Tuesday, July 13, 2021

সুখের ঘরে আগুন (৪১)

সুখের ঘরে আগুন (৪১  পর্ব)

   অম্বিকার গায়ে হলুদের তত্ব নিয়ে যখন রিতেশ, প্রমিতা,তার ছোট্ট ছেলে,নিখিলেশ বেরোচ্ছে তখন সেখানে অচলাকে দেখতে না পেয়ে নিলয় চিৎকার করে অচলাকে বলল,
--- তুইতো আজ ছমাস ধরে লাফাচ্ছিস গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে যাবি বলে, তা এখন বেরোচ্ছিস না কেন?
 অচলা যাবেই ঠিক করেছিলো কিন্তু নিখিলেশ যাচ্ছে দেখে সে যাওয়ার জন্য আর রেডি হয়নি।কিন্তু সেটা তার দাদাকে বুঝতে না দিয়ে মুখে হাসি এনে বললো,
--- যাবোই তো ভেবেছিলাম দাদা।কিন্তু আমি এখন বেরিয়ে গেলে মা একা হাতে সবকিছু সামলাতে পারবেন না।তাই আর যাচ্ছি না।
--- এখন কোন কাজ নেই।যা ভিতরে গিয়ে রেডি হয়ে আয়।
 মলিনাদেবী কাছেই ছিলেন।তিনিও বললেন,
--- এখন তো আমার কোন কাজ নেই।সবই তো লোকে করবে।আমাকে একেবারে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে দেবে এই মেয়েটা।এর ভালোবাসার অত্যাচারে আমি আমার হাত,পা নাড়াতেও ভুলে যাবো কটাদিন পর।
--- না মা,আমি যাবো না।
 নিলয় চেঁচিয়ে বললো,
--- না তোকে যেতেই হবে।তুই না গেলে ও বাড়িতে তত্বটাই যাবে না।
--- এটা কিন্তু তোমার অত্যাচার দাদা।
 সে যাই হোক।তোকে যেতেই হবে।
 অচলা অনিচ্ছা সত্বেও রেডি হয়ে এলো।প্রমিতার ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ওদের পিছুপিছু এগিয়ে গেলো।নিখিলেশ অচলা কপালে আঘাত পাওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারছিল অচলা তাকে এড়িয়ে চলতে চাইছে।বেশ কয়েকবার সে অচলার দিকে আড় চোখে তাকাতে গিয়ে তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেছে।দুজনেই যে যার মত চোখ নামিয়ে নিয়েছে।
 সামান্যই পথ।মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ওদের গাড়ি এসে অম্বিকাদের বাড়ির সামনে পৌঁছাল।অমলবাবু গেটের কাছেই অপেক্ষা করছিলেন।যথাযথ আপ্যায়ন সহকারে ওদের নিয়ে বসানো হল।অচলা ঘরে ঢুকেই প্রমিতার ছেলেকে তার মায়ের কোলে দিয়ে সোজা চলে গেলো অম্বিকার কাছে।তার কাছে বসতে বসতে বললো,
--- আর তোমায় তো দিদি বলা যাবে না।এবার থেকে তোমায় বৌদি বলতে হবে।কি দারুন লাগছে তোমায় দেখতে গো।
 তার কাছে বসে থাকা সকলের কোন বাঁচিয়ে আস্তে আস্তে অম্বিকা বললো,
--- তোর দাদা কি করছে রে!
 অচলা মুখটা অম্বিকার কানের কাছে নিয়ে হাসতে হাসতে বললো,
--- তুমি এখন যা করছো ---
--- মানে?
--- ওই তো তুমি দাদার কথা ভাবছো আর দাদা তোমার কথা ভাবছে।
 কথাটা বলেই হাসতে লাগলো।
 এরই মাঝে একজন প্রতিবেশী জানতে চাইলেন,
--- হ্যাঁরে অম্বিকা,মেয়েটি কে রে ?
--- আমার একমাত্র ননদ।
--- কিন্তু আমরা যে শুনেছিলাম নিলয় তার বাবা,মায়ের একমাত্র সন্তান।
ওদের কথার মাঝে প্রমিতা এসে ঘরে ঢোকে।আলোচনা কানে যেতেই সে বলে,
--- ও দাদার মাসতুত বোন।আমরা দুজনেই মাসতুত বোন।
 অচলা আর অম্বিকা দুজনেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।
  বাড়িতে ফেরার সময় অচলা প্রমিতাকে বলে,
--- মানুষের কত কৌতুহল দেখেছো দিদি।ভাগ্যিস তুমি এসে পড়েছিলে তা না হলে কি যে তাদের উত্তর দেবো বুঝতেই পারছিলাম না।
--- এগুলো অতি সাধারণ ব্যাপার রে।এসব নিয়ে মাথা ঘামাস না।পরীক্ষা কেমন হল বল।
--- মোটামুটি হয়েছে গো দিদি।আশাকরি ফাষ্ট ডিভিশন পেয়ে যাবো।
--- তাহলে তো বেশ দামী একটা স্মার্ট ফোন তোর বাঁধা।
--- নাগো দিদি আমি নিষেধ করে দিয়েছি দাদাকে।এখন বিয়েতে এত খরচ হচ্ছে আবার দামী ফোন?
--- আরে দাদাকে তুই চিনিস না।একবার যখন বলেছে তখন সে কিনেই ছাড়বে।
--- একটা কাজ করে দেবে দিদি?
--- হ্যাঁ বলেই দেখ না।
--- আমি না স্কুলে গিয়ে পড়তে চাই না। প্রাইভেটেই পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে চাই।আসলে এখন বয়সটা তো বেড়ে গেছে।লজ্জা করবে।আর তাছাড়া আমি স্কুলে চলে গেলে মায়ের পক্ষে সংসারের কাজ একা সামলানো খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে।তাই তুমি যদি দাদাকে একটু বুঝিয়ে বলতে ভালো হত।
--- ঠিক আছে।বিয়েটা মিটুক তারপর এক সময় বুঝিয়ে বলবো।তাড়াতাড়ি চল।আবার তো খেয়েদেয়ে,বিশ্রাম নিয়ে সাজুগুজু করে বেরোতে হবে।
  নিলয়কে নিয়ে রিতেশ আর কিছু বন্ধুবান্ধব আগেই বেরিয়ে গেলো।সন্ধ্যা লগ্নে বিয়ে।যেহেতু প্রায় একই পাড়ার মধ্যে বলতে গেলে বরযাত্রীরা সব হেঁটেই যাবে ঠিক করেছিল।একে একে সবাই বেরোতে লাগলো।অচলা সকলে বাড়ি ফিরে রাতে শোবে সেই ব্যবস্থা করতেই তখনো ব্যস্ত।তার মা তাকে তাড়া দিতে লাগলেন।সকলের শেষে যখন নিখিলেশ বেরোতে যাবে তাকে দেখতে পেয়ে মলিনাদেবী বললেন,
--- বাবা মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে যাও।পাগলীটা এখনো রেডি হয়নি।ওকে নিয়েই বেরোও। কথাটা অচলার কানে যেতেই সে বলে উঠলো,
--- না না আমি একাই চলে যেতে পারবো।এই এক্ষুনি বেরিয়ে যাবো মা।আপনি চলে যান।
--- বড্ড অবাধ্য হয়ে যাচ্ছিস অচলা।আমি যেটা বললাম সেটাই হবে।একা একা তোকে এখন আমি যেতে দেবো না।তুই রেডি হয়ে নিখিলের সাথেই যাবি।
  অচলা মায়ের রাগান্বিত আওয়াজ শুনে আর কোন কথা না বলে রেডি হয়ে নিখিলেশের সাথেই রওনা দিলো জড়োসড়ো হয়ে।
পাশাপাশি দুজনে হাঁটছে।কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই।বেশ খানিকটা হাঁটার পর নিখিলেশই বলে,
--- সরি অচলা সেদিন আমার জন্যই তুমি ব্যথা পেয়েছিলে।
--- সেতো কবেই ব্যথা সেরে গেছে।তারজন্য এখন সরি বলছেন কেন?আর আমি তো খুব গরীব ঘরের মেয়ে।আমাদের ওসবে কিছুই যায় আসে না।
--- এক সময় গরীব ছিলে।কিন্তু এখন তো আর গরীব নও।
--- পুরনো কথা ভুলে গিয়ে নূতন অবস্থানকে নিয়ে মেতে থাকলে মানুষ অহংকারী হয়ে যায়।তাই আমি সব সময় পুরনোকে মনে করেই চলি।আমি কখনোই ভুলতে পারবো না আমি কি ছিলাম।
--- আমার সম্পর্কে তোমার কি ধারনা?
--- আপনি দাদার বন্ধু ।তার একজন প্রকৃত শুভাকাঙ্ক্ষী।
--- আর কিছু ?
--- না।আমি এ টুকুই আপনার সম্পর্কে জানি।আমি আদার ব্যাপারী,জাহাজের খবরের আমার কি দরকার?
 এড়িয়ে যায় অচলা কথাটা।তারা ততক্ষনে অম্বিকাদের বাড়ির দোরগোড়ায় এসে গেছিলো।তাই আলোচনা ওখানেই বন্ধ হয়ে যায়।
  অম্বিকার বাড়িতেই বিয়ে হচ্ছে।এরজন্য আলাদা করে কোন ঘরভাড়া অমলবাবু নেননি। গিন্নী অবশ্য অনেক চেঁচামেচি করেছেন।কিন্তু তিনি গো ধরে বসে আছেন তার মেয়েকে তিনি বাড়ি থেকেই বিয়ে দেবেন।বিশাল বড় ছাদ তার।আর তিনি পেয়েছেন তার বাড়ির পাশে একটা ফাঁকা জমি।মালিকের অনুমতি নিয়েই ওখানে বিশাল প্যান্ডেল করে খাওয়ানোর আয়োজন করা হয়েছে।আত্মীয়স্বজন ছাড়াও তার জীবনের সবথেকে এই বড় কাজটাটে তিনি পাড়ার লোকজনকে ভীষণভাবে পাশে পেয়েছেন।বরযাত্রী আর অতিথি আপ্যায়নে তিনি ও তার স্ত্রী ছাড়াও সকলেই যেন একে অপরের হয়ে উঠেছেন।অমলবাবু প্রতিটা বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে সকলকেই বলে এসেছিলেন "শুধু নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে নয় কাছের মানুষ হয়ে আমার মেয়ের বিয়েতে আমার পাশে থাকবেন।আমার তো ওই একটি মাত্র মেয়ে।এটাই আমার প্রথম ও শেষ কাজ।আমার এই কাজে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি যদি কিছু দেখেন নিজেরাই সেগুলো সমাধান করবেন।আমার কাছে জানতে চাওয়ার কোন দরকার সেই মুহূর্তে নেই।সিদ্ধান্ত আপনারা যা নেবেন আমি হাসি মুখে মেনে নেবো।"সুতরাং বিয়ে বাড়িতে কোথাও কোন সমস্যার সৃষ্টি হলেই সেখানে উপস্থিত হওয়া অভিজ্ঞ এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র দেরি করেননি।সকলেই মন খুলে বিয়েবাড়িতে আনন্দ করেছেন।বিয়েবাড়িতে খাবারদাবার এবং রান্নার প্রশংসাও করেছেন সকলে।নরেশবাবু তো ভীষণ খুশি অমলবাবুর এই বিশাল আয়োজন আর আপ্যায়ন পেয়ে।তিনি তার বন্ধুকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে তো বলেই ফেললেন, "শেষমেষ ছেলেমেয়ে দুটিকে এক করে দিয়ে আমরাও কিন্তু অনেক কাছাকাছি চলে এলাম।"
  শুভ দৃষ্টির সময় ছাদনা তলায় তিল ধারণের জায়গা নেই।সকলে মিলে অম্বিকাকে এতটাই উপরে তুললো বর বড় না বউ বড় দেখার জন্য অম্বিকা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।অচলা দেখতে পেয়ে জোরে বলে উঠলো,
--- বৌদি ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে তোমরা বৌদিকে নিচুতে নামাও।
 নিলয় তাকিয়ে দেখে সত্যিই তাই। সেও সকলকে অনুরোধ করে অম্বিকাকে নামিয়ে নিতে।নিলয়ের কথা শুনে বন্ধুরা যারা সেখানে ছিল সকলেই তার পিছনে লেগে হাসিঠাট্টা করতে থাকে তখন।
 কেউ বলে,"এখনই এত দরদ!"আবার কেউ বলে, " এখন না এ দরদ অনেক আগে থাকতেই।--।" হাসাহাসি চলতেই থাকে।

ক্রমশঃ 
    

No comments:

Post a Comment