।তবে জায়গাটা একটু নির্জন।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তখন দশটা।কলকাতা শহরে রাত দশটা মানে কিছুই নয়।বুঝতে পারলাম মেয়েটির সম্মান এবং জীবন দুইই বিপন্ন।বাড়িতে হয়ত তার বাবা,মা এবং অন্যান্যরা তারজন্য ভাবছে।তার ফেরার অপেক্ষা করছে।স্বল্প সময়ের মধ্যে এও ভাবলাম আমার জন্য ভাবার তো কেউ নেই।আমি মেয়েটিকে বাঁচাতে গেলে হয়ত ওরা আমায় মেরেই ফেলবে।অভুক্ত অবস্থায় শরীরে নেই বিন্দুমাত্র জোর।তাছাড়া সংখ্যায় ওরা অনেকজন।কিন্তু হঠাৎ করেই শারীরিক বলের কাছে যেন আমার মানসিক বলটা কয়েকশ গুন বেড়ে গেলো।ছুটে এগিয়ে গেলাম ওদের কাছে
জন্মের পর থেকেই অভাব,দুঃখ আর কষ্টের মধ্য দিয়ে আমার জীবন শুরু।মা আমার নাম রেখেছিলেন সৌমেন।আদর করে আমায় সমু বলে ডাকতেন।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি আমায় নিয়ে মা মামাবাড়িতে শুধুমাত্র মাথার উপর একটু ছাদের আশায় ঘরের কাজ আর রান্নাবান্নার বিনিময়ে থাকেন সারাদিনে বিন্দুমাত্র সময় পান না।সন্ধ্যায় সব কাজকর্ম আর রান্না সেরে সাতটার মধ্যে বেরিয়ে গিয়ে দুটো বাড়িতে রান্না করে রাত দশটার মধ্যে ফিরে আবার সকলকে খেতে দেওয়া, বাসন মেজে রাখা।এই দুটো বাড়িতে রান্না করেই মা আমায় মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন।তারপর আর পড়ার সুযোগ আমার হয়ে ওঠেনি।
বহুবার মাকে জিজ্ঞাসা করেও বাবার কথা জানতে পারিনি।তবে একটু বড় হতেই মামীর মাকে বিঁধিয়ে কথা বলার ধরণ দেখে বুঝতে পারতাম মা ও, আজ আমার সামনে যে মেয়েটি বিপদের মধ্যে পড়ে নরপশুদের হাত থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আমার জন্মটাও ঠিক একইভাবে।আমাকে মা মেরে ফেলতে পারেননি বা হয়ত নিজেও মরার সাহস দেখাতে পারেননি আমাকে পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্য যেদিন থেকে একথা বুঝতে পেরেছি সেদিন থেকেই মাকে আমার জন্মদাতার কথা বলে আর লজ্জায় ফেলতে চাইনি।হতে পারি আমি জারজ কিন্তু জন্ম তো আমায় মা একা দেয়নি। যে বা যারা একটা নারীর সম্মান নষ্ট করে শুধু আমার জন্মদাত্রীর গায়ে নয় আমার গায়েও কালি লেপ্টে দিয়েছে তার খবরে আমার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
সামান্য ক'টা টাকা রোজগার করার জন্য ফুটপাথের হোটেলগুলোতে বাসন মাজা থেকে শুরু করে কি না করেছি।কিন্তু মা কখনোই চাইতেন না আমি এইসব কাজ করি।কিন্তু সেই মুহূর্তে কোন উপায়ও ছিল না।মায়ের নিউমোনিয়া হল।ডাক্তার জলের কাজ একদম করতে নিষেধ করলেন।রান্নার বাড়ি দু'টো ছেড়ে দিতে হল।ওই শরীরে মা আমার গুছিয়ে দেওয়া সবকিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করতে গিয়ে একদিন মাথা ঘুরে পড়ে যান।তারপর হাসপাতাল থেকে আর বাড়ি আসেননি।মুখ বন্ধ করে মায়ের কাজের পূর্ব পর্যন্ত মামীর সকল গঞ্জনা সহ্য করে কালীঘাটে নমনম করে মায়ের কাজ করে আর ওবাড়ির মুখো হইনি।
লোকগুলো মেয়েটির জামা ছিঁড়ে ফেলেছে ততক্ষনে; মুখটা তারই ওড়না দিয়ে বাঁধা। ওদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা মোটা লাঠি পেয়ে গেছিলাম ভাগ্যক্রমে।লাঠিটা নিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলাম ওদের।ওরা তখন মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।অসুরের মত তখন যেন আমার গায়ে শক্তি।মেয়েটি ওই অবস্থায় পার্কের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে চিৎকার চেঁচামেচি করে লোক জড়ো করলো।
নিজের গায়ের জীর্ণ জামাটা খুলে ওর হাতে দিয়ে বললাম,
-- পরে নাও। চলো তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
শরীরের নানান জায়গায় আমার কেটে গেছে তখন, ব্যথায় টনটন করছে।হঠাৎ করেই খিদেটা তখন আবার চাগার দিয়ে উঠলো।ওই অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেয়েটির সাথে ওর বাড়িতে গেলাম।
বাড়ির সকলে ঘটনার আদ্যপান্ত বিবরণ শুনে এবং সকাল থেকে আমি না খাওয়া জেনে আমাকে ভাত ও ডাল দিয়ে খেতে দিলেন।কারণ মেয়েটির বাড়ির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয় তা তাদের বাড়ি,ঘর দেখেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম।খিদের মুখে ওই ডাল, ভাতই ছিল আমার কাছে অমৃত।সেদিন রাতটা ওখানেই কাটিয়ে পরদিন কেউ ওঠার আগেই সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ি এই আশায় -একটা তো মাত্র পেট ও ঠিক চলে যাবে কিন্তু কারো বাড়িতে অন্য কারো গলগ্রহ হয়ে কিছুতেই থাকবো না।